নিজের সঙ্গে দেখা – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

শৈলেন্দ্র হালদার

কোনো একটা খারাপ কাজ করতে যাবার আগেই একজন ভালোলোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় নন্দিতার। ডালহাউসি স্কোয়ারের ফ্যাকাশে আকাশ থেকে নেমে আসা এপ্রিলের ঠাটাপোড়া রোদ সানগ্লাসকে মানছিল না। কোনো রকমে রোদের আঁচ এড়াতে টেলিফোন ভবনের টুকরো ছায়ায় মুখটা লুকিয়ে রেখেছিল। তবুও একটা অদ্ভুত হল্কা যেন কলকাতার বুক থেকে উঠে এসে ঝাপটা মারছিল নন্দিতার মুখে। এ-রকম গরমের মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাটা অসহ্য। নন্দিতার নরম কপাল পুতির মতো ঘামের বিন্দুতে সন্দীপদার প্রতি শুধু রাগ জমছিল। এতোই যখন তার প্রতি মোহ, অকারণে লজ্জা দেখানোর মানেটা কি! সে বেরিয়ে আসার পরে এক-অফিস লোকজনের সামনে দিয়ে নাকি সন্দীপদার বেরুতে খুব লজ্জা করে। এই ধরনের মানুষেরা চাকরির ক্ষেত্রে কী করে যে ওপরে ওঠে নন্দিতা বুঝতে পারে না। পাঁচ বছর ডালহাউসি পাড়ায় চাকরি করতে এসে বুঝে ফেলেছে চরিত্র নিয়ে মিনমিনে স্বভাব থাকলে আর যাই হোক ওপরে ওঠা কষ্টের। তার অফিস বে-সরকারি। এখানে উন্নতি-অবনতি কোনো সরলরেখা ধরে হয় না। তার এমন কোনও যোগ্যতাও নেই যে অফিস থেকে আলাদা গুরুত্ব দেবে, খাতির করবে। টাইপ আজকাল মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই ছেলেমেয়েরা শিখতে শুরু করে। সন্দীপদার ঘরে টাইপ মেসিনের সামনে তার চেয়ারটা ফাঁকা হলে কোম্পানি তার থেকে বেশি স্পিডের কোনো টাইপিস্টকে পাবে এটা নন্দিতা জানে। আর এর সঙ্গে এটাও সে জানে তাকে জুনিয়র টাইপিস্ট থেকে সিনিয়র টাইপিস্ট হয়ে হেড টাইপিস্ট হতে হবে। তখন সে প্রায় পিএ-র স্কেল ছুঁয়ে ফেলবে। এবং ওই জায়গায় পৌঁছনোর জন্যে তার যা যা দরকার সবকিছুই আছে। একত্রিশ বছর পার করেও ডালহাউসির ফুটপাত ধরে সে যখন হেঁটে যায় চারপাশের দ্রুত চলমান জীবনের ওপর থেকে ভেসে আসা গোপন দৃষ্টির দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে এই পৃথিবী থেকে এখনও অনেক কিছু তার অর্জন করা বাকি আছে, এবং সে অর্জন করে নিতে পারবে। তার কোমরের প্রান্তরেখার রহস্যপূর্ণ শাড়ির ভাঁজ দেখলে বোঝা যায় সে আত্মবিশ্বাসী।

সন্দীপদার অফিস থেকে পরে বেরনোর ব্যাপারটা তাই নন্দিতা মানতে পারে না। ডালহাউসি পাড়ায় অনেক লেডি অ্যাসিসটেন্টের প্রমোশন কী করে হয় তা তো এ-পাড়ায় চায়ের দোকান স্ন্যাকসবারের লোকেরাও জানে। বরঞ্চ এইভাবে বাসস্টপে একা একা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা খুব বাজে। অফিসপাড়ার লোকজনদের নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। আত্মীয়স্বজন বা পাড়া পরিচিত কিংবা পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের কেউ যদি দেখে ফেলে! অফিস সামলে একসময় বাড়িতেই তো ফেরা। পাড়া প্রতিবেশীরা তাকে খুব সম্মান করুক এ রকম কোনো আকাঙক্ষা তার নেই। তাদের অনেককেই চোখের গভীর দিয়ে সে চিনেছে। সুযোগ নেই বলেই সন্দীপদা হতে তাদের আপত্তি। কিন্তু তার অফিসের ব্যাপার ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকবে কেন! তাহলে কোথায় তার অফিসিয়ালিটি বুদ্ধির দৌড়।

সন্দীপ এতোসব সমস্যা বোঝে না। কারণ সমস্যাগুলো তার নেই। সে গাড়ি ব্যবহার করে ও চলাফেরা করে অত্যন্ত দ্রুত। মুখে কিছুটা রোদ এসে পড়লেও নন্দিতা একটু পিছনে সরে এল। যাতে বাসস্টপে সামনেই যারা দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ করে ঘাড় ঘোরালেই তাকে যেন দেখে না ফেলে। সামনে দু-তিনজনের ঘাড়ের ইউয়ের ভিতর দিয়ে দেখতে পেল গায়েত্রী এখনো দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে ওপরে চোখ তুলে বাসের নম্বর দেখছে। মেয়েটা এত ভালো যে চোখে চোখ পড়লেই কথা বলবে। লেখাপড়ায় রীতিমত ভালো ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে লেটার পেয়েছিল ফিলজফি আর ইতিহাসে। ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে মাস ছয়েক ক্লাস করে সেই যে কোথায় মিলিয়ে গেল কেউ কোনো খোঁজ পেল না। সময় একদিন মানুষকে গল্প করে দেয়। গায়েত্রীর গল্প একদিন অফিস ফেরতা মিনিবাসে মল্লিকা শোনাল। গায়েত্রীর বড়দি-র বিয়ের বছরখানেক বাদে ওর বাবার স্ট্রোক হয়েছিল। হাতপাতাল অবধি নিয়ে যাওয়া যায়নি। ছোটো যে ইলেকট্রিকের দোকানটা ছিল গায়েত্রীর কাকারা নিয়ে নিয়েছে। জামাইবাবুই এখন ওদের সংসার টানে।

জীবন আসলে ফুটপাতের ফাটলে সামান্য সবুজের মধ্যে ফেলে যাওয়া একটা বীজ। সবরকম অবহেলা সহ্য করেও একদিন শাখাপ্রশাখা ছড়ানো একটা গাছ হয়ে ওঠে। নন্দিতা ভেবেছিল গায়েত্রীর সঙ্গে বোধহয় আর কোনোদিনই দেখা হবে না। ঠিক সেদিনই শ্যামবাজার মোড়ে দেখা হয়ে গেল। ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছিল। চোখে চোখ পড়তেই একগাল হাসি। এগিয়ে এসে, কতদিন পর বলতো! কেমন আছিস…, কী করছিস এখন…

নন্দিতার পাল্টা প্রশ্ন—তুই—

পাড়ার নার্সারি স্কুলে।

নার্সারি, অত ভালো রেজাল্ট নিয়ে!

নন্দিতার বিস্মিত প্রশ্নে গায়েত্রী ঝরাপাতার মতো ঠোঁট দুটোতে প্রাণপণ একটা সবুজের ভাব এনে বলেছিল, এটা যে পাবো তাই-ই ভাবিনি—

নন্দিতা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। কারণ সেই মুহূর্তে এসপ্ল্যানেডের বাস তার কাছে জরুরি ছিল। সন্দীপদার চেয়ারে আগে যিনি বসতেন—রণিতদা, তার ছিল উলটো স্বভাব। অফিস থেকে তার আগেই বেরিয়ে পড়ত। ওয়াটারলু ম্যানসানে সেই অ্যাঙলো ইন্ডিয়ান বুড়োর ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রথমদিনেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে। সেই ঘরের খাট-বিছানা আলনা আয়না সিলিঙের দিকে তাকালে কেউ বুঝবে না এ-ঘর ভাড়ায় পাওয়া যায়। সেই ঘরে লেগেছিল ঘরের গন্ধ, গৃহস্থলীর ছবি। যেমন নন্দিতার কুঞ্চিত চুলের গভীরে বেড়ে ওঠা সিঁথি থেকে হেঁটে চলার ছন্দে মিশে আছে গার্হস্থ্য। কেউ কি তার অন্তঃপুরে প্রবেশ না করে বলতে পারবে তাকেও এই ঘরের মতো পাওয়া যায় সন্ধ্যের পরে কয়েক ঘন্টার জন্য! ঘর ও নন্দিতা, ইঁট-বালি আর রক্ত মাংস কি তাহলে এক হয়ে গেল! হয়। রক্তকণা কঠিন হয়ে বালুকণা হয় ডালহাউসিতে, কিন্তু তার জন্যে তোমাদের কোনো কষ্ট নেই! সহানুভূতি নেই। আছে শুধু উল্লাস, রসনার তৃপ্তি। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই ঘরের দরজা বন্ধ করায় রণিতদার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল নন্দিতা। মনে করে কি! বাজারের আলু-পেঁপে! প্রমোশনের রাস্তাটা মসৃণ রাখার জন্যে যেটুকু দেবার সেটুকু দেবেই। সে আপনার আগে যে এসেছেন তাকে দিয়েছি, আপনার পরে যিনি আসবেন তাকেও দেব। ভাঙার জন্যে যে তৈরি হয়ে এসেছে তাকে ভাঙার জন্যে তৎপর হতে হয় আপনাকে! আপনার নাম মানুষ!

কিন্তু শেষ পর্যন্ত রণিতদার ওপর থেকে রাগটা চলে গিয়েছিল নন্দিতার। কারণ মানুষটার হ্যাঁঙলাম লাভ ছাড়া আর ক্ষতি করেনি। খুব অল্পদিনের মধ্যে দুটো স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট পাইয়ে দিয়েছিলেন। হ্যাঙলামটা না থাকলে হয়ত ব্যাপারটা এত দ্রুত হয়ে উঠত না।

গায়েত্রীর বাস এখনও আসেনি। নন্দিতা দেখল দূরের দিকে চোখ তুলে বাসের নম্বর দেখার চেষ্টা করছে। সামনেটা এখন অনেক ফাঁকা। দু-চারজন করে বাসে উঠে পড়েছে। এই মুহূর্তে হঠাৎ করে ঘাড় ঘোরালে গায়েত্রী তাকে দেখে ফেলতে পারে। নন্দিতা আরেকটু পিছনে সরে এল। কিন্তু কতটা, আর কতটা সরবে। পিছনে টেলিফোন ভবনের দেয়াল। অরগ্যান্ডির আঁচল ঘামে সেপটে গেছে পিঠের সঙ্গে। গলার ভিতরটা শুকিয়ে কীরকম কাঠ। নন্দিতা বুঝতে পারছিল আর বেশিক্ষণ সে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। গায়েত্রী প্লিজ, প্লিজ তুই চলে যা, যে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে আছিস সেটা না এলে অন্য কোনো বাসে তুই উঠে পড়, অন্য কোনোদিকে চলে যা, আমি জানি তোর দিক ভুল হবে না, তুই ঠিক তোর জায়গায় পৌঁছে যাবি, না হলে এত ভালো রেজাল্ট করে সামান্য একটা নার্সারি স্কুলের চাকরি নিয়ে সুখে স্বস্তিতে আছিস কী করে! মনে পড়ে শ্যামবাজারে দেখা হওয়ার দিন কী স্বাভাবিক স্বরে তুই তোর চাকরির কথাটা জানিয়ে ছিলিস! আমি হলে পালিয়ে যেতাম, বিশ্বাস কর। চাকরি কেন? আমার থেকে মাত্র একটা গ্রেড ওপরে থাকা অফিসের কোনো লোকজনকে অফিসের বাইরে দেখতে পেলে চোখের দিকে তাকাতে পারি না জানিস! তুই চলে যা গায়েত্রী, দোহাই চলে যা…। বিশাল কোন গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ওপরে চোখ তুলে তাকালে দেখবি তখন আকাশ চোখে ধরা দেয় না, সবুজে হারিয়ে যায়, তখন পৃথিবীতে কোনো ফুলের গন্ধ নেই—শুধু মনে হয় একটা মাটির ঢিল হয়ে আছিস—খুব ছোটো, খুব ক্ষুদ্র…আমার এ-রকম কাজের মুহূর্তে তোদের এই চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়া আমাকে খুন করে ফেলে রে…

নন্দিতা যখন বুঝতে পারছিল দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব নয় তখনই ওল্ডকোর্ট হাউস স্ট্রিটের ওপর দিয়ে এপ্রিলের এই আগুন দুপুরেও এক চিলতে হাওয়া হারিয়ে যাওয়া বসন্তের মতো ছুঁয়ে গেল তার চিবুক। ফুটপাতের ধার ঘেসে গায়েত্রীর সামনে এসে থামল শ্যাওলা রঙের একটা এম এল ভেসপা স্কুটার। সামনে বসা হেলমেট পরা মানুষটিকে খুব চেনা মনে হল নন্দিতার। সন্দীপদার মুখের সঙ্গেই কি মিল আছে। হবে হয়ত। হেলমেট পরা অবস্থায় সমস্ত মানুষকে কেন জানেনা এরকম লাগে। স্কুটারে উঠে বসে গায়েত্রী ভদ্রলোকের কাঁধের ওপর দিয়ে ধরে বসল। মেয়েদের এই আচরণ নন্দিতা জানে, এর নাম নিরাপত্তা, এই জড়িয়ে ধরার নাম অবলম্বন। গায়েত্রী তাহলে এতোদিনে জায়গা খুঁজে পেল। সন্দীপদার গাড়ির হর্নে নন্দিতার খেয়াল ফিরে এল দ্রুতগতির জীবনের মাঝখানে। স্ট্র্যান্ড রোডের মুখে টার্ন নেবার সময় ট্রামলাইনের ওপরে উঠে থাকা একটা পাথরে চাকাটা ঠোক্কর খেয়ে গাড়িটা সামান্য দুলে উঠল। অন্যদিন এ মুহূর্তে নন্দিতার নাকের পাশে একটা বিরক্তির ভাঁজ উঠত, গাড়িতে বসে বসে কলকাতার রাস্তাঘাট নাড়ি নক্ষত্রের মতো সে জেনে ফেলেছে। রাস্তাগুলোর চামরা ফুঁড়ে শুধু পাথর বেরিয়ে আছে সারা শহরে। অথচ রেড রোডে উঠে আসতে জীবন মসৃণ। গঙ্গার ওপর থেকে একটা মৃদু হাওয়া ভেসে আসছিল। আজ অনেকদিন পরে ক্লান্তি আর ঘামে ভিজে যাওয়া গ্লানিময় বুকের নীচে সরু সুতোর মতো একটা সুখ যেন খেলছিল। পরিচিত ভালোলোকেরা যদি জীবনে একটা স্থায়ী সুন্দর জায়গা পেয়ে যায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। কলকাতার সব রাস্তাতেই ট্রামলাইনের বুক ফুঁড়ে পাথর উঁচু হয়ে আছে, তখন জীবনের একমাত্র সত্য রেড রোড। নন্দিতা উইন্ড স্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে অন্যমনস্ক চোখে শ্যাওলা রঙের স্কুটারটাকে খোঁজার চেষ্টা করছিল।

সন্দীপদা মানুষটা সম্পর্ক নিয়ে খেলতে জানে। অহেতুক আবেগ দেখায় না, নিজেকে সৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে না। যেটা চাওয়ার সেটা সরাসরিই চায়, কিন্তু সেই চাওয়ার মধ্যে কোথাও হামলে পড়া ভাব থাকে না, থাকে একটা সুরবোধ। তাই যেদিন আসতে দেরি হয়, নন্দিতা বাসস্টপে অপেক্ষা করতে করতে আগুন হয়, সেদিন দেরি করার কারণ নিয়ে হাজার গল্প বলার চেষ্টা করে না, একটি বারের জন্যেও প্রমাণ করার চেষ্টা করে না যে সে সত্যি চেষ্টা করেছিল অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরনোর। সেদিন খুব সঙ্গোপনে নন্দিতা অনুভব করে মানুষটার সম্পর্কের খেলা। সেদিন নন্দিতার তৃষ্ণা পেলে কোল্ডড্রিঙ্কস আসে না। সরভাসা গোলাপজলের গন্ধে ভেজা লস্যির গ্লাস এগিয়ে আসে, কোনো পানের দোকানের সামনে সন্দীপদার গাড়িটা না থেমে ঠিক র্যালিসের সামনে এসে থামে। ক্ষিদে পেলে সেদিন বাবুঘাটের গ্যে-তে মুখোমুখি চেয়ারে বসে না তারা। সেদিন ঝাউতলার এই চাইনিজ রেঁস্তোরায় সন্দীপদা তার হাত দুটো আপনমানুষের মতো তুলে আনে নিজের হাতের গভীরে। এ-রেঁস্তোরায় খাবারের দাম বেশি, সময়ের দাম অনেক। বিল দিয়ে যাওয়ার পরে আধঘন্টা বসে থাকলেও বেয়ারা চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে না। ভিড়-ভাট্টার রেঁস্তোরায় কাজের কথাগুলো খুব দ্রুত ও সরাসরি বাক্যে সারতে হয়। নন্দিতা সেই মুহূর্তগুলোতে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। সে দেখে আশেপাশের লোকজন দু-চোখ দিয়ে তাকে দেখে। চোখ দিয়ে তারা নন্দিতার চোখ দেখে না, চোখের থেকে তাদের চোখ আরও নীচে নামতে থাকে।

ঠান্ডা রেঁস্তোরার ভিতর বসেও একসময় উত্তেজনায় টানটান হয়ে গেল নন্দিতা। এখানেও গায়েত্রী। তার বিরুদ্ধে কি কোনো চক্রান্ত শুরু হয়েছে পৃথিবীতে। শ্যাওলা রঙের সবুজ স্কুটারটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। গায়েত্রী আর ওর সঙ্গের মানুষটি এগিয়ে আসছে। হেলমেট নামিয়ে ফেলেছেন ভদ্রলোক। নন্দিতার যেন দুপুরের থেকেও আরও চেনাচেনা মনে হল মানুষটিকে। গায়েত্রীর দুহাতে দুলছে দুটো দুটো ঢাউস পলিপ্যাক। সপিং করেছে খুব। সন্দীপদা গোয়ায় বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে কি যেন বলছিল। কোন হোটেলে থাকতে চাও? নন্দিতা যেন কিছু শুনতে পাচ্ছিল না। সন্দীপদার কথাগুলো যেন কোনো দূরলোক থেকে ভেসে আসছে। বলতে পারছিল না কোথাও নয়, কোথাও যেতে চাই না, শুধু পালাতে চাই…ভালোমেয়েটা এখানেও ঢুকে পড়েছে…। বাঁচতে চাইলেই বাঁচা যায় না কলকাতায়। ভিড়ভাট্টাহীন কোনো রাস্তায় একজন খুনিমানুষ যদি হেঁটে যায় এই শহরে তবে হয়ত অনেকেরই চোখে পড়বে না। কিন্তু অন্ধকার রেঁস্তোরার এককোণে সঙ্গোপনে বসে থাকা নন্দিতার চোখের ওপরে গায়েত্রীর চোখ গিয়ে পড়ল সঠিক। সঙ্গের ভদ্রলোককে পিছনে রেখে টেবিলের সামনে এসে বলল, তুই!

নন্দিতা বলল, বোস…

সঙ্গের ভদ্রলোক পিছনের টেবিলে বসে পড়েছেন। গায়েত্রী হাতের প্যাকেট দুটো ওই টেবিলে নামিয়ে রেখে মানুষটির কানে কানে কী যেন বলে নিল। হাসিটা কিন্তু ঠোঁট থেকে মুছল না।

নন্দিতার টেবিলে ফিরে এসে বলল, এদিকে? কোথায়?

একটু অফিসের কাজে এসেছিলাম রে—

অফিস…! তোদের ইনডাসট্রিয়াল হেভি অ্যাসিড না কিসের যেন কনসার্ন…

এখন বাড়িতে ব্যবহার করারও তৈরি হচ্ছে, তারই মার্কেট সার্ভে—

তুই তো অফিস অ্যাসিসটেন্টের কাজ করিস, বাইরের কাজ পারবি…

কোম্পানি বলছে এ-ব্যাপারেও নাকি আমি এফিসিয়েন্ট, এখন কর্তাদের মর্জি হলে কী করার আছে বল…। নন্দিতা দু-চোখে হাসি রেখে সন্দীপদার দিকে তাকায়।

গায়েত্রী আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নেয়, আপনারা মেয়েদের কি মনে করেন বলুন তো, ছাদের নীচে খাটাবেন ছাদের বাইরেও বের করে আনবেন, ঘরে-বাইরে সব এক করে দিলেন…

নন্দিতা লক্ষ করছিল গায়েত্রীর কথায় সন্দীপদার মুখের স্মার্টনেস হারিয়ে যাচ্ছে। আপ্রাণ সামলে নেবার জন্য বলল, তো তোর কাজের জায়গা তো পাড়ার স্কুল, তুই ঠাটা রোদে টোটো করতে বেরিয়েছিস কী জন্যে!

আমি বাবা কোনো কাজে নই, একদম বেড়াতে বেরিয়েছি…

এই গরমের মধ্যে!

গরম আমার লাগতে পারে, তোমার লাগতে পারে, কিন্তু পল্লবদার নেই, ও কিছুতেই শুনতে চায় না…

গায়েত্রী কথার মাঝেই পিছনের টেবিলের মানুষটির দিকে আড়চোখে তাকাল। সেই তাকানোয় হাসি ছিল, অথচ নন্দিতা দেখল ভয়।

ও! তোদের সঙ্গে তো আলাপই করান হয়নি, এই এদিকে এস না…

ভদ্রলোক উঠে আসার সময় একটা প্যাকেট ফেলে রেখে এসেছিলেন।

গায়েত্রী হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, দিদিরটা আনলে না…

নন্দিতা কোনো এক অজ্ঞাত ভয়ে যেন কেঁপে উঠল। অথচ ভয়টা সমস্ত শরীরে চালিত হওয়ার আগেই অন্য এক বিস্ময় তাকে থামিয়ে দিল। পল্লব ফেলে আসা প্যাকেটটা নিয়ে এসে টেবিলে বসতেই সন্দীপ বলল, ইউ শোয়াইন! এতোদিন ডুব মেরে ছিলিস কোথায়! তোর জন্যে ক্লাবে জবাবদিহি করতে করতে শালা আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেল। বিকাশদা, দত্তদা তোর খোঁজ করে করে মাথা খেয়ে ফেলল….

নন্দিতা দেখল সন্দীপদা পল্লবের হাতটা মুঠোর মধ্যে চেপে ধরেছে। এতোটা আবেগ মানুষটা সহজে প্রকাশ করে না। নন্দিতা বুঝতে পারছিল সন্দীপদার জীবনের খুব গোপনতম কাজে মানুষটি পাশাপাশি ছিল।

গায়েত্রী বলল, তোমারো দুজন দুজনকে চেনো! পল্লব কোনো কথা না বলে সরু করে হাসল সন্দীপের চোখে চোখ রেখে।

সন্দীপ বলল, কি খবর বলতো, ডুব মেরে আছিস কোথায়!

ডুব মেরে নয় বস, নতুন প্রোজেক্ট, অনেক ঝামেলা। এখন তো কলকাতায় নেই, নীলগঞ্জে…

নীলগঞ্জে! কবে থেকে!

মাস খানেক, ইট ভাটা করেছি—

লোহার ব্যবসা বন্ধ—

বন্ধ হবে কেন, ওটা যেমন চলছে চলছে… এটা স্টার্ট করলাম।

তাই বলে ক্লাবের আড্ডায় একদম ফাঁকি….

ফাঁকি নয় রে, সময় পাচ্ছি না—

দিব্যি তো দুপুরবেলায় ঘুরতে বেরিয়েছিস, এর বেলায় খুব সময় পাস…

নন্দিতা দেখল সন্দীপদা কথাগুলো পল্লবকে বললেও চোখ দুটো কৌতূহলে আটকে আছে গায়েত্রীর গলার চেনে।

পল্লব গায়েত্রীর কানের পাশে উড়ে থাকা দু-একটা চুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ওর সঙ্গে তো তোর আলাপ নেই, গায়েত্রী বোস…।

নন্দিতা ভেবেছিল গায়েত্রীর আলাপ পর্বে আরও দু-একটি কথা থাকবে। গায়েত্রীর সঙ্গে পল্লবের সম্পর্কের একটা নাম আছে। সেটা আসবে। অথচ এল না। সন্দীপ আলাপ করিয়ে দিল নন্দিতাকে। সেই একই ঢঙে। ব্যাপারটা যেন অফিসিয়াল চিঠির গঁদ—সেম টু বি ডেলিভারড অ্যাজ মেনশানড অ্যাভাব…। নন্দিতার বুক থেকে গলার দিকে এক ভরা চৈত্র মাস উঠে আসছিল। ফটফটে আকাশ থেকে হঠাৎ যেন বাজ পড়েছে থিকথিকে সবুজে ভরা এক বিশাল গাছের ওপরে। আর গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি বিস্ময়ে দেখছে দেশলাই কাঠির মতো পুড়তে পুড়তে গাছটা একসময় মানুষটার থেকেও ছোটো হয়ে যাচ্ছে।

সন্দীপ বলল, একদিন আগে থেকে সময় করে আমার বারাসাতের বাগান বাড়িতে চলে আয়, বউকে নিয়ে অনেকবার বাড়িতে আসতে বলেছি, আসিসনি, ওখানে চলে আয়, সারাদিন থাকা যাবে, বাড়িতে আসার থেকে অনেক বেশি চার্মিং, গায়েত্রীর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, আপনারও নেমতন্ন রইল…

পল্লব গার্লিক প্রণের টুকরো মুখে ফেলে বলল, নেমতন্ন থাকলে কী হবে? অতো দূর যাওয়া সম্ভব, তাও কলকাতায় থাকলে নয় হত…

কেন! অসুবিধার কী আছে, স্কুটারে চলে আসবি, রাজারহাট হয়ে ভি আই পি রোডে উঠবি, এয়ারপোর্ট দু-নম্বর গেট হয়ে যশোর রোড ধরে শাঁ…

শেষ শব্দটায় যেন আলোর থেকেও বেশি গতি ছিল। সন্দীপের ঠোঁট কাঁপল। পারলে ওদের আজ এখনই বারাসাত নিয়ে যায়। নন্দিতার ভিতর অস্থিরতায় মুচড়ে উঠছিল।

পল্লব বলল, তুমি তো শাঁ বলে দিয়েই খালাশ, অতোটা রাস্তা কতো তেল পুড়বে বলতো, এমনিতেই এক, দেড় যায় রোজ…

সন্দীপ হাসে। এক। দেড়। আমার কত যায় বলতো, অফিস থেকে রোজই বেরই, তারপরে ওকে সল্টলেকে ছাড়তে হয়, সেখান থেকে ব্রহ্মপুর। আমার তো আড়াই-র কমে হয় না…

নন্দিতা এসব কথায় খুব একটা অবাক হচ্ছিল না। এক অন্তলীন বিস্ময়ে শুধু দেখছিল গায়েত্রীকে। ওর চোখে কোথাও ব্যথার ছায়া নেই। এত সুন্দরভাবে বাঁচতে শিখে গেছে গায়েত্রী। আগে কলকাতার একটা সীমা-পরিসীমা ছিল। লোকে গল্প করে বলত ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, দর্জিপাড়ার ঐসব জায়গাগুলো নাকি ভদ্রলোকদের নয়। আজ একটার সঙ্গে আরেকটা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে ছাটকে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে, সল্টলেক ধাক্কা খেতে খেতে শ্যামবাজারে… শ্যামবাজারটা ব্রহ্মপুরে… ব্রহ্মপুরটা হয়ত বারাসাতে, আবার কোনোদিন হয়ত দেখবে বারাসাতটা শ্যামবাজারে চলে এসেছে…

খাওয়ার শেষে কাজের তাড়া দিয়ে ওরা চলে গেল। সন্দীপ বাইরে ওদের ছাড়তে গিয়েছিল, ফিরে এসে বলল আমাদের মতো ব্যাপার, কিন্তু পল্লব বুদ্ধি করে এমন জায়গায় শেকড় গেঁড়েছে কেউ কোনোদিন সন্দেহ করবে না, নিজের শালি, গায়েত্রীও নাকি দারুণ রেসপন্স করে, বলেছে বিয়ে করবে না…

সন্দীপের কথাগুলি এপ্রিল মাস হয়ে বয়ে যাচ্ছিল নন্দিতার শ্রবণের গভীরে। সে বলতে পারছিল না—জানি জানি সব জানি, রেঁস্তোরার ভিতর ঢুকে আসার মুহূর্তেই তো পল্লবকে চিনতে পেরেছি, ওর দিদির বিয়ের ফটো কি কলেজে পড়ার সময় দেখিনি, কিন্তু জানতাম না দূরত্বটা এতো কম, এতো কাছাকাছি এসে গেছে পৃথিবী দুটো… কোথাও দেড় লিটার কোথাও আড়াই…

অধ্যায় ৪০ / ৪০

সকল অধ্যায়

১. বিচারক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. ডালিম – চিত্তরঞ্জন দাশ
৩. চন্দ্রমুখী – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪. ঠিকানায় ‘বুধবার’ – জগদীশ গুপ্ত
৫. কুসুম – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৬. আদরিণী – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
৭. সাকীর প্রথম রাত্রি – রমেশচন্দ্র সেন
৮. হিঙের কচুরি – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. মেলা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১০. মন্দ লোক – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. দন্ত কৌমুদী – বনফুল
১২. গোষ্পদ – যুবনাশ্ব
১৩. ইতি – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
১৪. খট্টাঙ্গ পুরাণ – শিবরাম চক্রবর্তী
১৫. দুকানকাটা – অন্নদাশংকর রায়
১৬. চাচা কাহিনি – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৭. বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৮. অঙ্গার – প্রবোধকুমার সান্যাল
১৯. নমুনা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২০. চোর! চোর! – বুদ্ধদেব বসু
২১. বারবধূ – সুবোধ ঘোষ
২২. ট্যাক্সিওয়ালা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
২৩. বাইজি – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৪. তিমিরাভিসার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. জামাই – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
২৬. তলানি – নবেন্দু ঘোষ
২৭. মাশুল – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
২৮. শনি – সন্তোষকুমার ঘোষ
২৯. আঙুরলতা – বিমল কর
৩০. সুর্মা – রমাপদ চৌধুরী
৩১. ঘরন্তী – বিমল মিত্র
৩২. প্রাণ-পিপাসা – সমরেশ বসু
৩৩. বাগাল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৪. ছদ্মবেশিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. নরক – প্রফুল্ল রায়
৩৬. পহেলি পেয়ার – বুদ্ধদেব গুহ
৩৭. নিরুদ্দেশ প্রাপ্তি হারানো – সমরেশ মজুমদার
৩৮. বেওয়ারিশ লাশ – জাহান আরা সিদ্দিকী
৩৯. ঝরা পাতা – তসলিমা নাসরিন
৪০. নিজের সঙ্গে দেখা – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন