অর্পিতা সরকার
রাহুলকে কল করে লগ্নজিতা জিজ্ঞাসা করল, ‘মন্টু বাড়ি ফিরেছে?’
রাহুলের গলার স্বরটা অস্বাভাবিক রকমের থমথম করছে। তাল কাটা গলায় বলল, ‘না ম্যাডাম, ফেরেনি। সন্ধে হয়ে গেল, এখনও ফেরেনি। ফোনটাও নিয়ে যায়নি। সাইকেল ছাড়া, ফোন ছাড়া ও বেরোয় না। টাকা-পয়সাও নিয়ে যায়নি। কিছুই বুঝতে পারছি না ম্যাডাম, মন্টু গেল কোথায়! আমার নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। পুলিশে খবর না দিলেই হত। চন্দ্রজা ভুল বুঝলো, মা জেদ ধরে আছে মৃন্ময়কাকুই খুনি, এদিকে মন্টু বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। ম্যাডাম প্লিজ ডু সামথিং।’
ফোনটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল লগ্নজিতা। ঠিক এটাই আন্দাজ করেছিল ও। মন্টুকে কেউ সরিয়ে দিয়েছে। কারণ সরলাদেবী নয়, মন্টু সম্ভবত জানতো খুনি কে। তাই যখনই লগ্নজিতা তদন্ত শুরু করল, সঙ্গে সঙ্গে মন্টুকে সরিয়ে দেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ল অপরাধীর। ব্রজমোহনবাবু মারা যাবার বেশ কয়েকদিন পরেও লগ্নজিতা বুঝতে পারল না, খুনের মোটিভ কী? কেন খুন করা হল ওনাকে। খুনের মোটিভ বুঝতে পারছে না বলেই বড্ড এলোমেলো ছুটতে হচ্ছে ওকে। সরলাদেবী কেন মৃন্ময়বাবুকে জেলে পাঠাতে চান সেটা স্পষ্ট এখন। কিন্তু সত্যিই কি মৃন্ময়বাবু খুন করেননি? নাকি সরলাদেবী ঠিকই বলছেন। দ্বন্দ্ব একটা থেকেই যাচ্ছে।
ফোনটা বাজছে লগ্নজিতার। ইউসুফ ফোন করছে। ইউসুফ ওর বিশ্বস্ত ইনফর্মার। বলতে গেলে লগ্নজিতার আবিষ্কার ইউসুফ। ট্যাংরার কাছে বসে এটিএম পিন হ্যাক করছিল, সেই অবস্থায় ওকে ধরেছিল লগ্নজিতা। কিন্তু প্রমাণ অভাবে জেল হয়নি ছেলেটার। তারপর থেকেই ইউসুফ লগ্নজিতার হয়ে কাজ করে। এতদিন অবধি যতগুলো কেসে লগ্নজিতা সাফল্য পেয়েছে, তাতে ইউসুফের অবদান অনস্বীকার্য। গতকালই এই বিষয়ে ইউসুফকে কাজে লাগিয়েছে ও। আজকেই ছেলেটার ফোন। নিশ্চয়ই কিছু খবর দেবে।
ফোন ধরতেই উত্তেজিত হয়ে ইউসুফ বলল, ‘ম্যাডাম ব্রজমোহনবাবু বোধহয় গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিলেন। কোনো একটা পুরোনো বই থেকে উদ্ধার করেছিলেন। ওনার মর্নিংওয়াকের দুই বন্ধু আজ পার্কে বসে নিরিবিলিতে আলোচনা করছিলেন।’
লগ্নজিতা বলল, ‘গুপ্তধন? কোথায়?’
ইউসুফ বলল,’ ভালো শুনতে পাইনি ম্যাডাম। শিবনাথ আর বাসুদেব ওদের নাম। বাড়ি ওই তল্লাটেই। খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।’
লগ্নজিতার কাছে কয়েকটা জিনিস পরিষ্কার নয়। মন্টু যদি খুনিকে দেখে থাকে তাহলে কেন তার নাম বলল না? রাহুল যদি মন্টুকে সরিয়ে থাকে তাহলে কেন রাহুল বাবার মৃত্যুর তদন্ত চাইল। সরলাদেবীর মানসিক সমস্যার কথা কেন চেপে গেল রাহুল? মৃন্ময়বাবু সেদিন অত ভোরে ঠিক কী কারণে ব্রজধামে গিয়েছিল? কারণটা ঠিক বলতে চাইলেন না মৃন্ময়বাবু। হিসেবগুলো মিলছে না। বড্ড এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে উত্তরগুলো।
এত ভোরে ওঠা বহুদিন অভ্যেস নেই লগ্নজিতার। রাত পর্যন্ত কাজ করে সকালে আটটার আগে ঘুম ভাঙে না ওর। ভোর পাঁচটায় মাঠে হাঁটতে এসে অবশ্য বুঝতে পারল, উত্তর কলকাতায় ভোর হয় সূর্য ওঠার একটু আগেই। সকলের না হলেও কিছু বয়স্ক মানুষের তো হয়ই। একটা বয়সের পর ঘুম কমে আসে শুনেছে। সেই কারণেই কি রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত বইপত্র ঘেঁটে ব্রজমোহন আবার ভোর চারটেতে উঠে পড়তেন? এদের দলটা বেশ সতেজ হয়েই মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লগ্নজিতার বরং ঘুম ঘুম ভাব। রাহুলের দেওয়া ছবি অনুযায়ী লম্বা শ্যামলা মতন একটু বেশি কথা বলা মানুষটিই শিবনাথ। ওর দিকেই টুকটুক করে এগিয়ে গেল লগ্নজিতা। হ্যালো বলে হাত বাড়াতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘নতুন নাকি পাড়ায়? আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না তো।’
লগ্নজিতা স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, নতুন। কিন্তু আপনাদের টিমটাকে দেখেছি দু-একবার। ব্রজমোহনবাবুও তো আপনার বন্ধু ছিলেন। কী একটা মিসহ্যাপ হল বলুন তো?’
শিবনাথ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, ‘কোথায় থাকেন? ‘রূপকথা’ কমপ্লেক্সে নাকি? এ চত্বরে বাড়ি হলে আমি চিনতাম। ওই একমাত্র গজিয়ে ওঠা কটা ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের চিনি না।’
লগ্নজিতা বলল, ‘হ্যাঁ, রূপকথাতেই থাকি। আপনাদের এক সঙ্গে ফিরতে দেখেছি। কদিন আগেই শুনলাম ব্রজমোহনবাবু খুন হয়েছেন।’
শিবনাথ বিরক্তির স্বরে বলল, ‘জানি না, এটা কেন রাহুলরা রটাতে চাইছে এটা খুন। আসলে খুন নয়, সুইসাইড। হঠাৎই আত্মহত্যাকে খুন নাম দিয়ে কি ওদের পারিবারিক অশান্তিটা ঢেকে ফেলতে পারবে? সরলার সঙ্গে ব্রজর তো প্রায়ই ঝামেলা হতো। এখন তো আবার মৃন্ময়ের মেয়ের সঙ্গে বিয়েকে কেন্দ্র করেও ঝামেলা হল। ব্রজ একা আর কত সামলাবে এই বয়েসে? আর পারলো না সহ্য করতে। নিজেকেই শেষ করে দিল। তবে সন্দেহ আমারও হয়েছে, ব্রজমোহন আত্মহত্যা করার লোক নয়। ওর মনে অসম্ভব জোর। ও হেরে গিয়ে পালিয়ে যাওয়ার লোক নয়। বলা যায় না, মা ছেলে-দুজনে মিলে ষড়যন্ত্র করে মেরে দিল নাকি। এখন সবার দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য বাইরের লোককে খুনি প্রমাণের চেষ্টা করছে।’
শিবনাথ চলে গেল নিজের ছন্দে।
লগ্নজিতা অমিতবাবুকে গিয়ে বেশ আন্তরিকতার ঢঙে বলল, ‘ভালো আছেন কাকু? অনেকদিন পরে দেখা।’
ভদ্রলোক যে ওকে চিনতে পারেননি সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবুও স্মৃতির হলদে পাতা উল্টে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ নিজের গুরুমস্তিষ্কের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে ব্যর্থ হয়ে বললেন, ‘তোমায় তো আমি ঠিক চিনতে পারলাম না।’
লগ্নজিতা বলল, ‘সেকি? আপনাকে যে সেদিন দেখলাম ব্রজআঙ্কেলের বাড়িতে। আপনি কথা বললেন, আমার সঙ্গে। ভুলে গেলেন?’
অমিতবাবু বললেন, ‘তা হবে হয়তো। আজকাল সব কথা মনেও থাকে না। আমার স্ত্রী বলে, বয়েসের ধর্ম। ব্রজমোহনের বাড়িতে দেখেছিলাম? নামটা শুনলেই কেমন যেন শূন্যতা এসে ধরে। মানুষটা যেন ম্যাজিকের মত ভ্যানিশ হয়ে গেল। এই আছে আর এই নেইয়ের মাঝে যেন কয়েকটি ঘণ্টার ব্যবধান।’
লগ্নজিতা বলল, ‘ওটাই তো আশ্চর্যের আঙ্কেল। ওরকম একটা সাধাসিধে মানুষকে খুন কে করল?’
অমিতবাবু বলল, ‘প্রথমে তো শুনেছিলাম আত্মহত্যা। পরে শুনছি নাকি কেউ খুন করেছে। আগেরদিন মর্নিংওয়াকে এসে মৃন্ময়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হল। তখনও বুঝিনি ওরকম কিছু হতে চলেছে। বরং ব্রজকে বেশ খুশি দেখেছিলাম। ওদের পূর্বপুরুষের কোন একটা নথি আবিষ্কার করেছে। সেখানে নাকি গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিল। এসব নিয়ে বেশ মেতে ছিল। এমনিতেও বইয়ের জগতের মানুষ ও। ওসব নিয়েই থাকত। প্রফেসরি জীবনেও খুব নাম কামিয়েছে। কলেজেও খুব সুনাম ছিল ওর। মিশুকে স্বভাবের ছিল। বাড়িতে সবাইকে ডেকে হইহুল্লোড় করতে পছন্দ করত। যদিও সরলাবৌদি আমাদের মোটেই দেখতে পারত না বলে ইদানীং আমরাও যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম। তবুও এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
লগ্নজিতা বলল, ‘মৃন্ময়বাবুর সঙ্গে তো খুবই বন্ধুত্ব ছিল। ঝগড়া হল কী নিয়ে?’
অমিত বললেন, ‘আসলে রাহুল, মানে ব্রজদার ছেলে আর মৃন্ময়ের মেয়ে চন্দ্রজার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। সেটা আবার মৃন্ময় আর সরলাদেবী দুজনেই চান না। ব্রজমোহন চাইছিলেন বিয়েটা দেবেন। মৃন্ময় ভাবছিল বিয়ের পরে সরলাদেবী কষ্ট দেবে মেয়েকে। তাই রাহুলকে ঘরজামাই রাখার প্রস্তাবেই জ্বলে ওঠে ব্রজদা। সেই থেকেই অশান্তির সূত্রপাত। কিন্তু ওই কারণে আত্নহত্যা করেছে ব্রজদা এটা আমাদের মানতে কষ্ট হচ্ছে। আবার খুন কে করল সেটাও ধোঁয়াশা।’
ওদের কথার মাঝেই বর্ণালী আর মধুমিতা এগিয়ে এসে বললেন, ‘খুনি তো পালিয়েছে। যাকে ব্রজদা নিজের ছেলের মতো ভালোবাসত, সেই খুন করে এখন পালিয়েছে। আরে অমিতদা, এ মন্টুর কাজ। গতকাল থেকে তাকে এ চত্বরে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ এসেছিল বাড়িতে। তখনই পালিয়েছে। আজকাল আর কাকে বিশ্বাস করা যায় বলুন দেখি! পথে পড়ে ছিল, না খেয়ে মরছিল, ব্রজদা এনে পরিবারে আশ্রয় দিল তাকেই খুন করে তুই পালালি? দুটো টাকার লোভ এমন! ওদের বাড়ির কাজের মেয়ে মীনাক্ষীই বলছিল—মন্টু নাকি সেদিন থেকে খুব শোক পেয়েছে ভাবভঙ্গি করে চুপ করে ছিল। সুযোগ বুঝে চম্পট দিল। বেচারি ব্রজদা। বৌয়ের কাছে অবহেলা পেলো, মেয়েটা অকালে গেল, ছেলেও তো মাকেই বেশি ভালোবাসে। মন্টুটাকে ভালোবাসত। সে একেবারে টাকার লোভে মানুষটাকে শেষ করে দিল?’
মধুমিতা বললেন, ‘শুনে থেকে আমার তো ভয় করছে গো। বাড়িতে বিশ্বাস করে কাউকে তো রাখাও যাবে না।’
লগ্নজিতা বেশ বুঝতে পারছে মন্টুকে কেউ একটা সরিয়ে দিয়েছে। তার উদ্দেশ্য এটাই ছিল। খুনি হিসাবে মন্টুর নামটা উঠে আসুক। মন্টু যদি খুনই করবে তাহলে এতদিন এই বাড়িতে বসে কী করছিল? পুলিশ তো এর আগেও বার চারেক গেছে ব্রজমোহনের বাড়িতে। তখন যদি ভয় না পেয়ে থাকে, তাহলে এখন কেন ভয়ে পালাবে? তৃষা তাহলে ব্রজমোহনের মেয়ে। হয়তো রাহুলের দিদি। ওর মৃত্যুর সঠিক কারণটা জানতে হবে ওকে।
লগ্নজিতার কথা বলা বাকি আছে বাসুদেববাবুর সঙ্গে। ওনার বক্তব্যটা শুনে নিলেই মোটামুটি ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
বাসুদেববাবুকে দেখে লগ্নজিতা বলল, ‘কাকু, আপনার রেয়ার কয়েনের ব্যবসাটা কেমন চলছে?’
বাসুদেববাবু সম্ভবত এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কারণ অ্যান্টিক কয়েনের ব্যবসার খবরটা এ পাড়ার বেশিরভাগ লোকেরই অজানা। এই চূড়ান্ত খবরটা ইউসুফ জোগাড় করেছে। ওনার কাছে এমন কিছু কয়েন আছে যেগুলো ভারত সরকার পেলে মিউজিয়ামে রাখবে। সেই কারণেই এই গোপনীয়তা। উনি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘মানে? আমি রিটায়ার্ড পার্সন। সারাজীবন রেলের কেরানিগিরি করে সংসার চালিয়েছি। এখন পেনশন সম্বল। বিজনেস করব কোথা থেকে?’
লগ্নজিতা নিজের পকেট থেকে একটা বুনোমোষের চিহ্নওয়ালা রূপোর কয়েন বের করে বলল, ‘দেখুন, এটার না আছে সাল, না তারিখ। আমার বাবা বলেছিল, এটা নাকি সিন্ধু সভ্যতার আমলের। আমি ভেবেছিলাম আপনি এসবের ব্যবসা করেন, হয়ত বলতে পারবেন।’
বাসুদেববাবুর দৃষ্টি তীক্ষ্ন হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে লগ্নজিতা বলল, ‘এনিওয়ে কাকু, আপনি যখন এসব চেনেন না তাহলে হয়তো আমি ভুল খবর পেয়েছিলাম।’
বাসুদেববাবু ফিসফিস করে বললেন, ‘ভুল খবর ঠিক নয়। আমার এ বিষয়টি নিয়ে ইন্টারেস্ট আছে ঠিকই, তবে বিশাল বিজনেস করার খবরটা কিন্তু সত্যি নয়। আমি দেখে বলে দিতে পারব এ কোন আমলের রৌপ্য মুদ্রা।’
লগ্নজিতা মুদ্রাটা হাতে দিতেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন, ‘না। এটা সিন্ধু সভ্যতার আমলের নয়। এটা তার পরের। শের শাহ শূরী তার পাঁচ বছরের শাসনকালে (১৫৪০-১৫৪৫) ১৭৮ রতি ওজনের রুপোর মুদ্রা রুপিয়া নামে প্রচলন করেছিলেন। মোগল তথা মারাঠাদের রাজত্বকালের সঙ্গে ইংরেজশাসিত ভারতে রুপোর মুদ্রা প্রচলিত ছিল। দেখে মনে হচ্ছে এটা সেই সময়ের। সালটা এত আবছা যে বোঝা যাচ্ছে না। মহিষের ছবি দেখে মনে হচ্ছে মোষটা লড়াইয়ে উদ্যত। তখন তো বদ্ধভূমিতে বাদশার চোখে অপরাধী ব্যক্তিকে বুনো মোষের সামনেই ফেলা হত। লড়াইয়ে মানুষটি কোনদিনই জিততে পারতো না, মৃত্যু অবধারিত। তাও দর্শকাসনে বসে দেশের লোকজন আনন্দ উপভোগ করত। মোষকে শক্তিশালী পশু বলে সম্মান করা হতো। কিন্তু এ মুদ্রার মূল্য তো অনেক। তুমি মিউজিয়ামে না জমা দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?’
লগ্নজিতা বলল, ‘এটা আমাদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি। আমি মিউজিয়ামের কেন দেব বলুন দেখি?’
বাসুদেববাবু এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, ‘ঠিকই তো বলেছো। কেন দেবে পূর্বপুরুষের জিনিস? আমিও ওটাই করি। যে একান্ত বিপদে পড়েছে, বংশের জিনিস রাখতে না পেরে বেচতে বেরিয়েছে, তখন তাদের টাকা দিয়ে সাহায্য করি।’
লগ্নজিতা বলল, ‘সে তো বটেই। স্বাভাবিকভাবেই তার জিনিসটা আপনার কাছে চলে আসে তাই না? ব্রজমোহন আঙ্কেলের কাছেও তো এমন কয়েন ছিল কয়েকটা। কিনতে চাননি আপনি?’
বাসুদেববাবু একটু সতর্ক হয়েই বললেন, ‘ব্রজমোহন নিজেই দেখিয়েছিল কয়েনগুলো। ওদের পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসাবে। জিজ্ঞাসা করেছিল, এর দাম কেমন হতে পারে! আমি বিচার করে বলেছিলাম মাত্র। ব্রজমোহনের আর্থিক সঙ্গতি এমন ছিল না যে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি বিক্রি করতে হবে। তাছাড়া ব্রজমোহনের পারিবারিক ইতিহাস বেশ অন্যরকম। সেই কলঙ্কিত ইতিহাস নিয়েও ব্রজমোহন গর্ব করত। পূর্বপুরুষের গল্প করাটা ছিল ব্রজমোহনের নেশা। শ্রোতা বিরক্ত হচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে ও বিন্দুমাত্র বিচলিত হত না। বরং শোনাতেই ব্যস্ত ছিল। আমাকেও ওর সঞ্চিত রেয়ার কয়েন বা স্ট্যাম্প দেখিয়েছিল। বহু পুরোনো সেসব কয়েন। আকবরের আমলের, শেরশাহের আমলের কয়েন ছিল ওর কাছে। এমনকি …’ কথাটা অর্ধ সমাপ্ত করেই আবারও কয়েনটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বাসুবাবু বললেন, ‘একটা সত্যি কথা বলুন তো ম্যাডাম…এ কয়েন আপনি কোথায় পেলেন? চুরি করেছেন ব্রজর বাড়ি থেকে? এ কয়েন আমি একমাত্র ব্রজর কাছেই দেখেছিলাম। নাকি ব্রজমোহন আপনাকে বেচে দিয়েছিল?’
লগ্নজিতা বুঝল, বাসুবাবুর স্মৃতি নেহাতই কম নয়। ঠিকই ধরেছেন। এটা ব্রজমোহনের সংগ্রহের কয়েন। রাহুলকে বলে একটা এনেছিল তদন্তের স্বার্থে।
লগ্নজিতা আলগোছে বলল, ‘ধরুন ওর বাড়িরই কেউ এটা আমায় উপহার দিয়েছে।’
বাসুদেববাবু কলার তোলার ভঙ্গিমায় বললেন, ‘ডাক্তার একমাসের মধ্যে ছানি অপারেশন করতে বলেছে ঠিকই, কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছি চোখের জ্যোতি আমার কমেনি একটুও। তা বেশ। রাহুলের চরিত্রটাও ব্রজমোহনের মতোই হয়েছে। মৃন্ময়ের মেয়ে চন্দ্রাকে ছেড়ে এখন আপনার পিছনে পড়েছে। বাবা গত হতে সময় লাগল না, তার সঞ্চিত জিনিস বিলাতে শুরু করল! এক মহিলায় মন ভরে না ছেলেরও। বেশ বেশ। তা বিলাচ্ছে নাকি বেচবেও? যদি বেচে তো আমাকেও জানাবেন ম্যাডাম। ন্যায্য মূল্য দিয়েই সংগ্রহ করব। ঠকানো আমার রক্তে নেই।’
লগ্নজিতা আলতো স্বরে বলল, ‘বেশ। রাহুলকে বলে দেখব। সম্পত্তিটা তো ওর বাবার। তাই সিদ্ধান্ত ওর। কিন্তু আপনি একটা কথা বলুন দেখি। ব্রজমোহনআঙ্কেল মারা যাবার আগেরদিন সন্ধেতে আপনি কেন গিয়েছিলেন ওই বাড়িতে? মীনাক্ষী বলল, চা-জলখাবার না খেয়েই রাগ করে ব্রজধাম ছেড়ে চলে এসেছিলেন। ঘরের মধ্যে নাকি একটু উচ্চস্বরে কথাও শোনা গিয়েছিল আপনার আর ব্রজমোহনবাবুর মধ্যে।’
বাসুদেববাবু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমি একজন অপরিচিতকে এত কথা বলছি কেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আর একটা কথারও উত্তর দেব না আপনাকে। যান এখান থেকে।’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘দেবেন, দেবেন। সব উত্তর দেবেন। ফরম্যাল ড্রেসে যখন থাকব, আপনার বাড়ির বৈঠকখানায় বসে সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন। কারণ আমার পরিচয়টা শুধুই ব্রজমোহন আঙ্কেলের পাড়াতুতো ভাইজি নয়।’
বাসুদেববাবু রেগে গিয়ে হনহন করে হাঁটা জুড়লেন। পিছন থেকে শিবনাথ ডাকলেন, ‘আরে বাসু, চললে কোথায়? বারবার বলি প্রাতঃকৃত্য করে হাঁটতে এসো, তাহলে চায়ের মজলিশটা জমে ভালো। এখন দৌড়ে পালাতে হচ্ছে।’ বর্ণালী আর মধুমিতা দুজনেই মুখ টিপে হাসছিল শিবনাথের রসিকতায়।
মধুমিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে লগ্নজিতা বলল, ‘এই বাসুদেববাবু কিন্তু বেশ অন্যরকম। অল্পতেই রেগে যান। আমি শুধু জিজ্ঞাসা করলাম,—আপনার সঙ্গে ব্রজমোহনবাবুর সম্পর্ক কেমন ছিল, তাতেই রেগে গেলেন।’
শিবনাথবাবু প্রজাপতি বিস্কিটে কামড় দিয়ে বললেন, ‘এই তো ভুল করলে দিদিমণি। বোলতার চাকে ঢিল ছুঁড়ে বলবে করলাম কী? আরে রাহুলের সঙ্গে বাসুর মেয়ে শিঞ্জিনীর বিয়ে দিতে চেয়েছিল বাসু। কিন্তু রাহুল আবার মৃন্ময়ের মেয়েকে ভালোবাসে। মৌচাক সিনেমার মতো বুঝলে কিনা। কে আগে রাজপুত্রকে জামাই করবে—তাই নিয়ে ঝামেলা। আসলে কাল হল ব্রজমোহনের সম্পত্তি। নাহলে রাহুলের মতো মাইনের চাকরি আজকাল অনেকেই করে।’
মধুমিতা বললেন, ‘যাই বলুন শিবনাথদা, সরলাবৌদির আবার শিঞ্জিনীকেই পছন্দ ছিল। বছরখানেক আগেও শিঞ্জিনী প্রায়ই যেত ব্রজধামে। তারপর বোধহয় চন্দ্রজা আর রাহুলের রিলেশনশিপটা জানাজানির পরে শিঞ্জিনীর যাওয়া বন্ধ হল। চন্দ্রজা আর শিঞ্জিনী দুজনেই আমার স্টুডেন্ট। চন্দ্রজা এক ইয়ার সিনিয়র শিঞ্জিনীর থেকে। বর্ণালীদিও নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, চন্দ্রজার মতো রুচিশীল মেয়ে এ চত্বরে কমই আছে। যেমন পড়াশোনায় ভালো ছিল, তেমনি আবৃত্তি, গান, নাটক। আরে, স্কুলের নাটকে ওর অভিনয় দেখে তো আমরাই কেঁদে ফেলেছিলাম। শিঞ্জিনী মিডিওকার মেয়ে। বাবার অবস্থা ভালো, তাই একটু অহংকারী গোছের। কিন্তু চন্দ্রজা ভীষণ ভদ্র। এখনও দেখা হলে ঠিক পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। মৃন্ময়দা কিন্তু মেয়েকে যথেষ্ট ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।’
লগ্নজিতা বুঝল এরা প্রত্যেকেই গল্প করতে বেশ ভালোবাসে। একটু খোঁচালেই অনেক কথা বেরিয়ে আসে। পুলিশের ড্রেসে আসার থেকে প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গী হওয়া ভালো।
শিবনাথবাবু বললেন, ‘বাসুদেবের সঙ্গে রেষারেষিও ছিল বুঝলেন মধুমিতা। শুধু মেয়ের বিয়ের জন্য নয়। কার পূর্বপুরুষের ইতিহাস বেশি গৌরবময়, সে নিয়ে বিস্তর ঝগড়া হত। ওই যে কী সব রেয়ার কয়েন, স্ট্যাম্প নিয়ে তো প্রায়ই লাগত। বাসুদেব তো প্রায়ই ছুটত নিজের সংগ্রহ করা জিনিস নিয়ে ব্রজমোহনকে দেখাতে।’
বর্ণালীদেবী ধীর স্বরে বললেন, ‘লোক দেখানো বন্ধুত্ব ছিল ঠিকই, কিন্তু দুজনেই দুজনকে পছন্দ করত বলে আমার মনে হয়নি কখনও। কিন্তু শিবনাথদা, একবার তো মৃন্ময়দার বাড়িতে দেখা করতে যাওয়া উচিত। ব্রজদা মারা যাওয়ার পরের দিন থেকে মানুষটা আর এলো না হাঁটতে। শুনলাম জ্বর এসেছে, অসুস্থ। চলুন কাল সকালে বেরিয়ে আগে ওদিকটা ঘুরে আসি।’
অমিতবাবু বললেন, ‘এই কথাটা মন্দ বলেননি। অসময়ে খোঁজই যদি না নিলাম, তাহলে আর সহযাত্রী কিসের! একসঙ্গে পথ হাঁটি যখন, তখন সহযাত্রী তো বটেই।’
শিবনাথবাবু আনমনে বলল, ‘ব্রজমোহনকে হারিয়ে বেশি করে অনুভব করছি, আমরা হয়তো সহযাত্রী ছিলাম না। তাই ব্রজর দুঃখ বা একাকীত্বগুলোকে অনুভব করার চেষ্টাই করিনি। এত বছর লড়াই করে মৃত্যু যখন প্রায় দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, এখন তখন হাতছানি দিচ্ছে, তখন কেন আত্মহত্যা করবে? তার পিছনের কারণটা জানা হল না আমাদের কারোরই।’
অমিতবাবু বললেন, ‘আমি অবশ্য বিশ্বাস করি না উনি আত্মহত্যা করেছেন। বরং ওই পূর্বপুরুষের সম্পত্তিই মৃত্যু ডেকে আনল। কেন জানি না হিসেবনিকেশ গুলিয়ে গিয়ে মনে হচ্ছে এটা খুন।’
শিবনাথবাবু বললেন, ‘যাই হোক, আমরা একসঙ্গে পথ চলেও কিছুই টের পেলাম না। একটা স্বাভাবিক সকালে খুনের খবর পাওয়া ছাড়া।’
সকালের বাতাসটা আবারও একটু ভারী হল যেন। এরা ব্রজমোহনের শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই এ পর্যন্ত মনে হচ্ছে। একমাত্র সন্দেহজনক মৃন্ময়বাবু আর বাসুদেববাবুর ব্যবহার। দুজনেই মৃত্যুর আগে ব্রজধামে গিয়েছিলেন। দুজনের মেয়ের সঙ্গে রাহুলের বিয়ে দিতে চান। সঙ্গে বাসুবাবুর রেয়ার কয়েন কালেকশনের নেশা। বাকিদের তেমন সন্দেহের লিস্টে ফেলার কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে যে কোনো কেসে সকলকে সন্দেহের তালিকাতেই রাখে লগ্নজিতা। যতক্ষণ পর্যন্ত না আসল খুনি ধরা পড়ছে।
মধুমিতা একটু আফসোসের সুরে বললেন, ‘সরলাবৌদির ব্যবহারটা বড্ড অস্বাভাবিক ঠেকছে। গতকাল সন্ধেতে আমি আর বর্ণালীদি গিয়েছিলাম দেখা করতে। মুখে চোখে তেমন কষ্টের চিহ্ন নেই। শুধু ব্রজমোহনদা চলে যাবার কারণে রাহুল ওনার ঠিকমতো যত্ন করবেন কিনা সেটা নিয়েই ভাবিত। নিজের কষ্টের কথাই বলে গেলেন। ব্রজদার একটি কথা বলে তাকে স্মৃতিচারণ করতে দেখলাম না। শুধু বিয়ের পর থেকে ব্রজদার কাছে কীভাবে বঞ্চিত হয়েছেন, সেসব হিসেবনিকেশ করে গেলেন মৃত মানুষের উদ্দেশ্যে। সরলাবৌদির সঙ্গে ব্রজদার সম্পর্ক যে খুব মধুর ছিল না, সেটা অন্ধ মানুষও বলে দেবে। কিন্তু ব্রজদার মুখে কখনও বৌদির নিন্দে শুনিনি। বরং সম্মান দিয়েই কথা বলতেন। অথচ সরলাবৌদির প্রতিটা কথায় যেন বিরক্তি ঝরে পড়ছে। এর আগেও যেবারে সবাই মিলে ব্রজদার জন্মদিনে কেক নিয়ে হাজির হয়েছিলাম ব্রজধামে, তখনও সরলাবৌদির চোখে অসন্তোষ দেখেছি।’
শিবনাথ মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনাদের সামনে তো শুধু অসন্তোষ দেখিয়েছেন। আমাদের একবার দরজা দেখিয়ে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন। ব্রজমোহন লজ্জায় এতটুকু হয়ে বলেছিল—কেউ কিছু মনে করো না; ওর মনটা আজ ভালো নেই। তাই এভাবে রিয়্যাক্ট করছে। অমিত তো মুখের ওপর বলেই বসেছিল—’বৌদি আমরা আপনার বাড়িতে থাকতে আসিনি, এসেছিলাম ব্রজদার সঙ্গে গল্প করতে।’ যদিও তারপরে যতবার ব্রজমোহনের অনুরোধে ওর বাড়িতে গেছি, ভদ্রমহিলা এদিকে আসেননি। মন্টু চা, শিঙাড়া, চপ সাপ্লাই দিয়ে গেছে ব্রজর নির্দেশে। ভদ্রমহিলা ভদ্রতা করেও আর আসেননি আমাদের সম্মুখে।’
লগ্নজিতা সবটা শুনে টুক টুক করে পা চালালো নিজের গন্তব্যে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন