ইতি – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

শৈলেন্দ্র হালদার

দেশলাইয়ের বাক্সে কাঠি ছিল না, তাই মুখের নিবন্ত চুরুটটা বাঁচিয়ে রাখবার জন্য গোটা চার-পাঁচ টান দিয়ে রমেশ শুধোল, ‘এখন কি উপায়, কৃতার্থ?’

কৃতার্থ ঠোঁট উল্টে বললে, ‘উপায় একটা হবেই—’

রমেশ ঘাড় নেড়ে বললে, ‘কিন্তু গোঁফ-কামানো ছেলে আমি নামাতে পারবো না বলে রাখছি।’

কৃতার্থ বললে, ‘তা আমি যোগাড় করে দেব-ই। এ-জায়গাটায় বহু বছর আগে একবার এসেছিলাম। সামনের ঐ বাবলা গাছটার ধার দিয়ে যে-পথটা খালের দিকে এগিয়ে গেছে—ঐ পথটা ভারি চেনা চেনা। আপনি ঘাবড়াবেন না।’

চুরুটের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রমেশ বললে, ‘না ঘাবড়েই বা কি করি! যোগাড় করে আনো একটি। এ বিষয়ে ত তোমার হাত আছে। কিন্তু খালি জোটালেই ত চলবে না, টালও ত সামলাতে হবে—’

‘আচ্ছা দেখি।’ বলে কৃতার্থময় চাদরটা কাঁধে ফেলেই তক্ষুণি বেরিয়ে গেল।

একটি অখ্যাত ছোট শহর—আশেপাশে দু’দশ খানি গ্রাম,—ম্যালেরিয়ায় ঠাসা।

বড়দিনের ছুটিতে বড় শহর থেকে এক থিয়েটার পার্টি এসেছে—বিনা নিমন্ত্রণেই। দু’রাত্রি থিয়েটার হবে বলে আগেই রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল,—’মালতীঃ শ্রীমতী চমৎকারিণী দাসী।’—মানে, মেয়ের পার্টে যিনি নামবেন তিনি মেয়েই।

এ-খবরে সারা শহরে ও গাঁয়ে হৈ চৈ পড়ে গেছল,—স্টেজে দাঁড়িয়ে মেয়েমানুষ বইয়ের কথা গড় গড় করে মুখস্থ বলে যাবে—এ আশেপাশের গাঁয়ের লোকের কাছে একেবারে অবাক কাণ্ড। কিন্তু শহরের যাঁরা মাথা, মানে যাঁরা টাক ও টিকি, তাঁদের কেউ-কেউ এ নিয়ে মহা গোল পাকিয়ে তুলছেন—বলছেন, ‘ছেলেরা যাবে বিগড়ে, মেয়েদের মন যাবে বিষিয়ে। বন্ধ করে দাও।’

রমেশবাবু বললে, ‘আপনিই হয় ত বন্ধ হয়ে যাবে। আপনাদের যা দেশ,—মশাই-ই মশগুল। আসতে-আসতেই আমাদের চমৎকারিণী দাসীর জ্বর-চমৎকার হয়েছে। আমরা নিজেরাই পাল গুটাব’।

শহরের উকিল বগলাবাবু বললেন, ‘তাই গুটোন মশায় ,—হাওয়া উত্তুরে। মেয়েমানুষ নাবালে এক পয়সাও মিলবে না আপনাদের, চমৎকারিণীর ওষুধের খরচটি পর্যন্ত নয়! আমাদের এখানে বনের মশা আছে থাক—বিলাসের মশাল চাইনে। অভিনয় আমরা চাই বটে, কিন্তু অবিনয় নয়।’

বগলাবাবুর আর যাই থাক, গলা আছে বটে ,—দেখতে ও শুনতে।

বগলাবাবু যেতে-না-যেতেই একখানা ছ্যাকড়াগাড়ি এসে দাঁড়ালো। দোর খুলে কৃতার্থ নামছে। পেছনে একটি মেয়ে।

কৃতার্থ ঘরে ঢুকেই বললে, ‘এনেছি মশাই, দেখুন বাজিয়ে এবার।’

মেয়েটি ভারি ভীরু, ঘোমটাটি একটু টেনে দেয়ালের সঙ্গে মিশে রইল। দাঁড়াবার ভঙ্গিতে একটি কোমলতা আছে। প্লে-তে মালতীকে এমনি একবার দাঁড়াতে হবে,—রমেশবাবুর পছন্দই হল হয় ত।

বললে ‘তুমি যে আমাকে কৃতার্থ করলে হে! ব্যাপার?’

বুক চাপড়ে কৃতার্থ বললে, ‘খালের পারে যে এমন কলি ফোটে কলিকালের পক্ষে এ একটা সৌভাগ্য, রমেশবাবু। বাৎচিৎ করে হাল-চাল সমঝে নিন। চলবে? র’ এক পেগ পেটে খাওয়ার মতো একটু ঘোর-ঘোর লাগছে না?’

মেয়েটি ততই যেন মীইয়ে যেতে থাকে।

রমেশ শুধাল, তোমার নাম কি?’

মেয়েটি ঘোমটার ফাঁক থেকে জবাব দিল, ‘সরলা।’

স্বরটা একটু ভীতু বটে, একটু জোলো—কিন্তু ভারি স্পষ্ট।

কৃতার্থ বললে, ‘ঘোমটা একটু কমিয়েই আনো না, দিনের আলোয় এত ভয় কিসের?’

নিবিড় অন্ধকারের মতোই কালো দু’টি চোখ,—সরলা ঘোমটা একেবারে মাথার ওপর তুলে আনলে—কিন্তু দু’টি চোখেই যেন অন্ধকারের অগাধ স্নেহ মাখা। সমস্ত মুখে একটি ভারি মিষ্টি কমনীয়তা আছে, পাতলা ঠোঁট দু’টি পরস্পরের সঙ্গে ভারি আলগোছে ছোঁয়াছুঁয়ি করে আছে, একটুখানি কপাল—রমেশের মনে হচ্ছিল মাপলে হয় ত দু’আঙুলের বেশি হবে না, চিবুকটি একটু চ্যাপ্টা হয়ে গালের দু’দিকে ছড়িয়ে পড়াতেই মুখখানিতে এমন একটি পেলবতা এসেছে।

মেয়েটি একটি লাবণ্যের নদী। খুব স্রোত নেই, যেন বিকেলের আলোয় টলটল করছে।

নাটকের নায়িকার সঙ্গে কল্পনায় যতবার রমেশের সম্ভাষণ হয়েছে—অমনি তার মুখের ডৌলটি, ভাসা-ভাসা দু’টি চোখে অমনি একটি সস্নেহ কুণ্ঠা শুধু দাঁড়ানোটিতেই অমনি একটি সুষমা! মেয়েটি বেশ।

রমেশ ঢোঁক গিলে বললে, ‘তুমি পড়তে জানো ত?’

সরলা বললে, ‘জানি একটু-একটু। তবে কয়েকবার শুনলেই মনে করে রাখতে পারি।’

রমেশ হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তোরা এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস রে, নিমাই? দে ঐ চেয়ারখানা সরলাকে এগিয়ে।’

তিন-চারখানা হাত বেরিয়ে এল একসঙ্গে।

চেয়ারের দরকার হল না। সরলা মাটিতেই বসল।

রমেশ জিজ্ঞেস করলে, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে প্লে করবে? প্লে মানে খেলা নয়, নাটক।’

কৃতার্থ ভুরু কুঁচকে বললে, ‘ও’ তা খেলা-ই। কি বলো হে—

ঠোঁটে হাসি ফুটতে না দিয়েই সরলা বিজ্ঞের মতো বললে, ‘সংসারটাই ত খেলা শুনেছি।’

কৃতার্থ হাততালি দিয়ে বলে উঠল ‘কেয়াবাৎ। সরলা শুধু আমাদের দর্শন দেনই না, শেখানও।’

রমেশ বললে ‘পারবে করতে?’

সরলা বললে, ‘শিখিয়ে দিলে কেন পারব না? আমাদের শুধু পাখা নেই, নইলে ত আমরা পাখিই।’

কৃতার্থ ফের ভুরু কুঁচকোল। বললে, ‘পাখা নেই, কিন্তু উড়তে জানো খুব। তোমরা পোকাও।’

সরলা বললে, ‘আগুন দেখলেই উড়ে পড়ি। তাতে আগুন নেভে না, পাখাই পোড়ে।

মেয়েটি দেখতে ভীতু, কিন্তু কথায় জিলিপি।

রমেশ বললে, ‘ছোট্ট একটুখানি পার্ট, কিন্তু ভারি শক্ত। দু’তিন দিনে তৈরি করে দিতে হবে। আমরা আসচে শনিবারেই নামিয়ে দিতে চাই, আজ মঙ্গলবার।—পারবে ত? মোটে তিনটি সিন।

সরলা ঘাড় অনেকখানি হেলিয়ে দিলে।

আজ দুপুরেই তা হলে তোমাকে নিয়ে আসব। যার এই পার্ট করবার কথা ছিল, সে পড়েছে অসুখে,—তাই মুশকিল যেমন মারাত্মক, তাড়াও তেমনি। কেননা আসচে হপ্তায় বগুড়ায় একটা বায়না আছে, আগাম টাকা নিয়ে বসে আছি। খেয়ে-দেয়ে দুপুরে আসবে ত? বাড়ির ভিড় এ দু’দিন একটু সরিয়ে দাও ,—এই নাও।’

বলে রমেশ মানিব্যাগ খুলে একখানা দশ টাকার নোট সরলার দিকে প্রসারিত করে দিল। সরলা আঁচলের খুঁটে নোটটি বেঁধে কোমরে ভালো করে গুঁজে নিলে। ওর দুই চোখ খুশিতে উছলে উঠেছে।

রমেশ বললে, ‘গাড়ি করে ওকে পৌঁছে দিয়ে এসো, কৃতার্থ।’

সরলা বললে, ‘গাড়ি কি হবে? কতটুকুই বা পথ, দু’কদম। হেঁটেই যাচ্ছি।’

রমেশ ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘তবে যা নিমাই, ওকে একটু এগিয়ে দিয়ে আয়।’

নিমাই পা বাড়াচ্ছিল, সরলা পেছন না চেয়েই বললে, ‘দিনের বেলা লোক লাগবে কেন? একলাই ত যাওয়া-আসা করি,—আমি খুব যেতে পারব। আসব দুপুরে।’

সরলার চলাটিও বেশ—এক মুঠো ঝিরঝিরে বাতাসের মতো, বেশ জিরিয়ে-জিরিয়ে চলে। বাবলা গাছের গোড়া থেকেই পথটা বাঁক নিয়েছে। আর দেখা যায় না।

কিসের গাড়ি,—কিসের লোক!

সরলার সঙ্গে পৃথিবীর আজ নতুন করে শুভদৃষ্টি,—মগ-ডালের লাজুক হলদে ফুলটির পর্যন্ত। খালে জেলেরা জাল ফেলেছে নৌকোর গলুইএ দাঁড়িয়ে, পারে কারা বেত চাঁচছে, রোদ্দুরে খোলা পিঠ পেতে কাদের বাড়ির বৌ কলার পাতায় তেল মেখে বড়ি দিচ্ছে,—সরলা। ইচ্ছে করে সবাইর সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা কয়। ওদের ছায়া মাড়ালে স্নান করে—’ঐ যে পুরুতঠাকুর আসছেন তাঁকে দূর থেকে একটা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বসে , কাউকে খামোকা জিজ্ঞেস করে, বাবুইহাটির এ-রাস্তা দিয়ে নাক-বরাবর বেরিয়ে গেলে কত দূরে ঐ সবুজ মেঘটাকে মুঠির মধ্যে ধরা যায়—’

সরলা ট্যাঁকে-গোঁজা নোটটা বারে-বারে অনুভব করতে-করতে বাড়ি চলে।

বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই সরলা ডাক ছাড়ে, ‘ওলো ও ভূতি, কি করছিস? দেখে যা শিগগির—আমি থেটার করব। খোদ ফরিদপুর থেকে থেটারের দল এসেছে,—আমাকে পার্ট দিয়েছে। আমি রাণী সাজব,—মাথায় মুকুট, গলায় মটরমালা, পায়ে সেই জুতো—ঐ যে ঘোড়ায় চড়ে ছোটলাট এসেছিল, তার বিবির সেই খুর-তোলা জুতো দেখেছিলি, তেমনি। রাজা আমার পায়ের কাছে পড়ে কত কাঁদবে, কপাল কুটবে,—আমি ঘাড়টা এমনি করে থাকব—’

সরলা ঘাড়টা তেমনি করে দেখালো।

ভূতি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সরলার এ অস্বাভাবিক উচ্ছ্বাসে একেবারে থ’ হয়ে গেছল। বললে, ‘কি লো, ঘৌড়দৌড় দেখে এলি নাকি?’

সরলা বলতে থাকে, ‘এই দ্যাখ বায়না দিয়েছে দশ টাকা। দশ পয়সার বেপারি—দেখেছিস এমনি কাগজ,—সবুজ নীল কালো কালি,—পড়তে পারিস? দশ রূপেয়া! ক’ আনা জানিস? এক টাকায় ষোল আনা,—দশ টাকায়?’

এবার সত্যি ভূতির চোখ চড়ক-গাছ। দম নিয়ে বললে, ‘সত্যি বলছিস, সরি? পথে কুড়িয়ে পেলি নাকি লো? এত ভাগ্যি তোর?’

‘পথে আমার জন্যে সব মুক্তো ঢেলে রেখেছে, তোদের জন্যে তেঁতুল-বিচি! পাঁচ মুখে পাঁচ হাটে আমার নাম বিকোয়,—কে জানত আগে? কোথা সে ফরিদপুর, সেখান থেকে আমার নাম শুনে এসেছে এই শহরে! আমাকে তাদের দলে ভর্তি করে নেবে। ভারি শক্ত প্লে নিয়ে নেমেছে রে ভূতি,—সবচেয়ে শক্ত পার্ট পড়েছে আমার হাতে। কে আর করবে বল? সঙ্গে নিয়ে এসেছিল একটাকে,—মুখ দিয়ে একটা রা বেরুল না,—আর আমাকে যেই বলা, দিলাম বলে গড় গড় করেঃ প্রাণনাথ, রাখো তব পদতলে! বাবুদের সে কী তারিফ! বললে—সরলা, তোমার ছাড়া কারু আর সাধ্যি নয়।—বারে-বারে হাঁটু গেড়ে বসতে-বসতে পা দু’টো ব্যথা হয়ে গেছে।

কি যে বলবে সরলা ঠিক ঠাহর করতে পারে না। বলে, ‘আসছে শনিবার সন্ধ্যায় হবে। তোদের দেখিয়ে দেব মাগনা,–পাস পাওয়া যাবে ঢের। দেখবি রাণীর পোষাকে কী মানায় আমাকে!রাজা—সে সেজেছে নবিগঞ্জের জমিদারের ছেলে—আমার পায়ের কাছে মুক্তো ঢালবে, মাথার মুকুট খুলে রাখবে, রুমাল মুখে পুরে কত ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদবে,—আমি ঠায় সিংহাসনে বসে থাকব, মাথা উঁচু করে রাখব।’

বলে সরলা মাথাটা কড়িকাঠের দিকে উঁচু করে ধরে।

ভূতি বলে, ‘মাগনা দেখাবি ত সত্যি? ছাপানো কাগজ বিলি হবে না?’

‘হবে লো, সব হবে।’

বলে সরলা বারান্দার ওপাশে গিয়ে আবার ডাক ছাড়লঃ ‘ও বাড়িউলিদিদি! বড়ো যে সেদিন ঘরভাড়ার পাওনা টাকা নিয়ে তম্বি করছিলে, নাও তোমার টাকা—সাড়ে পাঁচ টাকা ফিরিয়ে দাও দিকিন।’

বাড়িউলি নোটটা হাতে পুরে বললে, সাড়ে পাঁট টাকা কি? সেদিন যে তোর অটলবাবু দু’পাইট মদ খেয়ে গেল—তার দাম কে দেবে?’

সরলা বললে, ‘তা আমি কি জানি? যে গিলেছে তার থেকে নাও গে–‘

‘তা ত বটেই লো, ছুঁড়ি। কে সে যে তাকে আমি শখ করে মদ দিতে যাবো? তোরই পীরিতি পোড়ে বলে না আমি—সে আমি বুঝছিনে বাছা, হাতের কাছে করকরে টাকা পেয়ে আমি ছাড়ছিনে, নিতে হলে তুমি আদায় করে নিয়ো–‘

সরলার মোটেই ঝগড়া করবার মন ও অবসর ছিল না , বললে ‘নাও, নাও, ঝামেলা রাখো, যা নেবার নিয়ে বাকিটা ফিরিয়ে দাও শিগগির। হিসেব-ফিসেব পরে হবে খন। আমার ঢের কাজ।’

খুচরো টাকা ক’টা নিয়ে যেতে-যেতে সরলা বললে, ‘অমন বাবুর মুখে ঝাড়ু!’

বাড়িউলি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মুখ-ঝামটা দিয়ে বললে, ‘কার মুখে ঝাড়ু লো, ছুঁড়ি? লজ্জা করে না বলতে? সেদিন ত ঐ বাবুই জুতোর গোড়ালিটা দিয়ে বোঁচা নাকটা থেঁতলে দিয়েছিল! ঐ থেৎলানো নাক নিয়েই ত সেই বমি-মুখো বাবুর সামনে পিকদানি তুলে ধরেছিলি।’

পরে গম্ভীর হয়ে বললে, ‘অত ছুটোছুটি ভালো নয় সরি, কানে তুলব কিন্তু—

সরলা বললে, ‘তুলো না! পরি এবারে সরে পড়ছে,—বাবুর তোয়াক্কা আর সে রাখে না। পায়ের কড়ে আঙুলের ডগায় বেঁধে রাখতে পারি—’

বাড়িউলি চাপা গলায় শুধু বললে, ‘আচ্ছা।’

সরলা ঝিকে পাকড়ালে। বললে, ‘তোমাকে এক্ষুনি সাজো-ধোপার বাড়ি যেতে হবে, মাসি। পয়সা না পেলে কাপড় দেবে না বলে শাসিয়েছে—এই ছ’টা পয়সা ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরে দিয়ে এসো ত। বোলো,—এবার থেকে ছ’টাকা দিয়ে বিলেত থেকে কাপড় কাচিয়ে আনব। ও ভয় দেখায় কি? এক্ষুনি যাও, মাসি,—গঙ্গাজলিটা পরে আমার এক্ষুনি আবার বেরুতে হবে। আর শোনো, এখন আর বাঁধবার সময় হবে না,—দু’পয়সার ফুলুরি নিয়ে এসো,—আর, আর দু’পাতা আলতাও কিনে এনো,—কতটুকুনই বা হাঁটতে হবে,—যাও লক্ষ্মী! মোটমাট দশ পয়সা দিলাম,—কিছু ফিরলে আমাকে আর ফিরিয়ে দিতে হবে না, তোমার ছেলে হরির নামে নিয়ো—’

ঝি বলতে-বলতে যাচ্ছিল, ‘ফিরবে তোমার মাথা—’

সরলা আর একটা পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে বললে, ‘নাও তবে আরেকটা।’

সরলার চোখে নিজের ঘরটাই শুধু আজ বিশ্রী লাগছে। জানলা দিয়ে রোদ এসে ঘরের সমস্ত কদর্যতা যেন বের করে ফেলেছে। নোংরা বিছানা, ছেঁড়া বালিশ, আ-মাজা বাসন-কোসন, দেয়ালে ঝোলানো মাংসের ও মদের দাগ-লাগা অটলবাবুর চুড়িদার আদ্দির পাঞ্জাবিটা। দিনের আলোয় ঘরটাকে যে এত বিরস এত বেমানান লাগে সরলার তা কোনোদিন চোখে পড়েনি।

সরলা জানলাটা বন্ধ করে খালের পারে এসে দাঁড়ালো। রোদ কতকটা চড়া হলে ওখানে যাবার মতো দুপুর হবে মনে-মনে ও তারই হিসেব করছিল। ছাই গাড়ি! ওর পা বেতো ঘোড়ার চেয়ে আগে যাবে।

ঝি এসে হিসেব দিলে। মোট এগারো পয়সাই লেগেছে।

বললে, ‘দু’পয়সার ফুলুরিতে কি লোকের পেট ভরে?’

সরলা বললে, ‘তুমি কি বোকা, মাসি! আমি কি পেট ভরে খাবার জন্যে তোমাকে বাজারে পাঠিয়েছি নাকি? আমার যে আজ নেমন্তন্ন থেটার পার্টিতে। আমি রাণী সাজছি। সেখানে কত খাবার দেবে’খন। ক’টা না ক’টায় খাওয়া হয়, সেজন্য ক্ষিদেটাকে একটু মেরে রাখবার জন্য দু’টো চিবিয়ে যাওয়া। ও আর আমি ছোঁব না মাসি, ও তোমার হরিকে নিবেদন করে দাও গে। আর শোনো—আমি তোমাদের মাগনা থেটার দেখিয়ে দেব’খন। তুমি যেয়ো হরিকে নিয়ে—বাপের বয়সে তোমরা তা কখনো দেখোনি।’

সরলা তাড়াতাড়ি চান করে নিলে। আয়নার কাছে বসে-বসে অনেক কসরত করবার সময় নেই মনে করে তাড়াতাড়ি চুলটা জড়িয়ে নিয়ে, ধোয়া শাড়ি সেমিজ পরে পায়ে টাটকা আলতা আর কপালে কাঁচপোকার টিপ লাগিয়ে না-খেয়েই বেড়িয়ে পড়ল। বড়ো রাস্তার উকিলবাবুর বৈঠকখানায় ঘড়িটা দেখবার জন্য একবারটি নিচু হয়ে চোখ পেল না। যা হোক গে, একটু আগে যাওয়াই ভালো।

এখন কোচোয়ানরা সব খেতে গেছে আড়গাড়ায় গাড়ি মেলাই ভার হবে। থেটারের বাবুদের শুধু-শুধু কষ্ট দিয়ে লাভ কি? সরলা এমন কি নবাবের বেটি!

পথ যেন সরলার এক নিশ্বাসেই ফুরিয়ে গেল। পায়ের কাঁচা আলতার দাগ তখনো শুকোয়নি, কাঁচা মাটির রাস্তায় ছোট-ছোট দাগ লেগেছে।

শহরের এ-বাড়িটা রমেশবাবুরই, এতদিন পড়ে ছিল।

পাশের মাঠে সকাল থেকেই স্টেজ খাটানো চলেছে,—এ পাড়ার সমস্ত ঘরামিই লেগে গেছে,—হোগলা তেরপল বাঁশ দড়ি পাটাতন বেঞ্চিতে ঠাসা। ময়মনসিং থেকে সিন এসে পৌঁচেছে। কে একজন সিনগুলিকে তদারক করছে, একটু-একটু মেরামত করছে,—ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের ভিড়,—একজন ধমকে উঠলেই সবাই ছিটকে পড়ে—আবার গুটি-গুটি এসে জড়ো হয়—কোলাহলে বাতাস যেন টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছে!

সরলা এসে দাঁড়ালো।

রমেশবাবু তখন ভেতরে কথাবার্তায় ব্যস্ত ছিল। শহরের কয়েকটি বয়স্ক ছেলে রমেশকে অভয় দিচ্ছিল, ‘বগলাবাবুর গলাবাজিতে ভড়কাবেন না, মশায়। আর যাই হোক, গেঁজেল ছোঁড়াদের হেঁড়ে গলায় ‘প্রাণনাথ’ ডাক শুনতে কক্ষনো পারব না আমরা—আত্মারাম খাঁচাছাড়া আর কি! চোখ বুজে কানে আঙুল ঢুকিয়ে কতক্ষণ বসে থাকা যাবে?’

রমেশ হেসে বললে, ‘সে-ভয় আমার নেই,—ঢের ঢের বগলাবাবু দেখেছি।’

ছেলেদের থেকে একজন বললে, ‘নিচু ক্লাসের চার আনাই করবেন মশাই,—তাই জোটাতে আমাদের প্রাণান্ত।’

রমেশ বললে, ‘যতই কেন না উনি বগল বাজান, আমাদের চমৎকারিণীকে দেখে ও তার য়্যাকটিং শুনে উনি যদি বিস্ময়ে হাঁ হয়ে না যান, ত কি বলেছি!’

এমনি সময় নিমাই উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সরলা এসেছে।’

রমেশ তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে ছেলেগুলিকে বিদায় দেবার চেষ্টায় বললে, ‘আচ্ছা, তাই কথা রইল। একদিন না-হয় স্টুডেন্টদের হাফ করে দেব।’

‘বেশ, বেশ, চমৎকার।’ বলে ছেলেরা হাসিমুখে বিদায় নিল।

তেমনি কুণ্ঠিত অবগুণ্ঠন টেনে সরলা এসে দাঁড়িয়েছে। ঘোমটার তলা দিয়ে ভিজা চুলগুলি পিঠের দু’দিকে ঝেঁপে পড়েছে,—ফিনফিনে শাড়িটি পরাতে সরলাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে,—সরলার কটিটি যেন মুঠির মধ্যে ধরে নেওয়া যায়,—এমনি—হালকা। সমস্ত মুখে বিষাদের একটি স্তিমিত অপূর্ব শ্রী।

রমেশ খুশি হয়ে বললে, ‘তুমি এসেছ, সরলা’? বেশ, বেশ। খেয়ে এসেছ ত?’

সরলা ঘোমটাটা আলগোছে একটু কমিয়ে আনলে বললে, ‘খেয়েই এসেছি।’

‘তবে তুমি ওখানে একটু বসো, আমরা চান করে খেয়ে নিই, পরে মহড়া শুরু হবে। ও নিমাই, সরলাকে একখানা বই এনে দে ত। তুমি ত পড়তে পার, একটু-একটু—এখন একটু চোখ বুলিয়ে নাও,—পরে হাত-পা নাড়া সব আমি শিখিয়ে দেব। মোটে তিনটি সিন তোমার, লাস্ট সিনটার সমস্তই তোমার ওপর নির্ভর করছে,—তুমি বেঁকলেই সমস্ত বই বেফাঁস। ঐটেই বেশ ভালো করে করতে হবে। পার্টে তোমার নাম মালতীমালা—জালন্ধরের রাজার একমাত্র মেয়ে। তুমি রাজকুমারী।’

সরলা অবাক হয়ে রমেশের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল,—গলা যেন শুকিয়ে আসছে। জেগে-জেগে রোদ্দুরের দিকে চেয়ে ও স্বপ্ন দেখছে। ওর সমস্ত জীবনের সঙ্গে বেখাপ্পা এই মুহূর্ত ক’টি যেন সুমধুর মদিরায় ভিজে গেছে। ও রাজকুমারী।

রমেশ একটু হেসে পাশের ঘরে চলে গেল।

সরলা চেয়ারে না বসে ঘরের একটি কোণে মাটির ওপর তেমনি বসেছে—দেয়ালে পিঠ রেখে। নিমাই বই নিয়ে এল। পাতাগুলি উল্টোতে-উল্টোতে কাছে এসে বললে, ‘তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে তোমার প্রথম আবির্ভাব—স্টেজে তুমি আর আমি। দুজনে প্রগাঢ় প্রেম হচ্ছে। মাঝের দৃশ্যটাতে তুমি আমার প্রেমে সন্দিহান হবে,—শেষ দৃশ্যে একেবারে ক্ষেপে গিয়ে ছুরি নিয়ে মারতে আসবে, কিন্তু—’

ও-ঘর থেকে রমেশ হেঁকে উঠল, ‘নিমাই!’

নিমাই বললে, যাই—কিন্তু আমাকে, আমাকে কি করে মারবে তুমি? কে আমার নাগাল পায়? তোমাকে পেয়ে সরলা, সত্যিই আমার য়্যাকটিং খুলে যাবে, পিপের মতো মোটা চমৎকারিণীর সঙ্গে স্টেজে প্রেম করাও একটা প্রকাণ্ড দুর্ভোগ। ওর দু’পল্লা গলার চামড়া দেখলে ভয়েই আমার গলা কাঠ হয়ে আসে,—প্রেমের বুলি বেরুবে কি ছাই! তুমি এসেছ, ভালোই হয়েছে। এমনি একটি মেয়েই আমি চেয়েছিলাম—দু’টি চোখে এমনি একটা লজ্জা,—তোমাকে পেয়ে মনে হচ্ছে সমস্তগুলি সিন যেন একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠবে—গানের মতো, ছবির মতো!’

সরলার দু’চোখ কৃতজ্ঞতার ভরে এসেছে,—নিমাইর প্রতি অনির্বচনীয় শ্রদ্ধায় ও স্নেহে ওর মুখের সমস্ত রেখাগুলি কোমল, কমনীয় হয়ে এল। ‘কিছুই বলতে পারল না, খালি একটি সপ্রেম কুণ্ঠায় নিমাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে মুখ নামিয়ে নিল।’

ও-ঘর থেকে রমেশবাবুর আরেকটা বিকট আওয়াজ আসতেই নিমাই তাড়াতাড়ি বইখানা সরলার কোলের ওপর ফেলে পিঠ দেখালো।

চমৎকার ছেলে এই নিমাই! উনিশ-কুড়ির বেশি হবে না? ছিপছিপে পাতলা চেহারাটা, টানা-টানা চোখ , কথায় যেন মধু ঢালা। এর সঙ্গে প্রেম করবার সময় স্টেজে দাঁড়িয়ে কি-কি কইতে হবে জানবার জন্য সরলা তাড়াতাড়ি বইয়ের তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য খুলে বসল। একটু কষ্ট করে-করে পড়তে লাগল,—চমৎকার!

প্রথমেই মালতী অর্থাৎ সরলা বলবে, ‘কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে—জ্যোৎস্নায় আকাশ ধুয়ে যাচ্ছে! পিকগণ কলরব করছে,—ফুলের গন্ধে, আকাশের নীলিমায় এত মধু। চলো উদ্যানে যাই।’

তারপর হিরণকুমার ওরফে নিমাই বলবেঃ ‘উদ্যান? ছার উদ্যান,—এ গৃহই আমার আকাশ, আমার স্বর্গ, মালতী। তোমার মুখখানি আমার চাঁদ, তোমার কণ্ঠস্বরে লক্ষ পিকের কুহরণ, তোমার দু’টি পরিপূর্ণ অধরের রঙিন পেয়ালায় রঙিন মদিরা।…..’

সরলা আর পড়তে পারে না, আবেশে সমস্ত গা অবশ হয়ে আসে। কে যেন ওর দিকে দু’টি সকম্প সাগ্রহ বাহু বিস্তার করে দিয়েছে,—কার কণ্ঠস্বরে যেন স্নেহপূর্ণ কাতর কাকুতি! শুধু কথার মধ্যে যে এত মাদকতা থাকতে পারে সরলা কি তা জানত? নিমাই,—নিমাই ওকে এই সব বলবে?

তারপরে—

খাওয়া-দাওয়ার পর রিহার্সেল শুরু হল।

দি ইয়ং ইণ্ডিয়া থ্যিয়েট্রিক্যাল পার্টির প্রোপাইটার, ম্যানেজার ও প্রধান য়্যাক্টার—সমস্তই রমেশবাবু। এমন কি জালন্ধর-পতন নাটকের লেখকও স্বয়ং উনিই। লোকটি চৌকস।

যাই হোক, শুরু হল রিহার্সেল। সবাইরই পার্ট তৈরি—দু’বছর নানা জায়গায় ঘুরে-ঘুরে জালন্ধর-পতনেরই অভিনয় চলেছে। তাই সমস্ত দিন-রাত্রি ভরে সরলার পার্টেরই মহড়া দিতে হবে।

তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য . সরলা আর নিমাই। দূরে চাঁদ, কাছে নদী—দৃশ্যের পৃষ্টপট।

সমস্ত রাজ্যের লজ্জা এসে সরলাকে গ্রাস করেছে। দু’বার তিনবার চেষ্টা করে সরলা যা বললে তার আর তুলনা হয় না। স্বাভাবিক লজ্জায় ওর কণ্ঠস্বরে একটি অস্ফুট কোমলতা এসেছে, তা শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। সমবেত অভিনেতার তারিফ শুনে সরলার মন গভীর আনন্দে স্নান করে উঠল,—জীবনের এই আনন্দের আস্বাদ যিনি ওকে প্রথম দিলেন, ওর ইচ্ছে হচ্ছিল, ছুটে সেই কৃতার্থবাবুর পায়ের ধুলো মাথায় নেয়,—রমেশবাবু, নিমাইবাবুর-ও।

আর নিমাই! এই দু’বছরের মধ্যে নিমাই আর কখনো এত ভালো অভিনয় করেনি।

রমেশ সরলাকে মোশন দেখিয়ে দেয়, উচ্চারণের তারতম্য শেখায়, স্টেজে চলা-ফেরার ভঙ্গিতে সজুত করবার চেষ্টা করে। সরলা ঠিক-ঠিক শিখে নেয়, যেখানে যেটুকু ভুল করে সেই ভুলটুকুই যেন সবার চোখে সুষমামণ্ডিত হয়ে ওঠে।

কৃতার্থ বলে, ‘কেয়াবাৎ! এই ঠিক!’

একেবারে একটি আনকোরা মেয়ের পক্ষে এমন স্টেজ-ফ্রি হয়ে অভিনয় করে যাওয়া—সবাই প্রশংসাসূচক বলাবলি করে। ততই সরলার মনে একটা আত্মবিশ্বাস আসে, তেজ আসে, নিমাইর প্রতি ওর সত্যিকার স্নেহ যেন ততই একটা প্রকাশ পাবার আশা করতে থাকে।

এই এক সিন-এই সরলা দাঁড়িয়ে গেছে।

চতুর্থ অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে আবার সরলার অভ্যুদয় , এবারে অন্য প্রকার মনোভাব নিয়ে। মালকানা-নগরের রাজপুত্রীর সঙ্গে হিরণকুমারের প্রেম হয়েছে মনে করে মালতীর ত্রুর সন্দেহ, আহত অভিমান!

মালকানা-নগরের রাজপুত্রীর ভূমিকায় যে নেমেছে সে রোগা, চিমসে—তার দিকে তাকালে সরলার রাগের চেয়ে করুণাই বেশি হয়।

সে সিনটাও কোনো রকমে উৎরে গেল—চলনসই।

এবারে শেষ অঙ্কের দৃশ্য। রমেশবাবু কলমের খোঁচা মেরে এই দৃশ্যটিকে একেবারে জমজমাট করে তুলেছে—সব দৃশ্যকে টেক্কা মেরেছে এ।

কিন্তু এই সিনটিতে এসে সরলা হাঁপিয়ে পড়ল। কিছুতেই পারল না ফোটাতে।

এই সিন-এ মালতী হিরণকুমারকে হত্যা করবার জন্য হাতে বিষাক্ত ছুরিকা নিয়ে প্রবেশ করবে—চোখে জ্বলবে দীপ্তি, অধরে কুটিল হিংসা, ক্রোধে সমস্ত দেহ যেন একটি লালায়িত বহ্নিশিখা! সরলা কিছুতেই মুখে-চোখে সেই দৃপ্তভাব আনতে পারে না, মুখখানি তেমনি সুকমোল ও সুকুমারই থেকে যায়।

ছুরি তোলা-টিও ঠিক হয় না।

কৃতার্থ অবজ্ঞাসূচক শব্দ করে বলে, ‘না, হল না। আমাদের চমৎকারিণী এ-জায়গাটা কি চমৎকার করত!’

নিমাই প্রতিবাদ করে, ‘প্রথম দিনে চমৎকারিণীর সাধ্যি ছিল না এমন উৎরোয়।’ দু’পাঁচবার দেখিয়ে দিলে সরলা চমৎকারিণীর ওপর ডবল প্রমোশান পাবে।’

রমেশবাবু সরলাকে দেখিয়ে দেয়, গোঁফ জোড়া ফুলিয়ে মুখে একটা বিকটতা আনে, কণ্ঠস্বরকে হেঁড়ে করে তোলে ,—সরলা অনুকরণ করে বটে, কিন্তু মুখে কিছুতেই সে-দৃঢ়তা আসে না। ওর নিটোল চিবুকটিই ওর মুখের এই কৃত্রিম অমানুষিক বন্যতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে,—ওর দু’টি চোখের সেই ব্রীড়ার কুয়াশা কিছুতেই কাটে না, কণ্ঠস্বর একটু তীক্ষ্ণ হয় বটে, কিন্তু তার মৃদুতা ঘোচে না। হাতে ছুরি তন্ময়, যেন ফুলের মালা নিয়ে এসেছে।

কৃতার্থ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, ‘হবে না। কিন্তু এ-সিনটাই সব, একে মার্ডার হতে দিলে প্লেই ফক্কা। এখানে চমৎকারিণীর কি আশ্চর্য রকম ডেলিভারি ছিল।

রমেশও হাল ছেড়ে দেয়। সরলার মুখ এতটুকু হয়ে আসে।

সরলা ঢোঁক গিলে বলে, ‘একদিনেই কি আর হয়? অভ্যেস ত নেই—কালকেই দেখবেন ঠিক হয়ে যাবে।’

নিমাই সায় দিয়ে ওঠে, ‘নিশ্চয়ই। একদিনে ওর পার্টসের যা প্রমাণ পাওয়া গেল, কোচিং পেলে চমৎকারিণী ত ছার, প্রভাও ওর কাছে ঘেঁষতে পারবে না। আচ্ছা, তার পরেরটুকু হোক।’

সরলা উৎসুক হয়ে প্রম্পট শুনতে লাগল—এর পরে কি আছে!

মালতীমালা প্রথমে ত ছুরি উঁচিয়ে হিরণকুমারকে খুন করতে এল,—এসে খুব খানিকটা স্বগত উক্তি করে যেই সত্যি-সত্যি ঘুমন্ত হিরণকুমারের বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে যাবে, দেখবে—হিরণকুমার আগেভাগেই বিষ খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে! তখন মালতীর কী সে অনুশোচনা! ছুরি ফেলে দিয়ে বিনিয়ে-বিনিয়ে, কী কান্না সে—হিরণকুমারের বুকের ওপর লুটিয়ে লুটিয়ে।

সেই কান্নার মধ্যেই যবনিকা-পতন।

নিমাইর মাথাটা কোলের কাছে টেনে এনে সরলা সত্যি-সত্যিই কেঁদে ফেললে—চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল। নিমাইর কোঁকড়ানো চুলগুলি নিয়ে ওর শীর্ণ আঙুল ক’টির কী সে আদর, যেন আঙুলের ফাঁক দিয়ে জলের মতো সমস্ত হৃদয় গলে পড়ছে!

নিমাই চোখ বুজে স্তব্ধ হয়ে সরলার কোলের কাছে মাথাটা রেখে মড়ার মতো পড়ে আছে। সরলার কান্না শুনে ওর নিজেরও চোখ ভিজে উঠছে। খালি ওর সেই দিদির কথা মনে পড়ে, যিনি ওর অসুখের সময় প্রাণপণ সেবা করেছিলেন সেবার।

সরলার কান্না ও কাকুতি শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। একজন বললে, ‘অডিয়েন্স-এর বুক ফেটে যাবে।’

খালি কৃতার্থ-ই সর্বান্তঃকরণে মানতে চায় না। বলে, ‘বুক ত ফাটবে, কিন্তু এর খানিক আগে যে, ছুরি-হাতে দেখে হেসেই বুক ফেটে গেছে। ফাটা বুক আবার ফাটে কি করে?’

সেই লোকটা বললে, ‘তবে ফাটা বুক জোড়া লাগবে, কৃতার্থবাবু।’

প্রম্পট করতে করতে রমেশ এতক্ষণ ভাবছিল—জালন্ধর রাজের পার্ট ছেড়ে হিরণকুমারের পার্টেই নেমে যাবে কি না! বললে, ‘কিন্তু এই দেখো চমৎকার মানিয়ে যাবে, কৃতার্থ!’

‘তা মানিয়ে নিতেই হবে এক রকম করে। কিন্তু চমৎকারিণী কি সুন্দর করেই যে কনট্রাস্টটা ফুটিয়ে তুলত! পড়ল জ্বরে—’

রমেশ তাড়াতাড়ি বললে, ‘ওকে ওষুধ-পথ্য দিয়েছিস ত রে নেমা! সন্ধ্যে হয়ে গেছে যে।’

নিমাই ওষুধ-পথ্য নিয়ে ও-ঘরে গেল। চমৎকারিণী বিছানায় শুয়ে ককাচ্ছে। জ্বরটা একটু কমেছে বিকেলের দিকে। উঠে বসে কান খাড়া করে সরলার রিহার্সেল শুনছিল।

বললে, ‘কে নিয়েছে মালতীর পার্ট?’

নিমাই উদাসীনের মতো বললে, ‘চিনি না।’

চমৎকারিণী বললে, ‘পারছে না বুঝি! বোকার মতো হাপুস-হুপুস কি রকম কাঁদছিল, একলা হাসতে-হাসতে আমার কোমরে ব্যাথা ধরে গেছে—’

নিমাই চটে উঠে বললে, ‘তোমার চেয়ে ঢের ঢের ভালো করে। ওকে পেয়ে আমি বর্তে গেছি। হাঁফ ছেড়ে যেন বেঁচেছি—’

‘বটে? হাঁফ ছেড়ে বেচেছ? খাব না আমি ওষুধ, ডাকো রমেশবাবুকে।’

‘ডাকছি।’ বলে নিমাই সরে পড়ল।

রাত বাড়ছে।

এক-থালা খাবার ও এক-পেয়ালা চা দু’হাতে করে নিমাই সরলার কাছে এসে দাঁড়ালো। বললে, তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে, খেয়ে নাও খানিকটা।’

সরলা অল্প একটু হেসে বললে, ‘আপনার মুখও তো শুকনো, আপনিও খান।’

‘আমি খাব’খন।

‘আপনি না খেলে আমি খাব না।’

ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে দুজনে খাবারের থালাটা শেষ করল।

রমেশ ডাকলে, ‘নিমাই!’

নিমাই তাড়াতাড়ি চায়ের পেয়ালাটা সরলার হাতে নামিয়ে দিয়ে বললে, ‘যাই।’

রমেশ সরলার হাতে আবার একখানা দশ টাকার নোট গুঁজে দিলে। বললে, ‘গাড়ি ডেকে দি?’

সরলা বললে, ‘দরকার হবে না।’

‘কালকে ঘুম থেকে উঠেই এসো। এখানেই খাবে দাবে। বুঝলে?’

ঘাড় নেড়ে সাড় দিয়ে সরলা একা পথে বেরিয়ে পড়ল।

বাবলা গাছটার বাঁক ঘুরতেই সরলা অবাক হয়ে চেয়ে দেখলে সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—নিমাই। বললে, ‘গাড়িতে উঠে এসো, সরলা।’

সরলা আপত্তি করল না। ‘গাড়ি খালের দিকে গড়ালো।’

দুজনে মুখোমুখি বসেছে। নিমাই বললে, ‘তোমার দিকে টেনেছিলাম বলে চমৎকারিণী ফণা তুলে আছে। কিন্তু তোমাকে বলে রাখছি সরলা, তুমি না থাকলে আমি কক্ষনোই এবারে প্লে করব না , ডাঙার কাছে নৌকা এনে ডুবিয়ে মারব ওদের।’

সরলা যেন সমুদ্রের কূল দেখে , গর্বে, সুখে ওর বুক ডগমগ করে ওঠে!

নিমাই পকেট থেকে সিগারেট বার করে বলে, ‘খাবে?’

সরলা সিগারেটটাই খায়, তবু বলে, ‘না’। নিমাইর সামনে ওর সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে না।

নিমাইও খায় না। বলে, ‘ঐ সিনটাতে খুন করতে আসাটাই বড়ো নয়, ভালোবাসার লোককে মরে গেছে দেখে ছুরি ফেলে আর্তনাদ করাটাই বড়ো কথা। কার্টেন পড়বার সময় লোকের মনে খালি তোমার ঐ কান্নাই ঘুরে বেড়াবে,—চোখের জলে ভেজা তোমার মুখখানিই তাদের চোখের তারায় আঁকা থাকবে।’

সরলা বলে, ‘আপনি পৃথিবীতে আর নেই, এ-কথা মিথ্যি-মিথ্যি করে ভাবলেও আমার কান্না পায়।’

কিন্তু কথাটা শেষ করতে না করতেই সরলার ভারি লজ্জা পেল।

নিমাই ভাবে—সরলার ঐ আঙুল ক’টি আবার নিজের চুলের মধ্যে রাখে কিন্তু হাত বাড়িয়ে ধরবার পর্যন্ত সাহস হয় না। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে।

খালের কাছে গাড়ি এসে দাঁড়ায়। সরলা নিজেই কবাট খুলে নেমে পড়ে। বলে, ‘আসবেন?’ কিন্তু বলেই মনে-মনে পীড়িত হয়ে ওঠে।

নিমাই বলে, ‘কৃতার্থবাবু ওরা তোমাকে অপমান করেছে, কিন্তু তার শোধ আমি নেব। আচ্ছা, যাই—’

নিমাই গাড়োয়ানকে বললে, ‘শহরটার খানিক এদিক-ওদিক ঘোরো। ডবল ভাড়া পাবে।’

এবারে সিগারেট ধরায়।

সরলা ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকে,—গাড়িটা যে অদৃশ্য হয়ে গেছে তা পর্যন্ত হুঁস নেই।

ভেতরের দাওয়ায় পা দিতেই বাড়িউলি খ্যা খ্যা করে উঠল, ‘বলি, সরি এসেছিস? তুই কেমনতরো মানুষ লো, ছুঁড়ি! সারা দুপুর-সন্দে টো টো করে বেড়াবি, আর এখেনি যত রাজ্যের লোক এসে মুখ-খারাপ করে যাবে?’

সরলা যেন গাড়ি থেকে এবারেই সত্যি নেমে আসে। ওর গতানুগতিক কদর্য বিরস জীবন ওর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। ফুলশয্যার ওপর কে যেন এক বোতল মদ ঢেলে দেয়,—ওর গা ঘিনঘিন করে ওঠে।

বলে, ‘কি হল বাড়িউলি-দিদি?’

‘কি হল? সেই অটল ছোঁড়া বিকেলের দিকে এসেছিল কতকগুলো চেলা জুটিয়ে। তোকে ঘরে না-দেখে কি কেলেঙ্কারিটাই না করে গেল! আমার থেকে তিন-চার পাঁইট করে দিশি-বিলিতী চেয়ে নিয়ে খেয়ে বমি করে গালাগালি দিয়ে জিনিসপত্র ছরকট করে লম্বা দিলে—একটি পয়সা দিয়ে গেল না। বললে সরি দেবে।’

সরলা ক্ষেপে ওঠে, ‘হ্যাঁ, সরিই ত দেবে! কেন? সরি কি ওর জুতোর সুখতলা নাকি? খালি-বোতলগুলো ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে মারতে পারলে না? এবারে আসুক না, ঝাঁটাপেটা করে যদি না তাড়াই ত আমি বামুনের মেয়ে নেই।’

বাড়িউলি বলে, ‘বামুনের মেয়ে বলে আর দেমাক করিসনি ছুঁড়ি। কেন বাড়ি থাকবিনে শুনি? বাঁধা লোকের টাকা আবার তার ওপরে চালবাজি! কেন সে গালাগাল করবে না?’

সরলা বলে, ‘রেখে দাও, অমন লোক বাজারে কাণা-কড়িতে বিকোয়। ও রকম বাবু আমার চাইনে। আমি কালই এ-বাড়ি থেকে খসে পড়ব।’

‘থেটার-ফেটারের কথা সব তার কানে উঠেছে। বলেছে,—থেটারে আগুন লাগিয়ে দেবে, আর তোর মুণ্ডুটা আস্ত রাখবে না।’

‘তার হয়ে তুমি লড়তে এসো না, বাড়িউলি-দিদি। আসুক সে, দেখি তার বাপের ঘাড়ে ক’টা মাথা! তার মুখে যদি নোড়াটা আমি না ঘষি ত কি বলেছি! কত টাকার মদ খেয়েছে সে? কত টাকা পেলে তুমি গলা থামাবে?’ বলে সরলা আঁচলের খুঁট থেকে নোটটা বাড়িউলির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল।

সব ঘর নোংরা, জিনিসপত্র এলোমেলো, কাচের জাগ গ্লাস ভাঙা, ট্রে-টা উল্টানো, কোথা থেকে একটা উৎকট গন্ধ আসছে। সরলা অন্ধকারে থমকে রইলো—দেশলাই জ্বালাবার পর্যন্ত যেন সামর্থ্য নেই।

বুকের মধ্যে সরলা যে গানের সুরটি নিয়ে এসেছিল, টুকরো-টুকরো হয়ে গেল। ও যেন আবার নরককুণ্ডে এসে পড়েছে, যেখানে সেই অটল আর সরলা , যেখানে না আছে মালতী, না বা হিরণকুমার!

সরলা ঘর থেকে বেরিয়ে খালের পারে এসে দাঁড়ালো।

পরে কি ভেবে আবার ঘরে গেল, ল্যাম্প জ্বালালে—কোমরে কাপড় জড়িয়ে বালতি করে জল এনে ঘর সাফ করতে বসল।

পঞ্চম অঙ্কের পঞ্চম দৃশ্যে নিমাইর মাথাটি কোলে নিয়ে যে-হাত দিয়ে ওর কপালে স্নেহস্পর্শ বুলিয়ে দিয়েছে, সেই হাতে ঘৃণ্য অটলের বমি নিকোতে হচ্ছে ভেবে ওর চোখ দিয়ে টস টস করে জল পড়তে লাগলো। ও সত্যিই আর এখানে থাকবে না, থিয়েটারে ভিড়ে যাবে—যে-থিয়েটারে হিরণকুমার আছে, সে-থিয়েটারে মৃত বন্ধুর উদ্দেশ্যে কৃত্রিম শোক করতে গিয়ে সত্যি-সত্যিই কান্না পায়।

ভূতি ঘরে এল। বললে, ‘আজ কি হল রে, সরলা?’

সরলা বললে, ‘কত! কত বড়ো শক্ত পার্ট যে হাতে নিয়েছি, সে দেখবি গিয়ে। স্টেজে খুন করতে হবে—’

ভূতি ভয়ে আঁতকে ওঠে, সরলাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বলিস কি লো?’

সরলা হেসে অভয় দিয়ে বলে, ‘সত্যি সত্যিই কি আর খুন করব নাকি বোকা মেয়ে! পুলিশ নেই? খুন করতে যাব খাঁড়া উঁচিয়ে, এমনি করে—চেয়ে দ্যাখ, এমনি দাঁত খিঁচিয়ে—দ্যাখ ত ঠিকমতো হচ্ছে কি না—’

ভূতি অত-শক্ত বোঝে না, বলে হ্যাঁ হ্যাঁ, হয়েছে—তারপর কি হবে?’

রসবোধের চেয়ে ভূতির কৌতূহল বেশি।

‘তারপর যেই খাঁড়া চালাতে যাব, দেখব হিরণকুমার আগেই বিষ খেয়ে ভবলীলা ঘুচিয়েছে। তারপরে অস্তর ফেলে দিয়ে তার মাথাটা কোলে নিয়ে কাঁদব।’ বলতে-বলতে সরলার চোখে ব্যথার কুয়াশা ঘনিয়ে আসে।

সরলা ভূতিকে ফের অভয় দেয়, সেই হিরণকুমার সত্যিই বিষ খাবেনা রে পরে পর্দা পড়ে গেলে জেগে উঠবে। …আমাকে খাবার খাইয়ে দিলে, গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিলে,—ভারি সুন্দর ছেলেটি, ভাই, মনের মতো। দেখিস এখন।’

দোর-গোড়ায় কে একটি ছোট ছেলে এসে দাঁড়ালো,—ঝি মাসির ছেলে, হরি।

হরি বললে, ‘আমাকে আর মাকে সত্যি-সত্যি মাগনা থেটার দেখাবে সরলা-দি?’

সরলা হাসিমুখে বললে, ‘দেখাবো। যাস তোরা।’

হরি খুশিতে উছলে পড়ে বললে, ‘তোমাদের হয়ে গেলে দেখো আমরা একটা থেটার করব বাবুতলার মাঠে। কাগজ দিয়ে সব ভীমের গদা বানিয়েছি। বাঁশের ধনুক। সেদিন তোমাদের নিয়ে যাবো। দেখবে—

ছুটতে ছুটতে চলে গেল।

ঐ সামান্য দু’টি মিষ্টি খেয়েই সরলার পেট ভরে আছে। ঝিকে বিদায় করে দিল।

পাড়াটা নিরিবিলি হয়ে এসেছে। সরলা দোর বন্ধ করে দিয়ে ওর ছোট আয়নাখানি বেড়ার গায়ে মানানসই করে লাগিয়ে ছুরির অভাবে চিরুনিটাই ছুরির মতো বাগিয়ে নিজের মনে শেষ দৃশ্যের মহড়া দেয়। আয়নায় সমস্ত মুখের ছায়া পড়ে না দূর থেকে, যেটুকু পড়ে তাতেই ও মুখের চেহারার আন্দাজ করে নিতে পারে। যতই ও ওর মুখ রুক্ষ কর্কশ বলদৃপ্ত করতে চায়, ততই ওর মুখে শীর্ণতা বীভৎসতর হয়ে উঠতে থাকে! গাম্ভীর্যের সঙ্গে হিংসার কাঠিন্য মেশাতে পারে না—তাই দেখায় কুৎসিত, হাস্যকর।

কি করে যে মানিয়ে নেবে ভেবে উঠতে পারে না।

অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে একটা ছেঁড়া বালিশ কোলে নিয়ে পার্টের বাকি অংশটুকুর মহড়া দেয়—বালিশকে ভাবে হিরণকুমার। তার জন্য রাত করে সরলা অনর্থক অশ্রুবর্ষণ করে।

এমন সুন্দর করে সরলার জীবনে ভোর হয়নি! ভোরবেলাটি ওর কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন লাগছে।

ঘুম থেকে উঠে সরলা ভাবছে, কে যেন ওর কাছে আসবে আজ। নিমাইকে ত ও আসতে বলে দেয়নি। কিন্তু না বলে দিলে কি আসতে নেই? অটলকে তাড়িয়ে দিলেও ত সে আসে।

বেলা বেড়ে চলে কিন্তু সরলার ভারি খালি খালি লাগে। অদূরে রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ পেলেই ওর বুক আশায় দুলে ওঠে। কিন্তু পরে ভাবে,—ওর কাছে আসবার এই একটিই ত সদর রাস্তা নয়,—শুধু গাড়িই ত তার বাহন নয়,—সে এসেছে তার ঘুমের মধ্যে, অজানতে ঘুম ভাঙার মধ্যে, মনের গোপন খিড়কির দুয়ার দিয়ে।

যে আসবে না, তার জন্যে এমনি অনর্থক প্রতীক্ষা করে থাকবার মধ্যে যে দুঃসহ সুখ আছে, সরলা কোনোদিন তা জানত না।

রোদ উঠতে-না উঠতেই সরলা বেরিয়ে পড়লো।

নিমাইকে কাছে পেয়ে সরলা শুধোল, ‘ভেবেছিলাম সকালবেলা আসবেন।’

নিমাই বললে, ‘ম্যানেজারের হুকুম তামিল করতে-করতেই সব গরমিল হয়ে যায়। আজ থেকেই স্টেজ-রিহার্সেল শুরু হবে। তোমার প্রবেশ-প্রস্থানগুলি ঠিক করে নিতে হবে। মুখস্থ হয়েছে?’

সরলা বললে, ‘একটু-একটু হয়েছে।’

ম্যানেজার বলেছিল ‘পার্টটা তোমাকে লিখে দিতে,—আমার হাতের লেখা ত আর বুঝবে না ছাই, তাই আমার বইখানাই তুমি নাও।’

বলে নিমাই পকেট থেকে ছেঁড়া জালন্ধর-পতন বইখানি সরলার হাতে গুজে দিল।

নিমাই বললে, ‘দেখো, আজ আরো ভালো হবে। তোমার হাতের আদর পাবার জন্য আমার কপালটা নিসপিস করছে। তোমার কান্না শুনলে আমার মন কেমন করে উঠে।’

সরলার ঠোঁট দু’টি শুধু একটু কাঁপে।

স্টেজ বাঁধা হয়ে গেছে,—বেড়া ও টিন দিয়ে চারিদিকে ঘেরা, পাড়ার ছেলে-মেয়েগুলো ফুটো করে উঁকি দিতে চায়, আর কে ওদের সব ভাগিয়ে দিতে থাকে। ঐখানে গানের আর নাচের মহড়া চলছে,—এপারে য়্যাকটিং—ঐখানে সিন পেন্টিং সিন শিফটিং চলেছে।

সমস্ত বাড়িটা গৈ গৈ করছে, যেন একটা উৎসব।

সরলা সব ভুলে যায়—খালপারে সেই নোংরা ঘর, সেই শীতকালে রাত বারোটা পর্যন্ত ফাঁকে জবুথবু হয়ে বসে থাকা, সেই একঘেয়ে বিশ্রী কথাবার্তা, সেই অটল বাবুর বীভৎস মুখ! ওর বন্দী পৃথিবী যেন হঠাৎ একটা অপরিমিত পরিধি লাভ করে। আকাশকে আজ ওর খুব বড়ো লাগে,—সমস্ত অবকাশ পুজার আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভাবে, ও সত্যিই অটলের রক্ষিতা কৃতদাসী নয়, ও সত্যই রাজকুমারী! ও ভালোবাসে, প্রেমিককে হারিয়ে ও বৈরাগিনী হয়েছে,—ওর দারিদ্র্য, ওর বিরহের কি সুন্দর ব্যাখ্যা! সরলা সব ভুলে যায়, মিথ্যার মাদকতা ওর ক্লান্তি ঘুচোয়—ও নতুন করে পৃথিবীতে জন্মলাভ করে।

শুধু দু’টি দিনের জন্যেই। তা হোক।

আজ ভোরে চমৎকারিণীর জ্বর ছেড়েছে। শরীর দুর্বল বটে, কিন্তু অচল নয়,—গড়াতে-গড়াতে এসে একটা চেয়ার নিয়ে বসল। অভিনয় সম্বন্ধে টিপ্পনীর তার আর শেষ নেই। কৃতার্থময় পেছনে দাঁড়িয়ে চমৎকারিণীর টিপ্পনীরই তারিফ করে।

রমেশ বলে, ‘তুমিই আজ থেকে প্রম্পট করো হে, মধুসূদন। তোমারই ত কাজ।’

মধুসূদন বই হাতে করে।

আজকে একেবারে গোড়াগুড়ি থেকে। তৃতীয় অঙ্ক পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায় বারোটা বাজে।

শুরু হল তৃতীয় অঙ্ক। সরলা মাৎ করে দিল।

কিন্তু শেষ দৃশ্য আসতেই সরলার আর হয়ে ওঠে না। মারবার সময়ে এমন একটা ভাব হয়, যেন খুব শক্ত একটা দড়ির গেরো খুলছে মাত্র—খুন করতে আসছে না। মুখ কিছুতেই কুঞ্চিত কর্কশরেখাসঙ্কুল হয়ে উঠতে পারে না। একটা বিশীর্ণ দৈন্য ফুটে ওঠে শুধু।

চমৎকারিণী মুখ টিপে-টিপে হাসে। কৃতার্থ তার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে হাসির সুর সপ্তম গ্রামে তুলে দেয়। বলে, ‘হবে না, রমেশবাবু। লুডিক্রাস!’

রমেশ বলে, ‘হবে না বললেই ত হয় না। এ নিয়েই চালিয়ে দিতে হবে আপাতত।’

চমৎকারিণীর হাসি কিছুতেই থামে না। যেন মদের পিপের মুখ ছুটে গেছে, তার থেকে ফেনিল উচ্ছ্বাস উঠছে।

নিমাই একেবারে রুখে ওঠে , বলে, ‘চোখের সামনে অমনি হাসলে কে পার্ট করতে পারে? রইল আপনার থিয়েটার। চলে এসো, সরলা!’

সরলা আয়ত চোখ মেলে নিমাইর দিকে তাকায়। ওর অপমানের বেদনা স্নেহে সুশীতল হয়ে ওঠে।

রমেশ হাঁকে, ‘নিমাই! এ কি অন্যায় কথা তোর! পরের সমালোচনা কি করে বন্ধ করবি? এগিয়ে এসো সরলা, আবার চেষ্টা করো। অমন হাসাহাসি কোরো না চমৎ! আমাদের এ-ই চালিয়ে নিতে হবে। জ্বরে পড়েই ত তুমি সব বিতিকিচ্ছি করে দিলে।’

‘বিতিকিচ্ছি?’ নিমাই ফের প্রতিবাদ করেঃ ‘সরলার সমস্ত শরীরে প্রেমের যে একটি সহজ লীলা ও পেলবতা আছে তা চমৎকারিণীর কোথায়? ওর স্বরে আপনি থেকে একটি স্নেহের সুর আছে,—কেমন চমৎকার মানায় ওকে! চমৎকারিণীকে খুনের পার্টেই বেশি খোলে, কিন্তু সরলা যেন মূর্তিমতী সরলা। আপনার বই থেকে ঐ খুনের অংশটুকু কাটা-প্রুফের মতো বাদ দিন।’

রমেশ এ-সব কথা কানেই তোলে না। আবার পার্ট চলে। সরলা আবার ব্যর্থ হয়ে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চায়।

পরেরটুকু আর আসে না। নিমাই বলে, ও যেমনি হচ্ছে হোক, বাকিটুকুতে কেঁদে সরলা আগের সমস্ত ত্রুটি ধুয়ে নিয়ে যাবে। দেখেছেন, একদিনে কেমন মুখস্থ করে ফেলেছে? চমৎকারিণীর লেগেছিল পুরো একটি বছর।’

চমৎকারিণী চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আমাকে এমনি ধারা অপমান করলে আমি আজই চললাম কলকাতায় ফিরে।’

কৃতার্থও চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মুখ সামলে, নিমাই!’

ঝগড়ার সম্ভাবনাটা কাটিয়ে ওঠবার জন্য রিহার্সেলটা খানিকক্ষণ বন্ধ থাকে।

রাত্রে সরলাকে গাড়ি করে এগিয়ে দিতে-দিতে নিমাই বললে, ‘আমার যদি অনেকগুলো টাকা থাকত, তবে তোমাকে নিয়ে নতুন একটা থিয়েটার খুলতাম। তোমাকে কোয়্যাকট্রেস পেয়ে সত্যিই আমার ভেতরে একটা আবেগ আসে,—কাউকে দিয়ে খুব মিষ্টি করে একটা প্রেমের গল্প লিখিয়ে নিতাম!

সরলা হেসে বলে, ‘আপনি নিজেই ত পারেন। পরকে খোশামোদের দরকার হয় না।’

একটুখানি মাত্র পথ—এক নিশ্বাসেই ফুরিয়ে যায়। সরলার ইচ্ছা করে নিমাইকে ঘরে নিয়ে যায়, নিজ হাতে রেঁধে ওকে কিছু খাওয়ায়, ফরসা চাদর বের করে ওর জন্য নিজ হাতে নতুন একটি বিছানা পেতে দেয়, ও ঘুমিয়ে পড়লে শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্যের মতো ওর চুলগুলিতে আঙুল বুলিয়ে দিতে-দিতে দুটি ফোঁটা চোখের জল ফেলে।

সরলা মুখ ফুটে নিমন্ত্রণ করতে পারে না।

ভাবে, এই বন্ধ গাড়ির মধ্যেই শুধু দু’টি মুহূর্তের জন্য ওর এই ছোট্ট ক্ষণিক সংসার—নিমাইর সঙ্গে। সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন মালতী আর হিরণকুমার!

গাড়িটা থামলে সরলা নামে, নিমাই হঠাৎ ওর আলোয়ানটা সরলার গায়ে জড়িয়ে দেয় , বলে, ‘তোমার শীত করবে না-হলে।’

সরলা আপত্তি করে না, আলোয়ানটি আরো নিবিড় করে জড়িয়ে পরিচিত ঘরে এসে ঢোকে। আজ আর কারু সঙ্গে কথা কয় না, ভূতির সঙ্গেও না। আলোয়ানটা গায়ে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।

সরলার জীবনে আরেকটি পরিচ্ছন্ন রাত্রি কাটে, ঘুম থেকে জেগে পবিত্র প্রভাতকে মনে-মনে অভিবাদন করে।

শুক্রবার। কাল প্লে। আজ ড্রেস-রিহার্সেল।

পার্ট সরলার মুখস্থ হয়ে গেছে। ওর একাগ্র মনোযোগের দরুনই তা সম্ভব হল। ছুরি-মারার ভঙ্গিটিও এক-রকম চলনসই করে এনেছে।

ও এর মধ্যে নিজের ত্রুটির ব্যাখ্যা পর্যন্ত বের করে ফেলেছে , বুঝিয়ে বলে, ‘এই অবস্থায় মালতীর মুখে খুব একটা হিংস্রতা আসতেই পারে না, সেই হিংসা ও ক্রোধের সঙ্গে যে ওর একটি মমতা ও শোক মেশানো আছে—তাই তার মুখে কোমলতাটা স্বভাববিরুদ্ধ নয়।’

বলা বাহুল্য ভাষ্যকার স্বয়ং নিমাই।

সকালবেলা ছুটতে-ছুটতে হরি এসে হাজির, হাতে একখানা ছাপানো কাগজ। সরলার দোর-গোড়ায় এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললে, ‘গাড়িতে করে কাগজ বিলি হচ্ছে, সরলা-দি। আমাকে কি দেয়? বললাম—আমার সরলা-দি থেটার করবে, তখন দিলে। গাড়ির ছাতে বসে সানাই বাজাচ্ছে, আর কত লোক যে গাড়ির সঙ্গে ছুটছে, সরলা-দি! রামু ত চাকার তলায়ই পড়ে গেছল আরেকটু হলে!’

গর্বে আনন্দে সরলার বুক দুলে ওঠে। এত বড়ো একটা আনন্দব্যাপারে ওর কিছু অংশ আছে ভেবে ও ধন্য হয়ে যায়।

ভূতি কৌতুহলী হয়ে কাছে আসে। সরলা হরির হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়ে সকলকে বুঝিয়ে দেয়। মাঝখানে একটা ছবি আছে—তার অর্থ করে।

বলে, এই হিরণকুমার বিষ খেয়ে শুয়ে আছে, আর আমি এমনি ছুরি নিয়ে মারতে আসছি।’

সমস্ত নাটকের মধ্যে এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে রোমহর্ষক বলে তারই ছবি ব্লক করে বিজ্ঞাপনে ছেপে দেওয়া হয়েছে।

ভূতি ও আর সব মেয়েরা ঈর্ষায় জর্জর হয়ে সরলার পানে তাকায়। ভূতি বলে, ‘কিন্তু এ ত তোর ছবি নয়—’

সরলা তা জানে। এ চমৎকারিণীর ছবি। যেন নৃমুণ্ডমালিনী চামুণ্ডা , হিরণকুমারকে ও কোনোদিন ভালোবেসেছিল তার কোনো প্রমাণই তাতে পাওয়া যায় না—যেন বরাবরই ও একটা শাকচুন্নি। আর শুয়ে আছে নিমাই—রুখু চুল, চোখের পাতা বোজা, একখানি হাত মাটির দিকে ঝুলে পড়েছে।

সরলা হেসে জবাব দেয়, ‘আমার ছবি কোথায় আর পাবে বলো। এমনি একটা এঁকে দিয়েছে। আমার অমনি মোটা হলেই হয়েছিল আর কি! পার্ট থেকে নাকচ করে দিত।’

কিন্তু নিজের মনকে এই বলে বোঝায় অনেক দিন আগে থেকেই এগুলি ছাপা বলে মালতীর ভূমিকায় সরলার নামটা আর ছাপা হয়ে ওঠেনি।

সরলা বলে, ‘আজ সব পোশাক পরে রিহার্সেল হবে, এখুনি যেতে হবে।’

হরি মিনতি করে বলে, ‘আমাকে টুপ করে কোনোখান দিয়ে আজ ঢুকিয়ে দিতে পারবে না, সরলা-দি? তোমাদের পোশাক-পরা নাটক দেখব।’

সরলা হেসে ওকে প্রবোধ দেয়, ‘আজ কি, কালই ত দেখবি। খুব ভালো জায়গায় বসিয়ে দেব’খন। মাকে নিয়ে যাস।’

হরির যেন ত্বর সয় না , বলে, ‘খুব ভালো জায়গা দেবে? বাঃ, কেয়া মজা! রামু ওরা ত জায়গাই পাবে না।’

হরি নাচতে-নাচতে বেরিয়ে গেল।

সরলাকে এখুনিই বেরোতে হবে। ঘরে যেটুকু সময় থাকে—স্নান করা, একটু খাওয়া কি না খাওয়া—সব সময়েই অস্ফুটস্বরে পার্ট আওড়ায়। ও এই নিয়েই আছে। ওর তিনদিন আগেকার অতীত জীবনের সঙ্গে যেন ওর কোনোই সম্পর্ক নেই—তাকে ও চেনেই না।

ড্রেস-রিহার্সেল শুরু। সবুজ রঙের শাড়ি পরে জালন্ধর-রাজকুমারী শ্রীমতী মালতীমালা ওরফে সরলাসুন্দরী যেন সবুজ মেঘের পরীর মতো পাখা মেলে এই শহরের মাটিতে নেমে এসেছে।

সরলার দিকে চেয়ে কে বলবে ও সত্যিই একগাছি মালতীর মালা নয়!

পিঠে কালো পরচুল মাটি ছোঁয়-ছোঁয়, শাড়ি-পরার ভঙ্গিতে কি আশ্চর্য সুষমা! হাতে আভরণ! গলায় পুষ্পহার।

আর সম্মুখে হিরণকুমার,—রাজপুত্রের বেশে। মাথায় সোনার মুকুট তাতে পাখির পালক গোঁজা।

সমস্ত স্টেজ গমগম করে ওঠে,—ডে-লাইটের সুতীব্র আলোতে পরস্পরের চোখে একটি বিহ্বল মুগ্ধতা আবিষ্কার করে দুজনে আবিষ্ট হয়ে পড়ে। অভিনয় শুনে সবাই তর হয়ে যায়।

কিন্তু শেষ দৃশ্য আবার তেমনি জোলো হয়ে আসে। কৃতার্থময় কিছুতেই সায় দেয় না, দুর্বল বলে উচ্চহাস্য থেকে বঞ্চিত হয়ে চমৎকারিণী একটা বীভৎস কটু আওয়াজ করে।

নিমাই বলে, ‘আর-আরদের অভিনয়ের প্যাঁচে কত যে গলদ থাকে তার কেউ খোঁজ করে না, এ বেচারির ছুরি ধরা ঠিকমতো হয় না বলেই যত ঠাট্টা! আপনারা ত ছাই সমঝদার, দেখবেন লোকে কি রকম নেয়!’

কৃতার্থ বলে, ‘লোকে ত আর তোমার মতো গাড়োল নয়, তাদের রসবোধ বলে একটা জিনিস আছে।’

রমেশ মীমাংসার সুরে বলে, ‘না না—এই আমাদের চালিয়ে নিতে হবে। বেশ হবে, সরলা। তুমি একটুও ঘাবড়িয়ো না।’

রিহার্সেলের শেষে সরলা দামী পোশাক ছেড়ে তার আটপৌরে শাড়িখানি পরলে। সরলা যেন নিমাইর চোখে রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে!

নিমাই বললে, ‘দেখবে কি রকম ভিড় হবে, হাততালিতে প্রত্যেকটি কথা ডুবে যাবে দেখো।’

সরলা মনে-মনে ছবি আঁকে,—বিপুল জনসমারোহের কূল-কিনারা করতে পারে না।

কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এসে সরলা কারুর দেখা পায় না। গাড়ি নিয়ে কেউই বাবলা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে নেই। সরলা ভাবে, হয়ত গাড়ি আনতে গিয়ে দেরি হচ্ছে , একটু অপেক্ষা করে, কেউ আবার পাছে কিছু সন্দেহ করে এই ভয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়াতেও পারে না। অন্ধকারে গা ছমছম করে। এ কেমনতরো লোক, একটুও ভাবনা নেই? সরলা বুকের মধ্যে একটা অস্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফেরে।

ভাবে দোরের বন্ধ তালাটা খুলতেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।

নিমাইর র্যাপারাটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। ভাবে, হয়ত তক্ষুনিই নিমাই গাড়ি নিয়ে এসে ঘুরে গেছে।

রাতের মতো রাত একটা, আশা-আকাঙক্ষায় ভরা! ওর চোখের সমুখে রাশীকৃত লোক—সবাই হাততালি দিচ্ছে, মুগ্ধ হয়ে ওর মুখের ওর পোশাকের দিকে চেয়ে আছে। অটল যদি যায়, সেও হাঁ হয়ে যাবে, চিনতেই পারবে না। কেউ দিস্তা খানেক নোট নিয়ে আসতে পারে, ও তা ছুঁড়ে ফেলে দেবে—ও হিরণকুমারের বাসনাবাসিনী প্রিয়া! তার জন্যেই ও গেরুয়া পরবে।

শনিবার। দিনের মতো দিন! পাঁজিতে এ-দিনটি যেন সরলার জন্য রিজার্ভড ছিল।

চোখ-মুখ ধুয়েই নিমাইয়ের র্যাপারটা গায়ে জড়িয়ে সরলা রওনা হল থেটার-বাড়ি।

যাবার সময় ভূতিকে বলে গেল, ‘দুপুরে একবার এসে পাস দিয়ে যাব তোদের।’

সরলার সুখের আজ অন্ত নেই। ওর মধ্যে এত বড়ো শক্তি প্রসুপ্ত ছিল, এত বড়ো কাজের যোগ্যতা ছিল জানতে পেরে ও গর্বে একেবারে ফুলে উঠেছে। নিজেকে আবিষ্কার করার মতো অহঙ্কার বোধকরি আর কিছু নেই। ও এ-ক’দিন একটা মাতালেরও মুখ দেখেনি, ওর সমস্ত আচরণে একটি ভদ্রতা এসেছে—মনে একটি বিশ্রামের সঙ্গে প্রশান্তির স্বাদ পাচ্ছে! কত ভালো লাগছে ওর—জীবনের বৃহৎ বৈচিত্র্যের আস্বাদ পেয়ে ও ধন্য হয়েছে।

সত্যিই, আজ ও মালতীমালার মতো সন্ন্যাসিনী হয়েও যেতে পারে।

সরলা এসে পৌঁছুলো। সব ফিটফাট। সব সিজিল-মিছিল হয়ে গেছে।

কিন্তু সবাই কেমন উদাসীন। সরলাকে দেখে কারু ঔৎসুক্য নেই। নিমাই কই?

রমেশবাবুকে বললে, ‘আজ রিহার্সেল হবে না?’

রমেশ বললে, ‘হ্যাঁ, দুপুরের পরে একবার হবে—কয়েকটি সিন।’

সরলা কিছু বুঝে উঠতে পারে না।

রমেশ আর যাই হোক মুখচোরা নয় , বুঝিয়ে দেয়। বলে, ‘তোমাকে আর আমাদের প্লে-তে লাগবে না। চমৎকারিণী সেরে উঠেছে, সে-ই মালতীর পার্টে নামবে।’

সরলা বসে পড়লো। ওর তাসের ঘর দমকা হাওয়ায় ছত্রখান হয়ে গেল।

রমেশ আরো খুলে বললে, ‘মার্ডারের সিনটা তোমাকে দিয়ে কিছুতেই হল না,—কৃতার্থ ওরা কিছুতেই রাজি হয় না। তা ছাড়া চমৎকারিণী ভালো হয়ে এই পার্টটা এখানে আবার করবার জন্য ভারি ঝুঁকে পড়েছে। জানই ত, ও আমাদের দলের সেরা য়্যাকট্রেস। ওকে ত আর চটাতে পারি না।’

সরলা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, ছেলেমানুষের মতো! এক মুহূর্তে ও যেন একেবারে ফুরিয়ে গেছে।

রমেশ বৃথা প্রবোধ দিতে চেষ্টা করে, ‘তুমি কিছু মনে করো না, সরলা। বিকেলে তুমি এসো থিয়েটার দেখতে। তোমাকে আর কয়েকটা টাকা দেব’খন, থিয়েটারের পরে কিংবা কাল সকালে এসে নিয়ে যেয়ো।’

রমেশ চলে গেল।

সরলা কোথায় গিয়ে যে ওর এই কান্না লুকোবে, জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। ওর কাছে পৃথিবী যেন আজ সমস্ত জায়গা খুইয়ে বসেছে।

খানিকক্ষণ এ-দিক ও-দিক নিমাইর খোঁজ করলে, কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। খুঁজতে খুজতে পোশাকের ঘরে এলো, সেখানেও নিমাই নেই। মধুসূদন বাক্স থেকে পোশাক আর চুল খুলে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখছে। কাল রাত্রে সরলা ঐ সবুজ শাড়িটি পরেছিল, আর নিমাই ঐ মুকুটটা।

একজনকে জিজ্ঞেস করলে, ‘নিমাইবাবু কোথায় বলতে পারেন?’

লোকটা কি কাজে ব্যস্ত ছিল , বললে, ‘জানি না।’

চট করে একটা কথা সরলার মনে পড়ে গেল,—বোধ হয় নিমাই পালিয়েছে। নিমাই ওকে বলেছিল, যদি সরলাকে শেষ পর্যন্ত না নামায়, তবে ও বেঁকে বসবে, পালিয়ে যাবে, পারের কাছে নৌকো এনে ডুবিয়ে মারবে!

ঠিক তাই। সরলাকে নামাবে না জেনে অভিমানে বেদনায় নিমাই বিবাগী হয়েছে।

সরলার মনে বল এল,—ধর্মের জয় আছেই। এই প্রবঞ্চকদের সমুচিত শাস্তি দরকার! বেশ হবে। নিমাই না থাকলে থিয়েটারই হতে পাবে না, হিরণকুমারের পার্টে আর কেউ তৈরি নেই।

নিমাইর প্রতি শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় সরলার মন ভরে ওঠে।

সরলা বিমর্ষ মুখে থিয়েটার-বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। বাবলা গাছটার তলায় বসে ও চোখের জল আর চেপে রাখতে পারেনি। জীবনে ও ঢের কেঁদেছে, এর চেয়ে ঢেড় বড়ো বেদনায় কিন্তু আজকের মতো নিজেকে কোনোদিন এমন ব্যর্থ মনে করেনি। ওর চোখের থেকে দিনের আলো যেন কে শুষে নিয়েছে।

কিন্তু নিমাইকে আজ ওর চাই—একান্ত করে চাই। এ সংসারে ও-ই সরলার একমাত্র বন্ধু, খালি ওকেই সরলার অপমান স্পর্শ করেছে। নিমাইকে আজ সরলা তার ছোট ঘরটিতে নিয়ে সমস্ত পৃথিবীর নাগালের থেকে আড়াল করে রাখবে।

নিমাইকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যে! বাজার, গাড়ির আড্ডা, অলি-গলি কোথাও নিমাই নেই। নিমাই নেই। নিমাই দেশ-ছাড়া হয়নি ত?

হঠাৎ মনে হল, নিমাই হয়ত ওরই বাড়ি গিয়ে বসে আছে, ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার জন্য। সরলার সমস্ত শরীর আনন্দে শিউরে উঠল।

সরলা তখুনি বাড়ি গেল। রোদ তখন বেশ চড়া হয়েছে। সরলার ঘরে কেউ আসেনি, কেউ ওর খোঁজও করেনি।

বাড়িউলি ঠাট্টা করে ‘আজ যে লোকের ওপর ভারি দরদ—’

ভূতি তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সরলার চেহারা দেখে থমকে যায়। বলে, ‘তোর কী হয়েছে, সরলা? কাঁদছিস কেন?’

সরলা বলে, ‘এই মাত্র পার্ট করে আসছি। আমার যে কাঁদবারই পার্ট।’

মুখে ঠুনকো হাসি ফুটোবার চেষ্টা করে বলে, ‘সেই তখন থেকেই কাঁদছি। নিজে কেঁদে পরকে কাঁদাব—তাই বড়ো শক্ত রে , হ্যাঁ রে ভূতি, আমার কাছে কেউ আসেনি—ঢ্যাঙাপানা ফরসাপানা একটি ছেলে, গায়ে ফ্লানেলের পাঞ্জাবি? আসেনি? কেউ না?’

সরলা ভগ্নোৎসাহ হয়ে বলে, ‘তবে যাই ফের থেটার বাড়ি। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না—তার সঙ্গেই আমার পার্ট। তাকে কোথাও না-দেখে সবাই ভারি ভড়কে গেছে। কোথায় গেল!’

বলে সরলা ফের বেরিয়ে পড়ল থিয়েটার-বাড়ির দিকে।

ভূতি বললে, ‘আমাদের পাস কই সরলা?’

সরলা বলতে-বলতে গেল, ‘দরজায় গিয়ে আমার নাম করলেই ছেড়ে দেবে,—ভাবিসনে।’

সেখানে গিয়ে ফের নিমাইর খোঁজ নিলে,—কেউ কিছু জানে না। কিন্তু কারু মুখে লেশমাত্র উদ্বেগের চিহ্ন নেই। স্বয়ং রমেশবাবুও হাসিমুখে গল্পগুজব করতে-করতে তদারক করে বেড়াচ্ছে,—সরলার দিকে চেয়েও দেখছে না।

ঠিক উচিত প্রতিশোধ নেওয়া হবে। হিরণকুমার মালতীর অপমান সইতে পারেনি, তার দণ্ড দিয়ে গেছে।

একজন বললে, ‘নিমাই শহরের গণ্যমান্যদের বাড়িতে-বাড়িতে উঁচু ক্লাসের টিকিট বেচতে গেছে।’

টিকিট বেচতে গেছে? অসম্ভব!

অসম্ভবই বা কেন? হয়ত এই অন্যায় পরিবর্তনের খবর এখনো নিমাইর কানে ওঠেনি। তাই সরলার অভিনয় সবাইকে দেখাবার জন্য টিকিট বেচতে নিমাইর এত আগ্রহ! নইলে নিজে গা করে টিকিট বেচবার মতো ছেলেই নয় সে।

সরলা যেন নিমাইয়ের মনের সমস্ত গলি-ঘুঁজি চিনে ফেলেছে।

চলল ফের শহরের দিকে। যদি রাস্তায় দেখা হয়।

ক্ষুধায় শরীর টা টা করছে,—সরলার হুঁস নেই। ও এই অবিচারের প্রতিবিধান চায়—যে তার প্রেমিক, যে তার সর্বস্ব—তার কাছে।

কোথাও নিমাইর দেখা নেই। যদি গেলই, সরলাকে কেন সঙ্গে নিয়ে গেল না?

সন্ধ্যা হতে-না হতেই হরি আর তার মা সরলাদের বাড়ি এসেছে।

হরি বললে, ‘আমাদের জন্য পাস রেখে গেছে, ভূতি-দি?’

হরি নতুন জামাকাপড় পরে এসেছে, হাতে একটা খেলনা রিস্ট-ওয়াচ বাঁধা, মাথায় দিব্যি টেড়ি বাগানো। হরির মা-ও কাপড় কেচে শুকিয়ে পরে এসেছে।

ভূতি বললে, ‘পাস রেখে যায়নি। বলেছে, টিকিট নিতে দরজায় যে থাকবে তাকে সরলার নাম করলেই বসবার জায়গা করে দেবে।’

হরি ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘তবে আগে-ভাগে চলো ভূতি-দি, জায়গা পাওয়া যাবে না। বেজায় ভিড় হয়ে যাবে। আর কাপড় বাছতে হবে না, একখানা এমনি পরে চলো।’

ভূতি ধমক দিয়ে উঠল, ‘এখনো আরম্ভ হতে দু’ঘন্টা বাকি—’

ভূতিও তার সাধ্যমতো সেজে নিল। তিন জনে বেরিয়ে পড়ল,—হরি আগে-আগে, লম্বা-লম্বা পা ফেলে হাত দুলিয়ে-দুলিয়ে। পথঘাট ওর নখদর্পণে।

দারুণ সোর-গোল, লোকে গিসগিস করছে। বগলাবাবুর ভবিষ্যদবাণী আংশিক রূপেও সফল হয়নি। হরি বললে, ‘বড্ড দেরি হয়ে গেছে, ভূতি-দি। জায়গা পেলে হয়। মেয়েমানুষগুলো চলতেই পারে না, কাপড় পরতেই তিন ঘন্টা!’

থিয়েটার আরম্ভ হতে এখানো কিছু দেরি আছে। হরি দরজার সামনের লোকটিকে গিয়ে গম্ভীরভাবে বেমালুম বললে, ‘সরলা-দিকে ডেকে দাও ত?’

লোকটি বললে, ‘কে সরলা-দি?’

হরি অবাক হবার ভান করে বললে, ‘কে সরলা-দি? বাঃ,—তুমি নতুন লোক বুঝি? সরলা-দি, যে য়্যাক্টো করছে, কাগজে-কাগজে যার ছবি উঠেছে, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে সেই-যে একটা মরা মানুষ খুন করতে ছুরি নিয়ে ছুটেছে—সেই সরলা-দি!’

ভূতি বুঝিয়ে বলে, ‘এই নাটকে মালতীর পার্ট নিয়ে যে নামবে আজ।’

লোকটি বিরক্ত হয়ে বললে, ‘সরলা-ফরলা বলে এখানে কেউ নেই। মালতীর পার্টে যে নামছে তার নাম চমৎকারিণী দাসী। সরলা আবার কে?’

‘বাঃ, আমাদের বলেছে গেটে এসে তার নাম বললেই আমাদের ছেড়ে দেবে, ভেতরে জায়গা করে দেবে,—তার নাম সবাইর মুখে-মুখে!’

লোকটি বললে, ‘তোমাদের সরলা-দিটি ভারি সৌখিন দেখছি। যাও, জায়গা ছাড়ো, অন্য লোকদের পথ করে দাও।’

হরি বিমর্ষ হয়ে বললে, ‘ঢুকতে দেবে না? দেখো না ভেতরে গিয়ে, সরলা-দি বসে আছে, হয়ত সাজছে। তোমার দু’টি পায়ে পড়ি, ভদ্রলোক, আমাদের ছেড়ে দাও।’

ভদ্রলোক কথা গ্রাহ্য করে না।

ও দিকে ঘন্টা পড়ে, সিন ওঠে য়্যাকটিং শুরু হয়।

হরি এবার গলা ছেড়ে কেঁদে ওঠে। হরির মা বলে, ‘কি দারুণ মিথ্যুক এই ছুঁচো হারামজাদি,—কি ভীষণ চালবাজ! এ যে জাঁহাবাজ ডাকাত বাবা,—একে পুলিশে দিতে হয়।’

ভূতি দুম দুম করে পা ফেলতে-ফেলতে বলে, ‘ফিরুক ও বাড়ি। ওর দেমাক আমি ভাঙছি অটলবাবুকে দিয়ে।’

হরি কিছুতেই আসবে না, বেড়ার ফাঁকে চোখ রেখে ও কি দেখছে ও-ই জানে। মা যত টানে ও ততই বেড়া আঁকড়ে থাকে। শেষে মার হাতের চার-পাঁচটা কিল খেয়ে হেরি হেরে যায়। হরির চীৎকারে বাইরের অন্ধকার বিদীর্ণ হতে থাকে।

সরলা আরেক প্রতিবেশিনীর ঘরে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, যখন ঘুম ভাঙে তখন থিয়েটার আরম্ভ হবার সময় কাবার হয়ে গেছে।

নিশ্চয়ই এখনো নিমাই ফেরেনি,—রমেশবাবুর উদ্বেগ অশান্তির আর সীমা নেই চমৎকারিণী খুব জব্দ হয়েছে। কৃতার্থের ফুটুনি ঘুচেছে। খুব মজা! নিশ্চয়ই থিয়েটার আর হয়নি, লোকেরা খুব গালাগাল করছে, রমেশবাবুকে বাধ্য হয়ে পয়সা ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।

মজা দেখতেই হয়ত সরলা ও-দিকে পা চালালো। কিন্তু একটু কাছে আসতেই ওর সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে ভারি শীত করতে লাগল, এত শীতেও পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে এল। দূরে ডে-লাইট দেখা যাচ্ছে। থিয়েটার হচ্ছে বৈকি!

সরলা গেল এগিয়ে। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে।

ছুটে গিয়ে দরজার লোকটিকে বললে, ‘নিমাইবাবু এসেছেন?’

‘সে কখন—’

‘তাঁকে একটু ডেকে দিতে পারেন?’

‘বাঃ, এই তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য হচ্ছে। উনি য়্যাক্ট করছেন যে—’

তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য। সরলার চোখ ফেটে জল পড়তে লাগল! সমস্ত দৃশ্যটি সরলার মুখস্থ। সেই সব কথাগুলি নিমাইকে আবার চমৎকারিণী বলছে—সরলা যা বলেছিল আগে! কণ্ঠস্বরে সেই আবেগ, স্পর্শে সেই উত্তাপ! তার মনের কথাগুলি যা বইয়ের আখরে সরলার অজানতে প্রকাশ পেয়েছিল, তা চমৎকারিণীর মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে!

তবু নিমাই বলেছিল,—তোমাকে পেয়ে সরলা, আমার মনে ভাবের জোয়ার আসে, তোমাকে না নামালে আমি ওদের ডুবিয়ে মারব।

ঈর্ষায় অভিমানে কেঁদে সরলা ধুলার সঙ্গে মিশে যেতে চায়।

কানে কিছুই আসে না বটে, কিন্তু সরলা চোখের সামনে সমস্ত হাব-ভাব আঁকা দেখতে পায়। সেই মোটা বেঁটে চমৎকারিণী তার মৃত নিমাইকে কোলে নিয়ে আদর করবে ভেবে সরলা নিজে নিজের চুল ছেঁড়ে, হাত কামড়ায়, কপালে করাঘাত করে।

ইচ্ছা করে একটা ক্ষুধিত আর্তনাদের মতো স্টেজের ওপর গিয়ে ফেটে পড়ে। বিকট চীৎকার করে অভিনয়ের সমস্ত লজ্জা ঢেকে দেয়।

ক্ষুধায় সমস্ত গা অবশ,—নিমাইর খোঁজে হেঁটে-হেঁটে পা একেবারে ভেঙে পড়তে চাইছে।

আস্তে আস্তে থিয়েটার ভেঙে যায়। কোলাহল করতে-করতে লোক সরে পড়তে থাকে। ততক্ষণ সরলা র্যাপার মুড়ি দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। সবাই চমৎকারিণীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বাড়ি ফেরে। প্রত্যেকটি কথা সরলার কানে আসে।

‘খুনের সিনটা কি রকম করলে! ওয়ান্ডারফুল!’

‘কি সুন্দর! অথচ কি ভীষণ! ভয় লাগে, ভালোও লাগে। পয়সা সার্থক, ভাই।’

সরলা আর বসে না, বাড়ি চলে। চলতে আর পারে না, কেঁদে কেঁদে মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে।

নিঃঝুম পাড়া সবাই ঘুমিয়েছে। ভূতিও হয়ত। সদর খোলা ছিল।

ওর ঘরে এসে দেখে মিটমিট আলো জ্বলছে। ভেতরে অটল একা বসে মদ খাচ্ছে। সরলার সমস্ত শরীর কালিয়ে এল।

অটল তখনো বেহুস হয়ে পড়েনি, সরলাকে দেখেই ওর রক্ত ফুটে উঠল। হাতের মুঠিতে ধরা ছিল মদের গ্লাসটা, তাই মারল ছুঁড়ে সরলার মাথা লক্ষ্য করে।

বললে, ‘শালির আমার থেটার করা হচ্ছে! তিন দিন ধরে ঘুরে-ঘুরে আমি হয়রান হয়ে পড়েছি—’

সরলা ‘বাবা গো’ বলে ঘুরে পড়লো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটেছে।

এতেও অটলের তৃপ্তি হয় না, জুতোটা দিয়ে সরলার পিঠের খাল ছিঁড়ে দেয় বলে, ‘বলে কিনা থেটারের দলে ভিড়ে যাব, …মদের দাম দেবে না, রাত্তির বেলা বাড়ি আসার নাম নেই…’

বলে আর লাথি-জুতো চলতে থাকে।

সরলা অটলের পায়ের নিচে পড়ে একেবারে ভেঙে গেছে। বাড়িউলি প্রথমে মনে-মনে মজা দেখে, পরে অটলকে থামাতে আসে। ভূতিই মাথায় ব্যাণ্ডেজ করে দেয়।

ভোরবেলা সরলার যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন সারা গায়ে বিষম ব্যাথা, জ্বর, মাথা ছিঁড়ে পড়ছে,—যেন সারা বছর ও কিছু খায়নি। পায়ের কাছের জানলা দিয়ে সূর্যোদয় দেখা যাচ্ছে।

এত দুঃখেও ওর স্বপ্ন কাটেনি। ভোরের আলোয় মনে হচ্ছে যেন ওর কাছে ওর হিরণকুমার আসছে—মাথায় তার সোনার মুকুট, তাতে পাখির পালক গোঁজা!

সকল অধ্যায়

১. বিচারক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. ডালিম – চিত্তরঞ্জন দাশ
৩. চন্দ্রমুখী – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪. ঠিকানায় ‘বুধবার’ – জগদীশ গুপ্ত
৫. কুসুম – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৬. আদরিণী – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
৭. সাকীর প্রথম রাত্রি – রমেশচন্দ্র সেন
৮. হিঙের কচুরি – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. মেলা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১০. মন্দ লোক – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. দন্ত কৌমুদী – বনফুল
১২. গোষ্পদ – যুবনাশ্ব
১৩. ইতি – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
১৪. খট্টাঙ্গ পুরাণ – শিবরাম চক্রবর্তী
১৫. দুকানকাটা – অন্নদাশংকর রায়
১৬. চাচা কাহিনি – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৭. বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৮. অঙ্গার – প্রবোধকুমার সান্যাল
১৯. নমুনা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২০. চোর! চোর! – বুদ্ধদেব বসু
২১. বারবধূ – সুবোধ ঘোষ
২২. ট্যাক্সিওয়ালা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
২৩. বাইজি – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৪. তিমিরাভিসার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. জামাই – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
২৬. তলানি – নবেন্দু ঘোষ
২৭. মাশুল – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
২৮. শনি – সন্তোষকুমার ঘোষ
২৯. আঙুরলতা – বিমল কর
৩০. সুর্মা – রমাপদ চৌধুরী
৩১. ঘরন্তী – বিমল মিত্র
৩২. প্রাণ-পিপাসা – সমরেশ বসু
৩৩. বাগাল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৪. ছদ্মবেশিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. নরক – প্রফুল্ল রায়
৩৬. পহেলি পেয়ার – বুদ্ধদেব গুহ
৩৭. নিরুদ্দেশ প্রাপ্তি হারানো – সমরেশ মজুমদার
৩৮. বেওয়ারিশ লাশ – জাহান আরা সিদ্দিকী
৩৯. ঝরা পাতা – তসলিমা নাসরিন
৪০. নিজের সঙ্গে দেখা – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন