অর্পিতা সরকার
‘আমার স্মৃতি যদি সেভাবে বিট্রে না করে তাহলে তুই হলি আমার সেই রাজকুমারী যাকে মাথায় বসিয়ে গাজনের মেলায় গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস পুলিশের ড্রেস পরে আসিসনি, তাহলে দূর দূর করে ভাগিয়ে দিতাম। পুলিশের মতো অপদার্থদের আমি মোটে সহ্য করতে পারি না।’
লগ্নজিতা পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল, ‘বলো মামা কেমন আছো? তোমার এই মাথায় বসিয়ে ঘোরানোর গল্পটা মায়ের মুখে বহুবার শুনেছি। ইনফ্যাক্ট তুমিও বলেছ। মা বলে, বিমান তোকে পারলে সারা হলদিয়া মাথায় বসিয়ে ঘুরতে চেয়েছিল।’
বিমানমামা একটু অন্যমনস্ক স্বরে বলল, ‘তুই বহুদিন পরে এলি এ বাড়িতে। স্কুলে পড়ার সময় কত আসতিস! আমার আর তোর মামিমার কাছে কত বায়না ছিল তোর।’
লগ্নজিতা আফসোসের সুরে বলল, ‘মামিমা চলে যাবার পরে আমি এসেছিলাম তোমাদের বাড়িতে। তুমি তখন বাড়িতে ছিলে না। মায়ের কাছে শুনেছিলাম হরিদ্বার গেছো। তারপর আর নানা কাজের চাপে আসা হয়নি।’
‘হ্যাঁ জিতা, হরিদ্বার গিয়েছিলাম। ওটাই শেষ ট্যুর আমার। আসলে কাজরীর চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। এ বাড়িতে ওকে ছেড়ে থাকতে পারছিলাম না, তাই পালিয়েছিলাম। তারপর আবারও ওর হাতে বসানো গাছগুলো যত্নের অভাবে মরে যাবে বলেই ফিরে এলাম।”
লগ্নজিতা জানে, বিমানমামা নিঃসন্তান। মামা, মামির দুজনের জুটি ছিল ঈর্ষণীয়। দুজনে প্রায়ই ছুটিতে বেড়াতে চলে যেত। বিমানমামাকে কোনোদিন মায়ের খুড়তুতো ভাই মনে হয়নি। মা ফোঁটা দেওয়া থেকে শুরু করে পুজোর তত্ত্ব সবই নিয়ম করে করত। বিমানমামাও অবশ্য কখনও মাকে বুঝতে দেয়নি মায়ের সহোদর ভাই মারা যাওয়ার কষ্টটা। লগ্নজিতার একমাত্র মামা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পরে মা অদ্ভুত চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। ভাইকে হারানোর কষ্ট কিছুতেই ভুলতে পারতো না মা। ও তখন খুবই ছোট। বহুদিন গাড়িতে অবধি চাপেনি মা। তখন বিমানমামাই মায়ের সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। তবে বিমানমামা হলদিয়ায় বাড়ি করার পরে মায়ের সঙ্গে যাতায়াত আরও বেড়েছিল মামা-মামির। কাজরীমামিও খুব মিশুকে, হুল্লোড়ে মহিলা ছিল। লগ্নজিতাকে খুব ভালোও বাসতো। মা একটা কথা প্রায়ই অভিমানের বশে বাবাকে বলে, আমি যদি কোনোদিন আগে চলে যাই সেদিন বুঝবে একাকীত্ব কার নাম। মহিলাদের সব সহ্য করার ক্ষমতা আছে কিন্তু পুরুষদের নেই। মেয়েরা বৈধব্য মেনে নেয় সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু দিশেহারা হয় বিপত্নীকরা। বিশেষ করে যখন আর বিয়ে করার বয়েস থাকে না। বাবা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই হার মেনে বলে, তুমি যেখানে যাবে আমায় নিয়ে যেও।
বিমানমামার গলার হাহাকারটুকু বুঝিয়ে দিল, কাজরীমামি চলে যাবার পরে কতটা একা হয়ে গেছে মামা। নেহাত বই সর্বক্ষণের বন্ধু—তাই একা এত বড় বাড়িতে থাকতে পারছে। একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাবু চা আনি?’
বিমানমামা ফুৎকারে কথাটাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘শুধু চা আনবি কিরে গণেশ, জানিস এ কে? আরে পুলিশ অফিসার লগ্নজিতা ভট্টাচার্য। ফাঁকিবাজির অপরাধে তোকে জেলে ঢুকিয়ে দিতে পারে। শিগগির খান কয়েক ফিসফ্রাই নিয়ে আয়।’
লগ্নজিতা বারণ করতে গিয়েও থমকে গেল। বিমানমামা কাছের একজনকে এতদিন পরে দেখে আত্মহারা হয়ে গেছে। এই আনন্দটুকুকে নষ্ট করা উচিত হবে না।
মামা ফিসফ্রাই আনতে দিয়েই ঘুরে বসল লগ্নজিতার দিকে,—’বল কেমন আছিস বল চোর, ডাকাত নিয়ে? ডান হাতে ব্যান্ডেজ কেন রে? বুলেট আদর করে বেরিয়ে গেছে নাকি?’
বিমানমামা স্বভাব রসিক মানুষ বরাবরের।
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘বুলেট নয়, ছুরি উষ্ণ স্পর্শ দিয়েছে। বুঝলে মামা? তাই তো কাজের সময় কলকাতা ছেড়ে মায়ের তত্ত্বাবধানে আসতে হল।’
বিমানমামা মুচকি হেসে বলল, ‘দিদি ফোন করে বলেছে সব। খুব দুশ্চিন্তা করে তোর জন্য।’
ফিসফ্রাইয়ের গন্ধে খিদেটা বেড়ে গেল লগ্নজিতার। গণেশদা প্লেটে ফ্রাই আর চা রাখতেই ও কামড় দিয়ে বলল, ‘তুমি এখনও মনে রেখেছো আমার ফিসফ্রাই প্রিয়?’
মামা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তোরাই সব বড় হয়ে ভুলে গেলি। আমাদের পৃথিবী তো তোদের ঘিরেই ঘুরে বেড়ায় তাই ভুলি কী করে?’
লগ্নজিতা বলল, ‘মামা তুমি সোনালী প্রকাশনাটা তুলে দিলে কেন? অনেকগুলো টাইটেল করে ছিলে তো।’
মামা একটু বিষণ্ণ স্বরে বলল, ‘আসলে চাকরি করে ব্যবসা হয় না বুঝলি। বইয়ের ব্যবসায় সময় দেওয়াটা জরুরি। প্রূফ রিডার, এডিটর—সব থাকলেও সময় দিতে হয় নিজেকেও। লাইব্রেরিয়ানের চাকরি করে এসব সামলাতে গিয়ে শেষে আমার বই পড়া কমে যাচ্ছিল। তবে তুই মনে করিস না সোনালী প্রকাশন উঠে গেছে। ওটা আছে বুঝলি? আরে, আমাদের অনন্ত মাস্টারের ছেলে কিনে নিয়েছে। এবারের মেলাতেও তো স্টল দিয়েছিল ও। দেখ ওদের বয়েস কম, ওরা পারবে খাটতে।’
লগ্নজিতা বলল, ‘তুমি দেখো তো একজন ভদ্রলোকের ছবি দেখলে চিনতে পারো কিনা।’
ব্রজমোহন চক্রবর্তীর ছবিটা সামনে ধরতেই বিমানমামা বলল, ‘আরে ইনি তো প্রফেসর ব্রজমোহন চক্রবর্তী। বসন্তবিহারী কলেজের হিস্ট্রির প্রফেসর ছিলেন। আমি যখন যাদবপুরে থাকতাম তখন ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বুঝলি? কিন্তু তুই কী করে বুঝলি আমি একে চিনতে পারি?’ বিমানমামার ভ্রুতে প্রশ্ন চিহ্ন।
লগ্নজিতা চায়ের কাপটা নামিয়ে বলল, ইন্সপেক্টর লগ্নজিতা ভট্টাচার্যের চোখকে ফাঁকি দিলেও ডিডেকটিভ লগ্নজিতার চোখকে ফাঁকি দেওয়া একটু শক্ত বুঝলে? ওনার ঘরের বইয়ের আলমারিতে একটা বই দেখলাম, ‘ইতিহাসের আনাচেকানাচে’- ব্রজমোহন চক্রবর্তী- সোনালী প্রকাশন। তখনই ভেবেছি তোমায় ধরতে হবে।’
মামা একটু অবাক হয়েই বলল, ‘কিন্তু কেসটা কি একটু খুলে বলবি?’
লগ্নজিতা বলল, ‘ব্রজমোহনবাবু খুন হয়েছেন বা আত্মহত্যা করেছেন।’
মামা অদ্ভুত গলায় বলল, ‘আত্মহত্যা করার মানুষ তো উনি নন। নিত্য নতুন নতুন বিষয় নিয়ে মেতে থাকতেন। বই ছিল ওনার ফার্স্ট লাভ। এ জন্য কখনও ওনার মধ্যে ফ্রাস্ট্রেশন তো দেখিনি। সব সময় নিত্য নতুন জিনিসের সন্ধানে থাকতেন। কিন্তু আরেকটা প্রশ্নও মাথায় এলো, অমন নির্বিবাদী মানুষকে খুন কে করবে? গল্পবাজ, হাসিমুখের মানুষ।’
লগ্নজিতা বলল, ‘তোমার সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হলো ওনার সেটা প্রথম থেকে বলো। উনি তোমার প্রকাশনায় কটা বই করেছিলেন?’
বিমানমামার মুখে বিষাদের ছায়া। পূর্বপরিচিত একটা মানুষের মৃত্যু সংবাদ শুনেই হয়তো।
মামা বলতে শুরু করল, ‘ভদ্রলোক তখন কলেজে পড়ান। একদিন আমার লাইব্রেরিতে এলেন একটা বইয়ের সন্ধানে। অন্য একজন প্রফেসরের লাইব্রেরির কার্ড নিয়ে। সেই আলাপ ওনার সঙ্গে। তারপর নেশার জিনিস মিলে যেতেই বন্ধুত্ব হল। নেশার জিনিস দুজনেরই বই। তখন আমি সদ্য সোনালী প্রকাশন খুলেছি। নামী লেখক-লেখিকারা নতুন প্রকাশনাকে বই দিতে নারাজ। আমি ওনাকে একদিন গল্পের ছলে বললাম, ‘এত পড়েছেন যখন তখন একটা লিখে ফেলুন।’ উনি হেসে বললেন, ‘আমি নিখাদ পাঠক মশাই। লেখক হবার ইচ্ছে নেই।’ কিন্তু আমি ছাড়বার পাত্র নই। শেষে বাধ্য হয়ে ‘ইতিহাসের আনাচে কানাচে’ নামে বইটা লেখেন। ওনার নিজের সাবজেক্ট। সেই হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোর সময় থেকে যে সব লিপি ব্যবহার করা হয়েছিল,মানে হরপ্পি লিপি আরকি—সেসব লিপিগুলোতে যে প্রতীকগুলো ছিল, তার ওপরে ছোট ছোট একটা করে গল্পের ঢঙে লেখা। বড় ভালো লিখেছিলেন। কিন্তু ওই আমিও নতুন প্রকাশক, উনিও নতুন লেখক তাই বইটা সেভাবে বিক্রি হল না। উনি তখন মেতে উঠেছিলেন সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবহৃত লিপির পাঠোদ্ধার করতে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের দিকে এই লিপি সিন্ধু সভ্যতায় মানুষ ব্যবহার করতো।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে আলেকজ্যান্ডার কানিংহাম হরপ্পায় প্রাপ্ত কিছু প্রতীক প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৪০০০ প্রতীক আবিষ্কার হয়েছে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইতাভাথাম মহাদেবান ৩,৭০০ সিল পরীক্ষা করে ৪১৭টি স্বতন্ত্র প্রতীক শনাক্ত করেন। তাঁর মতে হরপ্পা সভ্যতার মানুষ ডান থেকে বাম দিকে লিখতেন। কানিংহাম এফ রেমন্ড এ্যালিসিন, এবং অন্যান্য লিপিবিশারদদের মতে, এই লিপি থেকে ব্রাহ্মীলিপির উদ্ভব হয়েছিল।
এখনো পর্যন্ত এই লিপির পাঠ উদ্ধার করা যায়নি।
ওই বইটা সেভাবে মার্কেট পায়নি বলে লেখালিখিটাকে উনি আর ছাপার অক্ষরে আনতে চাননি। বলেছিলেন, ‘অযথা নিজের ব্যবসার ক্ষতি করবেন না বিমানবাবু। আমি বরং পাঠকই থাকি।’ তারপরেও যোগাযোগ ছিল বহুদিন। ওনার ওই প্রতীক চেনার নেশায় আমিও পড়েছিলাম। এমনকি আমার কলকাতার বাড়িতে দুজনে বসে রাত কাবার করেছি মিশরীয় প্রতীক চিনতে। তারপর আমিও বদলি হয়ে চলে এলাম, যোগাযোগও ক্রমে বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু মানুষটা খুন হয়েছে শুনে বড় কষ্ট পেলাম জিতা।’
লগ্নজিতা বলল, ‘মামা ওনার স্ত্রীকে তুমি চিনতে?’
মামা বলল, ‘এক-দুবার দেখেছিলাম ওনার বাড়িতে। মিশুকে টাইপ মহিলা নন। ওই নমস্কার জানিয়ে ঘরে চলে গিয়েছিলেন। কেন বলতো?’
লগ্নজিতা চিন্তিত স্বরে বলল, ‘অনেকগুলো জট পাকিয়ে আছে মামা। খোলার জন্য তোমায় প্রয়োজন। হেল্প লাগবে। ফোন করব। প্রয়োজনে কলকাতায় আসতে হবে তোমায়। আজ চলি। ওহ! ব্রজমোহনবাবুর লেখা বই আর তোমার কাছে আছে নাকি?’
মামা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ আছে। দাঁড়া দিচ্ছি তোকে এক কপি।’
লেখক পরিচিতিতে ব্রজমোহনবাবুর একটা হাসি মুখ। বইটা উৎসর্গ করেছেন, বান্ধবী মেঘবালাকে।
‘আমার সমস্ত অকাজের প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে যে, সেই বান্ধবী মেঘবালাকে।’
‘মেঘবালাকে তুমি চেনো বিমানমামা?’
বিমানমামা বলল, ‘পরে একদিন বলবো। আজ থাক।’ একটু যেন অন্যমনস্ক লাগল মামাকে। অথবা মেঘবালার পরিচয় দিতে চায় না মনে হল ইন্সপেক্টর লগ্নজিতাকে। ভাগ্নি হিসাবে যতটুকু বলা সম্ভব বলেছেন মনে হল।
লগ্নজিতাও আর উত্যক্ত না করে বলল, ‘আজ আসি। ফোন করব তোমায়।’
ঘাড় নেড়ে মামা বলল, ‘চলে আসিস হলদিয়া এলেই। দিদিকে বলিস দিদির দেওয়া পাতিলেবু গাছে ফুল এসেছে। লেবু হলে দিয়ে আসব আমি গিয়ে।’
লগ্নজিতা তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে আছে মামার চোখের দিকে। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে কিন্তু দৃষ্টিতে কিছু লুকিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা যেন। লগ্নজিতা বইটা ব্যাগে ভরে বেরিয়ে এলো। আর দুদিনের মধ্যেই ফিরবে কলকাতা। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ব্রজমোহনবাবুর খুনিকে খুঁজে বের করতে হবে।
বিমানমামার চোখ দেখে মনে হল মেঘবালাকে মামা চেনে। রাহুলের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে হবে আজকেই। ও কি চেনে এই মেঘবালাকে? ফোনে এসব নিয়ে কথা বলার পক্ষপাতী নয় লগ্নজিতা। চোখে চোখ রেখে কথা বললে অনেক কিছু বোঝা যায়। কোনটা সে লুকাতে চাইছে, কোনটা বলতে—সেটা আন্দাজ করা যায়। সরলাদেবীর কথাবার্তা শুনে মনে হয়নি স্বামীর প্রতি উনি বিরক্ত। তবে স্বামীর বন্ধুদের যে উনি বিশেষ পছন্দ করেন না সেটা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বিমানমামাও বলল, ভদ্রমহিলার মিশুকে নয়। মিশুকে নয় নাকি স্বামীর বন্ধুদের অপছন্দের কারণেই তেমন মিশতেন না?
সরলাদেবী সেদিন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন বারবার। রাহুল মাকে থামিয়ে দিল। ঠিক কী বলতে চাইছিলেন?
বাড়ি ফিরতেই মা বলল, ‘তুই বিমানের কাছে কি শুধু গল্প করতে গিয়েছিলিস, নাকি আবার কোনো ঝামেলার কেসে হাত দিয়েছিস? তাই ওর কাছে কোনো তথ্যের জন্য গিয়েছিলিস?’
লগ্নজিতা বাবার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বুঝলে মা? তুমি ইনবর্ন শার্লকহোমস। আমার তো মনে হয় প্রতিভার সেভাবে বিকাশ হয়নি বলেই এ রাজ্য একজন তুখোড় গোয়েন্দাকে পেল না। আর আজকে আমি একশো শতাংশ নিশ্চিন্ত হলাম, পুলিশের চাকরি করেও আমার কেস ধামাচাপা দেওয়ার স্বভাব কেন নেই? এটা আমার রক্তে এসেছে মা, তোমার থেকে। আমার বাবাকে দেখো। দু কাপ চা খাওয়াও; সঙ্গে দুটো ফিসফ্রাই। বাবা জিজ্ঞাসাই করবে না—বাড়ির দরজায় তো তালা দিয়েছিলাম, তুই ঢুকলি কীভাবে? কিন্তু তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া আমার কম্ম নয়। মা তুমি ব্রিলিয়ান্ট।’
বাবার ঠোঁটে হাসি। মামার দেওয়া ফিসফ্রাইয়ে কামড় দিয়ে দিব্য হাসছে মা-মেয়ের কাণ্ড দেখে। মা আরেকটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এত প্রশংসা বৃথা গেল অফিসার লগ্নজিতা ভট্টাচার্য। এবারে বল, আবার কোন সমস্যায় জড়ালি? তুই কি ভদ্রভাবে চাকরি করতে পারিস না? অযথা খুন-জখমে নিজের মাথাটা না ঢোকালেই চলে না? কলকাতা শহরে নিশ্চয়ই তুই একা নেই। যত সমস্যা তুই কেন কাঁধে নিস? তাড়াতাড়ি বল, আচমকা বিমানমামার জন্য এত মনখারাপের কারণ কী?’
লগ্নজিতা বলল, ‘আরে, তোমার ভাইয়ের কাছে কত খবর। কত জায়গা ঘুরেছে, কত লোকজনের সঙ্গে পরিচয়, কত বইপত্র পড়েছে—তাই একটু আড্ডা দিয়ে এলাম। আর আমার একটা কেস নিয়ে কয়েকটা ইনফর্মেশন নেওয়ার ছিল। সেটাই নিয়ে এলাম মাত্র। নাথিং সিরিয়াস।’
মা রাগত মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জীবনে ফার্স্ট টাইম ফিসফ্রাই খাচ্ছ তো তুমি? খাও,খাও।’
বাবা বলল, ‘হ্যাঁরে জিতা? আচমকা সব দোষ আমার ওপরে কেন পড়ে রে?’
বাড়ি ছেড়ে আবার কলকাতা চলে যেতে হবে লগ্নজিতাকে। বাবা-মায়ের এই খুনসুটি, আদরগুলো বড্ড মিস করে ওখানে।
ব্যাগ গোছানো কমপ্লিট। হাতের ক্ষত শুকিয়ে গেলেও ব্যথাটা এখনও অল্প আছে। তবে অ্যান্টিবায়োটিকের গুণে আপাতত ফিট হয়ে গেছে লগ্নজিতা। মা ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে ওর মাথার চুলে বিলি কাটতে লাগল। মুচকি হেসে লগ্নজিতা বলল, ‘মনখারাপের কী আছে বলতো? এই তো কয়েকঘণ্টা। যেদিন ইচ্ছে আমার ফ্ল্যাটে চলে যেও কর্তাগিন্নি। তোমাদেরই তো আবার কলকাতা শহরের গ্যাঞ্জাম পছন্দ নয়।’
মা শান্ত গলায় বলল, ‘আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবলি?’
লগ্নজিতা জানে ভবিষ্যৎ বলতে মা ওর বিয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চায়। কথাটা ঘোরাবার জন্যই বলল, ‘দাঁড়াও। এই সদ্য প্রমোশন পেলাম। গুছিয়ে বসি আগে, তারপর তো আবার নেক্সট নিয়ে ভাববো।’
—জিতা, কৌশিকের সঙ্গে তোর সম্পর্কটা কি শুধুই বন্ধুত্বের? সেদিন যখন তোর হাত ড্রেসিং করাতে এসেছিল, তোর ফোনটা বেজেই চলেছিল দেখে রিসিভ করলাম। স্ক্রিনে উঠল ডক্টর কৌশিক। ফোনটা ধরতেই উদ্বিগ্ন গলায় বলল—’জিতা কেমন আছো তুমি? আচমকা কলকাতা থেকে চলে কেন গেলে? এখানে থাকলে আমি দেখতে পারতাম তো।’ আমি তোর মা বলতেই তোর হাতের খবর নিয়ে বলল, পরে আবার কল করবে। ওর উৎকণ্ঠা শুনে মনে হল, তোকে খুব ভালোবাসে। দুশ্চিন্তায় আছে তোকে নিয়ে।’
লগ্নজিতা জানে মায়ের কাছে কোনো কিছুই সেভাবে লুকিয়ে রাখতে অক্ষম ও। এখানে ওর সব বুদ্ধিমত্তা হেরে যায়। লগ্নজিতা বলল, ‘মা কৌশিক আমার ভালো বন্ধু আপাতত। তোমার মেয়ের সঙ্গে যদি টিকতে পারে নিজ গুণে তাহলে ভেবে দেখব নাহয়। আপাতত এসব মাথা থেকে বের করে দাও।’
লগ্নজিতার মাথায় ঘুরেই চলছে সরলাদেবীর মুখটা ও কোথায় একটা দেখেছে। কৌশিকের সঙ্গে রিলেটেড মনে হতেই ওকে ছবিটা পাঠিয়েছিল। ঠিক কী ইনফর্মেশন পেয়েছে কৌশিক জানতে হবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন