শৈলেন্দ্র হালদার
প্রজাপতির পিছনে সারাদুপুর
রমনার ফুটপাতে যখন দাঁড়াই, আলোর নীচে মুখখানা পড়ে, ফর্সা ফর্সা লাগে। সোডিয়াম আলো একেবারেই রং পালটে দেয়। আমার গায়ের রং তামাটে, আর তামাটেকেই আলোর নীচে কাঁচা হলুদ মতো লাগে। রং দেখেই আমাকে অনেকে তুলে নিয়ে যায়, অবশ্য বাড়ি নিয়ে দেখে আমি কালো একটি মেয়ে, মুখে বসন্তর দাগ। দেখে কেউ মুখ ভরে-গাল বমি করে, কেউ মোটে পয়সা বের করতে চায় না। কেউ আবার যারা খুব মদে চুর থাকে, তারা ওই রংটঙের দিকে তেমন তাকায় না, কাজ হয়ে গেলেই টাকা, বরং দশ-বিশ টাকা বেশি দিয়ে বিদেয় করে। অবশ্য সব মদ্যপ এই কাজ করে না। অনেকের আবার পকেটে পাই পয়সাও নেই, দিব্যি দরদাম করে উঠিয়ে নিয়ে যায়, টাকা চেয়ে চিৎকার করলে চড় থাপ্পড় কষায়।
বিকেল হলেই রমনার ফুটপাতে চলে আসি। কেবল খদ্দের পাওয়ার জন্য আসি তা কিন্তু নয়। পুলিশ জ্বালায়, রিকশাওলারা হামলে পড়ে, তবু হাঁটতে ভালো লাগে আমার। যখন হাঁটি, আমার মাঝে মাঝে মনেই থাকে না আমি এখানে একটি কাজে এসেছি, আমার এদিক-ওদিক লক্ষ রাখতে হবে। রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে সবুজ পাতা ছাওয়া গাছগুলির দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকি। একটি ঝাউগাছে রঙিন একটি প্রজাপতিকে উড়তে দেখে সেদিন চোখ ফেরাতে পারিনি। দেওয়াল টপকে প্রজাপতির পিছনে ছুটেছি, ওটিকে ধরতে ইচ্ছে করছিল খুব। ছোটোবেলায় আমার ফড়িং ধরার শখ ছিল। ফড়িঙের পিছনে সুতো বেঁধে ঘুড়ির মতো ওড়াতাম। আবার মায়াও হত, ছেড়ে দিতাম। প্রজাপতি দেখলে সুতো বেঁধে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছা হয় না আর, কেবল অল্প একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। একটু ছোঁব বলে ঝাউ-এর গা গেঁষে দৌড়াই, পাতার ফাঁকে প্রজাপতির ল্যাজে পড়ে থাকে চোখ। এ দিকে আমাকে দেখে লোকের ভিড় জমে যায়, কী ব্যাপার এ মেয়ে দৌড়য় কেন?’ রসুলপুরের লোকেরাও এমন বলত, বলত ‘এই মেয়ে বনে বাদাড়ে এত দৌড়য় কেন?’ আমি জিভ ভেংচে দিতাম আরও দৌড়। অনেকদিন কাউকে ভেংচি কাটি না। খুব কাটতে ইচ্ছে করে। ওই যারা আমাকে নেওয়ার জন্য রিকশা থেকে নামে, তাদের ভেংচি কেটে দৌড় দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোথায় যাব দৌড়ে? কার কাছে? একবার অবশ্য দৌড়েছিলাম, দৌড়তে দৌড়তে একবারে সিতারা খালার কোলে, খালা বললেন, ‘কারে ভয় পাস। ওরা তো মানুষ। মানুষরে ভয় পাইতে নাই।’
মানুষকে ভয় পেতে নেই, সে আমিও বুঝি। কিন্তু ভয় কি আমি যেচে আনি? বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ শব্দ করে মানুষ দেখলে, সেটি কি চাইলেই থামানো যায়? আর আমিই বুঝি ভয় পাওয়ার মেয়ে ছিলাম—লোকে বলত, ‘এই মেয়ে ডাকাইত হইব। রাইতে রাইতে জঙ্গলে ঘোরে। ডর ভয় নাই।’ তেরো বছর বয়সেও সন্ধে মানিনি, শুকনো পাতা আর খড়ি টুকোতে চলে যেতাম বনে। ফিরে এলে মা উঠোনে খড়ি, পাতা পুড়িয়ে ভাত রাঁধত। চুলোর পাশে বসে আগুন তাপাতাম। আর ভাত ফুটলে দমদম করে যে ধোঁয়া বেরতো, তাতে আমার মুখ ডুবিয়ে রাখতে ইচ্ছে হত। মাও লোকের মতো সুর করে আমাকে বলত, ‘তর কি ভয়ডর নাই? সাঁঝ লাগার আগেই ফিইরে আসতে পারস না?’ কে মানে এসব? রাত হলে বনের মধ্যে এক সুগন্ধ ভাসে। কোন ফুল যে রাত করে ফোটে কে জানে। গজারি, শাল, সেগুন, সব তো চেনা! কবে কোন গাছে পাতা গজায়, কোন গাছে কবে মুকুল দেখা দেয়, সব। তবুও রাত হলে সুগন্ধ ভাসে কোত্থেকে, আজও আমি জানি না। মাঝে মধ্যে মনে হয় মাটি থেকে বুঝি। মাটি থেকেই গন্ধ উঠছে। আমার ইচ্ছে করে মাটিতে গা মেখে স্নান করি। জলে স্নান করার চেয়ে ধুলোয় স্নান করতেই আমার ভালো লাগে বেশি। পুরো বন সাদা পূর্ণিমায় ভেসে যাবে আর মা যদি বলেন ‘জঙ্গলে জ্বিন আছে, রাইতে রাইতে জ্বিনগুলান গাছের ডালে বইসা কথা কয়।’ তবে কি মন মানে? আমি এক বনজ্যোৎস্নার নীচে ধুলোয় গা গড়াতে দৌড়ে যেতাম বনের দিকে। ঝিঁঝি ডাকত, জোনাক জ্বলত, আমার পায়ের তলে পাতাগুলি মচমচ করে বাজত, পিছনে মা ‘আঙুরি আঙুরি’ বলে ডেকেই যেত।
আঙুরি বলে আমাকে আর কেউ ডাকে না। রিকশা থেকে যে পুরুষেরা আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এই ছেমরি তর নাম কীরে?’ আমি বলি, ‘আমার কোনও নাম নেই।’
‘নাম নাই? নাম ছাড়া মানুষ হয় নাকি?’
‘হয়। আমি যেমন নাম ধাম ছাড়া মানুষ।’
‘বাপের নাম কী?’
‘জানি না।’
‘বাপের নাম নাই। জাউরা নাকি?’
‘হ।’ আমি যখন ‘হ’ বলি, লক্ষ করেছি, আমার গলার স্বর এতটুকু কাঁপে না। কাঁপবে কেন? এ কথা তো ঠিকই, যে, জন্মে আমি কোনও বাবা নামক জিনিস দেখিনি। বাবা কেমন দেখতে, কোথায় থাকে, কী নাম তার—এসব জিজ্ঞেস করে মায়ের কাছ থেকে কোনও উত্তর পাইনি। তাই আমার কোনও দায় নেই বাবার পরিচয় দেওয়ার। মাঝে মধ্যে মা রাগ করে বলত, ‘গরিবের আবার বাপ কীরে? গরিব পয়দা হয় অভাবে। জন্মের এত ঠিকানা চাস ক্যান? ঠিকানা দিয়া কী হইব? গরিবি যাইব?’ মা যখন ফুঁকনি ফুঁকতেন, টগবগ করে ভাত ফুটত, আমি চুলোর কিনারে বসে মার লালা হয়ে ওঠা মুখখানা দেখে মুগ্ধ হতাম, মা বলত, ‘অত বাপ বাপ করস ক্যান, যে তর মুখে দুইটা ভাত দিব, সেই তর বাপ।’
‘ভাত তো আমারে তুমি দেও। তুমি কি আমার বাপ?’
মা মুখ ঝামটা দিয়ে বলত, ‘হ আমিই তর বাপ।’
আমি খিল খিল করে হেসে উঠতাম।
লোকে বলত, আমার বাবা নাকি সদরুদ্দিন। কেউ আবার বলত নছু পাগলা, আর দুটো নাম শুনেছিলাম, আম্মানুল্লাহ আর বারেক মিঞা। মাকে এই চারটি নাম শুনিয়েও অনেকদিন জিজ্ঞেস করেছি, ‘এগো মধ্যে কেডা, কও তো?’
মা হেসে বলেছে, ‘এগো মধ্যে কেউ না।’
‘তাইলে?’
‘তাইলে আর কী। তরা মর গিয়া বাপ লইয়া। ভাত পাইব কই, খাওন দিব কেডা, হেই চিন্তা করন লাগব না? এই যে বনে বনে ঘুরস, তার বাপ কেডা হেই নিয়া মাইনসের ঘুম নাই। হেরা তরে একবেলা খাওয়াইব? আমি যে না খাইয়া মরতে বইছিলাম, কোন ভালো মাইনসের পুত আইসা আমার মুখে এক মুঠা ভাত দিছে।’
আমি জন্ম থেকে মাকে ছাড়া কাউকে দেখিনি আপন। মা আমাকে বেড়ার ভাঙা ঘরটাতে বুকে জাপটে ধরে ঘুমোত। অনেক রাত অবধি মাথার কাছে কুপি জ্বালাত। মা কুপি নিবোত না। তেল খরচ জেনেও সে কেন কুপি নিবাতো না। পরে আমার মনে হয়েছে সে আমাকে আসলে আগলে রাখত। যে মানুষের স্বামী নেই সংসার নেই, লোকের বাড়িতে বাসন মাজে, বনের কাঠচোরাদের পিছনে পাতা কুড়োনি সেজে ঘুরঘুর করে দু-চার পয়সা পায়, দু-বেলা খেতে পায় না, সন্ধেয় একবার কেবল ভাত চড়ে বাড়িতে, তার বুকের ধন বলতে তো একটিই। এটি হারালে আর থাকে কী! শীতের রাতে ছেঁড়া কাঁথার তলায় দুটো শরীর গুটিসুটি হয়ে থাকে, সকালে আবার সেই রোজগারের ধান্দা। মা বলত, ‘কাছে কাছে থাকবি, দূরে যাবি না, মাইনসের মতলব ভালো না। বনে বনে ঘুরবি না।’
‘ঘুরুম না ক্যান? বন কী কার কেনা? বন গরমেন্টের? তুমি না এদিন কইলা বন গরমেন্টের?’
‘গরমেন্টের হইলে কী হইব? মাইনেসে গরমেন্ট মানে?’
‘তুমি গরমেন্ট মানো না?’
‘গরিবের কত কিছুই মানতে হয়। বড়ো হ। বুঝবি।’
বড়ো হয়েছি। দেখতে দেখতে মাকেও লম্বায় ছাড়িয়ে গিয়েছি, মা কিন্তু মোটেও মিথ্যা কথা বলেনি। গরিবকে অনেক কিছু মানতে হয়। যে জিনিস বড়োলোকের না-মানলেও চলে, গরিবের সেটা চলে না। আমি কি এখন চাইলে পারি ওই যে রিকশাওয়ালা আমাকে দেখে ফ্যাক ফ্যাক হাসছে আর বলছে ‘কী রে মাগী কতয় বেচবি?’ তার গালে দুটো চড় কষাতে পারি না। হাতে আমার সে জোর থাকতে পারে, মনে নেই। নেই, কারণ আমাকে এক চড়ের জন্য দশ চড় খেতে হবে। কে চায় আগ বাড়িয়ে মার খেতে?
মা আমাকে আগলে রাখত, রাতে দরজায় টুকুটুক—মা কুপি হাতে নিয়ে উঠত, চেঁচিয়ে বলত, ‘কুন হারামজাদার পুত আইছে ঘরের দুয়ারে। কুপাইয়া দু-খণ্ড কইরা দিব কলাম।’ আমার মাঝে মধ্যে মনে পড়ে মায়ের আগুনমূর্তি। দু-বেলা ভাত খেতে পারত না। অথচ কী ভীষণ জোর ছিল গায়ে। সারা দুপুর প্রজাপতির পিছনে ঘুরে বেড়িয়ে যে মেয়ে ঘরে ফেরে তাকে গায়ে শক্তি দিয়ে আগলে রাখে মা। জীর্ণ ঘরের দুঃখিনি মা, দুটো লাথি খেলে যে ঘর তার ছালবাকর ছাউনিসহ ধড়াস করে পড়বে, সেই ঘরেই একটি টিমটিমে কুপি আর একটি ভোঁতা দা সম্বল করে। সেই তেরো বছর থেকে আমি টের পেলাম এতদিনে। বনে বাদাড়ে ঘুরি ফিরি কেউ তেমন ফিরে দেখে না, রাতে আমার দাম চড়ে যায়, রাতে আমার দিকে সবাই আড়ে আড়ে চায়। পূর্ণিমা রাতে আমি মাকে কুপি জ্বেলে রাখতে দিই না। জানালা খুলে রাখি, জ্যোৎস্নায় ঘর ভরে যায়। মাকে বলি, ‘কুপি জ্বালাও ক্যান? গোটা আশমান জুইড়া কত বড়ো কুপি জ্বলতাছে দেখ না?’ এখনও পূর্ণিমার ঘোর আমার কাটে না। রমনার মাঠে সারা রাত শুয়ে থাকি। পূর্ণিমাগুলি একা আমার, আমি কারও সঙ্গে এই রাত ভাগ করি না। উপরে আকাশ, নীচে মাটি, মাঝখানে একটি ঘাস ফুলের মতো আমি আর কেউ নেই জগৎ জুড়ে মাঝে মাঝে নিজেকে আমার ঘাসফুলই মনে হয়। ছোট্ট ছোট্ট এতটুকু একটা ফুল। স্বজন নেই, পড়শি নেই, একা। আমার আছে কেবল আকাশ আর মাটি, আছে জল, বৃক্ষ, আছে অনন্ত নক্ষত্র বীথি।
মা তুই জোনাক পোকা?
‘মা তুই কার মেয়ে?’ এই প্রশ্নটি আমি মাকে করেছিলাম ছোটোবেলায়। মা বলেছিল, ‘জানি না।’
মায়ের, ‘জানি না’ উত্তর আমাকে অদ্ভুত এক মজা দিত। জোনানিক যেমন জানে না কোথায় তার জন্ম। মাকেও আমার জোনাকির মতো মনে হত। হাতের মুঠোয় জোনাকি ধরে এনে মায়ের মুখের কাছে ছেড়ে নেচে উঠতাম। ‘মা তুই জোনাক পোকা।’
মাও হাসত। মা বুঝত কেন আমি তাঁকে জোনাক পোকা বলতাম। আমার মনে হত জোনাকি জানে না অন্ধকার কোন জংলা থেকে জন্ম তার, সে কেবল আলো বয়ে বেড়ায়। মাও তেমন, জংলা থেকে বের হয়ে কুপি হাতে বসে থাকে।
মা অবশ্য ঘরের দাওয়ায় বসে খুব মন খারাপ করা সময়ে নিজের গল্প বলত। বলত, ‘বাড়ি ঘর তো ছিলই আমার, বাপ-মা ছিল। জমিও ছিল দুইকানি। অভাব কোনো দিন চক্ষে দেখি নাই। মুটকি ভইর্যা ধান রাইখা দিত মায়ের। তিনবেলা পেট ভইরা ভাত খাইতাম, পুস্কুনির মাছ দিয়া। দুইডা গাইও আছিল। বাজামন নিজে দুধ পানাইত। পাঁচ সের কইরা দুধ দিত গাই। আচমকা, কোন দিক দিয়া কী হইল কেডা জানে, শুনি দেবাকে কয় ‘খিদা লাগে। খিদা লাগে। তবে ক্যান লাগে? খিদা তো দেখি আমারও লাগে। মায়ের তিনবেলা জায়গায় এক বেলা রাঁধে। তাও মাইপা। বুঝদেয় বেশি রানলে খড়ি ফুরাইয়া যাইব। খড়ি বাঁচাইবার লাগি মা আমাগো ভাত দেয় না। এইডা যেন আমার বিশ্বাস হইবার চায় না। একসময় এমন হইল এক বেলা যে ভাত চড়ত তাও চড়ে না। খিদায় আমাগো পেট মোচড়ায়। আমরা কোথায় জুইর্যা খিদায় দাপাই। কোত্থেইকা কোন আকাল নাইমা আইল দেশে। বাজান দিল গাই বেইচা। দুইকানি জমিও বেচল। বেচার টাকা লইয়া হাটে বাজারে দৌড়ায় বাজান। নাই, চাইল নাই। এক মহাজন কিছু চাইল দিল। হেইডা শেষ হইল, আবার হাত-পাতা। খালি হাস পাতলে কেউ দেয় না কিছু হাতে। জমি গেল বাড়ি গেল। গোরু গেল কাঠের খাট সিন্দুক সবই গেল। শেষে বাজান কইল, ‘জরিনা হাঁটা দে।’ আমি জিগাই ‘বাজান আমি আবার কোন হাঁটা দিয়াম?’ বাজান কইল ‘আইজ বুইধবার হাটের দিন। চল তোরে ফরক কিন্যা দিই।’ পেটে ভাত নাই, আর ফরক কিনতে আমার বাড়ি ছাইড়া বাহির হওয়া জন্মের মতো বাহির হওয়া। বাজান আমারে বাজারে নিয়া এক বেডার কাছে তিনটেকা দিয়া বেইচা দিল। তিনডা টেকা হাতে লইয়া বাড়ির দিকে দৌড়াইয়া গেল বাজান। আমি ‘বাজান’, বইলা চিল্লাইয়া কাইন্দা তারে ফিরাইতে পারি না। গলা দিয়া তেমন স্বরও বাহির হয় না আমার। না-খাওয়া হইল্লে অত জোর কই?
মায়ের জন্য আমার মায়া হয় খুব। নিজের বাবা বিক্রি করে দিল মেয়েকে। আমারও যদি বাবা থাকত, সেও বোধহয় এরকম বিক্রি করে দিত আমাকে। মায়ের গল্প শুনে বাবা বিষয়ে আমার এক ভয় কাজ করত। যেন বাবা নেই এ আমার অনেক বড়ো ভাগ্য। মা কখনও কখনও তার বাবাকে মনে করে কাঁদে, ‘আহা বাজান খিদা সইতে পারে না। নিজের মাইয়া বেইচা খাইল।’
আবার হঠাৎ হঠাৎ রুখে ওঠে মা। বলে, ‘না না আমার কোনও বাপ ছিল না। আকাল আইলে বাপেরা বুঝি মাইয়া বেইচা দেয়? হেই বেডা আমার বাপ ছিল না। ছিল, আমার মায়ের সোয়ামি।’
‘মায়ের সোয়ামিরেই তো বাপ কয়।’ আমি তর্ক জুড়ে দিতাম।
মা বলত, ‘তরে কেডা কইল মায়ের সোয়ামিরেই বাপ কয়। বাপ হওয়া সহজ কথা না। বাপ হইতে গেলে পাতের ভাত তুইলা দিতে হয় সন্তানের পাতে। বাপ হইতে সবাই পারে না।
মাকে তাই জোনাক পোকা ডাকতে আমার ভালো লাগে। মিশমিশে কালো গায়ের রং। নাক ভোঁতা। কিন্তু চোখের ভিতর দেখে মনে হয়—আলো ঠিকরে বের হয়। আমারও এমন চোখ হয়েছে। আয়নায় তাকালে মায়ের চোখে আর আমার চোখকে তফাত করতে পারি না। রুখ্য চুল সে মায়েরও যেমন, আমারও তেমন। আমি মার মতো অত কালো না-হলেও কালো, সম্ভবত আমার জন্মের জন্য মার সে পুরুষ সঙ্গীটি দায়ী। সে খানিকটা কালোই ছিল। আচ্ছা, তারপর কী হল মার? সেই হাটে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে?
‘কী আর কমু। যেই বেডার কাচে বেচল, হে শক্ত কইরা আমার হাত ধইরা রাখল, বাজানের পিছন আর যাইতে দিল না। বেডা আমারে টানতে টানতে আমাগো বাড়ি ছিল উত্তরে, আমারে লইয়া গেল দক্ষিণে। পথ চিনি না, ঘাট চিনি না। খিদায় পা চলে না। বেডার আমার হুকনা দুইটার রুটি দিল খাইতে। আহা যে আমি মুনে লয় রুটি পাইয়া ভুইলা গেলাম আমার বাজান কেডা, মা কেডা, ভুইলা গেলাম সোহাগি গেরামের আমি মাইয়া। ওই বেডা আমারে লইয়া গেল শ্যামগঞ্জে। কতদূর শ্যামগঞ্জ! বীর পার হইলাম, হাওড় পার হইলাম, সাইঞ্ঝা লাইগা যায়, তবু গেরাম আসে না। লাইনের উপরে দিয়া মাইলের মাইল পার হই, কই হেগো গেরাম কই? নিশুত রাতে শ্যামগঞ্জ পৌঁছালাম। আহারে, আমার খুব পানি খাইতে ইচ্ছা করতাচ্ছিল, কেউ আমারে এক ঢোক পানি খাইতে দেয় নাই। ছাতি ফাইটা যায় এই অবস্থা। মুনে হইলা সেই তিয়াসটা আমার আইজও হয়।’
তিয়াস তিয়াস বলে মা আজও বুক চাপড়ায় আমি অবাক হই। সেই তার দশ বছর বয়সের তিয়াস কেন তাকে আজও তাড়িয়ে ফেরে বুঝি না। মা যখন বুকে চাপড় দিয়া বলে, ‘হায় রে তিয়াস। যেন পুরার কংস নদীর পানি এক ঢোকে খাইয়া ফেলতে পারুম।’ তখন আমারও জানি না কেন বড়ো তৃষ্ণা হয়। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়। আমার যখন ষোলো বছর বয়স, আমার তৃষ্ণা হয়েছিল। এক লোকে আমার গায়ের উপর চড়ে বসেছিল। সে কী ওজন লোকটির! আমি পানি পানি বলে চেঁচাই। লোকটি হা হা হাসে। কারও কষ্ট হলে কেউ যে হাসতে পারে সেই প্রথম দেখলাম। চড়ে বসা লোকটির চেয়ে আমাদের সুবলই ভালো। লক্ষ্মী ছেলে। যা বলতাম তাই শুনত। বনে পা ছড়িয়ে বসে বলতাম, ‘এই রে একটা কাঠবিড়ালি ধইরা নিয়ে আয় তো।’ অমনি সে দিত দৌড়। দৌড় দৌড়। ফিরে আসত ঠিকই একটি কাঠবিড়ালি নিয়ে। নামাতেই সুড়ুৎ করে পাতার ফাঁক দিয়ে দৌড়ে যেত। দৌড়ে যে গেল এটি নিয়ে আর কোনও দুঃখ থাকত না সুবলের। সে যে এনেছে, এনে দিতে পেরেছে আমার হাতে, এটি তার জন্য মহা শোকের বিষয়। ছেলেটির নাক বেয়ে সর্দি ঝরত। কোমরে ঘুনসি বাঁধা। হাড় গিলে। ছেলেটি ফাঁক পেলে আমার কাছে এসে বসত। যদি বলতাম, ‘সুবল, তর বাপ নাই, আমারও নাই। চল আমরা দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া এমন দূরে যাই, খুজইয়া পাইব না কেউ।’
‘কত দূর?’
‘ধর দিল্লি।’
‘দিল্লি?’ দিল্লি কুনু? নদীর এই পার হেই পার?’
‘হেই পার মনে হয়।’
‘তাইলে তো মাঝি লাগব।’
‘মাঝি বাদ দে, আমরা চল সাঁতরাইয়া পার হই।’
‘সাঁতরাইয়া?’
দুজনের স্বপ্নগুলি শুকনো পাতার মতো পড়ে থাকত নীচে-আমরা দুজনেই সেই স্বপ্ন মাড়িয়ে বাড়ি ফিরতাম। আমার তো তবু বাড়ি বলতে কিছু ছিল, সুবলের তাও ছিল না। ফরেস্ট অফিসারের বাড়ির বারান্দায় ঘুমোত। ও আমার অর্ধেক বয়সের এক ছেলে। বাপ-মা নেই। দয়া করে কারও বাড়ি থেকে কেউ যদি কিছু দিত তো খেত। মাকে যদি কখনও বলি, ‘সুবল্যারে আজ কিছু খাওন টাওন থাকলে দেওতো।’
মা প্রথম অবাক হয়ে বলত, ‘কেল্লিগা?’
‘দুই দিন খায় নাই।’
আহা ‘বেচারাকে ডাক, ডাক, জলদি কিছু মুখে দে।’
মায়ের ভিতরে আমি দেখেচি খুব নরম একটি মানুষ বাস করে। একবার দেখেছিলাম ফরেস্টের সেকেন্ড অফিসারের কাছে সুবল হাত পাতল। সুবলের গলা থেকে স্বর বেরোচ্ছিল না খিদেয়। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল ফরেস্টের লোকেরা। কিন্তু মা গরিব হয়েও ফেরায় না সুবলকে। মাঝে মধ্যে মাকেই মনে হয় ওদের চেয়ে বড়ো লোক। মায়ের এই আলো আমাকেও আলোকিত করে।
কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি
‘সুবল চোখের পলকে কাঠবিড়ালি ধরে এনে আমার পায়ের কাছে ফেলে দেবে। ঘুনসি বাঁধা সাত বছরের শরীরখানা শুকনো পাতার ওপরে রেখে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়বে। সুবলকে জিজ্ঞাস করি, ‘এই সুবলা বড়ো হইয়া কী হইবিরে?’
‘ডাকাইত।’
‘ডাকাইত হইবি? কেন রে? বড়োলোক হইতে চাস বুঝি?’
‘ডাকাত হইমু আর মানুষ খুন করুম।’
‘কারে খুন করবি রে?’
‘কমু না।’
‘হ্যাঁরে সুবল। আমারে কওয়া যাইবে না? ক না রে। আমি কি কাউরে কইয়া দিমু, ক? আমারে বিশ্বাস নাই তর? সুবল শুকনো পাতায় শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে নাচায়। ওর আধ আঙুলে নুনু ঝুলতে থাকে। পায়ের ফাঁকে। সারা গায়ে সুতো বলতে কোমরের কালো সুতোই। সুবল কিছুতেই বলে না কাকে খুন করবে। সেই রাতে আমি কেবলই ছটফট করেছি মা টের পেয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘কি রে ঘুম আহে না?’
‘না।’
‘স্বপন দেহস?’
‘হ।’
‘কী স্বপন?’
‘সুবল্যা ডাকাইত হইছে। মানুষ খুন করে।’
‘আলাইবালাই সুবল্যা ডাকাত হইব কেন? ভাত নাই আপদ নাই। নাক টিপলে দুধ বার হয়। হেয় কিনা ডাকাইত হইব।’
‘আমারে কইল তো? কইল কইল। তাতে হইল কী।’
‘আমিও ডাকাইত হইমু।’
মা খিল খিল করে হাসল। বললও ‘ডাকাইত হইয়া কী করবি?’
‘ডাকাইত মানুষ মারুক কারে মারতে ইচ্ছা করে?’
জমির মুনষিরে।
‘জমির মুনষির তরে কী করল?’
‘হেইদিন আমি কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালির পিছে দৌড়াতেছি।’
ওই ছেড়ি, ওই ছেড়ি। আমি কই কী কন?’
বেডায় কয় মায়েরে আমি…’
‘মায়ের আমি কী? ক।’
‘আমি কইতে পারুম না।’
‘বুঝেছি, আমি পাশ ফিরে শুই। কিন্তু মায়ের জন্য বড়ো মন খারাপ লাগে। মা দুঃখ পেলে আমার বুকের কোথায় যেন দুঃখ লাগে। চিন চিন করে ব্যথা হয় মা যখন আমাকে আদর করে মনে হয় আমি যেন মায়ের কাঠবিড়ালি। আমি কাঠবিড়ালি দু-হাতের তালুচেত বাদাম নিয়ে খাওয়াই। মাও আমাকে টিনের একটি থালে যখন ভাত বেড়ে দেয়, মনে হয় ছোট্ট একটি কাঠবিড়ালিকে মা আদর করছে। মা প্রায়ই নিজে না-খেয়ে আমাকে খাওয়ায়। একদিন হাপুস হুপুস করে খেয়ে দেখি মা ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে। জিজ্ঞেস করি, তুমি খাইয়াবা না?’
‘খামুনে পরে। তুই ঘুমা।’
‘আমি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মাও শুল। শুয়ে মা ঘুমিয়ে পড়ল। আমি পা টিপে টিপে পাতিলের ঢাকনা তুলে দেখি ভাত নেই। কিছু না-বলে আমিও শুয়ে পড়লাম। মা’র জন্য আমার বড়ো কান্না পেল। পরদিন মা পুকুর থেকে শাপলা তুলে সেদ্ধ করে খেল। আমি আড়ে আড়ে দেখলাম নিজেকে কাঠবিড়ালির মতো মনে হল। কাঠবিড়ালিকে যেমন নিজে না-খেয়ে পেয়ারা খাওয়াই, মাও ঠিক তেমন। আমি বোধহয় মার একটি পোষা কাঠবিড়ালিই।
বনফুলের লোভ
সুবল নয়, বনফুলই আমি আবিষ্কার করি। খড়ি টুকোতে গেছি, টুকোতে টুকোতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ ঘুম ভাঙে মিষ্টি এক গন্ধে। আমি উঠে চোখ কচলে গন্ধের পেছন ছুটেছি। ছুটতে ছুটতে গারোদের বাড়ি। সেই বাড়ি ডিঙিয়ে দিঘি পার হয়ে আবারও বন, সেই বনে ফুটে আছে ফুল। ছোটো, লাল ফুল। ফুলের এত গন্ধ থাকে। এত গন্ধও থাকে ফুলের!ইচ্ছে করে ফুলের উপর শুয়ে থাকি। জীবনভর শুয়ে থাকি। মা না-থাকলে জীবনভর শুয়ে থাকতাম। সুবলের সেই সুবিধেটা আছে। ইচ্ছে করলেই যেখানে খুশি রাত কাটাতে পারে। সারাদিন টই টই করে ঘুরলেও আমাকে ফিরতে হয় শনে ছাওয়া একটি ঘরে। ওখানে ধোঁয়া ওঠা ভাত রাঁধে মা। খেতেও মন চায়। মায়ের গায়ের ওম নিয়ে ঘুমোতেও মন চায়। হঠাৎ হঠাৎ আবার কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। ফুলের উপর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ফুলের গন্ধ নেব আর আকাশ দেখব এর চেয়ে সুখ আর কী আছে! আমার কোথাও বাধা নেই, আবার কোথায় যেন বাধা।
সুবলের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয় না। ও ছেলে আবার অনায়াসে বাজার চলে যায়। আনারস বিক্রি হয়, রাস্তার পাশে টুকরি ধরে বসে থাকে, বিক্রি শেষে দু-এক টাকা পায় হাতে। ওই নিয়ে নাচতে নাচতে ফিরে আসে। সে ক-দিন হয় একটি হাফপ্যান্ট পরে। অফিসারের বউ দিয়েছে। ও হাফপ্যান্ট পরল যেদিন, খুব হেসে তাকাচ্ছিল আমার দিকে, আমিও হাফপ্যান্ট পরি, সুবলও পরে, আর যেন পার্থক্য রইল না আমাদের মধ্যে। যেন সুবলও যা, আমিও তা। সে আর আমার ফুট ফরমাস খাটবে না। তাকে দিয়ে কাঠবিড়ালি আনানো যাবে না। বনে রাজত্ব আমার যেন আর হল না। আমি খুব মন খারাপ করে বসেছিলাম। সুবল আমার চুলে আমচকা টান দিয়ে বলল ‘কী বড়োলোক হইছি, দেখছিস?’
‘দেখছি।’
‘এইডা পাতা রঙের। আরেকটা পাইমু মাটি রঙের।’
‘ও।’
‘তোর ব্যবসা বুঝি খুব চলে?’
‘আমি আনারসের খেত দিমু। আনারস বেইচা বড়ো দালান তুলুম।’
‘কই ঢাহা শহরে?’
‘না দুবাই।’
‘দুবাই আমারে নিবি?’
‘দেহি।’
বলে চলে যায় সুবল। আমার খুব কষ্ট হতে থাকে। সুবল দুবাই চলে যাবে। আমি যাব কোথায়। আমি যাব কোথায়, এই রসুলপুর ছেড়ে আমি কি কোথায় যেতে পারব না? রসুলপুর আমার একবার ভালও লাগে, আবার লাগে না।
পরদিনই আবার সবুজ রঙের হাফপ্যান্ট পরা সুবলের সঙ্গে দেখা। বলে, ‘যাই বাজার যাই।’
‘আমারে নিবি?’
‘দুর, তরে নিব কী! তুই না ছেড়ি।’
‘তাতে কী হইছে? ছেড়িরা কি বাজারে যাইতে পারে না?’
‘ছেড়িরা তো যায় না।’
‘না যাক, আমি যামু।’
‘তাইলে নিজের ইচ্ছাসারে যা। আমারে কস ক্যা নিতে।’
‘গল্প কইরা কইরা গেলাম ধর।’
‘আমার টাইম নাই।’
‘ইহিরে টাইম কওয়া শিখছিস!’
সুবল হেসে ওঠে। তার সবুজ প্যান্টে ময়লা জমেছে। দিন দিন চাই এটি মলিন হয়ে যাক। ছিঁড়ে যাক। ছিঁড়ে যাক। ও আসলে যতদিন ন্যাংটা ছেলে ছিল ততদিন যেন আমার আপন ছিল বেশি। একটা প্যান্ট পরেই সে বাজারে যায়, ব্যবসা করে, দুবাই যাবে। আমার কেমন হিংসে হয়। রাগও হয়। সুবলকে বলি, ‘আমিও দুবাই যামু।’
সুবল খিল খিল করে হাসে। বলে, ‘ইহিরে।’
‘ইহিরে কস ক্যা। তুই যাইতে পারস। আমি পারি না?’
‘না তুই পারস না।’
‘পারি পারি পারি। কী করবি কর।’
সুবল হাসে। ঝকঝক করে ওর দু-পাটি দাঁত। ওর সামনে নিজেকে দীন হীন মনে হয়। বলি ‘আড়ি, তর সাথে আমার আড়ি।’
‘ইহিরে। আড়ি দেয় ছেমড়ি’
‘তুই আমারে দুবাই নিবি?’
‘না।’
‘বাজারেও না?’
‘না।’
সুবল বলে উঠে চলে যায়। আমি বসেই থাকি শুকনো পাতায়। কাঠবিড়ালি ডাকে। আমি ফিরে তাকাই না। একটি বাচ্চা ছেলের প্রতি আমার নির্ভরতা বাড়ছে টের পাই! সুবল চলে যাওয়ায় আমার কণ্ঠ ধরে যায়। টের পেয়ে আমি দৌড়ে বাড়ি চলে যাই। মা জিজ্ঞেস করে, ‘কীরে খড়ি কই?’
‘টুকাই নাই।’
‘হইল কী?’
‘ওই শালা সুবল্যা। হে নাকি দুবাই যাইব।’
‘সুবল্যা দুবাই যায় কী কইর্যা। ওর তো মুখ টিপলে এহনও…’
‘ও একল্যা যাইব।’
‘যাউক, গেলে ত ভালোই। মা-বাপ নাই বেচারা।’
‘আমার বাপ নাই, তাই বইল্যা কী আমি দুবাই গেছি?’
‘যাইতে পারলে যাইবি।’
‘ছেড়িরা নাকি যায় না।’
‘ছেড়ি আবার কি? ছেড়ি কী? ছেড়িগোর কি খিদা কম লাগে? ছোড়িগোর কি হাতা পাও নাই। ছেড়িরা কী পেডে পাথর বান্ধে? দুবাই যাইবি? যা, দুবাই আমি পাডামু।’
‘মিছা কথা কও জানি। আইচ্ছা মা, দুবাই কি গাঙের ওই পার?’
‘হ।’
‘দুবাই-এ কয়বেলা ভাত দেয়?’
‘মনে অয় চাইর বেলা।’
‘দুনিয়াতে কয়ডা দ্যাশ অছে কও তো দেখি?’
‘এই ধর কলিকাতা, ভারত, ইন্ডিয়া, আসাম আর দুবাই।’
‘সৌদি কইলা না? আসলাম ভাই না সৌদি গেল?’
‘সৌদি ত আল্লা রসুলের জাগা। সৌদি কী দ্যাশ নাহি।’
‘ও। তাও ত কহ।’
দিন দুই পর দুবাই ইচ্ছাও আমার আর হয় না। ভর দুপুরবেলায় কাঠবিড়ালিকে পেয়ারা খাওয়াচ্চি। সুবল এসে সামনে দাঁড়ায়। ওর হাতে একটি টুকরি। বলে, ‘আনারসের ব্যাবসায় নামলাম।’
‘নাকি খড়ি টুকাইবি?’
‘না।’
‘বনে আহস না ক্যা?’
‘শহরে চইল্যা যামু।’
‘দুবাই শহর?’
‘হ।’
‘যা। আমি যামু না।’
সুবল অবাক হয়ে বসে পড়ে। বলে, ‘যাইবি না?’
‘না। দুবাই আমার ভালো লাগে না। এই বন ভাল্লাগে। কাঠবিড়ালি ভাল্লাগে।’
‘ও।’
সুবল চলে যায়। আমি কাঠবিড়ালি ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকি। চোখ ধাঁধিয়ে নেয়। চোখ বুজে থাকি। দুপুরের কড়া রোদেও ঘুম চলে আসে। তখন আবার সেই গন্ধটা পাই। বনফুলের গন্ধ। আবার পিছু পিছু যাই। সুগন্ধের পিছু পিছু। আমি যে একা একটি মানুষ, বনে বনে ঘুরি, গাছ-পাতা পাখি-পশু আমার বন্ধু, মানুষ সুবলও বন্ধু, মাও। সেই আমি যেন কারও থাকি না। একা হয়ে যাই। একেবারে একা। আমি যখন একা হই, লক্ষ করি তখন ডাকাতে ইচ্ছে করে না, দুবাই যেতে না। ইচ্ছে করে শুয়ে শুয়ে কেবল বনফুলের গন্ধ নিই। প্রাণ ভরে ফুসফুস ভরে কেবল বনফুলের গন্ধ নিই।
বয়স নিয়ে কথা
অনেকদিন জিজ্ঞেস করেছি মাকে, মা আমার বয়স কত? মা বলে, ‘কত আর? দশ।’
‘দশ? দুই বছর আগেও আমি কইছ দশ।’
‘আমি কি জানি বয়সের হিসাব? গণ্ডগোলের বছর হাঁটা শিখছিস।’
‘ও বুঝেছি তাইলে এহেন চইদ্দ যোগ এ পনর বছর।’
‘পাঠশালায় যাস না, হিসাব শিখলি কই?’
‘তেঁতুলের বিচি গুনি ফতেমাগো লগে।’
‘ও।’
ফাতেমাদের বাড়িতে মাঝে সাঝে যাই। ওরা এটা-সেটা খেতে দেয়, খাই না। আসলে ও বাড়িতে আমি খেলতে যাই। তেঁতুলের বিচির খেলা, ষোলোগুটি খেলি। মা আমার বয়স জানে না, বয়স আমিই বার করেছি। বয়স যখন পনেরো, লক্ষ করি আমি খুব একা হয়ে যাচ্ছি, নতুন নতুন বন্ধু জুটছে আমার। নিজামুদ্দিন, রাইস আক্কাস, মনিরুদ্দি, আবদুল—এসব বন্ধু। এরা দিনে দু-বেলা বাড়ি এসে আমার খবর নেয়। কেমন আছি, শরীরটা ভালো কিনা, কোনও কিছু লাগবে টাগবে কিনা, চুড়ি ফিত্যা শাড়িকাপড়, যদি ইচ্ছা থাকে তবে তারা কোনওরকমে আপত্তি করবে না দিতে। একই গ্রামের মেয়ে আমি, তাই তারা নাকি এক রকম দায়িত্ব অনুভব করে খোঁজ খবর নেওয়ার। আমি হাসিমুখে সবাইকে না-বলে দিই যে লাগবে না, আমার তেল সাবান লাগবে না, ‘…পুস্কুনিতে দুইঘন্টা ডুব পাড়লে আপনাতেই শইলের ময়লা খইসা যায়, সাবান লাগে না। রিঠা দিয়া চুল ঘসলেই চলে, অত তেলের দরকার হয় না।’
ওরা আলাদা এসে এসে বলে
‘লাগবে না বুঝলুম। তবু যদি…’
‘নিমু না তো নিমু না।’
আমার রাগ দেখে ওরা খেপে যায়।
‘নিবি না, কোনও দেশে রাজরানিরে তুই? ফকিরের ঝি!’
‘ফকিরের ঝি হইলে বুঝি নেয়?’
‘তা তো নেয়ই। তর কীসের এত দেমাগ?’
‘জানি না।’
মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মা অরা তোমারে তেল সাবান দিতে চায় কেন?’
‘তুই যে ডাঙর হইছস। ডাঙর হইলে এরম দিতেই চায়।’
‘তুমারেও চাইছিল?’
‘ক-ত!’
‘নিচ্ছিলা তুমি?’
মা চুপ করে যায়। মা যদি বলতে পারত, ‘নিমু ক্যা? তেল সাবান ছাড়া মানুষের কি চলে না?’ আমি বোধহয় স্বস্তি পেতাম। মা নিশ্চয়ই নিত। মারও তেল সাবান চুড়ি ফিতের লোভ ছিল। টের পাই আমার গায়ের জামাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। বগলের দিকে ছিঁড়েছিল। মা সেলাই করেও দিয়েছিল। আবার ছিঁড়েছে। মাকে বললাম, ‘কী জামা যে ছিঁড়তাছে সেই খেয়াল আছে?’
মা আবারও চুপ করে গেল। বলল, ‘ফতেমার কাছে পুরান জামা টামা চাইয়া নে।’
‘তাইলে মর।’
মায়ের এমন রাগমূর্তি আগে কখনও দেখিনি। মন খারাপ হয়ে যায়। কোত্থেকে জামা কিনে দেবে? এক বাড়িতে ছুটা কাজ করে। মাসে কুড়ি টাকা করে দেয়। কুড়ি টাকায় কি মাস চলে? দিনে না-হয় একবেলা খাই, তবু একবেলার খাওয়ার খরচ কী কম?
রাতে রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয় কারা যেন আমাকে তেল সাবান দিচ্ছে, কারা যেন আমার হাত ধরে টান দিচ্ছে। টানতে টানতে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায় যেন। চিনি না এমন কোথাও। ভয়ে মায়ের শরীর আঁকড়ে রাখি। মা বলে, ‘কীরে ডর লাগে?’
আমি কথা বলি না। চুপ হয়ে থাকি। মা নিজেই বলে, ‘ডরাইস না। ডরাইলে গরিবের চলে না।’
‘তা হলে কী ডর সব বড়োলোকের লইগ্যা?’
‘হ!’
মা এমন কঠিন সুরে ‘হ’ বলে যে আমি আরও চুপ হয়ে যাই। গরিবের ডরভয় থাকতে নেই এ কথাটি আমার মনে কেমন গেঁথে যায়। নিঝুম রাতে মার এই রাগি উচ্চারণ আমারে সাহসী করে তোলে।
ফরেস্টে ইট ভাঙার কাজ চলছে। ফইজুদ্দিন চাচা, আমিরুল্লাহ আর নবী কাজ পেয়েছে। দাঁড়িয়ে ওদের ইট ভাঙা দেখি। একদিন ফইজুদ্দিন চাচার শরীর কেঁপে জ্বর নামল। চাচা একটি গাছের তলে শুয়ে শুয়ে থির থির করে কাঁপছেন আর সেই ফাঁকে আমি হাতুড়ি দিয়ে দিব্যি ইট ভাঙতে লেগে যাই। লোকে বলে, ‘আঁতুড় থ। আঁতুড় থ। আঙুল ছেঁইচা যাইব।
ছন্দে ছন্দে ভাঙতে থাকি ইট, কী যে খুশি লাগে। পুরুষেরা যা পারে তা যে আমি এত সহজে পারব আগে ভাবিনি। বিকেল পর্যন্ত ইট ভাঙি।’ আমিরুল্লাহ আর নবী হাসতে হাসতে বলল, ‘হইছে গারোগা মতো এহেন থেইক্যা মাইয়ারা বাইরের কাম লাইগা পারুক, আমার ঘরে গিয়ে আবুদুবাইন পালি। কী কস?’
‘হ। তাইত কথা।’
ফইজুদ্দিনের বয়স পঞ্চাশ, সে জানেও না কে তার হাতুড়ি নিয়েছে। কে তার ছাতার তলে বসে ইট ভাঙছে।
আমিরুল্লাহ আড়ে আড়ে লক্ষ করে আমি ভাঙছি ইট। ফুইজুদ্দিন চাচার কাছে ও খবর যায় যে তাঁর ইট ভেঙে দিচ্ছি আমি ফরেস্টের লোক একদিন ধরে ফেলে আমাকে। বলে, ‘তুই কে রে?’
‘আমি বলি, ‘ফইজুদ্দিন চাচা…’
‘তুই পারিস এই কাজ?’
ঘাড় নেড়ে বলি, ‘হ্যাঁ।’
ওরা হা হা করে হাসে। দিন শেষে আমার কাজের টাকা চলে যায় ফইজুদ্দিনের হাতে।
আমি খালি হাতে বাড়ি ফিরি।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই আবার দৌড়ে যাই কাজে। কাজের নেশা পেয়ে যায় আমার।
মা বলে, ‘ডাঙর হইছস, অহন ছাড় তো জঙ্গল ছাড়।’
‘আমি বলি ‘জঙ্গলে তো কাম পাইছি। কাইল থেইকা কুড়ি টাকা কইরা আমিও কামাইতাছি। বড়ো সাইবের পছন্দ হইছে আমার কাম।’
দিনে কুড়ি টাকার কাজ পেয়েছি, মার চোখ খুশিতে নাচে। কুড়ি টাকার কাজ পেয়েছি, মুখেই কেবল বলি, হাতে পাই না কিছু। পাই কেবল একটি হাতুড়ি। পনেরোদিন পর ফইজুদ্দিনের বাড়িতে টাকার জন্য যাই। আমার হাতে পাঁচ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘আরে মাইয়া হইয়া বেডাগোর কামে লাগছস, এইডাই তো বেশি। আবার টেহাপয়সা চাস কেন?
দিনে একটাকা দেড়টাকা হিসাবে ফইজুদ্দিনের কাজ করে যাই। এভাবে একমাস কাটে। একদিন কাজ শেষে অফিসারকে সাহস করে জিজ্ঞেস করি, ‘কামডা কী আমারে দেওয়া যায় না?’
অফিসার জুল জুল করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। তারপর হা হা হাসেন। আমি হাঁ করে ওঁর হাসির দিকে তাকিয়ে থাকি। পরদিন কাজে গিয়ে দেখি ফইজুদ্দিন হাজির। আমি দু-পা মেলে যেমন গাছতলায় বসি তেমন বসে রইলাম। ফইজুদ্দিন আমাকে একবারও বলল না, ‘কামে লাগ। পাঁচটা করে টেহা হইলেও তো পাইবি।’ যেন ঘটনাটি এরকম ছিল যে ধরিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু আমি কি বাতাসা খাবার জন্য এসেছি? আমি কাজ করতে চাই এ কথা কেউ বুঝল না, অথবা বুঝেও ভাবল যে মেয়েমানুষ আবার কাজ করবে কী। আমি পা ছড়িয়ে আগে বসে থাকতাম, তেমন বসে রইলাম। সুবলও নেই, কাঠবিড়ালিও নেই। আমার খুব একা লাগে।
বেকার বসে থাকি বাড়িতে। ইট ভেঙে আঙুল ইটের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে। শক্ত আঙুল দেখতে আনন্দ হয়। হাত-পাগুলো যদি এমন শক্ত হত, শক্ত শক্ত কাজ করতে পারতাম, আনারসের খেতে কাজ করা যেত। নিজের পলকা শরীরটির জন্য মায়া হয়, রাগও হয়। মন খারাপ করে বসে থাকি দাওয়ায়।
জমির মুনষি একদিন বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। মাকে দেখে থামে জিজ্ঞেস করে ‘ছেমরিডার বয়স কত?’
‘আমি মুখ্যু সুখ্যু মানুষ। বয়স কেমনে কই?’ মা কলপাড়ে দাঁড়িয়ে বলে।’
‘বিয়া শাদি দিবি না?’
‘বিয়া? কাইচলা আবুর বিয়া?’
‘কাইচলা আবু কী না একবার পাঁচজনে খুইলা দেখুক তাইলে।’
‘কী কন এইগুলান? খাওন পরন নাই। বিয়ার কতা ভাবে কেডা?’
‘বিয়া দিলেই ত খাওন পরন আইব।’
জমির মুনশি বাঁ-হাতে উরুসন্ধি চুলকোয়। উঠোনে লাউয়ের মাচার কাছে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখি আমি। মা খুব জবুথবু দাঁড়িয়েছিল। আমি বুঝে পাই না আমার বিয়ে দিচ্ছে না বলে মা এখন অপরাধীর মতো ভঙ্গি করছে কেন? আমাদের যখন ভাত থাকে না ঘরে, মা-মেয়ে মিলে দিনরাত আকাশ দেখি, আর আকাশে ভেড়ার লোমের মতো থাক। মেঘ ভাসে। আমার তখন খুব মেঘ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, ভাতের খিদেও লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে—তখন তো জমির মুনশি খবর নিতে আসে না আমরা কেন খাচ্ছি না। কেন আমরা চুলো ধরাচ্ছি না।
বিয়ের আমি বেশি কিছু তখন বুঝি না। মাকে জিজ্ঞেস করি, ‘মা মা মা, বিয়া কেন করে মানুষ?’
‘বাইচ্চা কাইচ্চা আইব। তাই।’
‘বাচ্চা যদি না অয়?’
‘জামাইয়ে খেদাইয়া দিয়া আবার বিয়া করব।’
‘আমারেও খেদাইয়া দিব?’
‘খেদাইত না তো কী! বংশ না-বাড়াইল বয়ইয়া বয়ইয়া খাওয়াইব নাকি?’
‘ও।’
আমি এসবের কতক বুঝি, কতক বুঝি না। আমার জানবার তৃষ্ণা দিন দিন বাড়ে। বিয়ে কী কেবলই এ কারণে করে? আমার মনে হয় আরও কোনও কারণ আছে। মা একদিন ঝিঁ ঝিঁ ডাকা রাতে আমাকে ঘুম থেকে তুলে বলল, ‘বিয়াডা হইছে খুব ভালো জিনিস। আবার খারাপও। ধর, তর বিয়া হইল, তুই যেন আর চিল্লাইয়া কথাকইতে না পারস, এই লিগাই বিয়া।’
চিৎকার করে কথা বললে কার অসুবিধে? পুরুষ লোকেরা কি চিৎকার করে না? তারা কি মিনমিন করে কথা বলে? আমি ঠোঁট উলটে বলি, ‘উঁহু আমি যেরম চিল্লাই, সেরমই চিল্লামু।’
‘তারপর ধর, সোয়ামির খেদমত। সওয়াব কামাইতে গেলে হের সেবাযত্ন তো করতে হইব।’
‘সেবাযত্ন কেন? সোয়ামির কী অসুখ্যা হয়?’
‘না, তা হইব কেন? বেডাইন তো জমিদারের জাত। জমিদারেরা কি নিজের কাম নিজে করে? কেউ কইর্যা দেয়। আসল কথা বান্দিগিরি করবার লাইগা মাইয়া মাইনেসে জন্মায়, বান্দিগিরি করতে করতেই হেরা মরে।’
আমার বিয়ে করতে কোনও ইচ্ছে হয় না। বরং আসমাদের মতো লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে। ওরা যেমন সুর পড়ে স্বর অ স্বরে আ। আমি যদি পড়তে পারতাম। মাকে একদিন বলি, ‘মা রে, লেখাপড়া কি খালি বড়োলোকেরই করে?’
‘হ।’
‘আমরা কেন বড়োলোকের হইলাম না?’
‘আল্লায় করল না।’
‘আল্লাডা খুব একচোখ্যাপনা করে। হেরা বড়োলোক, হেগোরে খাওয়ায়, হোগরে পড়ায়, হেগোরে জামাকাপড় দেয়।’
মার কপালে কুঁচকে ওঠে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ঈর্ষায় নাকি বেদনায় ঠিক বোঝা যায় না।
মানুষ হওয়া খুব দুঃখের
জমির মুনশি কাজটি করল প্রথম, মুখ বেঁধে নিয়ে। জ্বর ছিল, শুয়েছিলাম। মা গিয়েছিল ফিরোজাদের বাড়িতে চাল ধার চাইতে। এমন সময় মুনশি মাকে খুঁজতে এসে দেখে আমি শুয়ে আছি। কপাল ছোঁয়। আহা আহা করতে করতে হাতখানা বুকে নামায়। বুক থেকে পেটে। আমি তার হাত সরিয়ে দিতে চাই গায়ের সবটা শক্তি দিয়ে। পারি না। জমির মুনশি আমার গায়ের উপর চড়ে বসে। ভয়ে আমার মাথা ঘোরে। বমি আসে।
মা ফিরে এল যখন, জমির মুনশিকে দেখেনি। ততক্ষণে চলে গিয়েছে। মাকে সারারাত ধরে লোকটির ব্যবহারের কথা বললাম। ভোররাতের দিকে মা বলল ‘অঙ্গুরি। বুকটায় যেমন কেমন করেন।’
সুজি সাগু খেয়ে জ্বর সারল আমার। মা বলল, ‘আর বাইরে যাইস না। ঘরে বইসা থাক। দুনিয়াডের শেষ কী একদিন হইব না?’
দুনিয়াটার শেষ দেখব বলে আমি আর মা দাওয়ায় বসে থাকতাম। খিদে লাগত। মা রাঁধত না। হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, কখন আকাশ গড়িয়ে বৃষ্টির মতো চাল ডাল নামে। চাল ডাল নামত না। খিদেয় পেট জ্বলত। মা বলত, ‘জমির মুনশি তো তর বাপ লাগে আঙ্গুরি। ও বোধহয় আমরাও বাপ লাগত।’
আকাশে ভেড়ার গায়ের মতো থাক থাক লোম দেখি, আমার খুব ভেড়া হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ভেড়াদের মনে কি কোনও দুঃখ থাকে? কী জানি। আমার কেবলই মনে হয় মানুষ হওয়া খুব দুঃখের।
আমার এখনও মনে হয় মানুষ হওয়া খুব দুঃখের। রসুলপুর থেকে হঠাৎ এক রাতে একটি পেঁটালা বগলে নিয়ে সেই যে চুরি করে ঢাকা চলে এসেছি, আর রসুলপুর ফিরিনি। মায়ের কথা, সুবলের কথা মাঝে মধ্যে মনে পড়ে। সুবল ডাকাত হয়েছে কী পাঁড় ব্যবসায়ী হয়েছে জানি না। ছোটোবেলায় মানুষের দেখাদেখি কত কিছু হওয়ার কথা ভাবছি। ওসব খুব ভিতরের ইচ্ছে নয়। আমার আসলে ইচ্ছে করে ঘাসফুল হতে। এখনও রমনায় যখন হাঁটি, মনে হয় যদি ঘাসের সঙ্গে মিশে থাকতে পারতাম, পুরুষগুলো আমাকে এমন ছেঁকে ধরত না। আমার এখনও ঠিক মনে পড়ে না কেন কী করে কবে থেকে আমি রমনায় এলাম। কবে থেকে আমি সোডিয়াম আলোর তলে হাঁটছি। মাঝে মাঝে আমার দম বন্ধ লাগে। মনে হয় বেঁচে আছি কেন? দু-বেলা ভাত খাওয়ার জন্য বেঁচে আছি? খুব ইচ্ছে করে রসুলপুর চলে যাই। ওখানে গজারি গাছের তলায় উইয়ের একটা ঢিবি আছে, ওতে মাথা রেখে শুয়ে থাকি, কিন্তু দিনগুলো আমাকে কেবল সামনে ঠেলে দিচ্ছে। যত সামনে আসছি, পিছনে শক্ত দেওয়াল তৈরি হচ্ছে।
সিতারা খালা কাল বলছে, ‘আঙ্গুরি, গারমেন্টে কাম করবি?’
‘গারমেন্ট?’
‘হ। চাকরি। দশটা-পাঁচটা। বেতন দেয়।’
‘বেতন মানে কি ট্যাকা?’
‘হ। ট্যাকা।’
‘আমরা তা মাইয়া মানুষ। মাইয়া মানুষরা কী ওইতা কাম ছাড়া ট্যাকা পায়?’
সিতারা খালা দুলে দুলে হাসল। বলল, ‘চাকরি করলে কাইল আইস আমারে লগে।’
রমনায় হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ঠিক করে নিই কাল আমি সিতারা খালার সঙ্গে গারমেন্টে যাব কাজ করতে। কাল সকালে অনেকক্ষণ স্নান করে নেব। শরীরেধুলো ময়লা যা লেগেছে, তা ঝামা ঘষে সাফ করতে হবে।
ঝামা? হঠাৎ মাকে মনে পড়ে। মা গা মেজে স্নান করিয়ে দিত। ঝামা দিয়ে ময়লা তুলতে তুলতে বলত, ‘জঙ্গলের ভূতেরা তর শইল হাইগা যায় নাকি?”
মা কী জানে শহরের ‘বেডাইনেরা’ প্রতিরাতে আমার শরীরে ‘হাইগা’ যায়? মায়ের জন্য রমনার একটি একলা ঝাউগাছে উপুড় হয়ে আমার বড়ো কাঁদতে ইচ্ছে করে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন