জেরায় জেরবার

অর্পিতা সরকার

জেরায় জেরবার

স্থির হয়ে বসে আছে চন্দ্রজা। লগ্নজিতা বলল, ‘আপনাকে থানায় ডাকলাম একটা বিশেষ প্রয়োজনে। কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে। একটু পরিষ্কারভাবে উত্তর দিলে আমার সুবিধা হয়।’

চন্দ্রজা বলল, ‘বলুন। আমার উত্তরগুলো জানা থাকলে নিশ্চয়ই বলব।’

লগ্নজিতা দেখল চন্দ্রজার চোখে ভয় নয় বরং বিরক্তি ভিড় করে রয়েছে। হয়তো থানায় আসতে হয়েছে বলেই বিরক্ত। অথবা রাহুলকে ভালোবাসার খেসারত দিতে হচ্ছে বলেও হতে পারে।

—’আপনার সঙ্গে রাহুলের সম্পর্ক কতদিনের?’

চন্দ্রজা একটু ভেবে বলল, ‘দেখুন, সম্পর্ক বলতে আপনি যদি প্রেম বলতে চান সেটা বছর চারেক। আর যদি চেনার কথা বলেন, তাহলে বলব আমি ওকে ক্লাস ওয়ান থেকে চিনি। যেহেতু আমার বাবা আর ব্রজআঙ্কেল বন্ধু ছিল, তাই বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিলই। কিন্তু আমরা তখন খেলার সাথী ছিলাম। পরে বন্ধু হলেও প্রেম নিয়ে কেউই কিছু ভাবিনি। বছর চারেক আগে রাহুলের বার্থ ডে উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রণ ছিল। ওইদিন হঠাৎ রাহুলকে প্রোপোজ করেছিল বাসুআঙ্কেলের মেয়ে শিঞ্জিনী। আমারই স্কুলে পড়ত মেয়েটা, চিনতাম। আমি নিজে দেখেছিলাম শিঞ্জিনী রাহুলকে প্রোপজ করছে। কিন্তু রাহুল নাটকীয়ভাবে শিঞ্জিনীর সামনে বলে বসে—’আমি তো চন্দ্রজাকে ভালোবাসি সেই কবে থেকেই। আমরা এনগেজড।’ আমি একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম।

তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল অশান্তি। রাহুলের মা সরলাআন্টি আমায় তেমন পছন্দ না করলেও এতটা রেগে যায়নি। কিন্তু রাহুল আর আমার সম্পর্কের কথা জানার পর থেকে অকারণে আমায় অপমান করতে শুরু করেন। ওনার শিঞ্জিনীকে বেশি পছন্দ ছিল ছেলের জন্য অথবা বাবার কারণেই আমাকে অপছন্দ ছিল। ব্রজআঙ্কেল আমায় খুব ভালোবাসতেন। বিশেষ করে তৃষাদি চলে যাওয়ার পরে আরও আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরলাআন্টির অশান্তির কারণে গোলমাল হয়ে যেত সবকিছু। একটা ভয়ঙ্কর সিক্রেট আছে এর পিছনে। যেটা রাহুল মানতে চায় না। এমনকি বিশ্বাসও করতে চায় না। কিন্তু বিষয়টা সত্যি। আমার মা মারা যাবার পরে সরলাআন্টি আমাদের বাড়ি এসে সরাসরি বাবাকে বলেছিল, ‘রাজী থাকো তো এখনও আমি আসতে পারি তোমার জীবনে। যতদিন লোপা ছিল ততদিন তো আমাকে তোমার ধারে কাছেও আসতে দাওনি, এবার তো লোপা এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল, আর তো কোনো বাধা নেই। আমি ব্রজকে ছেড়ে, চক্রবর্তী বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে রাজি। বললে মেরেও ফেলতে পারি ব্রজকে। রাহুল, তৃষা, চন্দ্রাকে নিয়ে আমি আর তুমি থাকব।’ তখনই তৃষাদি বেঁচে ছিল।

আমি সরলাআন্টির এমন কথা শুনে কেঁপে উঠেছিলাম। সদ্য মা হারা যাবার যন্ত্রণার মধ্যে এমন কথা শুনে বাবাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কাঁটা হয়ে উঠেছিলাম।

বাবা খুব স্নেহের গলায় বলেছিল—’রিন্তি তুমি এখনও সেই জেদি আর ছেলেমানুষ রয়ে গেলে। ব্রজদার মতো মানুষ লাখে একটা মেলে। আর তুমি আর সেই আগের রিন্তি নেই, এখন তুমি আমার সরলাবৌদি। এসব ছেলেমানুষি ছেড়ে তোমার রাহুল আর তৃষার সঙ্গে আমার মেয়েটাকেও একটু স্নেহ দিও তুমি।’

সরলাআন্টি আচমকা বাবার গলা টিপে ধরে বলেছিল, ‘কী ছিল লোপার মধ্যে? যে মরেও তুমি আমার হলে না।’ বাবা হাঁসফাঁস করছিল, আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম। তখন ছেড়ে দিয়ে যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিল, তেমন চলে গিয়েছিল। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। বাবা হেসে বলেছিল—’চিন্তা করিস না, ও আমায় মারবে না কোনোদিন। অযথা নিজেকে শেষ করছে একটু একটু করে।’ তখনও আমি বুঝতে পারিনি সরলাআন্টি মানসিক রোগী বা বাবার সঙ্গে কলেজ লাইফ থেকেই পরিচয় ছিল। এরপরে আমি বলেছিলাম বাবাকে, ব্রজধামে আর না যেতে। কিন্তু বাবার সঙ্গে ব্রজআঙ্কেলের পরিচয় বহুদিনের। একই পাড়ায় বাড়ি বলেই শুধু নয়। বাবা যখন নাটক করত, তখনই ব্রজআঙ্কেল দেখতে যেত। সেই থেকেই পরিচয়। ব্রজআঙ্কেলের লেখা একটা ঐতিহাসিক নাটক বাবা মঞ্চস্থও করেছিল। আমি বলেছিলাম, সরলাআন্টি সম্পর্কে সব বলতে অঙ্কেলকে। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হয়নি। এমনকি অনেকবার দেখেছি সরলাআন্টির অনেক অসভ্য ব্যবহারের উত্তরেও বাবা কিছু না বলে চেপে গেছে। বাবা ব্রজআঙ্কেলকে রেসপেক্ট করত আর সরলাআন্টিকে প্রশ্রয় দিত। কেন সেটা আমি ঠিক বুঝিনি।

বাবাকে বারংবার খুন করে দেবে বলে হুমকিও দিয়েছে আন্টি। আবার এও বলেছে, ‘একদিন ব্রজকে শেষ করে দিয়ে তোমার কাছে আসব। লোপা সেদিন ওপরে বসে দেখবে।’

লগ্নজিতা বলল, ‘আপনার মা কীভাবে মারা গিয়েছিলেন? কোনো অ্যাক্সিডেন্টে?’

চন্দ্রজা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না। কিডনির প্রবলেম হয়েছিল। মা বেঁচে থাকতে আন্টি একবারও আসেনি। বাবাও ব্রজআঙ্কেলের বাড়িতে তেমন যেত না। ওই রাস্তাতেই গল্প করত মাঝেমাঝে। মা সরলাআন্টিকে পছন্দ করত না বলে আমার মনে হয়েছে। মা একদিন বাবাকে বলছিল—আজ রাস্তায় রিন্তিকে দেখলাম, খুঁজে খুঁজে এ পাড়াতেই বিয়ে করতে হল ওকে? আমায় দেখে বিশ্রীভাবে হাসল। বাবা বলেছিল, ওসব ছাড়ো। বিয়ে হয়ে গেছে আর আশাকরি আমাদের বিরক্ত করবে না। মা বলেছিল—আমি ওকে বিশ্বাস করি না। ও সব পারে। তখনও আমি জানতাম না সরলাআন্টির ডাকনাম রিন্তি। অনেক পরে বুঝেছিলাম, সরলাআন্টি বহুবছর আগে থেকেই বাবার প্রতি দুর্বল ছিল। এটাকে শুধু দুর্বল বললে ভুল বলা হবে, বাবাকে পাওয়ার জন্য সব কিছু করতে পারত। আমার বাবা আর মায়ের বিয়ের আগে মাকে রাস্তার মাঝে দাঁড় করিয়ে অসম্ভব অপমানও করেছিল। তখনও ব্রজআঙ্কেলের সঙ্গে বিয়ে হয়নি আন্টির। মা আর বাবার মাঝে সাময়িক ফাটল ধরিয়ে দিয়েছিল। তাই মা ওকে একেবারেই পছন্দ করত না।

মা বেঁচে থাকতে ব্রজআঙ্কেলদের বাড়ির সঙ্গে তেমন যাতায়াত ছিল না। মা মারা যেতে সরলাআন্টি, রাহুল, তৃষা প্রায়ই আসতো। আমরাও যেতাম। প্রথম যেদিন বাবা জানতে পারে রাহুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা, বাবা আঁতকে উঠে বলেছিল—রিন্তি মানবে না কিছুতেই না। আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, ও সেই প্রতিশোধ নেবে তোর ওপরে নিজের ছেলেকে দিয়ে। আন্টির সঙ্গে ব্রজআঙ্কেলের রিলেশন কোনোদিনই ভালো ছিল না। আন্টি মেন্টাল পেশেন্ট হওয়ায় আঙ্কেল সবসময় একটা ভয়ে থাকত। এই বুঝি কিছু করে দেয়। তৃষাদির আচমকা মৃত্যুর পরে তো আঙ্কেল আর আন্টির ঘরে থাকতোই না। আন্টি কোনো পুরুষকে সহ্য করতে পারতো না।

একদিন রাহুল ছিল না বাড়িতে। আমি গিয়েছিলাম ওদের বাড়ি। ব্রজআঙ্কেলের জন্য বাবা দামি চা পাতা কিনেছিল। ওটাই দিতে গিয়েছিলাম। বাড়িতে কেউ তেমন ছিল না। আমি আন্টির ঘরে ঢুকতেই হিসহিসে গলায় বলেছিল—এ বাড়ির বউ হওয়ার শখ? তারপর?

মন্টুদা সেদিন আমায় ইশারায় বেরিয়ে আসতে বলেছিল। বলেছিল, দিদিমণি আজ চলে যাও। রাহুল নেই। জেঠিমা তিনদিন ওষুধ খায়নি। বিপদ হতে কতক্ষণ?

এরপরে আমার বাবা বেঁকে বসেছিল। বলেছিল ব্রজধামে মেয়ের বিয়ে দেব না কিছুতেই। তাতেই ব্রজআঙ্কেলের সঙ্গে প্রায়ই বাবার ঝামেলা হচ্ছিল। রাহুল আর আমার দুজনেরই মনখারাপ ছিল। আঙ্কেল বলেছিল, ‘আমি যদি এত বছর এ বাড়িতে বেঁচে থাকি তাহলে চন্দ্রাও থাকবে, সরলা কিছু করতে পারবে না ওর। কিন্তু বাবা ভরসা করতে পারছিল না।’

লগ্নজিতা বলল, ‘দুদিন আগে রাহুল আপনাকে কী ফেরত দিতে এসেছিল, চন্দ্রজা?’

চন্দ্রজা একটু হকচকিয়ে বলল, ‘আমি জানি রাহুলের মনেও এখন অনেক ভুলভাল সন্দেহ ঢুকেছে। তাই হয়তো ও আমার গণেশটার কথা আপনাকে জানিয়েছে। কিন্তু ওই গণেশটা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না প্রায় মাস চার-পাঁচ আগে থেকে। সম্ভবত শেষ যেবার রাহুলদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখনই সরলাআন্টি ব্যাগ থেকে চুরি করে নিয়েছিল এটা। এখন আঙ্কেল মারা যাবার পরে এটাকে ক্লু হিসাবে দিচ্ছে রাহুলকে। শেষ গিয়েছিলাম রাহুলের খুব জ্বর ছিল, ওকে দেখতে। সেদিন ওদের ড্রয়িংয়ের ব্যাগটা রেখে রাহুলের ঘরে ঢুকেছিলাম আমি। কারণ ব্যাগটা ভারী ছিল কিছু জিনিসপত্রে। আমার ধারণা তখনই আমার পার্স থেকে লাকি গণেশ চুরি করেছিল আন্টি। কারণ আন্টি এই গণেশের কথা জানত। আমিই বলেছিলাম। শুনুন অফিসার, রাহুলকে আমি সত্যিই ভালোবাসি। ওকেই জীবনসঙ্গী হিসাবে চেয়ে এসেছি কিন্তু ব্রজআঙ্কেলকে খুন করে নয়। কারণ উনি আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। আমার ধারণা, এ কাজ রাহুলের মায়ের। ওই ভদ্রমহিলা কথায় কথায় খুনের হুমকি দিতেন অঙ্কেলকে। রাহুল অবশ্য এসব মানতে চায়নি। চায়নি বলেই এভাবে চলে যেতে হল অঙ্কেলকে। মাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে রাহুল, তারই পরিণতি আঙ্কেল আর মন্টুদার মৃত্যু।’

 এক টানা কথা বলে চন্দ্রজা জোরে শ্বাস নিলো। দু ঢোক জল খেয়ে বলল, ‘রাহুলের সঙ্গে সম্পর্কটা শেষের পথে। ব্রজঅঙ্কেলের খুনের দায়ে আমি আর বাবা জেলে গেলে আন্টি খুব খুশি হবে। আচ্ছা ম্যাডাম, ভালোবাসা এত নৃশংস হয়? হতে পারে? আমি যদি মেনেও নিই আন্টি অল্পবয়সে আমার বাবাকে এক তরফা ভালোবেসেছিল, কিন্তু পায়নি বলে, এত বয়েসে এসেও তার প্রতিশোধ স্পৃহা কমবে না? এর নাম ভালোবাসা? আমি তো জানতাম, একটা আগলে রাখার অনুভূতির নাম ভালোবাসা। একটা নরম বিকেলের নাম ভালোবাসা। এ তো দেখছি, চূড়ান্ত প্রতিশোধ স্পৃহার নাম নাকি ভালোবাসা।’

চন্দ্রজার গলায় উষ্ণতা, বিরক্তি মিলেমিশে একাকার। ‘একজন এই বয়েসের মহিলার মনে যে এত প্রতিশোধ স্পৃহা থাকতে পারে এটাই তো আশ্চর্যের, ম্যাডাম। ব্রজআঙ্কেলকে এই মহিলা সকলের সামনেও বহুবার গলা টিপে ধরেছে, তাই আমার দৃঢ় ধারণা এই শ্বাসরোধ করে খুন সরলা আন্টির কাজ। মানসিক অসুস্থ বলে তো তার অপরাধ কম হয়ে যাবে না ম্যাম! রাহুলকে বহুবার বলেছিলাম অ্যাসাইলামে পাঠাতে। যদি কথা শুনত তাহলে ব্রজআঙ্কেল, মন্টু এভাবে জীবন দিত না। এরপর হয়ত আবার আসবে আমার বাবার কাছে। ছেলের বিয়ের বয়েসে ….যাকগে আর ভালো লাগছে না। আপনি আপনার মতো তদন্ত করুন। শুধু একটু দেখবেন, আমার বাবা প্রেশারের রোগী। উত্তেজনা মোটেই ভালো নয় বাবার জন্য।’

 লগ্নজিতা বলল, ‘মৃন্ময়বাবু কিছু বললেন, কেন উনি ওইদিন ভোরে ব্রজমোহনবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন? আর কখন গিয়েছিলেন সেটা বললেন?’

চন্দ্রজা বলল, ‘আমার যতদূর ধারণা—আঙ্কেলের সঙ্গে বাবার আগের দিন আমাদের বিয়ে সংক্রান্ত কথা নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল। বাবা রাহুলের সঙ্গে বিয়ে দিতে যদিবা রাজি হয়েছিল কিন্তু আমায় ব্রজধামে পাঠাতে রাজি ছিল না। এই নিয়েই কথা কাটাকাটি হয়েছিল। বাবা বলেছিল, ওরা বিয়ের পরে আমার বাড়িতে থাকবে। দরকারে নতুন ফ্ল্যাট কিনে দেব মেয়ে-জামাইকে। এতেই আঙ্কেলের সম্মানে লাগে। রাহুলরা নিজেদের বংশমর্যাদা নিয়ে অহেতুক গর্ব করেই চলে। বিশেষ করে আঙ্কেল তো বংশমর্যাদার গরিমা নিয়ে মারাত্মক পজেসিভ। বাবারও মনখারাপ ছিল এই ঝগড়ার পরে। তাই হয়তো পরের দিন মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে মনোমালিন্য মিটিয়ে নিতে গিয়েছিল। তারপর কেন ঘর অবধি যায়নি সেটা আর কিছুতেই বলতে চাইছে না। আমি জিজ্ঞাসা করেছি। আসলে ব্রজআঙ্কেলের আকস্মিক মৃত্যুতে বাবা খুব আপসেট। তবে ম্যাডাম, আমার বাবা কাউকে খুন করতে পারে না। এটুকু আমি জোর গলায় বলতে পারি।’

লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘চন্দ্রজা, প্লিজ ওইদিন কেন মৃন্ময়বাবু ব্রজমোহনের সঙ্গে দেখা না করেই ফিরে এসেছিল সেটা আমায় তাড়াতাড়ি জানান। সন্দেহের তালিকায় যেহেতু উনি আছেন, তাই এটা ক্লিয়ার হওয়া জরুরি।’

চন্দ্রজা বুঝল, অফিসার ওর সব কথা শুনলেও বিশ্বাস করল না। মনে মনে সরলাআন্টির ওপরে মারাত্মক ঘৃণা জমেছে। ওই মহিলা সবকিছু শেষ করে দেবে। সেই শ্মশানের ওপরে হয়ত উনি নাচবেন।

মনটা বড্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে চন্দ্রজার। লগ্নজিতার কাছ থেকে ফিরে এসেছে অনেকক্ষণ। এসে ড্রয়িংয়ে বসেছিল। এখনও চন্দ্রজার ড্রয়িংয়ে সোফা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। বাবা কি এখনও ঘুমাচ্ছে? দুপুরে এতক্ষণ ঘুমানোর অভ্যেস তো বাবার নেই। ছুটির দিনে দুপুরে একটু আয়েশ করে বই পড়তে পড়তে পাওয়ার ন্যাপ নিত ঠিকই। কিন্তু প্রায় ঘণ্টাখানেক কোনো সাড়াশব্দ নেই। এমনকি চন্দ্রজা থানা থেকে ফিরল কিনা জানার জন্যও একবার দোতলা থেকে নেমে এলো না, এটা যেন বড়ই অবিশ্বাস্য। দু-কাপ চা করে নিয়ে ট্রেতে বসিয়ে চন্দ্রজা সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে গেল বাবার ঘরে। দরজা হাট করে খোলা। বাবা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। চায়ের ট্রেটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বাবার পিঠে হাত দিয়ে চন্দ্রজা বলল, ‘বাবা… তুমি কাঁদছো?’

মৃন্ময়ের চোখ দুটো লাল। গাল ভিজে। ভাঙা গলায় বললেন, ‘ব্রজদা চলে গেল আমার জন্য। পুলিশ থানায় ডেকে তোকে হ্যারাস করছে আমার জন্য, রাহুল আর তোর সম্পর্কটা ভেঙে গেল আমার জন্য। সবকিছুর জন্য দায়ী আমি। লোপাও হয়তো মনে মনে একটা কষ্ট পুষে রেখেছিল আজীবন। রিন্তি এভাবে আমাদের সব শেষ করে দিল চন্দ্রা। রিন্তি বড্ড ভয়ঙ্কর মানুষ। সব শেষ করে দিল। রিন্তি চায় তুই আর আমি জেলে থাকি। ব্রজদার খুনের দায়ে আমাদের জেলে না পাঠালে ওর শান্তি হচ্ছে না। রিন্তিকে আমি আজীবন স্নেহ করে এসেছি। ওর নাটক দেখেছি মুগ্ধ হয়ে। ওর বিপরীতে অভিনয় করার সময় ভেবেছি ভগবান কী অপরিসীম অভিনয় ক্ষমতা দিয়ে ওকে গড়েছেন। কী সাবলীল ওর অভিনয়! তখন বুঝিনি, ওর গোটা জীবনটাই ও নাট্যশালা করে রেখে দেবে। কেন যে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার! শেষ করে দেবে ও। শুনেছিলাম মেয়েরা মায়ের জাত হয়, কিন্তু রিন্তি নিজের সন্তান, স্বামী কাউকে ভালোবাসে না। ওর দাবি ও আমায় ভালোবাসে। এটা সবচেয়ে বড় নাটক। সবচেয়ে বড় অভিনয় ওর। ও আমায় শেষ করতে চায়। চন্দ্রা, আমি পুলিশের কাছে গিয়ে সারেন্ডার করি। তাহলে হয়তো রিন্তি তোকে রেহাই দেবে।’

চন্দ্রা বাবার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, ‘তুমি শান্ত হও বাবা। আমার অফিসারের সঙ্গে কথা হলো এতক্ষণ। রাহুলের বারণ সত্ত্বেও আমি সরলাআন্টির এই মানসিকতার কথা বললাম ওনাকে। আমাকে বলতেই হত বাবা। নাহলে হয়তো এবারে আন্টি রাহুলকেই খুন করে দেবে। আমার ভয় করছে বাবা। কিন্তু রাহুলকে বোঝাতে পারছি না আমি।’

মৃন্ময় উঠে বসে বলল, ‘কিন্তু রিন্তি আচমকা ব্রজকে খুন কেন করতে গেল কিছু বুঝতে পারছিস? কারণ ব্রজ জেদ ধরেছিল এই অঘ্রানে তোদের বিয়ে দেবে। আমি বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম সরলাবৌদি এটা মানবে না। ব্রজদার জেদকে তো চিনিস। সবেতেই একরোখা জেদ। এত লোকজন স্মার্ট ফোন ইউজ করল, কম্পিউটারে লেখালিখি করল, ব্রজদার সেই বোতাম টেপা মোবাইল আর মোটা মোটা বই। গুগল কী জীবনে খুলেও দেখল না। আমরা এত বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু ব্রজদা এসবের ধার কাছ দিয়েও গেল না কোনোদিন। আমার ধারণা ওই নিয়েই রিন্তির সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল, তাই ব্রজদাকে খুন হতে হল। ভাবতেই ঘেন্না করছে রিন্তি এটা করতে পারল! আমি এখনও ভাবছি ব্রজদা রেগে গিয়ে সুইসাইড করল না তো? কিন্তু মন্টুর মৃত্যু আরেকবার প্রমাণ করিয়ে দিল, ব্রজদা খুন হয়েছিল।’

চন্দ্রজা বলল, ‘কিন্তু বাবা, সরলাআন্টি তোমাকে খুনি প্রমাণ কেন করতে চাইছে? আর তুমি ব্রজধামে গিয়েও কেন আঙ্কেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলে না?’

মৃন্ময় ধীর গলায় বলল, ‘তুই এখন যা চন্দ্রা। আমি একটু একা থাকতে চাই। অনেকগুলো হিসেব মেলাতে হবে আমাকেও।’

চন্দ্রজা বুঝল, যে কোনো কারণেই হোক বাবা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে চাইছে না।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন