—ব্লাডটা আমি দিতে পারি স্যার, প্রণবেশ হাত বাড়ালো। চওড়া কবজি, সংক্ষিপ্ত সাদা বুশসার্টের সীমান্ত পর্যন্ত নিটোল শক্তিমান বাহুতে পেশীর তরঙ্গ। পৌরুষ আছে, কিন্তু কাঠিন্য নেই।
হাত থেকে জয়াবতীর দৃষ্টি প্রণবেশের মুখের ওপর উঠে এল। বয়েস সবে তিরিশ ছুঁয়েছে অথবা ছোঁয়নি। শরীর আর মনের স্বাস্থ্য অটুট থাকলে যেমন হওয়া উচিত, ঠিক তেমনি। চোখের তারা দুটো এখনো চঞ্চল, কোনো অন্তর্মুখী গভীরতার আকর্ষণে স্থির আর নিশ্চল হয়ে আসেনি। ঠোঁটের রেখাগুলো কোমল শ্লথলগ্ন। এত সহজে হাত বাড়িয়েছে যে, যেন একগুচ্ছ রজনীগন্ধা এগিয়ে দিয়েছে কাউকে।
কিন্তু যাকে দিয়েছে, নেবার ক্ষমতা তো নেই তার। যে শুভ্র বিছানাটির ওপর সে এলিয়ে আছে—তার শীর্ণ সুন্দর মুখে মৃত্যুর ছায়া। খাটের পাশে তার একখানা সকরুণ বিন্যস্ত হাত—রেশমের মতো ত্বকের নীচে নীল নিবিড় শিরাগুলি মানচিত্রের নদীর মতো টানা। আর মানচিত্রের প্রাণহীন নদীর মতোই তা শুকিয়ে আসছে—প্রণবেশের রক্তসঞ্চারে তাতে প্রাণের ধারা ফিরে আসতেও পারে। অন্তত ডাক্তার সেইরকম আশা করেন।
জয়াবতীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির মতোই ডাক্তার গম্ভীর চোখে তাকালেন প্রণবেশের দিকে। তারপর স্বচ্ছ সস্নেহ হাসি হাসলেন।
ইউ, ডক্টর?
হ্যাঁ স্যার। চলবে?
চলবে বইকি। আচ্ছা—এসো।
ছ-মাস পরে জয়াবতী চিঠি লিখলেন প্রণবেশকে।
আমার মেয়েটাকে তুমি বাঁচিয়েছে বাবা। যদি সময় থাকে আর খুব অসুবিধে না হয়, তা হলে যে-কোনো একদিন বিকেলে এসো আমাদের বাসায়। স্বচ্ছন্দে চলে আসবে—লজ্জার কোনো কারণ নেই। একবার—দুবার—তিনবার। চিঠির প্রতিটি শব্দ মনে মনে উচ্চারণ করে পড়ল প্রণবেশ, উলটে-পালটে দেখল কাগজখানাকে। বেশি গবেষণা না করেও বুঝতে পারা যায়, এ চিঠির কাগজ তাঁর নয়, এ হাতের লেখা তাঁর তো নয়ই। ফিকে নীল রঙের কাগজ, একটা লঘু সুরভি তাতে জড়ানো। লেখার ধরনটা একটু কাঁচা—একটি সুকুমার মনের ভীরুতার চিহ্ন বয়ে এনেছে। মার জবানিতে এ চিঠি লিখেছে সুনীলাই। সুনীলার হাতের লেখা কখনো না দেখেও তা সে অনুমান করতে পারে।
অন্যমনস্কভাবে কাচের টেবিলটার ওপরে প্রণবেশ আঙুল টানতে লাগল। জলরঙের এলোমেলো রেখা পড়তে লাগল এলোমেলো ভাবনার মতো। যেদিন হাসপাতাল থেকে সুনীলা ডিসচার্জড হল, সেদিন প্রণবেশ তাদের এগিয়ে দিতে গিয়েছিল হাসপাতালের গেট পর্যন্ত।
দুর্বল পায়ে আস্তে আস্তে হাঁটছিল সুনীলা—যেন যে-কোনো মুহূর্তে টলে পড়ে যাবে মাটিতে। কয়েকবারই ইচ্ছে হয়েছিল তার সবল বাহুর মধ্যে সযন্তে মেয়েটাকে আশ্রয় দেয় সে। কিন্তু পাশেই জয়াবতী চলেছেন। স্বাভাবিক সংকোচে বরং একটুখানি দূরত্বই রাখতে হয়েছিল তাকে।
ট্যাক্সি পর্যন্ত নিঃশব্দে এল তিনজন। তারপর জয়াবতী প্রণবেশের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
তুমি আমাদের জন্যে অনেক করলে বাবা। নিজের আত্মীয় থাকলেও তো করত না। তোমার ঋণ কী করে শোধ হবে জানি নে।
অভ্যস্ত কৃতজ্ঞতার জবাব দিতে হল অভ্যস্ত ভাষাতেই।
কেন তুলছেন ওসব কথা? ডাক্তারের যতটুকু দায়িত্ব, ততটুকুই করেছি। তার বেশি কিছু করিনি।
জয়াবতী হাসলেন : ডাক্তার আমি অনেক দেখছি, কে কতটুকু করে তাও জানি। তোমার মতো ডাক্তার যে কলকাতায় খুব বেশি নেই—এ আমি জোর করেই বলতে পারি।
এই সময় প্রণবেশের চোখ গিয়ে পড়েছিল জয়াবতীর চোখে। সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা খোঁচা লাগল তার। গলার স্বরের সঙ্গে এই চোখ মিলছে না, কথার সঙ্গে যেন সাদৃশ্য নেই এ দৃষ্টির। কেমন একটা ধূসর চাউনি, একটা অর্থভরা ইঙ্গিত। জয়াবতী কি ঠাট্টা করছেন তাকে? সংকুচিত হয়ে গেল।
কিন্তু এর মধ্যেই কখন সামনে নুয়ে পড়েছে সুনীলা—পায়ের অনাবৃত অংশে কয়েকটি শীর্ণ শীতল আঙুলের করুণ স্পর্শ। চমকে প্রণবেশ পিছিয়ে যেতে চাইল, ছি, ছি, কী এসব!
জয়াবতী বললেন, তাতে কী হয়েছে বাবা। একটা প্রণাম তো তোমায় করাই উচিত।
ধীরে ধীরে সুনীলা সোজা হয়ে দাঁড়াল। মুখ তুলল।
বেলাশেষের আলো সামনের বকুলগাছের ভেতর দিয়ে সুনীলার মুখে এসে পড়ল। মনে হল, তার ক্লান্তি-পাণ্ডুর গালে-কপালে কে যেন নববধূর মতো রক্তচন্দনের গোরোচনা এঁকে দিয়েছে। প্রণবেশ কী দেখল সেই-ই জানে। বুকের ভেতরে আচমকা একটা দোলা লাগল—আরো একবার শিউরে উঠল শরীর। কিন্তু এবার সম্পুর্ণ অন্য কারণে। জয়াবতীর চোখের সঙ্গে এর চোখের এতটুকুও তো মিল নেই কোথাও।
মগ্নতাটা কাটল মিনিট দুই পরে। ট্যাক্সির দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আকস্মিক ধাতব শব্দে।
জয়াবতী বললেন, সময় পেলে একবার যেয়ো আমাদের ওখানে।
সুনীলা কিছু বললে না, বলার দরকারও ছিল না। প্রণবেশ মাথা নাড়ল, নিশ্চয় যাব।
ধোঁয়া ছেড়ে বেরিয়ে গেল ট্যাক্সি। প্রণবেশ আরো কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সেইখানেই। তারপর মস্ত একটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়িকে ঢোকাবার জন্যে যখন পথ ছেড়ে দিতে হল, তখন আস্তে আস্তে নিজের ওয়ার্ডে সে ফিরে এল।
কিছুদিন সুনীলার কথা মনে পড়ল—মনে পড়ত ওই কেবিনটার দিকে তাকালে। ওর শূন্যতাটাকে এখন আরো বেশি বলে মনে হত, ওটা যেন করুণ বিষণ্ণতায় বিকীর্ণ হয়ে থাকত সব সময়। কিন্তু যথাসময়ে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বুড়ি ওই কেবিনে এসে আশ্রয় নিল। যেটুকু ঘুমত, সেই সময়টুকু ছাড়া বুড়ি চিৎকার করত অনর্গল, গালমন্দ করত, অভিশাপ দিত ডাক্তার আর নার্সদের, আর মাঝে মাঝে ঈশ্বরের দরবারে প্রার্থনা নিবেদন করত, হেলপ মি—ও লর্ড, হেলপ মি!
সুনীলার স্মৃতিটুকু নিভে-যাওয়া ধূপের গন্ধের মতো গেল মিলিয়ে। তারপরে ওখানে একের পর এক কত এল, কত গেল। ঘুরতে হল ওয়ার্ডের পর ওয়ার্ড। অসংখ্য মানুষের অসংখ্যতর ব্যাধি আর বিকার, বহু বিচিত্র রূপ, শরীরের জটিল যন্ত্রে যন্ত্রে কতরকম অবক্ষয়ের কাহিনি। পীড়িতের মুখের ভিড়ে সুনীলার মুখ মুছে একাকার হয়ে গেল। কিন্তু আজ এই চিঠি এসেছে—এসেছে বহুদিন পরে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সকলের ভেতর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে এসেছে সুনীলা। এই হাসপাতালের লোহার খাটে নয়, ওষুধের গন্ধে ভরা এখানকার অসুস্থ বাতাসের মধ্যেও নয়। সমস্ত পৃথিবীর পশ্চাদপট মুছে গেছে, একান্ত নিঃসঙ্গতার শূন্যতায় যেন নীহারিকার ওপর দাঁড়িয়ে আছে সুনীলা, আর তার মুখের ওপর রক্তচন্দনের পত্রলেখার মতো ঝরে পড়েছে বেলাশেষের আলো।
এসো আমাদের বাসায়।
তলায় নামটা অবশ্য জয়াবতীর। তবু প্রণবেশ জানে, এর মধ্যে সুনীলার স্বর আছে অথবা জয়াবতীর স্বরে সুর ঢেলে দিয়েছে সুনীলা। জয়াবতী সাজিয়েছেন কথার প্রদীপ, কাঁচা হাতের কোমল লেখায় সুনীলা তাতে শিখা জেলে দিয়েছে। তাই চিঠির ভেতরে অদৃশ্য সেতারের সুর বাজছে—জ্বলছে লক্ষ দীপান্বিতার আলো।
দীপ্ত মুখে প্রণবেশ উঠে দাঁড়াল। চিঠিটাকে গুঁজে নিলে বুকপকেটে, কোটের জন্যে হাত বাড়ালো হ্যাঙারের দিকে। আজকের মতো ডিউটি শেষ।
এ ডাক উপেক্ষা করা যায় না। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই, কোনো কারণ নেই আর। একটা কৌতূহল, যার রক্তে নিজের রক্ত মিশিয়ে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিল, এই ছ-মাসে সেই কিশোরী মেয়েটির কঙ্কালে যৌবনের পূর্ণতা কতখানি এসে ঢেউ দিয়েছে, একবার সেইটুকু নিজের চোখে দেখে আসা। একটা সহজ স্বভাবিক দাবি আছে বইকি।
যেতেই হবে একবার। কাল? কিংবা আজই? প্রণবেশ ঘড়ির দিকে তাকাল। ছটা বেজে গেছে, বিকেলের আলো নিবেছে কিছুক্ষণ আগেই। একটু বেশি দেরিই হয়তো হয়ে গেছে আজ—দিনান্তের চন্দন-বর্ণ আলোয় আজ আর হয়তো সুনীলার মুখ দেখা যাবে না। কিন্তু তবুও কিছু বাকি আছে এখনো। বিদ্যুতের আলো-জ্বলা ঘরে সুনীলার আয়ত কালো চোখে নতুন কিছু কি ধরা পড়বে না? নিবিড় সন্ধ্যাকে আরো নিবিড় করে কি দেবে না সুনীলা?
প্রণবেশ পথে নামল। ট্রামে নয়, ট্যাক্সিই ডাকল একটা।
বড়ো রাস্তার ওপরে চারতলার ফ্ল্যাট। পাড়াটা আন্তর্জাতিক, বাড়িটাও তাই। সিঁড়িতে পা দিতেই মাদ্রাজী সাহেব পাশ কাটিয়ে নেমে গেল, কানে এল পাঞ্জাবী মেয়ের তারস্বরে ঝগড়ার আওয়াজ, কোথা থেকে ভেসে এল পিয়ানোর সঙ্গে বিলিতি ফিলিমের চটুল গানের সুর। কেমন বিব্রত বোধ করল প্রণবেশ। পাড়াটার সুনাম নেই সে জানে।
কিন্তু জয়াবতীর দোষ দেওয়া যায় না, প্রণবেশ মনে মনে ভাবল। আজকালকার দিনে ইচ্ছেমতো বাড়ি চাইলেই কি পাওয়া যায়—আর ইচ্ছেমতো পাড়ায়? নিজেই সে এমন সব অঞ্চলে মধ্যবিত্ত বাঙালিকে বাসা নিতে দেখেছে—যেখানে পাঁচ বছর আগে বাংলা ভাষা বোঝবার মতো লোকও খুঁজে পাওয়া যেত না!
ফ্ল্যাটের নম্বর মিলিয়ে সে কড়া নাড়ল।
দরজা খুলে দিলেন জয়াবতীই। কয়েকটা রেখার আভাস পড়ল তাঁর কপালে, চোখে ফুটে উঠল সন্দেহের ধূসর ছায়া। প্রথমটা যেন চিনতেই পারলেন না। পরক্ষণেই তাঁর মুখে প্রশ্রয়ের পরিচিতি হাসি ছড়িয়ে গেল।
ওঃ, তুমি এসেছো? এসো—এসো। ভারী খুশি হয়েছি—এসো—প্রণবেশ ড্রয়িং-রুমে পা দিলে। সোফা দেখিয়ে জয়াবতী বললেন, বোসো, দাঁড়িয়ে আছো কেন?
প্রণবেশ বসল। কাশ্মীরী-কাজ করা একটা টিপয়কে মাঝখানে রেখে বসলেন জয়াবতীও।
সকালে চিঠি দিয়েছি, তুমি আজই আসবে বুঝতে পারিনি। তোমার আবার যে রকম কাজের তাড়া!
প্রণবেশ অপ্রতিভ হল। বড়ো বেশি তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। সৌজন্য-সংগত দেরি করা উচিত ছিল একটু, প্রতীক্ষা করবার সময় দেওয়া উচিত ছিল ওঁদের। কিন্তু যা, হওয়ার হয়ে গেছে।
কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল, হাতে আজ বেশি কাজ ছিল না, তাই এলাম। পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে হয়তো আর সময় পাব না, তাই দেখাটা করেই যাই।
বেশ করেছ, বেশ করেছ। —আবার প্রশ্রয়ের হাসিতে জয়াবতীর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, যখন সময় পাবে, তখনই এসো। বলতে গেলে এ তো তোমার আর একটা বাড়ি! বোসো, সুনীলাকে খবর দিই।—জয়াবতী উঠলেন। ডানদিকের দরজাটার ব্রোকেডের পর্দা সরিয়ে চলে গেলেন ভেতরে।
প্রণবেশ বিহ্বলভাবে তাকাল ঘরটার দিকে। যতটা সে ভেবেছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি সংগতিপন্ন এরা। বিধবা মা আর মেয়ের পক্ষে ড্রয়িংরুমের অঙ্গসজ্জাটা একটু বাড়াবাড়িই বলতে হবে। হাসপাতালে যেভাবে ক্যাপিটাল আর স্মল লেটার অসমভাবে সাজিয়ে জয়াবতী নিজের নাম সই করেছিলেন, তা থেকে কল্পনাই করা যায় না যে তাঁর রুচি এত সজাগ এবং এমন তীব্র আধুনিক। ঘরের কোণায় কোণায় তিন-চারটি অ্যাশ ট্রে—একটির ওপরে সোনালি লেবেল মোড়া আধপোড়া একটা মোটা চুরুট। স্পষ্টই বোঝা যায়, এ ঘরে ওপরতলার মানুষগুলোর-আনাগোনা আছে। দেওয়ালে একদিকে একখানা ল্যান্ডস্কেপ, অন্যদিকে একটি নারীমূর্তি, কিন্তু নারীটির দিকে তাকিয়ে মনে মনেই প্রণবেশ আরক্তিম হয়ে উঠল। জয়াবতীর রুচির মধ্যে কেবল আধুনিকতাই নেই, দুঃসাহসও আছে। সে ব্যাচেলর, কিন্তু নিজের ঘরে অমন একখানা ছবি টাঙাবার মতো মনের জোর তারও নেই।
আচমকা অনুভব করলে, কোথায় কী যেন হিসেবে ভুল হয়ে গেছে। বকুল পাতার ফাঁকে ফাঁকে বেলাশেষের আলো এখানে কোনো দিন পড়বে না। কী ক্ষতি ছিল ক্যামেরার ছবির মতো ওইটুকুকেই কেবল মনের মধ্যে ধরে রাখলে? এ বাড়িতে না এলেই কি তার চলত না?
নীচের ফ্ল্যাট থেকে পিয়ানোর সুর, ফিলিমের হালকা গান , নাচের আওয়াজও যেন পাওয়া গেল। সোফাটার ভেতরে যতটা সংকীর্ণ হওয়া যায়—নিজের অজ্ঞাতে প্রণবেশ তারই চেষ্টা করতে লাগল।
নমস্কার! —ঘরে ঢুকেছে সুনীলা। সঙ্গে সঙ্গে নাচ আর গানের শব্দের ঘূর্ণি স্থির হয়ে দাঁড়াল, সমস্ত ঘরটাই হারিয়ে গেল সুনীলার আবির্ভাবের আড়ালে। লাল শাড়ি পরা সুঠাম দেহ সুর্যস্নাত রক্তপদ্মের মতো ফুটে উঠল প্রণবেশের সামনে। প্রতি নমস্কার করবার হাতটাও ভালো করে উঠল না। তার আগেই সুনীলা ঝুপ করে বসে পড়েছে প্রণবেশের মুখোমুখি—ঠিক জয়াবতী যেখানে বসেছিলেন।
সত্যিই আপনি এলেন তা হলে? আমি কিন্তু বিশ্বাসই করতে পারিনি।
এবারেও প্রণবেশ জবাব দিলে না। মুগ্ধ বিস্ময়ভরা চোখ মেলে দেখতে লাগল, কেমন আশ্চর্য বদলে গেছে সুনীলা—যেন নতুন করে সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। হাসপাতাল থেকে বিদায় নেবার সময় দেখেছিল একটা কাঠামো—এখন দেখল প্রতিমা।
কী, কথা বলছেন না যে?—সুনীলা হাসল, চিনতে পারছেন না বুঝি?
একটু শক্ত বইকি চেনা—নীরবতা ভেঙে প্রণবেশ বলে বসল, এতখানি আশা করিনি।
সে তো আপনারই জন্য—সুনীলার চোখে কৃতজ্ঞতা উচ্ছলিত হয়ে উঠল, আপনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন।
কথাটার পুনরাবৃত্তি ভালো লাগে না, সম্পর্কটাকে কেমন যেন সংকীর্ণ আর সীমিত করে আনে। প্রণবেশ বললে, আমি না থাকলেও কয়েক আউন্স রক্ত দেবার লোকের অভাব হত না। ব্লাড ব্যাংকেও পাওয়া যেত। ও আলোচনা থাক। তার চেয়ে বলুন, এখনও টনিকগুলো নিয়মিত খাচ্ছেন তো? অনিয়ম করেছেন না তো শরীরের ওপর?
সুনীলা বললে, মানুষকে দেখলে কি টনিক ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ে না। আপনাদের দুনিয়ায় বুঝি পেসেন্ট ছাড়া দেখতে পান না আর কাউকেই?
আমি কিন্তু আজ পেসেন্টকেই দেখতে এসেছিলাম। —প্রণবেশ হাসল।
সর্বনাশ! সঙ্গে করে তাহলে স্টেথিসকোপও নিয়ে এসেছেন? আর ইনজেকশনের সিরিঞ্জ?
হালকা ধরনের একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল প্রণবেশ, সেই সময় ঘরে ঢুকলেন জয়াবতী, পেছনে একটা ছোকরা চাকর, তার হাতে চা আর খাবারের ট্রে।
এ কী! এসব ব্যাপার কেন করতে গেলেন এখন!
জয়াবতীর চোখে একটা অদ্ভুত ধূসর দৃষ্টি ফুটে উঠেই মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল আবার। অভ্যস্ত সুস্মিত হাসি হেসে বললেন, কী আশ্চর্য, সন্ধ্যেবেলায় এক পেয়ালা চা-ও কি তুমি খাও না?
লেখা স্লেটের ওপর আচমকা হাত বুলিয়ে যাওয়ার মতো আকাশের অর্ধেক তারা মুছে গেল। এতক্ষণ গুমোটের পরে একটা দমকা হাওয়া ফেটে পড়ল, ক্যাথিড্রাল রোডের দু-ধারে মর্মরিত হয়ে উঠল আলো-অন্ধকার গাছের সারি।
প্রণবেশ বললে, ঝড় আসছে মনে হয়।
সুনীলা বললে, ও কিছু নয়—এক-আধটা হাওয়া দেবে হয়তো। আসুন, এখানে বসা যাক ঘাসের ওপর।
ধুলো পড়বে যে চোখে মুখে।
এত বয়েস হল, এখনো চোখে ধুলো পড়বার ভয়?—লঘু শ্লেষের আভাস পাওয়া গেল সুনীলার স্বরে।
কী জানি, নিজেকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না।
পথ ছেড়ে ঘাসের দিকে এগোচ্ছিল সুনীলা, হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। মুহূর্তের ভেতরে তার মুখের রেখাগুলো শক্ত হয়ে উঠল, প্রণবেশ দেখতে পেল না।
সুনীলা ফিরে এল। হাসতে চেষ্টা করলে জোর করে।
চলুন তা হলে। নিরাপদ আশ্রয়েই পৌঁছে দেওয়া যাক আপনাকে।
প্রণবেশ আশ্চর্য হল, রাগ করলেন নাকি? মেঘ কেটে যাচ্ছে, আসুন, বসাই যাক বরং।
নাঃ, থাক আজ। রাত হয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল দুজনে। অত্যন্ত অকারণে কোথায় কী যেন একটা বেতালা হয়ে গেছে, প্রণবেশ ঠিক বুঝতে পারল না। মাঝে মাঝে এমন হয় সুনীলার। কেমন খটকা লাগে মনের মধ্যে। কোথাও কি একটা অজ্ঞাত অপরাধ আছে প্রণবেশের? সুনীলার কোনো দুর্বল জায়গায় সে কি আঘাত করে বসে যখন-তখন?
অস্বস্তিটা কাটাবার জন্যে একটা কথা খুঁজে বের করার আগেই সে চমকে উঠল। একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠেছে সুনীলা।
কী হল?
কিন্তু উত্তরের দরকার ছিল না। প্রণবেশও দেখতে পেল।
এতক্ষণ বোধহয় পথের ধারে পড়েছিল লোকটা, এবারে উঠে দাঁড়িয়েছে, টলতে টলতে একেবারে ওদের মুখোমুখি এসে পড়েছে। পথের ল্যাম্পের আলোয় লোকটার শরীরের প্রতিটি রেখা দেখা গেল সুস্পষ্ট। গায়ে কালো লংকোট, পরনে চুড়িদার পায়জামা, গালে কয়েকটি ব্রণের দাগ থাকলেও পরিষ্কার সৌখিন চেহারা। কিন্তু আপাতত মাথার চুলগুলো বিশৃঙ্খলভাবে কপালে নেমে এসেছে, চোখের দৃষ্টি ঘোলা, এমনভাবে টলছে যেন নিরবলম্ব হয়ে দুলছে বাতাসের সঙ্গে।
জড়ানো গলায় লোকটা বললে, পঞ্চাশ হাজার রূপেয়া।
প্রণবেশ বললে, মাতাল।
মাতাল!—সুনীলার আর্তনাদ এবার স্ফুটতর হয়ে উঠল। সভয়ে প্রণবেশের বুকের কাছে সে সরে দাঁড়াল, কী হবে?
কিছুই হবে না—প্রণবেশের বলিষ্ঠ পুরুষদেহ শক্তিতে বৈদ্যুতিত হয়ে উঠল, আপনিই চলে যাবে এখন।
লোকটা সেখানে দাঁড়িয়েই বিড়বিড় করে জড়ানো গলায় বলে চলছে। এতক্ষণে বোঝা গেল, ওরা তার লক্ষ্য নয়, সে এখন কাউকেই নিজের সম্মুখে দেখতে পাচ্ছে না। বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকা ঘুড়ির মতো কাঁপতে কাঁপতে লোকটা আওড়াতে লাগল . টিপস—ডবল টোট—গোল্ডেন অ্যারো! ছোঃ হামারা পঞ্চাশ হাজার রূপেয়া—
বলতে বলতেই হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ফেলল সে, পঞ্চাশ হাজার রূপেয়া—। ফতুর কর দিয়া—একদম ফতুর কর দিয়া। ওঃ হোঃ-হোঃ—
প্রণবেশ বললে, চলুন পাশ কাটিয়ে যাই। ও এখন পঞ্চাশ হাজার টাকার শোক সামলাতে পারছে না—কোনোদিকে তাকাবার ফুরসত ওর নেই এখন।
সুনীলাকে একরকম হাত ধরেই টেনে বের করে নিয়ে গেল প্রণবেশ। দ্রুতগতিতে খানিকটা এগিয়ে সভয়ে পেছনে ফিরে তাকাল সুনীলা। লোকটা এখনো সেইখানে দাঁড়িয়ে—এতদূর থেকেও তার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
এখনি সার্জেন্ট এসে ওকে থানায় নিয়ে যাবে—বেশিক্ষণ আপসোস করতে হবে না—প্রণবেশ আশ্বাস দিলে।
ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে সুনীলা বললে, কী হয়েছে লোকটার?
শুনলেন না? রেসের মাঠে ঘোড়ার পায়ে পঞ্চাশ হাজার টাকার নৈবেদ্য দিয়ে এল। এখন একেবারে ফতুর। সেই শোকটাকে ভোলবার জন্যেই প্রাণপণে মদ টেনেছে।
ওঃ!
প্রণবেশ যেন স্বগতোক্তি করলে, কোত্থেকে যে মানুষের ধারণা জন্মায় মদ খেলে দুঃখ ভোলা যায়! উলটোটাই হয় বরং। যে দুঃখ সেটা দশগুণ বাড়ে, যেটা কোনোদিন ছিল না, সেটাও আচমকা গজিয়ে ওঠে।
ডাক্তারিতে বলে বুঝি এসব?
ঠিক মনে পড়ছে না—প্রণবেশ পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট খুঁজতে লাগল, তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
মানে, আপনি—সুনীলা শিউরে উঠল।
ঠোঁটে সিগারেট লাগাতে লাগাতে প্রণবেশ বললে ভয় নেই। এখন আর ছুঁই নে—ছোঁয়ার প্রবৃত্তিও নেই। বছর তিনেক আর্মিতে ছিলাম আসাম-মণিপুর ফ্রন্টে। ট্রেঞ্চে রাতের পর রাত কাটাতে হয়েছে, মাথার উপর বৃষ্টির ঝাঁকের মতো বয়ে গেছে মেশিনগানের গুলি। শেল আর সারারাত বোমা ফেটেছে আশেপাশে। তখন সঙ্গে মদের বোতল না থাকলে তো পাগলই হয়ে যেতাম। তেষ্টায় জলের কাজ তো বিয়ার দিয়েই চালাতে হয়েছে কতদিন।
সুনীলা একটু যেন সরে গেল কাছ থেকে, ভারী খারাপ।
খারাপ বইকি। —সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে প্রণবেশ বললে, মানুষের মনুষ্যত্ব মুছে ফেলতে ওর মতো উপকরণ আর দুটি নেই। বিচার-বিবেক বিসর্জন দিয়ে নিরঙ্কুশ পশুকে জাগাতে হলে ওইটিই হল তার শ্রেষ্ঠ আহুতি। ওই লোকটাকে দেখলেন তো? এই নেশার ঝোঁকেই স্ত্রীকে লাথি মেরে তার গয়না কেড়ে নেবে যাওয়া যায় না।
ওসব আলোচনা ছেড়ে দিন। ভালো লাগছে না।
ঠিক কথা। জিনিসটা প্রীতিকর নয়।
চৌরঙ্গির ফুটপাত ধরে এসপ্ল্যানেডের দিকে এগোচ্ছিল দুজনে। হঠাৎ সুনীলা বললে, এখন বাড়ি যাওয়া যাক।
চলুন।
কোথাও চা খাবেন না এক পেয়ালা?
থাক আজ।
এর মধ্যে বন্ধু ঘটক একদিন পাকড়াও করলে প্রণবেশকে।
ব্যাপার কী ঘোষাল? চারিদিকে যে আলোড়ন জাগিয়ে বসে আছো।
অ্যাপ্রনটা খুলতে খুলতে প্রণবেশ বললে, হঠাৎ আলোড়ন জাগাবার মতো কী করলাম?
আজকাল প্রায়ই সন্ধ্যেবেলায় গড়ের মাঠ ইত্যাদি ভালো ভালো জায়গায় তোমাকে দেখা যাচ্ছে সঙ্গে একটি চাঞ্চল্যকর মেয়ে।
তাতে আলোড়িত হওয়ার কী আছে?—প্রণবেশ হাসল, চাঞ্চল্যকর মেয়েদের নিয়ে বেড়াবার জন্যেই তো ভালো ভালো জায়গা সৃষ্টি হয়েছে।
ঘটক হিংসার হাসি হাসল, সাধু সাধু। তবে তোমার মতো ভীষ্মের কাছ থেকে ওটা আশা করা যায় না—এই আর কি! যুদ্ধ থেকে ফিরেও যেমন কামিনীকাঞ্চনবর্জিত দিন কাটাচ্ছিলে, তাতে তুমি হঠাৎ—
এমন প্রতিজ্ঞা কি করেছিলাম যে মেয়েদের দেখলেই গঙ্গাস্নান করব?
তর্কে আমল না পেতে ঘটক ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করলে, তা বেশ। তবে তুমি আবার ইমিউনড নও কিনা। অনেক ঘাটের জল খেয়েছি আমরা—আমাদের কথা আলাদা। কিন্তু তোমাকে যদি একবার রোগে ধরে বাঁচানো শক্ত হবে।
থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইয়োর মেডিকেল অ্যাডভাইস—প্রণবেশ উঠে পড়ল, কিন্তু এখুনি বেরুতে হচ্ছে আমাকে।
কোথায়?—চোখের একটা তির্ষক ইঙ্গিত করলে ঘটক, সেই তার ওখানেই নাকি?
ঠিক ধরেছ। —চমকিত ঘটককে আরো নার্ভাস করে দিয়ে প্রণবেশ বললে, কিঞ্চিৎ বুদ্ধিও আছে দেখছি তোমার। আর শোনো। ইচ্ছে করলে তুমি এখন আমাকে ফলো করতে পারো। সাম মোর ডিশেজ ফর ইয়োর ফ্রেন্ডস।
জুতোর শব্দ তুলে প্রণবেশ বেরিয়ে গেল। ঘটক কিছুক্ষণ বসে রইল বোকার মতো, তারপর স্বগতোক্তি করলে, মরেছে।
কিন্তু সত্যি সত্যিই মরেছে প্রণবেশ। বিকেলে যেদিন ছুটি পায় সেদিন ওই চারতলার ফ্ল্যাট বাড়িটার আকর্ষণ কিছুতেই রোধ করতে পারে না সে। বেলাশেষের আলো এখন নেশার মতো নেমে আসে, সন্ধ্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘন হয়ে জমতে থাকে স্নায়ুর ওপরে। নিজের কাছে প্রথম প্রথম লজ্জা হত, সে স্তরটাও পেরিয়ে গেছে অনেকদিন।
বাইরের ঘরে আজ আর সুনীলা ছিল না, জয়াবতীও না। সোফার ওপরে পা তুলে শুয়েছিলেন একজন প্রৌঢ় অচেনা ভদ্রলোক। পাকা চুলে সৌখিন সিঁথি কাটা, পরনে সিল্কের পায়জামা আর পাঞ্জাবি, হাতে ধূমায়িত চুরুট। ভ্রূরেখা সংকীর্ণ করে ভদ্রলোক পরীক্ষকের ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মনে মনে প্রণবেশ ছটফট করে উঠল।
আপনি বোধ হয় ডক্টর প্রণবেশ ঘোষাল? আসুন, বসুন।
প্রণবেশ বসল। তারপর কুণ্ঠিত বিস্ময়ে একটা ঢোক গিলে বললে, আপনি—
ভদ্রলোক কথাটা কেড়ে নিলেন, আমি বি. মল্লিক—এঁদের কাছে মল্লিক সাহেব। আর এতদিন কোনো পরিচয় না থাকলেও নামটা অনেকদিন থেকেই জানি আপনার। তা সুনীলাকেই তো আপনি চান?—কেমন ধূর্ত হাসি হাসলেন মল্লিক সাহেব, দাঁড়ান, ডেকে দিচ্ছ।
গলা চড়িয়ে তীক্ষ্ণ কর্কশ স্বরে মল্লিক ডাকলেন . সুনীলা, ডক্টর ঘোষাল এসেছেন।
আসছি—সুনীলার সাড়া পাওয়া গেল।
ওর মা এখন বাড়িতে নেই অবশ্য। তাতে আপনার অসুবিধে নেই বোধ হয়?
হাসির সঙ্গে যেন চোখ টিপলেন মল্লিক।
বিরক্ত আর বিব্রত বোধ করলে প্রণবেশ। লোকটার মধ্যে কোথায় একটা প্রচ্ছন্ন ইতরতা আছে, আছে অশোভনভাবে খোঁচা দেবার একটা প্রয়াস। মুহূর্তের মধ্যে মল্লিকের মুখখানা দেখে নিল প্রণবেশ। দাঁতগুলো হলদে, গালে কপালে রেখার জটিলতা, চোখের কোলেকোলে কালো ভাঁজ। ডাক্তারের মন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল—এই বাড়িতে আসবার যোগ্য কি এ লোকটা?
মল্লিক হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, সঙ্গে গাড়ি এনেছেন বুঝি?
না, গাড়ি আমার নেই।
কবে কিনছেন?
লোকটা কি মোটর কোম্পানির এজেন্ট? সংক্ষেপে জবাব দিলে, সে কথা এখনো ভাবিনি।
মল্লিক নাকটা কুঁচকোলেন একটু, ওঃ! কিন্তু বাড়িটা তো নিজস্ব? না, ভাড়া দিয়ে থাকেন?
প্রণবেশের মুখ লাল হয়ে উঠল, ভালো করে পরিচয়টা হওয়ার আগেই এরকম সাংসারিক প্রশ্ন করবার কী অধিকার ওঁর আছে, এমনি একটা তিক্ত জিজ্ঞাসা ঠেলে এল গলার কাছে। কিন্তু তার আগেই ঘরে ঢুকল সুনীলা, পরনে নীল শাড়ি, প্রসাধনে উজ্জ্বল। বেরুবার জন্যেই তৈরি হয়ে এসেছে।
মল্লিক বললেন, একদম রেডি? বেরুবার জন্যে মুখিয়েই ছিলে বোধ করি? কিন্তু বাঃ—বাঃ! সুনীলা যে একেবারে নীলে নীলে একাকার! ”চলে নীল শাড়ি, নিঙাড়ি নিঙাড়ি”—
বিদ্যুৎবেগে মল্লিকের দিকে তাকিয়ে খরদৃষ্টিতে ভর্ৎসনা বর্ষণ করলে সুনীলা। তারপর তপ্ত মুখে প্রণবেশকে বললে, চলুন—
সঙ্গে সঙ্গেই প্রণবেশ উঠে পড়ল, বেরিয়ে গেল ঘরের বাইরে। আর একটু দেরি হলে হয়তো মল্লিককে আক্রমণ করে বসত।
ফেরা হবে কখন? —পেছন থেকে নির্লজ্জের মতো মল্লিক আবার প্রশ্ন ছুঁড়ল। সুনীলা কোনো জবাব দিলে না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শোনা গেল, পেছনে তীব্রভাবে শিস বাজাচ্ছে মল্লিক।
গাড়িতে ওঠবার পরে সুনীলাই স্তব্ধতা ভাঙল . কিছু মনে করেননি তো?
না, কেন মনে করব?
মল্লিক সাহেবের জন্য?
মনে করার কী আছে? —এতক্ষণের সঞ্চিত অসহ্য কৌতূহলটা প্রণবেশ মেলে ধরল, উনি বুঝি তোমাদের আত্মীয়?
সুনীলা জানালার দিকে মুখ ফেরাল, তৎক্ষণাৎ জবাব দিলে না। তারপর বললে, অনেকটাতাই বটে। কিন্তু—হঠাৎ তার দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠল, মল্লিক সাহেব কিছু বলছিলেন নাকি আপনাকে?
—বিশেষ কিছু নয়। জিজ্ঞেস করছিলেন, কবে গাড়ি কিনব, পৈতৃক বাড়ি আছে কি না আমার। ভদ্রলোক বোধ হয় একটু—
সুনীলা কিছুক্ষণ শক্ত হয়ে রইল, তারপর, আপনাকে একটা কথা বলব ভেবেছি—দ্বিধা করে শেষ করলে সুনীলা, যেদিন আসবেন, আগে একটা টেলিফোন করে দিলে ভালো হয়।
টেলিফোন? —প্রণবেশ ঘা খেল। এতদিন এই লৌকিকতাটুকুর প্রয়োজন হয়নি।
অপরাধে ম্লান হয়ে সুনীলা বললে, আর কোনো কারণ নেই, কখনো কখনো বাড়িতে হয়তো না-ও থাকতে পারি। আপনি এসে শুধু শুধু বসে থাকবেন—
কৈফিয়ৎটা মিথ্যের সংকোচ দিয়ে জড়ানো, জেরা করলেও আবরণটুকু এক মুহূর্তও টিকবে না। কিন্তু প্রণবেশের আর জের টানতে ইচ্ছে করল না। সব ঠিক আছে, অথচ কোথায় কীএকটা বাধছে ক্রমাগত। তাকে ধরা যাচ্ছে না, কিন্তু তার ক্ষতটা গভীর হয়ে আসছে প্রত্যেক দিন।
আজকের প্রোগ্রাম ছিল সিনেমা। কিন্তু ছবি আরম্ভ হতে তখনো দেরি আছে খানিকটা। দুজনে চা খেতে ঢুকল।
বেয়ারা অর্ডার নিয়ে যাওয়ার পরেও মাঝখানের আকাশটা কেমন মেঘগম্ভীর হয়ে রইল। অথচ, আজ নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না প্রণবেশ। নিজের কাছে যেটুকু কুণ্ঠা ছিল, সেটাকে ঘটকের ব্যঙ্গ ছিঁড়ে সরিয়ে দিয়েছে দূরে। চোখ-টেপা হাসিতে ইতর ভঙ্গিতে কী একটা কথা বলতে চেয়েছে মল্লিক সাহেব। চারদিক থেকে যেন সে আজ নগ্ন হয়ে গেছে, আর দ্বিধা করলে চলবে না।
সপ্রতিভভাবে সে হাসতে চাইল, বন্ধুদের বড্ড চোখ টাটাচ্ছে।
সুনীলা যেন নিজের মধ্যে তলিয়ে ছিল। মুখ তুলল, কিন্তু যেন শুনতে পেল না।
ওরা বলছে—পেশল হাতে টেবিলের একটা পায়া মুঠো করে ধরে সহজ আর দৃঢ় হতে চাইলে প্রণবেশ, আমার মতো ভীষ্মেরও নাকি মতিভ্রম ঘটছে। একটি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ঘোরাফেরা করার ব্যাপারটা খুব ভালো লাগছে না ওদের।
সুনীলা মাথা নীচু করলে। স্পষ্টোচ্চার প্রসাধন সত্ত্বেও গালের রঙ তার বিবর্ণ হয়ে এল, ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল অল্প অল্প।
মরিয়া প্রণবেশ বললে, আমি জবাব দিয়েছি, ভীষ্ম আমি নই, হতেও চাই না। —বেয়ারা ট্রে নামিয়ে দিয়ে গেল। সুনীলা চা তৈরি করতে লাগল নিঃশব্দে।
জবাবের জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আদালতে যেন স্বীকারোক্তি দিচ্ছি এমনিভাবে প্রণবেশ বলে চলল, ওরা বলছে, আমার নাকি আর বাঁচবার পথ নেই। নাই বা থাকল—উত্তেজিত উৎকণ্ঠ আবেগে সে ঝুঁকে পড়ল সুনীলার দিকে, তুমি কি মনে করো কোনো ক্ষতি আছে তা-তে?
চায়ের পেয়ালায় ঠোঁট ছুঁইয়েছিল সুনীলা। চুমুক না দিয়েই নামিয়ে রাখল।
আমার কথার জবাব দাও—প্রণবেশের উত্তেজনার মাত্রা ছাড়াতে লাগল স্তরে স্তরে, বলো।
সুনীলা মুমূর্ষূর মতো জ্যোতিহীন চোখে তাকাল, বন্ধুদের কথাই আপনার শোনা উচিত। এখনো ফেরবার উপায় আছে আপনার।
একথা তুমিও বলবে?—একটা আহত গোঙানি বেরুল প্রণবেশের গলা দিয়ে।
যা সত্যি, সে কথা সবাই বলবে।
সুনীলা!
প্রায় চাপা গর্জন করে উঠল প্রণবেশ, হয়তো আর একটু হলেই সুনীলার একখানা হাত সে চেপে ধরত। বিমর্ষ শ্রান্ত হাসি মুখে ফুটিয়ে সুনীলা বললে, চায়ের দোকানে বসে কী হচ্ছে এসব? তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন চা-টা, এখনি ছবি আরম্ভ হবে।
কিন্তু মনটাকে প্রাণপণে দমন করতে করতে প্রণবেশ চায়ের পেয়ালা মুখে তুলল। কিন্তু বিশ্রী রকমের তেতো লাগল চা-টা।
তারপর তেতো লাগল ছবিটাও। এমন ক্লান্তিকর দীর্ঘ ছবি জীবনে সে আর দেখেনি।
ফেরার পথে একবার যেন মনে হয়, জানালার বাইরে মুখ বের করে দিয়ে কাঁদছে সুনীলা। ইচ্ছে হল ওকে স্পর্শ করে, টেনে নিয়ে আসে বুকের ভেতর, মুহূর্তে চরম নিষ্পত্তি করে ফলে সব কিছুর।
কিন্তু সাহস হল না। নিজের মনের মধ্যেই একটা শক্ত বেড়া পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সুনীলাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে প্রণবেশ যখন বিদায় নিলে, রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা। ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল সুনীলা। বিস্বাদ একটা বেদনায় দেহমন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। মুখের ভেতরেও তিক্ত একটা অনুভূতি, চাপা জ্বর হয়েছে যেন। বারে বারে একটা নিঃশব্দ নিষেধ বাজছে নিজের মধ্যে, আর কেন—এইখানেই দাঁড়ি টানো। অন্যকে নিয়ে খেলবার আর নিজেকে নির্যাতন করবার একটা সীমা আছে—সে সীমা পেরিয়ে যাওয়ার আগেই তুমি থেমে দাঁড়াও।
এখন এই মুহূর্তে তার চারদিকের ফ্ল্যাট বাড়িটা ক্রমেই ঘন আর সংকুচিত হয়ে আসছে—তাকে ঘিরে ধরছে একটা ফাঁদের মতো। সিঁড়ির রেলিং আর পাশের দেয়াল তার হৃৎপিণ্ডকে চেপে ধরতে চায়—মুক্তি নেই, অথচ মৃত্যুও নেই। বাঁচতে পারবে না—মরতেও পারবে না,শুধু মাঝখানে দাঁড়িয়ে অক্সিজেন টানতে থাকবে—যেমন টানতে হয়েছিল হাসপাতালে কয়েকদিন।
ড্রয়িংরুমের দরজা খোলাই ছিল। মল্লিক সাহেব এখনো বসে আছে, তার চুরুটের ধোঁয়ায় ঘর প্রায় অন্ধকার। সোফার ওপর আধশোয়া জয়াবতীর মুখেও জলন্ত সিগারেট একটা।
সুনীলা পাশ কাটিয়ে ডানদিকের দরজার দিকে এগোচ্ছিল। জয়াবতী ডাকলেন, এই সুনী, দাঁড়া।
অপ্রসন্নভাবে সুনীলা থেমে দাঁড়াল, কী বলবে বলো।
অত তড়বড় করছিস কেন?—জয়াবতী ধমক দিলেন, কিছু দিলে আজ ডাক্তার?
কী আবার দেবেন? —একটা আসন্ন সংঘর্ষ অনুমান করে সুনীলা সোফায় পিঠ আশ্রয় করলে।
সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে খিঁচিয়ে উঠলেন জয়াবতী . তবে ওর সঙ্গে ঘোরা কেন অমন করে? এর চাইতে শেঠজির ছেলেটার সঙ্গে বেরুলেও এতদিনে দু’হাজার টাকা ঘরে আসত। এই তো মল্লিক সাহেব বলছিলেন—
আমি এখন বড্ড ক্লান্ত মা, আমার ভালো লাগছে না—সুনীলা আবার যাওয়ার উপক্রম করলে।
দাঁড়াও, দাঁড়াও! জয়াবতী কুৎসিত গলায় বললেন, আমারই বড্ড ভালো লাগছে কি না! এত খরচ-পত্তর করে এখানে সব সাজিয়ে বসলাম, সে বুঝি দুটো মিঠে মিঠে কথা শোনাবার জন্যে? নগদ টাকা না হোক অন্তত একটা ঘড়ি দিলে দিতে পারত, দিতে পারত দু-একখানা গয়না। ভুল আমারি হয়েছিল। সুন্দর চেহারা আর কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল বেশ ভালোঘরের ছেলে—
থামো মা, থামো। —আর্ত হয়ে সুনীলা বললে, যত ছোটো আমরা হই না কেন, আমাদেরও কৃতজ্ঞতা বলে একটা জিনিস আছে। যখন মরতে চলেছিলাম, নিজের রক্ত দিয়ে উনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। সে কথাটা অন্তত তোমার ভোলা উচিত নয়।
রেখাজটিল মুখের বিচিত্র ভঙ্গিতে হলদে দাঁতগুলো উদঘাটিত করে দিয়ে মল্লিক সাহেব এতক্ষণ লোলুপ দৃষ্টিতে লক্ষ করছিলেন সুনীলাকে। এবারে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে হেসে উঠলেন সশব্দে।
তোমার জন্যে ব্লাড? ওতে বাহাদুরি নেই। অমন চাঁদমুখের দিকে তাকালে আমার নিজেরই গলা কেটে ব্লাড দিতে ইচ্ছে করে, ছেলে-ছোকরারা তো কোন ছার!
দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ ঘৃণা জ্বেলে সুনীলা মল্লিক সাহেবকে দগ্ধ করতে চাইল, সবাইকে আপনার চোখ দিয়ে নাই বা দেখলেন মল্লিক সাহেব। আপনি ছাড়াও মানুষ আছে সংসারে।
আছে নাকি? —অশ্লীল একটা মুখভঙ্গি করলেন মল্লিক সাহেব, যাক শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। ওগো জয়মণি, তোমার আর ভাবনা নেই। তোমার লায়েক মেয়ে অ্যাদ্দিনে মানুষ চিনতে শিখেছে, আমরা এখন বাতিল!
খোঁচা-খাওয়া গোখরো সাপের মতো ফণা তুললেন জয়াবতী। তাঁর চোখ থেকে বিষ ঝরে পড়ছে। মনে হল, মেয়ের গায়ে হাত তোলবার জন্যে এই মুহূর্তেই তিনি প্রস্তুত।
চুপ কর, সুনী, খুব হয়েছে। রক্ত দিয়েছিল, বেশ তো। এক মাস ধরে লাই দিয়েছিস সেজন্যে। কিন্তু তাই বলে খালি হাতে কতদিন চলবে এসব ইয়ার্কি? তোর ভরসাতেই তো সব। এরকমভাবে কেবল বসে বসে লোকসান করলে আর ঠাট বজায় রাখা শক্ত হবে—দামি খদ্দের কেউ ভিড়বে না। তুই ডাক্তারকে আসতে বারণ করে দে। আর কাল মল্লিক সাহেব শেঠের ছেলেকে নিয়ে আসবেন—তার সঙ্গেই তুই বেরোবি এখন থেকে।
ঠোঁট চেপে কঠিন গলায় সুনীলা বললে, ক্ষমা করো মা—আমি পারব না।
পারবি নে? —অসহ্য ক্রোধে জয়াবতী কাঠ হয়ে গেলেন, কথা বেরুল না মুখ দিয়ে।
মল্লিক সাহেব কুটিল ব্যঙ্গে বীভৎস মুখে বললেন, কেন পারবে না? ‘লভ’ বুঝি? বিয়ে করবে ওকে?
লভ! বিয়ে!—জয়াবতী এবার ফেটে পড়লেন, ওই সব করার জন্যেই বুঝি তোমায় লেখাপড়া শিখিয়েছি? পাড়া ছেড়ে এখানে এসে ঘর নিয়েছি? শোন সুনি! এর পরে ডাক্তার এলে ঝাঁটা মেরে আমিই বিদেয় করব—তোকে কিছু করতে হবে না। লভ—বিয়ে। —জয়াবতী বিকটভাবে আবার মুখ ভ্যাংচালেন, ওসব ভদ্দর ঘরের নবেল পড়া মেয়ের সখ দিয়ে তোমার আর কাজ নেই বাছা!
কিন্তু প্রণবেশকে কারো কিছু বলবার দরকার ছিল না—জয়াবতীরও না। কারণ সুনীলার ছোটো হাতব্যাগটা ট্যাক্সিতে পড়ে থাকতে দেখে, সেইটে নিয়ে মিনিট দুয়েক পরেই ফিরে এসেছিল প্রণবেশ। ঘরে ঢোকবার তার আর দরকার হয়নি। দোরগোড়াতেই ব্যাগটা ফেলে দিয়ে নিঃশব্দে কখন সে বিদায় নিয়েছে, কেউ সেটা টেরও পায়নি।
পরশু রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে, আমি তোমার কাছে আসব।
বিশ্বাস করো, কোনো অপবিত্র দেহে কিংবা মনে তোমার রক্ত মেশেনি।—এক জন্মের অপরাধ ছাড়া আর কোনো অপরাধই আমার নেই। সেই অপরাধ ক্ষমা করার মতো উদারতা তোমার আছে সে কথাও আমি বিশ্বাস করি।
আমাকে যদি তুমি গ্রহণ না করো, তবে কোথায় আমাকে নেমে যেতে হবে সে তুমি জানো। তাই আমার সমস্ত পরিণাম তোমার হাতেই আমি তুলে দিলাম। আমার জীবনমৃত্যু দুই-ই তোমার কাছে ধরে দিয়েছি—এবার তুমিই বিচার করো।
সেই পরশুর রাত আজ এসেছে।
বাইরে বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। ভূতে পাওয়া অন্ধকারের কান্না বাজছে শার্সিতে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। বারোটার ঘরে।
কাঁপা হাতে গ্লাসটা নামিয়ে ত্রিশবার পড়া চিঠিখানা আরো একবার পড়ল প্রণবেশ, সেই প্রথম চিঠির মতোই কাগজ, সেই অস্পষ্ট সুরভির আমেজ—এতবার করে পড়াতেও সেটা মুছে যায়নি। সেই হাতের লেখায় একটি ভীরু সংশয়—একটি তরুণ মনের আকুতি।
প্রণবেশ হাসল, গ্লাসে নির্জলা পেগ ঢালল আর একটা। চার বছর পরে ট্রেঞ্চের রাত্রিটা ফিরে এসেছে আবার। জানালার শার্সিতে বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা মেশিনগানের গুলিরমতো এসে লাগছে। বিদ্যুৎ ঝলকে যাচ্ছে—শেল ফাটবার অগ্নিরাগে যেন চমকে উঠছেচারদিক।
আসুক সুনীলা, আসুক। দরজা খুলেই সে রেখেছে। আসুক এই ঝড়ের রাত্রিতে—আসুক এই অন্ধকারের পথ দিয়ে। নেশায় মাথাটা টেবিলের ওপর নুয়ে আসতে চাইল প্রণবেশের—কুঁকড়ে আসতে চাইল চোখের পাতা। গড়ের মাঠের সেই মাতালটার মতোই সেও বিড়বিড় করতে লাগল . আসুক, আসুক, সুনীলা!
কিন্তু সুনীলা তো এসেই ছিল। এসেছিল তিমিরাভিসারে, এই অন্ধকার—এই বৃষ্টির পথ দিয়ে। তবু তাকে ফিরে যেতে হয়েছে নিঃশব্দে দরজার গোড়া থেকে। সেদিন যেমন করে প্রণবেশ ফিরে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি করেই।
খোলা দরজা দিয়ে সে দেখেছে মদের গ্লাস—দেখেছে মদের গ্লাসের নীচে তার চিঠি। বুঝতে পেরেছে, প্রণবেশ তাকে তুলে নিতে চায় না—নেশার মধ্য দিয়ে তার কাছেইনেমে আসতে চায়। তাকে বাঁচাবার শক্তি নেই প্রণবেশের, সে পারে তারই সঙ্গে আত্মহত্যা করতে।
এর পরে কি আর সেখানে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল সুনীলার পক্ষে? সম্ভব ছিল এক মুহূর্তের জন্যেও?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন