শোনো, দশ নম্বর বিপদ সংকেত দিয়েছে। তুমি আজ কিছুতেই ঘরের বাইরে যাবে না। কেয়া আমার গতিবিধির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল।
উদবিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, একটু আগেই শুনলাম আট নম্বর, দশ হল কখন?
কেয়া বলল, এই মাত্র রেডিওতে শুনেছি। ঘূর্ণিঝড় এগুচ্ছে আর বিপদ সংকেত বাড়ছে।
সায়মা কোথায়?
ও ঘরে পুতুল খেলছে।
জানালাগুলো ভালো করে বন্ধ করেছ?
আমি দেখছি। তুমি বের হয়ো না কিন্তু।
আমার তো একটু বের হতেই হবে। লঞ্চটা ঠিকমত ঘাটে বেঁধে না রাখলে ডুবে যেতে পারে।
তোমার কর্মচারীদের সেরকম নির্দেশ দিলেই তো পারো।
তবুও নিজে গিয়ে একবার দেখে আসা ভালো।
কেয়ার মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ পড়ল, তোমাকে নিয়ে হচ্ছে এই সমস্যা। সবকিছু নিজে করতে চাও। ঠিক আছে, যাচ্ছ যখন যাও, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, ঝড় আসতে এখনও অনেক দেরি, কমপক্ষে ঘন্টা দুয়েক।
কেয়া ঘুরে দাঁড়াল, দেখি জানালা দরজাগুলো ঠিকমত বন্ধ আছে কি না।
কেয়া আমার অফিস রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি দেখলাম ও ফুলে ফুলে ছাওয়া লনটা পেরিয়ে বাংলোতে ঢুকল। চমৎকার ব্রিটিশ প্যাটার্নের বাংলো। ঘন অরণ্যের গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে অপার্থিব আলোছায়ায় বাংলোটি দেখতে অপূর্ব লাগছে। জঙ্গলের মধ্যে ফরেস্ট অফিসারের বাংলো আর অফিস কাছাকাছি হওয়ায় খুব সুবিধে হয়েছে। কেয়াকে খুব একটা একা একা দিন কাটাতে হয় না। নইলে এ নির্জন অরণ্যে মানসিকভাবে খাপ খাওয়াতে ওর খুব কষ্ট হত। আশ্চর্য, আমি নিজের কথা ভাবতে ভুলে গেছি। কেবল কেয়ার কথাই ভাবছি। আমাদের দশ বছরের বিবাহিত জীবনে ওর প্রতি আমার আকর্ষণ একটুও কমেনি। ওকে গভীরভাবে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। এখনও নেশা কাটেনি। শুধু আমি কেন এখনও কেয়ার প্রতি অনেক পুরুষেরই আকর্ষণ রয়েছে। ও শুধু সুন্দরী আর শিক্ষিতাই নয়, ওর কথা বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু আছে যা পুরুষকে আকর্ষণ করে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেয়ার চারপাশে ওরা কেবল ঘুরে বেড়ায়। কেয়াও নিজেকে রহস্যের আড়ালে ঢেকে রাখতে পছন্দ করে। বিশেষভাবে কাউকে প্রশ্রয় না দিলেও তাদের সুখদুঃখগুলো ভাগ করে নেয়। কেয়ার পুরুষ বন্ধুরা অনেক সময় ওকে ভুল বোঝে। এতে করে ওর খুব একটা যায় আসে বলে মনে হয় না। কেয়াকে নিয়ে আমি সব সময় টেনশানে ভুগি। জানি সে আমায় কখনও ছেড়ে যাবে না। আমার মতো করে কেউ তাকে ভালোবাসবে না, আমাকে ছাড়া সেও কাউকে ভালোবাসবে না। তবুও কেন জানি একটা আশঙ্কা সবসময় মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এখানে আসার পর কেয়ার ছেলেবন্ধুরা আর ভিড় করে না। আমার আশঙ্কাও অনেকটা কেটে গেছে। কেয়া এখন শুধু আমার—একান্তই আমার। কেয়া ছাড়া আমি আমার নিজের জীবন কল্পনা করতে পারি না। আর আমাদের ভালোবাসার ফসল ছোট্ট সায়মা। সে আমার বুকের সবটুকু দখল করে রয়েছে। আশ্চর্য, ওইটুকু মেয়ের কী সাহস! কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ গালে চড় বসিয়ে দেয়। এরই নাম কি সুখ? জীবনে এর বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?
ফোনটা বিশ্রী শব্দ করে বেজে উঠল। ধরতে যাব ঠিক সে সময় রিং থেমে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। চারদিকে থমথমে পরিবেশ। অদূরে গাছপালা সব থমকে দাঁড়িয়ে ঝড়ের প্রতীক্ষা করছে। একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের আভাস পেলাম।
ফোনটা আবার বেজে উঠল। রিসিভার তুলে বললাম, হ্যালো? ফিরোজ সাহেব বলছেন? অপর প্রান্তে মেয়েলি কণ্ঠস্বর।
হ্যাঁ, কথা বলছি।
আপনি কি এখানকার ফরেস্ট অফিসার?
হ্যাঁ, আপনি কে কথা বলছেন?
এতদিন পর আমাকে কি আপনি চিনতে পারবেন?
গলার আওয়াজ চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কী রহস্যময় সংলাপ? কৌতূহল বেড়ে গেল, সত্যি বলছি চিনতে পারছি না।
চিনতে পেরেও না চেনার ভান করছেন না তো?
কে আপনি?
কণ্ঠস্বরের অধিকারিণী যেন হেঁয়ালি করতে ভালোবাসে, আমাকে কিন্তু একসময় তুমি বলে সম্বোধন করতেন।
খানিকটা বিরক্ত ভাব দেখিয়ে বললাম, আমার স্মরণশক্তি আপনার মতো প্রখর নয় স্বীকার করছি, এবার যদি হেঁয়ালি রেখে নিজের পরিচয় দেন তাহলে খুশি হব।
আপনাকে বলেছি না আমাকে তুমি—
ঠিক আছে এবার বল তুমি কে?
মেয়েটা যেন আমার কথা শুনছে না, আপন মনে বলে যাচ্ছে, আজকের সন্ধেটা কী সুন্দর তাই না? ঝড় আসবে আসবে করছে। জানেন, এক-সময় আমি ঝড়কে খুব ভয় পেতাম, এখন আর পাই না। এখন বরং এরকম সময়ে বাইরে বেরিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
আমি একটু নার্ভাস হয়ে পড়লাম, এ কোন পাগলির পাল্লায় পড়লাম। কী সব অদ্ভুত কথাবার্তা বলছে কঠিন স্বরে। বললাম, কে তুমি?
রিসিভারের অপর প্রান্তে মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, ভয় পাচ্ছেন আমাকে? আপনার কি মনে আছে সেই বৃষ্টিভেজা রাতের কথা? সেদিন আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। চারদিকে ঘন অরণ্য, দূরে শেয়ালগুলো ডাকছিল, টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। আদিম অরণ্যের চেয়ে আমি আপনাকেই বেশি ভয় পেয়েছিলাম। উঃ! কী ভয়াবহই না ছিল সে রাত! আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাত। ভোরবেলা যখন বেরিয়ে এলাম আপনার ফরেস্ট বাংলো থেকে সামনে একটা কামিনী গাছের দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম। থোকা থোকা সাদা ফুল ভরে ছিল গাছের নীচটা। শীতে কাঁপছিলাম আমি। কান্নায় ভেঙে পড়ছিল আমার দেহ আর মন। পেছনের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমাকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলেছিলেন। আপনার ভয় ছিল কেউ যদি আবার দেখে ফেলে।
মেয়েটির কথা শুনে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছিল। এত বছর পরে এ-কার কণ্ঠস্বর? আমি তো প্রায় ভুলেই গেছিলাম—হ্যাঁ, এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে। ও কামিনী গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। আমি ভাবছিলাম কী বিপদ, ও চলে যাচ্ছে না কেন? প্রচণ্ড টেনশন নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আর ভাবছিলাম কত শিগগির ও বিদায় নেবে। বলা যায় না কখন কে এসে পড়ে!
আমার এক বন্ধুর জীবনে এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। মেয়েটি সাগ্রহে রাজি হয়ে ওর ফ্ল্যাটে এসেছিল। পরে লোকজন জড়ো করে এমন হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তাকে ওই মেয়েটিকে বিয়ে করতে হয়েছিল। এজন্য এ ধরনের লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা করা মাঝে মাঝে খুব বিপজ্জনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। জাতে ওঠার জন্য ওরা যে-কোন ধরনের নোংরা কৌশল খাটাতে পেছপা হয় না।
ভাবতেই আমার সমস্ত শরীর কেমন যেন করে উঠল। কী সর্বনাশ এরা আমাকে এরকম কোন ফাঁদে ফেলে আবার জোর করে বীথির সঙ্গে বিয়ে দেবার চেষ্টা করবে না তো?
অসম্ভব, সে আমি কিছুতেই হতে দিতে পারি না। বীথি কী করে আমার বউ হবে? ওর কী যোগ্যতা আছে যে আমার জীবন-সঙ্গিনী হবার মর্যাদা পেতে পারে? তাছাড়া ওর আর আমার মানসিকতায় অনেক ব্যবধান। ও কি পারবে আমার অনুভূতিগুলো বুঝতে? ওর সঙ্গে কথা বলারই বা কী থাকতে পারে?
ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। বীথি সেদিন আমাকে সেরকমভাবে কোন ফাঁদ পেতে ধরার চেষ্টা করেনি। মেয়েটিকে সেজন্য আমার ভালোই লেগেছিল। একেবারে সরল সহজ মেয়ে।
কী ব্যাপার চুপ করে আছেন কেন? ফোনের অপর প্রান্তে মেয়েটির কণ্ঠস্বরে বিদ্রুপ ঝরে পড়ল। আমাকে চেনার আগ্রহ এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল আপনার।
আশ্চর্য, এত সুন্দরভাবে কথা বলার ছলাকলা ও কীভাবে শিখল। এ সত্যিই কি বীথি না অন্য কেউ? কিন্তু ও না হলে এসব কথা জানলই বা কী করে? সত্যি সত্যিই বীথি বলে মনে হচ্ছে।
চাপা গলায় বললাম, বীথি তুমি হঠাৎ এতদিন পর, কী মনে করে?
বীথি হাসল। বলল, যাক বাঁচা গেল, চিনতে পেরেছেন তাহলে। প্রয়োজন আছে তাই ফোন করেছি।
আমার কাছে তোমার কী প্রয়োজন?
সেটা আমি সামনা-সামনি দেখা হলেই বলব।
সামনা-সামনি মানে?
সহজ কথাটা আপনার কাছে এত জটিল মনে হচ্ছে কেন? সামনা-সামনি মানে আমি এখনই আসছি।
আমি চমকে উঠে বললাম, কোথায় আসছ?
বীথি সহজ গলায় বলল, কেন আপনার অফিসে।
আমার অফিসের খোঁজ পেলে কী করে?
সেটা জানা কি খুব কঠিন? আপনার বাংলোর পাশেই ছোট্ট ছিমছাম অফিস রুম। আপনার সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে আর স্ত্রী যেখানে রোজ বিকেলে লনে বসে থাকে তার কাছাকাছি—
কী সর্বনাশ! এ যে দেখছি ভেতরে ভেতরে সব খবর নিয়েছে। তুমি এতসব জানলে কী করে?
খবর নিয়েছি।
কী চাও তুমি আমার কাছে?
বীথি মিষ্টি করে উত্তর দিল, এতদিন পর কথা হল, কেমন আছি জিজ্ঞেস করবেন না?
ন্যাকামো দেখে গা জ্বলে গেল। ওসব ফালতু কথা রাখো। কী চাও স্পষ্ট করে বলো।
কিছু নিশ্চয়ই চাই। কী চাই তা সামনা-সামনি বলব। আপনি অফিসে আমার জন্য অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।
এখন ঝড় আসছে, আমি বাড়ি যাব।
বীথির গলার স্বরে হাসির আভাস, আমি কি তবে আপনার বাড়িতে আসব?
শোনো, বীথি, সত্যি করে বলো তো কী চাও।
এই মুহূর্তে চাই আপনি অফিসে থাকুন।
আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়।
আমি জানি অফিসে বসে আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। যাকগে, অন্ধকার হয়ে আসছে আমি আর দেরি করতে চাই না—আসছি।
লাইনটা কেটে গেল। আমার হাতে তখনও রিসিভার। হঠাৎ প্রচণ্ড একটা দমকা বাতাসের ঝাপটা টিনের চালটা কাঁপিয়ে ঝড়ের আগমনী সংবাদ জানিয়ে দিয়ে গেল।
বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আবার নিঃস্তব্ধ হয়ে গেছে প্রকৃতি। অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। অদূরে অরণ্যের বুকে ঘুটঘুটে অন্ধকার দানা বেঁধে উঠেছে। বীথি কি সত্যিই আসবে? কী চায় ও? হঠাৎ এই ঝড়ের রাতে ও কেন দেখা করতে চায় আমার সঙ্গে?
সেই বীথি। নিষ্পাপ চেহারার পনেরো-ষোলো বছরের শ্যামলা মেয়েটি। ঘন কালো অসহায় দু-টো চোখ, কোঁকড়ানো চুল, দুর্বার বন্য আকর্ষণ ওর দেহের খাঁজে। দেখা মাত্র আমার রক্তের শিরায় শিরায় আগুন জ্বলে উঠেছিল। তখন সদ্য ফরেস্ট অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছি। পাহাড়ি এলাকায় ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গলের মধ্যে ছিল আমার অফিস কাম বাংলো। বীথি এসে দাঁড়িয়েছিল মিনতি-ভরা চোখে। আমার বাবা দুশ্চিন্তা করে করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শুধু আপনিই তাঁকে বাঁচাতে পারেন স্যার। আমার চোখ দু-টো তখন বীথির শরীরের অসমতল উপত্যকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কী দরকার আমার এসব সমস্যার কথা শুনে। আমার মধ্যে ভোগের বাসনা তখন তীব্র হয়ে উঠেছে। বললাম, তোমার বাবা কর্তব্যে তো অবহেলা করেছে। ঠিকমত গার্ড দেয়নি। বন থেকে ওই রাতে অনেক কাঠ চুরি গেছে।
বিশ্বাস করুন স্যার। আমার বাবা সে সময় অসুস্থ ছিলেন।
এসব ফালতু অজুহাতে কাজ হবে না। কাঠগুলো কেন চুরি হল সে রিপোর্ট আমাকে পাঠাতে হবে। তোমার বাবার গার্ড দেওয়ার কথা, তার ওপর সমস্ত দায়ভার চাপবেই।
স্যার আপনি আমাদের বাঁচান, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন তখন তিনি সত্যি অসুস্থ ছিলেন কি না।
আমি প্যাঁচ কষতে থাকলাম।
যদি অসুস্থই ছিলেন তা হলে অফিসে খবর দেননি কেন? ওর জায়গায় অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতাম।
স্যার, আপনিই বলুন কাকে দিয়ে খবর পাঠাবেন? ঘরে আমার ছোট্ট দু-টো বোন আর পঙ্গু মা।
কী মুশকিল, সেই দারিদ্র্যের প্যানপ্যানানি। এই উঠতি যৌবন ভরা মেয়ের মুখে এসব কথা কি মানায়? আমি এখন ওর সঙ্গে অন্য কথা বলতে চাই। মেয়েটিকে কী করে মনের বাসনা প্রকাশ করা যায়? একটু স্নেহ ভরা কণ্ঠে কথা বলব? ওর বাবাকে রেহাই দিলে কৃতজ্ঞতায় সে কি নিজেই এসে ধরা দেবে? নাকি সময় নষ্ট না করে সরাসরি প্রস্তাব দেব? চিড়িয়া এখন আমার হাতের মুঠোয়, ওকে আমি যে প্রস্তাব দেব ওর না মেনে উপায় নেই। সমস্যাটা হচ্ছে কীভাবে অগ্রসর হব। সরাসরি বললেই বা ক্ষতি কী? ও তো আর অভিজাত ঘরের লেখাপড়া জানা মেয়ে নয়, যে সে কী ভাবল না ভাবল তাতে আমার কিছু আসবে যাবে? ও হচ্ছে স্রেফ একটা ভোগের সামগ্রী। দাম দিয়ে কিনে নেব। ওর বাবাকে যে অভিযোগে বরখাস্ত করেছি সেটা প্রত্যাহার করা আমার কোনো ব্যাপারই নয়। কিন্তু বিনিময়ে বীথিকে আমার চাই।
স্যার।
চমকে ফিরে তাকালাম। বললাম, ও রঘুবীর?
হ্যাঁ স্যার, খুব ঝড় আসছে। আপনি বলছিলেন লঞ্চটা ঠিকমত ভেড়ানো হয়েছে কিনা দেখতে যাবেন।
হ্যাঁ, চল। না থাক। শোনো, এখানে একজন আসবে, এখন আমি যেতে পারব না।
এই ঝড়ের মধ্যে কে আসবে?
না, আমি আসলে বলতে চাইছি এই সময় আমার অফিস ছেড়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কখন কে আসে বলা যায় না। বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন রকমের সমস্যা থাকতে পারে। আর শোনো, তুমি গিয়ে লঞ্চটা ভালোমত দেখে বাড়ি চলে যাও।
আমি বরং আপনাকে যাবার সময় খবর দিয়ে যাব।
না, প্রয়োজন নেই। আমি একটু পরেই বাসায় যাব। শরীরটা ভালো লাগছে না। তুমি লঞ্চটা দেখেশুনে সোজা বাড়ি চলে যাও।
ঠিক আছে স্যার।
রঘুবীর চলে গেল। ভালোই করেছে। একটু খুব জরুরি কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেছে। এখন যেভাবেই হোক কেয়ার অফিসে আসা ঠেকাতে হবে। এমনিতে ও সহজে আসে না, কিন্তু এই ঝড়ের কারণেই বোধ হয় আজ সন্ধ্যায় এসেছিল।
বীথি আসছে, এমন সময় যদি কেয়া এসে পড়ে। কী বলব? অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, কিন্তু এই ঝড়ের রাতে কেন? কেয়ার একটা সিকস্থ সেনস আছে। ওর সেই সেনসটা এত প্রবল যে সব কিছু চোখের দিকে তাকিয়েই যেন বুঝে ফেলে। আমার দিকে তাকিয়ে ও সব বুঝে ফেলবে না তো? ও যে রকম অভিমানী আর আদর্শবাদী মেয়ে, কিছু একটা আঁচ করলে সারা জীবনের জন্য ওর সঙ্গে এই সুন্দর সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাবে। অসম্ভব, কিছুতেই সেটা হতে দেওয়া যাবে না।
কেয়ার কাছ থেকে ব্যাপারটা কীভাবে আড়াল করা যায়। বীথি আর সময় পেল না, আজ রাতে না এলে কি তার চলত না? দিনেরবেলা হলে সহজে কিছু একটা অজুহাত দাঁড় করানো যেত।
বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই আর একটা দমকা বাতাস বয়ে গেল। বাতাসের বেগ কেবলই বাড়ছে। গাছের ডালপালা সজোরে দুলছে। কেয়া বেতের চেয়ারে বসে দূরে বনের দিকে তাকিয়েছিল। আমার ডাকে ফিরে তাকিয়ে বলল—
যাক, তুমি বাইরে যাওনি। যা চিন্তায় ছিলাম।
না, বাতাসের বেগ বাড়ছে। এ সময় বেশি দূরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। তবে আমার অফিসে আরও কিছুক্ষণ থাকতে হবে।
এ সময়ে অফিসে আবার কেন?
এখনই তো অফিসে থাকা উচিত। টেলিফোনে কখন কী জরুরি ম্যাসেজ আসে। তুমি বরং ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে সায়মার কাছে থাকো। ও ভয় পেতে পারে।
বাতাস বাড়লে তুমি অফিসের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিও।
ঠিক আছে আমাকে নিয়ে অযথা চিন্তা করো না।
হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে তো?
ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি যাচ্ছি—
আমি লনে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম।
গার্ডকে সঙ্গে রেখো বুঝলে। কেয়া পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল।
ওর কন্ঠে মমতার ছোঁয়া। মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। মা যেমন করে আমাকে বেঁধে রাখতেন তাঁর স্নেহ, মমতা, উৎকণ্ঠা আর ভালোবাসা দিয়ে, কেয়া অনেকটা সেরকম। কেয়াকে ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন। কেয়াই আমার অস্তিত্ব, আমার সবকিছু। আমার কাছে সে হচ্ছে আলটিমেট ওম্যান। বীথির মধ্যে কী ছিল? শুধু তীব্র আকর্ষণ যা কেবল শরীরকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায় আর শরীরের চাহিদা মিটে গেলে ফুরিয়ে যায়। একটা আদিম উন্মাদনা। অথচ কেয়া ও আমার ভালোবাসার স্বরূপ অন্যরকম। আমরা একে অপরকে বেশ বুঝতে পারি, সুখদুঃখগুলো ভাগাভাগি করে নিতে পারি।
বীথিকে আমি শুধু কামনার ভোগ্যবস্তু হিসেবে চেয়েছিলাম। সে রাতে সামন্তপ্রভুর মতো তার সঙ্গে আচরণ করেছিলাম আর দাসীর মতো তাকে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। প্রয়োজন মিটে যাওয়ার পর তার কথা মনে রাখিনি। এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। আজ হঠাৎ এতদিন পর সে কেন আসতে চাইছে?
আমি কি বীথির জন্য অপেক্ষা করব?
মেয়েটার নিষ্পাপ চোখ দুটো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। জীবন সম্পর্কে তখনও ওর কোনো কঠিন অভিজ্ঞতা হয়নি। নইলে সে রাতে আমার নির্দেশ পালন করে বাড়িতে এসে এত কাঁদছিল কেন? আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, শোনো, এতে এত কান্নাকাটির কী আছে? এটা পৃথিবীর নিয়ম। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়।
আমি বাজে মেয়ে নই।
তবে এলে কেন? আমি তো তোমাকে জোর করিনি।
আমার বাবার চাকরিটা চলে গেলে আমরা না খেয়ে মারা যাব।
তাহলে মনে করো যে তুমি একটা মহৎ কাজ করেছ। পুরো পরিবারটাকে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করেছ। বীথির চোখে তীব্র ঘৃণার দ্যুতি খাঁচাবন্দি পশুর মতো ফুঁসে উঠে। হঠাৎ বলল, আপনি আমাকে অসহায় পেয়ে এখানে আসতে বাধ্য করেছেন। আমি কখনও ভুলব না।
বা চমৎকার কথা শিখেছ দেখছি। লেখাপড়া কিছু জান মনে হচ্ছে। স্কুলে গেছ কখনও? বীথির চোখে জল। কিন্তু কণ্ঠস্বর ঝাঁঝাল।
ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি।
তোমার বাবা যাতে খুব শিগগির চাকুরিতে জয়েন করতে পারেন তার ব্যবস্থা করছি।
আমার তো সব কিছু শেষ হয়ে গেল।
মনে মনে বিরক্ত হলাম, যত সব অসুস্থ মানসিকতা।
আবার একটা বাতাসের ঝাপটা সরাসরি মুখে এসে আঘাত করল। সমস্ত বনভূমির উপর দিয়ে একটা সোঁ সোঁ আওয়াজ বয়ে যেতে থাকল। বীথি আসছে না কেন এখনও? ও কি সত্যিই আসবে নাকি মিছে মিছে ভয় দেখাচ্ছে? ও না এলে বেঁচে যেতাম। ঝড়ের জন্য ও যদি আটকা পড়ে তাহলে ভালোই হয়। সেই মাদকতাময় বীথি কি আগের মতোই আছে, নাকি বদলে গেছে? দুটো চোখ আর অপরূপ লাবণ্যময় মুখশ্রী এখনও কি সেরকম আছে? ওর মধ্যে যে বন্যতা, আদিমতা আর উচ্ছলতা দেখেছি সেটা কি আজও আমার মধ্যে যে পশু ঘুমিয়ে আছে তাকে জাগিয়ে দেবে? তাহলে তো আরও বিপদ দেখছি।
আচ্ছা, কেয়া তো বাংলোর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সন্ধ্যার অন্ধকার যে রকম ঘনিয়ে এসেছে বীথি এলেও তাকে দেখা যাবে না। এই নির্জনে বীথির সঙ্গে আজও যদি চমৎকার কিছু সময় কাটাই তাতে কী আসে যায়? জীবনের সুন্দর আনন্দময় মুহূর্ত সচরাচর আসে না। সেটা যখন নিজেই হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিচ্ছে আমি সে সুযোগের সদব্যবহার করব না কেন?
এতে তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, তবে? না কেয়াকে এভাবে ধাপ্পা দেওয়া ঠিক হবে না। ও যদি জানতে পারে, তাহলে আমার সাজানো সংসার তছনছ হয়ে যাবে। এতবড়ো রিক্স নেওয়াটা ঠিক হবে না। বাতাসের তীব্র ঝটকায় একগাদা ধুলো আর শুকনো পাতা উড়ে এল।
ঝড়ের বেগ ক্রমেই বাড়ছে। বাতাসের ঝাপটা বার বার মুখে এসে আঘাত হানছে। খোলা দরজাটা সশব্দে বাড়ি খাচ্ছে। আর বাইরে অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলাম। বাইরে বাতাসের একটা অদ্ভুত শন শন শব্দ ক্রমেই জোরাল হয়ে উঠছিল। খুব শিগগিরই ঝড় আঘাত হানবে। দরজায় কিসের যেন শব্দ। বাতাসের ঝাপটা? না, সেরকম শব্দ নয় , কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।
তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিলাম। অন্ধকারে একটা নারীর অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি চোখে পড়ল। বাতাসে আঁচল দুলছে, তার অবিন্যস্ত চুলগুলো উড়ছে। ইতিমধ্যে বাতাসের বেগ বেশ বেড়েছে। বাইরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বীথি ঢুকতেই দরজাটা ভেতর থেকে আবার বন্ধ করে দিলাম। হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিয়ে এই প্রথম ওর দিকে তাকালাম। পর মুহূর্তে ভয়ানক চমকে উঠলাম। এই কি সেই বীথি? কোথায় সেই নিষ্পাপ লাবণ্যময় মুখ? এ কোন বীথি, একে তো আমি চিনি না। এর চেহারায় ছাপ পড়েছে আদিম পেশায় রত কোনো এক নারীর। কোথায় সেই লাবণ্য, কোথায় সেই নিষ্পাপ দৃষ্টি আর কোথায় বা সেই তীব্র বন্য আকর্ষণ? আমার সামনে যে বীথি বসে রয়েছে সে যেন এক স্থূলতার প্রতিমূর্তি। একটা জরির পাড়ের টুকটুকে লাল রঙের সস্তা শাড়ি পরনে। চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, হাতে একটা রঙচটা ঝোলানো ব্যাগ। সর্বাঙ্গে অপরিসীম ক্লান্তির ছাপ। এ কে? কেন এসেছে আমার কাছে? কী চায় ও? না, ওর সঙ্গে খুব অন্তরঙ্গ হওয়া চলবে না। ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে, ওর উপস্থিতি বা সান্নিধ্য আমার কাছে কাম্য নয়।
মুখে যথাসম্ভব বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলে জিজ্ঞেস করলাম, এত ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কী মনে করে এখানে এসেছ?
বীথি হাসল। কী কুৎসিত হাসি! বলল, কালই ফিরে যেতে হবে। তাই ঝড়বৃষ্টির পরোয়া করলে আমার চলে না।
কী এমন জরুরি ব্যাপার শুনি?
খুব সমস্যায় পড়েছি। আজকাল আর আগের দিন নেই। বুঝতেই পারছেন এই ব্যবসায় রূপ যৌবন সম্বল। এখন রূপে ভাটা পড়েছে, টাকা কামানো খুব মুশকিল।
ব্যঙ্গ করে বললাম, খুব ভালোই আছ মনে হচ্ছে। এই ব্যবসায় তো খাটুনি নেই।
বীথি শ্লেষের হাসি হেসে বলল, এ ব্যবসায় তো আপনিই আমাকে নামিয়েছিলেন। সেদিন থেকে আপনি আমার ওস্তাদ, নমস্য ব্যক্তি।
আমি হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।
আমি? আমি আবার কখন তোমাকে এসব—
আপনি আমার প্রথম গ্রাহক। তবে কাইন্ডে পেমেন্ট করেছিলেন, ক্যাশে নয়। তাই তো আপনার কাছেই আমার হাতেখড়ি।
কী আশ্চর্য! বীথির মুখে এ কী ভাষা, এত কথা সে শিখল কোথা থেকে? এর সঙ্গে সতর্কভাবে কথা বলতে হবে দেখছি। বললাম, ব্যবসায় তাহলে ভাটা পড়েছে। তা আমি কী করতে পারি?
বীথি কি তার প্রতি আমার বিতৃষ্ণা টের পেয়েছে, নাকি আমার কথাবার্তার ধরন ওর ইগোতে লেগেছে। তাচ্ছিল্য ভরে বলল, টাকার অভাব না হলে কি আপনার মতো লোকের কাছে আসি?
আমার সমস্ত শরীরের রক্ত গরম হয়ে উঠল। কী বললে? আমার সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলার সাহস তুমি পেলে কী করে?
সে সাহসটা আপনার কাছেই পাওয়া।
আমার কাছে?
হ্যাঁ, আপনিই। এবার শুনুন লেনদেনের খেলায় কিছু পেতে চাইলে কিছু দিতে হয়, তাই না?
স্পষ্ট করে বলো তুমি কী চাও?
আমার আপাতত হাজার দশেক টাকা হলেই চলবে। অবশ্য এরপর প্রয়োজন হলে যে আসব না সেরকম কথা দিচ্ছি না। এর মানে কী দাঁড়ায় তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমিও আপনার মতো স্পষ্ট কথা বলতে ভালোবাসি।
মাই গড! ব্লাক-মেইল। সেই অতীত জীবনের ক্ষণিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বীথি এসেছে এতদিন পর আমাকে ব্লাক-মেইল করতে? ও যদি একবার আমাকে মুঠোর মধ্যে ধরতে পারে তাহলে আর নিষ্কৃতি নেই। একদম ফতুর করে ছাড়বে। একবার এ ফাঁদে পা দিলে আর রক্ষা নেই। বিদ্রুপের হাসি হেসে বললাম, পাগল হয়েছ নাকি, তোমাকে আমি কেন টাকা দিতে যাব? তোমার কাছে আমার আর কী পাওয়ার আছে?
আপনি নিজের কথাটাই চিন্তা করেন। এর বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না। দাবার ছক যে বদলে গেছে সেটা বোঝার ক্ষমতাও দেখছি আপনার নেই।
ও এমনভাবে কথা বলছে যেন আমি একটা আস্ত গবেট। রাগে সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করল। কিন্তু না, এখন মাথাটা ঠান্ডা রাখতে হবে। কী বলতে চাও তুমি?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে অনেকটা এরকম—আপনার প্রয়োজনে আজ আমি আসিনি, এসেছি আমার নিজের প্রয়োজনে।
কেন আমি তোমার প্রয়োজনের কথা ভাবব?
কারণ সেদিন রাতে আমি আপনার প্রয়োজন মিটিয়েছিলাম।
সেটা ছিল কিছু একটা পাওয়ার বিনিময়ে।
সেদিন আমি ছিলাম অসহায় আর আপনি তার সুযোগ নিয়েছিলেন। আজ আপনি অসহায় আর আমি ফায়দা লুটতে এসেছি।
আমি অসহায়। তোমার কি মাথা ঠিক আছে?
বীথি বাংলোর দিকে মুখ করে ঘুরে বসল। তারপর কদর্যভাবে হেসে বলল, আপনার বউ আর মেয়েটা খুব সুন্দর। আপনাকে দেখলে সত্যিই হিংসে হয়। কী সুখী পরিবার! আর আমার কথা একবার ভাবুন। নিয়তির কী অবিচার! এই ঝড়বৃষ্টি পেরিয়ে স্রেফ টাকার ধান্দায় আপনার মত জঘন্য একটা লোকের কাছে এসেছি। কত কলা কৌশল খাটিয়েই না টাকা আদায়ের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।
আমার বুকের ভেতরটা কাঁপছে। মুখে সাহস দেখিয়ে বললাম, আমার স্ত্রী তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।
বীথি রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল। ও জানে পরিস্থিতি ওর হাতের মুঠোয়। ঠিক আছে ওঁকে বলে দেখি।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বীথির মুখে এসব কী শুনছি! মনে হয় এসব নোংরা কাজে থেকে আর অনেক লোকের সংস্পর্শে এসে এ শ্রেণির মেয়েরা এ ধরনের হঠকারী কথাবার্তা বলতে শেখে। এ বীথি আর সে বীথি নেই। খুব কৌশলে মোকাবেলা করতে হবে এর সঙ্গে। বললাম, এত টাকা আমার কাছে নেই। খুব বেশি হলে তোমাকে এক হাজার টাকা দিতে পারি।
বীথি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল, আপনার মতো গণ্যমান্য লোকের পক্ষে এত কম দেওয়াটা তো অসম্মানজনক ব্যাপার। ঘরের দরজাটা সশব্দে কেঁপে উঠল। বাইরে ঝড়ো হাওয়ার সোঁ সোঁ গর্জন শুরু হয়েছে। বাতাস ধীরে ধীরে মাতাল হয়ে উঠছে। এক আদিম ইচ্ছা আমার মাথায় চাড়া দিয়ে উঠল। এই ঘৃণ্য, কুৎসিত মেয়েলোকটার হাত থেকে যেমন করেই হোক আমার রেহাই পেতে হবে। কিন্তু কীভাবে? আচ্ছা টাকাটা দিতে যদি রাজি না হই? বলা যায় না সেক্ষেত্রে ও হয়তো ঘটনাটা অফিসের লোকজনের কাছে ফাঁস করে দিতে পারে। এর কোনো মান সম্মান জ্ঞান নেই। যা খুশি তাই করতে পারে, যত খুশি তত নীচে নামতে পারে। এটা তো ওর মূলধন। এতবড়ো একজন অফিসারের এককালের শয্যাসঙ্গিনী হবার মতো গর্বের বিষয়টা কি ও চেপে রাখবে? ছি, ছি, সেক্ষেত্রে অফিসে সবার চোখে আমি কী নীচুতেই না নেমে যাব! ওরা আমাকে এত শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তাছাড়া কেয়া ওদের চোখে করুণার পাত্রী হয়ে দাঁড়াবে। কেয়া আমার ভালোবাসা, আমার স্ত্রী, আমার কন্যার মা—ওকে আমি কিছুতেই এরকম একটা অসম্মানজনক অবস্থানে নামাতে পারি না। কিন্তু বীথি যদি সত্যি সত্যিই সুযোগ বুঝে কেয়ার কাছে গিয়ে হাজির হয়? ওর যা ভাবভঙ্গি তাতে মনে হয় ওটাই সে করবে। অসম্ভব, এ আমি হতে দিতে পারি না, কিন্তু এখন আমি এর হাতের মুঠোয় ধরা পড়েছি। ও আমাকে নিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন খেলতে পারে। একেবারে নিঃস্ব, রিক্ত করে ছেড়ে দিতে পারে। কীভাবে এর হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি? বার বার একটা অলক্ষুণে চিন্তা মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে শুরু করল। আমার মাথায় এ কী ভয়াবহ চিন্তা উঁকি দিচ্ছে? নিজেকে সামলে নিলাম। না, না, এ হতে পারে না। কিন্তু এছাড়া আমার তো আর অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই, সারাজীবন কি এর হাতে বন্দি হয়ে থাকতে হবে? আমার সুখের সাজানো সংসার, সামাজিক সম্মান সব ধুলোয় লুটোবে? এ আমি হতে দেব না। এটা তো মোক্ষম সময়। এত চমৎকার সুযোগ আর হয়তো কখনও আসবে না। আজ ঝড়ের রাতে সবাই ঘরে রয়েছে। এ সময় আমি যা করি না কেন কারও দেখে ফেলার ভয় নেই। এখনই সুবর্ণ সুযোগ। এ সুযোগ হাতছাড়া করা বোকামি হবে। তবে ও যাতে টের না পায় সেজন্য ওর সঙ্গে এক ধরনের খেলা খেলে যেতে হবে। ওর মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলে বললাম, টাকা নেওয়ার পরেও যে তুমি আমার স্ত্রীকে বলে দেবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? তোমার বাবার সব ঝামেলা মিটিয়ে দিয়েছিলাম।
ওটা যে এমন কিছু বিরাট ব্যাপার ছিল না, এখন তা আমি বুঝি। আপনি স্রেফ প্যাঁচে ফেলে আমাকে—
অবশ্যই ছিল, ওকে ইচ্ছে করলে আমি চুরির কেসে ফাঁসিয়ে দিতে পারতাম।
বীথি এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমি একটা ঘৃণ্য জীব। সেটা করলে অন্যায়ভাবেই করতেন। আর এ রকম কথা যদি আপনি বলেন তাহলে আমিও বলি সে রাতে চিৎকার দিয়ে লোক জড়ো করে আপনাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারতাম। তা তো আমি করিনি।
বাহ, এখন মনে হচ্ছে বিরাট মহত্ত্ব দেখিয়েছিলে। তাহলে শোনো, আমি বরং তোমার একটা উপকারই করেছিলোম। তুমি এ লাইনেরই মেয়ে ছিলে, তা না হলে এ নোংরা পথে পা বাড়াতে গেলে কেন? আমি তো শুধু তোমার লজ্জাটা ভেঙে দিয়েছিলাম।
আমি নোংরা? আচ্ছা ঠিক আছে, বিদ্রুপের হাসি ঝলসে উঠল বীথির কণ্ঠে, কিন্তু যে আমাকে হাত ধরে এ নোংরা পথে নামিয়েছিল সে নিজে কী?
আমি বললাম, তোমার ভাগ্যে এর চেয়ে ভালো আর কিই বা ছিল? বেশি হলে না হয় একটা পিয়নের বউ হতে পারতে।
সেটা হবারও উপায় ছিল না। সে রাতের ঘটনা পাড়া পড়শি সবাই জেনে গিয়েছিল। এসব কথা চাপা থাকে না।
তাই না কি? কই আমি তো কিছুই শুনিনি।
আপনাকে বলবে? আর এর কিছুদিন পরই তো আপনি বদলি হয়ে অন্য কোথায় চলে গেলেন। যাকগে সে কথা। একটা মজার কথা শুনাই আপনাকে। নিজের যে পরিবারকে আমি ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলাম বলে আপনি মনে করেন, তারাই পরে আমাকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করেছিল। একসময় সে সংসারেও আমার ঠাঁই হয়নি। বীথির ঠোঁটে তিক্ত হাসি। কী বিশ্রী লাগছে ওকে দেখতে। কিন্তু ওর শেষের কথাগুলো শুনে খানিকটা করুণারও উদ্রেক হল। বেচারী! সত্যিই তো কী-ই বা জীবন ওর। কারও কাছ থেকে শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা পায়নি কখনও। ওর প্রতি নিষ্ঠুর হতে ইচ্ছে করছে না। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়? বলা যায় না হয়ত মনের অজান্তে এখনও এর মধ্যে কিছুটা দয়ামায়া থাকলেও থাকতে পারে। বললাম, বীথি, আমি যা করেছিলাম তার জন্য আমাকে ক্ষমা করো। তোমার এরকম দুরবস্থা হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
বীথি উদাস দৃষ্টিতে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে রইল। ক্লান্ত স্বরে বলল, কেউ কারও কথা ভাবে না। সবাই নিজেকে নিয়েই ভাবে, সেজন্য আপনার আপসোস করার কিছু নেই। থাকগে কাজের কথায় আসা যাক। টাকাটা কি কাল দিতে পারবেন? তাহলে কাল দুপুরের বাসে আমি চলে যেতে পারতাম।
কী জঘন্য মেয়ে! টাকা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। আচ্ছা, কাঁদুনি গেয়ে ওর মধ্যে কি আমার জন্য করুণার উদ্রেক করা যায় না?
বললাম, আমার কৃতকর্মের জন্য আমাকে মাফ করো বীথি। তুমি বার বার এসে আমার কাছ থেকে এভাবে টাকা নিয়ে গেলে আমি শেষ হয়ে যাব। বিশ্বাস করো, আমি সত্যিই এত ধনী নই।
বীথি ফুঁসে উঠল, শুনেছি আপনি ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন।
অনুনয়ের সুরে বললাম, তোমাকে এভাবে টাকা দিতে থাকলে আমার ফ্ল্যাটটা বেচে দিতে হবে।
বীথি হিংস্রভাবে বলল, তাতে আমার কী? আমি তো আর ফ্ল্যাটে থাকতে পারব না। ঠিক আছে, দশ হাজার না হোক আপাতত আট হাজার হলেই চলবে।
বীথি এমনভাবে বলল যেন কী বিরাট দয়া দেখাচ্ছে। দরজায় প্রচণ্ড শব্দ হল। জানালাগুলো মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠছে। বাতাসের বেগ ক্রমেই প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে।
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। বাতাসের ঝাপটা আমাকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করল। হঠাৎ সমস্ত বনভূমি বিদ্যুতের আলোয় ঝলসে উঠল। গাছের ডালপালাগুলো ভয়ঙ্করভাবে দুলছিল। এখন সময়। আর দেরি করলে ঝড়ের উন্মত্ত তাণ্ডবে বের হওয়া সম্ভব হবে না।
মনে মনে বীথির জন্য দুঃখ হল। বীথি, আমি তোমাকে শেষ সুযোগ দিয়েছিলাম। তুমি তা ফিরিয়ে দিলে। একথা ভাবতেই মনের মধ্যে ওর জন্য তীব্র ঘৃণা আর রাগের জন্ম নিল। তুমি আমাকে এই পথ অবলম্বন করতে বাধ্য করছ। আমি কখনও এত নিষ্ঠুর হতে চাইনি। এছাড়া আমার উপায় নেই। এখন আমার আর তোমার মধ্যে কেবল মরা বাঁচার প্রশ্ন।
দেখি কে জেতে, আমি না বীথি? উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, বীথি, আমাকে এখনি বেরুতে হবে, তুমিও সঙ্গে চল।
বীথি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, এখন? ঝড় তো প্রায় শুরু হয়ে গেছে, এখন কীভাবে বেরুবেন?
অধৈর্য কণ্ঠে বললাম, আর একটু আগেই বের হওয়া দরকার ছিল। নদীতে লঞ্চটা ঠিকমত বাঁধা হয়েছে কী না দেখতে হবে।
ঠিক আছে আমি এখানে অপেক্ষা করছি।
সেটা সম্ভব নয়। আমি তোমার শর্ত মেনে নিয়েছি। তোমারও আমার কথা শুনতে হবে। আমার স্ত্রী এখানে এসে তোমাকে আবিষ্কার করুক তা আমি চাই না।
বীথি আমাকে আশ্বাস দিল, আমি তাকে কিছু বলব না।
তোমাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি না।
ফলন্ত গাছ মেরে ফেললে আমারই ক্ষতি, পরে ফল পাব কোথায়?
ওসব কথা ছাড়ো। আমার সঙ্গে তুমিই বা যেতে রাজি হচ্ছ না কেন?
আমি খুব ক্লান্ত। তা ছাড়া ঝড়ের মধ্যে যদি পড়ে যাই—
সারারাত তুমি এখানে থাকতে পারো না। আমি একটু পরই বাংলোতে যাব। তার চাইতে বরং লঞ্চঘাটে একটা ছোট্ট ঘর আছে তুমি রাতটা সেখানে কাটাতে পারো।
ঠিক আছে, আমি আপনার জন্য অহেতুক ঝামেলার সৃষ্টি করতে চাই না। আমার টাকা পেলেই হল, চলুন।
বীথি সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে উঠে পড়ল। দু-জনে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। প্রবল বাতাসের তোড়ে নিজেকে সামলে রাখাই মুশকিল। বীথি অসহায় কণ্ঠে বলল, বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
এই মুহূর্তে বীথি ঠিক একটা বাচ্চা মেয়ের মতো কথা বলছে।
আমার হাতটা শক্ত করে ধরো। এই একটুখানি পথ, এর পরই আমার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ব। তখন বাতাসের ঝাপটা আর ততটা লাগবে না।
বীথি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, নদী কতদূরে?
একেবারেই কাছে. জঙ্গলের মধ্যে।
আমার খুব ভয় করছে।
আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল। একটা তীব্র আলোকচ্ছটায় ঝলসে উঠল প্রকৃতি।
এই তো এসে গেছি আমরা, নদীটা দেখতে পাচ্ছ?
উহ, নদীতে এত ঢেউ।
উন্মত্ত ঢেউগুলো নদীর বুকে ফুলে উঠছে। যেন কালনাগিনীর মতো অবিরাম ফুঁসছে। বীথি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, লঞ্চটা কোথায়? বললাম, কাছেই অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না।
কই আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কোথাও কোনো লঞ্চ নেই। ঘরটাই বা কোথায়?
আমি কঠোরভাবে বললাম, আমার সঙ্গে এসো।
বীথি ভয়ার্ত আর মিনতি ভরা কণ্ঠে বলল, আপনার গলার স্বর এরকম শোনাচ্ছে কেন? আপনি আমাকে নদীর দিকে টানছেন কেন? দোহাই আপনার, আমি সাঁতার জানি না, ছাড়ুন।
আমি সাঁড়াশির মতো শক্ত করে ওর হাতটা চেপে ধরলাম। ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠল সমস্ত বনভূমি। গগনবিদারী শব্দের নীচে চাপা পড়ে গেল বীথির আর্তনাদ।
দুই
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। কোথায় আছি বুঝতে পারছি না। এখন কি রাত না দিন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু প্রচণ্ড অবসাদে শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। চেষ্টা করেও চোখ মেলতে পারছি না। কে যেন ডাকছে। অসময়ে আবার কে বিরক্ত করতে এল?
এই আর কতক্ষণ ঘুমাবে তুমি, ওঠো।
কেয়া ডাকছে। অনেক কষ্টে চোখ খুলে তাকালাম। হালকা নীল রঙের শাড়ি পরনে, পিঠের উপর সদ্যস্নাত ভেজা চুল। কী অপরূপ সুন্দরই না দেখাচ্ছে কেয়াকে। এ কী স্বপ্ন না বাস্তব?
ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসলাম, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এখনও অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে, সঙ্গে দমকা বাতাসও বইছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। আজ আর বৃষ্টিটা থামবে না।
জিজ্ঞেস করলাম সায়মা কোথায়?
কেয়া উত্তর দিল, ও তো তোমার পাশেই ছিল এতক্ষণ। এত গভীর ঘুমে ছিলে কিছু টের পাওনি দেখছি।
বললাম, হ্যাঁ সারারাত ঘুমুতে পারিনি।
কেয়া সহানুভূতির সুরে বলল, হ্যাঁ, কাল বিছানায় খুব ছটফট করছিলে তুমি।
হ্যাঁ কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল।
আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস, ঘুমের বড়ি দিয়েছিলাম। হ্যাঁ বড়িগুলো কাজে দিয়েছে। খুব মাথা ধরেছিল।
এখন মাথা ধরাটা গেছে তো?
হ্যাঁ, এবার বলো, ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি তো?
হয়নি মানে? অনেক বড়ো বড়ো গাছ উপড়ে পড়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা তিনটে লাশ পাওয়া গেছে।
কীভাবে মারা পড়েছে?
সেটা বলতে পারব না। তবে তোমার গার্ড বলেছিল ঝড়ে নাকি তিনজন মারা গেছে। এত প্রচণ্ড ঝড়, কিছু মানুষ তো মরবেই। আমার ধারণা আরও মৃতদেহ পাওয়া যাবে।
মাথার মধ্যে কেমন যেন করছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কেয়া, এখন ক’টা বাজে?
এখন আড়াইটা। শিগগির উঠে গোসল সেরে খেয়ে নাও।
তোমরা খেয়েছো?
সায়মাকে খাইয়ে দিয়েছি। ও অবশ্য তোমাকে ছাড়া খেতে চাইছিল না। আমি তোমার সঙ্গে খাব। কেয়া যেন মমতার এক প্রতিমূর্তি। ও এত ভালো না হয়ে আর একটু খারাপ হলেই পারত। খাট থেকে নেমে দাঁড়ালাম। একটা অসাড় অনুভূতি সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। জিজ্ঞেস করলাম। লাশগুলো এখন কোথায়?
কেয়া অবাক হয়ে বলল, কোন লাশগুলোর কথা বলছো?
ওই যে তুমি বললে ঝড়ে মারা পড়েছে।
ও এই কথা। ঝড়ে তো সবসময়ই কেউ না কেউ মারা পড়ছেই। কার লাশ কে খবর রাখে বলো। কিন্তু তুমি হঠাৎ ও নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লে কেন? না ভেবেছিলাম আমাদের কোনো কর্মচারী-টারি মারা গেল কি না?
সে রকম হলে নিশ্চয় খবর পেতে।
লাশগুলো কি শুধু পুরষের, নাকি মেয়েছেলেও আছে? কেয়া উত্তর দেবার আগেই মনে হল কে যেন বাইরে থেকে ডাকছে। কেয়া বলল, তুমি বাথরুমে যাও আমি দেখছি। কী যে হয়েছে আজ তোমার। কী সব অদ্ভুত প্রশ্ন করছ। ছেলের লাশ না মেয়ের লাশ।
না আর কথা না বাড়ানোই ভালো, এমনিতেই বড়ো বেশি কৌতূহল প্রদর্শন করে ফেলেছি। তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকলাম।
বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখি কেয়া তখনও দাঁড়িয়ে আছে। বলল, দেখো তো থানার ওসি সাহেব এসেছেন। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। থানার ওসি এখানে কী চায়? আমার সঙ্গে আবার কী কথা?
কেয়া আশ্চর্য হয়ে তাকাল। বলল, তুমি এমন করছ কেন? গিয়ে দেখই না তিনি কী কথা বলতে এসেছেন।
ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি ওসি সাহেব বসে রয়েছেন, গায়ে রঙ-চঙে শার্ট।
কুশল বিনিময়ের পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা গতরাতে কি আপনার কাছে লালশাড়ি পরা কোনো মেয়ে দেখা করতে এসেছিল?
প্রশ্নটা শুনে আমার মুখের রং কি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে? কথা বলতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? গলা দিয়ে যেন স্বর বেরুচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলাম—একথা কেন জানতে চাইছেন?
একটা মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। নদীর বুকে উপড়ে পড়েছিল একটা বড়ো সড়ো গাছ। ওর মধ্যে মেয়েটির মৃতদেহ আটকে ছিল।
ওই একটাই মৃতদেহ পাওয়া গেছে?
না, মোট চারটের খোঁজ মিলেছে। দুটো মরেছে ঘর চাপা পড়ে, একটা বিদ্যুৎপিষ্ট হয়ে আর এই মেয়েটি—
গলার স্বরটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, শুধু এই মেয়েটির ব্যাপারেই খোঁজ নিচ্ছেন কেন?
যদ্দুর খোঁজ পেয়েছি মেয়েটি এ অঞ্চলের কেউ নয়। এখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের কেউ তাকে চেনে না। তাছাড়া সাজ সজ্জা দেখে মনে হয় শহরের কেউ। এখানে মেয়েটির লাশ এল কী করে ঠিক বুঝতে পারছি না।
এমনও তো হতে পারে দূরে কোথাও লঞ্চ কিংবা নৌকাডুবি হয়েছে। স্রোতের টানে লাশ ভেসে এসেছে।
প্রথমে আমি সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু জঙ্গলের একজন গার্ড লাশ দেখে মেয়েটিকে সনাক্ত করেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটিকে কি সে চেনে?
না, মেয়েটিকে সে চেনে না। তবে গতকাল ঝড় শুরু হবার আগে মেয়েটি নাকি আপনার বাংলোর দিকে আসছিল। মেয়েটি তাকে আপনার বাংলোর ঠিকানা দেখিয়ে কীভাবে যেতে হবে জিজ্ঞেস করেছিল। ওর ধারণা মেয়েটি আপনাদের পরিচিত কেউ হবে।
প্রশ্নই আসে না, মেয়েটি কেন আমাদের কেউ হতে যাবে?
ওসি সাহেব অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, আপনি মেয়েটির লাশ না দেখেই কীভাবে এতটা নিশ্চিত হলেন? এমনও তো হতে পারে মেয়েটি আপনার কাছে আসছিল হঠাৎ পথ ভুলে অন্যদিকে চলে যায়। তারপর ঝড়ের মধ্যে পড়ে—
তা কী করে হয়। আমার বা আমার স্ত্রীর পরিচিত কেউ আসার কথা ছিল না। থাকলে আমরা জানতাম।
কিন্তু মেয়েটির কাছে আপনার নাম ঠিকানা লেখা ছিল কেন?
ব্যাটা আচ্ছা ঘুঘু তো, অথচ কী নিরীহভাবে প্রশ্ন করছে, সেটা কী করে সম্ভব?
দেখুন, আমি সেজন্যই আপনার কাছে এসেছি। মেয়েটির কাঁধের ব্যাগে, একটা ছোটো কাগজে আপনার নাম ধাম ঠিকানা লেখা আছে।
আমি আমার চোখে নিষ্পাপ দৃষ্টি ফুটিয়ে তুলে বললাম, তাই নাকি, আশ্চর্য! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মেয়েটি কে? কী তার পরিচয়?
ওসি সাহেব অমন করে আমার দিকে তাকাচ্ছে কেন?
সম্ভবত ওর নাম বীথি।
আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুতে চাচ্ছে না। অতি কষ্টে জোর করে জিজ্ঞেস করলাম, কী করে বুঝলেন?
ব্যাগের মধ্যে রাখা একটি বাসের টিকিটে মেয়েটির নাম লেখা রয়েছে বীথি। এই দেখুন—ওসি সাহেব পকেট থেকে বের করে একটা আধভেজা বাসের টিকিট আমার সামনে মেলে ধরলেন।
আমি অবাক হবার ভান করে বললাম, আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। এ নামের কোনো মেয়েকে আমি চিনি না। কেনই বা সে আমার বাড়িতে আসবে। তাও আবার ঝড়ের রাতে?
ওসি সাহেব কি সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন?
কাল রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?
ব্যাটা বদমাশ কিছুতে ছাড়বে না, জেরা শুরু করে দিল দেখছি।
কাল সন্ধ্যে থেকেই আমার মাথাব্যথা শুরু হয়েছিল। ঝড়ের আগে গার্ডকে সঙ্গে নিয়ে লঞ্চটা ঠিকমত বাঁধা হয়েছে কিনা দেখতে যাবার কথা ছিল। মাথাব্যথার জন্য শেষ মুহূর্তে সে পরিকল্পনাও বাতিল করতে হয়েছিল। গার্ডকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন।
ওসি পরিবেশটা হালকা করার জন্য বললেন, আপনি ব্যাপারটাকে ওভাবে নিচ্ছেন কেন? মৃতদেহটা কাকে হস্তান্তর করব সেটা বুঝতে না পেরে আমি আপনার কাছে এসেছি। নইলে এটা তো আর কোনো অপমৃত্যুর কেস নয় যে তদন্ত করব।
বললাম, অবশ্যই ঠিকই করেছেন। আসলে মেয়েটিকে সনাক্ত করার ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারলে খুশিই হতাম। কিন্তু নিজেই বুঝতে পারছি না কীভাবে আপনাকে সাহায্য করব। তবে এমনও তো হতে পারে আমারই কোনও কর্মচারীর খোঁজে কিংবা তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে আসছিল।
আমার যুক্তিটা বোধকরি ওসি সাহেবের মনে ধরেছে। বললেন, হতে পারে। এ ধরনের সম্ভাবনাই বেশি। যে-কোনো কারণেই হোক ঝড়ের মধ্যে আটকে পড়ে মারা গেছে। আপনি নিশ্চিত তো, গতরাতে এরকম কোনো মেয়েকে আপনি দেখেননি?
অবশ্যই। এরকম কোনও মেয়ে আমার কাছে আসেনি।
হঠাৎ দরজার ও পাশে ঝনঝন করে শব্দ হল। গ্লাস ভাঙার শব্দ। মনে হল কেউ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের সব কথা আড়ি পেতে শুনছে।
কেয়া নয় তো? সব ব্যাপারে ওর অদম্য কৌতূহল। পুলিশ আসতে দেখে তার কৌতূহলের মাত্রা নিশ্চয়ই বেড়ে গেছে। ওকি আমাদের কথাবার্তা সব শুনে ফেলেছে?
আচ্ছা আমি তাহলে উঠি। ওসি সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, অসময়ে এসে আপনাকে অযথা বিরক্ত করলাম।
লাশটার কী করবেন?
ওসি সাহেব সহজ গলায় বললেন, কী করব আবার? ওটা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে ধরে নিতে হবে।
আমি সায় দিলাম।
হ্যাঁ ঝড়ের কবলে পড়ে, নদীতে ডুবে কতজনই তো মারা পড়ে। সব মৃতদেহ কি আর সনাক্ত করা সম্ভব?
ওসি সাহেবের কপালে হঠাৎ চিন্তার রেখা দেখা দিল। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি ঠিক বুঝতে পারছি না. মেয়েটিকে গার্ড জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আসতে দেখেছে। নদীতে ও ডুবে মরল কী করে?
আমার হৃৎপিণ্ডের সব স্পন্দন যেন থেমে গেল। গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হল না।
ওসি সাহেব আমার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেননি। দরজা দিয়ে বের হতে হতে আপন মনেই বলতে থাকলেন, সম্ভবত ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে নদীতে ফেলেছে। মাই গড, কী প্রচণ্ড ঝড়! এরকম একটা ঘটনা আর একবার দেখেছিলাম। প্রবল ঝড়ো হাওয়ায় একজন লোক গাছের মাথায় গিয়ে আঁছড়ে পড়েছিল। গাছের মাথায় উঠে কত কষ্টে তার লাশ নামিয়ে আনতে হয়েছিল।
তাই নাকি?
যাকগে এ নিয়ে আর গবেষণার দরকার নেই। আমি আসি।
চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে করমর্দন করে ওসিকে বিদায় দিলাম। বাইরে তখনও টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তাকিয়ে দেখি আমার সাধের সেগুনগাছটা গোড়াসুদ্ধ উপড়ে পড়ে আছে। চারদিকে ঝড়ের তাণ্ডব লীলার চিহ্ন।
একটা ভয়ঙ্কর ফাঁড়া কাটল। এতক্ষণে কেয়া নিশ্চয় আমার জন্য টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছে। আশ্চর্য, ও কখনও জানতেও পারবে না যে কাল রাতে আমার উপর দিয়ে কী প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে। জীবনের সব কথা কী কেউ সবাইকে বলতে পারে? যা ঘটে গেছে তা এখন অতীত। আমার কাছে এর মূল্য নেই। আমি কেবল বর্তমানকেই প্রশ্রয় দেব, বর্তমানকে নিয়েই হবে আমার যত ভাবনা। আমাকে খাবার টেবিলে বসে খেতে হবে। কাল থেকে সায়মা তার বাবার কাছ থেকে কোনো আদর পায়নি। তাকে এখন একটু বেশি করে—
শোনো।
চমকে উঠলাম। কখন যে কেয়া পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। ওর গলার স্বরটা ইস্পাতের মতো কঠিন। কী ভয়ঙ্কর শীতল সেই কণ্ঠস্বর, ওর দিকে ঘুরে তাকালাম। কেয়ার চাউনিটা এমন দেখাচ্ছে কেন?
লালশাড়ি পরা ওই মেয়েটি তোমার কাছে কাল কেন এসেছিল? বিদ্যুতের আলোয় মেয়েটাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। তুমি ওসি সাহেবকে মিথ্যে কথা বলেছ। তুমি জানো মেয়েটা কীভাবে মারা গেছে, তাই না?
আমি কেয়ার চোখের দিকে তাকালাম। কী ভয়ানক অন্তর্ভেদী সে দৃষ্টি!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন