বাইরের বারন্দায় অনেকগুলি পায়ের শব্দ শোনা যায়, তার সঙ্গে একদল মেয়ে ও পুরুষের হাসিখুশী আলাপের কলরব। কারা যেন এসেছে। এইবার কড়া নাড়ছে।
শুনছেন। বাইরে থেকে এক ভদ্রলোকের গলার স্বর শোনা গেল।
ঘরের ভেতর চমকে উঠলো প্রসাদ। চেয়ারটা ছেড়ে চকিতে উঠে দাঁড়ালো। ঘরের অবস্থা যেমন অসম্বৃত, তার বুদ্ধিও তখনকার মত তেমনি অপ্রস্তুত। ফাঁপরে পড়লো প্রাসাদ। চাপা গলায় আস্তে আস্তে বললো—যা ভয় করেছিলাম, শেষে তাই হল লতা। শিগগির ওঠ।
লতা বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে বলে—আমাকে মিছে ভোগাও কেন? আমি ওসবের কি ধার ধারি?
তাকিয়ার ওপর এলিয়ে শুয়ে তেমনি নিবিষ্টমনে সিগারেট খেতে থাকে লতা। পাশে টেবিলের ওপর একটা বীয়ারের বোতল আর চাবি, তখনো ছিপি খোলা হয়নি। একটা রেশমী শাড়ী এলোমেলোভাবে লতার কোমরে জড়ানো। সন্ধ্যাপ্রদীপের আলোতে সবেমাত্র বৈঠক তখন বসেছে।
অন্যায় করছো লতা। ওঠ লক্ষ্মীটি। তাড়াতাড়ি ঘরটা গুছিয়ে ফেল। এতে শুধু আমারই মান বাঁচবে তা নয়, তোমারও। একটু ভদ্রতা রক্ষা করে চলতে দোষ কি? ওঠ, কিছুক্ষণের জন্য একটু কষ্ট কর, অনেকক্ষণ ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
লতা উঠলো। প্রসাদ তাড়াতাড়ি বীয়ারের বোতলটা আলমারিতে তুলে বন্ধ করলো। ঘরের দেয়ালে টাঙানো দুটো বড় বড় ছবি নামিয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে রাখলো। যতদূর সম্ভব ঘরের মূর্তিটাকে দু’চোখ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো প্রসাদ, কোথাও কোন অপরুচির ইঙ্গিত সব সতর্কতাকে ফাঁকি দিয়ে যদি বা লুকিয়ে থাকে। হাঁ, ঐ পর্দাটা—জরির কাজ-করা এক জোড়া বিলিতী নগ্নিকা বাতাসের দোলায় কুৎসিতভাবে ঢলাঢলি করছিল তখনো। প্রসাদ পর্দাটাকে এক থাবা দিয়ে ধরে কুঁচকে পাকিয়ে, খাটের তলায় ছুঁড়ে দিল।
প্রসাদ—এইবার তুমি একটু তাড়াতাড়ি……।
লতা—নাঃ, আর পারি না। তোমার ভদ্দোরপনার ভড়ং রাখতে গিয়ে বার বার বাইরের লোকের কাছে ঢঙ দেখাতে পারবো না। সারাটা দিন তো তোমার মানের ভয়ে চাকর-বাকরের সামনে একটু জোরে হাসতে কাশতেও পারি না। এতই যদি পারি, তবে তোমার কাছে বাঁধা থাকবো কেন? থিয়েটারে খাটলে দুদশ’শো হতো।
প্রসাদ যত ব্যস্ত হয়ে ওঠে, লতার উৎসাহ যেন ততই এক নির্বিকার হৃদয়হীনতায় শ্লথ হয়ে পড়ে থাকে। প্রসাদ অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখের চেহারাটা যেন বলছে—জোর করছি না। দয়া করে উদ্ধার কর।
ফিক করে হেসে ফেলে লতা। প্রসাদের থুতনিটা নেড়ে দিয়ে বলে—ডুডু খাবে খোকা? ভদ্দোরলোকের ভয়ে বুক দুর দুর করে, মেয়েমানুষ রাখার শখ কেন? শ্যাম রাখি কুল রাখি—দুই-ই একসঙ্গে হয় না।
লতা একটা তোয়ালে আর শাড়ি আলনা থেকে তুলে নিয়ে স্নানের ঘরে চলে যায়। প্রসাদের বুক থেকে বদ্ধ নিঃশ্বাসটা মুক্তি পায়। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বাইরের ঘরের দরজা খুলে দেয়। জন চারেক প্রৌঢ় বৃদ্ধ ও যুবক ছ’সাতটি প্রৌঢ়া ও তরুণী আর গোটা দশেক ছোট ছোট মেয়ে মুহূর্তের মধ্যে হুড়মুড় করে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
হিলতোলা জুতো আর স্যাণ্ডেলের শব্দ। একপাল ছেলের উল্লম্ফ হুটোপুটি, শাড়ি আর আঁচলের খসখস ফিসফাস শব্দ, চুড়ির নিক্কণ, পাউডার ও এসেন্সের একটা সুবাসিত ঝড়, তার সঙ্গে বৃদ্ধ পৌঢ়দের চুরুটের ধোঁয়া আর হাতছড়ির ঠুকঠাক—বাইরের পৃথিবী থেকে একটা প্রীতি ও সজ্জনতার উচ্ছ্বাস যেন প্রসাদের ঘরের দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে এসে ছড়িয়ে পড়লো। প্রসাদ হাসি মুখে নমস্কার জানায়—আসুন।
বেশ লোক এঁরা। ব্যবহারে কোন জড়তা নেই। কেতাদুরস্তী ভদ্রয়ানার বালাই নেই। অপরিচয়ের সঙ্কোচ নেই। বৃদ্ধ রাখালবাবু গা থেকে আলোয়ানের স্তূপ নামিয়ে প্রসাদের খাটের ওপরেই তাকিয়া টেনে বসে পড়লেন। যে যার ইচ্ছামত চেয়ার টেনে নিল। মেয়েরা ব্র্যাকেট থেকে একটা গোটানো সূতির গালিচা নিজেরাই নামিয়ে নেয়, মেঝের ওপর পাতে এবং বসে পড়ে।
এক যুবক-আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে এক বৃদ্ধ-আগন্তুক বললেন।—এইবার তোমার অভিযোগ শুনিয়ে দাও, রণজিৎ।
রণজিৎ প্রসাদের দিকে তাকিয়ে বলে—সত্যি মশাই, আপনার বিরুদ্ধে আমাদের অনেক কথা বলবার আছে। আমরাও আপনার মতই এখানে চেঞ্জে এসেছি। এই তো ক’ঘর মাত্র আমরা, এ ছাড়া আর কোন বাঙালীর মুখ দেখতে পাই না। আমরা খুঁজছি কি করে দল ভারি করি, আর আপনি বেমালুম আড়ালে লুকিয়ে আছেন?
প্রসাদ সলজ্জভাবে স্বীকার করে নিল—হ্যাঁ, এটা অন্যায় হয়েছে।
মেয়েদের দল থেকে প্রথম কথা বললো আভা, রণজিতের বোন।
বড়দা, তোমরা তো এরই মধ্যে নিজেদের দল ভারি করে ফেললে। আমরা কি করি? ভেতর থেকে তো কারও কোন সাড়াশব্দ পাচ্ছি না।
প্রসাদ তেমনি লজ্জিতভাবে হেসে বলে।—একটু অপেক্ষা করুন, এক্ষুনি আসছেন।
পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকলো লতা।
চওড়া-পাড় একটা তাঁতের শাড়ি পরেছে লতা। ঘরে ঢুকে সামনেই বুড়ো রাখালবাবুকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ায় লতা, মাথার কাপড়টা আরও একটু টেনে সামনে নামিয়ে দেয়। লতার সিঁথিতে লম্বা সিঁদুরের টান, পায়ে জুতো নেই তাই দেখা যায় সরু আলতার রেখা।
লতাকে দেখবার পর প্রসাদের মুখের ওপর থেকে এতক্ষণের ভীরুতা ও কাতরতার খিন্ন ছায়াটুকু সরে গেল। কথাবার্তায় সহজ স্ফূর্তি ফিরে পেল প্রসাদ।
রণজিতের বোন আভা লতাকে হাত ধরে গালিচার ওপর বসাবার জন্য একবার টানলো, লতা বললো—ভেতরে চলুন।
বাইরের ঘরে ও ভেতরের ঘরে অবধি গল্প তর্ক ও হাসির পালা গড়িয়ে চললো অনেকক্ষণ। ছেলেপিলেরা দু’বার মারামারি বাধালো। তাদের থামাতে গিয়ে বুড়োরা গোলমাল করলো আরও বেশি। আজ দেড় মাসের মধ্যে বরাকর কলোনির একান্তে এই নিরালা বাংলো বাড়িটার কোন সন্ধ্যা আজকের মত এত হর্ষমুখর হয়ে ওঠেনি।
অভ্যাগতদের আপ্যায়িত করার জন্য লতা খাবার তৈরী করবার উদ্যোগ করে। মেয়েরা সবাই মিলে প্রতিবাদ করে—শুধু চা হলেই হবে, খাবার-টাবার করবেন না, খবরদার।
লতা বলে—কিন্তু ছেলেরা কি খাবে? শুধু চা? তা হতে পারে না।
লতা রাগ করেই বলে—দেখছেন তো ওদিকে মশাই কেমন নিশ্চিন্ত মনে শুধু কথা দিয়ে চিঁড়ে ভেজাচ্ছেন। এদিকের কাজের জন্য কোন হুঁশ নেই, একটু খোঁজ-খবর নেই।
মেয়েরা হেসে উঠলো সবাই—তা বেশ করেছেন, আপনি হিংসে করছেন কেন?
আভা হঠাৎ নিজের খেয়ালেই বাইরের ঘরে এসে বলে—বৌদি রাগ করছেন। ভেতরে কত কাজ রয়েছে, আর আপনি এখানে গল্পে ডুবে আছেন?
প্রসাদ—কেন কি ব্যাপার?
আভা—স্বয়ং এসে খোঁজ নিন।
লতাও সঙ্গে এসেছিল। দরজার আড়ালে ভেতরের দাওয়ার অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল। প্রসাদ ভেতরে আসতেই ফিসফিস করে লতা বলে—চা না হয় হলো, কিন্তু ছেলেপিলেদের কি দেব? তুমি একবার বাজারে ঘুরে এস, কিছু মিষ্টি টিষ্টি…।
আভা এবং আরও দুটি তরুণী ঐ মৃদু ফিসফিসের ভাবার্থ বুঝতে পেরেই একসঙ্গে প্রতিবাদ করে—বৌদি বড় বাড়াবাড়ি করছেন!
প্রসাদ বলে—বিস্কুটের টিনটা খুললে হয় না? নইলে বাজার যেতে হয়।
লতা বলে—তাইতো, মনে ছিল না। যাক, ওতেই হবে।
বিস্কুটের টিন শূন্য করে দিল ছেলের দল। মেলামেশার পালা ক্ষান্ত হল রাত্রি দশটায়। তার আগে প্রসাদকে গাইতে হলো গান, ঘরের কোণে শালুর খোলে ঢাকা এসরাজটা গুণী প্রসাদের পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছিল।
রাখালবাবু আলোয়ানটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়ালেন আবার। রাখালবাবুর স্ত্রী, মেয়েরা এঁকে মাসীমা বলে ডাকছিল, পায়ের মোজাটা টেনেটুনে ঠিক করলেন। তাঁর ফোলা ফোলা পা দুটোতে বেরিবেরির নিদর্শন স্পষ্ট। তারকবাবু নতুন চুরুট ধরিয়ে হাতছড়িটা আবার ঠুকলেন। আভা ছাড়া সঙ্গের আর তিনটি মেয়েই হল তাঁর ভাগ্নী, ভাইঝি আর শ্যালিকা। ছেলেপিলেদের মধ্যে চারজন হল রাখালবাবুর নাতি, বাকী সবকটি হরিশবাবুর। হরিশ দম্পতি আজ অনুপস্থিত। তাঁরা বাতের প্রকোপে এখন শয্যা আশ্রয় করে আছেন।
রাখালবাবু বললেন।—তা হলে এইবার তোমায় মুক্তি দেব প্রসাদবাবু। রাত হল অনেক। আমরা উঠি।
বিদায় প্রসঙ্গে আর একবার আলাপবার্তার কলগুঞ্জন মুখর হয়ে উঠলো। প্রসাদ ফটক পর্যন্ত লণ্ঠন হাতে এগিয়ে এল। লতা সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে রইল ছায়ার মত।
চলে গেল আগন্তুকের দল।
আঃ বাঁচা গেল! বীয়ারের বোতলটা আবার টেবিলের ওপর নামালো প্রসাদ। শরীরটা যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল লতার, তাই বিছানার ওপর একটা বালিশ আঁকড়ে চুপ করে শুয়ে রইল।
কিন্তু প্রসাদের গলার স্বরে স্ফূর্তি চড়ে উঠেছে—একি? উঠে বসো লতা, এ সময়ে বে-রসিকতা করো না মাইরি!
লতা কোনো সাড়া না দিয়ে তেমনি নিঝুম হয়ে শুয়ে থাকে। প্রসাদ হাত ধরে টানাটানি করতেই উঠে বসে এবং রুক্ষস্বরে বলে—যখন তখন অসভ্যতা করো না।
প্রসাদ—বেশ বেশ, করবো না। যাও, এবার চটপট এই আলতা ফালতা সাজসঙ বদলে এস। এক পাত্র চড়িয়ে নিয়ে বসা যাক জুত করে।
লতা—এ রকম ক্যাংলাপনা করছো কেন? কিছু ফুরিয়ে যাচ্ছে না।
পাশের ঘরে চলে গেল লতা। তাঁতের শাড়ি ছাড়লো, আলতা সিঁদুর মুছে ফেললো। আকস্মিক একটি সন্ধ্যার কপট বধূবৃত্তির নির্মোক ঘুচিয়ে, পায়জামা পরে চটি পায়ে দিয়ে এসে আবার ঘরে ঢুকলো।
প্রসাদ খুশীতে আটখানা হয়ে গেল—বাঃ, সত্যিই তোমাকে ফাইন মানিয়েছে এবার।
লতার কানে যেন কথাটা গেল না , ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো লতা। দূরে বরাকরের পুলের ওপর একটা আলোর সারি মিটমিট করছে। আর কিছুই দেখা যায় না। নিকটেই একটা নামহীন ফুলের গাছের তলা থেকে স্তূপীকৃত বাসি ফুলের পচাটে গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে। লতা লম্বা লম্বা টান দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়ায় মুখ ভরে নেয়, আস্তে আস্তে ছাড়ে।
কিছুক্ষণ পরে প্রসাদের যেন চমক ভাঙলো। দ্বিতীয় বীয়ারের বোতলটা শেষ হয়েছে। লতা তখনো জানালার কাছে দাঁড়িয়ে। প্রসাদ ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকায়। তারপর বিড়বিড় করে বলে, স্বর জড়িয়ে যায়—বেশ, বেশ! ঐখানে দাঁড়িয়ে থাক। দূরেতে বন্ধু দূরেতে রহ। কিন্তু তুমি বাবা পাকা খেলোয়াড়। এতগুলি ভদ্র নরনারীকে দিনে তারা দেখিয়ে দিলে বাবা। তবু থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আমার মান বাঁচিয়েছ। তোমাকে বখশিশ দেব। আসছে বছর কাশ্মীর। কিন্তু…….কিন্তু তুমি আমাকে এইমাত্র অসভ্য বলেছ। ইউ ভ্রষ্টা মুড়িওয়ালীর বাচ্চী। আমি তোমাকে জুতিয়ে…।
টেবিলটা একটা ঠেলা মেরে উল্টে দিয়ে সরোষে দাঁত ঘষে প্রসাদ একটা হুমকি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
লতা শান্ত ও সহজ অথচ দৃঢ়স্বরে বলে—হঠাৎ এত মেজাজ জেগে উঠলো কেন? বসো বলছি!
প্রসাদের মেজাজ কুলকাঠের আগুনের মত তবু যেন থেকে থেকে সশব্দে ছিটকে পড়ছিল। লতা খুব ভালো করেই এ-রাগের ওষুধ জানে। এখনি প্রসাদের কোলের ওপর পা দুটো চড়িয়ে দিয়ে যদি একটু ফষ্টি করা যায়, অথবা দুটো খেউড় গেয়ে ওঠে, তবে ঐ মেজাজের আগুন ঠাণ্ডা ছাই হয়ে উঠতে কতক্ষণ।
প্রসাদ লতার মুখের দিকে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে, একটা দৃপ্ত ভঙ্গি নিয়ে বলে—যেমন রেখেছি তেমনি থাকবে!
লতা—বলছি তো তাই থাকবো।
প্রসাদ—তবে এত পোজ করছো কেন? তুমি তো বাঁধা মেয়েমানুষ মাত্র।
লতা—তা তো জানিই।
প্রসাদ—তুমি আমার চাকরানি হবার যোগ্য নও।
হঠাৎ যেন আগুনের ঝাপটা লেগে লতা ছটফট করে উঠলো। এতক্ষণ প্রসাদের বকাবকিকে নেশাড়ে মানুষের মূঢ়তা মনে করেই চুপ করে ছিল লতা। কিন্তু এই কথাগুলির ভিতর দিয়ে যেন একটি অতি সূক্ষ্ম সত্যের ইঙ্গিত ঝিলিক দিয়ে উঠেছে।
প্রসাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারের হাতলটা ধরে তার মুখের ওপর কঠোরভাবে তাকিয়ে রইল লতা। কিন্তু লতার ক্ষোভ শুধু ফণা তুলে দাঁড়াল মাত্র। ছোবল আর পড়লো না।
তোমার কাছে বাঁধা থাকতে কোন গরজ নেই আমার। আমি কালই চলে যাব তারকেশ্বরে। লতা সরে এসে আস্তে আস্তে পাশের ঘরে গিয়ে দরজার খিল এঁটে দিল।
অনেক রাত্রে একটানা স্তব্ধতার পর লতার ঘরের কড়া বেজে উঠলো আবার। নেশা কেটে যাবার পর প্রসাদের মনের অবসাদের মধ্যে সেই ভালোমানুষী ভীরুতা যেন আবার সতর্ক হয়ে উঠেছে। লতাকে সে ভালো করেই চেনে। এসব মানুষকে চটিয়ে লাভ নেই। জীবনের চোরাঘরে ওরা পাপের সঙ্গে চুক্তি করে চলে। বাইরের আঙিনা যেখানে আত্মীয়তার মেলা, সেটা ওদের কাছে বিদেশের মত দুর্বোধ্য। তার মর্যাদা দেবার কোন দরদ ওদের নেই। লোকসমাজে প্রসাদের মান মর্যাদার জন্য কতটুকু মাথাব্যাথা লতার? কাল সকালেই যাবার আগে হয়তো বরাকর কলোনির প্রতিটি প্রাণীকে জানিয়ে দিয়ে যাবে নিজের পরিচয়, আর সেই সঙ্গে প্রসাদের এত যত্নে গড়া সুনামের সামাজিক স্বাক্ষরে কালি ঢেলে দিয়ে যাবে!
প্রসাদ বাইরে দাঁড়িয়ে মিনতি করে বলে—লতা, বল তুমি রাগ করনি, তবে আমি ঘুমোতে যাব। তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। বল, তা না হলে এখান থেকে নড়বো না।
প্রসাদ বারবার কড়া নাড়তে থাকে, ঘরের ভেতর থেকে লতার শান্ত কণ্ঠস্বরের জবাব আসে—না, আমি যাব না। তুমি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়।
চাচিজী!
বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে লতাকে ডাকছে বিক্রম, সুবেদারবাবুর ছোট ছেলেটা। মেজের ওপর বিক্রমের লাট্টু মাঝে মাঝে খর খর করে চক্কর দিচ্ছে শোনা যায়। ঘুম ভাঙতেই প্রসাদ বুঝলো ভোর হয়ে গেছে।
ক’দিন থেকে রোজ প্রত্যুষে ছেলেটা আসে। লতার সঙ্গে চা পাউরুটি খায়। তারপর কিছুক্ষণ পেঁপে গাছটার নীচে মাটি দিয়ে একটি কেল্লা তৈরী করে, পেঁপে ডাঁটার তোপ দিয়েই শেষে উড়িয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যায়।
ভাঙা স্বপ্নের মত গত রাত্রি’র ঘটনার ছবিগুলি যেন জাগ্রত চেতনায় আবার জোড়া লেগে সমস্ত ইতিহাসটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে প্রসাদের কাছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রসাদ বুঝতে পেরেছে—পাশের ঘরে, লতা জেগে উঠেছে, কাপড় চোপড় ছাড়ছে। এইবার বাইরের ঘরের খিল খুলছে লতা! বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শোনা যায়, লতা বলছে—এস বিক্রম।
বিক্রম যেন অনুযোগ করে বলে—কিতনা নিঁদ যাতি হো চাচিজী।
প্রসাদ শুয়ে শুয়ে সবই অনুমান করে নিতে পারছিল। মহাবীর চাকরটাও বোধ হয় এসে গেছে। ঝাড়ু দেবার শব্দ শোনা যায়। তার পর? তার পর মহাবীর চা নিয়ে আসবে। বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে। তার পর আরও দেখতে হবে—লতা সুগৃহিণীর মত সারা দুপুর মহাবীরের কাজ তদারক করছে। ভাঁড়ার খুলে হিসেব করে ঘি-ময়দা বের করছে। তার পর খাওয়া। লতা তখন স্নান সেরে মহাবীরের সঙ্গে ধর্মশালার মন্দিরে প্রসাদ আনতে যাবে। এক কৃত্রিম সংসারের শিবিরে সমস্ত দিন ধরে এই নিষ্ঠাশীল ও নিয়মিত কর্তব্যের সাধনা। প্রেরণা নেই, তবু যেন নিজের দমেই চলে। প্রসাদের মনও যেন ক্লিষ্ট যাত্রীর মত এই খাপছাড়া মুহূর্তগুলির চাকার ওপর দিয়ে ধৈর্য্য ধরে গড়িয়ে চলে যতক্ষণ না সন্ধ্যে হয়, গন্তব্যে এসে পৌঁছে। তখনি শুধু লতাকে কাছে পাওয়া যায় আর চিনতে পারা যায়। তার আগে, এতক্ষণ সে বাংলো বাড়ির হাওয়া থেকে যেন উবে যায়।
বিক্রম চলে যায়, এবং যেতে না যেতে হয়তো লালাবাবুর স্ত্রী এসে বিশ্বসংসারের কাহিনী নিয়ে বসেন। লালাবাবুর জামাইটির চাকরি নেই, মেয়েটা দুঃখে আছে। কাহিনী শুনে লতার মুখ ম্লান হয়ে যায়। দেখে মনে হয়, দুঃখটা যেন লতার মনে বড় বেশি বেজেছে।
সমস্ত ঘটনাগুলিই প্রসাদের কাছে আজ কেমন যেন গর্হিত মনে হয়। এত বড় একটা ফাঁকি সত্যের সাজ সেজে থাকবে, আলো-অন্ধকারের তফাতটুকুও যে মিথ্যে হয়ে যায়।
রাখালবাবুর বেয়ারা একটা চিঠি নিয়ে এল—প্রসাদবাবু, লতাকে আজ বিকেলে একবার পাঠিয়ে দিও। আজ রাত্রে এখানেই দুটো ডাল ভাত খেয়ে ফিরবে। ইতি—মেসোমশাই।
চিঠি পড়ে অগ্রসর হয় প্রসাদ। দুশ্চিন্তার জাল আরও জটিল হয়ে ওঠে। কেমন যেন ভয়ও করে। এবং কি করবে ভেবে পায় না। ঘরের পর্দা সরিয়ে দিয়ে দেখতে পায়, বারান্দায় বসে মশলা বাছছে লতা।
আজকের সকালে লতার মনটাও কেমন অস্বস্তিতে ভরে আছে। মাঝে মাঝে অকারণে ভয়ও করছে। কিসের জন্য এবং কেন, লতা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না! এ রকম কোন দিন হয়নি। নইলে তাকে গালাগালি দিয়ে সেরে যাবে এমন কোন জমিদারের বেটা আজও সে দেখেনি। কিন্তু নিজের মনের দিকেই চেয়ে লতা আশ্চর্য হয়, কালকের রাত্রির ঘটনা নিয়ে একটা ঝগড়া বিতণ্ডা করার মত উৎসাহও যেন সেখানে আর নেই।
লতার বুঝতে দেরী হয় না।—এটা ভয় নয়, দুর্বলতা। কিন্তু দুর্বলতাই বা কেন?
এই এলোমেলো ভাবনার মধ্যেই লতার মন ধীরে ধীরে আবার হিংস্র হয়ে ওঠে। তাড়িয়ে দেবে? দিক না, তাতে ক্ষতি কি? সেই মাড়োয়ারী বেনিয়াটা এখনও আছে, তু করে ডাকলেই চলে আসবে। কিন্তু যাবার আগে এই ভালোমানুষের ছেলেকে এমন শিক্ষা দিয়ে যেতে হবে, জীবনে যেন আর বেশ্যার সঙ্গে বেয়াদবি করার দুঃসাহস না হয়।
লতা…।
প্রসাদের ডাক শুনে লতার বুকটা তবু আশঙ্কায় ছমছম করে উঠলো। প্রসাদ এগিয়ে আসতেই লতা মাথা নীচু করে মশলা বেছে চললো কোন উত্তর দিল না!
—রাখালবাবুর বাড়িতে তোমার নেমন্তন্ন! যাবে?
চোখ তুলে তাকাল লতা। আশঙ্কার ঝাপসা পর্দটা সরে গেল। উত্তর দেয়—যাব।
যাও, কিন্তু কোন রকম বেয়াড়াপনা যেন টের না পায়।
নাটকের সীন পাল্টে গেছে। নতুন দৃশ্যের আরম্ভ। যেমন অদ্ভুত তেমনি জটিল। শুধু তাই নয়, প্রসাদও তার সংক্ষিপ্ত জীবনের পরিধি অতিক্রম করে বহু মানুষের মেলামেশার প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রসাদের সন্ধ্যেগুলি বেশির ভাগ আভাদের বাড়িতেই কেটে যায়। লতা যায় রাখালবাবু, তারকবাবু ও হরিশবাবুর বাড়ি। তাছাড়া সুবেদার ও লালাজীর বাড়িও আছে। শুধু আজ পর্যন্ত আভাদের বাড়ি লতার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বার বার দু’বার নেমন্তন্ন এসেছে। কিন্তু দুদিনেই হঠাৎ কেন জানি লতার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একদিন জ্বর আর একদিন মাথাধরা।
প্রসাদ খুশী হয়ে বলে—সত্যিই তোমার বাহাদূরি বলতে হবে। যেখানে যাই, সবারই মুখে তোমার প্রশংসা আর ধরে না। কি চালই চেলেছ লতা!
উত্তরে লতা চুপ করে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে।
প্রসাদ আবার বলে—দেখো, বেশি বাড়িয়ে তুলো না যেন।
লতা—বাড়িয়ে তুললে তোমারই মান বাড়বে।
প্রসাদ হেসে ফেলে—সত্যিই কি যে কাণ্ড হচ্ছে! এক এক সময় যা ভয় করে আমার! যদি একবার ধরা পড়ে যাও লতা, কি ব্যাপার হবে বল তো?
লতা—আমার আর কি ছাই হবে? বনের পাখি বনে ফিরে যাব।
প্রসাদ হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে পড়ে। কি যেন ভাবে, তারপর অন্যমনস্কের মতই বলতে বলতে চলে যায়—হাঁ, তোমার কোন ক্ষতি নেই, কিন্তু……..
আভা আরও দু’তিন দিন প্রসাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। আভা কথা বলেছে লতার সঙ্গে, কিন্তু প্রথম দিনের সেই সহজ হৃদ্যতা তার মধ্যে আর ছিল না। পরিচয় যত পুরনো হয়েছে, ব্যবধান বেড়ে গেছে তত। লতাও ঠিক সহজ ভাবে মিশতে পারেনি। কথা বলেছে লতাও, কিন্তু তাল কেটে গেছে বার বার। লতা চা এনে আভার সামনে ধরেছে, আভা আপত্তি করেছে, কিন্তু সাধাসাধি করতে পারেনি লতা। চা জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে।
প্রসাদ আর লতা। যখন এরা দুজন শুধু থাকে, তখনই এদের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। কথাবার্তা বিরল থেকে বিরলতর হয়ে এসেছে। লতা বেরিয়ে এসে দেখে প্রসাদ তখনও ফেরেনি। প্রসাদ বাইরে থেকে মাঝে মাঝে ফিরে এসে দেখে—লতা ঘুমিয়ে পড়েছে, তার ঘরের দরজা বন্ধ।
ভদ্রলোকদের বাড়িতে মেয়েদের গল্পের আসরে লতার প্রসঙ্গ এক-একবার ওঠে। মাসীমা বলেন—মেয়েটা বড় শান্ত।
তারকবাবুর মেয়েরা, নিভা প্রভা ও মমতা একসঙ্গে সায় দিয়ে বলে—লতাবৌদি বেচারা সত্যি ভালোমানুষ। আভা মিছিমিছি ওর নিন্দা করে।
মাসীমা গলার স্বর চড়িয়ে প্রশ্ন করেন—আভা কি বলেছে?
মমতা—লতাবৌদি নাকি লেখাপড়া জানে না। একেবারে গেঁয়ো, গায়ের মেয়ে।
মাসীমা চটে উঠলেন—আভা নিজেকে কি মনে করে? ভয়ঙ্কর বিদুষী? মর ছুঁড়ি, বিয়ের ছ’মাস না যেতে স্বামী হারিয়েছিস, বিদ্যে নিয়ে ধেই ধেই করছিস। লজ্জাও করে না!
নিভা প্রভা হেসে ওঠে। আভার ওপর মাসীমার আক্রমণের একটা অর্থ হতে পারে, মাসীমাও গাঁয়ের মেয়ে।
লালাজীর স্ত্রী এসেছেন। লতা তাঁর সঙ্গে বসে গল্প করছে! বাইরের ঘরে গল্প করে প্রসাদ, আভার সঙ্গে।
প্রসাদ বেশ জোরে জোরে যেসব কথা বলে, শুনে আভার মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়। ঘন ঘন দরজার দিকে তাকায়। ভুরু কুঁচকে ভর্ৎসনার সুরে বলে—আপনার কোন ভয়ডর নেই, প্রসাদবাবু!
একটু পরেই দেখা যায়, আভা ও প্রসাদ বেড়াতে বার হয়ে যাচ্ছে। লালাজীর স্ত্রী বোকার মত লতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন—ও ছোকরি কে লতা? ওর চালচলন ভালো মনে হচ্ছে না। তুমি একটু কড়া হও, লতা।
লতা বলে—আমি ঠিক থাকলে সব ঠিক থাকবে, আমার স্বামীও ঠিক থাকবে। কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
লালাজীর স্ত্রী যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলেন—তা বটে।
কিন্তু লতার নিজের কথার প্রতিধবনি তার অন্তরের ভেতরে প্রচণ্ড বিদ্রূপের মত বেজে ওঠে? হেসে ফেল লতা।
প্রভার স্বামী এসেছে প্রভাকে নিয়ে যেতে। তারকবাবুর বাড়ি তাই আজ লতা ও প্রসাদের নেমন্তন্ন ছিল। সব মেয়েদের মত লতাও জামাইদের সঙ্গে গান গল্প ও ঠাট্টা নিয়ে আড্ডা জমিয়ে বসলো। বিদায় নেবার সময় প্রসাদ দেখতে পায়, প্রভার স্বামী লতার পা ছুঁয়ে প্রণাম করছে। প্রসাদের সারা মনটা একটা অপঘাতে যেন ছিঁড়ে পড়লো।
পথে আসতে আসতে লতাকে গম্ভীরভাবে প্রসাদ বলে—সত্যি বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
লতা উত্তর দেয় না।
প্রসাদ বলে—এই পাপ আমার লাগছে। তোমার কিছু হবে না।
প্রসাদের কথায় বিশ্বাস করতে পারলে খুশী হতে পারতো লতা। সব পাপ প্রসাদের জীবনের অভিশাপ বড় করে তুলুক, লতা তা’হলে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। কিন্তু এতটা সৌভাগ্য বিশ্বাস হচ্ছিল না লতার। তাই লতার বুকের ভেতরটাও শিউরে উঠেছিল সংশয়ে।
প্রসাদের অনুমান সত্য হলে আশ্বস্ত হওয়া যেত। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নিরীহ নির্দোষ মানুষের হৃদয়ের প্রীতিকে এত বড় ফাঁকি দেওয়া পাপ বৈকি। সে পাপের ভাগী কি সে নিজেও নয়? কিন্তু কোন স্বার্থের খাতিরে? প্রসাদের মানের জন্য?
লতা মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিয়েও হেসে ওঠে। আরও বেশি করে হাসি পায়, প্রসাদের ভাগ্যবিপাক দেখে।
ঘরে ফিরে প্রসাদ আবার কথা পাড়লো। কথার খাপছাড়া ভঙ্গিতে বোঝা যায়, অনেক কিছু সে বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারছে না, সে সাহস তার নেই!
প্রসাদ বলে—আজকাল দেখছি ঘরের ভেতরেও তুমি বড় শুদ্ধাচার চালিয়েছ। এখানে তো তোমাকে কেউ দেখতে আসে না। তবে এখানেও ক’নে বউটি সেজে থাক কেন?
লতা—কই, তুমি তো আজকাল কাছে ডাক না।
প্রসাদ—আমি না ডাকলে তোমার তাতে কি আসে যায়? দরকার থাকলেই ডাকবো। কিন্তু তুমি সিগারেট ছেড়ে দিলে কেন? তুমি যেমন ছিলে তেমনি থাকবে। তোমার এত কষ্ট করার দরকার নেই।
লতা—তোমাকেও কোন উপদেশ দিতে হবে না। যেমন ইচ্ছে তেমনি থাকবে।
লতার এই উদ্ধত উক্তি প্রসাদকে অপমান করলো ঠিকই, কিন্তু তার বিভ্রান্ত ও অসহায় চিত্তের অলিগলি ঢুঁড়ে সে এমন কোন মুক্ত আশ্রয় পেল না, যেখানে এসে লতাকে উপেক্ষা করা যায়। তার সম্ভ্রমভীরু মনুষ্যত্বের চাবিকাঠিটা যেন লতা হাত করে ফেলেছে।
লতা সত্যিই বেপরোয়া হয়ে গেছে। আভার কথা মনে পড়লে হেসে ফেলে। তার একটা মেকী আধুলি চুরি করে আভার যদি কিছু লাভ হয়, হোক, তার কিছুই হারাচ্ছে না। কেউ তার কিছু কেড়ে নিতে পারবে না। এমন কি প্রসাদেরও সে ক্ষমতা নেই। লতার নামের দাবী সবাকার স্বীকৃতির জোরে সব বাধা ছাপিয়ে গেছে।
এমনি করেই যায় যদি দিন, যাক না। বাহির যার এত বিচিত্র, অন্তর শূন্য থাকলে ক্ষতি কি? লতার দিনগুলি এই আশ্বাসে ভরে উঠেছিল। চোরাবালির ওপর কত বড় দালান তোলা যায়, প্রসাদ ও লতার সংসার তার প্রমাণ।
আভার জ্বরের খবর শুনে প্রসাদ সেই যে সকালবেলা বের হয়েছিল, ফিরে এল এই সন্ধ্যায়। আভার জ্বরের সঙ্গে হিষ্টিরিয়ার মত আর একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে, শুধু অকারণ কান্না। রণজিৎ বলেছে, আভার জ্বর আগেও হয়েছে, কিন্তু এসব উপসর্গ কখনও ছিল না।
লতাও সবেমাত্র বেড়িয়ে ফিরেছে।
প্রসাদ ঘরের ভিতর চিন্তিভাবে পায়চারি করে ঘুরে বেড়াতে থাকে। একটা কৌতুক যেন বিভীষিকা হয়ে চারিদিক থেকে তাকে চেপে ধরেছে।
অনেকদিন পরে প্রসাদ আজ আবার কথা বললো—তুমি বড় বেশি বাড়াবাড়ি করছো, লতা। আভার নামে নিন্দে রটাবার সাহস পেলে কোথায়?
লতা—নিন্দে? আমি আভার নামে কোথাও তো কিছু বলিনি।
প্রসাদ—সেটাও একরকমের নিন্দে ও অপমান করাই হল।
প্রসাদের কথাগুলির মধ্যে উত্তেজনা ছিল না। মেজাজও আগের মত দপ করে জ্বলে ওঠে না। বিচারকের রায়ের মত অবিচল সিদ্ধান্তে তীক্ষ্ণ ও শান্ত।
লতা—বল, কি করবো?
প্রসাদ—না তোমাকে দিয়ে আর বেশি নাটুকে খেলা করতে চাই না। অনেক করেছ, বেশ ভালো ভাবেই করেছ। কিন্তু তোমার দিক থেকেই ভেবে দেখ, চিরকালই তো এমনি ভাবে চলতে পারে না, তাতে তোমারই বা লাভ কি?
চুপ করে শুনতে থাকে লতা।
প্রসাদ যেন আরও একটু শক্ত হয়ে উঠলো—তারপর, আজ যদি ঘূণাক্ষরেও কেউ টের পায় তুমি কি বস্তু? তাহলে আমি কোথায় থাকি? তুমি আমার মানমর্যাদার চাবিকাঠি আগলে বসে থাকবে, তা হয় না। তোমাকে ভয় করে চলতে হবে, তোমার মেজাজ মরজির জন্য সব সময় তটস্থ হয়ে থাকতে হবে, এ হয় না।
লতা টেবিল ল্যাম্পটার দিকে একাগ্র দৃষ্টি তুলে তাকিয়েছিল। কথা বলতে সেও জানে, কিন্তু এই অভিযোগ খণ্ডন করার মত যুক্তি তার নেই, তার সে শিক্ষা দীক্ষা নেই। সে প্রয়োজনও হয়নি।
প্রসাদ বলে—তোমার চলে যাওয়া উচিত।
লতার শরীর পাথরের মত তেমনি স্তব্ধ হয়ে রইল।
তোমার যা পাওনা হয়েছে, সব মিটিয়ে দিচ্ছি, আরও কিছু দেব।
লতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আস্তে আস্তে বলে—কিন্তু, তারপর আমার চলবে কি করে?
প্রসাদ এইবার মেজাজ হারালো—সেটা কি আমার ভাবনা? ভুলে গিয়েছ, এখানে এসে প্রথম দিন তোমায় রাঁধতে হয়েছিল বলে কি কাণ্ড করেছিলে? বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশন পর্যন্ত চলে গিয়েছিলে। কত সাধতে হয়েছিল মনে আছে? তোমার মত একটা…।
প্রসাদের কথার মধ্যে এক তিল মিথ্যা নেই। প্রতিবাদের কোন অবকাশ নেই। নিছক নিরেট সব সত্য কথা। কাহিনী নয়, ঘটনায় গড়া ইতিহাস।
প্রসাদ তখুনি আবার শান্ত হয়—তুমি যে জন্য এসেছিলে, সে প্রয়োজন আমার আর নেই। সে রুচিও আমার আর নাই। তুমি এখানে মিছামিছি পড়ে আছো।
প্রসাদের গলার স্বর আরও নরম হয়ে এল—সত্যিই, আমি এভাবে টিকতে পারছি না, লতা। তোমার বোঝা উচিত।
এক পীড়িত মানুষের কাতরোরিক্তর মত, নিঃসহায়ের আবেদনের মত শোনায় কথাগুলি।
লতা বলে—সত্যি বলছো, আমায় যেতে হবে?
প্রসাদ—হ্যাঁ। শুধু ভাবছি, কার সঙ্গে যাবে।
লতা উঠে দাঁড়ায়। চিৎকার করে বলে—তার জন্য ভাবতে হবে না। আমি একাই যাব। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে দিও কিছু, মামা-কাকা কেউ এসে নিয়ে গেছে। কাল ভোরেই যাচ্ছি।
প্রসাদের সম্মুখ থেকে লতা সবেগে ছুটে অন্য ঘরে যায়।
মাত্র আজ রাত্রিটা। জেগে থাকলেও কেটে যাবে, ঘুমিয়ে পড়লেও কাটবে। তবু খুব ভোরেই উঠতে হবে, বিক্রম আসবার আগেই। কিন্তু প্রতিশোধ নিয়ে যেতে হবে।
ভেতরের বারান্দার অন্ধকারে মেজের ওপর নিঝুম হয়ে বসেছিল লতা। উঠোনে তখনো থালায় সাজানো ডালের বড়িগুলি হিমে ভিজছে। আচারের বয়ম দুটো রয়েছে। এখনো উঠিয়ে রাখা হয়নি। আর প্রয়োজন নেই।
লতা একবার নিজের মনে হেসে ফেলে। ভদ্রলোক ভয় পেয়েছে। যদি কেউ টের পেয়ে যায়, এই ভয়। আজ যদি মাসীমা বুঝতে পারেন, তারকবাবু হরিশবাবু শুনতে পান যে, আমি লতা নই, আমি তারকেশ্বরের পঞ্চীবিবি? আমিই যদি ফাঁস করে দিই? তাহ’লে ভদ্রলোকের জমকালো সম্মান কোথায় থাকে?
কিন্তু সে যে অসম্ভব! ওভাবে প্রতিশোধ নেওয়া যায় না। বহুজনের স্মরণে ও সমাদরে লতার এই ছদ্মনামের শঙ্খ বাজাতে থাকুক চিরকাল।
আহা! বুড়ো মানুষ রাখালবাবু, মেসোমশাই। ঠাকুর দেবতার মত শুদ্ধ। মাথা ছুঁয়ে কতবার আশীর্বাদ করেছেন! সব পাপ আমার লাগুক। মেসোমশাই চিরদিন এমনি সুখী থাকুন, মাসীমার বেরিবেরি সেরে যাক।
বুঝতে পারে এবং স্পষ্টভাবে কল্পনা করে নিতে পারে লতা, ভদ্রলোকের ছেলে প্রসাদের ভদ্র প্রেমের আবেগ কোন পথে মুক্তি খুঁজছে। এক বছর দু’বছর পরে এ বাড়ির ভবিষ্যতে এই রকমই একটি রাত্রি লুকানো আছে। তখন লোকে শুধু জানবে, লতা মরে গেছে। বিধবা আভার মাথায় নূতন করে সিঁদুরের দাগ পড়বে, এই বাড়ির ঘরে ঘরে আভার সংসারপনার চুড়ি শাঁখা বাজবে ঠুং ঠুং মিষ্টি শব্দ করে।
উনি কি করছেন? ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। বোধ হয় বই পড়ছেন।
বোধ হয় মতিগতি ফিরে গেছে। কিন্তু একবার যাচিয়ে দেখলে হয়। রেশমী পায়জামাটা পরে বেণী দুলিয়ে, চোখে সুর্মা লেপে, এক পাত্র হুইস্কি নিয়ে যদি কোলের উপর চড়ে বসি, চরিত্তিওয়ালার মুরোদটা দেখি একবার। কিন্তু ছিঃ!
তা করতে পারলেও যে ভালো ছিল। কিন্তু এভাবে প্রতিশোধ নেওয়া যায় না, কারণ লোকটাকে কুষ্ঠরোগীর মত অস্পৃশ্য মনে হচ্ছে আজ! জীবনে কোন লুচ্ছাকে ছোঁবার আগে এত ঘৃণা হয়নি কখনো। তবে, কড়া এক পেয়ালা মদ গিলে নিলে বোধ হয় এ ঘেন্না ভেঙে যাবে। কিন্তু মদ? গেরস্তের বাড়িতে মদ? মনে হতেই লতার বুকটা দুরদুর করে ওঠে।
সব সামর্থ যেন খসে পড়ে গেছে, যেন সব দিক দিয়ে অসহায় হয়ে গেছে লতা, শুধু একটু ছদ্মনামের গৌরবের লোভে। ঘোমটা আর সিঁদুর, শাঁখা আর নোয়া দিয়ে সাজানো তার নিজের ছদ্ম মূর্তিটার ওপর বড় বেশি মায়া পড়ে গেছে। ভাঙতে পারে না এই মূর্তিকে, ভাঙাবার চেষ্টাও করতে পারে না, বোধ হয় চেষ্টা করতেই ইচ্ছা করে না! কোন উপায় নেই।
চোখ দুটো একবার আঁচল দিয়ে মুছে নিল লতা। যাত্রাগানের পালার রাণীগুলো বনবাসে যাবার আগে বোধহয় এই রকম কাঁদে।
হ্যাঁ, যেতেই হবে। কিন্তু ঐ লোকটার ওপর যে প্রতিশোধ না নিয়ে যাওয়া যায় না। নিস্তব্ধ রাত্রির শুন্যতার মধ্যে একটি প্রতিশোধের মুহূর্তকে শুধু মনে মনে জপতে থাকে লতা।
না উঁচুদরের প্রেমের ঐ অহংকারের ওপর পঞ্চীবিবির ঘৃণার থুতু ছিটিয়ে দিয়ে চলে যেতে হবে, চৌদ্দপুরুষ তুলে গালাগালি দিয়ে। ভদ্রয়ানার শিকলে বাঁধা জমিদার প্রসাদ রায় শুধু অপমানের যন্ত্রণায় ছটফট করবে, সহ্য করবে আর নীরবে তাকিয়ে থাকবে , লোকের কানের ভয়ে জোর গলা করে একটা কথাও বলতে পারবে না। বেশ হবে। এইটুকু প্রতিশোধের তৃপ্তি নিয়ে চলে যাবে লতা।
ঘরের ভেতর হঠাৎ পড়া বন্ধ করে প্রসাদ চিন্তিত হয়ে পড়লো।
আহত সাপ পালিয়ে গেলেও কোনা না কোনদিন ফিরে এসে কামড়ায়। প্রসাদের মন হঠাৎ এই ধরনের একটা শঙ্কায় ভরে উঠলো। রাগানো উচিত নয়, বেশ খুশী করে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিদায় দেওয়া উচিত।
একতাড়া নোট দেরাজ থেকে বের করে প্রসাদ লতার কাছে একটা আলো হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায়।
এই নাও। আমার ওপর মনে কোন রাগ পুষে রাখলে না তো লতা? আমি তো তোমাকে কখনো ঠকাইনি, ক্ষতি করিনি।
লতা হাত পেতে নোটগুলি নেয়। চুপ করে বসে থাকে।
প্রসাদ আবার বলে—কি চুপ করে রইলে যে?
মুখ তুলে তাকায় লতা। প্রসাদের হাতের লণ্ঠনের আলো লতার চোখের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। প্রখর হয়ে জ্বলছে তার চোখের তারা , যেন বিবরের অন্ধকার থেকে ফণা তুলে এক বিষধরী তার জীবনশত্রু একটা জীবের দিকে তাকিয়ে আছে।
ভয় পেয়ে কম্পিতস্বরে প্রসাদ ডাকে—লতা!
বোধ হয় আলোর ধাঁধানি থেকে দৃষ্টি আড়াল করার জন্যই হঠাৎ চোখ নামিয়ে নিয়ে মাথার ওপর কাপড়টা বড় করে টেনে নিল লতা। আর, কী আশ্চর্য, সত্যিই যেন এক লাঞ্ছিতা গৃহবধূ , ভীরু অভিমানের এক করুণ মূর্তি, আস্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিয়ে লতা বলে—না তুমি ক্ষতি করনি, আভা ঠাকুরঝি আমার এই সর্বনাশটা করে ছাড়লো।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন