ছদ্মবেশিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

খানিকটা আগে এক পশলা জোর বৃষ্টি এসে পথ-ঘাট খালি করে দিয়ে গেছে। রাত প্রায় সওয়া দশটা। রাস্তায় গাড়ি খুব কম। কাছাকাছি কোথাও ট্যাক্সি দেখা যাচ্ছে না। চেম্বার থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাক্তার দত্ত চলে এলেন চৌরঙ্গিতে।

দুটো একটা ট্যাক্সি আসছে, কিন্তু হাত তুললেও থামছে না। আবার বৃষ্টি আসতে পারে। ডাক্তার দত্ত ভুরু কুঁচকোলেন। তাঁর গাড়িটার এঞ্জিন বোর করার জন্য দেওয়া হয়েছে, এক মাসের আগে পাওয়া যাবে না। এই একটা মাস খুব দুর্ভোগ পোহাতে হবে। কলকাতা শহরে ট্যাক্সির ওপরে নির্ভর করা যায় না।

একটা বাসে উঠতে পারলেও হত। বাসেরও দেখা নেই। ট্যাক্সি না পেলে বাসেই উঠবেন ঠিক করে তিনি রাস্তাটা পেরিয়ে দাঁড়ালেন ময়দানের দিকে। তাঁকে যেতে হবে উত্তরে।

কাছেই ময়দানের অন্ধকারে একটা বড়ো গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি মেয়ে। তার পরনে একটা লাল শাড়ি তাই এই অন্ধকারের মধ্যেও দেখা যায় তাকে। কিন্তু ডাক্তার দত্ত তাকে দেখতে পেলেন না। যদিও তিনি অস্থির ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন।

মেয়েটি তখন এগিয়ে এসে তাঁর কাছে দাঁড়াল। ডাক্তার এবার লক্ষ করলেন তাকে। ভাবলেন, মেয়েটিও বোধহয় বাসে উঠবে।

কিন্তু বাস আসছে না। আবার বৃষ্টি নামল ঝিরঝির করে। মহা জ্বালাতন তো! ডাক্তারের সঙ্গে ছাতা নেই। তিনি দেখলেন, মেয়েটিও ভিজছে। মেয়েটির সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হল। সে সোজা তাকিয়ে আছে ডাক্তারের মুখের দিকে। সে মিটমিট হাসছে।

একটা ট্যাক্সি উলটো দিকে আসতে আসতে গতি মন্দ করল। ডাক্তার সাগ্রহে এগিয়ে যেতেই ড্রাইভার জানলা দিয়ে মুখ বার করে জিজ্ঞেস করল, কোনদিকে?

ডাক্তার বললেন, আমহার্স্ট স্ট্রিট।

ড্রাইভার আর উচ্চবাচ্য না করে হুস করে জোরে বেরিয়ে গেল। ডাক্তার এত রেগে গেলেন যে সম্ভব হলে তিনি ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজাটা খুলে ফেলতেন। কিন্তু সম্ভব হল না। তাকে পিছিয়ে এসে আবার বাস-স্টপেই দাঁড়াতে হল। সেই সময় মেয়েটি খুব আলতো গলায় জিজ্ঞেস করল, যাবেন?

তিনি বললেন, আমি যাব আমহার্স্ট স্ট্রিট আর বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে।

আপনি কোথায় যাবেন?

মেয়েটি মুচকি হেসে বলল, আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন।

ডাক্তার বিস্মিত হয়ে মেয়েটিকে দেখলেন ভালো করে। তার খোঁপায় ফুল গোঁজা। পায়ে সবুজ রঙের প্ল্যাস্টিকের চটি। এই চটিটাতেই মেয়েটির জাত চিনিয়ে দেয়। কিন্তু ডাক্তার সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, অনেকদিন তিনি এরকমভাবে একা বেশি রাত্রে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেননি। ঠিক ব্যাপারটা তিনি তখনো বুঝলেন না। তিনি ভাবলেন, ওর মাথায় কিছু গোলমাল আছে?

আপনি ছেড়ে তুমিতে নেমে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে একলা কী করছ?

মেয়েটি বলল, এমনিই দাঁড়িয়ে আছি।

এত রাত্রে? কেন?

মেয়েটি একবার ইচ্ছে করে বুকের আঁচলটা ফেলে দিয়ে আবার সেটা গায়ে জড়িয়ে নিল। তারপর বলল, রোজই তো দাঁড়িয়ে থাকি! যাবেন তো চলুন। ঘর না থাকে, আমার চেনা ঘর আছে।

এবার আর ডাক্তারের বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না। তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তাঁর মতন একজন ব্যস্ত সম্মানিত লোককেও রাস্তায় মেয়েরা এরকম কুপ্রস্তাব দিতে পারে? ডাক্তারের বয়েস পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্য তাঁকে যুবকের মতন দেখায়। যদিও সব সময় তিনি মুখে একটা গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে থাকেন। ব্যস্ত ডাক্তারদের যেমন থাকতে হয়।

তিনি কড়া গলায় বললেন, তোমাকে আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে!

মেয়েটি উত্তর না দিয়ে শব্দ করে হাসল। সে ডাক্তারের ব্যক্তিত্বকে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না।

তোমাকে আমি কোথাও দেখেছি আগে?

দেখতে পারেন! আমি তো রোজ এখানেই দাঁড়াই।

কিন্তু আমি তো এখানে আগে কোনোদিন দাঁড়াইনি।

তাহলে কে জানে।

ডাক্তার হঠাৎ একটু শিউরে উঠলেন। এবার মনে পড়েছে। মাস ছয়েক আগে তাঁর চেম্বারে এইরকম সময়ই একটা লোক ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল, ডাক্তারবাবু, শিগগির একবার চলুন।

সেটা ছিল গায়ে আগুন লাগাবার কেস। অফিস পাড়ার মধ্যেই একটা ফ্ল্যাটে রাত্তিরবেলা একটা মেয়ে নিজেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল নিজের শাড়িতে। চিকিৎসার বিশেষ কিছু ছিল না, পাঠাতে হয়েছিল হাসপাতালে। সে মেয়েটি বাঁচেনি। সেই মেয়েটির মুখাখানা ছিল যেন ঠিক এই মেয়েটির মতন।

ডাক্তারের পক্ষে মৃত রোগীদের মুখ মনে রাখালে চলে না। কিন্তু ডাক্তারের মনে আছে ওই মেয়েটির একটা কথা। মেয়েটি যন্ত্রণায় দারুণভাবে ছটফট করছিল। তাকে একটা সিডেটিভ দেবার আগে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি এরকম করলেন কেন? শাড়িতে আগুন লাগিয়ে…

মেয়েটি মুখ বিকৃত করে বলেছিল, ঘেন্না ধরে গেছে। পুরুষ জাতটার ওপর ঘেন্না ধরে গেছে।

মৃত্যুপথযাত্রিনী সেই মেয়েটির মুখে ফুটে উঠেছিল তীব্র ঘৃণা। সেই কথাটাই ভোলা যায়নি।

সেই মেয়েটিই যেন ফিরে এসে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিশোধ নিতে। ডাক্তারের মনে হল, স্বয়ং মৃত্যুই যেন লাল রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়েছে রাস্তার ওপরে।

মেয়েটি বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, যাবে কিনা বল।

ডাক্তার খপ করে মেয়েটির একটা হাত চেপে ধরে বললেন, চল!

মেয়েটি বলল, কতক্ষণ? একঘন্টা?

ডাক্তার বললেন, ওসব জানি না, চল আমার সঙ্গে!

অত জোরে হাত ধরেছেন কেন? যাচ্ছিই তো। কতদূরে যেতে হবে? সেই আমহার্স্ট স্ট্রিট পর্যন্ত যেতে পারব না!

ডাক্তার কোনো উত্তর দিলেন না, হাতও ছাড়লেন না মেয়েটির। আবার রাস্তা পেরিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন নিজের চেম্বারের দিকে।

যে দু-একটা লোক চলছিল পথ দিয়ে, তারা অবাক হয়ে তাকাল।

ডাক্তারের ভ্রূক্ষেপ নেই।

চেম্বারে তাঁর সহকারী এবং কম্পাউন্ডার আগেই বাড়ি চলে গেছে। রয়েছে শুধু দারোয়ান, সে রুটি পাকাতে বসেছিল।

হঠাৎ ডাক্তারকে একটি মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে ফিরে আসতে দেখে সে বিস্মিত এবং তটস্থ হয়ে উঠল।

ডাক্তার বললেন, দরজার তালা খুলে দে।

ভেতরে এসে সব ক-টা আলো জ্বেলে তিনি পেসেন্টের চেয়ারের দিকে আঙুল দেখিয়ে হুকুমের সুরে মেয়েটিকে বললেন, বসো।

মেয়েটি আলগাভাবে বসে কনুইতে থুতনি ভর দিল।

আলোতে তিনি মেয়েটিকে দেখতে লাগলেন ভালো করে। বছর তিরিশেক বয়েশ মেয়েটি, রোগা, মুখে সস্তা পাউডার। চোখের নীচে রাত্রি জাগরণের ক্লান্তির কালি।

তিনি আবার হুকুম করলেন, উঠে দাঁড়াও।

বিনা প্রতিবাদে সে উঠে দাঁড়াল। তিনি আঙুল দিয়ে তার থুতনি উঁচু করে দেখলেন গলা। দেখলেন হাত দুটো। তারপর মেয়েটিকে ঘুরিয়ে দিলেন। দেখতে লাগলেন পেছন দিকটা।

মেয়েটির পিঠে, কোমর আর ব্লাউজের মাঝখানটায় একটা ক্ষত। বেশ পুরোনো! তিনি আঙুল দিয়ে তার ব্লাউজটা একটু উঁচু করে তুলে দেখলেন, ও-রকমে ক্ষত আরেকটা রয়েছে!

কতদিন এ লাইনে এসেছ?

এই তো সেদিন। একমাসও হয়নি। আমি এ লাইনে নতুন।

মিথ্যে কথা বলো না।

মাইরি বলছি, রাস্তায় দাঁড়িয়েছি বলে খাস্তা মাল নই।

চুপ করো! পিঠের ওই ঘাগুলো কতদিনের?

ওগুলো ঘা নয়। দেয়ালে পিঠ ছড়ে গিয়েছিল। এক মুখপোড়া নিয়ে গিয়েছিল এক ভাঙা বাড়িতে।

কতদিন ধরে ওরকম হয়ে আছে?

কে জানে। না, না, এই দু-তিন দিন।

ফের বাজে কথা! কতজন পুরুষের সর্বনাশ করেছ এর মধ্যে?

আ মরণ! সব সর্বনাশ তো আমারই! যাক এত কথা দিয়ে কী হবে? শুধু শুধু রাত হয়ে যাচ্ছে।

রুগিদের পরীক্ষা করার জন্য যে উঁচু বেঞ্চের উপর বিছানা পাতা আছে, সেটা দেখিয়ে ডাক্তার বললেন, ওখানে শুয়ে পড়ো।

মেয়েটি ছোট্ট একটা হাই তুলল। তারপর হাসল চওড়াভাবে। বুকের আঁচল ফেলে দিয়ে সে ব্রাউজের বোতাম খুলতে লাগল।

ডাক্তার বললেন, জামা খুলতে হবে না। যেমন আছ, তেমনি শুয়ে পড়ো।

মেয়েটির আঙুল থেমে গেল ব্লাউজের বোতামে। তারপরই ঝট করে খুলে ফেলল শাড়িটা। তার শায়াটার রং ক্যাটকেটে সবুজ।

এ কী করলে?

বাঃ, শাড়ি খুলে রাখব না? ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে।

ডাক্তারও হেসে ফেললেন এবার। গলার আওয়াজ নরম করে বললেন, আমি তোমায় পরীক্ষা করে দেখব। তোমার শরীরে অসুখ আছে। চিকিৎসার দরকার।

তিনি শাড়িটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলেন মেয়েটির গায়ে। মেয়েটি উঠে বসে বলল, আমার চিকিৎসার দরকার নেই। এত রাতে উনি আমার চিকিৎসা করতে এলেন! ভারী আমার ইয়ে!

আমি ডাক্তার, রুগি দেখলে আমি চিকিৎসা না করে পারি না।

কে বলেছে আমি রুগি? বাজে কথা বলবে না। বেশি ডাক্তারি ফলাতে এসেছে! তোমার মতন কত রকম ডাক্তার আমি পার করে দিয়েছি। আর ফষ্টি করতে হবে না, এবার আলো নিভিয়ে দাও।

আমি সেজন্য তোমাকে এখানে ধরে আনিনি। তুমি রোজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকো…তুমি… মানে, তুমি রোজ ক-জন পুরুষ মানুষের সঙ্গে…

তা জেনে তোমার লাভ? ওসব কথা বলে কি রাত কাবার করবে নাকি?

জিজ্ঞেস করছি, কারণ আমার দরকার আছে।

দু-জন তিনজন… কোনোদিন একজনও যেমন জোটে না। আজ যেমন তুমিই প্রথম।

ডাক্তার মনে মনে আবার শিউরে উঠলেন। মেয়েটির খুব সম্ভব সিফিলিস আছে। প্রতিদিন দু-তিনজন পুরুষের মধ্যে সেই রোগের বীজাণু ছড়িয়ে চলেছে। এই কি প্রতিশোধ? সেই আগুনে পোড়া মেয়েটি যেমন তীব্র ঘৃণা দেখিয়েছিল পুরুষ জাতের ওপরে। যেন সেই মেয়েটির আত্মা এসে প্রতিশোধ নিয়ে যাচ্ছে।

তিনি আবার বললেন—শোনো, তুমি যে এই রোগ অন্যদের মধ্যে ছড়াচ্ছ তাই নয়, তোমার নিজেরও সাঙঘাতিক বিপদ হবে, শরীরটা পচে যাবে—

এই কথাটা শুনেও হাসতে লাগল মেয়েটি। যেন একটা চমৎকার ঠাট্টা। সে ফুলে ফুলে হাসতে লাগল। তারপর শাড়িটা সরিয়ে ফেলে নিজের বুকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল—আমায় দেখতে খারাপ? তোমার পছন্দ হচ্ছে না?

তারপর হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ডাক্তারের মুখটা ধরে ফেলে বলল—এসো না, বাবা! দেরি করছ কেন?

ডাক্তার চমকে পিছু হটে ছাড়িয়ে নিলেন নিজেকে। তাঁর মায়া হল। মেয়েটি বড়ো সরল। ও জানে না, মৃত্যু কত ভয়াবহ। ওকে অন্তত আর একবার বাঁচবার সুযোগ দিতে হবে।

তিনি বললেন—শুয়ে থাকো, আমি এক্ষুনি আসছি।

চেম্বারের পাশেই আর একটি ঘরে ডাক্তারের নিজস্ব প্যাথোলজিক্যাল ইউনিট। সেখান থেকে তিনি সিরিঞ্জ আর টেস্টটিউব নিয়ে এলেন।

মেয়েটি শুয়ে শুয়েই দেয়ালে ঝোলানো একটা ক্যালেন্ডারের ছবি দেখছিল পাতা উলটে উলটে। জার্মানির রাইন নদীর পাড়ের দৃশ্য। কালো অরণ্য। নীল রঙের তুষারের ওপর হলুদ স্কার্ট পরা এক দেবদূতীর মতন তরুণী।

ডাক্তার বললেন—দেখি, তোমার হাতটা।

মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিল।

তোমার রক্ত নেবো একটু। ভয় পেয়ো না!

মেয়েটি কোনো আপত্তি করল না এবার। চুপ করে রইল।

ডাক্তার স্পিরিট ভেজানো তুলো দিয়ে হাত ঘষলেন মেয়েটির। তুলোটা ময়লা হয়ে গেল। মেয়েটি নিয়মিত সাবান মাখে না। যেখানে সেখানে শোয়। তার হাতে তো ময়লা থাকবেই।

তারপর তিনি শিরাটা খুঁজে নিয়ে সিরিঞ্জের সুঁচটা ঢুকিয়ে দিলেন। মেয়েটি কোনো ব্যথার শব্দ উচ্চারণ করল না। বরং সে পাশ ফিরে ডাক্তারের চুলের মধ্যে অন্য হাতটা ডুবিয়ে দিয়ে বলল এত বড়ো চুল, তুমি অনেকদিন চুল কাটোনি বুঝি?

ডাক্তার একটু হকচকিয়ে গেলেন। এরকম কথা তাঁকে কেউ বলে না কক্ষনো। তাঁর স্ত্রীও ডাক্তার, দু-জনেই সর্বক্ষণ ব্যস্ত। পয়সা রোজগারের মহোৎসবে দু-জনে মেতে আছেন, কথা বলারও সময় নেই।

ডাক্তার বললেন—হাত সরাও।

মেয়েটি তবু হাত সরাল না। খুকখুক করে হাসতে লাগল।

সিরিঞ্জটায় রক্ত ভরে ডাক্তার সরে এলেন। চলে গেলেন পাশের ঘরে। একটা স্লাইডে কয়েক ফোঁটা রক্ত নিয়ে সলিউশান মিশিয়ে সেটা ধরলেন মাইক্রোসকোপের নীচে। তাঁর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

পরে ভালো করে ডব্লু আর দেখতে হবে। কিন্তু এখনই তিনি নিঃসন্দেহ হয়ে গেছেন যে মেয়েটির সিফিলিস আছে।

চেম্বারে ফিরে এসে তিনি বললেন দিনে দুবার পাঁচ লাখ করে অন্তত দশ দিন পেনিসিলিন ইঞ্জেকশান নিতে হবে তোমাকে। সকালে, বিকেলে। ইচ্ছে করলে আমার এখানে এসে ইঞ্জেকশান নিয়ে যেতে পারো। আমার কম্পাউন্ডারকে বলে দেব।

মেয়েটি চোখ বড়ো বড়ো করে শুনল। কোনো উত্তর দিল না।

এবারে উঠে পড়ো, আর শুয়ে থাকার দরকার নেই।

হয়ে গেল?

মেয়েটি উঠে পা ঝুলিয়ে বসল। খোলা শাড়িটা সরিয়ে রাখল পাশে। অকারণেই একবার শায়ার দড়িটা খুলে আবার বাঁধল। ব্লাউজের একটা বোতাম খোলা ছিল, টিপে দিল সেটা।

দু-হাত তুলে চুল ঠিক করল। তারপর মুচকি হেসে নেমে দাঁড়াল মাটিতে। শাড়িটা পরতে লাগল এবার।

ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন—কোথায় থাকো তুমি?

বেলেঘাটায়।

এত রাত্রে সেখানে ফিরতে পারবে?

কেন পারব না? রোজই তো ফিরি। আমার তো গাড়ি-ঘোড়া লাগে না, আমি হেঁটে যাই। দাও।

কী দেব?

বাঃ, আমার টাকা দেবে না?

ডাক্তার আপাদমস্তক চমকে উঠলেন। এ মেয়েটা টাকা চাইছে? তাঁর কাছে কেউ কখনো টাকা চায় না। সবাই দেয়। এ মেয়েটা অকৃতজ্ঞ এমন? তিনি বিনা পয়সায় পরীক্ষা করলেন। অন্য রুগি হলে, অন্তত পঞ্চাশ টাকা চার্জ করতেন।

তিনি বললেন—কীসের টাকা?

বাঃ, আমার টাকা দেবে না? আমার সময়ের দাম নেই?

ডাক্তার চটে গেলেন এবার। একটা সামান্য রাস্তার মেয়ে, সে বলে কিনা তার সময়ের দাম! সে জানে না, কত বড়ো ডাক্তারের সঙ্গে সে কথা বলছে। সন্ধ্যেবেলা লাইন দিয়ে রুগিরা বসে থাকে। এক একদিন রুগিরা ফিরেও যায়। তাঁকে এই মেয়েটা বলে কিনা সময়ের দাম!

যাও, বাইরে যাও। আমি দরজা বন্ধ করব।

আ-হা-হা, যাও মানে? আগে আমার টাকা দাও। এতক্ষণ ফূর্তি করলে!

ফূর্তি?

আলবাৎ! কেউ শুয়ে শুয়ে ফূর্তি করে, কারুর শুধু জড়াজড়ি আর চুমু খেয়েই ফূর্তি পুরো হয়ে যায়। তোমার ফূর্তি দেখাদেখিতে। তুমি ছুঁতো করে এতক্ষণ আমায় দেখলে। আরও কিছু দেখতে চাও তো বলো, দেখিয়ে দিচ্ছি।

চুপ! এসব কথা আমি একদম শুনতে চাই না।

চোখ রাঙিয়ো না। আমিও রোজগার করতে বেরিয়েছি। তুমি না ডাকলে আমি অন্য লোকের সঙ্গে যেতুম। দাও, আমার টাকা দাও।

বেরিয়ে যাও এখান থেকে।

মেয়েটি এবার অন্য মূর্তি ধরল। কোমরে হাত দিয়ে বেঁকে দাঁড়াল সাপের মতন। বিষাক্ত চোখে তাকিয়ে বলল—আমার টাকা দেবে না? আবার চোখ রাঙাচ্ছ? দেখবে আমি টাকা আদায় করতে পারি কিনা? আমার নায্য পাওনার টাকা। আমার একঘন্টার দাম! বাড়িতে কি আমি শুধু হাতে ফিরব? তোমার মতন লোক ঢের দেখেছি আমি। টাকা দেবে না, ফূর্তি করবে? এঃ! মামার বাড়ি!

চুপ, চুপ!

কেন চুপ করব! পকেটে নেই কানাকড়ি, দরজা খোল বিদ্যেধরী! কেন ডেকে এনেছিলে আমায়? আমার হক্কের টাকা না পেলে আমি পাড়া মাথায় করব।

মেয়েটি ক্রমশ গলা চড়াচ্ছে। ডাক্তার সন্ত্রস্ত হলেন। দারোয়ান আছে বাইরে। এ ছাড়া পাশের বাড়ির লোকজন শুনে ফেলতে পারে। রাত দশটার পর ডাক্তার কোনোদিন চেম্বারে থাকেন না। এখন যদি লোকজন টের পায় যে তিনি এত রাত্রে একটা খারাপ মেয়েছেলের সঙ্গে খালি চেম্বারে রয়েছেন—

পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে তিনি মাথা নীচু করে জিজ্ঞেস করলেন—কত?

আমার একঘন্টার রেট পনেরো টাকা!

থরে থরে সাজানো নোটগুলোর মধ্য থেকে দুখানা দশটাকার নোট আলগোছে তুলে নিয়ে তিনি মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলেন।

মেয়েটি বলল—আমার কাছে খুচরো নেই।

থাক!

মেয়েটি খপ করে দশ টাকার নোট দুটি নিয়ে আট ভাঁজ করে ব্লাউজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তারপর তার রাগ করা মুখেই ফিকে হাসি ফুটিয়ে বলল—চলি।

ডাক্তার তার দিকে ফিরেও তাকালেন না।

মেয়েটি বেরিয়ে যাবার পরও তিনি বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন চেম্বারের মধ্যে। তিনি আরও পরে বেরুবেন। যাতে মেয়েটির সঙ্গে তাঁর আর দেখা না হয়। রাগে তাঁর শরীর জ্বলছে। কুড়িটা টাকা এমন কিছু নয়। কিন্তু মেয়েটি বেইমানের মতন তাঁর কাছ থেকে টাকা আদায় করে নিল।

রক্ত নেবার সময় মেয়েটিকে স্পর্শ করতে হয়েছিল বলে তিনি ঘৃণা বোধ করলেন এখন। বেসিনে গিয়ে হাত ধুতে লাগলেন।

হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল, সেই মেয়েটির কথা, যে নিজের কাপড়ে আগুন লাগিয়েছিল। তার ঝলসানো মুখেও ফুটে উঠেছিল তীব্র ঘৃণা। পুরুষদের সম্পর্কে। হাসপাতালে গিয়েও মেয়েটি বাঁচেনি। মেয়েটির স্বামী সেদিন তাঁকে ফি দিয়েছিল বত্রিশ টাকা। তিনি একটু আপত্তি করেছিলেন, ঠিক নিতে চাননি। তবু ওরা জোর করে দিল। রোগের চিকিৎসা করাই ডাক্তারের পেশা, জীবন-মৃত্যুর ভার তার হাতে নয়। তিনি এরকম ভেবেছিলেন।

মৃত্যু আজ ছদ্মবেশে এসে তাঁকে একটু শিক্ষা দিয়ে গেল।

সকল অধ্যায়

১. বিচারক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. ডালিম – চিত্তরঞ্জন দাশ
৩. চন্দ্রমুখী – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪. ঠিকানায় ‘বুধবার’ – জগদীশ গুপ্ত
৫. কুসুম – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৬. আদরিণী – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
৭. সাকীর প্রথম রাত্রি – রমেশচন্দ্র সেন
৮. হিঙের কচুরি – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. মেলা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১০. মন্দ লোক – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. দন্ত কৌমুদী – বনফুল
১২. গোষ্পদ – যুবনাশ্ব
১৩. ইতি – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
১৪. খট্টাঙ্গ পুরাণ – শিবরাম চক্রবর্তী
১৫. দুকানকাটা – অন্নদাশংকর রায়
১৬. চাচা কাহিনি – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৭. বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৮. অঙ্গার – প্রবোধকুমার সান্যাল
১৯. নমুনা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২০. চোর! চোর! – বুদ্ধদেব বসু
২১. বারবধূ – সুবোধ ঘোষ
২২. ট্যাক্সিওয়ালা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
২৩. বাইজি – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৪. তিমিরাভিসার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. জামাই – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
২৬. তলানি – নবেন্দু ঘোষ
২৭. মাশুল – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
২৮. শনি – সন্তোষকুমার ঘোষ
২৯. আঙুরলতা – বিমল কর
৩০. সুর্মা – রমাপদ চৌধুরী
৩১. ঘরন্তী – বিমল মিত্র
৩২. প্রাণ-পিপাসা – সমরেশ বসু
৩৩. বাগাল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৪. ছদ্মবেশিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. নরক – প্রফুল্ল রায়
৩৬. পহেলি পেয়ার – বুদ্ধদেব গুহ
৩৭. নিরুদ্দেশ প্রাপ্তি হারানো – সমরেশ মজুমদার
৩৮. বেওয়ারিশ লাশ – জাহান আরা সিদ্দিকী
৩৯. ঝরা পাতা – তসলিমা নাসরিন
৪০. নিজের সঙ্গে দেখা – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন