শৈলেন্দ্র হালদার
বহুদিন পরে আবার ভাই দুটিকে দেখা গেল। আবির্ভাবের মতোই দেখতে পেলাম। গোলদিঘি কফি হাউসের কোণ ঠেসে বসে।
আমিও ওদের কোল ঘেঁষে পাশের টেবিলে গিয়ে বসেছি। আমাকে দেখে হর্ষবর্ধন—ঠিক হর্ষধবনি নয়—অর্ধপরিচিতের মতোই অভ্যর্থনা করল—এই যে!
বলেই আবার ভাইয়ের সঙ্গে মশগুল হয়ে গেল গল্পে।
অনেকদিন পরে দেখা গেল। মনে হল, হয়তো আমায় চিনতে পারেনি ঠিক। কিংবা হয়তো হাড়ে হাড়ে চিনে? নইলে শুধু এই যে—এই শুষ্ক সম্ভাষণ—এত কম ভাষণ নিতান্তই হর্ষবর্ধন- বিরুদ্ধে, কিন্তু ও নিয়ে আর মাথা না-ঘামিয়ে নিজের কফির পেয়ালায় মন দিলাম। আর কান দিলাম ওদের কথায়…।
বুঝলি গোবরা, এরকমের আরেকটা কফিহাউস কাছে চৌরঙ্গির কাছে। কিন্তু সাবধান, সেখানে যেন ভুলেও কখনো যাসনে—।
কেন যাব না কেন? কান খাড়া করা ভাই মাথা চাড়া দিয়েছে কী হয় গেলে?
গেছিস কী মরেছিস। এ কফি হাউস তো ভালো। এখানে তো খালি বাঙালি। বাঙালির ছেলে-মেয়েরাই আসে কেবল। নিতান্ত নিরাপদ। কিন্তু সেখানে—বাবা, যা মারাত্মক!
বলে ভারাত্মক মুখখানা ভাইয়ের চোখের ওপর তিনি রাখেন।
মারাত্মকটা কী শুনি?
মেমরা আসে সেখানে। হর্ষবর্ধন বিশদ হন, মেমরা দেখা দেয়।
দিলেই বা!মেম তো আর বাঘ নয় যে গিলে ফেলবে!
বাঘের বেশি। না-গিলেই হজম করে ফেলতে পারে। তবে আর বলছি কী!…সেদিন একটা মেমের পাল্লায় পড়েছিলাম। ধরেছিল আমায়।
কিচ্ছু না। সবেমাত্র সেখানে ঢুকে একটা খালি জায়গা পেয়ে বসেছি। অত বড়ো হলটা গিস গিস করছে মানুষে। বাঙালি, পাঞ্জাবি, চিনেম্যান সাহেব-মেমে ভর্তি। হলের মাঝামাঝি একটা থাম ঘেঁষে শুধু দুটিমাত্র চেয়ার খালি। একটি ছোট্ট টেবিল নিয়ে—তারই একটিতে গিয়ে আমি বসেছি। একটু পরেই একটা মেম এসে অন্য চেয়ারটায় বসল।
ও এই ধরা!সে তোমাকে ধরবার জন্যে নয় গো দাদা, বসবার আর জায়গা ছিল না বলেই—বলতে যায় গোবর্ধন। নিজের দাদাকে সে ধর্তব্যের মধ্যেই ধরে না।
শোনা না আগে। সবটা শোন তো। হর্ষবর্ধন বাধা দেন—মেমটা বসেই না আমাকে বলল, ‘গুড ইভনিং মিস্টার।’ আমি তার জবাব দিলুম—গুড নাইট মিসেস!
তুমি গুড নাইট বলতে গেলে কেন? গুড নাইট তো বলে লোকে বিদায় নেবার সময়।
তখন কি আর ইভনিং ছিল রে? সন্ধে উতরে গেছে কতক্ষণ!আটটা বাজে প্রায়। আমি শুধু মেমটার ভুল শুধরে দিয়েছি। কিন্তু বলতে কি, আমি অবাক হয়েছি বেশ। মেমরাও ইংরাজিতে ভুল করে তাহলে? আশ্চয্যি!
তারপর? তারপর?
তারপর মেমটা কী যেন বলল ইংরাজিতে, তার একটা কথাও যদি আমি বুঝতে পেরেছি—
নিশ্চয় খুব ভুল ইংরাজি?
ক্যা জানে। তারপর করল কী মেয়েটা। তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা নোট বই বের করল আর ছোটো একটা পেনসিল। কী যেন লিখল কিছুক্ষণ ধরে, তারপরে দেখাল সেটা আমায়!
তুমি পড়তে পারলে?
পারব না কেন, ইংরাজি তো নয়!পেয়ালা!
পেয়ালা? পেয়ালা আবার কোন দেশি ভাষা দাদা?
এই পেয়ালারে বোকা! হর্ষবর্ধন কফির পাত্রটা তুলে ধরেন—এই বাংলা কাপ ডিশ! এই না এঁকে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। যাকে বলে সপ্রশ্ন নেত্রে।
‘তুমি কী করলে?’
আমি বুঝলাম মেমটা এক পেয়ালা কফি খেতে চাইছে! আমিও আর দ্বিরুক্তি না-করে বেয়ারাকে কফি আনতে বললাম, দু-পাত্তর। আমাদের দুজনের জন্যে।
মেমটা দেখতে কেমন?
মেম—মেম। আবার কেমন? মেমরা যেমন হয়ে থাকে। তবে বয়সে বেশি নয়, এই পঁচিশ কি ছাবিবশ। বাঙালির মেয়ের মতো অত সুন্দর না-হলেও দেখতে ভালোই বলতে হবে।
তাই বলো!গোবর্ধন সমঝদারের মতোন ঘাড় নাড়ে . প্রেম করার মতো মেম? তা বলতে হয়।
কী যে বলিস! তোর বউদি যদি জানতে পায়! তারপর শোন। আমি বললাম একটা মেয়েকে কী শুধু কফি খাওয়ানো ঠিক হবে? সেটা যেন কেমন দেখায়। তাই আমি ওর খাতাটা নিয়ে একটা পাতায় টোসটের মতোন কতকগুলো আঁকলাম। এঁকে দেখলাম ওকে। দেখে সে বলল, ইয়েসিয়েস। থ্যাঙ্কু।
ইয়েসিসেস মানে? গোবরা জানতে চায়।
মানে তুই যা করেছিস এখন। হ্যাঁ। দাদা জানায়—ইয়েস মানে জানিসনে বোকা? তারি ডবোল, বুঝেছিস এখন? আর থ্যাঙ্কু মানে—
জানি জানি। বলতে হবে না আর। তাহলে মেমটা তোমার কথায় হি হি করে উঠল বলো?’
করবে না? তারপর মেমটা করল কী, এক জোড়া ডিম এঁকে দেখাল আমায়। বুঝলাম যে টোসটের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ চাইছে। তাও তখন আনতে বললাম বেয়ারাকে।
বাঃ বেশ তো! বলে গোবরা সুরুত করে জিভের ঝোল টানে।
মেমের কথা শুনে যে তোর জিভ দিয়ে জল পড়ছে দেখছি।
মেম নয়। মেমলেটের কথা ভেবে দাদা। মেমটা মেমলট খেতে চাইল না?
ওর ডিম পাড়বার পর তারপর আমি খাতাটা নিলাম। নিয়ে এক প্লেট কাজুবাদাম আঁকলাম। আর ও আঁকল—কতকগুলো চ্যাপটা চ্যাপটা কী যেন। মনে হল পাঁপরভাজা। কিন্তু বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করায় সে বললে পাঁপরভাজা সেখানে মেলে না। আলুভাজা হতে পারে। সে আলুভাজা নিয়ে এল। আর কাজুবাদামও। আলুভাজা পেয়ে মেয়েটাকে খুশি হতে দেখে তখন বুঝলাম যে সে আলুভাজাই চেয়েছিল।
আলুভাজা আর পাঁপরভাজার কী এক চেহারা? গোবরা নিখুঁত চিত্র-সমালোচকের ন্যায় খুঁত খুঁত করে। দুটোর আকার কী একরকম?
তা কী হয়রে? কিন্তু ছবি দেখে কিচ্ছু বোঝবার জো নেই। এই যে মশাই, আপনাকেই বলছি—হর্ষবর্ধন সম্বোধন করেন আমায়—আঁকার বিষয়ে আপনি কিছু জানেন? বলুন তো আঁকতে গেলে এমনটা হয় কেন? পাঁপর ভাজার সঙ্গে আলুভাজা এমন মিলে যায় কেন?
আঁকের বেলায় যেমন একেক সময় মিলে যায় না? তেমনি আর কী। আবার আঁকের মতোই অনেক সময় মেলেও না ফের। ভালো আঁকিয়ে হলে তবেই মেলাতে পারে। এমন ইঁদুর আঁকবে যে মনে হবে যেন হাতি।
আবার উটপাখিকে মনে হবে মুরগি—ওইখানেই আঁকার বাহাদুরি।
কী করে তা হয়ে থাকে? দুই ভাই একসঙ্গে শুধায়। দুজনার মুখে ডবোল ইয়েস দেখা দেয়।
ব্লকের কেরামতি মশাই। আঁকা তো কিছুই না। আঁকিয়ে তো একটুকরো কাগজে ছোট্ট করে একটুখানি আঁকে। যারা ব্লক করে তারাই হচ্ছে ওস্তাদ। তারাই মাথা খাটিয়ে দরকার মাফিক সেইটাকে বাড়িয়ে কমিয়ে যে ছবিটি চাই তার মতোন ব্লক বানিয়ে দেয়। ধরুন, আপনি লিচু এঁকেছেন। কিন্তু আপনার দরকার কাঁঠালের। ব্লকমেকার সেই লিচুকেই বড়ো করে বাড়িয়ে কাঁঠাল বানিয়ে তার ব্লকে আনতে পারে। একই আঁকুনি ছোটো করলেই লিচু আর বড়ো করলেই কাঁঠাল।
ছোটো করলেই লিচু আর বড়ো করলে কাঁঠাল? বারে! গোবরা অবাক হয়।
‘তাহলে আমি যে কাজুবাদাম এঁকেছিলাম, ব্লকওয়ালা ইচ্ছে করলে সেই ছবির থেকেই কুমড়োর ঝুড়ি বানাতে পারত?’
পারতেই তো।
যাকগে, আমাদের শিল্প—তাত্ত্বিক আলোচনায় গোবর্ধন বাধা দেয়। ‘তারপর কী হল বলো না দাদা।’
তারপর অনেক কিছুই খেলাম আমরা—একটিও কথা না-বলে—শুধু কেবল ছবি চালিয়ে। প্রায় টাকা পনেরোর মতো খাওয়া হল। তারপর বেয়ারা বিল নিয়ে এলে আমি একটা একশো টাকার নোট দিয়েছি আর সে ভাঙিয়ে আনতে গেছে এমন সময় দেখলাম কী—মেয়েটা একমনে কী যেন আঁকছে তখনও!
তোমার চেহারা বুঝি? গোবরার মুখে বেয়াড়া হাসি দেখা দেয়।
‘এই চেহারা আঁকা কোনও মেমের কম্মো না। ছোট্ট একটু খাতায় পাতায়। তোর মতো রোগা-পাতলা হলেও হয়তো হত।…আঁকা শেষ করে ছবিখানা সে আমার হাতে দিল। দিয়ে একটুখানি—যাকে বলে সলজ্জ হাসি—হাসল।’
ওর নিজের ছবি বুঝি?
না, দেখলাম একটা খাট এঁকেছে সে।
খাট? খাট কেন? খাট কী কোনও খাবার জিনিস? শোবার তো জানি! গোবরা অবাক হয় ও বুঝেছি, তোমাকে আরো খাবার মতলব ছিল মেয়েটার।
আমি কী মশারি যে আমায় খাটাবে? অত সোজা নয়। হর্ষবর্ধন আপত্তি করেন। কিন্তু কেন যে সে খাট আঁকল তাই আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম।
কীরকম খাট? দুগ্ধফেননিভ? আমি শুধাই।
বেশ বড়ো খাট। খাট যেমন হয়ে থাকে। কিন্তু সেজন্য না, আমার তাক লাগাল এই ভেবে যে, আমি যে খাটের জন্মদাতা, কাঠের ব্যাবসা যে আমাদের, তা সেই মেয়েটা টের পেলে কী করে? এর রহস্য আমি ভাই এখনো অব্দি বুঝতে পারিনি। থ হয়ে রয়েছি সেই থেকে—রহস্যের থই না-পেয়ে, বুঝছেন মশাই!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন