বিধবা কি সধবা কি করে বুঝব বলুন!
সরু পাড় কি নিপাড় শাদা শাড়ি এখন অনেকেই পরেন। ওটা স্টাইল।
আর চুড়ি না রাখা।
সিঁদুর না পরা।
কি এমনভাবে সিঁদুরের টিপ চুলের অরণ্যে লুকিয়ে রাখবে যে কপালের সঙ্গে কপাল ঠেকলে যদি আপনার মালুম হয় আলপিনের ডগার আঁচড়টি। অনেক সময়ই হয় না।
তাছাড়া মুখখানা প্রায় সব সময়ই বাঁ দিকের পার্টিশন তাক করে ধরে ছিল বলে মেয়েটির সিঁথি নজরেই পড়ছিল না।
চুড়ির বদলে বাঁ কব্জিতে ছোট ছেলেদের মোজার গার্ডারের মত কালো সরু ফিতায় বাঁধা ঘড়ি। ওর তলে রাখা হাতের সাদা ঈষৎ চ্যাপ্টা সরু কব্জির মাথায় তেঁতুল বিচির মত ঘড়িটা দেখতে দেখতে কেন জানি আমি মোটামুটি একটা বয়স আন্দাজ করে ফেললাম। ত্রিশ বত্রিশ? আটাশও হতে পারে।
কি আর একটু কম।
চবিবশ। বাইশ?
বাইশ হলে খুব কম করে ধরা হত। বস্তুত একদিকে বর্ষার কচি মূলোর মত মসৃণ কোমল কব্জি, আবার অন্য দিকে ওর উপর মাংসল ভারি পা দুটো বয়েস সম্পর্কে মনে কেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। তাই হয়। অনেক সময় কোনো মেয়ের চিবুক ও চোয়াল আপনাকে যে বয়সের ইঙ্গিত দেবে, গলা বা ঘাড়ের দিকে চোখ রাখা মাত্র আপনার সেই অনুমান মিথ্যা মনে হবে। চিবুকে যদি চবিবশ বছর বয়স লেখা থাকে ঘাড়ের দিকে তাকান মাত্র আপনার মনে হবে—না আরো বেশী, বত্রিশ।
এই ক্ষেত্রে আমি সে ধরনের একটা গোলমালে পড়েছিলাম। চেয়ারের তল দিয়ে মেয়েটির চটি খোলা পায়ের যেখানটায় শাদা লেস পরানো সায়াটা উড়ু-উড়ু করছিল (বস্তুত এত জোরে ও ফ্যান চালিয়ে দিয়েছিল যে হাওয়ায় তার কামরার ভিতর ঝড় বইছিল) দুবার আমি সে জায়গাটা বেশ ভালো করেই দেখতে পেলাম। তামাটে বেশ শক্ত মতন মাংসের একট ডেলা। অথচ সেই তুলনায় তার হাতটা অনেক বেশী শুভ্র কোমল কচি মনে হচ্ছিল।
সুতরাং হাত যে বয়স বলছিল, পা বলছিল তার উল্টোটা। কিন্তু তাহলেও আমি পায়ের বয়সটা বাতিল করে দিলাম। কেননা ঝড়ো হাওয়ায় মুহুর্মুহু খোঁপা থেকে আঁচলটা যখন খসে পড়ছিল ওর গলা ও ঘাড়ের সুন্দর কোমল বাঁক ও রেখাগুলি দেখে চবিবশ পঁচিশের বেশী বয়স হবে না নিশ্চিন্ত হতে পারলাম!
আমার এতটা দেখার সুবিধা হত না।
আমি অনেকক্ষণ আগেই চা শেষ করে চুপচাপ বসে ছিলাম। একজন কেউ ভিতরে পর্দা খাটানো কামরায় বসে খাচ্ছে হোটেলে (হোটেল রেষ্টুরেন্ট) পা দিয়েই অনুমান করতে পেরেছিলাম। পর্দার ওপারে একজন আছে কি দুজন আছে প্রথমটায় অবশ্য ঠিক করতে পারিনি। এবং ধরতে না পারাটা কাজের কথা না—কোন বুদ্ধিমান যুবকই মেয়েটি একলা এসেছেন না সঙ্গে অন্য লোক আছে, না জানা পর্যন্ত নিশ্চেষ্ট থাকেন না!
আমি চেয়ারটা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে পর্দার দিকে চোখ রেখে এপারে বসে আর একটা কিছুর অর্ডার দিতে তৈরি হতে লাগলাম।
পুরুষ খদ্দেরের গলার শব্দ শুনে কিনা ঈশ্বর জানেন, ও-ঘরের পাখা হঠাৎ বেগবতী হয়ে উঠল। তারপর তো পর্দা কতবার উঠল, কতবার নড়ল, কতবার দরজা থেকে তা সরে গেল। ভিতরের হুকুম পেলেন কিনা বোঝা গেল না যে ছেলেটা আর একবার ভাত নিয়ে সেদিকে যাচ্ছিল পর্দাটা দলা পাকিয়ে পার্টিশনের মাথায় তুলে দিলে!
ভাতের পর দেখলাম আবার ডালের বাটি গেল, এক দলা আলু সিদ্ধ।
ডিম মাংস কালিয়া কোর্মা দো-পেঁয়াজি ইলিশ-ভাতের গন্ধে চারদিক ম-ম করছিল। চপ কাটলেট গ্রীল মোগলাই পরটার অর্ডার পড়ছে অন্য দিকে। বেশ বড় রেষ্টুরেন্ট।
কিন্তু সেই ডিশে ও কামড়ায় ডাল আর আলু সিদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু প্রবেশ করল না লক্ষ্য করে সচকিত হয়ে উঠলাম।
এটা অবশ্য কাজের কথা নয়।
অবস্থা ও রুচিভেদে এক একজন এক একরকমে খাওয়া পছন্দ করে। একটা আস্ত সিগারেট শেষ করে আমি একটা চিংড়ি কাটলেট-এর অর্ডার দিলাম। সামনের কামরায় একটি মেয়ে খাচ্ছে আর সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে একটা চেয়ার দখল করে এমনি বসে থাকাটা অশোভন। কাজেই অতিরিক্ত খরচে নামা গেল।
ছেলেটাকে ডাকলাম।
যে উদ্দেশ্যে গলা বড় করে আমি ছেলেটাকে ডাকছিলাম তাও চরিতার্থ হল। পর পর দুবার ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটি এদিকে তাকায় ও আমাকে দেখে।
একটি মেয়ে সম্পর্কে আমি এতটা উৎসুক কেন, আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। ভাবছেন লোকটা অভদ্র ইতর।
আসলে কিন্তু আমি তা না। আমি ট্যাক্সি চালাই। যারা ট্যাক্সি চালায় তারা সব সময়ই চোখ কান সজাগ রাখে। কে কখন ডাকে, কার কখন হঠাৎ ট্যাক্সির দরকার হয় তার ঠিক আছে কিছু।
হ্যাঁ, আমার প্রথমেই মনে হল যেন খাওয়া সেরেই মেয়েটি নিশ্চয় গাড়ি ঘোড়া কিছু একটা ডাকবে।
আপনারা ঠোঁট ঠিপে হাসছেন!
কিন্তু এটা তো সত্য, যে নিত্য যাত্রী পারাপার করে, কার কখন গাড়ির দরকার হবে রাস্তায়- ঘাটে লোকের চোখ মুখ দেখলে আপনাদের চেয়ে সে একটু আগে বুঝতে পারে।
হ্যাঁ, আট বছর আমি কলকাতা শহরে ট্যাক্সি চালাই। আমার নিজের গাড়ি।
গাড়ি কিনে আমি এই ব্যবসা করছি ঠিক তা না কিন্তু।
বরং গাড়ি চড়ে দিব্যি হাওয়া খাওয়া যাবে এই মতলবে আমার গাড়ি কেনা হয়েছিল। হাম্বার। এক নম্বরের গাড়ি এটা মশাই আমার।
হ্যাঁ, ওতে চড়ে হাওয়া খাওয়ার মতলবটা আমার চেয়ে আমার বাবার বেশি ছিল। কিন্তু কেনার এক বছর পরে বাবা মারা যান।
তার পরের বছর আমাদের দেশ ভাগ হয়। অর্থাৎ পাকিস্তানের ছোটখাট জমিদারিটা গেল।
ফতুর, আমি তখন ফতুর। জমানো টাকা কিছুই প্রায় ছিল না। জমিদারিতে ক’বছর ধরেই ঘুণ ধরেছিল।
আর কি, গাড়িখানা সম্বল করে আমার স্ত্রী রমার হাত ধরে হিন্দুস্থান, মানে কলকাতায় বড়মামার বাসায় এসে উঠলাম।
হুঁ, একডালিয়া রোডে।
গাড়িটা এবং বলতে সঙ্কোচ নেই, রমাও প্রায় নতুনই ছিল। গাড়ি কেনার ছ’মাস আগে তো আমি বিয়ে করেছিলাম।
যাকগে, এখন জমিদার-নন্দন চাকুরে মামার ঘাড়ে চেপে তার অন্নধবংস করবে তা-ও একলা না সস্ত্রীক, অত্যন্ত নিন্দনীয়। বুঝলাম।
তাছাড়া মামা পারতেনও না।
বুদ্ধি করে বৌকে মামাশ্বশুরের জিম্মায় রেখে আমি গাড়িটা নিয়ে রাস্তায় বেরোলাম।
হুঁ, ট্যাক্সির লাইসেন্স নিয়ে (অবশ্য সরকারী চাকুরে আমার মামাই তদ্বির-টদ্বির করিয়ে চট করে লাইসেন্সটা বার করতে সাহায্য করলেন)। বেশ দু’পয়সা কামাতে লাগলাম।
চাকরি, বিশেষ করে অফিসের লেখা-পড়ার কাজের বিদ্যা মশাই, আমার ছিল না বলে রাখছি—জমিদারের বাচ্চা, দুধের সর আর মাছের পেট খেয়ে প্রজাদের চোখ রাঙিয়ে জমিদারি চালাব এই স্বপ্ন নিয়েই বড় হয়েছিলাম। তা সে সুখ কপালে রইল না।
হুঁ, আমি ও আমার গাড়ি যখন দিবারাত্র কলকাতা শহর চষতে লাগলাম আর একজন কিছু দূরে একডালিয়া রোডে চুপ করে বসে রইল না। রমা।
পাকিস্তান থেকে সে-ও নতুন এসেছে তাজ্জব শহরে। গাড়িটা যদি একডালিয়া রোডের বাসায় এমনি পড়ে থাকত তো আমার মামা বিকাশ রায়ের বড় মেয়ে টুনি (ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছেন) ওটাকে ব্যবহার করত। সে কি এক আধ বার। দিনের মধ্যে বিশ বার। সে-বাড়ি উঠেই দু-এক দিনের মধ্যে আমি টের পেয়েছিলাম। নতুন কলেজী হাওয়া গায়ে লেগেছে টুনির। তার ওপর চেহারাখানাও মিষ্টি মতন। তায় আবার সবে লাগছিল ষোলটা বসন্তের হাওয়া। মশাই, ও কি আর ওর মধ্যে ছিল। টুনি বন্ধুদের সঙ্গেই দেখা আর শেষ করে উঠতে পারছিল না।
অবশ্য বিকাশবাবু চেষ্টা করেছিলেন অনেকদিন থেকেই গাড়ি কিনতে। তা সে কি আর চাকুরে লোকের পক্ষে চট করে হয় মশাই, তা-ও এই গ্রেডে থেকে।
কাজেই বুঝতে পারছেন টুনি গাড়িটা একবার বাড়ির মধ্যে পেয়ে প্রাণখুলে বেড়াতে শুরু করেছিল। ওটাকে আমার সঙ্গে না নিয়ে এলে কী অবস্থাটা হত?
গাড়ি রেহাই পেল, কিন্তু রমা রেহাই পায়নি। মফঃস্বল থেকে নতুন মেয়ে এসেছে। তা-ও একডালিয়া রোডের মত ফ্যাশানেবল পাড়ায়। তার ওপর রমার চেহারা ওপাড়ার অনেক মেয়ের চেয়েই ভালো—আর এই তো সবে বিয়ে হয়েছে, এখনো ইয়ে—
‘বৌদি বৌদি।’
হ্যাঁ, বিকাশ রায়ের বড় ছেলে বেণু রায়। কী পাজি মশাই, যদি দেখতেন। এমনি মুখ দেখলে মনে হবে সাত চড়ে রা বেরোয় না। ভাজা মাছ উল্টে খেতে শেখেনি। আর এদিকে তলে তলে হাড়বদমায়েস।
‘বৌদি বৌদি।’
ঐ যে বললাম। টুনি করত আমার গাড়িটার সদ্ব্যবহার, আর বেণু হারমজাদা করতে লাগল আমার স্ত্রী রমাকে ব্যবহার। হ্যাঁ, ঐ যথার্থ শব্দ। বৌদি না হলে চা-খাওয়া হয় না, বাবুর বিছানা ঠিক থাকে না, বৌদি টেবিলের বই গুছিয়ে না রাখলে গোছান হয় না, ধোবার কাপড় এলে সেগুলো সুটকেসে তুলতে ও দরকার মত একটা একটা করে বার করে দিতে বৌদি। ভাত খেয়ে উঠে বৌদির হাতের মুখশুদ্ধি মশলা মিষ্টি। বাথরুমে যেতে তোয়ালে সাবানের জন্য বৌদির ডাক।
কেন হবে না মশাই!
রাতদিন দেখছিল সমর্থ সব মেয়ে।
সমর্থ মেয়েরা বেছে বেছে সমর্থ পুরুষকে পাকড়াও করছে। একত্র বেড়ানো, একসঙ্গে সিনেমা দেখা।
আমি তো আগেও কলকাতায় এসেছি। কিন্তু হালে, পাকিস্তান ছেড়ে এসে এবার রকম সকম দেখে বুদ্ধি লোপ। আর একডালিয়া রোডের মত বাবুপাড়া। অবাধ মেলামেশার যেন বান ডাকছিল।
কিন্তু আমাদের সোনার চাঁদ বেণু সুবিধে করতে পারছিল না বাপের অবস্থা তো আর দশটি ছেলের বাপের মতন না। বুঝতে পারছেন। রাজা জমিদারের মত অবস্থার ঘরের ছেলের সংখ্যা সেখানে অনেক কম।
আর লুটিছিল সব তারাই।
গাড়ি আছে, বানি আছে, হাতে দুটো তিনটি করে হীরে চুনীর আংটি সব ছেলের।
মশাই, কায়দা করে বাবা বনেদী পাড়ায় বড়মানুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকছিল বটে।
কিন্তু চারদিকের অবস্থা যে অন্যরকম। ছেলে মেয়ে দুটোরই উপোসে কাটছিল। টুনি পাচ্ছিল না একটা গাড়ি বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। আহা কী সব বন্ধু। হাতিবাগান না সিমলা স্ট্রীট থেকে একদিন একটা ছেলে গিয়েছিল ওবাড়ি। ছেঁড়া স্যাণ্ডেল, গায়ে কাঁধছেড়া ময়লা পাঞ্জাবী। শুনলাম ঐ নাকি টুনির লেটেস্ট। তা যেমন অবস্থার ঘরের মেয়ে এর চেয়ে ভালো ছেলে ও যোগাড় পারত কি?
আর এদিকে ভুগছিলেন বেণুবাবু।
নতুন গোঁফ কামাচ্ছেন। কলেজে একটা পাস দিয়েছেন। আদ্দি মলমলটা যে গায়ে না উঠছে তা নয়, পায়ে হরিণ চামড়ার চটি, বোতামের গর্তে একটা দুটো গোলাপ ফুলও মাঝে মাঝে গোঁজা হয় এবং মাথায় একটু আধটু গন্ধ তেল। কিন্তু ঐ। এর বেশি না। পকেটে। পার্সে আর ক’টাকা নিয়ে চলাফেরা করতেন সাব-ডেপুটির ছেলে? এই বিত্ত নিয়ে ওখানকার মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করা! আমার তো মনে হয় কারো চুলের ডগটি ও ছুঁতে পারেনি ওপাড়ার।
তার শোধ তুলল সে রমার ওপর। হ্যাঁ, আমার স্ত্রী। আত্মীয়াও বটে, নারী তো বটেই। আঠারো বছর বয়েসে সবে পা দিয়েছিল রমা। আর, বেণু ওকে পেলে কোথায়—রাস্তায় ঘাটে না, বাড়িতে, ঘরে, একেবারে হাতের মুঠোর মধ্যে।
‘বৌদি বৌদি।’
মানে উপোসী বাঘ হরিণের সাক্ষাৎ পেল। কি, আমি খুব বেশি দোষ দিই না রমার। কি আর তেমন বুদ্ধিসুদ্ধি হবে ওই বয়েসে, পাড়াগাঁয়ে থাকে লেখাপড়া শিখে চোখমুখ ফুটবে তারও খুব একটা সুযোগ পায়নি। আদুরে বাপের মেয়ে মাঘমণ্ডল ব্রত করে আর দেয়ালির রাতে হাজার বাতি ও রংমশাল জ্বালিয়ে বড় হতে না হতে টুপ করে একদিন বিয়ে হয়ে গেল।
তাছাড়াও একটা শয়তান যদি একটি মেয়ের মুখের ওপর চবিবশ ঘন্টা নিশ্বাস ফেলতে থাকে—
একডালিয়া রোডের বাড়ির শোবার ঘরে, বাথরুমে, বাগানে, ছাদে আধখানা মাথা নষ্ট হয়েছিল রমার। বাকি আধখানা হল বাইরে রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে এবং আর কোথায় কোথায় বেণু ওকে নিয়ে গিয়েছিল জানি না। এদিকে আমাকে থাকতে হচ্ছিল বাইরে বাইরে গাড়ি নিয়ে রোজগারের ধান্দায়। টের পাইনি। কিন্তু যখন টের পেলাম তখন সব শেষ হয়ে গেছে। না, একটা সান্ত্বনা থাকত যদি বেণু ওকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে কোথাও ঘর-সংসার পাতত—কিন্তু তা সে করেনি, করার ইচ্ছাও ছিল না হয়তো এসব রেওয়াজ এই শহরে আজকাল উঠে গেছে। একডালিয়া রোডের বাসায় যাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। দরকার ছিল না। রমাও সেখানে ছিল না জানতাম। নারকেলডাঙ্গার কাছাকাছি একটা টিনের শেড ভাড়া করে আমি আমার ট্যাক্সি নিয়ে থাকি। তখনই একদিন খবর পেয়েছিলাম রমা নাকি ধর্মতলার কোন একটা বার-এ মদ খেয়ে এক রাত্রে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। বেণু রায়? না, সঙ্গিনী নিয়ে শুঁড়িখানায় বসে ফূর্তি করার পয়সা তার ছিল না। হাত বদল হয়ে হয়েই রমা সেদিন কার কাছে গিয়ে পড়েছিল। তারপর বেশ কিছুদিন আর আমার স্ত্রী সম্পর্কে কেউ কোন সংবাদ দেয়নি।
তারপর বছর তিন বাদে সংবাদ পেলাম দেরাদুন না কোথাকার হাসপাতালে আড়াই মাস একটা ঘা নিয়ে শুয়ে থেকে তারপর রমা শেষ নিশ্বাস ফেলেছে।
শুনে আমিও শান্তির নিশ্বাস ফেললাম।
তারপর, তারপর আমি নারকেলডাঙ্গা থেকে উঠে এসে সার্কুলার রোড ও শেয়ালদার কাছাকাছি একটা জায়গায় একটা টালির শেড ভাড়া করে গাড়ি নিয়ে আছি, হুঁ তেমনি ট্যাক্সিড্রাইভার। তবে রোজগার এখন বেড়েছে। বেড়েছে মানে বেশ বেড়েছে।
না, পূর্ব পরিচয় দিলাম এই জন্যে যে আমার ওপর দিয়ে, হ্যাঁ ভাগ্যের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে।
আপনারা শুনলে হাসবেন।
হাসবেন এবং দুঃখও করবেন।
এবং এটা খুবই সত্য যে লোকে বলে যে, ঈশ্বর একদিকে কেড়ে নিলে আর একদিক দিয়ে দেয়।
স্ত্রী, জমিদারী গেছে। দেশ গেছে। কিন্তু যেমন দিনকাল। খুব একটা খারাপ অবস্থার মধ্যে সে আজ এই শহরে আমাকে থাকতে না হত তার বিশ্বাস ছিল কি? হ্যাঁ, আমি টাকা পয়সার কথাই বলছি। দিব্যি আছি। সুখই বলা যায়। আমি, দেখুন ইচ্ছে করলে, রোজ এক বোতল বিয়ার খেতে পারি। দুপুরবেলা আস্তানায় ফিরে গিয়ে সসপ্যানে করে আলুসিদ্ধ ভাত রান্না করে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। শেয়ালদা কি ধর্মতলার কোন হোটেলে তিন টাকা সাড়ে তিন টাকা খরচ করে এখন মাংস ভাত চালাই। তবে একটু রয়ে-সয়ে খাওয়া দাওয়া করি আর মদটদও পারতপক্ষে অভ্যাসে আনতে চাই না। আমার পেটের ধাত ছোটবেলা থেকেই একটু আধটু খারাপ। লিভারের জোর কম।
তার সুবিধা হল এই যে, অপব্যয় না করার ফলে দু’চার হাজার টাকা আমি যখন তখন বার করে দিতে পারি। একটা একাউন্ট খুলেছি ব্যাঙ্কে। খাই-খরচা বাদ দিয়ে যে টাকাটা বাঁচে ওখানেই ফেলে রাখি।
এতক্ষণ পর নিশ্চয়ই আপনারা অনুমান করতে পারছেন আমি অত লোলুপ দৃষ্টিতে কেন বারবার মেয়েটিকে দেখছি। খাওয়া দেখছিলাম।
হ্যাঁ, কখন খাওয়া শেষ হবে আর বেরিয়ে এসে আমার গাড়িতে উঠবে! আরও ক’টা টাকা পাব। ড্রাইভাররা, বিশেষ করে যারা ট্যাক্সি চালায়, তাদের চিন্তাটা সাধারণত এখাতেই বয়। অন্তত প্রথমে বইতে শুরু করে।—আর তা ছাড়াও আমি গোপন করব না, মেয়েটিকে যখন দেখছিলাম তখন তার হাত, পা, পিঠ, কাঁধ, চুল, গায়ের রং এমন কি কোমরে কতটা মাংস নেই আর বুকে কতটা মাংস বেশি আছে দু চোখ দিয়ে জরীপ করলাম। দূর থেকে যতটা সম্ভব।
হাওয়ার দাপটে যখন খোঁপা থেকে আঁচলটা পিঠে নামল ও পরে পিঠ থেকে সরে গিয়ে আর একটা কাঁধের কাছে উড়ু উড়ু করে তখন আমি তার এ-কাঁধটা দেখতে পাই, বুকের এপাশের সুগোল মসৃণতা। তারপরেই অবশ্য ধীরে সুস্থে একটা কাটলেটের অর্ডার দিই। না হলে আর এই গরমে আমার কাটলেট খাওয়ার ইচ্ছা—
কেননা এ-কাঁধের কাপড় সামলাতে এদিকে ও ঘার ফেরাতে আমার চোখের সঙ্গে ওর চোখ বেঁধে গেল! ঐ এক সেকেণ্ড সময়ের মধ্যেই বুঝে নিতে পারলাম গাড়ির দরকার হবে।
কাটলেট শেষ করে আর একটা সিগারেট ধরাই।
ব্যক্তিগতভাবে আমার যে খুব একটা লোভ হচ্ছিল বৌটিকে দেখে, তা না।
তাছাড়া, নিজের স্ত্রী, রমার কাছে কামড় খাওয়ার পর স্ত্রীলোকেদের আমি এড়িয়েই চলি। বেশ আছি একলা আমার টিনের শেডে। খাই-দাই ফুর্তি করি। তা না, জমিদারের ছেলে, দেশের অনেক বড়লোক বন্ধু পেয়ে গেছি এখন এই শহরে। হয়তো অনেকে আগে বড়োলোক ছিল না, এখন হয়েছে, নিজেদের চেষ্টা, বুদ্ধি ও ভাগ্যের জোরে। ব্যবসাকেন্দ্রে আমার আনাগোনা একটু বেশি! তাঁদের আমাকে একটু সহানুভূতি করাও বটে। তাঁরা ডাকছেন, তাদের ছেলেমেয়েরা ডাকছেন, আত্মীয় এবং বন্ধুর দরকার হলেই আমার গাড়ি ভাড়া করেন। বালিগঞ্জ থেকে ভবানীপুর, ভবানীপুর থেকে গড়পার, গড়পার থেকে নতুন বাবুপাড়া লিনটন স্ট্রীট, সেখান থেকে সোজা পার্ক স্ট্রীট এবং সেখান থেকে বেরিয়ে ডালহৌসী, কি চৌরঙ্গী কি ধরমতলা। পুরুষ—আমি আপনাদের কাছে যখন কিছুই গোপন করব না তখন বলে রাখি, পুরুষের চেয়ে মেয়েরাই আমাকে বেশি ডাকে। তাই বলছিলাম, ভগবান আমার একদিক নিয়েছেন আর একদিক পূরণ করেছেন। এক এক সময় ভাবি, এক কালে জমিদার ছিলাম, আমার চেহারায়, চলায় বলায় তার পরিচয় এখনো একটু আধটু লেগে আছে বলে কি তারা আমার ট্যাক্সিতে চাপতে পছন্দ করেন! আমিও আমার চেহারা এবং পোশাক যতটা সম্ভব সুন্দর সুদৃশ্যে রাখতে চেষ্টা করি এবং ফি মাসে গাড়িটার রং ফিরিয়ে ওটাকে তকতকে ঝকঝকে রাখাতে চেষ্টার ত্রুটি করি না। কেন তা করব না বলুন, আর দশটা ট্যাক্সিও যদি পর পর দাঁড়িয়ে থাকে, বালিগঞ্জের সেই সুন্দরী মেয়েটি, কি যেন নাম—উমা সেন, হাত তুলে ঠিক আমাকেই ডাকবে। লিনটন স্ট্রীটের সেই রূপসী বৌ, রুবি রায়—যদি কষ্ট করে একটু হেঁটে এসেও আমার গাড়ি ধরতে হয় তো তা করতে সে ভ্রূক্ষেপ করে না। রাস্তায় আর পাঁচটা ট্যাক্সিওয়ালা বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে শুধু দেখে। গড়পাড়ের অসীমা চ্যটার্জী, পদ্মপুকুরের তৃপ্তি চৌধুরী, মোহনবাগান স্ট্রীটের মালা রায়, পার্ক সার্কাসের চামেলী, শোভাবাজারের সুমিতা এবং আরও একশটি মেয়ের বাড়ির নম্বর আমার মুখস্থ। বাড়ির নম্বর এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে (যদি কেউ অফিসে কাজ করে তো সেই অফিস এবং সেখান থেকে বেরিয়ে যেখানে বেরিয়ে যায়) যেখানে যাবে সেই ঠিকানা আমি জানি! মাফ করবেন, আপনি যদি স্ত্রী পুত্র কন্যার হাত ধরে লটবহর নিয়ে হঠাৎ শেয়ালদার ট্রেন ধরতে কি কাঁকুড়গাছি কোন আত্মীয়ের বাড়ি পৌঁছে দিতে আমায় ডাকেন, আমি দু’হাত তুলে আপনার কাছে ক্ষমা চাইব? সময় নেই। আজ শনিবারের দুপুর সোওয়া বারোটা বাজে ঠিক একটায় ব্যাঙ্কশাল স্ট্রীটের লাল অফিস-বাড়িটার সামনে আমাকে ট্যাক্সি নিয়ে হাজির থাকতে হবে। সেই অফিসের রেবা সোমকে আমার শেয়ালদার একটা হোটেলে পৌঁছে দিতে হবে। আজ রোববার, উঁহু তিনটে বেজে গেছে, এখনই আমাকে ছুটে যেতে হবে সাদার্ন এভিন্যু। ঝাউ গাছের আড়ার করা সেই আকাশী রঙের বাড়ির সপ্তমী বোসকে পৌঁছে দিতে হবে সৈয়দ আমীর আলী এভিন্যুর একটা সুন্দর ফ্লাট বাড়িতে। সোমবারের সকাল, সময় নেই, মধু বোস লেনের মায়া গাঙ্গুলী আমার ট্যাক্সিতে চেপে টালিগঞ্জের একটা বাড়িতে যাচ্ছে। সেখান থেকে আবার সন্ধ্যা সাতটায় সেই মায়াকে ধর্মতলায় যেতে হবে।
হ্যাঁ, সব ঠিক করা আছে। সময়, স্থান, লোক ও পথের দূরত্ব। ঘড়ির কাঁটা ধরে ধরে আমার সে সব জায়গায় উপস্থিত থাকতে হয়।
তাই বলছিলাম, হরিদ্বার কুম্ভমেলায়, যাবেন মনে মনে ঠিক করে কখনও আপনার বুড়ি দিদিমা একদিন হাওড়ার মেল ধরতে চাকর পাঠিয়ে আমার ট্যাক্সি ভাড়া করতে চান তো তিনি নিরাশ হবেন!
অবশ্য মিষ্টি বাক্য বলেই আমি আপনাদের চাকরদের ফিরিয়ে দেব আর আপনার দিদিমার জন্য মনে মনে কষ্টও করব, কিন্তু আপনারা শুনে হাসবেন আজ অবধি কোন বর্ষীয়সীই আমার গাড়িতে চাপল না। তখন, তখন হয়তো আমি আমার সাদা কালো হাম্বার নিয়ে লিনটন স্ট্রীটে যেতে তাড়াতাড়ি এক কাপ চা খেয়ে তৈরী হতে আপনাদের পাড়ার রেষ্টুরেন্টের সামনে গাড়িটা থামিয়েছি। আর আপনার চাকরটাকে ফিরিয়ে দিয়ে দোকানে বসে চায়ের বাটি সামনে নিয়ে আমি একটি তরুণীকে দেখছি। বনানীকে। তার ফর্সা সুগঠিত বাহু, শক্ত মজবুত খোঁপা এবং ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ উদ্ধত নাক। ট্যাক্সি নিয়ে যেতে হলে সেই নাকের ঘায়ে ও আমাকে কচুকাটা করে দিতে চাইবে। ছবিটা ভাবছিলাম। গোলাপী রং করা গোল প্যাটার্নের বাড়ির অসামান্যা সুন্দরী মেয়ে। কলেজে পড়ে। বনানী সেন।
এবং বনানীর মত সবাই দেখতে ভালো। হ্যাঁ, যারা আমার গাড়িতে চাপে। সব মেয়ে, সব বৌ।
গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে আমি যখন পাশে চুপ করে দাঁড়াই তখন তাদের চুল দেখি চোখের পলক দেখি ঘাড়ের বাঁক দেখি পিঠ দেখি, কোমর। গাড়িতে উঠতে কি নামতে যদি কোন মেয়ের শায়া বা শাড়ি একটু বেশী সরে বা উঠে যায় তো আমি পায়ের রং মাংসল ডিম এমনকি রোমকূপগুলি পর্যন্ত সতর্ক সূক্ষ্ম দৃষ্টি বুলিয়ে চট করে দেখে নিই। প্রশ্ন করবেন, কেন? অভ্যাস। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। ওপর ওপর দেখা। নখ চুল আঙুল পালক মাংস চামড়া ছাড়া আর কিছু দেখা আমার ইচ্ছাও নেই সময়ও হয় না।
মন?
তাই বলছিলাম ওদের ওদিকটা আমি মাড়াই না। যতদূর সম্ভব চোখ বুজে থাকি, এড়িয়ে যাই। না হলে বনানী কেন আমার ট্যাক্সি যথাসময়ে ওর দরজায় হাজির না থাকলে রাগ করে, বালিগঞ্জের বৌটি মূর্ছা যায়, টালিগঞ্জের মেয়েটি চোখে-মুখে অন্ধকার দেখে, আত্মহত্যা করতে প্রস্তুত হয় তার কিছু কিছুটা আমি জানি। কিন্তু জেনে করব কি। আমি যে আগেই একজনের কাছে ছোবল খেয়ে আছি।
চুপ থাকি। চোখ বুজে যাই। মিটার মিলিয়ে পয়সা আদায় করে আর এক সেকেণ্ড কোথাও দাঁড়াই না। আর এক পাড়ায় ক্ষেপ দিতে শহরের রৌদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
বরং মন-টন না দেখে আর দশজন ট্যাক্সিওয়ালার মত নিস্পৃহ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকাটাই নিরাপদ মনে করি। পৃথিবীতে বোধ করি একমাত্র ট্যাক্সিওয়ালারাই এত কাছে এসে এত নিরাসক্ত চোখে নারীর রূপ দেখে। তাই তাদের হাঁ করে তাকিয়ে দেখাটাও বাড়ির ‘জেনানারা’ কোনদিন আপত্তি করে না!
আমরা ট্যাক্সিওয়ালারাও সিগারেট মুখে গুঁজে সেই অগাধ রূপের ওঠানামা দেখার নেশায় বুঁদ হয়ে চবিবশ ঘন্টা স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে যাই। এর বেশি কিছু আমাদের দরকার হয় না।
আর, তা ছাড়াও, আমি, ধরুন এখন যেমন অভদ্রভাবে টেবিল থেকে চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে বার বার খাবার প্লেট থেকে থুঁতনিটা তুলে বৌটির খাওয়া দেখছিলাম, এমন করার সুযোগ আপনার সেখানে পেতেন না।
রেষ্টুরেন্টওয়ালাই আপত্তি তুলে বলত, মশাই বেরিয়ে যান। এটা ভদ্রলোকের জায়গা। এমন ভাবে তাকানো—
সেই স্বাধীনতা আমার ছিল।
সেই সুখ। আর আপনাদের এখন বুঝতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে না, রোজ অন্তত দেড় ডজন মেয়ের রঙিন শাড়ি শায়া ব্লাউজ অবিশ্বাস্য রকমের সব সুন্দর খোঁপা বেণী, চোখ, চোখের রং ও হাসিকান্না দেখে আমি নিজের স্ত্রী-বিচ্ছেদের কথা একেবারে ভুলতে পেরে ট্যাক্সিওয়ালার জীবন কায়মনে আঁকড়ে ধরে আছি। বেশ আছি।
হ্যাঁ, কি যেন বলতে যাচ্ছি—খুঁটিয়ে বৌটিকে দেখছি। নিশ্চন্ত মনে। তাছাড়া এইমাত্র হঠাৎ একটা ভিড় হয়ে রেষ্টুরেন্ট আবার পাতলা ফাঁকা হয়ে গেছে। কলকাতা শহরের হোটেল রেষ্টুরেন্টের দস্তুর যা। কোথা থেকে সব লোক ছুটে আসে আবার একসঙ্গে সব অদৃশ্য হয়ে যায়। একটিও থাকে না।
আমি দৃশ্যটা তাই উপভোগ করব বলে চেয়ারের ওপর পা তুলে দিয়ে বসি। খাওয়া দেখি। ছোট ছোট হা। শাদা মুখ শাদা ব্লাউজ। শাদা পাড় ছাড়া কাপড়। একটা শ্বেতপাথরের পুতুলের মত লাগছিল। পুতুল খাচ্ছে।
তাছাড়া ওর উল্টো দিকের দেয়ালের রংটা পাকা সবুজ। তার ওপর এই দিনেরবেলায়ও মাথার ওপর বত্রিশটা বালব জ্বলছে। শরীরের একটা শাদা ছায়া পড়েছিল সামনে টেবিলের কাছে। শরীরটা ছোট। নুয়ে খাওয়ার সময় ছায়াটা আরো ছোট হয়ে টেবিলে পোর্সেলিনের শাদা ডিশটার সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছিল এক একবার।
এবার পায়ের দিকে চোখ পড়তে দেখলাম শাড়ির আঁচলটা সরে গিয়ে শায়ার খানিকটা বেরিয়ে আছে। ঘোর লাল রং। এখন বুঝলাম হাতের মত পা দুটোও খুব ফর্সা। শায়ার লালচে আভা লেগে পায়ের মাংস বাদামি রং ধরে আছে। বয়সের রং না ওটা।
মানে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারলাম, হাত পা আঙুল গলা নাক ভুরু চুল চোখ সব নতুন। একেবারে টাটকা, তাজা। যেন এইমাত্র বাক্স থেকে (বা ঘর থেকে যা-ই বলুন) বেরিয়ে রাস্তায় এসেছে। একটা রেষ্টুরেন্টে বসে খাচ্ছে।
এক গ্লাস জল দিতে ডাকলাম ছেলেটাকে।
জল খেয়ে মেরুদাঁড়া টান করে সোজা হয়ে বসলাম।
মেয়েটিও সোজা হয়ে বসেছে। জল খাচ্ছে। ওপরের দিকে ওর থুঁতনি। আঁচলটা আর খোঁপা বা ঘাড়ে লেগে নেই, সরে গিয়ে বাঁ বগলের তলায় উড়ু উড়ু করছিল, ফলে সবটা পিঠ এখন দেখা যাচ্ছিল। আহা, কী পিঠ! যেন ঈশ্বর নিজের হাতে বাটালি চালিয়ে খোদাই করে সেই পিঠ তৈরী করেছে, তারপর ওতে র্যাঁদা চালিয়েছে।
মেয়েরা খুব পাতলা ব্লাউজ পরে। ব্লাউজের তলায় বডিজের ফিতে দুটো কড়া হয়ে চোখে পড়ে। যেন ওটা দেখানোর জন্যই ওপরের জামাটা। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখে খুশী হলাম। বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, টালা, গড়পার, এন্টালি, পার্ক সার্কাস-এর এত মেয়েকে আমি রোজ বয়ে বেড়াই! এমন রেখে-ঢেকে জামা পরতে আর কাউকে দেখিনি। অথচ এতে যে তার পিঠের লাবণ্য মাংসের ছোট নরম ঢেউগুলো বোঝা যাচ্ছিল না তা-ও-না। শাদা ট্র্যাপ দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। এখন দেখলেই মনে হয় শরীরের কোথাও বুঝি অপারেশন হয়েছে। ওটা ব্যাণ্ডেজ। বাদুড়বাগানের শ্যামলী, সাদার্ন এভিন্যুর রেখা, লিনটন স্ট্রীটের বনানী, সুরাবর্দী এভিন্যুর শোভা সোম সব, সব এক। আমি, যদি কোন সময় কাপড় সরেও যায়, ওদের পিঠের দিকে তাকাই না। চোখ ফিরিয়ে নিই। কিন্তু, গোপন করে লাভ নেই, আমার যেন ইচ্ছে হচ্ছিল এখন এখানে এই মেয়েটির পিঠটা একবার ছুয়ে দেখি।
অবশ্য আমাদের ট্যাক্সিওয়ালার জীবনে তার সুযোগ কম। পিঠ ধরব কি ভালো করে ওদের সঙ্গে কথাই বলা যায় না। ‘রোককে’, ‘জোরসে চালাও’, ‘আ গিয়া’ আর তারপর ‘কত উঠল মিটারে?’ ইত্যাদি একটা দুটো প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দেওয়া ছাড়া জেনানাদের সঙ্গে ক’টা আর কথা হয়।
আর তারা এত ব্যস্ত থাকেন এক একজন।
আমরা ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েই খালাস। কেবল রাস্তার ক’মিনিটের সম্পর্ক।
কেবল সেদিন, আমার এখানে এই সাত বছরের জীবনে বকুলবাগান স্ট্রীটের একটি বৌয়ের হাত ধরেছিলাম। ভারি নরম হাত। বৌটি তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে ফুটবোর্ড থেকে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল।
আর কোনদিন দেখিনি আমার ট্যাক্সিতে উঠতে। হ্যাঁ, খুব তাড়াতাড়ি করছিল।
এখন বৌটি স্বামীর বাড়ি থেকে ভরদুপুরে পালিয়ে হাজরার মোড়ের একটা বাড়িতে একটি ছেলের সঙ্গে যে প্রেম করছিল আমি এটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম।
হ্যাঁ, হর্ন শুনে যেভাবে ছেলেটিও একটা ঘরের পর্দা ঠেলে ছুটে বেরিয়ে মেয়েটিকে ধরতে এসেছিল। পড়ে যেত বলে তার আগেই আমি যদিও ওর হাতটা ধরে ফেলে নিরাপদ জায়গায় নামিয়ে দিয়েছিলাম।
না, বলছি এই জন্য যে, আমি সেখানে দাঁড়ানো সত্ত্বেও ছেলেটি বৌটির গলায় হাত রেখে যেসব কথা বলছিল।
কিন্তু তা শুনে তা বুঝে করব কি। আমি করবার কে। চোখ মুছে ফের মেয়েটি গাড়িতে উঠে যেখান থেকে এসেছিল সেখানি ফিরিয়ে নিতে বলেছিল। ডবল টিপ। দুটো বেশি পয়সা রোজগার হয়েছিল। ঐ পর্যন্ত।
আর দেখিনি ওকে।
অবশ্য এরকম ঘটনা আমি আঙুলের কড়ে গুণে আপনাদের শোনাতে চাই না। শোনাই না। আমরা সব দেখে বুঝে চুপ থেকে সিগারেট ধরিয়ে ফটক ছেড়ে চলে আসি। কথাটা উঠেছে এই জন্যে, যে হাত ধরেছিলাম।
কিন্তু আমার হাত ধরায় কী এসে যায়। আমার দিকে আর কবার ও তাকিয়েছিল? যে হাত ধরেছিল ফেরার পথে তার মুখ ভেবেই সারা রাস্তা চোখে রুমাল চাপা দিয়ে বৌটি গাড়ির কোণায় মাথা রেখে নিঝুম পড়েছিল। কাজেই আমাদের ট্যাক্সিওয়ালাদের হৃদয় মন হাসি-কান্নার মধ্যে উঁকি না দিয়ে থাকাই লাভ।
কী, সেদিন, আমি যতক্ষণ না রিচি রোডের উমা চ্যাটার্জীকে তুলে চৌরঙ্গীর হোটেলের একটা কামরায় পৌঁছে দিতে পারছিলাম ততক্ষণ, সারাটা বিকেল, উনিশ বছরের (কি কুড়ি একুশ বছর বয়স হবে বৌটির) একটি মেয়ের শরীরের তাপ, খাঁ খাঁ যৌবন, মাংসের মসৃণতার স্বাদ হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছি, চিন্তায় বুদ হয়ে শিস দিয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়েছিলাম। মন খারাপ করব কেন।
হ্যাঁ, ট্যাক্সিওয়ালা তার ওপর রমার সেই ঘটনায় হৃদয় নামক জিনিসটাকে গাড়ির চাকার তলায় থেঁতলে থেঁতলে এই শহরের পিচের রাস্তায় আমি যে সাত বছরে একেবারে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলাম তা সহজেই আপনারা অনুমান করতে পারছেন।
আর এক মেয়ে উমা।
কী চেহারা মশাই। আগুন।
এখনো কলেজে পড়ছে। এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চুরি করে রোজ হোটেলে সেই ভদ্রলোকের কাছে কেন যায় আমি কি জানি না, জানি, জেনে চুপ থাকি।
চুপ থাকার কারণ কাল আবার ট্যাক্সিটা যখন উমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় ধীরে ধীরে চালিয়ে যাব ও হাত তুলে ডাকবে!
পাঁচ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট সময় লাগিয়ে একটা নীল কি গোলাপী সিল্কে শরীর মুড়ে চোখে কাজলের পুরু প্রলেপ বুলিয়ে ও আমার ট্যাক্সিতে চাপবে। হুঁ সিনেমায় যাচ্ছে। আজ তিন মাস। সেই হোটেল। সেই সন্ধ্যার অন্ধকার কামরা। অথচ আর সব ঘরে আলো।
ফুলের মত মেয়ে উমা।
কিন্তু হৃদয়বৃত্তি, ন্যায় অন্যায়ের চর্চায় মাথা ঘামালে আমার চলছিল কি। হোটেলে পৌঁছে দেওয়া মাত্র একটা দশটাকার নোট। মিটার খরচ পাঁচ। আমার বখশিশ পাঁচ।
টাকাটা পকেটে পুরে লম্বা সেলাম জানিয়ে আর একবার উমার লম্বা ঘাড় মৌচাকের মত মস্ত খোপা ও সোনার বর্শার মত সুন্দর লম্বা হাত দুটো দেখে হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছি। ওই দেখাটুকুনই আমার লাভ।
উপরি পাওনা।
এত কথা বলছি এই জন্যে যে, এখনো যে আমার ওই মেয়েটির পিট ছুঁয়ে দেখতে ভয়ানক ইচ্ছা হচ্ছিল সেটা নিতান্তই শাদা ইচ্ছা। হাইএর সঙ্গে ওঠে নামে। এই ইচ্ছাকে আমি কোনদিনই কাজে পরিণত করব না , কোন ট্যাক্সিওয়ালাই করে না। লোকের মার পুলিশের হ্যাঙ্গামা মামলা মোকদ্দমা যাহোক একটা কিছুর কথা ভেবে তারা ভীষণ নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থেকে সিগারেট টানে আর ঘড়ি দেখে। কখন সময় হবে! সে এসে গাড়ি আলো করে বসবে আর বলবে, ‘চালাও।’
আমিও তার অপেক্ষা করছিলাম। খাওয়ার পর আরো একটা সিগারেট শেষ হয়েছে। পুরো পঁচিশ মিনিট এখানে খেয়ে বসে বিশ্রাম করে কাটানো গেছে হিসাব করলাম।
‘ওটা তোমার ট্যাক্সি?’
ঘাড় নাড়লাম।
আর অবাক হলাম বৌটিকে দেখে। হ্যাঁ, সুন্দর বলতে সুন্দর। সিঁদুরের রেখাটি অমন সরু করে না দিলে অত সরু চুলের সঙ্গে মানাত না। আর এমন সুন্দর চোখ। লম্বা সরু পালক ঘেরা দুটো দীঘি। জল টলটল করছে, জীবন। ব্লাউজের হাতায় আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতে বেরিয়ে আসা কচি সবুজ সোনালী আঙুরগুচ্ছ। শাড়ির পাড় আছে। সূক্ষ্ম জড়ির কাজ। দূর থেকে বোঝা যায় না।
‘বাঙালী ট্যাক্সিওয়ালা আমার ভালো লাগে।’ মেয়েটি বলল।
আমি চুপ করে হাসি।
লম্বা স্বর্ণচাঁপার মত দুটো আঙুল গলিয়ে বৌ বিলের টাকাটা কাউন্টারের ওধারে পাঠায় আর এক হাত দিয়ে মনি-ব্যাগটা বুকের মধ্যে ব্লাউজের ভিতর রাখে।
আমি ইতিমধ্যে সিগারেট ধরিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে বেরিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিই। কেননা সেখানে দাঁড়িয়ে হাঁ করে চেয়ে থাকা অসভ্যতা।
‘ভারি সুন্দর গাড়ি তো!’
গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বলল। মনে মনে বললাম, তোমার মত সুন্দরী মেয়েরাই তো আমার গাড়ির সওয়ার। ওরা রোজ বেরোয়, বেড়ায়। তুমি, তোমায় তো আর কোনদিন দেখিনি!
‘এই ট্যাক্সিওয়ালা!’
ঘাড়টা ফেরাই।
‘কোথায় যেতে হবে জিজ্ঞেস করছ না তো?’
আহা, কী দাঁত।
আমার তো মনে হয় ঐ দাঁত দিয়ে যদি সে কামড়াতে চায় তো রাস্তার সব পুরুষ দাঁড়িয়ে পড়বে, হাত বাড়িয়ে দেবে, গলা কি আঙুল। কেটে আলগা করে দিক।
আমি দেখছিলাম ওর গাল।
হ্যারিসন রোডের দিক থেকে রোদের লম্বা রেখা ওর গালে গলায় পড়ছিল। ওর পাতলা চামড়ার তলার রঙের লাল আভা দেখছিলাম। গলা বাড়িয়ে দিয়ে সে সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখছিল তখন। সামনে রেড সিগন্যাল। এগোবার উপায় নেই। তাই দুজনের কথা বলার সুযোগ হল।
‘লোয়ার সার্কুলার রোড বললেন না? ওই তো দক্ষিণ দিক।’
‘হ্যাঁ, তারপরে বাঁয়ে। মিডল রোড।’
‘ও দশ মিনিটে নিয়ে যাব।’
‘আবার সেখান থেকে আমাকে এই গাড়িতে ফিরতে হবে। চারটের মধ্যে মাণিকতলায় ফেরা চাই। হরিতকী বাগান লেন।’
‘তা হবে, খুব হবে, বিশ মিনিট লাগবে বড় জোড় নর্থে ফিরতে।
ঘাড়টা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে আবার সুন্দর চোখজোড়া দেখলাম। দেখলাম আর দরকার হলে কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালারা যে কত ভদ্র মার্জিত গলায় জেনানাদের সঙ্গে কথা বলে প্রমাণ করতে আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘শেয়ালদার রিফিউজি হোটেলটায় খেতে বসে আপনি হঠাৎ যেভাবে গলা বাড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকালেন তখনই বুঝে গেলাম আপনি গাড়ি খুঁজছেন। ট্যাক্সি চাই।’
একটু হাসলাম।
ওর একটু নিশ্বাস এসে আমার গলায় ও ঘাড়ে লাগল। ভালো লাগল। অবশ্য এগুলো আমাদের উপরি-পাওনা। গাড়ি একটু সামনের দিকে ঝুঁকলেই মেয়েদের গায়ের গন্ধ এসে আমাদের গায়ে পিঠে লাগে। রাস্তা পরিষ্কার দেখে চট করে আমি তখন স্টার্ট নিয়েছি।
‘চারটের মধ্যে ফিরতে পারলেই হল। ওখানে আমার বেশি দেরি হবে না। যাচ্ছি তো একটা কথা বলতে।’
‘কার সঙ্গে?’
‘মার সঙ্গে।’
‘ওখানে বুঝি আপনার মা থাকেন। মিডল রোড কত নম্বর?’
পাঁচ-এর পি কি সি বুঝতে পারলাম না কিন্তু তা না পারলেও কার কাছে যাচ্ছে একবার একটা প্রশ্নের ঢিল মেরেই যে জেনে নিতে পারলাম জেনে সুখী হলাম। আমরা ট্যাক্সিওয়ালারা কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে আগেই জেনে গেলে একটু বেশী খুশী মেজাজে গাড়ি চালাই তো।
‘আর ওখানে বুঝি আপনার শ্বশুড়বাড়ি মানে স্বামীর ঘর, হরিতকী বাগান লেন?’
কথা না কয়ে থুঁতনি নেড়ে বৌ হাসল। রামধনুর মত বাঁকা ভুরু টান করে ফিসফিস গলায় বলল, ওটা আমার স্বামীর ঠিকানা। তোমরা ট্যাক্সিওয়ালার চট করে বুঝে ফেল।
‘তা কেন পারব না, আমরা কি এ-লাইনে নতুন নাকি। আপনাদের কে কোথায় থাকেন আসা-যাওয়া দিয়ে আমাদের বুঝতে হয়। অনেক সময় ঠিকানা ভুলে যাবার পরও আন্দাজের ওপর আমরা গাড়ি চালাই।’
‘হ্যাঁ, শেয়ালদা থেকেই ট্যাক্সি ধরব ঠিক করছিলাম, ভীষণ খিদে পেল ট্রেন থেকে নেমে। দুটো খেয়ে নিলাম। সারাদিন খাওয়া হয়নি। ইস কী রান্না!’
‘বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল বুঝি?’
‘হুঁ, কাঁচড়াপাড়া। আমার ছোট ভাই আছে ওখানে। টি.বি.।’
‘আজকাল টি.বি-র জ্বালায় প্রাণ ঝালাপালা। চারদিকে কেবল ওই।’
উত্তরে কি বলল ও বোঝা গেল না। কেননা একটু ফাঁকা পেয়ে গাড়ি জোরে চালিয়েছিলাম। তা ছাড়া এলোমেলো হাওয়া ছিল।
আর একটু পর একটা বাঁক ঘুরতে সামনে প্রকাণ্ড ভেড়ার পাল পড়ে গেল। রং করা ওদের গায়ের পশম। হাতে সময় আছে, তাড়াতাড়ি ছুটব বলে পথ পেতে খামকা কতগুলো হর্ন দিয়ে স্লটার হাউসের যাত্রীদের ব্যতিব্যস্ত করতে বাধল! বরং যতটা পারা যায় আস্তে, বেশ আস্তে গাড়ি চালিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাই।
‘তোমার কি সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছে নাকি ট্যাক্সিওয়ালা। তাহলে গাড়ি থামিয়ে এইবেলা সিগারেট ধরিয়ে নিতে পার।’ বৌ তার হাতের ঘড়ি দেখল। ‘হাতে সময় আছে।’
দাঁড়িয়ে পড়ি। স্টিয়ারিং ছেড়ে নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে নিলাম। রাস্তায় চলতে এ ধরনের সহানুভূতিগুলি আমরা খুব পছন্দ করি।
সিগারেট ধরিয়ে বললাম, ‘আজ রাতটা তা হলে মার কাছেই থাকবেন ও বাড়ি?’
‘ও মা, কি বলছি, তোমায় ট্যাক্সিওয়ালা? এই গাড়িতেই যে আমাকে মাণিকতলা ফিরে যেতে হবে। চারটের সময় আমাকে হরিতকী-বাগান লেনে নামিয়ে দিতেই হবে।’
কথাটা মনে ছিল না তাই লজ্জায় হাসলাম। ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’
‘আমার স্বামী খুব কড়া লোক। কোথাও একলা বেরোতে দেয় না। আজ ও একটু অফিসের কাজে বাইরে গেছে। বিকেলে ফেরার কথা। ওই ফাঁকে ওদের দেখে নিচ্ছি। একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি।’
‘অঃ বাবা, আপনি তা হলে ভীষণ লোকের পাল্লায় পড়েছেন। সারাক্ষণ বাড়িতে।’
‘সারাক্ষণ।’
চোখ জোড়া ভীষণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল মেয়েটির।
‘আমি যে কী সাংঘাতিক লোকের পাল্লায় পড়েছি তা যদি তোমরা বাইরের লোক একটু জানতে ট্যাক্সিওয়ালা, আমি কী ভীষণ লোকের ঘর করছি।’
নতুন করে স্টার্ট দেওয়াতে আমার গাড়িয়ে ইঞ্জিন ধুকধুক করছিল। আমিও সেরকম একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম ভিতরে।
এই গাড়িতে চড়ে আমার এই ট্যাক্সির হাওয়া লাগিয়ে লাগিয়ে শহরের কত অসংখ্য মেয়ে আমোদ-ফুর্তি লুটছে তা যদি তুমি জানতে বৌ, রোজ—অবশ্য তারা তোমার চেয়ে অনেক বেশি চালাক, ঢের বুদ্ধিমতী।
কথাটা বললাম না।
কেননা আমাদের ট্যাক্সিওয়ালাদের এসব ব্যাপারে নাক ঢোকাতে নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেললে সেই নরম বুক কতটা ওঠে নামে আড়চোখে সেটুকুন দেখে নিয়ে আমি নিজের কাজে মন দিই, জোরে দুই হাতে স্টিয়ারিং চেপে ধরি। ভেড়ার দল সরে গেছে। ফাঁকা রাস্তা।
‘আপনি যখন জানা হয়ে রইলেন তখন মাঝে মধ্যে দুপুরে আধ ঘন্টা আমার ট্যাক্সিতে করে বেড়াতে বেরোতে পারেন। আপনার স্বামী অফিসে বসে মোটেই টের পাবেন না। কোন ফাঁকে কখন আপনাকে তুলে ঘুরিয়ে আবার কলে জল আসবার আগে হরিতকী বাগান লেনে রেখে এসেছি। মিডল রোড যান ইচ্ছা পার্ক সার্কাস যান, সময় মত নিয়ে যাব, আবার ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় বাড়ি ফিরিয়ে আনব।’
‘আচ্ছা দেখা যাবে, সে দেখা যাবে।’ বৌ বলল আর আমি আড়চোখে ওর লম্বা শ্বাসের সঙ্গে বুকটা কতটা কাঁপে তা চুরি করে লক্ষ্য করি।
কেননা কাল হয়তো ওকে আর দেখতেই পাব না, কোনদিনই না।
‘এবাড়ি?’
‘না, আর একটু চলো।’
আমি বললাম, ‘যদি মন খুব খারাপ লাগে তো আজ রাতটা মার বাড়ি থেকে যান। একটা চিঠি পাঠিয়ে দিলেই হল। মার অসুখ।’
তোমরা যত সহজ মনে করো ট্যাক্সিওয়ালা তত সহজ না। ঘরের বৌয়ের বাইরে মানে স্বামীর ঘর ছাড়া আর কোথাও রাত কাটাতে হলে অনেক তথ্য প্রমাণ হাতে নিয়ে নামতে হয়, যে-লোক সাত জন্মে শ্বশুর বাড়ি যায় না, সে ছুটে তক্ষুণি এসে দেখে যাবে কতটা অসুখ, কী রকম অসুখ শাশুড়ীর।’
‘বুঝতে পেরেছি,’ আমি অল্প হেসে মাথা নেড়ে বললাম, ‘আপনার শরীরটা আপনার স্বামীর কাছে একটা মদ বিশেষ, দামী নেশার মত। কিছুতেই আপনি না থাকলে ভালো লাগে না।’
অল্প হেসে বললাম আর দু’বার ঘন ঘন, ও দেখে ঠিক সে ভাবেই ওর গলার নরম পেশীর ওঠানামা দেখলাম।
সত্যি দামী শরীর বলে আমার এতটা লোভ হচ্ছিল মেয়েটির ওপর, কিন্তু কি করি উপায় কি, কতটা আর করতে পারে একটি যুবতী মেয়েকে একলা গাড়িতে নিয়ে যখন শহরের ট্যাক্সিওয়ালারা চলে! একটা বাড়ির নম্বর দেখে জোরে আর একটা মোচড় দিয়ে এগোই। ‘এ বাড়ি?’
বেঁধে।
হাত বাড়িয়ে দরজা খুলে দিতে ও নামল, ‘তুমি দাঁড়াও, আমি এক্ষুণি কথা সেরে আসছি।’
আমি গলা বাড়িয়ে আবার ওর পায়ের মাংসের গোছা দেখলাম। কেন জানি আমার তখন গরম ফাউলকারীর কথা মনে পড়ে গেল।
‘মুখটা ফেরানো ছিল। চিবুকের ধারটা দেখে আপেলের টুকরোর কথা মনে পড়ল! আর টুসটুসে আঙুর।’
আহা পৃথিবীর সেরা আঙুর ভেবে সারারাত চুষে ছিবড়ে করে ফেললেও রস যাবে না, ভাবলাম।
কিন্তু ভেবে কি আর আমি গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিলাম! শতকরা নিরানববই জন ট্যাক্সিওয়ালার মত ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে গাড়িটাকে ব্যাক করে একটু ঘুরিয়ে একটা ছায়ায় নিয়ে রাখলাম উল্টো দিকে মুখ করে।
হ্যাঁ ওর শরীরের ওপর বেশি লোভ করেছিলাম বলে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত গিয়ে এই দাঁড়াল! দেখুন কী সব ঘটনা ঘটে আমাদের জীবনে! আমি তো ভাবছিলাম মার সঙ্গেই দেখা করে ও বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। চোখে জল। নীল রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে!
কিন্তু তা না। শাদা কাঠের গেট-এর পিছনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক চিৎকার করছিল। হ্যাট পরা! সাহেব মানুষ। যেন এইমাত্র বাইরে থেকে ফিরছে কি এখন বাইরে যাবে।
তা অত সব চিন্তা করার সময় ছিল না।
আমি কথা শুনছিলাম দুজনার।
ট্যাক্সিওয়ালাদের দাঁড় করিয়ে আপনারা যেমন কথাবার্তা বলেন।
‘বাড়িতে আর কোনদিন তোমাকে দেখলে আমি ঠিক গুলী করব, চিত্রা।’
‘আমার গ্রাসাচ্ছাদনের যতদিন না সুব্যবস্থা হয় তদ্দিন আমাকে আসতে হবে!’
‘না চরিত্রহীন স্ত্রীর গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে দিতে আমি বাধ্য নই।’
‘বেশ তাহলে আমি কোর্টে যাব।’
‘হ্যাঁ, তাই যাও আমি তাই চাই। একটা প্রস্টিটিউট এসে মোকদ্দমা করে মহীতোষ রায়ের কাছ থেকে খোরপোষ আদায় করবে। বেশ তো, তাই একবার চেষ্টা কর।’
বলে মহীতোষ রায়, সেই হ্যাটকোট পরা ভদ্রলোক সযত্নে কাঠের গেটটায় একটা তালা পরিয়ে দিয়ে গট গট করে ভিতরে চলে গেলেন।
চিত্রা ঘুরে এসে আমার গাড়ির কাছে দাঁড়াল। দরজা খুলে দিতে ভিতরে ঢুকল। ‘চালাও।’
এ সময়টা আমরা বিশেষ কথাবার্তা বলি না। কিন্তু তবু স্টার্ট দেওয়ার পর আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি নীল রুমাল দিয়ে চোখটা এখনো টিপে আছে কিনা।
‘এই ট্যাক্সিওয়ালা।’
খানিকটা অগ্রসর হবার পর, ও আমায় আস্তে ডাকল। ঘাড় ঘুরিয়ে ওর মুখের দিকে তাকাই। রুমাল সরে গেছে। চোখের কোণ শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে।
‘তুমি তো দাঁড়িয়েছিলে কাছে, কথাগুলো শুনলে?’
কথা বললাম না। সামনে এবার একপাল মোষ। রাস্তাটা কালো হয়ে গেছে।
‘ও আমাকে গুলী করে মারবে।’
যেন কিছুই হয়নি, এসব কথার কোন দাম নেই, এরকম একটা ভান সময় সময় আমাদের করতে হয়। গাড়িটা একেবারে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে অল্প হাসলাম . ‘ও কিছু না। আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া। দু’দিনেই মিটে যাবে।’
বললাম, বলতে হয় আমাদের এসব।
কিন্তু দেখলাম সে কথায় বৌটির কান নেই। এক দৃষ্টে রাস্তার ধারের একটা বাদাম গাছের গুড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে কি ভাবছে। জায়গাটাও নির্জন।
মোষেরা অনেকটা এগিয়ে গেছে।
‘না মিটবে না, এ ঝগড়া মিটবার নয় তা সে-ও জানে আমিও জানি।’ তেমনি বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে অস্পষ্ট ধরা গলায় ও যেন নিজের মনে কথাগুলো বলল, তারপর হঠাৎ এক সময় মুখটা ফিরিয়ে আমার চোখের দিকে তাকাল।
‘ট্যাক্সিওয়ালা!’
‘কি, বলুন!’
‘ও আমায় ঘৃণা করে। কিন্তু আমিও যে ওকে ঘৃণা করি তা কি সে বোঝে না?’
আমি হাসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না। মেয়েটির গলার মধ্যে এমন একটা অদ্ভুত শব্দ হতে শুনলাম যে চমকে উঠলাম।
‘গুলী করবে, সামান্য ক’টা টাকা চাইতে গেছি বলে তোমার সামনে, একজন ট্যাক্সিওয়ালার সামনে আমাকে অপমান করল, উঃ, কিন্তু, কিন্তু—সে কি মনে করে—’
আমি হতভম্ব হয়ে ওর কাণ্ড দেখলাম।
‘কোথায় গুলী করবে, এখানে এই বুকে, এখানে এই বুকের মাংস ঝাঁজরা করে দেবে মহীতোষ!’ উপেক্ষার হাসি হেসে দ্রুত ব্যস্ত আঙুলে ব্লাউজের সব ক’টা হুক ও খুলে ফেলল। ‘হ্যাঁ, তোমায় দেখাচ্ছি, তোমার সামনে অপমান করল কি না, তুমি দেখে রাখ, আমার এই বুক লক্ষ টাকা রোজগার করবার ক্ষমতা রাখে কিনা—সামান্য ক’টা টাকা, সামান্য ক’টা—উঃ, এত অপমান!’
এ-ধরনের অভিজ্ঞতা জীবনে আমার হয়নি। কিন্তু তা না হলেও বিমূঢ় বা বিব্রত হওয়ার পরিবর্তে শরীরটাকে শক্ত কঠিন করে আমি ইঞ্জিনের দিকে ঘুরে বসার উপক্রম করতে ও আমার হাত চেপে ধরল। এবার বিব্রত হয়ে পড়লাম। ব্লাউজের মুখটা হা করে আছে। নিশ্বাসের সঙ্গে দুটো পেশী শক্ত হয়ে উঠে আবার জেলীর মত নরম হয়ে যাচ্ছে।
এতৎ সত্ত্বেও হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলাম।
কিন্তু ততক্ষণে ও আমার হাতের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। গরম জল টের পেলাম। কান্নার ঠমকে সেই সুন্দর র্যাঁদা করা পিঠ অনেকবার উঠল নামল।
কিন্তু তা দেখবার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই আমার ছিল না। তিক্ত গলায় বললাম, ‘তা অত ঘৃণা যখন, ওখানে গিয়েই বা কাজ ছিল কি—’ বলছিলাম, কিন্তু এমন অস্পষ্টভাবে কথাটা মুখ থেকে বেরোল যে ও শুনল বলে মনে হল না।
হেচকা টান মেরে হাতটা এবার ছাড়িয়ে নিয়ে মোটা গলায় বললাম, ‘ভালো কথা, এখন আপনি কোথায় যাচ্ছেন কিছু বলছেন না তো, সেই হরিতকী বাগান লেনের ঠিকানায় কি ট্যাক্সি—’
আমার কথা শেষ হবার আগে ও চোখে রুমাল গুঁজে মাথা নাড়ল। তারপর রুমাল সরিয়ে নিয়ে অল্প হেসে বলল, ‘বেশ্যার আবার ঠিকানা কি, ট্যাক্সিওয়ালা।’
আপনারা ভাবছেন সেই মদির হাসি দেখে আমার বুকের ভিতরটা তির তির করে উঠবে, কিন্তু তা হয় না, আমরা হতে দিই না। তৎক্ষণাৎ ব্রেক কষে আমি গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলাম। এবং মুখের ওপর সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম, ‘সঙ্গে পয়সাকড়ি কিছু আছে কি, ট্যাক্সিভাড়া দিতে পারবে?’
‘না।’
‘তবে এক্ষুনি নেমে পড়।’ কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠে আমি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির দরজা খুলে দিই। আর আমার মুখের দিকে তাকায়নি, ঘাড় নিচু করে ও গাড়ি থেকে নেমে গেল। একবারও সেদিকে না তাকিয়ে আমি জোরে গাড়ি চালিয়ে সার্কুলার রোডে উঠে এলাম। তেল না, জল তাই ট্রাউজারে হাতটা ঘষে তা মুছে ফেলতে অসুবিধা হল না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন