অর্পিতা সরকার
—’চন্দ্রজা, আমি তোমাদের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। একবার বেরোনো সম্ভব?’
চন্দ্রজার বাড়িটা মোড়ের মাথা থেকেই দেখা যায়। এর আগেও রাহুল এখানে দাঁড়িয়েই ওর জন্য অপেক্ষা করত। তখনও ওদের সম্পর্কটা দুই বাড়িতে জানাজানি হয়নি। চন্দ্রজাকে কল করলে রেডি হয়ে বেরিয়ে আসতো ও। এখন তো অফিসের কারণে দুজনেই ব্যস্ত থাকে সারা সপ্তাহ। রবিবার ছাড়া ছুটি কোথায়? বাবার এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থেকে দিনগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বার, তারিখরা এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে রাহুলের হিসেবনিকেশ ছাড়াই। আজ রবিবার বলেই ফোনটা করল রাহুল। জানে চন্দ্রজা অভিমান করে আছে। কারণ মা মৃন্ময়কাকুকে খুনি বানিয়ে দিয়েছে। চন্দ্রজার ধারণা—রাহুল কোনোরকম প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু চন্দ্রজা যেটা ভাবছে সেটা একেবারেই ভুল। রাহুল মাকে থামানোর অনেক চেষ্টা করেছিল পুলিশের সামনে। কিন্তু মা মৃন্ময়কাকুর নামটা নিয়ে নিল। দুদিন পুলিশ এসেছিল মৃন্ময়কাকুর বাড়িতে। পাড়ায় যথেষ্ট অপমানিত হয়েছে মানুষটা। আগে হলে সোজা ওদের বাড়ি ঢুকে যেত রাহুল। কিন্তু এই ঘটনার পরে ওরা কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। তাই বাড়িতে না গিয়ে সেই পুরোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
ফোনটা কেটে দিল চন্দ্রজা। তবুও আশা নিয়ে আরও মিনিট দশ দাঁড়িয়ে থাকবে রাহুল। এর আগেও রাগ করে কল কেটে দিয়েছে চন্দ্রজা। তবুও ঠিক এসেছে এখানে। ওদের বাড়ির বাদামি গেটের দিকে তাকিয়ে দেখেছে ওখান থেকে চন্দ্রজা মুখে একরাশ অভিমান নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। আজও গেটটার দিকে তাকিয়ে ছিল রাহুল। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল তবুও চন্দ্রজার দেখা নেই। আর মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে ফিরেই যাবে।
আচমকাই চন্দ্রজা পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এখানে কেন? বাড়িতে যেতে পারতে তো। নাকি বাবার খুনির বাড়িতে পা দিতে ঘৃণা করছে?’
রাহুল ব্যথিত স্বরে বলল, ‘প্লিজ চন্দ্রা, এভাবে বলো না। আমি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। কোথা দিয়ে যে কী ঘটে গেল, আমি বুঝতেই পারছি না।’
চন্দ্রজার মুখে আজ আলোর দেখা নেই। নিটোল অভিমান আর বিরক্তিতে মুখটা থমথম করছে। রাহুল ওর হাতে ছোট্ট একটা পিতলের গণেশের মূর্তি দিয়ে বলল, ‘এই যে তোমার লাকি গণেশ। আমাদের বাড়িতে পড়ে ছিল।’
চন্দ্রজা চমকে উঠে বলল, ‘তোমাদের বাড়িতে? কিন্তু আমার এটা হারিয়েছে তো প্রায় মাস পাঁচেক আগে। আমি বাধ্য হয়ে অন্য একটা কিনে নিয়েছি। ভাবলাম কোনোভাবে পার্স থেকে পড়ে গেছে। তোমাদের বাড়িতে কী করে গেল?’
রাহুল বলল, ‘আমি জানি না চন্দ্রা। মা এসে হাতে দিয়ে বলল, বাগানে পড়ে ছিল। কে জানে আর কে কে এসেছিল ওদিন বাড়িতে!’
চন্দ্রজা বলল, ‘ওহ শুধু বাবার নামে দোষ দিয়ে হচ্ছে না ওনার, তাই আমাকেও খুনির আসনে বসানোটা খুব জরুরি।’
রাহুল গণেশটা হাতে দিয়ে বলল, ‘আমায় ক্ষমা করো চন্দ্রা। আমার কাছে সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।’
চন্দ্রজা নীচের ঠোঁটটা কামড়ে হিসহিস করে বলল, ‘এবারে পুলিশ এলে আমি সরলা চক্রবর্তীর ইতিহাসটা বলে দেব রাহুল। তোমার মা বলে ঢেকে রাখতে পারব না। তাহলে হয়তো পুলিশের ওনার চরিত্রটা বোঝা সহজ হবে। ওনার মধ্যে যে একটা জলজ্যান্ত খুনি লুকিয়ে আছে সেটা পুলিশের জানা উচিত। ছেলে হয়ে তুমি যেমন তোমার মাকে গার্ড করার চেষ্টা করছ, মেয়ে হয়ে আমিও আমার বাবাকে প্রটেক্ট করতে চাইব—এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং, আপাতত আমাদের মধ্যে আর যোগাযোগ না থাকাই ভালো।’
রাহুল অসহায় গলায় বলল, ‘তাহলে তুমি কি চাও মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিই? মায়ের এই মেন্টাল কন্ডিশনে আমি ছেলে হয়ে ওকে রাস্তায় বের করে দিই?’
চন্দ্রজা ব্যঙ্গাত্মক ঢঙে হেসে বলল, ‘একেবারেই চাই না। তবে তুমি যেটা চাও, সেটাও আবার আমি পারব না। তোমার ওই মায়ের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতে। সুতরাং দুজনের পক্ষেই ভালো, আমরা আর এই সম্পর্কটা নিয়ে এগোব না।’
রাহুল বলল, ‘কী বলছো চন্দ্রা? এও সম্ভব?’
চন্দ্রজা বলল, ‘সম্ভব তো সবই। আমার প্রায় পাঁচমাস আগের হারিয়ে যাওয়া গণেশ তোমার বাবার রহস্যজনকভাবে মৃত্যুর পরে তোমাদের বাড়ি থেকে পাওয়া, আমার বাবাকে খুনি ভাবা…সবই সম্ভব। এনিওয়ে, মন্টুদাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তো দিনদুপুরে কোথায় গেল মন্টুদা? নাকি তোমার মা তোমার বাবার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রিয় মানুষটিকেও সরিয়ে দিল পৃথিবী থেকে? উনি তো সেটাই চেয়ে এসেছেন এতদিন, ব্রজআঙ্কেল মারা যাক।’
রাহুল যেন একটু কেঁপে উঠল চন্দ্রার এমন কাটা কাটা কথায়। একটু গলা তুলেই বলল, ‘প্লিজ চন্দ্রজা, মাকে নিয়ে আমি এসব শুনতে রাজি নই।’
হনহন করে হাঁটা জুড়লো রাহুল। ভেবেছিল চন্দ্রজার কাছে এসে একটু শান্তি পাবে, উল্টে একটা শিরশিরে ভয় ওর মেরুদণ্ড দিয়ে নেমে যাচ্ছে। চন্দ্রজা কি ঠিক বলছে? মা এমন করতে পারে বাবার সঙ্গে? অবশ্য দিদি মারা গিয়েছিল মায়ের জন্যই। কিন্তু ইদানীং তো মা অনেক শান্ত হয়ে গেছে। আগের মতো উত্তেজিত হয়ে ওঠে না। নিজের মনেই বইপত্র পড়ে, গান শোনে। আগের মতো অশান্ত হয়ে তো থাকে না। তাহলে আচমকা বাবাকে মেরে কেন দেবে? পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, মাথায় সজোরে আঘাত করা হয়েছে, তারপর গলায় ফাঁস দেওয়া হয়। ভারী জিনিস ছুঁড়ে মারার অভ্যেস অবশ্য মায়ের আছে। তাই কি সব জেনে মন্টু অমন চুপ করে গেল! শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করছে রাহুলের। এমনিতেই অশৌচ বলে খাওয়াদাওয়া সেভাবে হচ্ছে না, তারপর এত দুশ্চিন্তায় ঘুমটাও বিদায় নিয়েছে ওর কাছ থেকে। আজ চন্দ্রজাও ওকে ছেড়ে চলে গেল, কেমন যেন একা হয়ে গেল রাহুল এ কদিনে। সবাই বলে অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে বাবার, তাই দশ দিনের অশৌচের দরকার নেই। তারপরেও রাহুল পালন করছে। বাবা বড্ড চাহিদাহীন মানুষ ছিল, সে চলে যেতে এটুকু করবে রাহুল। আর এইভাবে মারা গেলে নাকি কেউ বাড়িতে খেতে আসে না। তাই একটা অনাথ আশ্রমে গিয়ে ওখানের বাচ্চাদের খাইয়ে আসবে ভেবেছে ও। আগামীকাল ব্রাহ্মণ আসবে বাড়িতে। ছোট্ট করেই শ্রাদ্ধ-শান্তি করবে। বাবার কিছু কলেজের কলিগ, প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গী আর কিছু আত্মীয়দের আমন্ত্রণ করেছে রাহুল। আসলে ভালো লাগবে—এটুকুই। মৃন্ময়কাকুকে আসতে বলতেই গিয়েছিল আজ। চন্দ্রজা পারমিশন দিলে গিয়ে বলে আসতো। কিন্তু সেখানেও একটা তিক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হল। মন্টুও কোথায় যে গেল?
ব্রজধামে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সাদা ফলকের ওপরে একটুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল রাহুল। বাবা প্রায়ই ছুটির দিনে সাবান জল দিয়ে ধুয়ে দিতো ফলকটা। ছোট থেকেই রাহুল দেখেছে এটা। দাদু বেঁচে থাকতে বাবা রোজ সকালে উঠে দাদুকে প্রণাম করে এই ফলক ধুয়ে তারপর কলেজে যেতো। তারপর শেষের দিকে রোজ না হলেও সপ্তাহে দুদিন অন্তত ধুয়ে দিতো বাবা। বাকি সব কাজ মন্টুকে দিয়ে করালেও এটা নিজের হাতে করতো। দাদুর তৈরি বাড়ি আর দাদুর দেওয়া নাম ব্রজধাম বলেই হয়তো বাবার একটা অদ্ভুত টান ছিল এই ফলকটার প্রতি। বাবার যখন বয়েস মাত্র পাঁচ কি ছয় তখনই বাবার দাদু ১৯৬০ সালে বাড়িটা বানিয়েছিল। শুরু করেছিল ১৯৫৭ সালে। তিন বছর নাকি লেগেছিল ব্রজধাম গড়তে। তারপর সাদা পাথরে নাতির নামে নাম রেখেছিল ”ব্রজধাম।” রাহুল ছোটবেলায় জিজ্ঞাসা করত, ‘বাবা ১৩৬৬ কেন?’ বাবা হেসে বলত, ‘আমরা ভুলে যাই আমরা বাঙালি।’ ধীর পায়ে বাড়িতে ঢুকল রাহুল। বাড়িটা কদিনে কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। বাবা যে বাড়িতে খুব বেশি কথা বলতো এমন নয়, তবুও একজন মানুষের অনুপস্থিতিতে এতটা শূন্যতা চেপে ধরে, এটা বোধ হয় এই প্রথম অনুভব করল ও।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন