শৈলেন্দ্র হালদার
শীতের ধোঁয়াটে রাত্রি। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া হাড়ের ভেতর সেঁধোয়। আবছা অন্ধকারে সেই থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে জয়ন্ত। লক্ষ্য, ফুটপাতের ওধারে জীর্ণ তিনতলার বাড়িটার দিকে। দাঁতের ফাঁকে অর্ধদগ্ধ চুরুট জ্বলে-জ্বলে নিভে গেছে। অন্তর্দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত।
যাবে?
যাবে না?
যাবে?
কিন্তু এরই নাম মুক্তি? নয়ই বা কেন? উষ্ণ ঘন পিচ্ছিল বিস্মৃতি…। মূল্য দিয়ে কিনতে হয়। কোথায় নেই এই দেনা-পাওনার বোঝাপড়া। সঞ্চয়ের তহবিল স্ফীত নয় বলে তো আজ এই নিঃসঙ্গ শীতের রাতেও ওর প্রতীক্ষায় বসে নেই কেউ।
অযোগ্যতা…?
যোগ্যতার মাপকাঠিতে দুনিয়া চলে? ওই যে তিনতলার ছোটো ঘরে আছে মেয়েটি, যে-কোনো আগন্তুকের প্রতীক্ষায়, কোন যোগ্যতার অভাব ছিল তার! সুশ্রী, নম্র,বুদ্ধিমতী…। কিন্তু বিধিলিপি এমন নয়?
পানের দোকানের পাশে ছোটো অপরিসর গলির মধ্যে দিয়ে প্রবেশপথ। আশেপাশে ভদ্র লোকের বসতি। এমন কী এ বাড়ির পাঁচ মিশালি বাসিন্দাদের মধ্যেও গরিব গৃহস্থ আছে দু-চার ঘর। ভুল করে কোনো আগন্তুক যদি তাদের দরজায় ঘা দেয়, আধ-বয়সি গৃহস্থ বউ দরজা খুলে নিস্পৃহ মুখেই জানিয়ে দেবে ভুল জায়গায় এসেছে।
দু-তিন দিনের যাতায়াতে বাড়িটার আনাচ-কানাচ চেনা হয়ে গেছে জয়ন্তর। ভাঙা সিঁড়ি ধরে সোজা উঠে যাবে তিনতলায়। সামনের সরু অন্ধকার বারান্দার এক কোণে রেলিং ঘেঁষে বসে আছি বুড়ি ঝি। বয়সের ভারে দেহ সামনের দিকে নুয়ে পড়েছে। আফিং খেয়ে ঝিমোয় সারাক্ষণ। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা মাত্র তার দুমড়ানো শিরদাঁড়া সোজা হবে। অন্ধকার ভেদ করে ঘোলাটে দুটো চক্ষুকোটর সংবদ্ধ হবে আগন্তুকের মুখের ওপর। আস্তে আস্তে দেহ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়বে আবার। বিড় বিড় করে বলবে, ভিতরে যান, ঘরে আছে—।
ব্যতিক্রম ঘটল। এই দারুণ শীতে স্যাঁতসেতে সরু বারান্দায় বুড়ি বসে আছে ঠিকই। কোলে কম্বল জড়ানো পুঁটুলির মতো একটা কী। অন্ধকারে জয়ন্ত ঠাওর পেল না। বুড়ি তেমনি মুখ তুলে দেখলে ওকে, বলল, বাইরে গেছে, ঘরে গিয়ে বসুন।
অপ্রত্যাশিত নিরাশা। কী করবে ঠিক করে উঠতে পারছিল না জয়ন্ত। বুড়ি আবার বলল, সামনের দোকানে গেছে, এক্ষুনি আসবে, ঘরে গিয়ে বসুন—।
প্রায় আদেশের মতো শোনায়। ওই একটি মাত্র ঘর তিনতলায়। ভিতরে প্রবেশ করে জয়ন্ত দরজাটা ভেজিয়ে দিল আবার। বুড়ির দৃষ্টির নাগালের কাছে থাকাটাও অস্বস্তিকর। সুপরিচ্ছন্ন ছোটো ঘর। ধপধপে বিছানা পাতা। দেয়ালের গায়ে গোটা কতক দেবদেবীর মূর্তি। ঘরের অধিবাসিনীর ফটোও আছে একটা। নাম নীলা।
বসে আছে জয়ন্ত। খুশির আমেজ লাগছে যেন। একটু বিরক্তও। যেন নিজের ঘরটিতে বসে আছে সে, আর তারই নিতান্ত আপন কেউ বলা নেই কওয়া নেই নিশ্চিন্ত মনে বাইরে ঘুরছে কোথায়। এত শীতে ঠান্ডা লেগে অসুখ করাও তো বিচিত্র নয়।
লঘু পদধবনি। কণ্ঠস্বরও শুনল একটু বাদেই, মা গো কী শীত বাইরে, একি! এই ঠান্ডায়…
বুড়ির শীতল কণ্ঠে বাধা পেয়ে থেমে গেল!—একজন বাবু বসে আছে ঘরে।
জয়ন্ত উৎকর্ণ। অনুচ্চ কণ্ঠের তর্জন শোনা গেল, পারিনে আর, যেতে বলে দিলে নাকেন—!
বুড়ি ততোধিক শান্ত—জয়ন্তবাবু অনেকক্ষণ বসে আছে, ঘরে যা—।
মর্যাদাটুকুর অর্থ স্পষ্ট ও নগ্ন। আফিংখোর বুড়ি ঝিও জয়ন্তর দুর্বলতার খবর জানে। বাদানুবাদ দূরে থাক, গেল বারে কত দিল না দিল ভালো করে না দেখেই সে পালিয়েছিল। একটু আগের খুশির ভাবটুকু কেটে গেল। বিকৃত হাসি দেখা দিল মুখে, প্রতিমুহূর্তের অভ্যর্থনা এখানে মূল্য দিয়ে কিনতে হয় জেনেই তো আসা।
আস্তে আস্তে ঘরে প্রবেশ করল মেয়েটি। দরজা আবজে দিল। গায়ের গরম আলোয়ানটা আলনায় রাখল। মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়াল তারপর।
জয়ন্ত দেখছে। অভিসারিকার বেশ নয়, সাদাসিধে আটপৌরে শাড়ি, ব্লাউজ। দোকানে যাওয়ার কথাটা বুড়ি বানিয়ে বলেনি হয়তো।
অনেকক্ষণ বসে আছেন তো?
জয়ন্ত স্থির, শান্ত। দেনা-পাওনার সম্পর্কটা আজ ভুলবে না কিছুতে। বলল, ঝি যেতে বলে দেয়নি, তুমি বললেও তো পারো।
তার পাশ ঘেঁষে বসল নীলা। বলল, বাবা, এও কানে গেছে! কিন্তু আপনার নাম শুনে তো আর কিছু বলিনি—।
অন্যদিনের মতো আজ আর গল্প জমল না। জয়ন্তর ভাবুক মনের তাল কেটেছে। শুধু তাই নয়, নীলাকেও অন্যমনস্ক দেখছে কেমন। অন্যদিন ও অনভিজ্ঞ অতিথির বিপর্যস্ত হাবভাব লক্ষ্য করছে নিঃশব্দ কৌতুকে। আজ নিজের অজ্ঞাতে বন্ধ দরজার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে বারবার। হঠাৎ জোর করেই একটা হাই তুলে নীলা বলে ফেলল, ঘুম পাচ্ছে…..।
মুহূর্তে দু-চোখ জ্বলে উঠল জয়ন্তর। এও তো যেতে বলারই নামান্তর। অর্থাৎ যত শিগগির পারো টাকা দিয়ে বিদেয় হও। কিন্তু আজ জয়ন্তও করবে দোকানদারী।
নির্মম দৃঢ় নিষ্পেষণে সে কান পেতে শুনতে চাইল ওর বুকের উষ্ণ স্পন্দন। বদলে বাইরে থেকে হঠাৎ কানে এলো শিশুর সুস্পষ্ট গোঙানির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে নীলা চমকে উঠল যেন।
কী—?
নীলা জবাব দিল, কিছু না।
পরক্ষণে আবারও। এবারে কাতর কান্না। বাইরে বুড়ি ঝির তাকে থামবার চেষ্টা। ঘরে দুই সবল বাহুর মধ্যে নীলার অস্বস্তি।
জয়ন্ত উঠে বসল—বাইরে কাঁদছে কে?
নীলা থতমত খেয়ে গেল কেমন।
কে কাঁদছে বাইরে?
মেয়ে।
কার মেয়ে?
আমার।
জয়ন্ত নির্বাক! দুই চোখে নির্বোধ বিস্ময়। বুড়ির কোলে পুঁটুলির দৃশ্যটা মনে পড়ে। এই প্রচণ্ড শীতে ঘরের মধ্যে জায়গা হয়নি। …একটি মাত্র ঘর।
কত বড়ো মেয়ে?
দেড় বছর…।
অন্যদিন তো দেখিনি?
একটু চুপ করে থেকে নীলা বলল, নীচের তলায় একজন ভাড়াটের কাছে থাকত…।
জয়ন্তর সমস্ত দেহে কী একটা শীতল পদার্থ যেন ওঠানামা করছে। গম্ভীর মুখে আদেশ দিল, ঘরে নিয়ে এসো।
নীলা হকচকিয়ে গেছে আগেই। উঠে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বাইরে গেল। জয়ন্ত কান পেতে শুনল, বুড়ি ঝি ফিস ফিস করে বলছে—জ্বরে গা পুড়ে গেল, কতক্ষণ আর ঘুমুবে।
নীলার অন্যমনস্কতা, ঘুম পাওয়া, কান্না শুনে চমকে ওঠা, সব কিছুর অর্থ সুস্পষ্ট হল এতক্ষণে। হাসি পাচ্ছে জয়ন্তর। নির্মম, নিষ্করুণ হাসি। মেয়েদের মাতৃত্ব-বোধ বিধাতার সকলের বড়ো আশীর্বাদ ….সকলের বড়ো অভিশাপও নয় কেন?
মেয়ে কোলে নীলা ফিরে এল। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বসল চৌকির ওপর। জয়ন্ত চেয়ে আছে বিস্ফারিত নেত্রে। …একমাথা অবিন্যস্ত কোঁকড়া চুল, শীতে আর জলো হাওয়ায় গাল দুটো ফেটে দগদগে লাল হয়ে গেছে। পাতলা বিবর্ণ দুই ঠোঁট থেকে থেকে কেঁপে উঠছে থরথর করে। নাহলে আর পাঁচটি শিশুর মতোই সুন্দর।
জ্বরের ঘোরে বেহুঁস হয়ে পড়েছে আবার , বুকের সর্দিতে প্রতিটি শ্বাসের ঘড়ঘড়ানি শুনতে পাচ্ছে জয়ন্ত। ওর বুকের ভেতরটাও কে যেন নিংড়ে দুমড়ে একাকার করে দিল হঠাৎ। বিকৃতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ওষুধ দিয়েছ কিছু?
আনতে গিয়েছিলাম, দোকান বন্ধ।
অনুচ্চকণ্ঠে জয়ন্ত ধমকে উঠল, এ তো আর তোমার দোকান নয় যে সারা রাত খোলা থাকবে, আগে কী করছিলে?
নীলা শান্ত মুখে তাকাল তার দিকে—আগে টাকা ছিল না।
আর সাড়া শব্দ নেই। জয়ন্ত নির্বাক নিস্পন্দ। …মৃতকল্প শিশুর জায়গা তখনো ছিল বাইরের অন্ধকারে এই স্যাঁতসেতে ঠান্ডায়, বুড়ির কোলে। এই একটি মাত্র ঘর ওষুধের টাকা জুগিয়েছে। কিন্তু দোকান তখন বন্ধ। দরজার দিকে চোখ পড়তে জয়ন্ত দেখল, বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। ঘরে ঢুকল। খানিক নীরব থেকে ঘরের পরিস্থিতি অনুভব করল যেন। টানা গলায় নীলাকে বলল, ঘুমিয়ে পড়েছে, দে নিয়ে যাই।
নীলার বিব্রত দুই চোখ পড়ে সামনের মানুষটার দিকে। কপালের কাছটায় দপদপ করছে জয়ন্তর। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল চৌকি ছেড়ে। জ্বলন্ত দৃষ্টি বুড়ির মুখের ওপর। বুড়িও চেয়ে আছে তার দিকে। …নির্বিকার, নিস্পৃহ। মড়ার মতো ঘোলাটে চোখ দুটো যেন হেসেও উঠল একবার। খুক খুক করে কাশতে কাশতে বাইরে চলে গেল বুড়ি।
অকস্মাৎ একটা সন্দেহ সজোরে নাড়া দিল জয়ন্তকে। তাকাল নীলার দিকে—ওই বুড়ি কে?
নীলা ভয় পেয়ে গেছে। শুকনো মুখে চকিতে দরজার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল একবার।
কে, ও?
মা।
ঘর ফাটিয়ে আবার হেসে উঠতে ইচ্ছে করছে জয়ন্তর। ঠিক অনুমান করেছিল। নীলা বসে আছে মূর্তির মতো। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা দেখছে জয়ন্ত। …বিশ বছর, পঁচিশ বছর পরের একটা সম্ভাবনা ভাসছে। সামনের তাজা নারী দেহ মিলিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। তার বদলে বসে আছে পলিতকেশ লোলচর্ম এক জরাজর্জর বৃদ্ধা, কোলে তার নতুন কোনো আধমরা শিশু, মাথার ওপরে ছাদ নেই, ভিজে স্যাঁতসেঁতে শীতের হাওয়া—সামনের দরজা বন্ধ। …নগ্ন প্রত্যাশার উল্লাসে সেখানে ধক ধক, ধক ধক করছে এক আদিম নর-দানবের জ্বলন্ত হৃৎপিণ্ড—নির্মম, নৃশংস, মাংস-লোলুপ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন