প্রাণ-পিপাসা – সমরেশ বসু

এক কৃষ্ণপক্ষের দুর্যোগময়ী রাতের কথা বলছি।

দুর্যোগটা হঠাৎ মেঘ করে হাঁক ডাক দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে মুষলধারে দু-এক পসলা হয়ে যাওয়ার মতো নয়। একঘেয়ে রুগ্ন গলার কান্নার মতো কয়েকদিন ধরে অবিরাম ঝরছেই বৃষ্টি, তার সঙ্গে পুব হাওয়ার একটানা ঝড়। শহরতলির বড়ো সড়কটি ছাড়া আর সব কাঁচা গলিপথগুলো সুদীর্ঘ পাঁক-ভরা নর্দমা হয়ে উঠেছে। দুর্গন্ধ আর আবর্জনায় ছাওয়া অসংখ্য বাড়ির ভিড়, ঠাসা, চাপাচাপি।

পথ চলছিলাম রেল লাইনের ধারে মাঠের পথ দিয়ে। কিন্তু ভিজে ভিজে শরীরের উত্তাপটুকু আর বাঁচে না। হাওয়াটা মাঠের উপর দিয়ে সরাসরি এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল শরীরটা। রীতিমত দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি হচ্ছে। বেগতিক দেখে বাঁয়ে মোড় নিয়ে শহরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। অন্তত হাওয়ার ঝাপটা-টা কম লাগবে তো!

একটা নিস্তব্ধ ঝিমিয়ে পড়া ভাব চটকল-শহরটা। যেন কাজ এবং চাঞ্চল্য সবটুকু এই অবিরাম বৃষ্টি ভিজিয়ে ন্যাতা করে দিয়েছে। কুকুরগুলো অন্যদিন হলে বোধ হয় তেড়ে এসে ঘেউ ঘেউ করত। আজ দায়সারা-গোছের এক-আধবার গরর গরর করে গায়ের থেকে জল ঝাড়তে লাগল। গেরস্তদের তো কোনো পাত্তাই নেই। কোনো জানলা-দরজায়, একটি আলোও চোখে পড়ে না। রাস্তার আলোগুলো যেন কানা জানোয়ারের মতো স্তিমিত এক চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে, কিন্তু অন্ধকার তাতে কমেনি একটুও।

রাস্তাটা ঠিক ঠাওর করতে পারছি না, তবে উত্তর দিকেই চলেছি তা বুঝতে পারছি। একটি ধার ঘেঁষে চলেছি রাস্তার। নিচু রাস্তা, জল জমেছে। কোনো বারান্দায় যে উঠে রাতটা কাটিয়ে দেব তার কোনো উপায়ই নেই। কারণ বারান্দা বলতে যা বোঝায়, এখানে সে-রকম কিছু ঠিক চোখেও পড়ছে না আর বস্তিগুলোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ভেতরে ঘরগুলোও বোধ হয় শুকনো নেই। তা ছাড়া, অবস্থাটা তো নতুন নয়। জানা আছে, সেখানে শুয়ে পড়লে লোকজনেও নানান কথা বলতে পারে পুলিশের বেয়াদপি তো আছেই তার উপর।

যেতে হবে নৈহাটি রেল-কলোনির এক বন্ধুর কাছে। অন্তত কয়েকটা দিনের খোরাক, শুকনো কাপড় একখানি আর এমন বিদঘুটে প্যাচপেচে ঠান্ডা রাতটার জন্য একটু আশ্রয় তো পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন দেখছি আড্ডা ছেড়ে না বেরুনোই ভালো ছিল। তবে উপায় ছিল না। বিশেষ করে, কয়েকদিন আগে আমাদের আড্ডার হা-ভাতে বন্ধুদের মধ্যে একজন মরে গেল, তখন থেকেই একটু নিশ্বাস নেওয়ার জন্যে বেরিয়ে পড়ব ভাবছিলাম। বন্ধুটির মরা হয়তো ভালোই হয়েছে। তা ছাড়া আর কী হতে পারত , আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। বাঁচার জন্য যা দরকার তার কিছুই তো ছিল না, তবু বুকটার মধ্যে…যাক। ওটা কোনো কথা নয়। কিন্তু সে আমাকে একটা জিনিস দিয়ে গেছে ছোট্ট জিনিস অথচ মনে হয় পর্বতপ্রমাণ তার ভার আর কষ্টকর। বোঝাটা হল…

আরে বাপ রে হাওয়াটা যেন শিরদাঁড়াটার ভিত ধরে নাড়া দিয়ে গেল। জলটাও বেড়ে গেল হঠাৎ। এতক্ষণ পরে মেঘের গড়গড়ানিও যাচ্ছে শোনা। এবার আর দাঁত নয়, রীতিমত হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লাগছে। গাছের মরা ডালের মতো ভিজে একেবারে ঢোল হয়ে গেছি। এসে পড়লাম একটা চৌরাস্তার মোড়ে, চটকলের মাল চালানের রেল সাইডিংয়ের পাশে। জায়গাটা একটু ফাঁকা। কাছাকাছি একটা মোষের খাটাল দেখে ঢুকব কী না ভাবতে ভাবতে আর একটু এগোতেই হঠাৎ ডাক শুনতে পেলাম, এই যে, এদিকে।

না, অশরীরী কিছু বিশ্বাস না করলেও ভয়ানক চমকে উঠলাম। আমাকে নাকি? জলের ধারা ভেদ করে গলার স্বরের মালিককে খুঁজতে লাগলাম। ডানদিকে একটা মিটমিটে আলোর রেশ চোখে পড়ল আর আধ-ভেজানো দরজায় একটা মূর্তি। হ্যাঁ, মেয়েমানুষ। তা হলে আমাকে নয়। এগুচ্ছি। আবার কই গো, এসই না।

দাঁড়িয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে?

জবাব এল, তা ছাড়া আর কে আছে পথে?

কথার রকমটা শুনে চমকে উঠলাম। ও! এতক্ষণে ঠাওর হল পথটা খারাপ। ঠিক বেশ্যাপল্লি নয়, তবে একরকম তাই, মজুর-বস্তিও আছে আশেপাশে ধার ঘেঁষে।

আমি মনে মনে হাসলাম। খুব ভালো খদ্দেরকে ডেকেছে মেয়েটা! তাই ভেবেছে নাকি ও? কিন্তু সত্যি, এ সময়টা একটু যদি দাঁড়ানো যেত ওর দরজাটায়। তবু আমাকে যেতে না দেখে মেয়েটা বলে উঠল, কী রে বাবা, লোকটা কানা নাকি?

মনে মনে হেসে ভাবলাম, যাওয়াই যাক না। ব্যাপার দেখে নিজেই সরে পড়তে বলবে। আর কোনোরকমে বৃষ্টির বেগটা কমে আসা পর্যন্ত যদি মাথার উপরে একটু ঢাকনা পাওয়া যায় মন্দ কী! এমনিতে নৈহাটি দূরের কথা মোষের খাটালের বেশি কিছুতেই এগনো চলবে না। আপনি বাঁচলে বাপের নাম—প্রবাদে যারা বিশ্বাস করে তারা এ রকম অবস্থায় কখনও পড়েনি।

উঠে এলাম মেয়েটার দরজায়। একটা গতানুগতিক সংকোচ যে না ছিল তা নয়, বললাম, কেন ডাকছ?

কোন দেশি মিনসে রে বাবা!—হাসির সঙ্গে বিরক্তি মিশিয়ে বলল সে, ভিতরে এসো না।

আমি ভিতরে ঢুকতেই সে দরজা বন্ধ করে দিল। বৃষ্টির শব্দটা চাপা পড়ে গেল। একটু হাওয়া আসবার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু দেখলাম, এ ঘরের মেঝেও টালির ফাঁক দিয়ে জল পড়ে ভিজে গেছে। তক্তপোশের বিছানাটা ভেজেনি। ঘরের মধ্যে আছে দু-চারটে সামান্য জিনিস, থালা-গেলাস-কলসি।

কোথায় মরতে যাওয়া হচ্ছে দুর্যোগ মাথায় করে? এমনভাবে বলল সে, যেন আমি কতকালের কত পরিচিত।

বললাম, অনেক দূরে, কিন্তু—

বুঝেছি।—মুখ টিপে হাসল সে। ঘরটা তুমি একেবারে কাদা করে দিলে। এগুলো ছেড়ে ফেলো জলদি।

ঠান্ডায় আর আচমকা ফ্যাসাদে রীতিমত জমে যাওয়ার যোগাড় হল আমার। বললাম, কিন্তু এদিকে—

সে বলে উঠল, কী যে ছাই পরতে দিই! ভেজা জামাটা খুলে ফেলো না।

ফেলতে পারলে তো ভালোই হয়। কিন্তু গলায় একটু জোর টেনে বলেই ফেললাম মিছে ডেকেছ, এদিকে পকেট কানা।

এবার মেয়েটা থমকে গেল। যা ভেবেছি তাই। হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে খানিকক্ষণ। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করল, কিছু নেই?

তার সমস্ত আশা যেন ফুৎকারে নিবে গেছে, এমন মুখের ভাবখানা।

বললাম, তা হলে আর দুর্যোগ মাথায় করে পথে পথে ফিরি?

মেয়েটা অসহায়ের মতো চুপ করে রইল। এ তো আমি আগেই জানতাম। কিন্তু মেয়েটা এখানে ব্যাবসা করতে বসেছে, না, ভিক্ষে করতে বসেছে। আমি দরজাটা খুলতে গেলাম।

পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে এখন?

বললাম, ওই মোষের খাটালটায়। দরজাটা খুলে ফেললাম। ইস। হাওয়াটা যেন আমাকে হাঁ করে খেতে এল। পা বাড়িয়ে দিলাম বাইরে।

মেয়েটা হঠাৎ ডাকল পেছন থেকে, কই হে, শোন। রাত্তিরটা থেকেই যাও, ডেকেছি যখন। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কপালটাই খারাপ আমার।

বললাম, কেন কপালটা ভালো থাকুক তোমার, আমি খাটালেই যাই।

যা তোমার ইচ্ছে। হতাশভাবে বসে পড়ল সে তক্তাপোশে। আজ তো আর কোন আশাই নেই।

ভাবলাম, মন্দ কী? এই দুর্যোগে এমন আশ্রয়টা যখন পাওয়াই যাচ্ছে কেন আর ছাড়ি। কিন্তু মেয়েমানুষের সঙ্গে রাত কাটানোটা ভারি বিশ্রী মনে হল। কেননা, এটা একেবারে নতুন আমার কাছে। অবশ্য মেয়েমানুষ সম্পর্কে আমার আগ্রহ এবং কৌতূহল তোমাদের আর দশজনের চেয়ে হয়তো একটু বেশিই আছে। তা বলে এখানে? ছি-ছি! সে আমি পারব না। …তবে ওর সঙ্গে না শুয়েও রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যায়। ভেতরে ঢুকে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলাম।

লম্বা ছেয়ালো গড়ন মেয়েটার। মাজা মাজা রঙ। গাল দুটো বসা, বড়ো বড়ো চোখ দুটো অবিকল কচিঘাস-সন্ধানী গোরুর চোখের মতো। ওই চোখে মুখে আবার রঙ কাজল মাখা হয়েছে। মোটা ঠোঁট দুটোর উপরে নাকের ডগাটা যেন আকাশমুখো।

খুঁজে খুঁজে সে আমাকে একটা পুরনো সায়া দিল পরতে, বলল, এইটে ছাড়া কিছু নেই।

সায়া! হাসি পেল আমার। যাক, কেউ তো দেখতে আসছে না, কিন্তু—

ধক করে উঠল আমার বুকটার মধ্যে। তাড়াতাড়ি পকেটে চাপ দিলাম আমি। মরবার সময় আমার বন্ধু যে ছোট্ট জিনিসটা পর্বতের বোঝার মতো চাপিয়ে দিয়ে গেছে সেটা দেখে নিলাম। জিনিস না, একটা রক্তের ডেলা। হ্যাঁ রক্তের ডেলাই। ভীষণ সংশয় হল আমার মনে! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালাম! সে তখন পিছন ফিরে জামার ভিতরের বডিস খুলছে। বললাম, কিছু কিন্তু নেই আমার কাছে, হ্যাঁ।

কবার শোনাবে বাপু আর ওই কথাটা—সে হতাশভাবে বলল।

হ্যাঁ বাবা। বললাম, বলে রাখা ভালো। তবে আমার কোনো ইচ্ছে নেই কিছু। খালি মুসাফিরের মতো রাতটা কাটিয়ে দেওয়া।

মেয়েটা ওর গোরুর মতো চোখ তুলে একদৃষ্টে দেখল আমাকে। বলল, কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিচ্ছে?

তা বটে। আমি সায়াটা পরে নিলাম। কিন্তু খালি গায়ে কাঁপুনিটা বেড়ে উঠল। বাইরে জল আর হাওয়ার শব্দে দরজাতে বেশ খানিকটা আলোড়ন তুলে দিয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে একপ্রস্থ হেসে নিয়ে একটা পুরোনো শাড়ি দিলে ছুঁড়ে। নাও, গায়ে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো।

বলে আমার জামা কাপড় দড়িতে ছড়িয়ে দিল। বলল, একটু আঁসিয়ে যাবে খন।

আরাম জিনিসটা বড়ো মারাত্মক, বিশেষ এ-রকম একটা দুরবস্থার মধ্যে। আমি প্রায় ভুলেই গেলাম যে, আমি একটা বাজারের মেয়ে মানুষের ঘরে আছি। বললাম, পেটটা একেবারে ফাঁকা দুদিন ধরে, তাই এত কাবু করে ফেলেছে জলে।

সে কোনো জবাব দিল না। হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে রইল। বললাম, তা হলে শোয়া যাক।

সে মুখ তুলল। মুখটা যন্ত্রণাকাতর, তার সুস্পষ্ট বুকের হাড়গুলো নিশ্বাসে ওঠানামা করছে। বলল, খাবে? ভাত চচ্চড়ি আছে।

ভাত চচ্চড়ি? সত্যি, এটা একেবারে আশাতীত। ভাতের গন্ধেই যার অর্ধেক পেট ভরে তার সামনে ভাত। জিভটাতে জল কাটতে লাগল আর পেটটা যেন আলাদা একটা জীব। ভাত কথাটা শুনেই ভেতরটা নড়ে চড়ে উঠল। কিন্তু—

সে ততক্ষণে এনামেলের থালায় ভাত বাড়তে শুরু করেছে। দেখে আমার মনের সংশয়টা আবার বেড়ে উঠল। আমি দড়ির উপর থেকে জামাটা তুলে নিলাম তাড়াতাড়ি। গতিক তো ভালো মনে হচ্ছে না। সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, ভাতের পয়সা-টয়সা কিন্তু নেই আমার কাছে।

গোরুর মতো চোখ দুটোতে এবার বিরক্তি দেখা গেল। বলল, মোষের খাটালই তোমার জায়গা দেখছি। কবার শোনাবে কথাটা।

সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো। হতভাগা মরবার সময় এমন জিনিসই দিয়ে গেল, এখন সেই বোঝা নিয়ে আমার চলাই দায়। রাখাও বিষ, ছাড়াও বিষ। বাইরে পড়ে থাকলে এ বোঝাটার কথা হয়তো মনে থাকত না। সে আবার বলল মানুষের সঙ্গে বাস করনি তুমি কখনও।

শোনো কথা। তাও আবার জিজ্ঞেস করছে কারখানা বাজারের মেয়েমানুষ। বললাম করেছি তবে তোমাদের মতো মানুষের সঙ্গে নয়।

সে নিশ্চুপে তাকিয়ে রইল আমার দিকে খানিকক্ষণ। তারপর বলল, রয়েছে যখন খেয়ে নাও, নইলে নষ্ট হবে। ভেবে দেখলাম তাতে আর আপত্তি কী? বিনা পয়সার ভাত। আর দেখছেই বা কে ! জামাটার হাত গুটিয়ে নিয়ে গপাগপ করে ভাত খেয়ে নিলাম। তারপর একঘটি জল। এ-রকম বাড়া ভাত খেয়ে ব্যাপারটা আমার কাছে চূড়ান্ত বাবুগিরি বলে মনে হল আর সেই জন্যই সংশয়টা বাঁধা রইল মনে আষ্টেপৃষ্টে।

তারপর শোয়া। সে এক ফ্যাসাদ। আমি শুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি শোবে কোথায়? সে নিরুত্তরে আমার দিকে তাকিয়ে খসা-ঘোমটাটা টেনে দিল। তা হলে তুমি শোও আমি বসে রাতটা কাটিয়ে দি।—আমি বললাম।

সে পাশতলার দিকে বসে বলল তুমিই শোও, আমি তো রোজ শুই। একটা রাত তো। ডেকেছি যখন…

বলতে বলতে আমার হাতের মুঠির মধ্যে জামাটা দেখে সে দড়ির দিকে দেখল তারপর আমার দিকে। আমিও তাকিয়েছিলাম। বলল, জামাটা ভেজা যে।

হোক তাতে তোমার কী?

চুপ করে গেল সে। শরীরটা আরাম পেয়ে আমার মনে হল সিটনো তন্ত্রীগুলো স্বাভাবিক সতেজ ও গরম হয়ে উঠেছে। বাইরের যে জল হাওয়া আমাকে এতক্ষণ মেরে ফেলতে চেয়েছিল তারই চাপা শব্দ যেন আমার কাছে ঘুমপাড়ানি গানের মতো মিষ্টি মনে হল। চোখের পাতা ভারী হয়ে এল বেশ।

ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। তেমনি বসে আছে। চোখের দৃষ্টিটা ঠিক কোনদিকে বোঝা যাচ্ছে না! অত্যন্ত ক্লান্ত আর চাপা যন্ত্রণার আভাস তার চোখে। কী জানি এদের নাকি আবার ঢঙের অভাব হয় না। হয়তো ঘুমিয়ে পড়ব তখন—

নাঃ, হতভাগার এ জিনিসটার ব্যবস্থা আমি কালকেই করে ফেলব। কী দরকার ছিল মরবার সময় আমাকে এটা দিয়ে যাওয়ার? একটা রক্তের ডেলা। রক্তের ডেলাই তো। ঘামের গন্ধে ভরা ছোট্ট ন্যাকড়ার পুঁটলিটা। একটা রাক্ষুসে খিদে-খিদে গন্ধও আছে। ছোঁড়া মরতে মরতে মুখের কষ-বওয়া রক্ত চেটে নিয়ে বলেছিল, এটা তুই রাখ।

এমনভাবে বলেছিল কথাটা যে আজও মনে করলে বুকটার মধ্যে—যাক সে কথা।

মেয়েটা তখনও ওইভাবে বসে আছে দেখে হঠাৎ বলে ফেললাম তুমিও শুয়ে পড় খানিকটা তফাত রেখে।

সে আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। বলল, ছিষ্টিছাড়া মানুষ বাবা।

তারপর শুয়ে পড়ল।

আমার শরীরটা তখন আরামে রীতিমত ঢিলে হয়ে এসেছে। আর মেয়েমানুষের গা যে এত গরম তা মেয়েটার কাছ থেকে বেশ খানিকটা তফাতে থেকেও আমি বুঝতে পারলাম। কী অদ্ভুত রাত আর বিচিত্র পরিবেশ। লোক দেখলে কী বলত! ছি-ছি! কিন্তু এতখানি আরাম আমার দুঃস্থ ক্লান্ত শরীরে এতখানি সুখবোধ আর কখনও পেয়েছি কী না মনে নেই। ঘুমে ঢুলে আসছে চোখ। কিন্তু—

না, তা হবে না। সেই বন্ধুটির কথা বলছি। হতচ্ছাড়া মরবার সময় বলে গেল পুঁটলিটা দিয়ে, আমার রক্ত।

বললাম রক্ত কিসের?

চোখের জল আর কষের রক্ত মুছে বলল, আমার বুকের। না খেয়ে খেয়ে রোজ—

বলতে বলতে রক্তশূন্য অস্থির আঙুলগুলো দিয়ে হাতড়াতে লাগল পুঁটলিটা।

আমি রাগ সামলাতে পারলাম না। বললাম কিসের জন্য র্যা?

বলল, ঘর বাঁধার আশায়।

এমনভাবে বলেছিল কথাটা ফের গালাগালি দিতে গিয়ে আমার গলাটার মধ্যে…

যাক সে কথা।

মেয়েটা একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে উঠল।

জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?

সে তাকাল। চোখ দুটো যেন যন্ত্রণায় লাল আর কান্নার আভাস তাতে। বলল, কিছু না।

তার গরম নিশ্বাসে এত আরাম লাগল আমার গায়ে। ঠান্ডা-জমে-যাওয়া গায়ে যেন কেউ তাপ বুলিয়ে দিচ্ছে। মনে হল হঠাৎ, খুব খারাপ নয় দেখতে। ঠোঁট আর নাকটা একটু খারাপ। বোজা চোখের পাতা, বুকে জড়ানো হাত দুটো আর তার নমিত বুক বিচিত্র মায়ার সৃষ্টি করল। সে জিজ্ঞেস করল আমাকে, ঘুম আসছে না তোমার?

আমি ঘুমুব না—বললাম। মনে মনে ভাবলাম, তা হলে তোমার বড়ো সুবিধে হয় না? সেটি হচ্ছে না বাবা। কথা বললেই তো সংশয়টা বাড়ে আমার মনে। তার চেয়ে চুপ করে থাকুক না।

বাইরের তাণ্ডব তখনও পুরো দমেই চলেছে। টালি-চোঁয়ানো জলের ফোঁটার শব্দ আসছে মেঝে থেকে, সঙ্গে ছুঁচোর কেত্তন।

সে আবার ককিয়ে উঠল।

কী হয়েছে?

একটু চুপ করে থেকে বলল, রোগ।

রোগ! কিসের রোগ।

সে-নীরব।

বলো না বাপু।

তবুও নীরব।

আমি হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠলাম, বলো না কেন রোগটা। যক্ষ্মা কলেরা-টলেরা হলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ি। রোগের সঙ্গে পীরিত নেই বাবা।

সেও হঠাৎ মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, কার সঙ্গে আছে তোমার পীরিত, শুনি?

তা বটে, পীরিতের কথাই তো ওঠে না এখানে। বললাম, তা বলই না কেন রোগটা।

যা হয় এ লাইনে থাকলে—সে বললে।

লাইনে থাকলে। সর্বনাশ! ভীষণ সিটিয়ে গেলাম। ভয়ে ঘৃণায় জিজ্ঞাস করলাম, এর ওপরও সন্ধ্যারাত্র—

নিশ্চয়ই।

পাঁচজন—সে বলল।

ইস! কী সাংঘাতিক! বললাম, চিকিচ্ছে করাও না কেন?

পয়সা পাব কোথায়?

কেন, নিজের রোজগার?

সে তো মনিবের পয়সা।

মনিব? এটা কি চাকরি নাকি?

নয় তো কী? মনিবের ব্যাবসা, ঘর-দোর জায়গা জিনিস। আমরা আসি খাটতে।

ভয়ানক দমে গেলাম কথাগুলো শুনে। এরা বেশ মজায় থাকে না তা হলে? এও চাকরি! বললাম, মনিব শালাই বা কেমন , চিকিচ্ছে করায় না কেন?

যখন মর্জি হয়। কলের মানুষ রাতদিন কত মরছে, কলের মালিকরা তাদের চিকিচ্ছে করায়?

ঠিক। তার বেদনার্ত শান্ত চোখের দৃষ্টি এবার আমাকে সত্যিই দিশেহারা করে তুলল। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক প্রাণ দেয়, কিন্তু জীবনের এ কী প্রতিরোধের লড়াই? বললাম, তা হলে…

সে বলল, তা হলে কী। মনিবের চোখে ধুলো দিয়ে যেটা রোজগার হয়, তাতে চিকিচ্ছে করাই।

বাঁচতে?—হাসতে গিয়ে মুখটা বিকৃত হয়ে গেল আমার।

সকলেই বাঁচতে চায়।—সে বলল যন্ত্রণায় ঠোঁট টিপে।

ঠিকই। ডাঙায় বাঘ আছে জেনেও মানুষ এ ডাঙাতেই তার বাস ও জনপদ গড়ে তুলেছে। বন্যা, ঝড়, ক্ষুধা, কী নেই। তবু। আর সেই হতচ্ছাড়া চেয়েছিল, ঘর বাঁধতে। হ্যাঁ, তবু পুঁটলির প্রতিটি পয়সা রক্তের ফোঁটা। রক্তের ডেলা একটা—এই পুঁটলিটা।

সে বলল, ঘুমুবে না?

না, ঘুম নেই চোখে। ওর নিশ্বাস লাগছে। যন্ত্রণার গরম নিশ্বাস। মিঠে তাপ, তেপে তেপে গনগনে আগুনের মতো মনে হল। শক্ত করে পুঁটলি শুদ্ধ জামাটা চেপে ধরে উঠে পড়লাম। বাইরে ঝড়-জলের দুর্যোগ তেমনই। রাত প্রায় কাবার। নিজের জামা কাপড় পড়ে নিলাম।

সে উঠল। হাসতে চাইল , চললে?

পকেটে হাত দিয়ে শক্ত পুঁটলিটা চেপে ধরে বললাম, হ্যাঁ।

হতভাগা মুখের কষ-বওয়া রক্ত চেটে নিয়ে বলেছিল মরতে মরতে, এটা তুই রাখ! কেন? কেন?

মেয়েটা বলল, যন্ত্রণায় চাপা গলায়, আবার এসো।

মেয়েটার কী চোখ! সমস্ত মুখটি লাঞ্ছনার দাগে ভরা, আকাশমুখো নাক, মোটা ঠোঁট। কিন্তু এমন মুখ তো আর কখনও দেখিনি।

ভীষণ রেগে ওর দিকে ফিরে পুঁটলিটি ওর হাতে তুলে দিলাম। ওর নিশ্বাস লাগল আমার গায়ে। মুহূর্তে চোখ নামিয়ে একটি অশান্ত ক্রোধে দাঁতে দাঁত ঘষে বেরিয়ে এলাম পথের উপরে।

সে কী একটা বলল পেছন থেকে। হাওয়ায় ভেসে গেল সে কথা। বললাম, পিছু ডেকো না।

বোঝামুক্ত আমি উত্তর দিকে এগিয়ে চললাম। বানপ্রস্থ নয়, বন্ধুর বাড়িতে, পুবে হাওয়া ঠেলে দিতে চাইল পশ্চিম গঙ্গার ঘাটের দিকে। পারল না।

সকল অধ্যায়

১. বিচারক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. ডালিম – চিত্তরঞ্জন দাশ
৩. চন্দ্রমুখী – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪. ঠিকানায় ‘বুধবার’ – জগদীশ গুপ্ত
৫. কুসুম – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৬. আদরিণী – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
৭. সাকীর প্রথম রাত্রি – রমেশচন্দ্র সেন
৮. হিঙের কচুরি – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. মেলা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১০. মন্দ লোক – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. দন্ত কৌমুদী – বনফুল
১২. গোষ্পদ – যুবনাশ্ব
১৩. ইতি – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
১৪. খট্টাঙ্গ পুরাণ – শিবরাম চক্রবর্তী
১৫. দুকানকাটা – অন্নদাশংকর রায়
১৬. চাচা কাহিনি – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৭. বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৮. অঙ্গার – প্রবোধকুমার সান্যাল
১৯. নমুনা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২০. চোর! চোর! – বুদ্ধদেব বসু
২১. বারবধূ – সুবোধ ঘোষ
২২. ট্যাক্সিওয়ালা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
২৩. বাইজি – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৪. তিমিরাভিসার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. জামাই – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
২৬. তলানি – নবেন্দু ঘোষ
২৭. মাশুল – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
২৮. শনি – সন্তোষকুমার ঘোষ
২৯. আঙুরলতা – বিমল কর
৩০. সুর্মা – রমাপদ চৌধুরী
৩১. ঘরন্তী – বিমল মিত্র
৩২. প্রাণ-পিপাসা – সমরেশ বসু
৩৩. বাগাল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৪. ছদ্মবেশিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. নরক – প্রফুল্ল রায়
৩৬. পহেলি পেয়ার – বুদ্ধদেব গুহ
৩৭. নিরুদ্দেশ প্রাপ্তি হারানো – সমরেশ মজুমদার
৩৮. বেওয়ারিশ লাশ – জাহান আরা সিদ্দিকী
৩৯. ঝরা পাতা – তসলিমা নাসরিন
৪০. নিজের সঙ্গে দেখা – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন