আঙুরলতা – বিমল কর

মনে হল না এইমাত্র অতি বড়ো একটা সর্বনাশ ঘটে গেল আঙুরের—আঙুরলতার ঘরে।

হাউমাউ করে কেঁদে নন্দর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না আঙুর। দুটো ঠান্ডা পা নিজের বুকের মধ্যে দু-হাতে জাপটে ধরে মাথা ঠুকতে শুরু করল না , আধভেজানো দরজাটা হাট করে দিয়ে ছুটে যে বাইরে যাবে, চেঁচামেচি করে কাউকে ডাকবে, তাও না। নন্দর চৌকির পাশে মেঝেয় পা ছড়িয়ে সে ইনিয়ে-বিনিয়ে একটু কাঁদল না পর্যন্ত।

মধুর সঙ্গে চ্যবনপ্রাশ মেড়েছিল আঙুর। আঙুল দিয়ে নন্দর জিভে আস্তে আস্তে সেটা মাখিয়ে দিতে মানুষটার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল একটু আগে। নন্দর যখন সাড়া পাওয়া গেল না, দশ ডাকেও ঠোঁট ফাঁক করল না, জিভ বার করল না একটুও—আঙুর তখন তাকিয়ে তাকিয়ে লোকটার বোজা চোখের পাতা দেখল সন্দেহভরে। একটা কালো পিঁপড়ে উঠেছিল পলকের তলায়। ঘাড়টা একটু কাত হয়ে রয়েছে। ঠোঁট সামান্য ফাঁক। সমস্ত মুখখানা সেদ্ধকরা বাসী ডিমের মতন শুকনো, শক্ত শক্ত, ফ্যাকাশে। যে আঙুলে মধু-চ্যবনপ্রাশ মাখিয়েছিল আঙুর নন্দর জিভে ছুঁয়ে দেবে বলে, সেই আঙুলটাই নন্দর নাকের তলায় ধরল। না, নিশ্বাস পড়ছে না নন্দর। আঙুলটা সরাতে গিয়ে নন্দর নাকের ডগার সঙ্গে ছুঁয়ে গেল। ঠান্ডা। নন্দর বুকে হাত রাখল, কান পাতল। কোনো শব্দ নেই। যাই যাই করছিল মানুষটা! আজ যাই কি কাল যাই ! যাক শেষ পর্যন্ত চলেই গেছে।

মধু মাড়া খলনুড়িটা কুলুঙ্গির মধ্যে রেখে দিতে এসে পশ্চিমের জানলাটা খুলে দিল আঙুর। হিমুদের পুরোনো টিনের চালার ওপর এখন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। মাটির দেয়ালগুলো ভিজে সপসপ। ডোবাটার নীল জলে শ্যাওলা থিকথিক করছে। আশ-শ্যাওড়া আর কচুর জঙ্গলে ক-টা কাক ভিজছে আর ডাকছে।

জানলার কাছ থেকেই ঘুরে দাঁড়াল আঙুর। নন্দর দিকে আর একবার চাইল। নড়বড়ে সরু চৌকিটার ওপর কতকগুলো এলোমেলো হাড় যেন কেউ চিট ছেঁড়া কাঁথার তলায় চাপা দিয়ে রেখে দিয়েছে। দুটো মাছি এসে বসেছে নন্দর মুখে।

নন্দ তো মরে জুড়োল কিন্তু আমায় যে এই শেষ সময়েও জ্বালিয়ে গেল! আঙুর ভাবছিল . এখন কী করি! কাকে ডাকি, কার পায়ে ধরি, কার কাছে হাত পাতি?

ভীষণ রাগ হচ্ছিল আঙুরের। পাজি নচ্ছারটা যেন বুঝেসুঝেই এসেছিল এখানে। যেন ঠিক করেই এসেছিল, এঁটো পাতটা আঙুরকে দিয়েই তুলিয়ে নেবে। সেই জেদ ও রাখল।

এখন কী করে আঙুর? এ-ভাবে তো ঘরের মধ্যে মড়া ফেলে রাখা যায় না। ওটাকে শ্মশানে নিয়ে যাবার, পোড়াবার কী হবে?

খানিকটা ভেবে আঙুর ঘরের পূর্বদিকের দেয়ালের কাছে এগিয়ে গেল। তোবড়ানো রঙচটা বাক্সটার ওপর ক’টা পোঁটলা-পুঁটলি গুটানো মাদুর চাপানো ছিল। তারই ওপর কালো ছিটকাটা বেড়ালটা মুখ গুঁজড়ে ঘুমোচ্ছিল।

চোখ পড়তেই আঙুর যেন ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠল। খপ করে ধরে বেড়ালটাকে আধভেজানো চৌকাঠের দিকে ছুঁড়ে মারল। ধপ করে একটা শব্দ, বেড়ালটার সামান্য একটু ককিয়ে ওঠা। দরজার ফাঁক দিয়ে পালাল জন্তুটা।

যেমন করে বেড়ালটার টুঁটি চেপে ধরেছিল আঙুর তেমন করেই মাদুর পোঁটলা-পুঁটলি, একটা উদোম বালিশ—মেঝের উপর ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলতে লাগল ও। যত আপদ সব! আমার কপালেই জোটে গো—এও আশ্চয্যি। কেন তোদের আর জায়গা হয় না! হারামজাদা, নচ্ছারের দল। অন্য ঠাঁই নেই? শুতে পারিস না, মরতে পারিস না সেখানে। না থাকে রাস্তায় যা, ভাগাড়ে যা!

আঙুরের গলা চড়ল। যখন বেশ চড়ায় উঠল—তখন আঙুর যেন থেমে গিয়ে প্রত্যাশা করছিল এইবার অন্য কেউ কথা বলবে। ম্লান বিষণ্ণ ভাঙা-ভাঙা, চাপা গলায়। কিন্তু কোনো জবাব আসছে না দেখে মুখ ফিরিয়ে নন্দর দিকে তাকাতেই খেয়াল হল, লোকটা মরে গেছে।

রঙচটা, তোবড়ানো বাক্সটা খুলে বসল আঙুর। হাঁটকাল, হাতড়াল। একটা পাটের ফাঁস-খাওয়া বাহারী শাড়ি বের করল, দুটো তাঁতের—ছেঁড়া পেঁজা। সায়াও একটা, সার্টিনের একটা বডিজ—। কাঠের কৌটো, প্রসাদী ফুল বাঁধা ন্যাকড়া, রোলডগোল্ডের ম্যাড়মেড়ে কানপাশা, কাচের মালাও একটা। আর বেরুল একপাতা সিঁদুর। ক-টা মাথার কাঁটা।

আঙুর সিঁদুর আর মাথার কাঁটা ক-টা হাতে করে একটু চুপ করে বসে থাকল। নন্দর দিকে মুখ ফিরিয়ে চাইল না, কিন্তু চোখ দুটো ওর মনে-মনে নন্দকেই দেখছিল। বছর পাঁচেক আগেকার নন্দকে। তখন নন্দর গায়ে মাংস ছিল, হাড়টা চোখে পড়ত না। মুখটা ছিল চোখ-টানা। ভরাট গাল, বড়ো-বড়ো চুল।

আঙুরের বুকের মধ্যে এতক্ষণে টনটন করে উঠল। গলার কাছে নিশ্বাসটা একটু সময় চাপ হয়ে থাকল। চোখের সাদা জমি ব্যথা ব্যথা করে জল জমছিল। এক ফোঁটা জল একটা গাল ভিজিয়ে পড়ল টপ করে—হাতের ওপর। ঠিক কবজির কাছটায় আর আঙুর সে-দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বাক্সের মধ্যে মুখ বাড়িয়ে দিল।

না, নেই। সেই শাঁখা জোড়া আঙুর কবে যেন টান মেরে খুলে ফেলেছিল হাত থেকে। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল নর্দমায়। বিয়ের শাঁখা তো নয়, শখের শাঁখা , স্বামীর সিঁদুর তো নয়, যে-লোকটা তাকে রেখেছিল মেয়েমানুষ করে তার একচেটিয়া জবরদস্তির সীলমোহরও সিঁদুর। আঙুর শাঁখা ফেলে দিয়েছিল, সিঁদুরও মুছে ফেলেছিল। সে অনেকদিন হল।

চোখটা মুছে নিল আঙুর। এই যে তার মনটা খারাপ লাগছে, কান্না আসছে—এর জন্যে নিজের ওপরই তার রাগ আর বিরক্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এবার সে ন্যাকামি শুরু করেছে! যেন এই ন্যাকামিটুকু করা উচিত, করলে পাঁচজনে দেখবে, অন্তত নন্দ।

ঘাড় ঘোরাল আঙুর। না নন্দ আর দেখবে না। ও মরেছে।

বাক্স হাতড়ে খুঁটে-খুঁটে সবসুদ্ধ সাড়ে এগার আনা জুটল। একটা অচল টাকা আছে। এমনই অচল যে কোনো রকমে চালাবার উপায় নেই। যে হারামজাদা ফাঁকি দিয়ে এটা ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল—সে আর কোনোদিন এল না। এলে আঙুর তার কাছ থেকে টাকাটা ঠিক আদায় করে নিত। ঠাকুরের বাড়িতে মানুষ অচল চালায় আর চালাবার চেষ্টা করে তাদের এই পটিতে।

সাড়ে এগারো আনা—আর আঙুর মনে মনে খুঁজে-পেতে দেখল, কুলুঙ্গিতে গেলাস চাপা দেওয়া একটা আধুলি আছে, দোক্তার কৌটার মধ্যে একটা দুয়ানি। ও, হ্যাঁ—আর আনা ছয় পয়সা আছে চালের হাঁড়িটার মধ্যে। কত হল সবসুদ্ধ তা হলে! সেই এক টাকা সাড়ে এগার আনা।

এক টাকা সাড়ে এগার আনায় কি একটা লোককে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া, পোড়ান-টোড়ান সম্ভব! আঙুর যদিও এমন ফ্যাসাদে আগে পড়েনি তবু জানা কথাই গোটা দুয়েক টাকায় শ্মশান খরচ চলে না।

কী করবে, কী করা যায়—আঙুর ভাবছিল। কুল পাচ্ছিল না। বিক্রি করবে, বাঁধা রাখবে—এমন কোনো জিনিসই আর তার কাছে নেই। কী আছে আর তার এখন? এক রতি সোনা না, রুপো না, এমন কি কাঁসাও নেই। সোনা কোনোকালেই ছিল না। সোনার পাত পরানো হালকা চুরি চারাগাছি ছিল এককালে, নন্দই করিয়ে দিয়েছিল তখন, সে চুড়ি কবেই গেছে। কানে দু-তিন আনা সোনা ছিল—এটা অবশ্য আঙুর তার রোজগারে গড়িয়েছিল—সেটাও গেছে মাসদেড়েক আগে নন্দ আসার পর।

নন্দ এল, আর যেন মস্ত বড়ো হাঁ নিয়েই হারামজাদা এসেছিল, আঙুরের কানের তিন আনা সোনা গেল, খাঁটি সোনা , নাকের দেড় আনা—মাথায় গোঁজা রুপোর চিরুনিটা, দু-খানা রেশমি-শাড়ি, কাঁসার থালা, বাটি-গেলাস টুকিটাকি আরও কত কি?

কী করবে আঙুর! আহা, সে কী সেধে এনে ঘরে ঢুকিয়ে চৌকি পেতে দিয়েছিল। অত পিরিতের কেষ্ট ছিল না নন্দ তার। বরং ওই ছ্যাঁচড়া শয়তান, ইতর, স্বার্থপর লোকটা যখন ধুঁকতে ধুঁকতে এসে উঠল, আঙুর তো তাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে গিয়েছিল।

মুখপোড়া মাগিচাঁটা তখন আঙুরের পা জড়িয়ে ধরে মেয়েমানুষের মতো কেঁদেছে। আঙুরের নিজেরই তখন ঘেন্না করছিল। নন্দর সর্বাঙ্গে ঘা, পুঁজরক্তে ময়লা ছেঁড়া কাপড়জামা দাগ ধরে কড়কড় করছে , বিকট গন্ধ—দাঁতে পোকা, চুলে উকুন, একমুখ দাড়ি, হলুদ চোখ। আর বৈশাখ মাসের দুপুরের খড়ের গাদার মতন গরম গা। ”দুটো রাত, আমায় থাকতে দাও, আঙুর , গায়ের তাপটা একটু কমুক আমি চলে যাব।” নন্দ বলেছিল আঙুরের পা সত্যি-সত্যি জড়িয়ে ধরে।

”না, না, না। যেখানে কাটালে এতদিন—সেখানে যাও।” আঙুর রোদজলে পোড়খাওয়া কাঠের মতো শক্ত। ”তোমার পয়সার সুখ যারা লুটেছে, যাদের পায়রা করে পুষেছ এতদিন, শোয়াশুক্তি রঙ্গ করেছ, তাদের কাছে যাও। কেন, তারা এখন রাখল না, লাথি মেরে জুতো মেরে তাড়িয়ে দিল!”

নন্দ জবাব দিতে পারছিল না। তার জবাব দেবার কিছু ছিল না। শুধু জ্বরের ঘোরে, যন্ত্রণার বিকারে একটা মারাত্মক জখম-হওয়া কুকুরের মতন ছটফট করছিল, মাথা খুঁড়ছিল।

আঙুর থাকতে দেবে না। নন্দও উঠবে না। ওঠার মতন ক্ষমতাটুকুও তার নেই যেন।

অগত্যা।

”থাকছ, থাক—, কিন্তু জ্বর ছাড়লেই চলে যেতে হবে।” আঙুর সাফসুফ বলে দিয়েছিল, শাসিয়ে দিয়েছিল। সেই গোড়াতেই।

নন্দ তো জ্বর ছাড়াতে আসেনি, এসেছিল আঙুরকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করতে। কী ঝামেলা, কী ঝকমারি নন্দকে থাকতে দিয়ে। জ্বর তো যায়ই না, উপরন্তু বাড়ে। মাঝে মাঝেই নন্দ বেহুঁশ। হুঁশ থাকে যতক্ষণ, কাটা ছাগলের মতো ছটফট করে।

চোখের সামনে জবাই আর কতক্ষণ দেখতে পারে মানুষ। আঙুর বিরক্ত হয়ে, কোনো উপায় নেই দেখে, নন্দকে গালাগাল দিতে দিতে ডাক্তার ডেকে আনল। অম্বিকা ডাক্তারকে। এ-পাড়ার ডাক্তার। যার কাছে আঙুরদের লুকানো-চোরানো রোগগুলো জলের মতন পরিষ্কার। ও জ্বালা-টালা, ঘা-টা আপাতত সে চাপাচুপি দিয়ে দিতে পারে।

অম্বিকা ডাক্তার দেখল নন্দকে। আঙুরকে বলল, ও আঙুর—খারাপ ঘা-টা গুলো না হয় একটু সারিয়ে-সুরিয়ে দিলাম আমি , কিন্তু ওর লিভার যে পচে গেছে মদ খেয়ে খেয়ে। বড়ো কাহিল অবস্থা। সহজে মেরামত হবে না। হবে কি না তাও সন্দেহ। ওকে বরং কলকাতার হাসপাতালে দাও, যদি কিছু হয়—এখানে তো সুবিধে দেখছি না।

আঙুরকে যেন কেউ উনুনের আঁচ থেকে টেনে চুল্লিতে ফেলল। জ্বলে যেতে লাগল আঙুর। কোথায় আপদ বিদেয় করতে পারলে বাঁচে তা না নাড়িভুঁড়ি পচিয়ে ফিচিল রোগে সমস্ত রক্তটাকে দূষিয়ে হারামজাদা তার কাছে আরাম করতে এসেছে।

মর, মর, অরুচি আমার। খেলাম, শুলাম, সুখ করলাম পাটে , ছাই ঝাড়তে ওরে পচি, এলাম তোমার হাটে। বেইমান মিনসে কোথাকার! হবে না, শরীর তো পচে পচে গলে গলে ঝরবে। প্রায়শ্চিত্যি এমনি করেই হয়। কেন, যখন আঙুরকে ছেড়ে পথে বসিয়ে পালিয়েছিলে মনে ছিল না। আমার মা না হয় পা পিছলে কাদায় পড়েছিল। কিন্তু আমি তো সাত ভাতার করে বেড়াইনি। তখন ফুসফাস করে ভাগিয়ে নিয়ে এলে। কত রস-আদিখ্যেতা, মধুমিছরি কথা—।

আঙুর তখন বড়ো মিষ্টি, রস টুসটুসে। একাই চাখব, একাই খাব। ফন্দি-ফিকির, ছেনালি কত! শাঁখা পর, সিঁদুর দাও সিঁথিতে। বর-বউ , স্বামী-স্ত্রী আমরা। ভগবান সাক্ষী, যে-মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি, এই মাটি সাক্ষী, এই ঘরের চুন, দেয়াল ছাদের বন্ধন—এরা সাক্ষী।

বছর কাটতেই আঙুরের রস শুষে শুষে ছিবড়ে করে ফেলল নন্দ। আর সুখ নেই, স্বাদ নেই, অরুচি ধরে গেছে। পালাল নন্দ। কিছু না বলে, ঘর দেয়ালের বন্ধন কাটিয়ে। তারপর চার বছর আর এ-পথ মাড়াল না। আজ এসেছে—মরতে বসে যখন আর কোথাও জায়গা পাচ্ছে না দেহটা রাখে।

আঙুর চিৎকার করে করে শুনিয়ে শুনিয়ে এ সব কথা দশবার করে বলে। দূর দূর করেই আছে। জিভের রাখঢাক নেই। সারাদিন বিরাগ আর বিরক্তি, রাগ-ঘেন্না উপরে যাচ্ছে।

অথচ নেহাতই যেন এমন এক কলে পড়েছে যেখান থেকে উদ্ধার নেই তার লোকটা না চলে যাওয়া পর্যন্ত—তাই ভীষণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও, পাপ বিদায়ের গুণাগার দেবার জন্যেই ডাক্তার আর ওষুধ আর এ-পথ্য সে-পথ্য।

অম্বিকা ডাক্তার ক’টা ছুঁচ ফুঁড়ল, দু-চার শিশি ওষুধ। ঘা-ফোড়ার দগদগানি কমল একটু! আর কিছু না। চটকলের সেই বড়ো ডাক্তার—তাকেও একদিন দেখিয়ে আনল আঙুর। তার লিখে দেওয়া ওষুধ খাওয়াল। যে কে সেই। এই ডাক্তারও বলল, কলকাতায় হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে এস।

বিশ মাইল কলকাতা। যেতে আসতে চল্লিশ মাইলের রগড়ানি। রেল-ভাড়া, বাস-ভাড়া। নন্দর ওঠার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই। তবু আঙুর পচাগলা মাছের চেঙারির মতন নন্দকে কাঁখে-কোমরে ধরে তাও কলকাতার দু-দুটো হাসপাতালে ধরনা দিল। কিসের কি, কানে কথাই তুলল না কেউ। দেখল না পর্যন্ত। এক নজর চেয়েই বলল, এখানে কেন নিয়ে এসেছ গো, নিমতলায় নিয়ে যাও। আর যদি আঁচলে নোট বেঁধে এনে থাক—টাকা দিয়ে ভর্তি করে দিয়ে যাও।

ফেরার পথে নন্দর সঙ্গে হাসপাতালেরও বাপান্ত করতে-করতে ফিরল আঙুর। আর সেই যে এসে পড়ল নন্দ তারপর আর পাশ ফেরবার পর্যন্ত ক্ষমতা থাকল না। হোমিওপ্যাথি চলছিল শেষটায়। তবু দু-আনা পুরিয়া পাওয়া যায় কালীকেষ্টর ডাক্তারখানায়। গত পরশু থেকে সত্য কবিরাজের কথা মতন মধু-চ্যবনপ্রাশ।

তারও শেষ হল। নন্দ মরল।

আঙুর রঙচটা তোবড়ানো খোলা বাক্সর অন্ধকারে বেহুঁশ হয়ে তাকিয়েছিল। চোখের পাতা পড়ছিল না, মনেই হচ্ছিল না ও আছে, ও কিছু ভাবছে কিছু ওর করার আছে।

হুঁশ হল মেঘের ডাকে। খুব জোরে একটা মেঘ ডেকে উঠল বাইরে। আঙুর মুখ ফিরিয়ে দেখল, জানলার বাইরেটায় অনেকটা অন্ধকার জমে এসেছে।

বাক্সটা থেকে পাটের বাহারি শাড়িটা বের করে ডালাটা বন্ধ করে দিল। জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। তাকাল বাইরে। খানিকটা কালো মেঘ জমেছে বলে মনে হচ্ছে কিন্তু বিকেলও হয়ে গেছে। বৃষ্টি অবশ্য আর পড়ছে না।

আঙুর শুনতে পাচ্ছিল তার ঘরের বাইরে চাঁপা, আতা, লাবণ্য, চামেলি, গোলাপ—দুপুরের গা-গড়ানো ঘুম শেষ করে, কেউ জল ভরতে, কেউ হাই তুলতে, উড়ের দোকান থেকে চার পয়সার চা আনতে—উঠোন দিয়ে আসছে যাচ্ছে, কথা বলছে। আতরের কিরকিরে গলা আর গোলাপের ভাঙা গলার বিশ্রী হাসিটা স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছিল আঙুর।

আতা ছুঁড়িটার কপাল ভালো। পাটকলের একটা ছোঁড়া খুব যাচ্ছে আসছে। আগেরটা ভাগতে না ভাগতেই নতুনটা জুটে গেছে। আঙুর ভাবছিল . আতা কি এই পাটের বাহারি শাড়িটা নেবে? ওর তো এই সব রঙ, বাহার ভালোই লাগে। যদি নেয় আতা, হোক না একটু ফাঁস খাওয়া তবু এখনও ছটা মাস নিশ্চিন্তে পরতে পারবে। আহা, শাড়ি পরে তো আর বিছানায় ধামসাচ্ছে না।

যদি নেয়, আঙুর চার টাকাতেই দিয়ে দেবে। আর যদি না নিতে চায়? আঙুরের মনের মধ্যে আতা, পাটের শাড়ি, নন্দ সব এলোমেলো হয়ে গেল।

একটু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আঙুর যেন সব ভেবে নিল, পর-পর। কী করবে, কার কাছ থেকে কার কাছে যাবে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে এবার। বিকেল তো হয়েই গেল। আর কতক্ষণ ঘরে মড়া ফেলে রাখবে।

যাবার সময় নন্দর মুখের দিকে চেয়ে একটা কুৎসিত গাল আওড়াল আঙুর। বাইরে এসে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল।

আতা তার ঘরের কাছটিতে পিঁড়ি পেতে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। নিশ্চয় ওর বাবু কাল যাবার সময় ফেলে গেছে। কিংবা আতা সরিয়ে রেখে দিয়েছে নিজেই। সেই সিগারেটের ভাগ পাবার আশায় মানদা আতার চুলের জট ছাড়িয়ে দিচ্ছে, চিনু পায়ের কাছটিতে উবু হয়ে বসে ঝামা দিয়ে পা ঘষে দিচ্ছে।

পাটের শাড়িটা আঁচলের তলায় আড়াল করে দিয়েছিল আঙুর আগেই। আতার আশেপাশে অত ভিড় দেখে এখন আর যেতে ইচ্ছে হল না। মানদা যতক্ষণ কাছে থাকবে, শত খুঁত বের করবে, আতার ইচ্ছে থাকলেও মানদা কিনতে দেবে না। দর-দাম তো পরের কথা।

তার চেয়ে আগে হিমুর কাছে যাওয়া যাক। বলতে গেলে হিমুই একমাত্র লোক যার সঙ্গে আঙুরের ভাবসাব আছে ভালো মতন। সুখ-দুঃখের কথা তার সঙ্গেই যা হয়। এত বড় বিপদের কথাটা তাকেই আগে জানানো দরকার।

আঙুর উঠোন পেরিয়ে তর তর করে সদর দিয়ে বাইরে চলে গেল। হিমুদের চালাটা পাশে।

চুল বাঁধতে শুরু করে দিয়েছিল হিমু। আঙুর এসে কাছে দাঁড়াল।

বিপদের কথাটা বললে আঙুর। হিমুর হাত থেমে গিয়েছিল। ”কখন মলো?”

”দুপুরে।”

”ঘন্টা তিন চার হল তবে! আজ আবার শনিবার। দোষ না পায়!”

”পাবে পাক, আমি কী করব! আমার কাছে তো চিতেয় ওঠার খরচ জমা রেখে যায়নি!”

”কী করবি?” হিমু চুলের খোঁপাটা আবার গুছোতে শুরু করল।

”ক-টা টাকা জোগাড় করতে পারলে হারামজাদাকে চিতেয় উঠিয়ে আসব।” আঙুর দাঁতে দাঁত পিষে বলল।

”বিশুদের কাছে যা। ওদের বল। তবে মাগনায় মড়া কাঁধে করে পোড়াতে যাবে না ওরা।”

”তা জানি।”

”দেখ তবু হাতে-পায়ে ধরে—যদি যায়।”

আঙুর তাকিয়ে তাকিয়ে হিমুর মুখ দেখল। হিমুকে দেখে মনে হচ্ছে, এ-ব্যাপারে তার কোনো গা নেই।

”তুই আমায় ক-টাকা দিবি হিমু?”

”টা—কা!” একটুক্ষণ আঙুরের দিকে চেয়ে থেকে হিমু হতাশ, বিষাদ-বিষাদ মুখ করল, ”তোকে বলছিলাম না সে-দিন! স্যাকরার জন্যে বারোটা টাকা রেখেছি অনেক কষ্টে আর চারটে হলে—জিনিসটা হয়। তা পোড়া কপাল এমন চারটে টাকাও জুটোতে পারছি না।”

আঙুর হিমুর মুখের দিকে চেয়ে থাকল।

কী ভেবে হিমু বললে আবার, ”সিকি, আধুলি, বড়ো জোর টাকাটা হয়, পারি আঙুর। তার বেশি আমাদের ক্ষমতা কী। তা তুই দুটো টাকা নে বরং আমার কাছ থেকে। পরে শুধে দিস। বলেই হিমু একটু অন্য রকম হাসল, ‘তুই আর শুধবি কি—!”

হাত পেতে আঙুর দুটো টাকাই নিল। অন্য সময় হলে নিত না, কিছুতেই না।

হিমুর কাছ থেকে বেদানামাসির ঘরে।

মাসি শুনে খেঁকিয়ে উঠল, ”তখন বলেছিলাম ও-আপদ ঝেড়ে ফেল গা থেকে। শুনলি না। দরদে একেবারে উথলে উঠলি। যা এবার নিজেই কাঁধে করে নিয়ে যা। ছেনাল মাগি কোথাকার।”

আঙুর কিছু বলল না। মনে-মনে ভাবল শুধু দরদে ও উথলে ওঠেনি, বিছানা পেতেও শুতে দেয়নি। নন্দর আমি বিয়ে করা মাগ নয় যে, খেয়ে সেবা-শুশ্রূষা করেছি ওই পচা মর-মর লোকটার। নেহাত ছিল, একই ঘর, চৌকিতে, আমি মেঝেতে , তাই জল চাইলে দিয়েছি ওষুধটা ঢেলেছি মুখে। পথ্যটা দিয়েছি দায়ে পড়ে !

বেদানামাসি বললে, ‘আমি কী করব !’

”মড়াটা ঘরে পড়ে থাকবে?” আঙুরের গলা যেন আর উঠছিল না।

”তা থাকবে বৈকি—আমার এখানে মড়া-ধরা না থাকলে, না পচলে তোদের চলবে কেন!যা—যা মেথর মুদ্দোফরাসকে খবর দিগে যা—হাতে আধুলিটা টাকাটা গুঁজে দিস—না হয় একদিন নিয়ে শুস বিছানায়—ওরাই ধড়টাকে পা ধরে টেনে নিয়ে ভাগাড়ে ফেলে দেবে।”

আঙুরের বুকটা ছ্যাঁক করে উঠল। মেথর, মুদ্দোফরাস! জিনিসটা কল্পনা করতে গিয়ে মনে পড়ল, মরা কুকুরকে কীভাবে পায়ে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যায় ওরা।

আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল নন্দর উপাধিটা। ও চক্রবর্তী। বামুন।

কেমন যেন শিউরে উঠল আঙুর। বুকের মধ্যে সত্যি সত্যি একটা অদ্ভুত ব্যথা আর অসহায়তা জমে উঠতে থাকল।

বিকেল পড়ে সন্ধ্যে হয় হয়।

আঙুর তাড়াতাড়ি এল আতার ঘরে। আতা তখন সাজছে। ছেঁড়া সায়ার ওপর আর একটা নতুন লাল সায়া চড়িয়েছে। তা কোমর-টোমর ফুলেছে খুব! বডিজ এঁটে শাড়িটা সবে পড়েছে, ঘরে কেউ নেই।

কথাটা সরাসরি পাড়ল আঙুর। পাটের শাড়িটা একেবারে বের করে।

আতা দেখল হাতে নিয়ে, খুলে ফেলে, কোমরে পাক দিয়ে, গায়ে ফেলে। ‘শাড়িটা তোমার বড্ড সেকেলে, আঙুরদি! পাড় ভালো না!’

আঙুর কী বলবে! তিন বছর আগের শাড়ি সেকেলে হয়ে গেছে! আঙুর শুধু বিড়বিড় করল, ‘তোকে মানাবে। বেশ মানাবে।’

আতা হাসল। ”ছারুবাবু সে দিন আমায় একটা ছাপাই এনে দিয়েছে। এ-নিয়ে আর কী করব! বড্ড পুরোনো ছেঁড়া ফাটা।”

‘নে না—!’ আঙুর নিজের অজান্তেই কখন যেন মিনতি করে বসল ‘আমি বলছি আতা, নিয়ে নে। তোকে সুন্দর দেখাচ্ছে শাড়িটা গায়ে ফেলে। আর যদি শুনিস বাপু তবে বলছি,—এ-শাড়ি পরে তো আর ধামসাচ্ছিস না। রেখে রেখে পরিস—বছর খানেক চলে যাবে।

আতা ভাবল। ‘আমার কাছে তিনটে টাকা আছে—আড়াইটে টাকা দিতে পারি। না হলে তুমি নিয়ে যাও, আমার তেমন দরকার নেই।’

আড়াইটে টাকাই নিল আঙুর। ঘরের বাইরে এল। লণ্ঠন আর কুপি জ্বালিয়ে ঘরে ঘরে সব তৈরি। সাজ-পোশাক শেষ করে ফেলেছে চামেলি লাবণ্যরা। আকাশ লালচে লালচে, বৃষ্টি হয়ত আরও জোরে আসবে। টিপটিপ পড়তে শুরু করেছে আবার। সেই বৃষ্টিতেই চামেলিদের কেউ মাথার ওপর আঁচল তুলে গলির মুখে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। একটি ছাতায় দু-তিনটে মাথাও জড়।

সরু গলিটা দিয়ে রাস্তায় চলে এল আঙুর। গলির আবছা আলো-অন্ধকারে তখন গোলাপদের জটলা, বিড়ি ফোঁকা, গা-ঢলাঢলি, হাসি। ঘুর ঘুর শুরু হয়েছে সবে খদ্দেরের।

রাস্তায় এসে মনে মনে টাকার পুরো হিসেবটা সেরে ফেলল আঙুর। এক টাকা সাড়ে এগারো আনা, হিমুর দুই আর আতার আড়াই—তা ক’টা টাকা হয়ে গেছে। বিশুরা যদি এখন এই ছ’টাকায় রাজি হয়। মনে হয় না হবে—। কততে যে হবে তাই বা কে জানে! হনহন করে এগিয়ে গেল আঙুর!

এখান-ওখান খোঁজ নিয়ে বিশুকে পাওয়া গেল সাইকেল সারাবার দোকানটায়। টিনের নড়বড়ে চেয়ারে বসে দোকানের দরজার পাল্লায় পা তুলে কাঁচের গেলাসে চা খাচ্ছিল। কার্বাইডের আলো তার পাজামা আর মুখে পড়েছে।

আঙুর কাছে গিয়ে ডাকল। ইশারা করল কাছে আসবার।

চা শেষ করে, বিড়ি ধরিয়ে ফুঁকতে ফুঁকতে বিশু এল , মিটমিট চোখে চারপাশ দেখতে দেখতে। ‘কি রে পটলি কী খবর?’ বিশুর কাছে আঙুররা সবাই পটলি। কিন্তু আঙুর কিছু বলবার আগেই বিশু সামনের দিকে চেয়ে বলল, ‘দাঁড়া আগে মাইরি একটা পান খেয়েনি। শালা চা নয় তো যেন ঘোড়ার পেচ্ছাপ। জিভটাই বেসাদ হয়ে গেল।’ বিশু কথাটা শেষ করেই হাত বাড়াল। অর্থাৎ পান সিগারেটের পয়সাটা আগে ফেল। পরে বাতচিত।

আঙুর এ-সব দস্তুর জানে। গরজ তার। আঁচলের খুট থেকে আধুলিটা দিল—আতার দেওয়া আধুলিটা। বললে, এক খিলি পান , একটা সিগারেট—তার বেশি নয়, কালীর দিব্যি থাকল।

বিশু হাসল। ‘খুব টাইট যাচ্ছে না কিরে পটলি! দিনকাল শালা যা যাচ্ছে— যেন সত্যযুগ। আয়—আয়, শালা আঙুরের রস চাটবে তাও মাছি আসে না।’ বিশু হাসতে হাসতে চলে গেল।

এল খানিক পরে, জোড়া খিলি পানে গাল ভরতি করে, সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে। পয়সা কিন্তু ফেরত দিল না। ‘বল পটলি কি বলছিলি?’

আঙুর বলল সব। গলায় উদবেগ আর মিনতি।

বিশু রাস্তার ছিটে-ফোঁটা আলোতে আঙুরের মুখটা ভালো করে দেখল। একটু ভাবল, ‘ক’টাকা আছে তোর কাছে?’

‘ছ’টাকা।’

‘ছ’টাকা! ছ’টাকায় কী হবে রে, একটা ঠ্যাং-ও তো পুড়বে না নন্দর’, হো হো করে হেসে উঠল বিশু।

‘কত লাগবে তবে?’ আঙুর বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে বিশুর অট্টহাসি শুনতে শুনতে শুধল।

‘দেড় টাকা মন আম কাঠ। তা মন সাতেক লাগবে! দশ টাকা তো তোর কাঠেই লাগবে , তারপর হাঁড়ি কড়ি ধুনো—ধর আরও এক টাকা। নতুন বসতর পরাতে চাষ তো—’

‘না।’ আঙুর তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল। ওর বুক শুকিয়ে আসছিল। নতুন বস্ত্রে আর দরকার নেই।

‘এইত আর কি , আর আমরা চারজন খাবো চারটে পাইট দিবি। তা দু’নম্বরই দিস—দু’টাকা ছ’আনা করে ধরে নে—গোটা দশেক টাকা আর কি!’

আঙুরের পায়ের সাড় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, হাতেরও। বিশুর মুখটা পর্যন্ত শুয়োরের মতন ছুঁচলো ঘিনঘিনে দেখাচ্ছিল।

খানিকটা সময় লাগল আঙুরের সইয়ে নিতে। বললে, ‘অত টাকা আমি কোথায় পাব? আমার বাপ না ভাতার যে তাকে পোড়াতে বিশ টাকা খরচা চাইছিস?’

‘বাপ না, ভাতার না,—তো সেরেফ চেপে যা। থানায় গিয়ে খবর দিয়ে দে—ধাঙড় পাঠিয়ে নিয়ে যাবে।’

আবার সেই ধাঙড়! বুকটা ধক করে উঠল। আঙুর নিরুপায় হয়ে বলল, ‘আমার খেমতা থাকলে বিশই দিতাম। চামারগিরি করিস না বিশু।’

‘তুই মাইরি, অকারণে বিগড়োচ্ছিস পটলি! এই বৃষ্টি-বাদলার দিন—এখন শালা শ্মশানে যেতে হলে পেঁচো, বীরে, কেলো—তিন শালাকে খুঁজে বের করে ধরতে হবে। মুফতি কেউ যেতে চাইবে না। অন্তত গায়ের ব্যথাটা মারবার খরচা দিবি তো। আচ্ছা যা, দুটো পাঁইটই দিস—তোর বাপ ভাতার যখন নয়—এক রকম মাগনাতেই চিতেয় উঠিয়ে দেবো। আর কিছু বলিস না মাইরি, তোর পায়ে পড়ি!’

আঙুর হাঁ হুঁ কিছু বললে না। মাথা নাড়ল না। সায় দিল না। রাস্তার আলো শোষা অন্ধকার, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আর বিক্ষিপ্ত লোক-জন, দোকানপাটের দিকে নির্জীবের মতন চেয়ে থাকল।

বিশু বললে, ‘যা শালা, কাঠ না হয় পাঁচ মণের মধ্যেই সেরে দেবো। বাপ, ভাতার কিছুই নয় যখন তোর—আধাপোড়া হলেও ক্ষতি নেই। টান মেরে গঙ্গায় ফেলে দিলেই হবে। আরও গোটা ছ’সাত টাকা জোগাড় করে ঝপ করে আয় দেখি, পটলি। হাঁদুর দোকানে আছি।’

বিশু চলে গেল। আঙুর চুপ করে দাঁড়িয়ে। আরও সাত টাকা সে কোথায় পাবে, কার কাছে হাত পাতবে!

ফিরতে লাগল আঙুর। যেন ভীষণ জ্বরে তার সর্বাঙ্গ অবশ, অচেতন। কিছু আর দেখতে পাচ্ছে না, ভাবতে পারছে না।

যাক, মেথর মুদ্দোফরাসেই টেনে নিয়ে যাক নন্দকে, টেনে নিয়ে গিয়ে ভাগাড়ে ফেলে দিক গে। কী করবে আঙুর, কী আর করতে পারে! নন্দর ওপর তার এত বেশি রাগ হচ্ছিল যে লোকটাকে যদি বাঁচা অবস্থায় পেত, আঁচড়ে কামড়ে মেরে-ধরে কুরুক্ষেত্র করত আজ। মরেও আমার হাড়মাস জ্বালাচ্ছে গো! আর এ কী অসহ্য জ্বলন! আঙুরের কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।

বড়ো রাস্তা ধরে আবার তাদের পটির কাছে এসে পড়ল প্রায় আঙুর। আসবার সময় চোখ রেখে আসছিল, যদি তেমন কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যার কাছে একটা দুটো টাকা হাত পেতে চাওয়া চলে।

লোক তো অনেক যাচ্ছে আসছে। কিন্তু ওরা কেউ আঙুরের আঁচলে টাকা ছুঁড়ে দেবে না মুফতিতে। না নন্দর ভাগ্যে আর চিতেয় ওঠা হল না। হবে কোথা থেকে? অমন ঠগ, জোচ্চোর, শয়তান মানুষের কি আর দাহ হবার পুণ্য আছে। একে বলে প্রায়শ্চিত্য। বামুনের ছেলে—এবার মেথর ধাঙড়ের হাতে যা, যেমন করে কুকুর শেয়াল যায় তাও আবার কোন ভাগাড়ে যাবি কে জানে।

আঙুরের ঘাড়ের কাছটা ব্যথা করছিল। মাথার মধ্যে দপ দপ করছে, শিরদাঁড়াটা যেন মাঝখানে মচকে যাবে। চোখের সামনে সব ঝাপসা ঝাপসা—অদ্ভুত!

হল না। আর হল না। একটা মানুষ মরল , তার দাহ হল না। কেউ সে-দায় নিল না! কেন নেবে? নন্দ তাদের বাপ, ছেলে, স্বামী, ভাই—কেউ না।

হঠাৎ মানিকবাবুর সঙ্গে দেখা। হনহনিয়ে ছাতা মাথায় চলেছে। আঙুরের কি যে হল, প্রায় ছুটে গিয়ে মানিকবাবুর পথ আগলে ফেলল।

মানিকবাবু চিনতে পারলে না। ‘কে? কী চাও?’ আঙুরকে দু-হাত তফাতে রেখে মানিক মুন্সি যেন এ-পটির মেয়ের ছোঁয়া বাঁচাচ্ছিল।

আঙুরের অত আর দেখবার সময় নেই। গড়গড় করে বলে গেল আঙুর ‘আপনি বাবু, একদিন এসে আমাদের ভোট কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন দাড়িবাবুর জন্যে। বলেছিলেন আপদ-বিপদ সুখ-সুবিধে দেখবেন। আজ আমার বড়ো বিপদ। ঘরে মড়া পড়ে পচছে, পুড়োতে পারছি না। একটা ব্যবস্থা করে দিন বাবু। অন্তত দাড়িবাবুর থেকে চেয়ে সাতটা টাকা দিন।’

মানিক মুন্সি খিঁচিয়ে উঠল, ‘আহা কী আমার আব্দার রে মাগির, টাকা দিন। কেন, দাড়িবাবু তোমায় টাকা দেবেন কেন? তোমার ঘরে লোক মরবে আর মিউনিসিপ্যালিটির মেম্বারবাবু তাকে খরচা করে পোড়াবে। যাও, যাও,—ওসব আব্দার রাখ। দাড়িবাবুর সঙ্গে দেখা করতে হয়, কিছু বলতে হয়, কাল বেলা দশটার পর অফিসে যেও।’

মানিক মুন্সি চলে গেল। আঙুর থ। কাল বেলা দশটা। মানুষ মরল আজ দুপুরে, তার দাহের জন্যে পা ধরতে যেতে হবে কাল বেলা দশটায়। আর সারা রাত ভোর তার ঘরে মরাটা পচুক।

আঙুর বুঝতে পারছিল, দায়টা আর কারুর নয়—তারই। যে দায়ে তাদের বেশ্যাপট্টির ঘরে ঘরে ঘুরেছে, পান মিষ্টি খেতে জনে জনে টাকা দিয়েছে। আজ তার দায় নেই।

চোখ ফেটে কান্না আসছিল আঙুরের।

কিন্তু কাঁদল না আঙুর। চোখ পড়ল সামনের দোকানটায়। পানের দোকানের মতো একফালি দোকান। রাস্তার সঙ্গে মেশান নীচের দোকানটায় বসে মুড়ি, ছাতু-টাতু বিক্রি করে একজন। ওপরটায় অন্য জনের দোকান।

আয়না দিয়ে সাজানো। হরেক রকম শিশির থাক। আতর, জর্দা, সূর্তি আর সূর্মার সঙ্গে মোদকও বিক্রি হয় ও-দোকানে।

একটু তফাতে দাঁড়িয়ে লোকটাকে দেখতে দেখতে আঙুরের দু’টো চোখ হঠাৎ কিসের আঁচে যেন জ্বলে উঠল। হ্যাঁ, লোকটাকে ভালো করেই চেনে আঙুর। ওর নাম প্রভুলাল। আর এও জানে আঙুর, ওকে দেখলে প্রভুলালের শরীরটা কেমন কিলবিল করে ওঠে। যেন জ্বর লেগে যায়। দাঁত মুখ, চোখ, গা—সব যেন কসমস করে, কাঁপে ভেতর ভেতর , টসটসিয়ে ওঠে। তখন লোকটার একটা চোখ চক-চক করে, ভীষণ চক-চক, আর অন্য চোখটা—যেটা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে, ঝুলে পড়েছে, মাছের পিত্তির মতন গলাগলা, সবুজ—সেটা যেন আরও কুচ্ছিত হয়ে ওঠে। প্রভুলালের কালো কুচকুচে ফোলা ফোলা মুখ থেকে দাঁতগুলো তখন যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। জিভ দিয়ে লাল পড়ে।

আঙুরের দিকে প্রভুলালের নজরটা বরাবরই এইরকম। কেন, কে জানে। আঙুর বুঝতে পারে না। এক-একটা লোকের এক-একজনের ওপর এ-রকম হয়। দাঁত উঁচু টোপা-কপাল ঝুমুরের ওপর তা না হলে এমন সুন্দর মানুষটার চোখ পড়ে মন্টুবাবুর। মন্টুবাবু তো ঝুমুরকে এখান থেকে উঠিয়েই নিয়ে গেল।

আঙুর জানে, তার রূপ গেছে। অমন ব্যাধি থাকলে না ঝরে উপায় নেই। আর ব্যাধির কি ঠাই বিচার আছে। এমন জায়গায় গুছিয়ে বসল যে, আঙুরের আসলটাই গেল। অম্বিকা ডাক্তার বলেই দিয়েছিল খুব সামলে সুমলে থাকবে। বেশি অত্যাচার করো না। ছেড়ে দিতে পারলেই ভালো। নয়ত একদিন এতেই মরবে।

সেই থেকে আঙুরের অবস্থা পড়ে গেল। নয়ত আতা, চিনু, চামেলির বড়ো মুখ ওকে সইতে হত না। ঈশ্বর যাকে মারেন—তার আর উপায় কী! তাও একটা বছর আঙুর কত সাবধানে থেকেছে। নেহাত যখন পেট ভরাবার চালডালটুকুই বাড়ন্ত হত—তখনই আঙুরকে গলির মুখে এসে দাঁড়াতে হত সেজেগুজে।

রোগটা ভেতরের—তাই ওপরটায় আজও আঙুরের কিছু কিছু আছে। মুখখানাই শুধু যে ভালো তা নয় , বুক কোমর চলন-টলনগুলোও এখন পর্যন্ত ভালো আছে। বিশেষ করে সামনাসামনি দেখলে—আঙুরের এই আশ্চর্য ভরাট গলা-ঘাড়-বুকের দিকে চেয়ে থাকতে পারা যায় না।

প্রভুলালের দোকানের দিকে পা পা করে এগিয়ে যেতে লাগল আঙুর। লোকটাকে কী ঘেন্নাই করত ও , প্রভুলালের কালো কুচকুচে, থলথলে মোটা ভোঁদড়ের মতো শরীর—আর ওই কুচ্ছিত মুখ মাছের পিত্তির মত গলাগলা একটা চোখ, যেটা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে—দেখলেই আঙুরের গায়ে কাঁটা দিত, ঘিন ঘিন করত সারা গা, ভয় ভয় লাগত। বেশিক্ষণ তাকাতে পারত না লোকটার দিকে। নয়ত প্রভুলাল কতবারই তো ঘুরঘুর করেছে—আঙুর প্রশ্রয় দেয়নি। মাগো, ওই লোকটার সঙ্গে কি শোয়া যায় নাকি? আঙুর তাহলে মরেই যাবে।

আজ আর এত কথা ভালো করে ভাবতে পারল না আঙুর। বরং ভাবছিল, প্রভুলালও যদি মাথা নাড়ে। না বলে।

ধুক ধুক বুকে প্রভুলালের দোকানের একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল আঙুর।

‘সুর্মা আছে?’ মুচকি হাসল আঙুর। একটু হেসে দাঁড়াল।

প্রভুলাল প্রথমটায় অবাক। তারপরে যেন কোথাও একটা পালকের সুড়সুড়ি খেয়ে সারাটা গা-মুখ বেঁকিয়ে বুঁকিয়ে ফুলিয়ে হাসল। গলার মধ্যে সর্দি-জড়ানো আওয়াজের মতন ভাঙা আবেগ-স্বর উঠছিল।

সুর্মার দিকে হাত বাড়াল না প্রভুলাল। আঙুরের দিকে চেয়ে একটু ঝুঁকে পড়ল, ‘কী খবর—আঁ—তুমি কাঁহা ভাগ গিয়েছিল! শালা সারা পট্টি আনধার হয়ে গেল।’

হাসি আসছিল না। তবু আঙুর হাসল। যেন একটা ঝাপ্টা খেয়ে প্রভুলালের কোলের ওপর পড়তে পড়তে সোজা হল। এলোমেলো আঁচলটা তো হাতে লুটোচ্ছিল, বুকের কাপড়টাও কখন সরিয়ে একপাশে গুটিয়ে দিয়েছে আঙুর। ”মসকরা থাক। সুর্মা আছে কিনা বলো। না থাকে তো যাই।” আঙুর মাঝ কোমর থেকে বুক পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আবার টেনে নিল। ঠিক যেমন লাট্টু ঘুরোতে লেত্তিকে ছেড়ে দিয়ে টানতে হয়। গলা বেঁকিয়ে চোখের পাশ দিয়ে বিভ্রম ছুঁড়ল।

‘আছে, আলবৎ আছে।’ প্রভুলালের চোখ চকচক করছে, ‘তোমাদের আঁখে সুর্মা লাগাতেই তো বসে আছি।’

‘থাক, তোমায় আর লাগিয়ে দিতে হবে না। হাতে পিঁপড়ে ধরে যাবে।’ আঙুর আর এক দফা হেসে—প্রভুলালের বসবার জায়গাটার কাছে বেঁকে কনুই ভর দিয়ে দাঁড়াল। গালে হাত রাখল। ঘাড় হেলিয়ে মুখ-চোখ তুলে ধরল।

ঠেলে বেরিয়ে আসা মাছের পিত্তির মতন প্রভুলালের চোখটা যেন গলে গলে পড়ছিল। আঙুর চোখ বুজল।

‘কিরপা থোড়ি কুছ হো যাক আঙুগুরী! শালা কী চোট যে আছে তুমার বাস্তে।’ প্রভুলাল কখন তার গরম হাতটা দিয়ে আঙুরের কনুইয়ের ওপরটা ধরে ফেলেছে।

আঙুর সেই অবস্থায় জোরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে টেনে টেনে একবার নিশ্বাস নিল, আস্তে আস্তে ছাড়ল। বুক উঠল, নামল। ঠোঁট কামড়ে, বাঁ-চোখ টিপে হাসল আঙুর।

‘তোমার পচা আতরের গন্ধ ক-দিন থাকবে গো!’ আঙুর ঠোঁট উলটাল।

‘পচা নেই, আসলি আতর দেবো যে ক-দিন রাখতে চাও।’ প্রভুলাল আঙুরের গালে টোকা মারল।

আঙুর বলল। ‘দশটা টাকা আজ দাও তবে।’

‘দশ—?’ প্রভুলাল থতমত খেয়ে গেল, ‘দ-শ কি রে?’

‘দরকার আছে, দশ দাও। আগাম দাও—।’

‘আগলি?’

‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়ল আঙুর, ‘দশ না পারো—সাত আটটা টাকা দাও।’

মনে মনে হিসাব করে নিল প্রভুলাল। নীচু গলায় বললে ‘বহুত আচ্ছা, আট টাকা দেবো। মাগর—’ প্রভুলাল কুচকুচে কালো মুখে, গোফের ডগায় হিসেবী একটা হাসি তুলল। আঙুল দিয়ে দেখাল দিনের হিসেবটা। প্রায় সপ্তাহভর আর কি!

ও-সবের দিকে চোখ ছিল না আঙুরের। হাত পাতল আঙুর। ‘টাকা’।

প্রভুলাল আঙুরের গালটা টিপে দিল। ‘তু যা পাগলি, ঘর যা সুরতটুরত থোড়া ঠিক করে লিগে যা , একদম কলকত্তাবালী হয়ে যা। দোকান বনধ করে আমি আসছি। টাকা লিয়ে যাব।’

আঙুর ভীষণভাবে চমকে উঠল। সমস্ত শরীরটা হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেছে। পা পাথর। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল আঙুর প্রভুলালের দিকে।

‘কি রে?’ প্রভুলাল আতরের শিশিটিশি, জর্দার নিক্তি ওজন গোছাতে লাগল। আঙুর তার সদ্য নিবন্ত চোখ তুলে আস্তে গলায় বলল, ‘আমার ঘর না, তুমি অন্য কোথাও বল।’

এ-রকম কথা প্রভুলাল জীবনে আর শোনেনি যেন। ‘বাঃ—! টাকা তুমি লেবে আঙুগুরী—আর ঘর ঢুঁড়ব আমি। তব তো দুসরা আওরাত ভি—।’

আঙুরের চোখের ওপর প্রভুলালের মুখও আর ভাসছিল না। আলো, আয়না, হরেকরকম শিশি—আর ফাঁকা ফাঁকা ঝাপসা সব কী যেন! প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে হলুদ বিকারের চোখে মানুষ যেমন কী দেখছে জানে না, বোঝে না, চেতনায় চিনতে পারে না, তেমনি।

একটু পরে আঙুর মাথা নাড়ল। ‘বেশ, তবে তাই, আমার ঘরেই এস তুমি। তাড়াতাড়ি।’

প্রভুলালের দোকানের সামনে থেকে একটা অন্য রকম শরীর আর পা যেন জলো হাওয়া আর অন্ধকার আর পচপচে রাস্তা গলি দিয়ে নেশার ঘোরে টলতে টলতে মিশিয়ে গেল।

আঙুরের বুকের মধ্যে শব্দগুলো এলোমেলো। সমস্ত মাথাটা ঠাসা , কিচ্ছু বুঝতে পারছে না, চোখে ঠাওর করতে পারছে না। হাত-পা সাড় পাচ্ছে না। একটা দম দেওয়া পুতুলের মতন যা হবার হয়ে যাচ্ছে, আপনা থেকেই।

কুপি জ্বেলেছে আঙুর। ধুনো পুড়িয়ে দিয়েছে ঘরে। ক’টা ধূপও। বাক্স থেকে শাড়ি বের করতে গিয়ে পাটের শাড়ি খুঁজেছে প্রথমে—তারপরেই মনে হয়েছে আতাকে বিক্রি করে দিয়েছে সেটা খানিক আগেই। তাঁতের ঘোর লাল রঙের ছেঁড়া ছেঁড়া শাড়িটা তাড়াতাড়ি গায়ে পরে নিয়েছে, সেই সাটিনের পুরনো বডিজটা পর্যন্ত। চুল বেঁধেছে। আলতা দিয়েছে পায়। টিপ আর কাজল।

প্রভুলাল এলো। ঘরটা বড়ো অন্ধকার। ‘লণ্ঠন কি হল? টুট গিয়া—’ আতরের গন্ধ প্রভুলালের জামায়। হাতে পানের ঠোঙা। মুখে একগাল পান, জর্দা।

প্রভুলালের চোখ লালচে, চকচকে। মাছের পিত্তির মতন চোখটা যেন গলেই গেল। ওর নাকের নিশ্বাসে হিসহিস শব্দ। লাল দাঁতগুলো তৈরি, খাবারটা পেলেই যেন চিবিয়ে চুষে সাবাড় করে দেয়।

আঙুরের শরীরটা যেন নদীর জলে ভাসছে—সাড় হারিয়ে। কী হচ্ছে ও জানে না, বুঝতেই পারছে না। মনটা শুধু সময় গুনছে—রাত কত হল! বিশু কি থাকবে হাঁদুর দোকানে? যদি বৃষ্টি আসে ঝমঝমিয়ে আবার! তবে কী হবে? সারারাত কি ফেলে রাখতে হবে! দোষ ধরল না তো! শনির দুপুরের মড়া।

নিজেকে দেখতে পাচ্ছে না আঙুর। কুপির আড়াল পড়েছে। একটা ভাগাড়ের খ্যাপা কুকুর দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে তাকে।

মনের জ্বালাটা আরও বাড়ছে বাড়ুক। কিসের ওপর, কার ওপর সে প্রতিশোধ নিচ্ছে, তা জানে না। তবে অনুভব করতে পারছে, এই কষ্ট—এই যন্ত্রণা অনেকটা তেমনি।

আবার কি বৃষ্টি এল? না, বৃষ্টি নয়। বৃষ্টি যেন আর না আসে হে মা কালী! কোনো গতিকে শ্মশান পর্যন্ত যেতে দাও। চরণে পড়ি তোমার।

প্রভুলাল খুশি। আঙুর হাত পাতল। চর্ব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয় খেয়ে যেমন হোটেলের দাম মেটায় মানুষ—তেমনি, ঠিক তেমনি আরও দু’খিলি পান জর্দা মুখে দিয়ে রুপোর দাঁত-খোঁটা কাঠিটা দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে আটটা টাকা দিল প্রভুলাল হেসে-হেসে। আঙুরের গালটা আর একবার টিপে দিয়ে চলে গেল।

টাকা আটটা আঁচলে বেঁধে নিল। আগের টাকাগুলোও। তারপর বাইরে এসে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিল। আঁট করে।

আতা চামেলিদের ঘরে তখন আলো, হাসি, হুড়োহুড়ি, ঝুমঝম তালি, বেসুরো গান আর দিশি মদের গন্ধ।

আঙুর তর তর করে দাওয়ায় নেমে গেল। তারপর বাইরে। সদর রাস্তায়। হাঁদুর দোকানে বিশু কি আছে এখনও!

বিশুদের নিয়ে ফিরল আঙুর। দরজা খুলে ঢুকল।

পিছু পিছু বিশু।

‘কই মড়া কই! আ, খুব বাহারে ধুপ জ্বালিয়েছিস তো, পটলি।’ বিশু নাক টেনে গন্ধ নিল ধূপের।

আঙুর লণ্ঠন জ্বালাল।

বিশু তাকাল এদিকে, ওদিকে। ‘মড়া কই?’

আঙুর আঙুল দিয়ে চৌকির তলাটা দেখিয়ে দিল।

বিশু মুখ নীচু করে দেখল। অবাক ও, চোখের পাতা পড়ল না।

‘ওর মধ্যে সেঁধিয়ে গেল কী করে?’

আঙুর সে-কথায় কোনো জবাব দিল না।

বিশু একটু অপেক্ষা করে সঙ্গীদের ডাকল। ডাকবার আগেই পেঁচো, বীরে, ঢুকে পড়েছে।

বিশু বললে, ‘বাঁশ এনেছিস তো, লে শালাকে টেনে বের করে বাঁধ।’

মড়া নিয়ে বিশুদের বেরুতে খুব একটা সময় লাগল না। ওদের সঙ্গে সঙ্গে আঙুর দাওয়ায় নামল।

আঙুর বলল, ‘হরিবোল দিবি না?’

বিশু জবাব দিল, ‘চল, রাস্তার গিয়ে দেবো। এখানে রসের হাটে হরিবোল দিলে শালাদের মেজাজ গণ্ডগোল হয়ে যাবে।’

বিশু কেলো সামনে—পেঁচো আর বীরে পেছনে। মাদুরে জড়ানো দড়ি দিয়ে বাঁধা নন্দর ধড় বাঁশের ওপর চাপিয়ে চারটে লোক দাওয়া দিয়ে এগিয়ে গেল। চারটে ছায়া। আর আঙুর পিছন পিছন।

আতার ঘরে তখন বস্ত্রহরণ পালার হাসি-উল্লাসের ঝাপ্টা বয়ে যাচ্ছে।

শ্মশানে এসে পৌঁছতে প্রায় মাঝ রাত হয়ে গেল! কেলো গেল কাঠ আনতে পেঁচো পাঁইট আনতে। কাছাকাছি সে-ব্যবস্থা আছে। বিশু বিড়ি ফুঁকতে লাগল। আর বীরে একটা সিনেমার গান গাইতে লাগল, সদ্য কেনা হাঁড়িটার পেছনে বোল তুলে।

আঙুর চুপ করে বসে থাকল এক পাশে।

বিশুর দলের বাহাদুরি বলতে হবে—ঘন্টাখানেকের মধ্যে সব ঠিক করে ফেলল। গঙ্গার জলে ধোয়ান হল নন্দর দেহ। চিতে সাজিয়ে শোয়ান হল। এবার মুখে আগুন দেওয়া। পাঁকাটিতে আগুন ধরিয়ে বিশু আঙুরের দিকে এগিয়ে দিল। বললে, ‘নে পটলি, মুখে আগুনটা দিয়ে দে।’

আঙুর চমকে উঠল। নন্দর মুখে আগুন দেবে ও? কেন? নন্দর সঙ্গে তার সম্পর্ক কিসের? কিছু না। কেউ না নন্দ ওর।

আঙুর মাথা নাড়ল। ”আমি কেন দেবো। না—না, তোমরা কেউ দিয়ে দাও।”

‘দিবি না তুই? লে কেলো, তুই-ই তবে দিয়ে দে শালার মুখে আগুন।’

কিন্তু কেলো ততক্ষণে একটু পাশে গিয়ে পাঁইটে মুখ দিয়েছে। পেঁচো বলল আঙুরকে, ‘আহা দাও না তুমি। তোমার সঙ্গে তবু তো জানাশোনা ভাবসাব ছিল খানিকটা, আমরা তো সব রাস্তার লোক।’

জানাশোনা, খানিকটা ভাবসাব? তা হ্যাঁ, তা ছিল বই কি? আঙুর সেটা অস্বীকার করতে পারে না। এত লোকের মধ্যে একমাত্র আঙুরই তবু নন্দকে চিনত, জানত। ওর সঙ্গে এক ঘরে থেকেছে, খেয়েছে, শুয়েছে। সখের স্বামী-স্ত্রী খেলা—তাও খেলেছে। শাঁখা-সিঁদুরও পরেছে।

পাঁকাটিটা জ্বলছিল। সে-দিকে তাকিয়ে আঙুর কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেল। তারপর হাত বাড়াল বিশুর দিকে।

জ্বলন্ত পাঁকাটি নিয়ে নন্দর মুখের কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়াল আঙুর। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে পাঁকাটিগুলো। সেই আলোয় নন্দর শুকনো তোবড়ানো, বাসি ডিমের সিদ্ধ মতো মুখটা অদ্ভুত দেখাচ্ছে। যেন সব যন্ত্রণার শেষ ঘা খেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

‘সামলে রে পটলি, শাড়িতে আগুন ধরে যাবে।’ বিশু হাঁকল।

আঁচলটা সামলাতে গেল আঙুর। এক্ষুনি পাঁকাটির আগুন লেগে যেত।

কিন্তু শাড়ির আঁচল সামলাতে গিয়ে পাঁকাটির আগুনে যেন হঠাৎ কী দেখল আঙুর।

দেখে নিথর হয়ে গেল! মনের মধ্যে কী যে অস্বস্তি জাগল! গা ঘিন ঘিন করে উঠল!

নিজেকে বড়ো অশুচি অশুচি লাগছিল। এই শাড়ি পরে একটু আগে প্রভুলালের সঙ্গে সে শুয়েছে। এখনো সেই ভাগাড়ে কুকুরটার—?—না ‘এই বস্ত্রে কারুর মুখে আগুন দেওয়া যায় না। নন্দ স্বর্গে যাবে কি নরকে যাবে—কে জানে, তবে এই সংসার তো ছেড়ে চললই। এ সময়ে আর খুঁত থাকে কেন?’

পাঁকাটি ক’টা মাটিতে নামিয়ে রেখে আঙুর হনহনিয়ে এগিয়ে গেল।

‘কোথায় যাচ্ছিস আবার?’ বিশু অবাক।

‘আসছি। গঙ্গায় একটা ডুব দিয়ে আসি। আঙুর তরতরিয়ে ডাইনে ঘাটের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

ধাপ ভেঙে গঙ্গার জলে এসে দাঁড়াল আঙুর। আকাশটা লাল। একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না। হাওয়া বয়ে যাচ্ছে হুহু। গঙ্গার জল কালো। একটা শব্দ উঠেছে স্রোতের। ঘাটে আছড়ে পড়ার।

জলে পা দিয়ে একটু দাঁড়িয়ে এই আকাশ, এই জল, এই নিস্তব্ধতা যেন মনে, বুকে, গায়ে মেখে নিচ্ছিল আঙুর। মাথাটা ছাড়িয়ে নিচ্ছিল, ঘোলাটে মনটাকে ধুয়ে নিচ্ছিল আঙুর। কেমন একটা পচা গন্ধ এসে নাকে লাগল আচমকা। নিশ্চয় কোনো গলা-পচা গোরু ছাগল কি মোষটোষ হবে, জলে ভেসে এসেছে। আধপোড়ান মানুষ-টানুষও হতে পারে।

‘বড়ো বিশ্রী গন্ধ। এদিক ওদিক চাইল আঙুর। নাক বন্ধ করল। একটু পরে আবার খুলল। আর ধক করে যে বিশ্রী গন্ধটা নাকে এসে লাগল সেই গন্ধটা বড়ো চেনা ঠেকল। হ্যাঁ, বিশুর গায়ে এই গন্ধ ছিল, এই গন্ধ আছে আতা, বেদনামাসি, প্রভুলালের গায়ে। সর্বত্র।’

আঙুরের চোখের সামনে সত্যিকারের গঙ্গা যেন এইবার আলো হয়ে উঠল। কোথায় সে পাপ ধুতে এসেছে, অশুচি ছাড়াতে—?

মাথার মধ্যে একটা শিরায় যেন ফস করে কেউ দেশলাইয়ের কাঠি ছুঁইয়ে দিল।

জ্বলে উঠল সমস্ত শিরা স্নায়ুগুলো। অশুচি, কিসের অশুচি? গঙ্গাজল তার কোনটা ধোবে—বস্ত্র না দেহ না মন। বেদানামাসি, হিমুর গা অনেক ধুয়েছে গঙ্গা। কী দিয়েছে?

গঙ্গার জলে একটা লাথি মারল আচমকা আঙুর। আর তারপর ছুট। ছুটতে ছুটতে এসে জ্বলন্ত পাঁকাটি ক’টা নিয়ে নন্দর মুখে ঠেসে দিল।

আগুন ধরল। আঙুর চুপ করে দাঁড়িয়ে। এখানে আগুন, ওখানে আগুন। আ! সাজিয়েছে বটে বিশুরা চিতা! শুকনো কাঠ বেছে এনেছিল। চোখের পলকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল চিতা।

খানিকটা পিছিয়ে এসে আঙুর দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিশুরা একটা পাঁইট শেষ করে আর একটা খুলল।

আকাশটা লাল। খুব লাল। বৃষ্টি না এসে পড়ে।

নন্দর মুখটা আর দেখা যাচ্ছে না। বীরে খুঁচিয়ে দিচ্ছে এ-পাশ ও-পাশ। লাঠি মারছে।

আঙুর অপলক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে এই অদ্ভুত দাহ দেখছে।

আগুনের হলকাটা হঠাৎ ধক করে বেড়ে উঠল। সমস্ত চিতাখানা টকটকে লাল। সে-দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আঙুর আচমকা খিল খিল করে হেসে উঠল। হাসি আর থামে না। যেন মাতাল হয়ে গেছে।

বীরে খোঁচাচ্ছে। বাঁশ দিয়ে পা ভেঙে দিচ্ছে শবের। পেটাচ্ছে। কাঠ পুড়ে পুড়ে ভাঙছে —মট মট। হাড় ফাটছে নন্দর। ফেটে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে না!

আর আঙুরের কানে সেই শব্দগুলো লাগছে ভয়ানক ভাবে। ছটফট করছে আঙুর। যেন তার বুকের হাড়গুলো কেউ মট মট করে ভেঙে দিচ্ছে। বুকের মধ্যে থেকে এক খাবলা কিছু নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ওই আগুনে।

আঙুর আর পারছিল না। অস্থির হয়ে উঠেছিল। কী যে অসহ্য একটা জ্বালা দাপাদাপি করছে তার মধ্যে। মোচড় দিয়ে উঠছে সারাটা বুক। কণ্ঠার কাছে টনটনে ব্যথাটা ফুলছে আর ফুলছে।

আঙুর পারছিল না। ওই চিতা দেখছিল নন্দর। আর মনে মনে ভাবছিল সব—সব তোমরা সমান। সবাই। তুমি, হিমু, বেদনামাসি, হাসপাতাল, ডাক্তার, আতা, বিশু, মানিকবাবু, প্রভুলাল—সবাই। তেমনি তোমাদের গঙ্গা। সবই তো এ সংসারেরই কাদা, মাটি, জল। এক ছাঁচ, একই নকশা।

আঙুরের কষ্ট হচ্ছিল, অযথাই সে একা নন্দর ওপর রাগ আর ঘেন্না আর জ্বালা নিয়ে থাকল।

আঙুর কাঁদল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, ফুঁপিয়ে। ঠোঁট কামড়ে ধরে। নন্দর চিতার আগুন যেন তার সমস্ত চোখ মন শরীর জুড়ে জ্বলছে। বড়ো দুঃসহ সে-আগুন। বড়ো স্পষ্ট। সবকিছু তার আলোয় ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। এই সংসার, এখানের ভালোবাসা, ঘর গড়া, ঘর ভাঙা, মানুষ, মানুষের ব্যবহার, মন।

আঙুর ডুকরে উঠল। সকলকে চমকে দিয়ে। এই প্রথম। হঠাৎ, হঠাৎই। বর্শায় খোঁচা খাওয়া একটা পশুর মতো সমস্ত জায়গা কাঁপিয়ে, থরথরিয়ে। তারপর গুমরে গুমরে। কাতরে কাতরে।

আঙুরের ইচ্ছে হচ্ছিল, ওই চিতার কাছে ছুটে গিয়ে নন্দর আধপোড়া ঝলসানো পা দুটো বুকে চেপে ধরে। মাথা খোঁড়ে।

আঙুর সত্যিই ছুটে যাচ্ছিল। বিশু খপ করে তার কোমর জড়িয়ে ধরল। ‘কি রে পটলি মরবি নাকি?’

না, আঙুর মরবে না। চোখ তুলে বিশুর দিকে চাইল ও। তারপর আকাশের দিকে! এ-পাশ, ও-পাশ। চিতা এবং গঙ্গার দিকেও। যেন এই সংসারের আকাশ, মাটি, মানুষ, জন—সব তার চেনা হয়ে গেল। আর সে মরবে না, কাঁদবে না।

সকল অধ্যায়

১. বিচারক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. ডালিম – চিত্তরঞ্জন দাশ
৩. চন্দ্রমুখী – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪. ঠিকানায় ‘বুধবার’ – জগদীশ গুপ্ত
৫. কুসুম – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৬. আদরিণী – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
৭. সাকীর প্রথম রাত্রি – রমেশচন্দ্র সেন
৮. হিঙের কচুরি – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. মেলা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১০. মন্দ লোক – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. দন্ত কৌমুদী – বনফুল
১২. গোষ্পদ – যুবনাশ্ব
১৩. ইতি – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
১৪. খট্টাঙ্গ পুরাণ – শিবরাম চক্রবর্তী
১৫. দুকানকাটা – অন্নদাশংকর রায়
১৬. চাচা কাহিনি – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৭. বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৮. অঙ্গার – প্রবোধকুমার সান্যাল
১৯. নমুনা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২০. চোর! চোর! – বুদ্ধদেব বসু
২১. বারবধূ – সুবোধ ঘোষ
২২. ট্যাক্সিওয়ালা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
২৩. বাইজি – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৪. তিমিরাভিসার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. জামাই – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
২৬. তলানি – নবেন্দু ঘোষ
২৭. মাশুল – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
২৮. শনি – সন্তোষকুমার ঘোষ
২৯. আঙুরলতা – বিমল কর
৩০. সুর্মা – রমাপদ চৌধুরী
৩১. ঘরন্তী – বিমল মিত্র
৩২. প্রাণ-পিপাসা – সমরেশ বসু
৩৩. বাগাল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৪. ছদ্মবেশিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. নরক – প্রফুল্ল রায়
৩৬. পহেলি পেয়ার – বুদ্ধদেব গুহ
৩৭. নিরুদ্দেশ প্রাপ্তি হারানো – সমরেশ মজুমদার
৩৮. বেওয়ারিশ লাশ – জাহান আরা সিদ্দিকী
৩৯. ঝরা পাতা – তসলিমা নাসরিন
৪০. নিজের সঙ্গে দেখা – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন