শৈলেন্দ্র হালদার
রবিবারের অলস দুপুর। চারিদিক নির্জীব ক্লান্ত। গাছের ডালে কাকটা অনেকক্ষণ পরপর অবসন্ন ভাবে মাঝে-মাঝে ডাকছে।
চারিদিকের এই শ্রান্ত-শান্তির মধ্যে আলস্য নেই, ওই ভিখিরির দলের। দল বেঁধে কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে, তারা দোরে দোরে ঘুরছে, রবিবারেই তাদের যা কিছু রোজগার।
দলের প্রায় সবাই মেয়ে।
আর ক্লান্তি ছিল না তার, যে ওই ক্ষুধাতৃষ্ণাতুর ধবংসপথের যাত্রীদের মাথার ওপরে আগুন ঢালছিল। খাঁ-খাঁ রোদে পথঘাট তেতে উঠেছে। হাওয়ায় গা ঝলসে যাচ্ছে—মাথার চাঁদি ফাটবার যোগাড়!
কিন্তু ভিখিরির আবার রোদ-বিষ্টি! পেট চালাতে হবে তো?
সম্প্রতি রাস্তা দিয়ে যারা চলেছে, তারা হচ্ছে পটলডাঙার দল। দলের মধ্যে সব গোনা-গুনতি? বাইরের কেউ যে ফাঁকি দিয়ে এসে দলে ঢুকে তাদের সাথে রোজগার ক’রে যাবে, তার যো’টি নেই। মোড়ল খেঁদি-পিসীর এমনি কড়া নজর! এইতো সেদিন হাটখোলার কুসুম এসে ভিড়ে গিয়েছিল, তা নিয়ে কি কাণ্ডটাই না হ’ল! খেঁদি তো বেটিকে খুন করতে বাকি রেখেছিল।
দলের সবাই তাকে ভয় করতও যেমনি, নামও তেমনি আশে পাশের পাঁচখানা পাড়ার সব দলই জানত।
এ-হেন ডাকসাইটে খেঁদির দল চলেছে আমহার্স্ট স্ট্রীট ধরে। সামনেই একটা বড় বাড়ি দেখে সবাই হুড়মুড় ক’রে ঢুকে পড়ল। কাচ্চা-বাচ্চা কতকগুলো চাপা পড়বার উপক্রম হয়েছিল, চ্যাঁ-ভ্যা ক’রে কাৎরে উঠল। বড়দের মধ্যে এই সূত্রে একটা কুরুক্ষেত্র হয়ে গেল। কিন্তু আসল ব্যাপারটা অর্থাৎ ভিক্ষে পাওয়াটা তখনো বাকি, তাই লড়াই বেশি দূর গড়াল না।
হরেঃ কেসটো,—দুটি ভিক্ষে পাই বাঁবা।
এইয়ো—ঠার যাও, উধার—মৎ আও—মাৎ আও—
দারওয়ানজীর হুমকীতে আর কেউ বেশি দূর না এগিয়ে ওইখানেই থেমে গেল। তারপর আঁচল, কোঁচর, থলে, যার যা ছিল, সবাই তাই পেতে, সিকি-মুঠো ক’রে চাল নিয়ে আবার রাস্তায় নেমে পড়ল।
বাইরে এসেই খেঁদি দাঁড়াল। এটা দলের নিয়ম। প্রত্যেক জায়গা থেকে বেরোন মাত্রই সবাইকে একবার গুণতি ক’রে নিতে হয়। আর সবাই যে যার মতো বক বক করতে করতে, অথবা ছেলে পিটতে পিটতে এগুলো। হঠাৎ খেঁদি চেঁচিয়ে উঠল—এই মাগী, তু’ কে লা?
যাকে লক্ষ্য ক’রে একথা বলা হ’ল, সে বুক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে চলেছিল। কেউ তাকে আগে লক্ষ্য করেনি। তার কাপড়খানা অন্য সবার মতো অত জীর্ণ নয়, একটু ফরসাই! চলনটাও বাধো-বাধো।
খেঁদি তার হাত ধরে হিড়হিড় ক’রে টেনে একপাশে সরিয়ে নিয়ে এল। দলের দিকে ফিরে বলল, যা, যা তোরা এগো। তারপর মেয়েটির কাছে এসে বলল, তু’মাগী কোত্থেকে এয়েচিস? খেঁদি মোড়লনীর নাম শুনিসনি? দেখি দেখি মু’খানা তোর—ব’লে, একটানে তার মুখের কাপড় সরিয়ে দিয়েই অবাক হ’য়ে তার মুখের দিকে তাকাল।
ওমা,—এযে ভদ্দর ঘরের মেয়ে গো!
খানিকক্ষণ তার মুখে কথাই ফুটল না। মেয়েটি ততক্ষণে নিজের মুখের কাপড় আবার টেনে দিয়েছিল। খেঁদি দলের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, ক্ষ্যান্ত, আজ তুই খবরদারী করিস। আমি ফিরনু।
মেয়েটিকে নিয়ে সে বাড়ির পথ ধরল।
দলের সবাই একটা রহস্যের গন্ধ পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিল! কিন্তু ফেরবার উপায় নেই, তাহলে পিসী কি আর আস্ত রাখবে? তাছাড়া পেটের তাড়া!
গলির পর গলি, সরু, মোটা, আবছা, অন্ধকার নানারকম রাস্তা পার হয়ে আস্তানায় পৌঁছে খেঁদি বলল, এইবার বলতো বাছা, কোত্থেকে এয়োচো?
সার সার মাটি-লেপা অন্ধকূপ। বিশ্রী গন্ধ। নোংরা একটা ঘর থেকে অনবরত ধোঁয়া বার হয়ে দম ফেলবার উপায়টুকুও বন্ধ করেছে। একটা ঘরে কে মরেছে! মড়াটা টান দিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। একটু ঢাকাও নেই—সর্বাঙ্গ মাছি ও পোকায় ছাওয়া!
মেয়েটি দু’একবার চারিদিকে তাকিয়ে ঘোমটার মধ্যেই শিউর উঠল। তারপর মাগো—ব’লে, সেইখানেই বসে পড়ল।
খেঁদি বিরক্ত হয়ে বলল,—কি গেরো! বলি ভিরমী গেল নাকি! কিগো ভালোমানুষের মেয়ে, বলি, দু’কদম হাঁটতে পারবে? চল, চল, আমার ঘরে, সেখানে গে সব বলবে চল!
ঘরে ঢুকে দোর বন্ধ ক’রে দিয়ে, দিনের রোজগার চাল ক’টি ও গোটা দু’য়েক পয়সা সযত্নে এককোণে রেখে, খেঁদি এসে মেয়েটির সামনে বসল। বলল এইবার মুখের কাপড় খোল। ওকি কাঁদচ? তুমি নতুন নোক বুঝি? আর তাতো বটেই, সে তো তোমার চেহারাতেই নেকা রয়েছে! তা, এমন ছুরত থাকতে ব্যবসা না করে পথে বেরিয়েচ যে বড়? ব্যারাম পীড়ে হয়েচে বুঝি?
মেয়েটি দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল।
খেঁদি মহা বিব্রত হয়ে বলল,—ভ্যালা ঠ্যাকারের মধ্যে পড়নু যে! এযে রা-বাক্যি কিছুই নেই, যা বলি তাতেই কাঁদে। বলি বাছা সব খুলে না বললে কি ক’রে বুঝব? আর, তা না হ’লে ঠাঁইও তো পাবেনা এখানে! বাইরের মানষের হেথা থাকবার নিয়ম নেই! তুমি যদি দলে ভর্তি হও, তবে অবিশ্যি থাকতে পাবে। ঘর নিজেই গড়ে নাও, চাই আর কারো সাথে বকরা ক’রে থাকো। সে তোমার ইচ্ছে! কিন্তু আগে সব শোনা দরকার তো?
মেয়েটি অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ ক’রে ফুঁপিয়ে কেঁদে নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে যা বলল, তার মর্মঃ
সে পাড়াগেঁয়ে গেরস্ত ঘরের বউ। সাধারণতঃ যা হয়ে থাকে, তেমনি এক পুরুষের সাথে কলকাতায় কালীঘাট দেখতে আসে। তাঁর সাথী তাকে নিয়ে এসে মানিকতলা খালের কাছে এক বাড়িতে রাখে। একদিন বেড়াতে যাবার নাম ক’রে তাকে নিয়ে, নেবুতলায় এক বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সরে পড়ে। গয়নাগাটি টাকা কড়ি যা ছিল, সব সে নিয়ে গেছে। গলার একটা মালা ছিল, তা সেই নেবুতলার বাড়িউলি কেড়ে রেখেছে। তার সাথী চলে যাবার পর প্রথমটা সে কিছুই বোঝেনি। বাড়িউলি তাকে নানারকম আশ্বাস দিয়েছিল। দিন দুই থাকবার পর, একদিন রাত গোটা এগারোর সময় তার ঘরে দু’জন মাতাল ঢোকে। সে ভয়ে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ে।
জ্ঞান যখন ফিরে এল, তখন সকাল হয়েছে—তারা ফিরে গেছে।
বাড়িউলি এসে বলল,—কি বাছা, খবর ভালো তো?
তার কথা কইবার শক্তি ছিল না। বাড়িউলি আগের দিনই তার হারটা দখল করেছিল, কাজেই জবাব না পেয়ে বিশেষ মেজাজ খারাপ করল না! বরং বলল,—তা ঘুমোও বাছা! পেথমদিন একটু কাহিল তো লাগবেই!
বেলা গোটা দশেকের সময় মনের ও শরীরের অসহ্য যন্ত্রণায় সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। কোন পথ তার খোলা আছে? সে কয়বাড়ি আশ্রয়ের চেষ্টা করল। সবাই কেমন ক’রে যেন তাকায়, সব শুনে ফিরিয়ে দেয়। সব পথ বন্ধ। ভিক্ষেই করতে হবে! কিন্তু একা-একা নতুন মানুষ, ভেবে কুল পাচ্ছিল না, তাই পথে এসে দাঁড়িয়েছিল। বড়বাড়ি থেকে পটলডাঙার দল বার হ’তেই তাদের সাথে গিয়ে জুটেছিল! ভেবেছিল, এতবড় ভিখিরির দলে মিশে থাকলে কেউ তাকে লক্ষ্য করবে না।
খেঁদি বলল, তা—তোমার গে, বাছা, আমাদের দলে যাদের দেখলে, সবাই তো ওই করতো এককালে! পরে বুড়ো হয়ে, কেউ ব্যারামে পড়ে, পথে বেরিয়েচে। তোমার এই বয়েস, অমন চেহারা—তা বাবু নিজে বোঝ।
মেয়েটি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
এবার আর খেঁদি কান্না শুনে খিট-খিট ক’রে উঠল না। অনেকক্ষণ চুপ ক’রে থেকে কি ভাবল। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্চা, থাকো! কিন্তু এ চেহারা নিয়ে কোলকাতা হেন জাগায় কি সামলে থাকতে পারবে? আমার খবরদারীতে যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ অবিশ্যি ভয় নেই। কিন্তু সব সময় তো আমিও চোক রাখতে পারবো না?
মেয়েটি আবার চোখে আঁচল দিতেই খেঁদি বলে উঠল,—আচ্চা, আচ্চা। ভয় নেই , কেউ তোমার কিচু করতে পারবে না। আমি একা থাকি, এইখানেই দু’জনে থাকব খন।
মেয়েটি পটলডাঙার দলে ভর্তি হয়ে গেল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন