শান্তিনিকেতনে আরও দুজন

অর্পিতা সরকার

‘বর্ণালীদি তুমি দেখেছো কিনা জানি না, ওই পুলিশ অফিসার লগ্নজিতা এখন শান্তিনিকেতনে। আমি আর তুমি যখন কালকে কোপাইয়ের ধার থেকে ফিরছিলাম তখনই দেখলাম ওকে। সঙ্গে একটা আদিবাসী মেয়ে আর একজন ডক্টর। ওই ডক্টরের চেম্বারে আমি একবার গিয়েছিলাম আমার ননদের সঙ্গে। বুঝলাম না ওরা এখন এখানে কী করছে? বেড়াতে আসতেই পারে। কিন্তু ব্রজদার খুনের তদন্ত নাকি উনিই করছেন শুনলাম। তাই ভাবছি।’ বর্ণালীদি বলল, ‘গেস্ট হাউজের মালিক গতকাল রাতে বলছিলেন, সোনাঝুরির জঙ্গলে নাকি কোনো এক পুলিশ অফিসার খুন হয়েছে। কলকাতার পুলিশ। তাই হয়তো উনি এসেছেন। আজকে তো সোনাঝুরির ওদিকটা যাওয়া যাবে না শুনলাম। এক কাজ করি চলো, আজকে বিশ্বভারতী চত্বরটা ঘুরে নিই। সুমন্ত বলছে—পারমিশন করিয়ে রেখেছে ভিতরটা ঘুরিয়ে দেবে। ও এখানের কলাবিভাগের শিক্ষক। সুনির্মলের বন্ধু।’

মধুমিতা বলল, ‘বর্ণালীদি সেদিন অমিতদা বলছিলেন তৃষার রেপের কেসটা নাকি আবার রিওপেন করতে চাইছিল ব্রজদা আর রাহুল। তাই নাকি?’

বর্ণালীদি একটু থমকে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘দেখো মধুমিতা তৃষা সুনির্মলের ভালো বন্ধু ছিল মাত্র। জানি না কেন পাড়ার সবাই ওটাকে প্রেম বলে মাথাখারাপ করছিল। আর যদি প্রেম থেকেও থাকত তার রেপের ঘটনায় সুনির্মল কীভাবে যুক্ত থাকবে বলো তো?’ মধুমিতা বলল, ‘সুনির্মলের বন্ধুরা বোধহয় এসব করেছিল তাই না?’ বর্ণালীদি কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ গো সত্যিই ব্রজদার সঙ্গে তোমার হাজবেন্ডের পুজো কমটিতে ঝামেলা হয়েছিল? তোমার হাজবেন্ড নাকি বলেছিল, ব্রজদাকে দেখে নেবে! দেখো বাবা পুলিশের কাজকর্ম আমার একেবারে বিশ্বাস হয় না। এবারে না তোমার বাড়ি গিয়ে হাজির হয় এই খুনকে কেন্দ্র করে।’

মধুমিতার মুখ থেকে মুহূর্তে আলোটা নিভে গেল। মধুমিতা কাউকে বলেনি, অলরেডি পুলিশ ওর হাজবেন্ডকে থানায় ডেকে পাঠিয়েছিল। ওই লগ্নজিতা ভট্টাচার্য নানা ভাবে জেরাও করেছে। ওই দিন ও কোথায় ছিল? ব্রজমোহন কবে থেকে এই পুজো কমিটিতে ঢুকেছে এইসব।

ব্রজদারা এ চত্বরের বহু বছরের বাসিন্দা হলেও পুজো কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না কোনোকালেই। শিবনাথদাই বেশি চাঁদা পাবার লোভে ব্রজদাকে কমিটিতে ঢুকিয়ে দিল। এতকাল কেউ ওর হাজবেন্ডকে চোর বলল না, ব্রজদা এসেই নাকি ধরল কমিটির কত লাখ টাকা তছরূপ করেছে ও। এসব হিংসে মধুমিতা বেশ বোঝে। একাই বড় বাড়িতে থাকবে, দামি গাড়িতে চাপবে। পাড়ার অন্য কেউ চারতলা বাড়ি হাঁকালেই দোষ। সেই কারণেই ব্রজদা এসব করল। মধুমিতা নিজেও স্কুল টিচার, ইনকাম তো কিছু কম করে না। ওর স্বামী নাহয় ছোটখাটো ব্যবসা করে। তাই বলে বড় বাড়ি, গাড়ি হাঁকানোর ক্ষমতা ওদের নেই এমন ভাবল কেন ব্রজদা! অহংকারী হিংসুটে বংশ ওই চক্রবর্তী বংশ। মধুমিতাকে একটু অন্যমনস্ক দেখে বর্ণালীদি বলল, ‘চলো বেরোই। কলকাতা ফিরে না হয় আবার ব্রজদাকে কে খুন করেছে সেই আলোচনা করব। ভুলে গেলে চলবে না, আমার ছেলে বা তোমায় হাজবেন্ড দুজনেই কোনো না কোনোভাবে ব্রজধামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল দুর্ভাগ্যজনকভাবে।’ মধুমিতা আর কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘চলো বর্ণালীদি। আমি কয়েকটা বাটিকের চাদর কিনব ভেবেছি।’

 শ্যামবাটিতে পৌঁছে দুজনের চোখেই পড়ল লগ্নজিতা আর কৌশিক দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মোড়ে। ওদের দেখেই লগ্নজিতা এগিয়ে এসে বলল, ‘আরে আপনারা? বেড়াতে নাকি? উঠেছেন কোথায়? এই দেখুন কলকাতার বাইরে কলকাতার মানুষদের পেয়ে গেলে কেমন একটা নিজের নিজের মনে হয়। এনিওয়ে কোন গেস্টরুমে উঠেছেন বলুন, সন্ধেবেলা আমি যাব আড্ডা দিতে।’ বর্ণালী বলল, ‘আমরা জাস্ট বেড়াতে এসেছি। সঙ্গে কিছু কেনাকাটা। ছুটি পেলে টুক করে শান্তিনিকেতন আসি। এটা নতুন কিছু নয়।’ লগ্নজিতা বলল, ‘তার মানে এখানের অনেক কিছুই আপনারা চেনেন, জানেন। বর্ণালীদেবী ফুলডাঙ্গার রাঙামাটি গেস্টরুম নিয়ে আপনাকে কিছু বলেছিল নাকি সুর্নিমল? শুনলাম দোলের সময় তৃষাও নাকি এসেছিল শান্তিনিকেতনে। সুনির্মলও বন্ধুদের নিয়ে রাঙামাটিতেই ছিল দিনদুয়েক।’ বর্ণালী হেসে বলল, ‘দেখবেন ম্যাডাম শেষে খড়ের গদায় ছুঁচ খুঁজতে বসবেন না। তৃষার রেপ শান্তিনিকেতনে হয়নি। হয়েছিল খোদ কলকাতায়। এখানে কে দোলে এসেছিল, কে রাঙামাটিতে ছিল এসব জেনে এত বছর পরে করবই বা কী? সুনির্মল তৃষার বন্ধু ছিল। তাও ক্লাসমেট নয়। তৃষা মারা গেছে বহু বছর হল। এতদিন পরে ব্রজদার খুনের সূত্রধরে যদি সুনির্মলকে জড়ানোর চেষ্টা করেন তাহলে তো আর কিছুই বলার থাকে না ম্যাডাম।’ লগ্নজিতা বলল, ‘সুনির্মলের বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনলাম। পাত্রীর সঙ্গে প্রেম তো বহুদিন ধরেই। আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার হবু বৌমা জানেন সুনির্মলের বন্ধুরা তৃষাকে রেপ করেছিল?’

বর্ণালীম্যাডাম হঠাৎই ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ জানে। না জানলে কি আপনি জানাবেন? আমি ঠিকানা দিচ্ছি গিয়ে জানিয়ে আসুন। আপনি এখন কার খুনিকে খুঁজছেন তৃষার নাকি ব্রজদার? নাকি মন্টুর? নাকি এখনও অবধি কাউকেই খুঁজে পাননি, তাই একজন ইনোসেন্ট ছেলের নাম জড়িয়ে দিলে ভালো হবে। বেশ একখানা গল্পও ফেঁদে দিতে পারবেন। তৃষার রেপকেসের ফাইল আবার রি-ওপেন করতে চলেছে ব্রজমোহন, তাই ওকে খুন হয়ে যেতে হল। তৃষার কোনো এককালের বন্ধুই এই খুন করেছে, তাকে আপনারা গ্রেফতার করবেন। কলকাতা পুলিশ কতটা অ্যাকটিভ এটাই দেখাবেন তো?

তাহলে সেটাই করুন। অযথা শান্তিনিকেতনে এসে আমাদের আক্রমণ করার তো কোনো কারণ দেখি না।’

লগ্নজিতা বলল, ‘আক্রমণ? আমি তো একটু গল্প করতে চাইছি মাত্র। আপনারাই পুলিশের নামে বিরক্ত হচ্ছেন।’ মধুমিতা বলল, ‘শুনুন ম্যাডাম আমরা বেড়াতে এসেছি। এখানে এসে পুলিশি জেরা চাইছি না। প্লিজ।’

লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘বেশ তাহলে নাহয় কলকাতা গিয়েই হবে।’

কৌশিক ইশারায় ডাকল ওকে। এগিয়ে যেতেই বলল, ‘গতকাল প্রায় কুড়ি মিনিট লেটে গিয়েছিলাম বলে মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখা করলেন না। আজ টাইম দিলেন। তুমি কি আজকেও মিস করতে চাও? চলো তাড়াতাড়ি।’ কৌশিক আর লগ্নজিতা জোরে পা চালালো। শ্যামবাটির কাছেই ওনার নিজস্ব বাড়ি। সুন্দর সাজানো দোতলা। বাড়ির গেটে বেগনভেলিয়ার রঙের স্পর্ধায় বসন্ত এখানে চিরস্থায়ী যেন। বাড়ির নামটা ভারী মিষ্টি, ‘বিদায় বেলায়’। সামনের ঘরটা ওনার চেম্বার। এখন বন্ধ রয়েছে। পাশেই কলিংবেল। কৌশিক বেলটা বাজাতেই, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’…গানটা বেজে উঠল। কৌশিক বলল, ‘মহিলা শুধু মনের ডক্টর নন, বেশ রবীন্দ্র অনুরাগী সেটা বোঝা যাচ্ছে।’ লগ্নজিতা বলল, ‘সেই কারণেই হয়তো শান্তিনিকেতনে বসবাস করছেন। কবিগুরুর চলা পথে রোজ হাঁটতে পারবেন বলেই হয়ত।’

একটা গাট্টাগোট্টা মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে দরজা খুলে বলল, ‘আপনারা কলকাতা থেকে আসছেন? ডাক্তার কৌশিক কি?’

কৌশিক ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ আমরাই। গতকাল এসেছিলাম লেট হয়ে গিয়েছিল তাই আর দেখা হয়নি।’ মহিলা বললেন, ‘আসুন। এখানে বসুন। দিদিমণি আসছে।’

কৌশিক আর লগ্নজিতা দেখলো, ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের বড় একটা ছবি। গলায় একটা টাটকা রজনীগন্ধার মালা দেওয়া। কর্ণারে একটা বুক র‌্যাক। লগ্নজিতা উঠে গিয়ে দাঁড়ালো বইগুলোর সামনে। রবীন্দ্ররচনাবলি ফুল সেট রয়েছে। আরও কিছু মনোবিজ্ঞানের বইয়ের সঙ্গে সাজানো রয়েছে দু-কপি ‘ইতিহাসের আনাচে কানাচে’—ব্রজমোহন চক্রবর্তী। সোনালী প্রকাশনা।

লগ্নজিতা শুনতে পেল চপ্পলের আওয়াজ। সিঁড়ি বেয়ে নামছেন ডক্টর মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়। লগ্নজিতা ভীষণ রকমের চমকে গেছে ভদ্রমহিলাকে দেখে। বয়েস আন্দাজ বছর বাহান্ন হবে। রীতিমতো সুন্দরী। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা। সবচেয়ে চমকেছে মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন সরলা চক্রবর্তীর যমজ বোন। মুখের এতটা মিল কিভাবে সম্ভব সেটাই ভাবতে পারছে না লগ্নজিতা। কৌশিকও যে চমকেছে সেটা ওর মুখ দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। লগ্নজিতা নমস্কারের ভঙ্গিমা করে বলল, ‘আমি ইন্সপেক্টর লগ্নজিতা ভট্টাচার্য। একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি।’

মেঘবালা ইশারায় বললেন, ‘বসুন।’

লগ্নজিতা বলল, ‘তার আগে একটা প্রশ্ন করতে পারি? আপনি কি সরলা চক্রবর্তীর কেউ হন?’

মেঘবালা হেসে বললেন, ‘উহু সরলা চক্রবর্তীর আমি চূড়ান্ত শত্রু। তবে রিন্তি বন্দ্যোপাধ্যায় আমার জেঠুর মেয়ে ছিল। মুখের মিলের কারণ বোধহয় এটাই। কিন্তু ওইটুকুই। এ সম্পর্ককে কোনোদিন প্রকাশ করতে দেয়নি রিন্তিদি। যাকগে বলুন, আপনারা কেন এসেছেন?’

কৌশিক বলল, ‘ম্যাডাম অমলেন্দু আমার বিশেষ বন্ধু। ওর মাধ্যমেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করি।’ মেঘবালা হেসে বললেন, ‘অমলেন্দু ভারী ভালো ছেলে। আমার ভাইয়ের মতো।’ লগ্নজিতার তখনও ঘোর কাটেনি সেটা ওর চোখ দেখেই বুঝতে পারা যাচ্ছে। সব তালগোল পাকিয়ে যাবার উপক্রম। রাজেন চৌধুরীর মেধাবী ছাত্রী মেঘবালা নাকি সরলাদেবীর খুড়তুতো বোন? ব্রজমোহন এনাকে কেন বই উৎসর্গ করলেন? কেনই বা একটা মোটা অ্যামাউন্ট এনার নামে দিয়ে গেলেন? এদিকে সরলাদেবীর সঙ্গে সম্পর্ক যে সুন্দর বোন-দিদির তেমন তো কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে না। লগ্নজিতা ভূমিকা না করেই বলল, ‘আপনি বোধহয় জানেন ব্রজমোহনবাবু খুন হয়েছেন নিজের ঘরেই। ডক্টর রাজেন চৌধুরী বললেন, ওনারা দুজনেই আপনার পেশেন্ট ছিলেন দীর্ঘদিন। তাই কিছু তথ্যের জন্য আপনার কাছে আসা।’

মেঘবালার ঠোঁটটা কেঁপে উঠল মুহূর্তের জন্য। বাইরে রেখাপাত হতে না দিয়েই স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ বলুন কী জানতে চান?’

লগ্নজিতা বলল, ‘ব্রজমোহনবাবু কি শেষ দিকে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন? মানে ডক্টর হিসেবে কী মনে হয় আপনার, উনি সুইসাইড করতে পারেন?’

মেঘবালা বললেন, ‘হ্যাঁ আমি খবর পেয়েছিলাম ব্রজদা মারা গেছেন। রাহুল আমায় কল করে বলেছিল। বাবা আত্মহত্যা করেছে।’ লগ্নজিতার মনে পড়ল, রাহুলকে যখন ও জিজ্ঞাসা করেছিল, মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাহুল চেনে কিনা, তখন রাহুল বলেছিল, ‘হবে বাবার কোনো রিলেটিভ। ও ঠিক চেনে না।’ কেন যে ছেলেটা এত মিথ্যে বলে কেসটাকে আরও জটিল করে দিল কে জানে!

মেঘবালা বললেন, ‘না ব্রজদা সুইসাইড করতেই পারেন না। ডিপ্রেশনে ভুগেছিলেন কিছু বছর। তৃষার মৃত্যুর পরে। কিন্তু তারপর আমার ওষুধে ওনার খুব কাজ হয়েছিল। বহুদিন আর ওষুধ খেতেও হত না। মাঝেসাঝে কাউন্সিলিংয়েই কাজ হয়ে যেত। কাজ প্রেমী মানুষ তো, নিজেকে ওর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করতেন।’

লগ্নজিতা বলল, ‘আর সরলাদেবী? ওনার কথা বলুন প্লিজ।’ মেঘবালা বললেন, ‘সরলাদির মধ্যে অদ্ভুত কমপ্লেক্স ছিল। যেটা এত চেষ্টাতেও আমি সারাতে পারিনি। বছরখানেক আর আসতো না আমার কাছে। কলকাতাতেই কোনো এক ডক্টরের আন্ডারে ছিল শুনেছি। আমি বরং ওর ছোটবেলাটা বলি, তাহলে বুঝতে পারবেন ওর সমস্যার সূচনা অনেক গভীরে। আমার জেঠুরা একসময় বেশ অবস্থাপন্ন ছিল। জেঠু বড় চাকরি করত। হঠাৎ করেই জেঠুর নার্ভের প্রবলেম দেখা যায়। চাকরিটা চলে যায় দিনের পর দিন কামাই করতে করতে। জেঠুর মানসিক সমস্যাও দেখা দিয়েছিল। কাউকে চিনতেই পারছিল না ভালো করে।

তখন রিন্তিদি স্কুলের স্টুডেন্ট। যেমন গানের গলা, তেমন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। কিন্তু জেঠুর চাকরিটা চলে যাওয়ায় ওদের পরিবারটা বিপদে পড়ে যায়। রিন্তিদির দাদা একটা চাকরি জোগাড় করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি বাড়ির সঙ্গে। বাধ্য হয়ে জেঠিমাকে সবরকম কাজ করতে হয়।’ লগ্নজিতা বলল, ‘সবরকম বলতে?’ মেঘবালা বললেন, ‘দুটো বাড়িতে রান্নার কাজ নিয়েছিল। সন্ধেতে টিউশনিও করত। সত্যি বলতে দ্বিধা নেই, আমার বাবা বা ছোটকাকু দু-একদিন দাদাকে সাহায্য করলেও ওদের অভাব দেখে সবাই দূরে সরে আসে। নিত্য অভাবের আত্মীয়কে যেমন সবাই এড়িয়ে চলে তেমনই। তখন থেকেই রিন্তিদির হীনমন্যতার শুরু। ওর মনে হত, ভালো ছেলে ওকে বিয়ে করবে না কোনোদিন ওর মায়ের পেশা জানলে। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারপর আমি পড়াশোনার জন্য হোস্টেলে চলে যাই। রিন্তিদি নাটকের দলে জয়েন করে। ওখান থেকে বোধহয় একটা হাত খরচ পেতো। ততদিনে জেঠু একটু সুস্থ হয়েছিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে রিন্তিদির পড়াশোনা যাতে নষ্ট না হয়ে তাই জেঠিমা এত চেষ্টা করার পরও রিন্তিদি মাকে একটুও সম্মান করত না। বরং মায়ের পরিচয় দিতে চাইতো না কাউকে। জেঠিমা কষ্ট পেতো। কিন্তু রিন্তিদির মাথায় ঢুকেছিল, ওর গরিব বাবা-মা জানলে কোনো রাজপুত্র ওকে বিয়ে করবে না। ভীষণ সুন্দরী গুণী একটা মেয়ের কমপ্লেক্স তৈরি হল। তারপর আমাদের সঙ্গে আর যোগাযোগই চলে গেল প্রায়। আমার দাদাভাইয়ের কলেজের প্রফেসর একদিন এসেছিল আমাদের বাড়িতে। ব্রজমোহন চক্রবর্তী। সুপুরুষ, ব্যচিলর। আমার মায়ের বোধহয় শখ হয়েছিল ওনার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবার। আমি তখন সদ্য ডাক্তারি পাশ করেছি। আমার থেকে ব্রজদা প্রায় বছর বারোর বড়। হঠাৎই শুনলাম, ব্রজদা রিন্তিদির নাটক দেখতে গিয়ে ওর গানের ভক্ত হয়ে গেছেন। তারপর রিন্তিদি বোধহয় ওনার কাছে দু-একদিন টিউশন নিতেও গিয়েছিল। তারপরেই ভালোবেসে বিয়ে হয় ওদের। রিন্তিদি অনেক দূরের মানুষ হয়ে যায়। বড়লোক বাড়িতে বিয়ে করে আমূল বদলে গিয়েছিল রিন্তিদি। ভীষণ অহংকারী হয়ে উঠেছিল। ওদিকে আমি প্র্যাকটিস শুরু করি রাজেন স্যারের আন্ডারে। দীর্ঘদিন ওদের খবর রাখিনি। রিন্তিদির বাচ্চা হয়েছে শুনেছিলাম। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে আসি শান্তিনিকেতনে। আমার স্বপ্নের শহরে। এখানেই বাস শুরু করি।

কলকাতার কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ তেমন ছিল না।’ লগ্নজিতা বলল, ‘আপনি তাহলে একাই থাকেন?’

মেঘবালা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ। বিয়ে করিনি আমি। ওই ইচ্ছে কোনোদিনই ছিল না। নিজের জীবনটা নিজের শর্তে, নিজের ইচ্ছেয় পরিচালনা করব এটাই প্রায়োরিটি ছিল। হঠাৎই এত বছর পরে ব্রজদা আর রিন্তিদি আমার চেম্বারে এলো কারণ রিন্তিদি মানসিকভাবে অসুস্থ।

আমাকে দেখেও চিনতে পারল না। ব্রজদা ইশারায় বললেন, পুরোনো কথা বেশি জিজ্ঞাসা না করতে। ব্রজদা জানতেন না রিন্তিদির অতীত জীবনে এমন একটা না পাওয়া, অপমান, অবহেলা ঘাপটি দিয়ে বসে আছে যে সেটাই এই রোগের উপসর্গ। কথা বলতে বলতেই তৃষার মৃত্যুর কারণ, মৃন্ময় বলে একজনের প্রতি রিন্তিদির বিদ্বেষ জানতে পারি। আমি ট্রিটমেন্ট শুরু করি। রিন্তিদি আবার গান শুরু করে নতুন করে। একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছিল। কলেজ থেকে ফিরে প্রায়ই নন্দন কিংবা গিরিশ মঞ্চে নাটক দেখতে নিয়ে যেত ব্রজদা আমারই পরামর্শে। বেশ সুস্থ হয়ে উঠছিল। তারপরে আবারও সমস্যা তৈরি হল। ব্রজদা নাকি নাটক দেখতে যায় নাটকের মহিলাদের দেখবে বলে, এই সন্দেহের বশে সব বন্ধ হল। বাড়িতে যে গানের দিদিমণি আসছিলেন তার সঙ্গে জড়িয়ে ব্রজদাকে বিশ্রীভাবে বদনাম করল রিন্তিদি। নিজেও ভালো থাকতে চাইত না, অন্যকেও ভালো থাকতে দেবে না।

দিনরাত ব্রজদাকে, রাহুলকে নানাভাবে অত্যাচার করেই যেত। দু-একবার ব্রজদার গলা চেপে ধরে মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছে রিন্তিদি। তারপর প্রায় মাসখানেক আর কোনো যোগাযোগ করল না আমার সঙ্গে। আমি ব্রজদাকে কল করলেও কেটে দিত। এমনিতেই ব্রজদার ফোনে অ্যালার্জি। চিঠি লেখা পছন্দ করত। প্রায় মাস দেড়েক পরে আমার এই ঠিকানায় একটা চিঠি এসে পৌঁছালো, ব্রজদা লিখেছে। মেঘবালা আমি আর বাঁচতে চাই না। এ জীবনের সব প্রাপ্য পেয়ে গেছি। সরলাই মিটিয়ে দিয়েছে। রাহুল মৃন্ময়ের মেয়েকে ভালোবাসে। সেই নিয়ে আবারও অশান্তির সূত্রপাত। আমি রাহুলের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছি বলে, দুদিন রাতে আমায় মেরে ফেলতে চেয়েছে। ভাবছি সরলাকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে দিয়ে আসব। আর পারছি না।

আমি ব্রজদাকে বললাম, আরেকবার নিয়ে এসো আমার কাছে। দেখি শেষ চেষ্টা করে। সেবারে ব্রজদা নয়, রাহুল নিয়ে এলো। রাহুলের কাছেই শুনলাম, রাতে ঘুমের ঘোরে ব্রজদার গলা টিপে ধরতে চেয়েছিল। তাই আপাতত ব্রজদা লাইব্রেরি রুমে থাকে। মধ্যরাত পর্যন্ত বই পড়ে, ঘুমাতেও ভয় পায়। দরজা বন্ধ আছে কিনা বারবার নাকি চেক করে। রিন্তিদি চুপ করে বসেছিল চেম্বারে এসে। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়। আচমকা বলল, চন্দ্রজার সঙ্গে বাপ-ছেলে দুজনের রিলেশন আছে। ওই জন্যই ওকে বউ করে আনতে চাইছে ব্রজ। আমি হতে দেব না। ব্রজ আমায় তাড়িয়ে দেবে তারপর। আমার বাবা-মা নেই, কোথায় যাব? মায়ের মতো রান্না করব লোকের বাড়িতে?

বুঝলাম, সেই কষ্ট এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে। রাহুলকে বললাম, এখানে রেখে যাও দিন কয়েকের জন্য। আমি দেখি। এখানের একটা নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। ওখানে নিয়ে গেলাম। ওরা রবীন্দ্র নাটক মঞ্চস্থ করার প্ল্যান করছিল। রিন্তিদি মেতে উঠল। যে মানুষটা আমায় চিনতে পারছিল না, সে সঠিক সংলাপ বলছিল নাটকের। তেমনি অসাধারণ অভিনয়। প্রায় সপ্তাহখানেক থেকে, নাটক মঞ্চস্থ করে, হাততালি পেয়ে প্রায় সুস্থ হয়ে ফিরে গেল। তারপর একদিন ব্রজদা এলো উদ্ভ্রান্তের মতো। চোখের নীচে কালি। জীবনের সব রংটুকু যেন হারিয়ে ফেলেছেন। কাউন্সিলিং করতে শুরু করলাম। ব্রজদার দুর্বলতা ওর বংশ। বললাম, বইপত্র লেখো। তোমার বংশের সব ঐতিহ্যগুলো পৌঁছাক মানুষের কাছে। নাহলে তো মানুষের অজানাই রয়ে যাবে চক্রবর্তীদের সম্পর্কে। ব্রজদা মেতে উঠল বইয়ের কাজ নিয়ে। ‘ইতিহাসের আনাচে কানাচে’ লিখল। আমি তখন ব্রজদার একমাত্র ভরসা দেবার বন্ধু। প্রতিটা লাইন লিখেই আমায় শোনাত। আমি উৎসাহ দিতাম। বই উৎসর্গ করল আমায়।’ লগ্নজিতা বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ম্যাম? এটা কি শুধুই ডক্টর আর পেশেন্টের সম্পর্ক ছিল? নাকি আরেকটু বেশি কিছু?’

মেঘবালা খুব স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেন। হেসে বললেন, ‘না ব্রজদার দুর্বলতা তৈরি হচ্ছিল আমার প্রতি। আমিই একমাত্র মহিলা যে ওনাকে বনলতা সেনের মতো একটু শান্তি দিয়েছিলাম বোধহয়। কিন্তু সেখানেও সমস্যা দেখা দিল। আমার সঙ্গে রিন্তিদির মুখের এতটাই মিল যে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ব্রজদার সমস্যা হচ্ছিল। এরপরে আপনি প্রশ্ন করবেন, আমার দুর্বলতা ছিল না? হ্যাঁ ছিল। চোখের সামনে একজন প্রাজ্ঞ মানুষকে শেষ হতে দেখে কষ্ট হত। চেষ্টা করতাম হাতটা ধরে রাখার। আপনি জিজ্ঞাসা করবেন হয়তো, আপনাদের মধ্যে ফিজিক্যাল রিলেশন হয়নি?

আমি বলব, না হয়নি। ইচ্ছে হয়নি দুজনেরই। ব্রজদা মানসিক শান্তির জন্য একটা বন্ধু চেয়েছিল। আমি কিছুই চাইনি, শুধু দিতে গিয়ে মানসিকভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। রিন্তিদি এরপর আমায় চিনতে পারে। সোজা চেম্বারে ঢুকেই আমার গলা চেপে ধরে বলে, কেড়ে নিতে চাস আমার সবকিছু? ছোট্ট থেকে তোরা চেয়েছিস আমি খারাপ থাকি। তুই আমায় ওষুধ দিয়ে মেরে ফেলবি, তারপর ব্রজর সব সম্পত্তি ভোগ করবি। আমি বুঝলাম, আর রিন্তিদি আমায় বিশ্বাস করবে না। তাই ব্রজদাকে বললাম, অন্য ডক্টরের কাছে যেতে। কিন্তু ব্রজদা তখন রিন্তিদি সম্পর্কে সব উৎসাহ হারিয়েছিল। এক চূড়ান্ত বিরক্তি এসেছিল মানুষটার প্রতি। যে মানুষটা রিন্তিদিকে প্রশ্রয় দিত, ভালোবাসত, স্নেহ করত, সব পাগলামিকে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইতো সেই মানুষটা চূড়ান্ত ঘৃণা করতে শুরু করল রিন্তিদিকে। এটা সামলানোর ক্ষমতা আমার ওষুধের ছিল না। প্রায়ই এক প্রকাশকের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে এসে থাকত। তার বাংলোয় বসে দুজনে কিসব হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করত।

তারপর তো কলকাতাতেও একদল বন্ধু তৈরি হয়েছিল, যাদের সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে বেরোত। আমার মুখটা ওর বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। ততদিনে আমি ব্রজদাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। খুব চাইতাম, ব্রজদা শান্তিনিকেতন এলে আমার বাড়িতে আসুক। কিন্তু ব্রজদা আসতে চাইত না। রাস্তায় দেখা হলে, আলগাভাবে জিজ্ঞাসা করত, ভালো তো? আমি একদিন ওই প্রকাশক বিমানবাবুর বাংলোতে গেলাম নিজেই। দেখলাম দুজনে প্রচুর বইপত্র খুলে কিসব লিখছেন। আমায় দেখেই ব্রজদা রেগে গেল। বলল, সরলার মতো মুখের মেয়েরা কখনও ভালো হতে পারে না মেঘবালা। আমার সম্পত্তির জন্য আমার সঙ্গে মিশতে চাও কি? তাহলে কথা দিচ্ছি একটা বড় অ্যামাউন্ট মরার আগেই রেখে যাব তোমার নামে। আমি বাইরের ভদ্রলোকের সামনে চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে ফিরে আসি। ব্রজদা নিজের মতো থাকত তারপর। শান্তিনিকেতন এসেছে খবর পেতাম কিন্তু দেখা হত না। রিন্তিদিও আর বিশ্বাস করে আমার ওষুধ খায়নি। রাহুল নিজে এসে নিয়ে গিয়েছিল বার দুয়েক। তারপর আমিই বলেছিলাম, পেশেন্ট না দেখে এভাবে ওষুধ দেওয়ার সমস্যা। কারণ ততদিনে আমি সরলা চক্রবর্তীকে ভয় পেতে শুরু করেছিলাম। হয়তো নিজেই কিছু করে বসবে দিয়ে বলবে ডক্টর মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওষুধ খেয়ে এটা হল।

তারপর প্রায় বছর খানেক আর কোনো যোগাযোগ নেই ওদের সঙ্গে। আমিও আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ওই প্রকাশক ভদ্রলোক মাঝে মাঝে খবর দিতেন ব্রজদার। ওইটুকুই যা। আমার নিস্তরঙ্গ শান্তিনিকেতনের সন্ধেগুলো কেটে যাচ্ছিল পেশেন্টদের মনের কষ্ট শুনে শুনেই। কবে যেন নিজের মনের কষ্টগুলো ভুলতে শুরু করলাম।

ব্রজদাকে আর কোনো ফোন করিনি কখন। ওই অপমান ভুলতে পারিনি। আমি চক্রবর্তীদের সম্পত্তি পাবার আশায় ব্রজদার বন্ধু হইনি। আমি একজন নিঃসঙ্গ মানুষের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলাম। আমার হাত ধরে সেই ডিপ্রেশন, সেই দমবন্ধ দিনগুলো ও পেরিয়ে গিয়েছিল তারপর আমাকেই এভাবে অপমান করেছিল, তাই ভালোবাসা থাকলেও শ্রদ্ধা আর অবশিষ্ট ছিল না।

হঠাৎই মাস তিনেক আগে ব্রজদা হাজির আমার এই বাড়িতে। হাতে একটা ব্যাগ। আমি দেখেই বলেছিলাম, আবার কী মনে করে? স্ত্রী অসুস্থ বলে? কলকাতায় ডাক্তারের অভাব নেই। আমাকে রেহাই দাও।

ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা রেখে দাও তোমার কাছে। আমি জেরক্স দিয়ে কাজ চালাবো। গুপ্তধনের সন্ধান আছে এতে। অনেককে আবেগের বশে বলে ফেলেছি। অরিজিনালটা থাকলে চুরি হতে পারে।

আমি বলেছিলাম, আমার তো কোনো গুপ্তধনের দরকার নেই ব্রজদা। কোনো সম্পত্তির দরকার নেই। আমার যেটুকু আছে, সুন্দরভাবে চলে। এসবে আমায় জড়িও না প্লিজ। আমার হাতটা ধরে বলেছিল, মেঘবালা ক্ষমা করো আমায়। তোমার কাছে এলে শান্তি পাই আমি। কিন্তু তোমার মুখের দিকে তাকালে আবারও সরলার দেওয়া নরকযন্ত্রণাময় জীবনটার কথা মনে পড়ে যায়। তাই না পারি তোমায় বন্ধু ভাবতে, না ভালোবাসতে! অথচ আমি চাই তোমার বন্ধুত্ব। আসলে তুমি তো মনের ডাক্তার তাই আশাকরি বুঝতে পারো আমার সমস্যাটা কোথায়! সরলা আজীবন মৃন্ময়কে চেয়ে গেল বলে আমার কোনো সমস্যা নেই মেঘবালা। আমার সমস্যা ও আমাকেও বাঁচতে দিল না শান্তভাবে। একটা কাজের মেয়ের সঙ্গে সন্দেহ, একজন কলিগকে নিয়ে সন্দেহ, এমনকী হবু পুত্রবধূকে নিয়েও নোংরা ইঙ্গিত পেতে পেতে মনে হয় আমি বোধহয় বড্ড দুশ্চরিত্র। তাই কারোর সঙ্গে স্বাভাবিক হতেই পারি না। অথচ সরলা জানে আজ অবধি আমি ওকে ছাড়া কাউকে কোনো দিন স্পর্শ অবধি করিনি। দুর্বলতা যদি বলো এই প্রথম সরলা বাদ দিয়ে তোমাকে নিয়ে একটু তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বয়েস হল, আর এই বয়েসে তোমার বদনাম চাই না। ব্রজদার চোখে জল দেখেছিলাম সেদিন। ব্যাগটা দিয়ে চলে গেল যেমন এসেছিল। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠে কলকাতা ব্যাক করল। আবারও যোগাযোগ ছিন্ন হল। ব্রজদা বলত, মেঘবালা আমি একটা অবৈধ সম্পর্কের সঙ্গে জীবনটা কাটালাম। যেখানে না আছে ভালোবাসা, না আছে শ্রদ্ধা। শুধু বিয়ের চিহ্ন ছাড়া এ সম্পর্কে আর কিছুই নেই। মৃন্ময়কে আজীবন একাগ্র মনে চেয়ে যাওয়া সরলার মনের কোথাও আমি ছিলাম না মেঘবালা, কোনোদিনই ছিলাম না। তাই এ সম্পর্ক বড্ড অবৈধ, আসলে ভালোবাসাহীন সম্পর্কগুলো সমাজের চোখে আবার বৈধতা নিয়ে বসে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্রজদা বলত, একই মুখশ্রীর দুটো মানুষের ব্যবহারে কত অমিল!’

কৌশিক উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘সেই ডায়েরিটা কি আপনার কাছে আছে ম্যাডাম?’

মেঘবালা বলল, ‘হ্যাঁ ছিল তো। কিন্তু ব্রজদা মারা যাবার দিন তিনেক পরে আমি সন্ধের দিকে একটু মার্কেটে গিয়েছিলাম, কয়েকটা জিনিস কেনার ছিল। বাড়ি ফিরে দেখলাম, বাড়ির তালা খোলা। আমার মেডও আমার সঙ্গেই ছিল। প্রথমে বুঝিনি বিষয়টা কী! ঘরে ঢুকে বুঝলাম, কেউ তন্নতন্ন করে কিছু খুঁজছে। কী হারিয়েছে বুঝতেও পারিনি। এক নজরে সবই ছিল বাড়িতে।

পরের দিন খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, ব্রজদার দেওয়া ডায়েরিটা নেই। আমি থানায় গিয়ে এফ আই আরও করে এসেছি। কিন্তু কই আর পেলাম। এখন রাহুলকে আমি কী ফেরত দেব কে জানে। রাহুলের বাবার মতো ও হয়তো ভাববে চক্রবর্তীদের গুপ্তধনের প্রতিই আমার লোভ ছিল।

কিন্তু অফিসার আমি আদৌ এক বর্ণ বুঝিনি ওই ডায়েরির।’ লগ্নজিতা বলল, ‘বর্ণনা করতে পারবেন?’

মেঘবালা বলল, ‘একবারই কৌতূহলবশে খুলেছিলাম ব্যাগটা। দেখলাম একটা পুরোনো চামড়ায় ডায়েরি। সামনে সোনার লক করা। তাতে একটা ছোট্ট চাবি ছিল। চাবিটা দুবার সামনের দিকে দুবার পিছনের দিকে ঘোরালে খুলে গেল। ভিতরে একটা অপরিচিত ভাষায় লেখা বা আঁকা আছে শেষ পর্যন্ত। যতদূর মনে হল ভাষাটা মিশরীয় ভাষা। আমি মনে করেছিলাম ব্রজদা হয়তো মুখে না বলতে পেরে এভাবে লিখে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, তাই আগ্রহ নিয়ে খুলেছিলাম। শেষপর্যন্ত অপরিচিত লেখা দেখে বিরক্ত হয়ে তালা দিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। চাবিটাও ওই ডায়েরির সাইডের পকেটে রেখেছিলাম। মুখের ওখানের সোনার তালার জন্য যে এটা চুরি হতে পারে ধারণা ছিল না।

লগ্নজিতা বলল, ‘আপনি শিওর আপনার বাড়ির তালা ভাঙা ছিল না খোলা ছিল?’ মেঘবালা বললেন, ‘হ্যাঁ খোলা ছিল।’ লগ্নজিতা চিন্তিত গলায় বলল, ‘এর চাবি কি আর কাউকে দিয়েছিলেন?’ হ্যাঁ এ বাড়ির আরেক সেট চাবি ব্রজদাকে দেওয়া ছিল। তাতে লেখাও ছিল ‘বিদায় বেলায়।’ কিন্তু রাহুল আমার বাড়িতে চুরি করতে এসেছিল এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। ব্রজদার যেমন ঐশ্বর্যে লোভ ছিল, আরও সম্পদ করার দিকে মন ছিল, বংশের গুপ্তধন খোঁজায় মন দিয়েছিল, রাহুল কিন্তু সম্পত্তি নিয়ে সামান্যতম আগ্রহ প্রকাশ করত না।’

লগ্নজিতা বলল, ‘এই বাড়ির চাবি আর কার কার কাছে ছিল ডক্টর?’ মেঘবালা বললেন, ‘আরেক সেট দিয়েছিলাম ব্রজদাকে। যদি কখনও আমি না থাকি, শান্তিনিকেতনে এসে যেন রাস্তায় না দাঁড়াতে হয় তাই। আর কারোর কাছে ছিল না।’ মেঘবালার চোখে ফেলে আসা দিনের স্মৃতির আঁকিবুঁকি। ঠিক যেন কুয়াশাচ্ছন্ন লালবাঁধ। মেঘবালা বললেন, ‘সে চাবির ব্যবহার একবারই করতে হয়েছিল ব্রজদাকে। যখন রিন্তিদির সঙ্গে ঝগড়া করে চলে এসেছিল এখানে। তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না। তিনদিনের জন্য কলকাতা গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে এসে দেখি রান্নাঘরে ভাত ফোটার গন্ধ। ব্রজদা রান্না করছে আর হেঁড়ে গলায় গুনগুন করে গান গাইছে। ওই একবারই চাবি দিয়ে তালা খুলেছিল এই বাড়ির। বাকি তো আমি থাকাকালীন এসেছে রিন্তিদিকে নিয়ে, নয়তো চেম্বারে বসে চলে গেছে ফিরে।’ লগ্নজিতা বলল, ‘ওই চাবি রাহুলের কাছে আসা সব থেকে সহজ। রাহুল এসে চুরি করেনি তো?’

মেঘবালা বললেন, ‘আমারও প্রথম এই নামটার কথাই মাথায় এসেছিল। তারপর মনে হল এ তো রাহুল আমায় চাইলেই আমি দিয়ে দিতাম। অযথা চুরি করতে যাবেই বা কেন!’ কৌশিক বলল, ‘আচ্ছা আপনার মেড মেয়েটি কেমন? মানে ও এটা করার সম্ভাবনা কি একেবারেই নেই?’

মেঘবালা হেসে বললেন, ‘বাড়িতে দুর্মূল্য জিনিস তো কিছু কম নেই। আমার ড্রয়ারে টাকাও থাকে বেশ ভালোই। সেসব না নিয়ে ওই ডায়েরি যার একবর্ণ আমি বুঝতে পারলাম না সেটা ওই আদিবাসী মহিলা নিয়ে করবেই বা কী? তাছাড়া এরা ভীষণ বিশ্বস্ত। আমার ঘরের প্রতিটা জিনিস ও গুছিয়ে রাখে। ওই চুরিতে বাড়ির একটা সামান্য জিনিস খোয়া যায়নি, শুধু ডায়েরিটা ছাড়া। ব্রজদার একটা বড় রোগ ছিল। উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলে আর মুখের লাগাম থাকত না। আমার স্থির বিশ্বাস বন্ধুমহলে সকলকেই বলেছিল, এ ডায়েরি আমার কাছে গচ্ছিত আছে। আর এই ডায়েরিতে চক্রবর্তীদের বিশাল গুপ্তধনের সন্ধান আছে। সেই কারণেই ওই পুরোনো চামড়ার ডায়েরিটা চুরি গেল। বাসুদেব নামের কোনো এক বন্ধু তো বহুদিন ব্রজদার পিছনে পড়েছিল শুনেছি, ব্রজদার মিশরীয় কয়েন বা দুর্মূল্য মূর্তি এসব নেবে বলে। প্রচুর টাকা অফারও করেছিল একটা ইউনিক আনুবিসের মূর্তির জন্য।’

কৌশিক বলল, ‘আনুবিসের মূর্তি তো কিনতে পাওয়া যায়। তাহলে?’

মেঘবালা বলতে শুরু করলেন—’আসলে আনুবিস ছিলেন দেবতা নেপথিস ও সেত এর পুত্র। সদ্যমৃত ব্যক্তিকে মর্ত্যলোক থেকে মৃতদের দেশ পাতালপুরীতে নিয়ে যাওয়ার পথে নিরাপত্তা দিতেন আনুবিস। মৃত ব্যক্তি আকাশের তারায় পরিণত হতে পারবেন কি না, তা বিচারের ভারও ছিল আনুবিসের ওপরে। আনুবিসের হাতে পালকযুক্ত দণ্ড থাকত যা দিয়ে মৃতের বিচার হত। যদি হৃদয়ের ওজন পালকের ওজনের চেয়ে কম হত তবে মৃত ওরিসিসে প্রবেশের অনুমতি পেত। আর ওজন বেশি হলে তার আত্মা ধ্বংস করে ফেলা হত। এমনই প্রচলিত ছিল গ্রিক ইতিহাসে। এই যে অনুবিসের হাতে একটা পালক যুক্ত দণ্ড থাকার কথা এটার বদলে নাকি একটা দাঁড়িপাল্লা ছিল। তার একদিকে ছিল একটা ছোট্ট পাখি অন্যদিকটা ফাঁকা। ওটা সম্ভবত মৃতের হৃৎপিণ্ডের ওজন মাপার জন্য। এই অন্যরকম আনুবিসের মূর্তি নাকি এক বিশেষ রাজার আমলে কিছুদিনের জন্য চালু হয়েছিল। কিন্তু মিশরীয়রা আপত্তি করায় উঠে যায়। ওই বিশেষ সময়ের একটা মূর্তি আছে ব্রজদার কাছে। সেটার ওপরেই নজর ছিল বাসুদেববাবুর। ব্রজদা ওকে ডায়েরির কথা বলতে, ও তো হায়রোগ্লিফ পড়তে পারে এমন লোককেও নাকি হাজির করেছিল। কিন্তু ব্রজদা কাউকে বিশ্বাস করত না। তাই কাউকে দেখায়নি ওটা। এগুলো ব্রজদার মুখেই শোনা। কিন্তু এটাই যে সেই ডায়েরিটা এটা আমি পরে বুঝতে পারি। অমন একটা জিনিস ভরসা করে ব্রজদা দিয়ে গিয়েছিল আমায়, আর আমি সেটা রাখতে পারলাম না।এটাই খারাপ লাগছে জানেন। প্লিজ অফিসার ওটা উদ্ধার করে রাহুলের হাতে পৌঁছে দিন।’

লগ্নজিতা বলল, ‘ডক্টর ব্রজমোহন চক্রবর্তী আপনার নামে মোটা টাকাও রেখে গেছেন। ওটার নোমিনি আপনি।

মেঘবালা একটু চমকে উঠে বললেন, না না ওটাকা আমি নিতে পারব না। ওসব সম্পত্তি রিন্তিদির আর রাহুলের। আমি রাহুলকে দিয়ে দেব। কেন যে ব্রজদা বুঝলো না আমায়। যদি বুঝত তাহলে এভাবে অসম্মান করে যেতে পারতো না। আমার নামে টাকা রেখে ব্রজদা আমাদের বন্ধুত্বটাকে অপমান করে গেল। মেঘবালার গলাটা সামান্য কেঁপে গেল যেন।’ লগ্নজিতা বলল, ‘কিন্তু ম্যাডাম যে ডায়েরির জন্য ব্রজমোহন খুন হয়েছে বলে আমরা মনে করছি সেই ডায়েরিটা আপনার বাড়িতেই ছিল গত তিনমাস। অথচ খুন হবার তিনদিনের মধ্যে চুরি হয়ে গেল এটা যেন বড্ড অবিশ্বাস্য লাগছে। আসলে পুলিশের মন তো, বড্ড নোংরা ঘেঁটে অভ্যস্ত।

মেঘবালার মুখে কোনো বিরক্তি নেই। বললেন, ‘আপনি প্লিজ বাড়িটা সার্চ করে দেখতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই। আপনারা আপনাদের ডিউটি করছেন। আমি কিছু মনে করব না।’ কৌশিক ইশারায় লগ্নজিতাকে নিষেধ করল। লগ্নজিতা বলল, ‘ধন্যবাদ ডক্টর। আমি একটু ঘুরে দেখছি।’ দোতলার ঘর, ড্রয়িং সব ঘুরে ফেলল লগ্নজিতা। না ডায়েরি যে এখানে পাওয়া যাবে না সে ব্যাপারে ও নিশ্চিত ছিল। মেঘবালা অত বোকা নন যে দোতলায় ডায়েরি সাজিয়ে রেখে চুরি যাওয়ার গল্প সাজাবেন। যদি উনি সরিয়েও থাকেন সেটা করার পরেই এসব চুরির গল্প তৈরি করে রেখেছেন। তাই ডায়েরিটা যে পাবে না সেটা নিশ্চিত লগ্নজিতা। ভদ্রমহিলা মনের ডাক্তার। তাই মানুষের মনের ঠিক যেই জায়গাটায় গিয়ে কড়া নাড়েন যেখানের দরজাটা মানুষ খুলতে চাইছিল বহুদিন ধরে। অথচ সাহসের অভাবে সেটা হয়ে উঠছিল না। ঠিক যেমন লগ্নজিতা বারবার ওনার সিঁড়ির দিকে তাকাতেই উনি ঘর সার্চ করার কথাটা বলে দিলেন নির্দ্বিধায়। সার্চ ওয়ারেন্ট নেই, তাই বলেও উঠতে পারছিল না। কিন্তু মনের ডাক্তার মেঘবালার সেটা বুঝে উঠতে সময় লাগেনি। লগ্নজিতা গোটা দোতলা ঘুরতে ঘুরতে একটা জিনিসে চোখ আটকে গেল, বইটা খুলে একটু অবাকই হল লগ্নজিতা। চট করে উপহারের পাতাটার ছবি তুলে নিল। কেন কে জানে তদন্তে নেমে একটা অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে ব্রজমোহনবাবুর জন্য। আর ততই চোয়াল শক্ত হচ্ছে, অপরাধীকে জেলে ঢোকাতেই হবে। উপযুক্ত শাস্তি দিতেই হবে।

মেঘবালার বেডরুমটা বেশ সাদামাটা। রুচির ছাপ থাকলেও বৈভবের চিহ্ন নেই। ব্রজমোহনের অর্থ আত্মসাৎ করার ইচ্ছে হয়তো সেভাবে কোনদিনই ওনার মাথায় ছিল না। কিন্তু এবাড়ি থেকে তালা খুলে ডায়েরিটাই চুরি করে নেবে তাও আবার মেঘবালারই দেওয়া চাবি দিয়ে এটা একমাত্র সম্ভব রাহুল আর সরলাদেবীর দ্বারা। কারণ ব্রজমোহনের কাছ থেকে এ চাবি ওরাই পেতে পারে একমাত্র। আরেকজন হতে পারে অবশ্য, মন্টু। ব্রজমোহন ওকে রাহুলের থেকেই বেশি বিশ্বাস করত। তবে কি মন্টুই ডায়েরিটা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল তখনই খুন হয় ছেলেটা? কিন্তু কার নির্দেশে এসেছিল মন্টু এ বাড়িতে? রাহুল না সরলাদেবী? কেউই হয়ত চাইতো না মেঘবালার কাছে তাদের বংশের জিনিস থাকুক। মেঘবালাকে ফেরত চাইলে সে অস্বীকারও করতে পারত, তাই কি এই চুরি? নাকি মেঘবালা গোটাটাই বানিয়ে বলছে নিজের সুবিধা মতো!

লগ্নজিতা নীচে নেমে শুনল, ভদ্রমহিলা ওকে নিয়ে কৌশিককে জ্ঞান দিচ্ছেন।

‘এমন ধরনের প্রফেশনে যারা আছেন তারা ইচ্ছে করলেও কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না কৌশিক। কারণ ওনার ডিউটি ওনাকে আটকে দেয়। এটাই তো সৎ অফিসারের গুণ। এটাতে আপনি বিরক্ত হবেন না। আপনারা ভবিষ্যতে একই ছাদের নীচে থাকতে চলেছেন, তাই দুজনকে বুঝে নেওয়াটা খুব জরুরি।’ কথাটা লগ্নজিতার কানে খট করে লাগল। উনি কোথা থেকে জানলেন, ওরা ভবিষ্যতে একই ছাদের নীচে থাকবে? তবে কি এই অবসরে কৌশিক ওনাকে এসব গল্প করে ফেলেছে?

লগ্নজিতা ফিরে আসতেই মেঘবালা বললেন, ‘যে কোনো প্রয়োজনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তবে রাত্রি আটটার পরে নয়। ওই সময়টা আমি নিজের জন্য রাখি।’ লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই।’

বাইরে বেরিয়ে এসেই কৌশিক একটু বিরক্ত স্বরেই বলল, ‘উনি এতটা সত্যি বলার পরেও তুমি অযথা ওনার ঘর সার্চ করতে গেলে। এটা খুব অন্যায় হল ভদ্রমহিলার সঙ্গে।’

লগ্নজিতা বলল, ‘পেশায় উনিও ডাক্তার বলে তোমার এই পার্সিয়ালিটি একেবারেই উচিত নয় কৌশিক। এটার থেকে আগে বেরিয়ে এসো তারপর কয়েকটা কথা আলোচনা করব।’

কৌশিক বলল, ‘আরে মেঘবালা ম্যাডাম সত্যি বলছিলেন, আমি ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলাম।’

লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘কৌশিক ভদ্রমহিলার মনে হচ্ছে কোলেস্টরেল আছে বুঝলে।’ কৌশিক অবাক হয়ে বলল, ‘ফালতু বলছো। তুমি ওনাকে একবার দেখে বুঝে গেলে এটা? আমি ডাক্তার হয়ে বুঝলাম না। আরে চব্বিশঘণ্টা ওই করছি গো।’

লগ্নজিতা বলল, ‘আমিও চব্বিশঘণ্টা নিরীহ মুখের, ইনোসেন্ট মুখের খুনি অপরাধী দেখছি কৌশিক। তাই আপাত নিরীহ চোখের আড়ালে কতবড় অপরাধী লুকিয়ে থাকে সেটা আমিই ধরতে পারি না। আর তুমি ওনার চশমার মোটা পাওয়ারের মধ্যে দিয়ে চোখ দেখে বুঝে ফেললে উনি সব সত্যি বলছেন?’

কৌশিক এতক্ষণে বুঝল, লগ্নজিতা ওকে ব্যঙ্গ করছে। এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বোঝার ক্ষমতা ওর নেই। তাই রাগ করে একটু জোরে জোরে পা চালিয়ে চলল। মনে ক্ষুদ্র আশা ছিল, জিতা বলবে রাগ করলে? অত জোরে হাঁটছ কেন?

কিন্তু একটাও ডাক না পেয়ে পিছন ঘুরে দেখল, লগ্নজিতা নেই। এ তো মহামুশকিল। গেল কোথায় মেয়েটা! কেউ আবার তুলে নিয়ে চলে গেল না তো দিনের আলোয়! যতবার এর সঙ্গে কৌশিক মান-অভিমান করতে গেছে ততবার এরকম দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে ও।

ফোনটা বের করে কল করতে যাচ্ছিল জিতাকে। তার আগেই একটা মেসেজ ঢুকল। রাগ করে জোরে পা চালিয়ে বাংলোতে চলে যাও। মহাদেবদা খাবার রেডি করে রেখেছে, খেয়ে ঘুমিয়ে নিও। আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। ফিরে গিয়ে বাকি ঝগড়া করব।

কৌশিক রাগে দুবার লালচে মাটিতে পা ঠুকে নিল। এই মেয়েকে কেউ ভালোবাসে? অদ্ভুত টাইপের মানুষ একটা। যত ঝামেলা যেন কৌশিকেরই। এখন ভেবে মর, কোথায় গেলেন তিনি। কেন যে আগে আগে চলতে গেল। ধুত্তোর।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন