উত্তর-দক্ষিণে লম্বা একটা দীঘির চারি পাড় ঘিরিয়া মেলাটা বসিয়াছে। কোনও পর্ব উপলক্ষে নয়, কোন এক সিদ্ধ মহাপুরুষের মহা-প্রয়াণের তিথিই মেলাটির উপলক্ষ।
দোকানীরা বলে, বাবার মাহাত্ম্য আছে বাপু। যা নিয়ে আসবে ফিরে নিয়ে যেতে হয় না কাউকে।
সত্য কথা, দোকানের জিনিসও ফেরে না, যাত্রীর ট্যাকের পয়সাও না।
সিউড়ীর ময়রা নাকি তিন বছর আগে এগারশো টাকা লাভ পাইয়াছিল। গত বছরের মত মন্দা বাজারেও তাহার দুশো টাকা মুনাফা দাঁড়াইয়াছে। সিউড়ীর দোকানের পাশেই লাভপুরের দুখানা মিষ্টির দোকান। একখানা হরিহরের অপরখানা রাম সিং-এর। রাম সিং-এর দোকানের পরই পশ্চিম পাড়ের দোকানের সারি পূর্ব মুখে উত্তর পাড়ে মোড় ফিরিয়াছে।
উত্তর পাড়ে মনিহারীর দোকান সারি বাঁধিয়া চলিয়া গেছে! প্রথম দোকান ঘনশ্যাম ঘোষের। ঘনু আপনার দোকানে বসিয়া বিড়ি টানিতেছিল। খরিদ্দার তখনও জুটে নাই। রাম সিং-এর দোকান তখন সাজিয়া উঠিয়াছে। মাথার উপর সুন্দর একখানি চাঁদোয়া খাটানো হইয়াছে। নীচে তক্তপোশের উপর পাটাতনের সিঁড়ি। শুভ্র একখানি চাদরে ঢাকা সেই সিঁড়ির উপর হরেক রকম মিষ্টি বড় বড় পরাতে সুকৌশলে সাজানো। বরফি যেন পাথরের জালি , রঙীন দরবেশের চূড়া উঠিয়াছে। বড় বড় খাজাগুলি শ্বেতপাথরের থালার মত সাজাইয়া রাখা হইয়াছে। সম্মুখেই গামলায় রসগোল্লা, ক্ষীরমোহন, পান্তোয়া ভাসিতেছে। তারও আগে পথের ঠিক সম্মুখেই ডালায় মুড়িমুড়কী চূড়া দিয়া রাখা হইয়াছে।
বাজারের পথে অল্প দুই-দশটা যাত্রী এদিকে যাওয়া আসা করিতেছিল। তাহাদের উদাসীনতায় ঘনশ্যাম বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। পোড়া বিড়িটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া সে রাম সিং-এর সহিত গল্প জুড়িয়া দিল।
বিকিকিনি যা-কিছু কাল থেকেই শুরু হবে, কি বল সিং?
রামদাস কহিল, সন্ধ্যে থেকেই লোক জুটবে। আনন্দ-বাজার এবার জমজমাট—দেখেছ তুমি?
ঘনশ্যাম উৎসাহিত হইয়া উঠিল। কহিল, সে আমি দেখে এসেছি। এবার একশো চৌত্রিশ ঘর এসেছে। চার দল ঝুমুর। মেয়েগুলো দেখতে শুনতে ভালো হে। চটক আছে।
সিংও সায় দিল, হ্যাঁ, গোটা বিশ পঁচিশেক এরই মধ্যে বেশ। চার-পাঁচটা খুবই খপসুরৎ।
ঘনশ্যাম ঘাড় নাড়িয়া কহিল, কমলি আর পটলি বলে যে দুজন আছে, বুঝেছ! ফেশান কি তাদের। টেরীবাগানো ছোকরাদের ভিড় লেগে গেছে এরই মধ্যে। …কি চাই গো তোমাদের?
একজন যাত্রী পথে দাঁড়াইয়াছিল। সে চলিতে শুরু করিল।
সিং কহিল, ডাইস কত টাকায় ডাক হল জানো?
অন্যমনস্ক ঘনশ্যাম কহিল, এ্যাঁ? ডাইস? দেড় হাজার।
কে ডাকলে?
ঘনশ্যাম উত্তর দিল না।
একটি দশ-এগার বছরের ছেলে দোকানের সম্মুখ দিয়া চলিয়াছিল। তাহার পিছনে একটি ছয়-সাত বছরের ফুটফুটে মেয়ে। মেয়েটি ছেলেটির হাত ধরিয়া টানিল। ছেলেটি কহিল, কি?
ঘনশ্যামের দোকানে দড়িতে ঝুলানো নাগরদোলায় মেম-পুতুল তখনও দমের জোরে বনবন শব্দে ঘুরিতেছিল। মেয়েটি আঙুল দিয়া পুতুলটা দেখাইয়া দিল। ছেলেটিও দাঁড়াইল। পকেটে হাত পুরিয়া কহিল, আয় আয়, ও ছাই।
ঘনশ্যাম তাদের দেখিয়াই গল্প বন্ধ করিয়াছিল। সে কহিল, এসো খুকী, এসো। পুতুল নিয়ে যাও।
সঙ্গে সঙ্গে সে দম দিয়া এরোপ্লেনটা দোলাইয়া দিল। দমের জোরে টিনের প্রপেলারটা ফর-ফর শব্দে ঘোরে, এরোপ্লেনটা দোলে, ঠিক মনে হয় এরোপ্লেনটা উড়িতেছে। মেয়েটি আবার কহিল, দাদা?
ঘনশ্যাম ছেলেটিকে ডাকিয়া কহিল, আসুন খোকাবাবু, এরোপ্লেন নিয়ে যান। দেখুন কেমন উড়ছে।
ঘনশ্যামের কথাবার্তার ভব্যতায় ছেলেটি খুশী হইয়া উঠিল। সে জিজ্ঞাসা করিল, কত দাম?
কিসের? পুতুল না এরোপ্লেনের?
কথার উত্তর দিতে গিয়া ছেলেটি বোনের মুখপানে তাকাইল। বোনটিও দাদার মুখপানে চাহিয়াছিল।
ঘনশ্যাম আবার প্রশ্ন করিল, কোনটা নেবেন বলুন?
দুটোই।
দুটোর দাম দেড় টাকা।
ছেলেটি আর একবার পকেটে হাত পুরিয়া কি ভাবিয়া লইল। পর মুহূর্তে বোনটির হাত ধরিয়া টানিয়া কহিল, আয় মণি।
সঙ্গে সঙ্গে ঘনশ্যাম কহিল, এরোপ্লেনটাই নিয়ে যান খোকাবাবু। দুজনেই খেলা করবেন। ওটার দাম এক টাকা।
সে হাঁটুর উপর ভড় দিয়া খেলনাটার দড়িতে হাত দিয়াছিল।
ছেলেটি কোন উত্তর দিল না। কিন্তু মেয়েটি গিন্নীর মত দিব্য মিষ্টস্বরে কহিল, না মানিক, আমাদের কাছে এত পয়সা নাই।
একদল বাউল একতারা, গাবগুবাগুব, খঞ্জনী বাজাইয়া গাহিতে গাহিতে চলিয়াছিল, ‘রইলাম ডুবে পাঁকাল জলে কমল তোলা হল না।’
পিছনে পিছনে—একদল সংকীর্তনের পুরোভাগে একটি শ্রীমান সন্ন্যাসী নীরবে চলিয়াছে।
ময়রারা বাতাসা ছিটাইয়া দিল। দু’পাশের লোক উঠিয়া প্রণাম করিতেছিল। ঘনশ্যামও উঠিয়া দাঁড়াইল। বাতাসার লোভে সংকীর্তনের পিছনে পিছনে ছেলের দল কোলাহল করিতে করিতে চলিয়াছিল। তাহাদের পাশে পাশে কয়টা জীর্ণ মলিনবসনা নীচজাতীয়া নারী!
সংকীর্তন পার হইয়া গেল।
মেয়েটি তখনও বলিতেছিল, না বাপু আমাদের কাছে দুটি আনি আছে শুধু।
ঘনশ্যাম কহিল, দেখ দেখ কড়াই দেখ। বড় বড় কড়াই আছে। আঃ, যাও না ছোকরা, সামনে দাঁড়িয়ে ভিড় কর কেন?
পিছনে তখন কয়জন যাত্রী দাঁড়াইয়া পরস্পরকে কড়াই দেখাইতেছিল।
মেয়েটির নাম মণি। মণি দাদাকে কহিল, এস ভাই দাদা চলে এস। বকছে ওরা সব।
সিং-এর দোকানে একদল মুসলমান দাঁড়াইয়া মোরববার দর করিতেছিল।
সিং বলিতেছিল, চেখে দেখুন আগে, ভালো না হয় দাম দেবেন না আপনি!
দোকানের ফাজিল ছোকরাটা হাঁক দিয়া কহিল, খেয়ে দাম দেবেন, খেয়ে দাম দেবেন। ক্যাওড়া-দেওয়া জল।
মণি দাদাকে কহিল, মোরববা খাবে না দাদা?
দাদা মণিকে টানিয়া লইয়া আর একটা দোকানের পটিতে ঢুকিয়া পড়িল।
সিং তখন বলিতেছিল, কি বলেন? বাসি? ফল কি কখনও বাসি হয় আজ্ঞে?
ছোকরাটা কহিল, চাখনা মিষ্টির দাম দিয়ে যান মশায়। আপনি খারাপ বললেই খারাপ হবে নাকি?
মণি চলিতে চলিতে হাসিয়া দাদাকে কহিল, সবাই তোমাকে বলছে খোকাবাবু। তোমার নাম জানে না কেউ, অমরকেষ্ট বললেই হয়।
চুপ কর মণি। কাউকে নিজের নাম, বাড়ি বলতে যেও না। চুরি করে পালিয়ে এসেচি মনে আছে তো। খবরদার!
দিন না বাবু, হিলটা একদম ছেড়ে গেছে …লাগিয়ে দিই।
জুতার পটির পথের দু’পাশে মুচীর সারি বসিয়াছিল! অমরের জুতাটির অবস্থা দেখিয়া একজন ওই কথা বলিল।
অমর কথা কহিল না। গোড়ালী-ছাড়া জুতাটায় সত্য সত্যই তাহার বড় কষ্ট হইতেছিল কিন্তু সম্বলের কথা স্মরণ করিয়া সাহস হইতেছিল না। সে মণির হাত ধরিয়া আগাইয়া চলিয়াছিল। মুচীর দল কিন্তু নাছোড়বান্দা। অমর যত আগাইয়া চলে দু’পাশ হইতে তত অনুরোধ আসে—আসুন না বাবু! দিন না বাবু! একদম নতুন বানিয়ে দেব বাবু।
মণি কহিল, কেন বাপু তোমরা বলছ? আমাদের পয়সা নাই—না, আমরা যে বাড়ি থেকে…
অর্ধপথে মণি নীরব হইয়া গেল। দাদার কথাটা তাহার মনে পড়িল।
মুচীটা হাসিয়া কহিল, আসুন খোকাবাবু, হিলটা আমি ঠুকে দিই। পয়সা লাগবে না আপনার।
অমরের মাথাটা যেন কাটা যাইতেছিল। সে ঠাস করিয়া একটা চড় মণির গালে বসাইয়া দিল। মণি কাঁদিয়া উঠিল। মুচীটা তাড়াতাড়ি উঠিয়া মণিকে ধরিতে গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মণি কান্না থামাইয়া কহিল, না না বাপু ছুঁয়ো না তুমি, অবেলায় চান করতে পারব না।
হঠাৎ চড়টা মারিয়া অমর লজ্জিত হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু সে আপনার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করিল না। বেশ গম্ভীর ভাবে কহিল, আয় আয় মণি, চলে আয়।
মণি ক্রোধভরে কহিল, যাবে তাই? কিছুতেই যাব না আমি, সবাইকে বলে দোব সেই কথা।
অমর এবার আগাইয়া আসিয়া মণির হাত ধরিয়া কহিল, লক্ষ্মী মেয়ে তুমি। এস, আবার বাড়ি যেতে হবে।
মারলে কেন তুমি?
ওদিকে কোথায় ডুম ডুম শব্দে বাজীর বাজনা বাজিতেছিল। অমর তাড়াতাড়ি মণিকে আকর্ষণ করিয়া কহিল, আয়, আয় বাজী দেখি গে আয়।
মণি চলিতে চলিতে সহসা থামিয়া কহিল, মখমলের চটি কেমন দেখ দাদা।
অমর কহিল, আয় আয়। ওর চেয়েও ভালো চটি তোকে কিনে দেব।
মণি কহিল, আর বছরে তো তুমি কলকাতায় পড়তে যাবে। আমাকে এনে দেবে, নয় দাদা?
হ্যাঁ—হ্যাঁ দোব।
অমর সিক্সথ ক্লাসে পড়ে।
ভিড় যেন ক্রমশ বাড়িতেছিল।
বড় বড় দোকানগুলির সম্মুখে পথের উপর ছোট ছোট দোকান বসিয়াছে। তাহারা হাঁকিতেছিল…
শাঁক আলু, পালং শীষ!
পয়সা-বাণ্ডিল বিড়ি বাবু।
লাঙলের কাঠ নিয়ে যাও ভাই।
একজন যাত্রী বলিল, লাঙলের কাঠ কত করে ভাই?
দশ আনা, বারো আনা। খাঁটি বাবলা কাঠ।
লাঙলের দোকানের পাশেই ছোট একটি কাঁচের কেসে কেমিকেলের গয়না লইয়া একজন বসিয়াছিল। সে কয়জন নিম্ল শ্রেণীর দর্শককে ডাকিয়া কহিল, তিন পাথরের আংটি একটি করে নিয়ে যেতে হবে যে দাদা! বেশী নয় চার পয়সা করে।
লোক কয়জন চলিয়া গেল না। তাহারা আংটি দেখিতেই বসিল। দোকানদার বলিল, বসো দাদা, বসো।
লাঠির মাথায় কার, ফিতা, গেঁজে ঝুলাইয়া একটি লোক পথে হাঁকিয়া চলিতেছিল—চার হাত কার দু’পয়সা, বড় বড় কার দু’পয়সা, রকম রকম দু’পয়সা—জামাই বাঁধা কার দু’পয়সা। টানলে পরে ছিঁড়বে না, চুল বাঁধলে খুলবে না, না নিলে মন ভুলবে না… দু-দু পয়সা, দু-দু পয়সা।
পটিটার মোড় ফিরিতেই নিবিড় জনতার স্রোত কলরোল করিতেছিল। অমর ও মণি সেই জনতার মধ্যে ডুবিয়া গেল। জনতার গতিরোধ দুইদিকে চলিয়াছিল। একদিকে বাজীর বাজনা বাজিতেছিল। সারিবন্দী তাঁবুগুলো দেখা যাইতেছিল। অমর মণির হাত ধরিয়া তাঁবুর দিকে অগ্রসর হইতে হইতে কহিল, ওই দেখ মণি বাজীর ঘর সব। মণি আঙুলের উপর ভর দিয়া ঘাড় উঁচু করিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল।
কহিল, কই দাদা?
আরও পিছনের দিকে চলিয়াছিল জনতার আর একটা প্রবাহ। সন্ধ্যার আলো তখন জ্বলিতে শুরু করিয়াছে। এই জনতা-প্রবাহের লক্ষ্যস্থানে সমচতুষ্কোণ করিয়া বড় চারিটি ডে-লাইট জ্বলিতেছিল। উজ্জ্বল আলোক কয়টির চারিপাশে সমচতুষ্কোণ করিয়া ছোট ছোট খড়ের ঘরের সারি, বেষ্টনীর মধ্যের অঙ্গনটি লোকে লোকারণ্য হইয়া আছে। দলে দলে মানুষ চঞ্চল হইয়া অঙ্গনে ছুটিয়া চলিয়াছে। স্থানটায় প্রবেশ করিতেই নানা দ্রব্যের সংমিশ্রণে সৃষ্ট একটি উৎকট গন্ধে মানুষের বুকটা কেমন করিয়া উঠে। মদ, গাঁজা, বিড়ি, সিগারেট, সস্তা এসেন্সের তীব্র গন্ধে বাতাস যেন ভারী হইয়া উঠিয়াছে।
অঙ্গনের মধ্যে জনতার স্রোত আগের মানুষের ঘাড়ের উপর মুখ তুলিয়া নিবিড়ভাবে ওই ঘরগুলির দিকে আগাইয়া চলিয়াছে। বালক, বৃদ্ধ, যুবা, বাঙালী, খোট্টা, উড়িয়া, মাড়োয়ারী, কাবুলীওয়ালা, হিন্দু, মুসলমান, সাঁওতাল সব ইহার মধ্যে আছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী সব যেন এখানে একাকার হইয়া গেছে।
একটাই আনন্দ-বাজার অর্থাৎ বেশ্যাপটী।
প্রতি ঘরের দরজায় ছোট ছোট চারপায়ার উপর এক একটি স্ত্রীলোক বসিয়া আছে। আর তাহাদের লেহন করিয়া ফিরিতেছিল অন্ততঃ পাঁচশ জোড়া ক্ষুধাতুর চোখ। সস্তা অশ্লীল রসিকতার মুহুর্মুহু উচ্ছৃঙ্খল অট্টহাসি আবর্তিত হইয়া উঠিতেছিল।
এইখানে তারপর ওই দরজায় আবার আর একটা দরজায়… মোট কথা বিরাম নাই, বিশ্রাম নাই।
মাতালের চীৎকার, আস্ফালনে আকাশের বুকের নিস্পন্দ অন্ধকার পর্যন্ত যেন তরঙ্গিত হইয়া উঠিতেছিল।
সমস্ত সমবেত কোলাহল ছাপাইয়া মাঝে মাঝে ধবনিত হইয়া উঠিতেছিল জুয়ার আড্ডায় উন্মত্ত উল্লাসরোল। অঙ্গনটির ঠিক মধ্যস্থলে আলোটির নীচে জুয়াখেলা চলিতেছে। কোন ঘরে নারীকন্ঠে অশ্লীল গান আরম্ভ হইয়া গেছে। বাহিরের জনতা সে অশ্লীল গান শুনিয়া হো-হো শব্দে হাসিয়া উঠিল।
মানুষের বুকের ভিতরকার পশুত্ব ও বর্বরতা পঙ্কিল জলস্রোতের ঘূর্ণীর মত মুহুর্মুহু পঙ্কিলতর হইয়া এখানে আবর্তিত হইয়া উঠিতেছিল।
ওদিকে কোথায় শব্দ হইল—ওয়াক—ওয়াক।
একটি মেয়ে বমি করিতেছিল। সেই দুর্গন্ধে দাঁড়াইয়াই দর্শকের দল কৌতুক দেখিতেছিল আর দেখিতেছিল অসম্বৃত-বাসা নারীর দেহ।
বমির উপর বসিয়াই গান ধরিয়া দিল—’মরিব মরিব সখি নিশ্চয়ই মরিব?’
জনতা হাসিয়া উঠিল—হো-হো-হো।
একজন পানওয়ালা হাঁকিতেছিল—মনমোহিনী খিলি বাবু, মনমোহিনী খিলি। যে যে-বয়সে খাবে সে সেই বয়সে থাকবে।
প্রজাপতির মত সুবেশা একটি সুশ্রী মেয়ে অঙ্গন দিয়া যাইতে যাইতে গান ধরিয়া দিল—’পান খেয়ে যাও হে বঁধু…’
একজন দর্শক সঙ্গীকে বলিল, দেখেছিস?
অপরজন কহিল, এর চেয়ে ভালো আছে। তার নাম কমলি। ফড়িং বললে আমায়।
মেয়েটি মৃদু মৃদু হাসিতেছিল।
প্রথমজন বলিল, কি নাম তোমার?
মেয়েটি বলিল, চেহারা দেখে নাম বুঝে নাও। কমলিনী ফুলরাণী। বলিয়া হেলিতে দুলিতে আপন ঘরের দিকে আগাইয়া গেল।
শোন শোন। দক্ষিণে…
সিকি আধুলিতে কমল-মালা গলায় পরা হয় না নাগর। গোটা গোটা।
একজন কহিল, মদ খাবে তো!
খাওয়ায় কে? বলি বকে বকে মুখ তেত হয়ে গেল। পান খাওয়াও দেখি নাগর!
একটি ঘরের সম্মুখে কলরোল উঠিয়াছিল।
কোন বন্ধুর গোপন অভিসার বন্ধুর দল ধরিয়া ফেলিয়াছে। কুৎসিত ছন্দে উলঙ্গ নৃত্যে বর্বরতার পায়ে বীভৎসতার নূপুর বাজিতেছিল।
কমলি বলিতেছিল, টাকা দিলেই নাচতে পারি। পয়সা দিয়ে হুকুম কর, আমি তোমার পায়ের দাসী।
একটা ঘর হইতে একটি প্রায়-উলঙ্গ মাতাল একটি স্ত্রীলোককে টানিতে টানিতে বাহির হইয়া পড়িল। মেয়েটিও মাতাল হইয়াছে। পুরুষটি মত্তকন্ঠে কহিতেছিল—আমায় ভালোবাসবি না তুই। তোর নামে আমি নালিশ করব। ডিফরমেশন সুট!
মেয়েটি কহিল, যা যা যা , আমি হাইকোর্ট থেকে উকিল নিয়ে আসব।
সহসা মাতালটার কোন খেয়াল হইল কে জানে, সে মেয়েটিকে ছাড়িয়া দিয়া কহিল, আমি আর সংসারেই থাকব না। সন্নেসী হব আমি।
স্খলিত কাপড়খানাকে টানিতে টানিতে সে চলিয়া গেল। মেয়েটি নেশার তাড়নায় বসিয়া পড়িয়া তখনও আস্ফালন করিতেছিল—তোকে আমি জেলে দেব। ব্যারিষ্টার আনব আমি। কই যা দেখি সন্নেসী হয়ে।
বাজীর ওখানে আসিয়াই মণি আনন্দে চীৎকার করিয়া উঠিল—ওই দেখ দাদা, ওই দেখ !
সে হাততালি দিয়া নাচিয়া উঠিল। ভিড়ে ছাড়াছাড়ি হইয়া যাইবার ভয়ে অমর তাহাকে ধরিয়া ফেলিল।
ব্যাপার আর কিছুই নয়। একটা বাজী-ঘরের সম্মুখে একটা লোক নাক-লম্বা মুখোস পরিয়া নাচিতেছে। পরনের পোষাকটাও তার অদ্ভুত। হাতে এক জোড়া প্রকাণ্ড করতাল।
মণি আবার তাহার জামা ধরিয়া টানিল—ভূত দাদা ভূত। ঐ দেখ ভূত আঁকা রয়েছে। অমর উপরের দিকে চাহিয়া দেখিল সত্য সত্যই সাইনবোর্ডটায় কতকগুলো বড় বড় চামচিকার মত ভূত নৃত্য করিতেছে। ছবিগুলার নীচে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে, ‘ভৌতিক বিদ্যা ও ভোজবাজী।’
অমর চুপি চুপি কহিল, জানিস মণি, এটা ভূতের খেলা, দেখবি?
মণি ঘাড় নাড়িয়াই আছে।
অমরের কিন্তু এত সহজে মন স্থির হইল না। অল্প পয়সায় সব চেয়ে ভালো বাজীটা দেখা তাহার ইচ্ছা।
এটার পরই একটা গেরুয়া রং-এর তাঁবু। সেটার বাহিরে কিছু লেখা নাই। কিন্তু তাঁবুর মধ্যে অনবরত টিং টিং করিয়া ঘন্টা বাজিতেছে।
দুয়ারে দাঁড়াইয়া একটা লোক চীৎকার করিতেছে—এই ফুরিয়ে গেল। চলে এসো ভাই। এক পয়সা।
তার পরেরটায় ইংরাজীতে লেখা ‘ইন্ডিয়ান…।’ তারপর কি অমর তাহা বানান করিল কিন্তু উচ্চারণ করিতে পারিল না—কি, কি, ইউ ডাবল জেড, এল, ই।
মণি তখন আবার নাচিতে শুরু করিয়াছে।
ও দাদা, ও দাদা, নারদ মুনি সায়েব সেজে নাচছে দেখ। অমর ফিরিয়া দেখিল, মণি মিথ্যা বলে নাই। সত্যই বুড়া নারদ মুনির মত দেখিতে। তেমনি দাড়ি, তেমনি গোঁফ, আবার ফোকলা মুখের সম্মুখে দুটি নড়বড়ে দাঁত। নারদ মুনি সাহেবের পোশাক পরিয়া বাজনার তালে তালে ঘাড় দোলাইতেছিল আর গোঁফ নাচাইতেছিল। মণি কহিল, চল দাদা, এইটে দেখি ভাই।
অমর তখন পাশের তাঁবুটার সাইন-বোর্ড পড়িতেছিল। ‘কাটা মুণ্ডু অফ বোম্বাই।’ এক পাশে একটা কবন্ধ, ওপাশে দুইটা মাথাওয়ালা একটা মানুষ, মধ্যে রক্তাক্ত মুণ্ড।
অমরের এই ‘কাটা মুণ্ডু অব বোম্বাই’ দেখিবার ইচ্ছা হইতেছিল। কিন্তু আরও ওপাশে কোথায় ব্যান্ড বাজিয়া উঠিল। মণি অমরের হাত ধরিয়া ওই ব্যান্ডের দিকে টানিয়া কহিল, ওই দাদা ইংরাজী বাজনা বাজছে। আয়, আয়! ওদিকে বড় বড় বাজী আছে।
পিছন হইতে জনতা সকলকে সম্মুখের দিকে ঠেলিতেছিল। নিবিড় জনতার মধ্যে শিশু দুটি চলিতেছিল ঠিক যেন নদীর স্রোতে অর্ধমগ্ন কুটার মত। বাজীর তাঁবুর সম্মুখে একটি পরিসর জায়গায় তাহারা আসিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া বাঁচিল।
প্রকাণ্ড তাঁবুর সম্মুখে উজ্জ্বল আলো জ্বলিতেছে। একটা মাচার উপর দুজন ক্লাউন নমুনা হিসাবে রিং-এর খেলা দেখাইতেছিল। আর একজন ক্রমাগত হাঁকিতেছিল—চলো, চলো, দো-দো পয়সা! দো-দো পয়সা!
সহসা বাজনা থামিয়া গেল। বড় ক্লাউনটা বত্তৃতার ভঙ্গিতে বলিতে আরম্ভ করিল, বাবু লো-ক।
হাঁ—হাঁ। ছোট ক্লাউনটা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল। অমর ও মণি হাঁ করিয়া ক্লাউনদের মুখের দিকে চাহিয়াছিল।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবচেন কি?
কি ভাবছেন মশায়? ঠিক সম্মুখের লোকটির নাকের কাছে ছোট ক্লাউন হাত নাড়িয়া দিল।
লোকটা চমকিয়া উঠিল। ছোট ক্লাউন কহিল, যান ভিতরে যান দেখুন খেলা শুরু হয়ে গেল যে!
তাঁবুর সম্মুখের পর্দাটা খুলিয়া গেল। ভিতরে থিয়েটারের রং-চঙে স্টেজ দেখা গেল। দর্শক দল একটু চঞ্চল হইয়া উঠিল। অমর আঙুলের উপর ভর দিয়া ঘাড় উঁচু করিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল।
স্টেজের উপর তখন নর্তকী-বেশী দুটি মেয়ে দেখা দিয়াছে।
ক্লাউন হাঁকিল, হরেক রকম, রকম রকম দেখবেন। ভিতর যান ভিতর যান।
ক’জন ঢুকিয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে পর্দাটা বন্ধ হইয়া গেল। মেয়ে দুটি ভিতরে তখন গান ধরিয়া দিয়াছে।
আবার ক’জন ঢুকিল।
সহসা পিছনের জনতার মধ্যে কোলাহল উঠিয়া পড়িল—সরে যাও, হাতী—হাতী!
ঠং ঠং শব্দে ঘন্টা দোলাইয়া জমিদারের হাতী বাজারের মধ্য দিয়া চলিয়াছিল। চঞ্চল জনতা চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল।
মণির কাপড় ধরিয়া অমর অনেক দূর পর্যন্ত জনতার চাপে চলিয়া আসিল। একটু খোলা জায়গায় আসিতেই কাপড়ে ঝাঁকি দিয়া কে কহিল, কাপড় ছাড় না হে ছোকরা!
অমর সবিস্ময়ে দেখিল, অপরিচিত একজনের কাপড় সে ধরিয়া আছে। সে কাপড় ছাড়িয়া দিয়া ব্যাকুল হইয়া চারি পাশে চাহিল। কিন্তু কোথায় মণি?
শুধু মণি কোথায় নয়, এতক্ষণে অমরের হুঁস হইল দিন চলিয়া গিয়াছে। মাথার উপরে কালো আকাশ তারায় তারায় আচ্ছন্ন। চারি পাশে দোকানে দোকানে উজ্জ্বল আলোর পণ্যসম্ভার ঝকমক করিতেছে।
অমরের কান্না পাইল মণি! কোথায় মণি!
অমর সম্মুখের দিকে অগ্রসর হইয়া চলিল। মেলাটা তখন লোকে লোকারণ্য হইয়া গেছে। নিজের কোলটুকু ছাড়া ছোট্ট অমর আর কিছুই দেখিতে পাইতেছিল না। ধাক্কায় ধাক্কায় জনতার মধ্যে কোথায় যে আসিয়া পড়িল কিছুই সে বুঝিতে পারিল না।
আনন্দ-বাজারের অঙ্গনমধ্যে উচ্ছৃঙ্খল আবর্ত উচ্ছ্বাস তীব্রতম হইয়া ঘনীভূত হইয়া উঠিয়াছে। বিপুল জনতার মধ্যে একস্থানে নাচ গান চলিতেছিল। অমর বহু কষ্টে ভিতরে প্রবেশ করিয়া অবাক হইয়া গেল।
একজন পুরুষের গলা ধরিয়া সুশ্রী একটি মেয়ে উন্মত্তার মত নাচিতেছিল। বোঁ বোঁ শব্দে ঘুরপাক খাইতেই পুরুষটি মেয়েটিকে ছাড়িয়া দিয়া একপাশে দাঁড়াইয়া টলিতে টলিতে পড়িয়া গেল। উচ্ছৃঙ্খল অট্টহাস্যে জনতা উল্লাস প্রকাশ করিল।
অমর আর একটা জনতার মধ্যে ঢুকিয়া দেখিল সেখানে ডাইস খেলা চলিতেছে। পয়সা টাকা জনস্রোতের মত ঝম ঝম করিয়া পড়িতেছে। খেলোয়াড় হাঁকিতেছিল, এক টাকা দিলে দু’টাকা, দু’টাকায় চার টাকা!
অমর ক্ষণেকের জন্য সব ভুলিয়া গেল। আপনার পকেটে হাত দিয়া নাড়িতে আরম্ভ করিল।
কে একজন তাহার কাঁধে হাত দিয়া কহিল, খোকা, তুমি জুয়ো খেলতে এসেছে? অমর দেখিল আঠারো-উনিশ বছরের একটি খদ্দর পরা ছেলে, মাথায় গান্ধী টুপী।
জুয়া খেলোয়াড় চটিয়া গিয়াছিল, সে কহিল, কেন মশায় আপনি এমন করছেন? আমি দেড় হাজার টাকা জমিদারকে গুনে দিয়ে তবে খেলা পেতেছি। ধর খোকা ধর, এক ঘুঁটিতে ডবল, দু’ ঘুঁটিতে চার গুণ, তিন ঘুঁটিতে ছ’গুণ পাবে, ধর ধর।
অমর ছেলেটির মুখপানে চাহিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল। ছেলেটি তাহার হাত ধরিয়া কহিল, এসো আমার সঙ্গে এসো। কি হয়েছে তোমার? পিছনে ডাইসওয়ালা তখন হাঁকিতেছিল—চোরি নেহি, ডাকাতি নেহি। নসীবকে খেলা হ্যায় ভাই। খোদা দেনেওয়ালা। ধর ভাই ধর।
ভিড়ের বাহিরে আসিয়া ছেলেটি অমরকে জিজ্ঞাসা করিল—কার সঙ্গে এসেছ তুমি? বাড়ি কোথা?
অমর ফোঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল—কহিল, আমার বোন হারিয়ে গেছে।
সচকিত ভাবে ছেলেটি প্রশ্ন করিল, বোন? কত বড় সে? তোমার চেয়ে ছোট না বড়?
আমার চেয়ে ছোট। ছ’ বছর বয়েস তার।
গায়ে তার গয়না-টয়না আছে না কি?
হাতে দুগাছা বালা আছে শুধু।
কি নাম তার?
মণি তার নাম। খুব চালাক সে। পিঠে বিনুনি বাঁধা আছে!
আনন্দ-উন্মত্ত যাত্রীর কল-কোলাহলে চারিদিক মুখর হইয়া উঠিয়াছে। নিকটের কথাবার্তা দুই-চারিটা শুধু স্পষ্ট ভাবে কানে আসিয়া ধরা দেয়। তাহা ব্যতীত যে শব্দ শোনা যায় সে যেন বিরাট একটা মধুচক্রের অগণ্য মধুমক্ষিকার গুঞ্জন।
অমর প্রাণপণ চীৎকারে ডাক দিয়া চলিয়াছিল।
বিক্ষিপ্ত জনতার মধ্যে ছোট্ট মেয়েটি লোকের পায়ের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়া পড়িয়াছিল বাজীকরের তাঁবুর মধ্যে। সেখানে এদিক ওদিক চাহিয়া মণি দেখিল তাহার দাদা নাই। মণির বড় কৌতুক বোধ হইল। দাদা ভারি ঠকিয়া গিয়াছে। সে ঢুকিতে পারে নাই! থাক সে বাহিরে দাঁড়াইয়া! পরক্ষণেই মনটা তাহার কেমন করিয়া উঠিল। আহা—দাদা দেখিতে পাইবে না যে!
মণি দাদাকে ডাকিতে ফিরিল। কিন্তু সে অবসর আর তাহার হইল না। ঠং ঠং শব্দে পিছন ফিরিয়া দেখিল স্টেজের উপর একটি ঘোড়া পিছনের দু’পায়ে দাঁড়াইয়া নাচিতেছে। মণি অবাক হইয়া গেল। বিস্ময়ের উপর বিস্ময়! কুকুরে ডিগবাজী খায়, বাঁদরে ঘোড়া চড়ে, টিয়াপাখীতে বন্দুক ছোড়ে! একটা লোক আবার সং সাজিয়া কত রঙ্গই দেখাইয়া গেল, মণির হাসি আর থামে না।
ঢং ঢং শব্দে ঘন্টা বাজিয়া স্টেজের উপর পর্দা পড়িয়া গেল। খেলা শেষ হইল। জনস্রোতের সঙ্গে সঙ্গে মণি বাহিরে আসিয়া চারিদিক দেখিল, দাদা তো নাই! কয়েক মুহূর্ত মণি হতভম্বের মত দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর সে জনতার সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হইয়া চলিল।
ভারি দুষ্টু তাহার দাদাটা!
দূরে নাগরদোলা ঘুরিতেছিল মণি সেই দিকে চলিল। ওইখানে সে নিশ্চয় আছে। তাহাকে ফাঁকি দিয়া সে নিশ্চয়ই নাগরদোলায় চাপিয়াছে!
পথে একটা দোকানে দোকানী হাঁকিতেছিল, চলে এসো ভাই, চলে এসো। কাবাব রুটি। গোস পরোটা! চিংড়ী-কাঁকড়া—এই এই, ভিড় ছাড়ো, ভিড় ছাড়ো!
ভিড় কমিল না। লোকটা অকস্মাৎ অতি বিকট চীৎকারে বলিয়া উঠিল, এই বড়ো বাঘ!
মণি চমকিয়া উঠিল। আর্তস্বরে সে ডাকিয়া উঠিল—দাদা!
আবার পিছন দিক হইতে রব উঠিল—এই সরো, এই সরো।
কে কহিল, এই সরো’ই বটে রে বাবা—গাড়ি আসছে, গাড়ি আসছে।
জনতা দুই পাশে বিভক্ত হইয়া জমাটভাবে চলিতে আরম্ভ করিল। ভিড়ের মধ্যে যে কেমন করিয়া কোন দিকে চলিয়াছিল তাহা মণি বুঝিল না। যখন সে হাঁপ ছাড়িবার অবকাশ পাইল তখন দেখিল তাহার চারিপাশে অন্ধকার আর মেলার বাহিরে একটা খোলা মাঠে সে দাঁড়াইয়া আছে।
পিছনে দোকানের পর্দায় ঢাকা আলোকোজ্জ্বল মেলাটা বিপুল কলরবে গম গম করিতেছে। উপরে নক্ষত্রখচিত অন্ধকার আকাশের নীচে মেলার উৎক্ষিপ্ত আলোকরশ্মি সাদা কুয়াশার মত জাগিয়া রহিয়াছে। সেই অন্ধকারের মধ্যে চারিপাশে দূরে দূরে কাহারা চলিয়াছে। কে যেন তাহার দাদার মত হুইসিল বাঁশী বাজাইতেছে। মণি চীৎকার করিয়া উঠিল, দাদা!
দূর মাঠ হইতে কে একজন উত্তর দিল, দাদা দাদা ডাক ছাড়ি, দাদা নাইক’ ঘরে, দাদা গেছে বৌ আনতে ওপারের চরে।
মণি বিষম রাগে তাহাকে গালি দিল—মর, মর, মর তুমি। কিন্তু এই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া থাকিতে তাহার ভয় করিল। সম্মুখেই খড় দিয়া ঘেরা ছোট ছোট ঘরের সারি। ঘরগুলার অন্ধকার পিছন দিকটা দেখা যাইতেছিল। ওপাশে সম্মুখের দিক উজ্জ্বল আলোয় আলোকময় হইয়া আছে।
মণি আসিয়া আলোকিত জায়গাটার ভিতরে যাইবার রাস্তা খুঁজিল। রাস্তা নাই। তবে ঘরগুলির পিছন দিকে একটি করিয়া দরজা রহিয়াছে। মণি একটা ঘরের দরজা ঠেলিয়া ভিতরে উঁকি মারিল।
সঙ্গে সঙ্গে কে বলিয়া উঠিল, কে? কে?
মণি তাড়াতাড়ি সরিয়া আসিল। ঘরের মধ্য হইতে সে আবার বলিল, চোর, চোর নাকি? মণি এবার কাঁদিয়া ফেলিল। ততক্ষণে ঘরের মেয়েটি বাহিরে আসিয়া মণির হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, কে রে?
মণি ফোঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। একটা দেশলাই জ্বালিয়া সে মণির মুখের সম্মুখে ধরিল, মণির ফুটফুটে মুখখানি দেখিয়া মেয়েটির মুখচোখ কোমল হইয়া আসিল। মণিরও ভয়ার্ত ভাব যেন কাটিয়া গেল, যে তাহাকে ধরিয়াছিল সেও বড় সুন্দর।
মেয়েটি মণিকে জিজ্ঞাসা করিল, কাঁদছ কেন খুকী?
তাহার গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া মণি কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, আমি যে দাদাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
গভীর স্নেহে তাহাকে বুকে তুলিয়া লইয়া মেয়েটি কহিল, ভয় কি? তুমি কেঁদ না। সক্কালেই তোমাকে দাদার কাছে পাঠিয়ে দেব।
রাত হয়ে গেছে যে!
হোক না, তুমি আমার কাছে থাকবে আজ।
মণিকে বুকে করিয়া মেয়েটি ঘরের মধ্যে ঢুকিল। ওদিকের রুদ্ধ দ্বারের বাহিরে কে ডাকিতেছিল, কমলমণি, কমলমণি।
আবার একজন কহিল, এ ঘরের লোক কই গো!
মণিকে বিছানায় বসাইয়া দিয়া মেয়েটি কহিল, বসো তো মা একবার।
তারপর রুদ্ধ দ্বারটা খুলিয়া দ্বার-পথে দাঁড়াইয়া বলিল, কি? চেঁচাচ্ছ কেন?
কে একজন কহিল, পুজো করব বলে।
জনতা হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল! মেয়েটি দুয়ার টানিয়া দিল।
বাহির হইতে আবার কে কহিল, শুনচ। কমল!
কমল কহিল, অনেক নরকের দোর তো খোলা রয়েছে, যাও না। আমি পারব না।
একবার শোনই না!
কমলি কহিল, বেশী উপদ্রব করলে পুলিশ ডাকব আমি!
মণি আবার ভয় পাইয়া গিয়াছিল, সে চুপি চুপি কাঁদিতেছিল।
কমলি তাহার গায়ে গভীর স্নেহে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে কহিল, কেঁদ না খুকী, কেঁদ না।
মণি কান্নার মধ্যেই কহিল, আমার নাম তো খুকী নয়, আমার নাম মণি—
মণি। তা হ্যাঁ মা মণি, তোমার খিদে পেয়েছে?
হ্যাঁ।
ঘরের কোণের একটা হাঁড়ি হইতে কচুরী-মিষ্টি বাহির করিয়া কমল মণির হাতে দিল।
তাহার মুখপানে চাহিয়া মণি কহিল, তোমাকে কি বলে ডাকব?
কমলি যেন অকস্মাৎ বলিয়া ফেলিল—মা।
মণি কহিল, না, মা যে আমার ঘরে আছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া মেয়েটি জল গড়াইতে বসিল। মণি কহিল, তোমায় আমি মাসী বলব, কেমন?
জল গড়ানো রাখিয়া দিয়া মেয়েটি মণিকে বুকে জড়াইয়া ধরিল! বলিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, মাসী মা—মাসী মা—
মণি ঘাড় নাড়িয়া জানাইল—আচ্ছা।
অল্পক্ষণের মধ্যেই মাসীমার সহিত মণির নিবিড় পরিচয় হইয়া গেল। মায়ের কথা, বাবার কথা, দাদার কথা, বুড়ো দাদুর কথা, ছোট বোনটির কথা পর্যন্ত বলিতে সে বাকী রাখিল না। এমনকি সেই দুষ্ট দোকানীটার কথা পর্যন্ত বলিতে সে ভুলিল না। এরোপ্লেন, নাগর-দোলা, পুতুল দুটি কত ভালো তাহাও সে বলিল। মখমলের চটিও কেমন তাও অপ্রকাশ রহিল না।
কমলি মণির মুখপানে একদৃষ্টে চাহিয়া তাহার কথা শুনিতেছিল। ছোট্ট ফুটফুটে মুখখানি তাহার বড় ভালো লাগিতেছিল।
সহসা সে কহিল, তুমি একটু চুপ করে শুয়ে থাক তো মণি। আমি একটু ঘুরে আসি। কেঁদ না যেন, বেশ!
মেয়েটি চলিয়া গেল।
নিস্তব্ধ নিঃসঙ্গ কক্ষে বাহিরের কোলাহল প্রচণ্ডরূপে শিশুর কানে আসিয়া বাজিতেছিল। মণি ভয়ে একখানা কম্বল চাপা দিয়া শুইয়া পড়িল।
পিছনের দরজা ঠেলিয়া কমলি ফিরিয়া আসিল, মৃদুস্বরে ডাকিল, মণি।
মুখ হইতে কম্বলের আবরণটা সরাইয়া দিয়া মুখ তুলিয়া মণি সাড়া দিল—উঁ।
কমলি আঁচল হইতে কতকগুলা জিনিস বাহির করিয়া দিল। মণি সাগ্রহে একেবারে সমস্তগুলা কাছে টানিয়া লইল। এরোপ্লেনটা ঠিক তেমনি, বোধ হয় সেইটাই। নাগর-দোলার পুতুলটা কিন্তু সেটার চেয়েও ভালো। মখমলের চটিটা নতুন ধরনের।
কমল জিজ্ঞাসা করিল, পছন্দ হয়েছে মণি?
মণি ঘাড় নাড়িল! কমল সাগ্রহে কহিল, একটি চুমু দাও দেখি তবে।
মণি গাল বাড়াইয়া দিল। চুমা দিয়া মণিকে বুকে ধরিয়া কমলি কহিল, তোমার মা ভালো, না আমি ভালো!
একটুক্ষণ ভাবিয়া মণি উত্তর দিল—মাও ভালো, তুমিও ভালো।
কমলি একটু হাসিল।
মণি সহসা কহিল, তুমি বিড়ি খাও কেন মাসী! মা তো খায় না।
মেয়েটির মুখ যেন কেমন হইয়া গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে মণির পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় মারিয়া কহিল, ঘুমোও দেখি দুষ্টু মেয়ে।
মণি কহিল, তুমি শোও।
হাসিয়া কমলি মণিকে বুকে টানিয়া শুইয়া পড়িল।
মণির চোখের পাতা ধীরে ধীরে মুদিয়া আসিল। কমলি অনিমেষ দৃষ্টিতে তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল। অকস্মাৎ তাহার চোখ দিয়া কয় ফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িল।
পিছনের দরজার বাহিরে কে তাহাকে ডাকিল—কমলি।
কমলি উঠিতে উঠিতে আহ্বানকারী আগড় ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল।
কমলি কহিল, মাসী!
আগন্তুক মেয়েটি কহিল, হ্যাঁ। ঘরে শুয়ে রয়েছিস যে? কি হয়েছে তোর? এরপর কিন্তু টাকা দিতে পারব না বললে আমি শুনব না। জমিদারের টাকা আমাকে গুনতে হবে।
কমলি কোন উত্তর দিবার পূর্বেই আবার সে কহিল, ও কে লো? কার মেয়ে?
কমলির মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। সে কহিল, জানি না।
কারুর হারানো মেয়ে বুঝি? কোথায় পেলি?
ঘরের পেছনে।
কেউ জানে?
বিবর্ণ মুখে ঘাড় নাড়িয়া কমলি জবাব দিল—না।
বেশ, তবে ভোরের আগেই ওকে সরিয়ে দিতে হবে। সরকারকে বলে আসি আমি। ভালো করে আগড়টা সরিয়ে দে!
ব্যস্ত হইয়া বৃদ্ধা বাহির হইয়া গেল। কমলি আগড়টা আঁটিয়া দিতে গিয়া আগড়ে হাত রাখিয়াই দাঁড়াইয়া রহিল। মাসী ইঙ্গিতে যে কথার আভাস দিয়া গেল সে কথা ভাবিতেও পারে নাই। সে শিহরিয়া উঠিয়া ঝর ঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। ওদিকে বাহিরের কোলাহল ধীরে ধীরে স্তব্ধ হইয়া আসিতেছিল। দুই একটা উচ্চ, জড়িত কন্ঠের শব্দ বা কাহারও আহ্বানের শব্দ শুধু শোনা যায়। বাজী, সার্কাসের বাজনা নীরবে হইয়া গিয়াছে।
কমলি পিছনের আগড় খুলিয়া একবার বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। অন্ধকার থম থম করিতেছে। পথিকের আনাগোনাও বিরল হইয়া আসিয়াছে।
কমলি আবার ঘরে ঢুকিল। তারপর এক মুহূর্ত সে বিলম্ব করিল না। মণিকে সে বুকে তুলিয়া লইল। আঁচলে সেই খেলনাগুলি জড়াইয়া পিছনের দরজা দিয়া বাহির হইয়া সে মাঠের অন্ধকারে মিলাইয়া গেল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন