ঘরের দরজায় ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িউলীর কর্কশ গলা শোনা গেল, ‘ভরসন্ধেয় দরজা বন্ধ কেন লা, বেগুন? খোল না, কতক্ষণ দাঁড়াব!’
প্রদীপের অস্পষ্ট আলোকে একটি বিগত-যৌবনা রোগা লম্বা স্ত্রীলোক সিল্কের একটা শাড়ী সেলাই করছিল। স্ত্রীলোকটির ঠিক বয়স আন্দাজ করা কঠিন হ’লেও সিল্কের শাড়ীটি যে সমস্ত উজ্জ্বলতা ও সৌন্দর্য খুইয়ে বীভৎস প্রৌঢ়ত্বে এসে পৌঁচেছে এটা সহজেই বোঝা যায়।
দরজায় প্রথম আঘাত শুনে বেগুন কিসের আশায় একটু চঞ্চল হয়ে তাড়াতাড়ি শাড়ীটি বিছানার তলায় লুকোবার চেষ্টা করতে গেছল, কিন্তু তারপর বাড়িউলীর গলার স্বর শুনে সেটি আর না লুকিয়ে বিরক্ত স্বরে বললে, খোলাই আছে, জোরে ধাক্কা দাও।’ তারপর আবার সে সেলাই-এ মন দিলে।
তার হারান-যৌবনের সমস্ত সম্পদের মধ্যে ঐ কণ্ঠস্বরটুকু বুঝি এখানো অবশিষ্ট ছিল। কণ্ঠস্বরটি ছেঁড়া জুতোর নতুন ফিতার মতো একেবারে বেখাপ্পা!
বাড়িউলী তার বিপুল বাতগ্রস্থ দেহ নিয়ে অতি কষ্টে একপায়ের ওপর ভর দিয়ে বেঁকে আর একপা তুলে উঁচু চোকাঠটা ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকে বললে, ‘সে ছোঁড়া ত আজও এলা না রে, বেগুন—সে এবার ভেগেছে।’
বেগুন কোনো কথা না বলে নীরবে শাড়ীটা সেলাই করতে লাগল।
বাড়িউলী তক্তপোষ কাঁপিয়ে বসে বললে, ‘বলছিলুম কি, এই বেলা তোর তাগা জোড়াটা বিক্রী করে ফেল , শশীর বাবু ত শশীকে এক জোড়া কিনে দেবে বলেছে, আমি বন্দোবস্ত করে তোর তাগা জোড়াই গছিয়ে দেব’খন।’
শাড়ীটা সেলাই শেষ করে সেটা সন্তর্পণে পাট করতে করতে বেগুন বললে, ‘আমি তাগা বিক্রী করব না তোমায় কতবার বলেছি, তবু তুমি বিরক্ত করতে আস কেন বলো ত মাসী—? এখন যাও বাপু, আমার কাজ আছে।’
অতিরিক্ত ক্রোধেও মাসীর স্থূলদেহ স্থূলতর হবার আর কোনো সম্ভাবনা ছিল না। মাসীর কর্কশ কণ্ঠস্বর কিন্তু সপ্তমে উঠল—
‘কেন যাব লা, কেন? দে আমার দু’মাসের ভাড়া দে, গাণ্ডে পিণ্ডে যে দু’মাস গিলেছিস সেই খোরাকি দে। আমি তোর কাছে ভিখিরী হয়ে এসেছি? আমার পাওনা চুকিয়ে দিয়ে বেরো আমার বাড়ি থেকে, কালই আমি খেঁদিকে এনে বসাব। ঘাটের মড়া! দু-দু’মাসে একটি মিনসে ওর চৌকাঠ মাড়াল না, ওর আবার রোখ! কিছু বলি না বলে , ভালোমানুষীর কালই নেই, ভালো কথা বলতে এলুম না আমি বিরক্ত করতে এলুম! তাগা বেচবি না ত ক’দিন তোকে অমনি-অমনি পুষব রে মড়া?
দম ফুরিয়ে গেছল বলেই বোধ হয় বাধ্য হয়ে এবার চুপ করে মাসী হাঁপাতে লাগল।
মাসীর কণ্ঠস্বরে বাড়িময় সাড়া পড়ে গিয়েছিল, দরজার কাছে যে কয়েকজন এসে জমেছিল তার মধ্যে শশীই সব চেয়ে মাসীর আদরের—মাসী তাকে ছেলেবেলা থেকে মানুষ করেছে। তার দেহে যৌবনের কমনীয়তা হয়ত ছিল না কিন্তু বাঁধুনী ছিল, উগ্রতাও ছিল। তার রোজগার বেশী ছিল বলে সে বাড়ির সমস্ত বাসিন্দার হিংসার ঈর্ষার ও মাসীর স্নেহের পাত্রী। একটা সোনার চিরুনি হাতে ঘরের ভেতর ঢুকে সে ন্যাকামি ভরা আদুরে নাকীসুরে বললে, ‘ও—মাসী, তুই এখানে কোঁদল কচ্ছিস আর আমি তোকে খুঁজে খুঁজে সারা! তুই চিরুনিটা ভালো করে গুঁজে দিবিনে ত—বেশ আমার খোঁপা খুলে যাক!’
শশী আবার ঠোঁট উলটে মুখ ঘুরিয়ে দরজার কাছে ফিরে গেল।
মাসী তখনও ভালো করে দম ফিরে পায়নি, হাঁপাতে হাঁপাতে ক্রোধ-কর্কশ গলাটাকে যথাসাধ্য মোলায়েম করে বললে, ‘আয় না লো দিই, রাগ করিস কেন?’
মাসীর পাওনা সত্যি সত্যি বাকী থাকলেও অন্যদিন হলে বেগুন মাসীর মুখনাড়ার প্রতিশোধ দিতে কিছুতেই পিছপা হ’ত না। কিন্তু আজ সে চুপ করেই রইল। বুকের পুরোন ব্যাথাটা আজ আবার বেড়ে উঠেছিল। প্রতুত্তর দেবার লোভ সামলান শক্ত হ’লেও চেঁচামেচির পরিণাম শরীরের পক্ষে কখনই ভালো হবে না, হয়ত তার ফলে এই দুঃসময়ে ক’দিন অকর্মণ্য হয়ে শয্যাগত থাকতে হবে জেনে সে অতিকষ্টে সংযত হয়ে রইল।
শশীর পায়ে জুতো লক্ষ্য করে মাসী বললে, ‘ও আবার কি ঢং লা, মেমসায়েব হলিনাকি!’
শশী আগেকার মতনই কচি খুকির গলা নকল করবার চেষ্টায় নাকীসুরে উত্তর দিলে, ‘বা! আজ যে একজিবিশনে যাচ্ছি, জানিস না বুঝি?’
‘সে আবার কি’?
‘ওমা, একজিবিশন লো একজিবিশন , সায়েবদের মেলা, জানিস না?’
‘তা আমায় নে যাবি নে?’
শশী মুখ বেঁকিয়ে বললে, ‘হ্যাঁ, তুই যে ধুমসি, তোকে আবার নে যাবে! নড়তে পারিস না, থপ থপ করে চলিস, তোকে নে’ গে’ মুস্কিলে পড়ি আর কি?’
এ কথা শশী ছাড়া প্রায় আর কারুর মুখ থেকে বেরুলে মাসী সহ্য করত না, কিন্তু শশীর এখন রাজপাট , সুতরাং অতিকষ্টে কথাটা হজম করে মাসী বললে, ‘বেশ আমি না হয় ধুমসি, তুই না হয় রূপুসী, তা বলে তোর মাসী ত, তুই পারিস বলেই সাধছি নইলে আর কাউকে কি বলতে গেছি?’
মনস্তত্ত্বে মাসীর অশিক্ষিত পটুত্ব ছিল। রূপসী বলায় ও ক্ষমতার উল্লেখে খুশি হয়ে শশী বললে, ‘আচ্ছা, চ’ দেখি বাবু গাড়ি আনতে গেছে।’
ঝগড়া হঠাৎ থেমে যাওয়ায় দরজায় ভিড় হাল্কা হয়ে গিয়েছিল। বেগুন ইতিমধ্যে নীরবে টীনের ভাঙা পেঁটরা থেকে কাপড়-চোপড় বার করায় মন দিয়েছে।
‘সায়েবদের মেলায় যাবার আশায় আপাততঃ রাগটা কিছু ভুলে, মাসী শশীকে নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় বলে গেল, ‘খোরকি আর ভাড়া না পেলে বাছা, বলে যাচ্ছি কাল থেকে আমার বাড়িতে আর তোমার জায়গা হবে না।
‘আচ্ছা, আজই ভাড়া দেব।’ বলে বেগুন দরজাটা সশব্দে ভেজিয়ে দিলে। তারপর তাড়াতাড়ি সাজপোশাক করতে মন দিলে। আজকের এই একজিবিশনই তার একমাত্র আশা। সত্যই দু’মাস তার ঘরে কেউ আসেনি, দু’মাস ধরে মাসীর কাছে ধারে খাচ্ছে। প্রদীপের তেলটুকুও আজ ক্ষ্যান্তর অনুপস্থিতিতে তার ঘর থেকে না বলে নিয়ে এসেছে! মাসী যে পয়সা না পেলে এতদিনের বাসিন্দা বলে একটুও খাতির রাখবে না একথা ভালো রকমই জানে। আজ কোনো রকমে শিকার হাতড়ান চাই-ই। তাই মান্ধাতার আমলের সিল্কের শাড়ীটা এতক্ষণ ধরে সে সেলাই করেছে। আজ একজিবিশনে গেলে, রাত্রের মতো খাওয়া বন্ধ জানলেও এখন জলখাবারের জন্যে অপব্যয় করবার তার একটা পয়সাও নেই। তার শেষ পয়সা ক’টি টিকিট কেনবার জন্যে রাখতেই হবে। প্রদীপের স্তিমিত আলোর সামনে সে চুলটা বাঁধতে গেল।
ডানদিকে কপালের ওপরেই চুল অত্যন্ত পাতলা হয়ে টাক পড়বার মতো হয়েছে, সেখানটা যথাসাধ্য অন্যদিকের চুল টেনে সে খোঁপা বাঁধলে। একটি মাত্র ভালো সেমিজ ছিল তা ধোপা বহুদিন থেকে পয়সা না পেয়ে আর ফেরৎ দিয়ে যায় না—সুতরাং পুরোন আধ-ময়লা সেমিজটা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। পাউডারের কৌটো বহুদিন খালি! কেরোসিনের ডিবের আলোয় খড়ির গুঁড়ো ধরা পড়ে না কিন্তু একজিবিশনের উজ্জ্বল আলোতে খড়ির গুঁড়ো মেখে যেতে তার সাহস হল না। দুই চোখের কালিভরা কোটর, লুকোবার কোনো উপায় নেই। তাদের ব্যবসায়ে ভালো সাজপোশাকের মূল্য যে কত, তা সে জানে, বিশেষতঃ এই যৌবনের পারে এসে মানুষের চোখে ধাঁধা লাগাতে হ’লে সাজপোশাকের অন্তরালে আসন্ন-বার্ধক্যের কুশ্রীতা গোপন না করলে যে চলতেই পারে না। কিন্তু বেশভূষা দূরের কথা, কিছুদিন ধরে দু’বেলায় উপযুক্ত যৎকিঞ্চিৎ অন্নসংস্থান করাও তার পক্ষে বিশেষ কঠিন হয়ে উঠেছে। যে তাগা জোড়া বিক্রী করবার পরামর্শ দিতে এসে মাসী এইমাত্র ঝগড়া করে গেছে, সেই তাগা-জোড়াটা বার করে নিয়ে সে পরলে। কেন সে তাগা বিক্রী করতে চায় না, তা যদি মাসী জানত! তার শেষ অলঙ্কার যে বহুদিন আগে অভাবের তাড়নায় বিক্রী হয়ে গেছে, একথা জানিয়ে, তার তাগা-জোড়া এবং সমস্ত গহনাই যে গিল্টি এই সংবাদ দিয়ে, সে আর বাড়ির সবার কাছে ছোট হ’তে চায় না।
শেষকালে কিন্তু শশীর কথা মনে করে সে তাগা-জোড়া খুলে রাখলে। বহুদিন আগে তার এক সৌখীন সাহেবী-ঘেঁষা প্রণয়ী জুটেছিল। সে তাকে জুতো পরিয়ে বিবি সাজিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াত। তারি দেওয়া এক জোড়া হিল-তোলা জুতো বহুদিন পেঁটরার এক কোণে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে ছিল। আজ সেটিকে বার ক’রে, ভালো করে পরিষ্কার করে অনেক দিন বাদে পায়ে দিলে। জুতোর সঙ্গে তাগা মানাবে না ভেবে, সে তাগা-জোড়া খুলে রেখেছিল।
সাজগোজ সমাপ্ত করে যখন সে পথে বেরুল তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে হবে। অনেকদিন বাদে জুতো পায়ে দিয়ে চলতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল কিন্তু একেবারে অনভ্যস্ত নয় বলে তার চলন নিতান্ত অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল না।
চৌরঙ্গীর চৌমাথা পার হবার সময়, দুজন লোক তার সম্বন্ধে একটা অভদ্র ইঙ্গিত করে হেসে উঠল। তার আকর্ষণী শক্তি একেবারে লোপ পায়নি মনে করে বেগুন একটু খুশিই হ’ল।
টিকিট-বিক্রেতা মনস্তত্ববিদ নয় , তাদের সে অবসরও নেই, নইলে সেদিন দক্ষিণ তোরণের টিকিট-ঘরের কাউন্টারে টিকিট নেবার সময় একটি শিরওঠা কঠিন সৌষ্ঠবহীন হাতের কাঁপুনিতে তারা অনেক কিছু দেখতে পেত। এটি বেগুনের শেষ আধুলি।
আলোকের উন্মত্ত উৎসব! অসংখ্য উৎসবমত্ত মানুষের কোলাহলের সঙ্গে দূরের ব্যাণ্ডের অপরিস্ফুট সুরধারার মাধুর্য ও সমস্ত আনন্দ-সমারোহের ওপর অতল গভীর আকাশের স্নিগ্ধ নক্ষত্র-খচিত রহস্যাবরণ,—সমস্তই বেগুনের কুটিল পথক্লান্ত জীবনের,—নিত্য অবহেলার মরচেপড়া মনের কাছে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেল।
মেহেদি গাছের বেড়া দেওয়া বাঁদিকের অপেক্ষাকৃত নির্জন পথটা দিয়ে সে এগিয়ে চলল। দুর্বল শরীরে এতখানি হেঁটে এসে অত্যন্ত ক্লান্তি বোধ করছিল। বুকের ভেতর পুরোন বেদনাটা তাকে পরিহাস করবার জন্যই যেন মাঝে মাঝে চিড়িক দিয়ে উঠছিল। কিছুদূর গিয়েই অল্প অন্ধকারে একটা খালি বেঞ্চি দেখে কিছুটা জিরিয়ে নেবার জন্য সে বসে পড়ল। এ পথটা দিয়ে লোকজনের যাতায়াত অপেক্ষাকৃত কম। সামনেই একটা বৈদ্যুতিক বাতির পোস্ট, কিন্তু তাতে আলো ছিল না। বেগুন কতকটা নিজের অজ্ঞাতে ও কতকটা সজ্ঞানে আসন্ন সংগ্রামের জন্যে যেন শক্তি সংগ্রহ করছিল। কিছুক্ষণ অবসন্নভাবে বসে থাকবার পর হঠাৎ পাশে চোখ পড়াতে সে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে উঠল। তার অলক্ষ্যে কে একজন বেঞ্চির অন্য পাশে এসে বসেছে! অন্ধকারে তার মুখ ও বেশভূষা ভালো করে দেখা না গেলেও, সে যে পুরুষ এবং বলিষ্ঠ পুরুষ তা বুঝতে বিশেষ কষ্ট হয় না। বেগুন সজাগ ও উদগ্রীব হয়ে ভালো ক’রে বসল। ডান পায়ের জুতো মাটিতে ঠুকে বারকয়েক শব্দ করলে এবং মাথার কাপড় ফেলে হঠাৎ খোঁপার কি ত্রুটি শোধরাতে বিশেষ করে মন দিলে।
সামনের বাতিটা কোন কারণে নিশ্চয় খারাপ হয়েছিল। একজন মিস্ত্রী সেটা জ্বালাবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ বাতিটা পলকের জন্যে জ্বলেই নিভে গেল। ঐ পলকটিতে লোকটাকে দেখে নেবার সুযোগ কিন্তু বেগুনের হয়নি। যাই হোক লোকটা তাকে দেখতে পেয়েছিল নিশ্চয়ই। অন্ততঃ সেও এবার তার দিকে একটু পাশ ফিরে একটা পায়ের ওপরে পা তুলে দিয়ে বসল। মাথায় খোঁপার কাল্পনিক ত্রুটি শুধরে বেগুন বেশ একটু জোরেই হাতটা নামালে। হাতের গিল্টির চুড়িগুলি বেজে উঠল—রিনঠিন রিনিঠিন।
অন্ধকার হ’লেও বোঝা গেল লোকটা তার দিকেই চেয়ে আছে , কিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেও তার দিক থেকে অগ্রসর হবার কোনো লক্ষণ পাওয়া গেল না। বেগুন একটু অধীর হয়ে উঠল! তবে কি লোকটা এখনো বোঝেনি, না কোনো গোবেচারী গোছের চাষাভূষো হবে?
আলোটা জ্বলে না কেন? কিন্তু এই বেশভূষা নিয়ে আলোর চেয়ে অন্ধকারই যে তার পক্ষে সুবিধার একথা সে জানত। কিরকম লোক না জেনে আরো অগ্রসর হওয়া উচিত হবে কিনা ভাবছিল, এমন সময় লোকটা একবার কাশলে। বেগুনও একবার কাশলে। লোকটা আবার কাশলে!
বেগুনের বুকটা আশায় দুলে উঠল! এ যে জোর করে নকল কাশবার চেষ্টা, তা বোঝা আর কঠিন নয়। আঁচল থেকে ধীরে ধীরে চাবিটা খুলে বেগুন পায়ের কাছে ফেলে দিলে। তারপর খানিক খোঁজবার ভান করে লোকটার দিকে ফিরে বললে, ‘আপনার কাছে দেশলাই আছে? আমার চাবিটা একটু খুঁজে দেখব—’
লোকটা চমকে উঠল। সত্যি সে কণ্ঠস্বর চমকাবার মত। এই কণ্ঠস্বরটিতে এখনও কৈশোরের অপরূপ কোমলতা ও যৌবনের অসীম মাধুর্য ও স্নিগ্ধ মাদকতা অটুট ছিল। আর সে স্বরে ছিল—নিখিলের সুষমাময় নারীত্বের প্রচ্ছন্ন বিস্ময়ের আভাষ!
এই পতিতার জীর্ণ জীবনের জঞ্জালে এই সদ্য-স্ফুট শেফালির মতো সৌরভ-শুচি কণ্ঠস্বর কেমন করে থাকতে পারে এইটেই আশ্চর্য! লোকটা চমকে উঠেছিল কারণ সে এতটা আশা করেনি।
নীরবে পকেট থেকে একটা দেশলাই বার করে বেগুনের প্রসারিত হাতে সে গুজে দিল।
বেগুন নীচু হয়ে দেশলাই জ্বেলে চাবি খোঁজবার ছল করবার মধ্যেই টের পেলে লোকটা আর একটু সরে বসেছে।
সামনে ইলেকট্রিক বাতিটা আর একবার জ্বলে উঠল কিন্তু বেগুন মুখ তুলে লোকটাকে দেখবার আগেই আবার নিভে গেল! বেগুন মনে মনে বাতির ও বাতিওয়ালার সপ্তম পুরুষ উদ্ধার ক’রে আবার আর একটা দেশলাই জ্বাললে। বাতিটা যেন ইচ্ছে করেই তার সঙ্গে তামাসা করছিল। এবার আর চাবি খুঁজে পেতে দেরী হ’ল না। দেশলাইটা ফিরিয়ে দেবার ছলে বেগুন লোকটার হাতে একটা আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে আঘাত করলে, তারপর আর একটু ঘেঁষে বসল। বললে, ‘ভাগ্যিস আপনি ছিলেন, নইলে এই অন্ধকারে চাবি খোঁজা কি সোজা!—’
লোকটা কোনো উত্তর দিলে না, শুধু অন্ধকারে একটা হাত বেগুনের কোমরে এসে ঠেকল! বেগুন সে হাতটা মুঠোয় খপ করে ধরে ফেলে একটু চাপ দিলে। অন্ধকারের মধ্যে স্পর্শ করে বেগুন অনুভব করছিল, হাতটা অত্যন্ত লোমশ ও চামড়া অত্যন্ত কর্কশ—লোকটা দেখতে খুব সুশ্রী বোধহয় হবে না—তা না হোক।
বারকয়েক মিট মিট করে সামনে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠল।
ঘৃণায় বিতৃষ্ণায় আতঙ্কে লোমশ হাতটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেগুন লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। লোকটার উপরের ঠোঁট একেবারে নেই—মাড়ি থেকে লম্বা অপরিষ্কার দাঁতের পাতি, ভয়ঙ্কর ক্ষত থেকে বেরিয়ে এসে সমস্ত মুখটাকে বীভৎস করে তুলেছে, আর বাঁ দিকের সমস্ত গাল কবে যেন আগুনে ঝলসে পুড়ে বিবর্ণ মাংসপিণ্ড হয়ে গেছে!
লোকটা বেগুনের এই আতঙ্কে একটুও হতভম্ব হয়নি এমন নয়, কিন্তু সে যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইল। বেগুন তার দিকে আর না চেয়ে এগিয়ে চলল। অনেক সময় ও অনেক কলাকৌশল তার বৃথা নষ্ট হয়েছে সত্য কিন্তু তা বলে ঐ দুঃস্বপ্নের সঙ্গে সে স্ফূর্তি করতে পারে না! এর চেয়ে ভালো শিকার সে নিশ্চয় যোগাড় করতে পারবে।
অনেক দিন বাদে জুতো পায়ে দিয়ে অতখানি হেঁটে পায়ে ফোস্কা পড়েছিল। একটানা চলার সময় তার বেদনা বিশেষ কিছু অনুভব না করলেও অনেক্ষণ জিরোবার পর এখন হাঁটা একটু কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। এখন জুতো খুলে ফেলাও অসম্ভব, খুঁড়িয়ে হাঁটলেও হাস্যাস্পদ হ’তে হয় সুতরাং যন্ত্রণা গোপন করে সে যথাসাধ্য স্বাভাবিক ভাবে হাঁটবার চেষ্টা করছিল। তাকে হাঁটতেই হবে যে। কিছু দূর গিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকাল। লোকটা তখনও তার দিকে চেয়ে সেই বেঞ্চিতেই বসে ছিল।
নির্মম জুতোর নিঃশব্দ পীড়ন সহ্য করা বিশেষ কঠিন হয়ে উঠলেও সে অনেকক্ষণ নানাদিকে ঘুরে বেড়াল। মেলার মজা ও আমোদ লক্ষ্য করবার মতো মনের অবস্থা তার ছিল না। চারিদিকে ক্ষুধিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শিকার অনুসন্ধান করাতেই সে একেবারে তন্ময় হয়ে ছিল। যত সময় যাচ্ছিল তার আশঙ্কা ও অস্থিরতা তত বেড়ে উঠছিল। এ পর্যন্ত কোনো সুবিধা সে করতে পারেনি। কয়েকজন নিঃসঙ্গ পুরুষের আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়ে ও কয়েকজনকে দৃষ্টির ইঙ্গিতে আকর্ষণ করবার চেষ্টা করে কোনো ফল হয়নি।
শাখায় শাখায় লালবাতি-দেওয়া ঝাঁকড়া একটা গাছের তলায় বেশী ভিড় জমে ছিল। সেটা জুয়ার আস্তানা। লোহার আলের ওপর ঘুরে ঘুরে একটা ছ’কোণা কাষ্ঠখণ্ড খেলোয়াড়দের ভাগ্য নিরূপণ করছিল। বেগুন যখন গিয়ে সেখানে দাঁড়াল তখন ভাগবাঁটরা হচ্ছে, একতরফা খেলা শেষ হয়ে গেছে।
একটি বামনাকার স্থূলকায় লোক স্মিতবদনে একতাড়া নোট পকেটে রাখছিলেন। খুশিতে তার দু’ভাঁজ চিবুক তিন ভাঁজ হয়ে উঠেছে। বেগুন ঠেলেঠুলে তাঁর পাশে জায়গা করে নিলে। তার ঠিক বিপরীত দিকে একটি ফিরিঙ্গি মেয়ে একটি ফিরিঙ্গি যুবকের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কি বলছিল। তাদের কথাবার্তা না বুঝলেও হাব-ভাবে বেগুন বুঝতে পারলে ছেলেটি সম্প্রতি অনেক লোকসান দিয়ে আর খেলতে না চাইলেও মেয়েটি তাকে ছাড়তে দিতে চায় না।
ইতিমধ্যে মোটা ভদ্রলোক পাঁচ নম্বরে একটা দশ টাকার নোট ধরেছেন। আবার কাষ্ঠখণ্ড ঘুরলো! তারপর চারিদিক থেকে কোলাহল উঠল, ‘চার নম্বর মার দিয়া!’
মোটা ভদ্রলোকটি রাগে টেবিল চাপড়ে আর একটা দশ টাকার নোট বার করলেন। ওদিকে ফিরিঙ্গি ছেলেটির সাথে মেয়েটির বচসা সুরু হয়েছে। ছেলেটি এবারও হেরেছে ও মেয়েটি আর একটি ফিরিঙ্গি বুড়োর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। খানিক বচসা করে ছেলেটি মুখ রাঙা করে চলে গেল। বেগুন মোটা লোকটির আরো কাছ ঘেঁষে একবার জুতো দিয়ে তার পাটা মাড়িয়ে দিলে! তৎক্ষণাৎ আবার ক্ষমা চেয়ে সে বলতে যাচ্ছিল, ‘মাফ করবেন, দেখতে পাইনি।’ কিন্তু লোকটির কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, তিনি তার জুতোর চাপ টেরই বোধ হয় পাননি!
আবার খেলা শুরু হ’ল। এবার নম্বর উঠল ‘দুই’। মোটা লোকটির টাকা ছিল তিনে।
পেছন থেকে একটা ধাক্কা এল। বেগুন সামলাতে না পেরে ভদ্রলোককে জড়িয়ে ধরলে।
‘এইও পাজী বদমাস!’ ভদ্রলোক এক ঝটকায় তার হাত দুটো ছাড়িয়ে তাকে অন্য পাশে ছিটকে দিলেন। বেগুন এবার সত্য সত্যই অতি কষ্টে পেছনে লম্বা-চওড়া এক শিখের গায়ে ভর দিয়ে টাল সামলাল।
‘আরে হিঁয়ে ত মর যাওগে’ বলে শিখ তাকে ভিড় থেকে ঠেলে বার করে দিলে। সে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে আর তার সাহস হচ্ছিল না। ভিড়ের বাইরে সে এর পর কি করা যায় ভেবে পেল না।
যে সব পথে সারি সারি আলোকজ্জ্বল সুসজ্জিত দোকানের সামনে দিয়ে অসংখ্য লোকজন যাতায়াত করছিল, সেখানে তার যাবার উপায় নেই। তার সাজসজ্জার অসংখ্য ত্রুটি, তার অস্তমিত যৌবনের কুশ্রীতা সেখানে আলোকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে যাবে। নিশাচর শ্বাপদের মতো তার অন্ধকারের সঙ্গেই আত্মীয়তা। একটি বয়স্ক সুবেশ বলিষ্ঠকায় ভদ্রলোক পাশ দিয়ে যাবার সময় তার দিকে একবার চেয়ে গেলেন। খানিক দূর গিয়ে আর একবার ফিরে চাইলেন, তারপর ডানদিকের ঝিলের উপরকার ছোট সাঁকো পার হয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
বেগুন সন্দিগ্ধ মনে তাঁর পিছু নিলে। সাঁকো পার হয়ে একটা ছবির ঘরে গিয়ে বেগুন আবার তাঁকে দেখতে পেলে। ভদ্রলোক ব্যস্ত ভাবে যেন কি খুঁজছিলেন। সে বিপরীত দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছবির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিলে। ভদ্রলোক বোধ হয় তাকে লক্ষ্য করেননি। হঠাৎ বেগুন তাঁর দিকে ফিরে বললে, ‘আচ্ছা, তের বছরের মেয়ে এমন ছবি আঁকতে পারে?’
ভদ্রলোক বোধ হয় শোনেননি, কোনো উত্তর দিলেন না। বাম পাশ থেকে কে মিহি গলায় বললে, ‘হ্যাঁ , তের বছরের মেয়ে আবার অমনি আঁকতে পারে! ও অমনি বাড়িয়ে লিখেছে।’
পেছনে শশী, তার জিরাফ-গর্দান কাঠঠোকরা-মুখো বাবুও মাসীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল। বেগুন আশ্চর্য হয়ে ফিরে তাকাল। মাসী একবার তার বেশের দিকে চেয়ে নাক সিঁটকে মুখ ফেরালে। শশী একটু হাসলে। কিন্তু তখন শশীর সালঙ্কারা সৌভাগ্য-গর্বিত যৌবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করে ঈর্ষান্বিত হবার সময় তার ছিল না। ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন , বেগুন তাঁর পিছু নিলে। মাসী পেছন থেকে বলছে শুনতে পেলে, ‘ওই রূপের আর দেমাক দেখে বাঁচি না!—’
ভদ্রলোক বেশ জোরে হাঁটছিলেন। হয়ত এ অনুসরণে কোনো লাভ হবে না ভেবেও এবং পায়ের যন্ত্রণা সত্ত্বেও বেগুন যথাসাধ্য জোরে হাঁটতে সুরু করলে। প্রকাণ্ড একটা নাগরদোলার সামনে গিয়ে তিনি বসলেন। বেগুন এবার মরিয়া হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে হাতটা খপ ক’রে ধরে ফেলে বললে, ‘আসুন না, ঐ চেয়ারটা খালি আছে।’
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তার দিকে ফিরে চাইলেন। ভদ্রলোক শুনতে পাননি ভেবে বেগুন কম্পিত বুকে, হাতে একটু টান দিয়ে বিবর্ণ-মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে আবার বললে, ‘আসুন না, ওই দোলাটায় একবার চড়ে আসি।’ কিন্তু তৎক্ষণাৎ সভয়ে তাঁর হাত ছেড়ে দিলে। ভদ্রলোকের মুখে চোখে অসীম বিতৃষ্ণা ও ক্রোধ ফুটে উঠেছিল। এমন দুঃসাহস অবশ্যই তিনি আশা করেননি। ক্রোধকটুকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘তোমার এই বেয়াদবির জন্যে তোমায় পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি জান?—নচ্ছার পাজী মেয়েমানুষ কোথাকার!—’
বহুদিনের পুরাতন বেদনাটা আবার বুকের পাঁজরায় পেরেক ঠুকছিল। ভদ্রলোক বলছিলেন, ‘তোমার এতবড় আস্পর্ধা—’
হঠাৎ পাশ থেকে একটি ছেলে ডাকলে ‘বাবা! ওমা, এই যে বাবা।’ আধা ঘোমটা দেওয়া একটি স্ত্রীলোক কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বেগুন ভদ্রলোকের ক্ষণিকের অন্যমনস্কতার সুযোগে সেখান থেকে সরে গেল। খানিক দূর গিয়ে একটা চেয়ারে সে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল। মাথাটা ঘুরছিল, চোখেও যেন একটু ঝাপসা দেখছিল—এখন যদি একটু মদ পেত!
কিন্তু ক্রমশঃ সময় যাচ্ছে। আজ যাহোক কিছু রোজগার করা চাই-ই। এখন মনে হচ্ছে, সেই প্রথম শিকার অবহেলা করা হয়ত উচিত হয়নি, কিন্তু সে যে ভাবতেও গা শিউরে ওঠে! কিছুক্ষণ পরে এক জড়ভরতকে কাঁধে ভর করিয়ে এনে একটি মেয়ে তার সামনের চেয়ারে বসিয়ে দিলে। মেয়েটি যে তারই সমশ্রেণীর এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এই অষ্টাবক্র মূর্তিমান জরাকে কোথা থেকে সে পাকড়াও করলে!
বুড়োকে চেয়ারে বসিয়ে মেয়েটা বললে, ‘খবরদার, এখান থেকে নড়িসনি বুড়ো, তা’হলে তোর হাড়মাস একজায়গায় রাখব না!’ বুড়ো সুরা-জড়িত কণ্ঠে অস্পষ্টভাবে কি বললে বোঝা গেল না। মেয়েটা বললে ‘দে টাকা, এক বোতল আনি।’ তারপর বুড়োর পকেটে হাত দিলে। কিন্তু এ বিষয়ে বুড়ো এখনও খুব সজাগ , সে আর্তকণ্ঠে বিকৃত স্বরে চিৎকার করে বললে, ‘ঐ নিলে, সব চুরি করে নিলে!’ মেয়েটা বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বললে, দে তবে হতচ্ছাড়া, তুই নিজেই দে।’ বুড়ো পকেট থেকে একটা নোট কম্পিত হাতে বার করে দিলে, মেয়েটা চলে গেল।
বেগুন নীরবে সমস্ত লক্ষ্য করছিল। বুড়োর যেমন রূপ তেমনি বেশ! তার দেহের গঠন দেখলে মনে হয়, মাত্র সম্প্রতি সে চতুষ্পদে চলা ত্যাগ করেছে। তার কুৎসিত মুখের লোল-মাংসে ও প্রতি রেখায় সারাজীবনের পৈশাচিক ইতিবৃত্ত লেখা। বেশ তার অদ্ভুত। শীর্ণ দেহে একটা ময়লা চাপকান এবং সে চাপকানের ওপর আবার এক দুর্গন্ধ নোংরা চাদর। গলার কম্ফর্টার জড়ান, পাঁকাটির মতো সরু ও ধনুকের মতো বাঁকা পায়ে লাল মোজা ও ক্যাম্বিশের ছেঁড়া জুতো। ঐ ধবংসাবশেষের মাঝে মৃত্যুর ভ্রুকুটির তলেও কদর্য কামনার বীভৎস উৎসবের লীলা আজও থামেনি। বেগুনের নিঃসাড় মনেও ঘৃণা ও বেদনা জাগছিল।
কিন্তু বৃদ্ধের পকেট টাকায় ভরা ঐ মেয়েটার বদলে যদি সে নিজে আজ একে শিকার করতে পারত, কিছুদিনের দুর্ভাবনা অন্ততঃ ঘুচত। একবার ইচ্ছে হ’ল যে, মেয়েটার অনুপস্থিতিতে বুড়োকে ভুলিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যায়। কিন্তু সাহস হ’ল না। মেয়েটা যদি আর না আসে, তাহ’লে হয়ত ভালো হয়, কিন্তু সে সম্ভাবনা খুব কম। মেয়েটার কিন্তু অনেক দেরি হচ্ছিল।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত মেয়েটিকে আর ফিরতে না দেখে বেগুন অবশেষে আর নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকতে পারলে না। বৃদ্ধ বোধ হয় ঝিমোচ্ছিল। ধীরে ধীরে তার কাছে গিয়ে বসল। পকেট থেকে মনিব্যাগটা উঁকি মারছিল। একবার ইচ্ছে হ’ল এই অবসরে মনিব্যাগটা নিয়ে সরে পড়ে, কোনো হাঙ্গামা নেই, কেউ দেখতেও পাবে না। কিন্তু সে সাহস হ’ল না, বুড়ো সে সুযোগ দিলেও না, হঠাৎ চোখ চেয়ে বললে, কে, রূপো এলি? দে, বোতল দে।’
বেগুন বললে, ‘আমি রূপো নই—’
‘আচ্ছা তুই সোনা, দে এখন, বোতল দে।’
সে হাত বাড়ালে।
‘বাঃ, আমি বোতল কি জানি!’
বুড়ো এবার চটে বললে, ‘আমার সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে? দে বলছি বোতল!’
বেগুন বুড়োকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, ‘মর বুড়ো, আমি কি তোর রূপো, তোর রূপো চম্পট দিয়েছে।’
বুড়ো এবার সচেতন হয়ে উঠল। বেগুনের দিকে চেয়ে বললে, ‘কোথায় গেল রূপো? তুই কে!’ তারপর দুর্বল পায়ে উঠবার চেষ্টা করলে। বেগুন তাকে নিরস্ত করতে গেল। বুড়ো চিৎকার করে বললে, ‘না না, আমার রূপোকে খুঁজব, ছাড় তুই মাগী।’ কিন্তু বুড়োর ওঠবার ক্ষমতা ছিল না, বেঞ্চিতে আবার টলে পড়ল। বেগুন বৃদ্ধের গলা বাহু দিয়ে বেষ্টন করে বললে, ‘রূপো থাকগে, আমি তোকে বোতল দেব, চ আমার সঙ্গে!’
‘না না, আমার রূপোকে চাই!’ বৃদ্ধ বেগুনের বাহুর বেষ্টন থেকে মুক্ত হবার দুর্বল চেষ্টা করতে লাগল। বৃদ্ধের বুকে মাথাটা রেখে ফুঁপিয়ে কান্নার অভিনয় করে এবার বেগুন বললে, ‘কে তোর রুপো? তোকে ফেলে সে পালিয়ে গেল, আর আমি তোকে সাধছি তবু আমায় পায়ে ঠেলছিস!’ অভিনয়ে চির-অভ্যস্ত এই পতিতার পঙ্কিল হৃদয়ও সে জঘন্য অভিনয়ে বিতৃষ্ণায় ভরে উঠেছিল—কিন্তু উপায় নেই।……..
বুড়োকে রাজী করিয়ে অনেক কষ্টে তাকে গেটের কাছাকাছি এনে বেগুনের একটু আশা হ’ল। এই দুর্বল অসুস্থ শরীরে এই অথর্ব বৃদ্ধের ভার বয়ে আনা সহজ নয়। বেগুনের সমস্ত দেহ ভেঙে পড়তে চাইছিল কিন্তু গেটের কাছে পৌঁছোলেই কিছুদিনের মতো দুঃখের অবসান হবে ভেবে, আশায় সে প্রাণপণে এগিয়ে চলছিল। হঠাৎ পেছন থেকে কে হাঁকলে, ‘এইও, খাড়া হো যাও—’
বেগুন তখনও এগিয়ে চলছিল। লালপাগড়ী-পরা পাহারাওয়ালা পেছন থেকে ছুটে এসে সামনে দাঁড়িয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললে, ‘এত্তা চিল্লাতা, শুনতে নেহি?’
সভয়ে বেগুন দাঁড়িয়ে পড়ল। বৃদ্ধের শিথিলপ্রায় দেহ তার কাঁধে ঝুলছিল।
‘ইতো মাতোয়ালা হ্যায়, ছোড়দে ইসকো—’
বৃদ্ধ অস্পষ্ট স্বরে বললে, ‘হ্যাঁ বাবা, মাতাল হ্যায়।’ বেগুন হতাশ হয়ে শেষ চেষ্টা করে বললে, ‘আমার স্বামী যে, পাহারাওয়ালা সাহেব!’ দু’চারজন লোক মজা দেখতে জড় হয়েছিল, তারা হেসে উঠল।
‘চুপ বদমাস মাগী, দিললাগি করতা—’ পাহাড়াওয়ালা বৃদ্ধকে ধরে নিয়ে গেল! অনেকদিন বাদে বেগুনের চোখ সজল হয়ে উঠছিল বোধ হয়।
লোকের ভিড় অনেক কমে গেছল। রাত্রি অনেক হয়ে এসেছে। যে পথে প্রথম একজিবিশনের ভেতর গিয়েছিল সেই পথেই আবার বেগুন চলতে আরম্ভ করলে। এখন তার মনে হচ্ছিল প্রথম সুযোগ ত্যাগ করা তার ভয়ানক বোকামি হয়েছে।—ভাগ্যহীনার আবার সুরূপ কুরূপ।
বেঞ্চিটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল। তার ওপরে কে যেন শুয়ে আছে মনে হ’ল। ভাগ্যের এত পরিহাসের পর আর দুরাশা করবার তার সাহস ছিল না। কিন্তু নিজের সৌভাগ্য সে প্রথম বিশ্বাস করতেই পারল না। যাকে দেখে সে কিছু পূর্বে আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল তার সেই বিভৎস মূর্তিই খানিক পরে তার এত আনন্দের কারণ হবে, এ কথাও সে কল্পনা করতে পারেনি। সেই মূর্তিমান দুঃস্বপ্নই বেঞ্চির উপর শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। মনের অদ্ভুত বিতৃষ্ণা-ভরা আনন্দ দমন করে সে তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে বললে ‘রাত অনেক হয়ে গেছে—’ এই জাগানোর অধিকার নিয়ে কোনো সন্দেহ কোনো দ্বিধা তার মনে আর ছিল না।
লোকটা হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে তার দিকে বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। লোকটার গায়ে খাকী ছেঁড়া কোট, পরণে আধ ময়লা কাপড় দেখে নিম্লশ্রেণীর মিস্ত্রী-টিস্ত্রী হবে বলে মনে হয়। লোকটার হাত ধরে তুলে বেগুন কিন্তু অবিচলিতভাবে বললে, ‘চলো, যাবে না?’
প্রথমে ঘুমের ও বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে লোকটা দু’হাতে চোখ রগড়ে উঠে দাঁড়াল। মেলায় লোক আর ছিল না বললেই চলে। তারা দুজনে পাশাপাশি এগিয়ে চলল। ক্ষুধায় শ্রান্তিতে বেগুনের পা আর চলছিল না। খাবারের দোকানের সামনে এসে বেগুন তাকে থামিয়ে বললে, ‘দাঁড়াও কিছু খাবার আনি, কিছু রেস্ত বের করো দেখি।’
লোকটা ধীরে ধীরে একে একে তিনটে পকেটের ভেতরকার কাপড় উল্টে দেখালে।
কিছুক্ষণ নিঃসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বেগুন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘মিনি-পয়সায় ইয়ার্কি দিতে এসেছ হারামজাগা চোর।—’
লোকটা নীরবে দাঁড়িয়ে রইল, তার অন্তরের কোনো ভাবই মুখের বিকৃত ভগ্ন আয়নায় প্রতিফলিত হবার সম্ভাবনা ছিল না। বেগুন হতাশ হয়ে একবার তার পকেট ও পয়সা লুকোবার সম্ভব-স্থান নিজে হাতড়ে দেখলে। একটি দেশলাই ও গুটিকতক বিড়ি ছাড়া তার কোনো সম্বল ছিল না।
দাঁতে দাঁত চেপে অসীম অসহায় হতাশায় কপর্দকহীন সেই মূর্তিমান দুঃস্বপ্নের হাত ধরেই বেগুন বললে, ‘চলো—’
এবার তাদের পথে কেউ বাধা দিলে না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন