অর্পিতা সরকার
মীনাক্ষীর ফোনটা পেয়েই অফিস থেকে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরে এসেছে রাহুল। এসেই দেখল মায়ের কোনো সেন্স নেই। মুখে জল দিলে সেন্স আসছে আবার চলে যাচ্ছে। মীনাক্ষী ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কোথায় যেন বেরিয়েছিল জেঠিমা। ফিরে এসে থেকে এমন করছে।’ রাহুল মুখটা মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘মা, কী হচ্ছে তোমার?’ সরলাদেবী খুব ফিসফিস করে বললেন, ‘মৃন্ময়দা আর চন্দ্রজাকে ডাক। আমি ক্ষমা চাইবো।’ রাহুল বলল, ‘সে পরে হবে। আগে বলো তোমার কী হচ্ছে? ডাক্তারকাকুকে ডাকি বরং।’ চক্রবর্তীদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান দিব্যেন্দু রায়কে একবার কল করবে কিনা ভাবছিল রাহুল। তার আগেই সরলাদেবী চোখ মেলে ধীর স্বরে বললেন, ‘ওদের ডাক রাহুল। আমি চন্দ্রার কাছে ক্ষমা চাইতে চাই। ওকে অনেক ভুলভাল কথা শুনিয়েছি।’
রাহুল বলল, ‘মা এখুনি ক্ষমা চাওয়ার আছে কী? পরে ডাকব না হয়।’ সরলাদেবী কাঁপা গলায় বললেন, ‘হয়তো সময় পাব না আর। তোর বাবাও তো সময় পেল না আর।’
রাহুল চন্দ্রজাকে কল করল। চন্দ্রজা ফোনটা রিসিভ করেই বলল, ‘আবার কী হল রাহুল? ব্রজধামে আবার কোনো ক্লু পেলে নাকি তোমরা? যেটা থেকে প্রমাণ হয় আমরাই খুনি?’ রাহুল শান্ত গলায় বলল, ‘মা খুব অসুস্থ চন্দ্রা। অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে বারবার। তার মধ্যেই তোমাকে আর আঙ্কেলকে ডাকছে একবার। বলছে ক্ষমা চাইবে। আসবে একবার?’ চন্দ্রজা শান্ত গলায় বলল, ‘আমি নার্সিংহোমে আছি রাহুল। বাবার প্রেশারটা ভয়ংকর বেড়েছে। রিস্ক না নিয়ে ভর্তি করে দিলাম। ফিরে নাহয় যাবো একবার। তুমি তোমার মায়ের খেয়াল রাখো।’ রাহুল বলল, ‘কোন নার্সিংহোমে আছো? আমি আসছি।’ চন্দ্রজা ধীর গলায় বলল, ‘প্লিজ এসো না। বাবা ওই বাড়ির কারোর সঙ্গে আর দেখা করতে চাইছে না।’
ফোনটা কেটে গেল। রাহুল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই ভাবছিল, কত দূরে চলে গেল চন্দ্রা।
ঘর থেকে মা ডাকছিল। রাহুল ঢুকতেই বলল, ‘কি রে কী বলল?’ রাহুল বলল, ‘মা মৃন্ময়কাকু নার্সিংহোমে। প্রেশার বেড়েছে। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল বাড়িতে।’
আচমকা সরলাদেবী অট্টহাসি হেসে বলল, ‘জানিস ”রাতের রজনীগন্ধা” নাটকে মৃন্ময়দা এরকম করেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। কেন জানিস? কারণ ওর স্ত্রী রজনীকে ও নিজে হাতে খুন করেছিল। রজনীর অভিনয় করেছিলাম আমি। মৃন্ময়দা আমার গলা টিপে খুন করেছিল। তারপর উত্তেজনায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। নাটকের ডিরেক্টর রঞ্জনদা বলেছিল, খুনের পরে এই জ্ঞান হারানোর অভিনয়টা নাকি মৃন্ময় চমৎকার করেছে। রাহুল মৃন্ময়দার আসলে কিছুই হয়নি। তোর বাবাকে খুন করেছে তো ও আমায় পাবে বলে, তাই এখন পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে এসব করছে।’ রাহুল বলল, ‘মা তুমি রেস্ট নাও। আমি দিব্যেন্দু রায়কে একবার কল করে দিচ্ছি।’ সরলাদেবী এক মনে বলছেন, ‘অভিনেতা। মৃন্ময়দা বড় অভিনেতা।
ব্রজকে খুন করে গা বাঁচাতে নার্সিংহোমে গেছে।’
মা একনাগাড়ে বলেই চলছে, অভিনয়। সব অভিনয়। ব্রজও অভিনয় করে গেল আজীবন। ভালোবাসা নিয়ে অভিনয়। পুরুষরা ভালোবাসে না। রাহুল ঘরে বসে বসে ভাবছিল, মায়ের এই পুরুষ বিদ্বেষটা কাটানোর জন্য তৃষার রেপিস্টদের শাস্তি পাওয়াটা বোধহয় দরকার। বর্ণালীম্যাডামের ছেলের বিয়ে সামনের মাসেই। অথচ সুনির্মলের সঙ্গে যে দিদির একটা সম্পর্ক ছিল সেটা আর কেউ না জানুক রাহুল জানে। দিদি প্রায়ই রাত্রি জেগে কথা বলতো সুনির্মলের সঙ্গে। সুনির্মল হয়তো দিদিকে রেপ করেনি কিন্তু ওর বন্ধুবান্ধবরাই যুক্ত ছিল এ ঘটনার সঙ্গে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ওরা বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানেই সুনির্মলদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দিদির। একই পাড়ার ছেলে বলে রাস্তায় হয়তো দেখা হয়েছে, কিন্তু সেভাবে কথা হয়নি দিদির। সুনির্মলদারা আটজন ছেলে মিলে কলেজ শেষ করে বেড়াতে গিয়েছিল। রাহুল দেখেছে দিদির সঙ্গে ওর বন্ধুত্বটা। ওটা যে শুধু বন্ধুত্ব নয় আরেকটু বেশি রাহুলের ওই বয়েসের অনভিজ্ঞ চোখেও ধরা পড়েছিল সেটা। কলকাতা ফিরেও দিদি আর সুনির্মলদা একই টিউশনে পড়তে যেত। তারপরেই আচমকা ওই ঘটনা। বর্ণালীম্যাডাম অবশ্য প্রমাণ করে দিয়েছিল ওর ছেলে নাকি ওইদিন ছিলই না কলকাতায়। কিন্তু সুনির্মলদার বন্ধুরা জেরার মুখে বলেছিল, সুনির্মলের ডাকেই নাকি সেদিন সন্ধেতে তৃষা গিয়েছিল বন্ধুদের পার্টিতে। বাবা বহু বছর মামলা চালিয়েছিল কিন্তু তৃষার রেপিস্টরা প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। এর পিছনে ওই সাব ইন্সপেক্টর সুব্রত বসুর হাত আছে বলেই বাবারও বিশ্বাস ছিল। ওই টাকা খেয়ে কেসটা বন্ধ করে দিল। বছরখানেক ধরে বাবা আর রাহুলের চেষ্টায় আবারও তৃষা চক্রবর্তীর রেপ ও মার্ডার কেসটা ওপেন হতে চলেছিল। এর মধ্যেই বাবা এভাবে খুন হয়ে গেল, এরপর মন্টুর খুন-দুটো ঘটনার সঙ্গে কি সুনির্মল বা সুব্রতর যোগাযোগ আছে? কেসটা উঠলে সুনির্মলদাকে আবারও ডাকাডাকি হবে। সামনেই বিয়ে, একটা এইরকম ঘটনার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কিছুতেই হয়তো আসতে চাইছে না। বাবা যদিও বলেছিল, বর্ণালীম্যাডাম নাকি খুবই ভালো ব্যবহার করেন ইদানীং। তৃষার চলে যাওয়ায় খুবই দুঃখিত, এটাও বলেছেন। বর্ণালী ম্যাডাম আর মধুমিতাম্যাডাম দুজনেই এখন বাবাদের সঙ্গে হাঁটতে যান। মধুমিতাম্যাডামের হাজবেন্ডটা তো পাক্কা চোর। বাবা ওকে হাতে নাতে ধরেওছিল গতবছর। পুজোকমিটির মিটিংয়ে। বারোয়ারি পুজোর ক্যাশিয়ার হয়ে মোটা টাকা হাতিয়েছিল। বাবা বলেছিল, নেক্সট পুজোয় আর ওকে ক্যাশিয়ার না করাই ভালো। তাতে সান্যালবাবুর হেভি রাগ হয়েছিল বাবার ওপরে। ওপেন রাস্তায় বলেছিল, ‘বাবাকে দেখে নেবে।’ অত ভোরে যে এ বাড়ির দরজা খোলে এটা সম্ভবত এ পাড়ার সবাই জানে। বিশেষ করে বাবার বন্ধুরা। রাহুল যখনই একা থাকছে তখনই মনের মধ্যে একটা ভাবনা বারংবার ঘুরে-ফিরে আসছে, মৃন্ময়কাকু ওইদিন কেন এসেছিল অত ভোরে এ বাড়িতে? চন্দ্রজার লাকি গণেশ কেনই বা তার পরের দিন বাগানে পড়ে থাকতে দেখেছিল? যদিও মৃন্ময়কাকু বা চন্দ্রা দুজনেই এগুলোর অন্য কারণ দেখিয়েছে কিন্তু সেটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। লগ্নজিতাম্যাডাম বলেইছেন, ‘যে যার মতো যুক্তি সাজাবে, মিথ্যে বলবে নিজেকে বাঁচাতে, এটা নতুন কিছু নয়। সবাই বাঁচতে চায়। তাই অপরাধীও বুক ফুলিয়ে মিথ্যে বলবে।’ মায়ের কথা মতো বাবাকে যদি সত্যিই মৃন্ময়কাকু খুন করে থাকে তাহলে ওর জেল হবে। চন্দ্রজা আর ওর সম্পর্কের শেষ সুতোটুকু কেটে যাবে। বুকটা কেমন করে উঠল রাহুলের। কেন এমন পরীক্ষার জায়গায় নিয়ে এসে দাঁড় করাল ঈশ্বর ওদের সম্পর্কটাকে কে জানে! লগ্নজিতা ম্যাম ওই সোনার লক করা ডায়েরিটার খোঁজ করছিল। বলছিল, বাবার ঘরে সেটা আছে কিনা। বাবার ঘর তো পুলিশ সিজ করেছে। কোন ডায়েরিটা? যেটা নিয়ে বাবা রাতের পর রাত বসে থাকত পড়ার টেবিলে? কি যেন গুপ্তধনের হদিশ আছে বলেছিল একবার। ওই ডায়েরিটা তো বহুদিন দেখেওনি রাহুল। বাবা তো অন্য কতগুলো বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিল জীবনের শেষ কিছুদিন। রাহুলের অবশ্য এতে ইন্টারেস্ট নেই। সম্পত্তি তো ওদের কিছু কম নেই। আর কী হবে? প্রশ্নটা শুনে বাবা বলেছিল, ‘তোর কি মনে হয় আমি শুধু অর্থের জন্য এটা খুঁজছি? না রে ওতে হয়তো আমাদের বংশের কোনো এক পূর্বপুরুষের গল্প লুকিয়ে আছে।’ বাবার এই বংশ বংশ নিয়ে অবসেশনটা কিছুতেই গেল না। মারা যাওয়ার আগের দিনও রাহুলকে বলেছিল, ‘দোতলায় একটা ঘরকে সাজাবো বুঝলি রাহুল! আমাদের বংশের সকলের ছবি দিয়ে। তোরও ছবি থাকবে সেখানে। শুরু হবে বিজয়কৃষ্ণর পিতা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীর ছবি দিয়ে। তার আগে বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তীর ছবি জোগারের এত চেষ্টা করলাম করতে পারলাম না বুঝলি। তোর মায়ের জন্যই তো তোর নামটা এমন বংশ ছাড়া রাখতে হল। তোর দাদু নাম রেখেছিলেন বিপুলেশ্বর চক্রবর্তী। কিন্তু তোর মা পাল্টে দিল রাহুল।’ রাহুল একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বাবা তোমার বংশের কে ঠিক করেছে বলত?’
বাবা বলতে শুরু করেছিল বংশের লোকের পণ্ডিত্যের কথা। রাহুল সব শুনে বলেছিল, ‘এতে এত গর্বের কী আছে? একমাত্র বুদ্ধিদৃপ্ত আর সাহসী লাগল শুধু বিজয়কৃষ্ণকে। যে রাজার মুখের সামনে সত্যি কথা বলে দেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাকিরা তো ব্যবসা, বাণিজ্য করে জীবনধারণ করেছে। যেমন তুমি প্রফেসর, আমি চাকরিজীবী। দাদু ছিল বড় ব্যবসাদার।’ বাবা অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছিল, ‘এমন কিছু আবিষ্কার করব আমি এই বংশের যেটা তুই কেন কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।’ কী সেই আবিষ্কার তা নিয়ে রাহুলের কোনো আগ্রহই ছিল না। এখন মনে হচ্ছে, নিশ্চয়ই বাবার ওই গুপ্তধনের খবর বাবা বন্ধুমহলে দিয়েছিল। তাই হয়তো কেউ খুন করে দিল। বাবার ঘরটা খুঁজে দেখতে হবে ডায়েরিটা আর আছে কিনা। বা অন্য কিছু চুরি গেছে কিনা। বাবা এ খবর প্রথম বলবে মৃন্ময়কাকুকে। তারপর বাকিদের। মৃন্ময়কাকু তো এসব নিয়ে কিছু বলল না রাহুলকে। তবে কী… আর ভাবতে পারছে না রাহুল। চোখের সামনে বাবার মেঝেতে পড়ে থাকাটা মনে পড়ে যাচ্ছে। মন্টুর আর্তনাদ করে ডাকা রাহুল…মনে পড়ে যাচ্ছে। ঘুম চোখে বাবার ঘরে গিয়ে দরজাটা পুরো খুলতেই ওভাবে বাবাকে দেখবে কল্পনার বাইরে ছিল। মায়ের তারপরেও বাগানে নির্লিপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়ানো মনে পড়ল। তবে কি চন্দ্রজার কথাই ঠিক? মা কি মেরে দিতে পারে বাবাকে রাগের মাথায়? কিন্তু ইদানীং তো দুজনে কথাও বেশি বলছিল না। শুধু প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া। ডক্টর মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আর দেখাবে না বলে সেই জেদ ধরার পর থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। মেঘবালার ওষুধ যতদিন খাচ্ছিল এতটা বাড়াবাড়ি হয়নি মায়ের। চিরটা কাল বাড়ির সব ঝামেলা রাহুলের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল বাবা-মা ওই জন্যই ব্রজধামের অর্ধেক বিষয় রাহুলের কাছে ধোঁয়াশা। এ বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী হয়েও এ বাড়ির মোটা মোটা থামের আড়ালে যে গল্পগুলো ঘুরে বেড়ায় সেগুলো ওর অজানা। বাবাকে কি মা আদৌ ভালোবাসত? নাকি মৃন্ময়কাকুর প্রতি নেশাটা এখনও কাটেনি। বাবাকে প্রায়ই মেরে দেব, শেষ করে দেব বলে হুমকি দিয়েছে মা। কিন্তু আবার বাবার পছন্দের কিছু নিজের হাতে রান্না করতেও দেখেছে। বাবার জন্য দুশ্চিন্তা করতেও দেখেছে সুস্থ অবস্থায়। দুজনের সম্পর্কটা যে ঠিক কেমন ছিল বুঝতেই পারল না রাহুল! দিদি একবার বলেছিল, ‘মায়ের সারাজীবনটা অভিনয় করতে করতেই কেটে গেল। ওই থিয়েটারের মঞ্চেই মাকে বেশি মানাতো। এত চক্রবর্তী বংশের অহংকার করে বাবা শেষপর্যন্ত কেন যে একজন নাটক, যাত্রা করা মেয়েকে বিয়ে করেছিল কে জানে! মহিলা এ পৃথিবীর সকলকে হিংসে করে। নিজের মেয়েকে অবধি।’ রাহুল বলেছিল, ‘মায়ের নামে এমন বলছিস কেন রে?’ দিদি রাগে মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, ‘আরেকটু বড় হ তারপর বুঝবি। যখন দেখবি প্রতিটা পদক্ষেপে নিজের মা তোর জীবনটা শেষ করে দেবে বলে উঠে পড়ে লেগেছে তখন বুঝবি।’ দিদির সঙ্গে প্রায় মায়ের ঝামেলা হত। মা দিদির ঘরে গিয়ে দিদির নতুন কেনা লিপস্টিক, মেকআপের বক্স ভেঙে দিয়ে আসত। দিদিকে চিৎকার করলে বলত, ‘অত সেজে কোথায় যাবি? যাকে ভালোবাসিস তাকে কোনোদিন পাবি না। সেই তো অন্য পুরুষ নিয়ে ঘর করবি যে তোর সাজগোজ দেখবে না। সেজে করবিটা কী?’
দিদিকে বাবা লুকিয়ে টাকা দিতো ওগুলো আবার কিনে নিতে। কিন্তু মাকে কখনও কিছু বলত না বাবা। রাহুল দেখত বাবার একটা অদ্ভুত প্রশ্রয় ছিল মায়ের প্রতি। মা যত অন্যায়ই করত, বাবা সেভাবে কোনোদিনই কিছু বলত না। শুধু বলত, ‘জীবনে সেভাবে কিছু পায়নি তোদের মা। একটু মানিয়ে নে।’ এই কথা শুনে এসেছে ছোট থেকেই। বাবা যেন মাকে একটু স্নেহের চোখেই দেখত। কিন্তু হঠাৎই বছর দশেক ধরে বা দিদির মৃত্যুর পরে বাবার ব্যবহার পাল্টে গেল একটু একটু করে। বাবা আরও বেশি রাশভারী হয়ে গেল। কলেজ আর নিজের বইপত্র এছাড়া কোনোদিকেই তাকাত না। বিশেষ করে মায়ের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল অনেকটা। এমনকি মায়ের ঘরে রাতে ঘুমাতেও যেত না। সব সময়ের সঙ্গী হয়েছিল মন্টু। রাহুলের থেকেও বেশি কথা বলত মন্টুর সঙ্গে। বাবার আচরণ দেখে মনে হত দিদির মৃত্যুর জন্য বাবা মাকেই দায়ী করছে। মায়ের ওই অতিরিক্ত সন্দেহ, মেয়েকে হিংসার চোখে দেখার প্রবণতাই দিদিকে আরও বেশি করে বাইরের জগতে নিয়ে গেছে। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, ভরসা পাবার আশায় দিদি বেশি করে ছুটে গেছে অপরিচিত বন্ধুদের কাছে। দিদি প্রায়ই বলত, ‘ব্রজধাম দিন দিন চিড়িয়াখানা হয়ে উঠেছে। যেখানে একজন পাগল মহিলা সকলকে পরিচালনা করেই চলেছে।’ দিদি কলেজ থেকে ফিরে বাথরুমে ঢুকলেই দিদির জামাকাপড় থেকে ব্যাগ অবধি সার্চ করত মা। কবে যেন দিদির আর মায়ের সম্পর্কটা একই হোস্টেলের রুমে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো হয়ে গিয়েছিল। কেউ কাউকে এতটুকু বিশ্বাস করত না। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন চোখ দুটো লেগে গিয়েছিল রাহুলের। মীনাক্ষীর ধাক্কায় ঘুমটা ভাঙল রাহুলের। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মীনাক্ষী বলল, ‘শিগগির এসো, চন্দ্রজা দিদিকে মেরে ফেলল জেঠিমা।’ রাহুল ধড়ফড় করে উঠে ছুটল মীনাক্ষীর দেখানো রাস্তায়। মায়ের ঘরে নয়, দোতলার একটা ঘরে চন্দ্রজাকে গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে মা। মায়ের শরীরে যেন অসম্ভব কোনো শক্তি এসে ভিড় করেছে। চন্দ্রজা মাটিতে পড়ে আছে, মা প্রায় ওর বুকের ওপরে বসে গলা টিপে ধরেছে। চন্দ্রা আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছাড়ানোর। পা দুটো নড়ছে…
রাহুল গিয়ে সজোরে ধাক্কা দিল মাকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেঝেতে। চন্দ্রা কাশছে। মুখটা টকটকে লাল। মীনাক্ষী জল এগিয়ে দিল ঘরের কোণ থেকে।
রাহুল জলটা খাওয়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু আতঙ্কে অথবা গলায় প্রেশারের কারণে জলটা মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল ওর। ওদিকে মেঝেতে বসেই হাউহাউ করে কাঁদছে মা। অদ্ভুত করুণ সে কান্না। যে দেখবে তারই চোখে জল আসবে। পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘রাহুল চন্দ্রা আমায় মেরে ফেলতে এসেছিল রে। আমায় বিষ খাওয়াতে এসেছিল। এই দেখ শিশিটা দেখ।’
মায়ের হাতে একটা ছোট্ট শিশি। মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী ওটা নাকি চন্দ্রা এনেছিল, মাকে কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াবে বলে। তাই মীনাক্ষীর সঙ্গে রান্নাঘরেও গিয়েছিল চা করতে। কিন্তু মায়ের সন্দেহ হওয়ায় পিছন পিছন গিয়ে দেখেছে এই শিশিটা খোলার চেষ্টা করছে চন্দ্রা। তখন ওটাই হাত থেকে নিয়ে মা ছুটে ওপরে চলে আসে। চন্দ্রাও ওটা নিতেই ওপরে আসে। তখন মা নিজেকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে ওকে চেপে ধরেছিল। চন্দ্রজা কোনোমতে উঠে বসল, মীনাক্ষীর হাত থেকে জলটা নিয়ে দু-ঢোক খেয়ে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তারপর মেঝের কোণে ছিটকে পড়ে থাকা ব্যাগটা তুলে নিয়ে সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল। রাহুল ডাকল, ‘চন্দ্রা প্লিজ..’ চন্দ্রজা ঘুরেও তাকাল না। বারান্দা থেকে রাহুল দেখল, ব্রজধামের গেট পেরিয়ে চলে যাচ্ছে চন্দ্রজা। পরনে একটা বেগুনি চুড়িদার। ওড়নাটা হালকা হাওয়ায় অল্প উড়ল যেন, নাকি রাহুলের চোখের ভুল। মা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। মীনাক্ষী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটোতে আতঙ্কের আঁকিবুঁকি। রাহুল ইশারায় মীনাক্ষীকে ডাকল। মীনাক্ষী ঘরে এসে বলল, ‘জেঠিমা ওষুধ খাচ্ছে না জেঠু মারা যাবার পর থেকেই। দিলেও ফেলে দিচ্ছে। আর যা পারছে করছে। চন্দ্রাদিদি এসেছিল জেঠিমাকে দেখতে। জেঠিমা চন্দ্রাদিদির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, রাগ করে আছিস এখনও আমার ওপরে? তোর আঙ্কেল তো চলে গেল। এবার তো তোদের বিয়ের দায়িত্ব আমার। রাহুলটাকে আগলে রাখিস।
একটু চা করে আনবি রে মা আমার জন্য। এই শিশিতে লবঙ্গর রস আছে চায়ে মিশিয়ে দিবি। আমি ওপরের ঘরে যাচ্ছি, চা নিয়ে ওখানে আয়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে খাবো। অনেক কথা বলার আছে তোকে। ভুলগুলো স্বীকার করার আছে। চন্দ্রাদিদির মুখে হাসি ছিল। আমার সঙ্গেই রান্নাঘরে এলো। চা করল, ওই শিশিটা থেকে লবঙ্গের রস মেশাতে গিয়ে বলল, এটা তো পয়জেন মীনাক্ষীদি। এটা কোথা থেকে এলো সরলা আন্টির কাছে?
চায়ের ট্রেটা নিয়ে এসো বলে চন্দ্রাদিদি ওপরের ঘরে যেতেই হাত থেকে শিশিটা কেড়ে নিয়ে জেঠিমা আচমকা গলা টিপে ধরল। বলল,তুই না মরলে আমি মৃন্ময়কে পাবো না। মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মরার আগে আমি মৃন্ময়ের সত্যিকারের বউ হবই। মঞ্চে অনেক সিঁদুর পরেছি ওর হাতে। বাস্তবেও পরব। চন্দ্রা তুই মরে যা। তখনই আমি ছুটে তোমায় ডাকতে এলাম। কেন যে জেঠিমা এরকম পাগলামি করছে কে জানে। রাহুলদা, জেঠুকে জেঠিমাই মেরে দেয়নি তো?’
রাহুল ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, ‘চুপ করে যাও। পুলিশ আসলেও চুপ থাকবে। মায়ের নাম উঠবে না কোথাও। যাও দেখো মা কী করছে?’
রাহুলের চোখের সামনে ভাসছে ভয় আর ঘৃণা মিশ্রিত চন্দ্রজার চোখের চাউনিটা। রাহুলের কাছে সত্যিটা বলে নিজেকে প্রমাণ করার আর যেন কোনো দায়ই নেই চন্দ্রজার। বড্ড নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় পেরিয়ে গেল ব্রজধামের সাজানো বাগানটা। একবারও ঘুরে তাকালো না বাড়িটার দিকে। অথচ যখন আগে আসতো তখন বলত, ‘রাহুল তোমাদের এই বাগানটাকে আমি বারবার ঘুরে ঘুরে দেখি। বড্ড মায়া আছে এই ফুলগাছগুলোতে। যেন সস্নেহে বলছে, ওদের একটু আদর করতে।’ রাহুল ফিসফিস করে বলত, ‘ওদের কথা তুমি শুনতে পাও চন্দ্রা আর বাগানের মালিকের মনের কথা শুনতে পাও না? সেও তো তোমায় বলছে, একটু আদর করতে।’ চন্দ্রজার চোখ ভারী হয়ে আসতো লজ্জায়। রাহুল সেদিকে তাকিয়ে হাসত।
আর বোধহয় দেরি করাটা উচিত হচ্ছে না। লগ্নজিতাম্যাডামকে ফোন করে বলা উচিত, বলে দেওয়া উচিত ব্রজমোহন চক্রবর্তীর খুনি কে, অথবা মন্টুকেই বা কে অমন করে মেরেছিল। এরপর লুকিয়ে রাখাটা বোধহয় অন্যায় হচ্ছে। প্রতিটা মৃত্যু হয়েছে শ্বাসরোধ করেই। আজ চন্দ্রজাও মারা যেত ওই একই কারণে। ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে রাহুল। ও ফোন করে বললেই, মাকে অ্যারেস্ট করবে। একজন মানসিক রোগীকে এভাবে জেলে পাঠানো কি ঠিক হবে? কিন্তু বাবা আর মন্টুর খুনিকে বাড়িতে রেখে দেওয়াটাই কি ঠিক হচ্ছে? মৃন্ময়কাকু কেন এসেছিল সেদিন, কী দেখেছিল যে বাবার ঘরে না ঢুকে বাড়ি চলে গিয়েছিল! তবে কি মায়ের অমন রুদ্র মূর্তি দেখেই ভয়ে বাগানে দাঁড়িয়েছিল? অস্থির লাগছে রাহুলের। মীনাক্ষী এসে বলল, ‘ঘুমিয়ে গেছে জেঠিমা। রাহুলদাদা, আমি আর এ বাড়িতে কাজ করব না। তোমরা আমার জন্য অনেক করেছ। কিন্তু জেঠিমা এই কদিনে যা যা করেছে সেটা আমি তোমায় বলতেও পারব না। আমি কাজ দেখেছি একটা। ওই বাড়িতে থাকব। আমায় ছেড়ে দাও। শেষে কি না ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে আমি গর্ভবতী কিনা সেসব টেস্ট করাতে বলে জেঠিমা। বলে আমার স্বামী বা ছেলে কে ওকে প্রেগন্যান্ট করেছে একটু দেখুন ডাক্তার। একটা ওষুধ রোজ জেঠুকে খাওয়াত আর বলত, এই ওষুধ খাওয়ালে তোর জেঠু আর কোনোদিন কারোর বাবা হতে পারবে না। এত অত্যাচার সহ্য করেও ছিলাম জেঠুর জন্য। আর নয়।’
রাহুল বুঝল, মীনাক্ষী অসম্ভব ভয় পেয়ে আছে। পাওয়াটা তো অস্বাভাবিকও নয়। আজ যেটা চন্দ্রার সঙ্গে হচ্ছিল কাল মীনাক্ষীর সঙ্গেও হতে পারে। মীনাক্ষী এতদিন ধরে এ বাড়িতে আছে মায়ের ধাতটা চিনে গিয়েছিল। নতুন আবার কাকে কাজে লাগবে, সে আবার থাকতে পারবে তো এ বাড়িতে! এসব কী যে করে বেড়ায় মা অযথা সন্দেহের বশে। নিজের স্বামী-ছেলেকে লোকের কাছে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করতে মায়ের কি একটুও বাধে না?
রাহুলকে চুপ করে থাকতে দেখে মীনাক্ষী বলল, ‘না বলো না রাহুলদা। আমি আর পারছি না এইসব অশান্তি। এ বাড়িতে জেঠু চলে যাবার পর খেয়েও সুখ নেই। মন্টুর ঘরের সামনে দিয়ে গেলেই বুকটা ধরাস করে ওঠে। আর থাকব না এখানে।’ রাহুল বলল, ‘দিন সাতেক একটু ওয়েট করো। আমি একটা লোকের ব্যবস্থা করছি। তারপর তুমি চলে যেও।’ মীনাক্ষী একটু দাঁড়িয়ে থেকে বলল, ‘যাওয়ার আগে আরও কয়েকটা কথা বলে যাব তোমায়।’
রাহুলের আর শুনতে ইচ্ছে করছে না মা সম্পর্কে কিছুই। মাকে নিয়ে ওর একটা অদ্ভুত রকমের টান ছিল। সেটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে যেতে এমন জায়গায় আসবে ভাবতেও পারেনি। লগ্নজিতা ভট্টাচার্যকে কলটা করতেই হবে। বাবার খুনিকে ক্ষমা করা যাবে না মা বলে। এটুকু মনের জোর রাখতে হবে রাহুলকে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন