ওরা সমাজ-ছাড়া, সমাজের বাইরে ওরা। কিন্তু ওদেরও একটা সমাজ আছে। ওদেরও ছেলেমেয়ে আছে, আর ছেলেমেয়েদের বিয়েও হয় কখনো-সখনো। কিন্তু বিয়েটাকে খুব সুনজরে দেখতে পারে না সকলে।
পারে না তার কারণ এ নয় যে ওরা অসামাজিক জীব। কারণটা অর্থনৈতিক। ওদের সমাজে শেষ ভরসা হল একটি ভরা-বয়সের মেয়ে। নিজের হোক পরের হোক, তফাত নেই কোনও। মা-মাসির রোজগারে ভাটা পড়লে ভয় কীসের? মেয়ের যৌবনের জোয়ার মানেই তো রোজগারেও জোয়ার।
কিন্তু দু-একটা মেয়ে হঠাৎ একসময় বেঁকে দাঁড়ায়।
চোখ কপালে ওঠে বিপত্তারিণীর। বিপত্তারিণী অবশ্য নাম নয়, আসল নামটা যে কী ছিল তা আর মনেই নেই কারও। বয়সকালে যতবার পাড়া বদলেছে ততবার নাম, তারপর এ তল্লাটে যখন ব্যবসা জাঁকিয়ে বসল তখন থেকে সবাই ঠাট্টা করে নাম দিল—বিপত্তারিণী। ব্যবসাটা মন্দ চলে না। আইনকানুনের যত কড়াকড়ি হচ্ছে, বিপত্তরাণীর ততই লাভ। দিশি-বিলিতি পাঁচ রকমের মদ রাখে বিপত্তারিণী। রাত্তিরে মদের দোকানগুলো যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন অনেকে ছুটে আসে তার কাছে। বাড়তি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যায়। লুকোচুরির কাজ, কিন্তু থাকে দু-পয়সা। সত্যি বলতে কি, শেষ বয়সে মেয়ের রোজগারে খাবার লোভও নেই, প্রয়োজনও হবে না বিপত্তারিণীর। তা বলে সমাজ ছাড়া হবে কেন তার মেয়ে।
চিরকাল যা দেখে এসেছে, বাকি দিন ক-টাও তাই দেখে যেতে চায় বিপত্তারিণী। উঠতি বয়সে অমন অনেক কথা মনে হয়, অনেক স্বপ্ন ও নিজেও দেখেছিল। তারপর ঘা খেয়ে খেয়ে ভুল ভেঙে গেছে, বুঝেছে যে যার নিজের নিজের ফুটপাত ধরে চলাই ভালো। তাই সুর্মাকে ভুল করতে দিতে চায় না। সোনাদানায় গা মুড়ে বেশ রবরবা নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে মেয়ে তার, এইটুকু দেখে যেতে পেলেই যেন খুশি হয় বিপত্তারিণী। আর বিয়েই যদি করতে হয় তো শেঠেদের সেই ছোকরা বাবুটি—
তা নয়, সুর্মার মন পড়েছে রতনের ওপর। এ পাড়ারই ছেলে, এ পাড়াতেই গান শিখিয়ে বেড়ায়। গলির মধ্যে চায়ের দোকানটা চালায় রতনের মা। দোকানটা ছিল এক হিন্দুস্থানির, রতনের মার কাছে আনাগোনা ছিল তার। কলেরা না-বসন্ত কী হয়ে যেন মারা যায় লোকটা, তারপর থেকে ওটা রতনের মা চালিয়ে আসছে।
রতনের দোকান-টোকান ভালো লাগত না। গান গাইতে পারত ভালো, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শেখাত পাড়ার মেয়েদের।
যে যা পারত দিত মাইনে, রোজগার মন্দ হত না!
সবচেয়ে বড়ো রোজগার হয়ে গেল সুর্মা।
সুর্মাকে গান শেখাতে শুরু করেছিল সে খুব ছেলেবেলা থেকে। তারপর ধীরে ধীরে কখন যে সকলের অজ্ঞাতে হঠাৎ বড়ো হয়ে উঠেছে সুর্মা তা রতন লক্ষ করেনি।
ও-সব অত লক্ষ করেও না রতন। এই পাড়ায় মানুষ, জন্মে থেকে অনেক কিছু দেখেছে অনেক কিছু শিখেছে, তা সবই গা-সওয়া হয়ে গেছে। কার বয়েস বাড়ল, কার বয়স ছাড়ল—এসব খোঁজই রাখে না।
তবু হঠাৎ একদিন তার মনটা কেমন যেন আনচান করে উঠল। সুর্মার চোখে, সুর্মার হাসিতে, এমনকী তার গলার স্বরেও কী যেন একটা নতুন নতুন ঠেকল। রতন যাকে রোজ দেখে, ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে, এ যেন সেই সুর্মা নয়। অন্য কেউ।
গান শেখাতে শেখাতে এক-এক সময় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে রতন। কী যেন ভাবে। আর তা দেখে মুচকি হাসে সুর্মা।
এমনিভাবেই চলছিল। বিপত্তারিণীর যে চোখে পড়েনি তা নয়! কিন্তু এমন ধারায় ইয়ারকি ফাজলামিকে কোনও গুরুত্ব দিলে চলে না ওদের। তাই দেখেও দেখেনি।
কিন্তু এমন একটা সাংঘাতিক কথা সুর্মার কাছে শুনতে পাবে, বিপত্তারিণী কোনওদিন কল্পনাও করেনি।
দুম করে একদিন সুর্মা বলে বসল, রতন বলেছে আমাকে বিয়ে করবে।
চোখ কপালে উঠল বিপত্তারিণীর। মোটাসোটা খসখসে চেহারাটা কেঁপে কেঁপে উঠে আরও কুৎসিত দেখাল। নিজের মেদবহুল দু-হাতে চেপে বসে আছে সোনার তাগা, গলায় মোটা বিছেহার, সেগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বিপত্তারিণী বললে, তা এগুলো পরিয়ে দিতে হবে তোকে, তাই না!
ঠাট্টা বুঝে চুপ করে রইল সুর্মা।
বিপত্তারিণী হেসে বললে, তারপর এগুলো বেচে দু-দিন পরে আবার ফিরে আসবি, এই তো!
মেয়ের কথা শুনে তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যেন। বিয়ে করবে সুর্মা? তাও রতনকে?
সুর্মা ধীরে ধীরে বললে, কিছু চাই না তোমার কাছে, ফিরেও আসব না কোনওদিন।
অ, রতন বুঝি বাসা করে নিয়ে যাবে? কথাগুলো বিছুটির মতো ছিটিয়ে দিলে বিপত্তারিণী।
কিন্তু গায়ে মাখল না সুর্মা। বললে, হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখব না আমি। এ পড়াটা আমার বিষ লাগে।
হঠাৎ যেন একটা ঘা খেল বিপত্তারিণী। রাগে জ্বলে উঠল তার সর্বশরীর। বললে, দেখ সুর্মা, নাটক নবেলের মতো কথা বলিসনে, হাড় জ্বলে যায় শুনলে। বলে দপদপ করে পা ফেলে চলে গেল বিপত্তারিণী চায়ের দোকানটির দিকে। অর্থাৎ রতনের মায়ের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে হবে।
কিন্তু রতনের মায়ের কোনও আপত্তি নেই। এমনি বিয়ে তো কতই হয়েছে তাদের পাড়ায়। হবে না কেন? বিয়ের পর কেউ সরে গেছে, ঘরসংসার করছে। আবার কেউ বিয়ে করেও ব্যবসা ছাড়েনি। রতন যদি বিয়ে করে এখান থেকে চলেই যায় তো কী অন্যায় হবে?
সুর্মা দেখতে একটু সুশ্রী ছিমছাম—তাই এত আপত্তি বিপত্তারিণীর, তা বোঝে সবাই।
পর পর দিনকয়েক কান্নাকাটি ঝগড়া-বিবাদ চলল। তারপর একদিন সকলের চোখের সামনে দিয়েই সুর্মা আর রতন চলে গেল।
ও-পাড়া ছেড়ে দিয়ে এসে বাসা করল। গলির মধ্যে নীচের তলায় একখানা ঘর, একেবারে বস্তির গায়ে।
নতুন ঘরসংসার পাতার স্বপ্ন দেখল সুর্মা। রতনের উৎসাহও কম নয়।
রতনের মা এসে জোগাড়-যন্তর করে দিয়ে গেল, উপদেশ দিয়ে গেল একরাশ। কিন্তু ফিরে গিয়ে সাতটা দিন পার হল না। খবর পেয়ে ছুটে গেল রতন। কিন্তু তখন সব শেষ।
চায়ের দোকানটা নিয়ে বিপদে পড়ল রতন। গান শেখাবে, না দোকান দেখবে?
সুর্মা বললে, না। ও পাড়ায় আর গান শেখানো হবে না!
রতন হাসল . ও পাড়ায় না-শেখালে আর কোথাও কাজ পাব কি নাকি? ভদ্দর পাড়ায় অচেনা অজানা লোক রাখবে কেন?
সুর্মা বললে, তবে দোকানটা এদিকে কোথাও তুলে আনো, দোকানের রোজগারে বেশ চলে যাবে।
রতন আপত্তি করলে . চালু দোকান ছেড়ে দিয়ে এদিকে করলে চলবে কিনা কে জানে!চলবে, চলবে। সুর্মার কথাটাই যেন সবচেয়ে বড়ো যুক্তি।
বোঝবার চেষ্টা করল রতন। বললে, ও দোকানটাই চালাই এখন, ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে এদিকে একটা শুরু করা যাবে। এ দোকানটা দাঁড়ালে তখন ও-পাড়ারটা তুলে দেব।
সুর্মার কিন্তু তাতে আপত্তি। যে পাড়াটাকে ও মনে-প্রাণে ঘৃণা করে, যে জীবনকে ছেড়ে চলে এসেছে, তার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্কই রাখতে চায় না।
অনেক ভেবেচিন্তে রতন চলে গেল শেঠদের সেই ছোকরাটির কাছে। গঙ্গাধরকে ও পাড়ায় একদিন রতনই পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বড়োলোকের ছেলে, তিন-তিনটে বাড়ির টাকার শেষ নেই। দু-একটা ভালো খবর-টবর দিলে দু-চার টাকা রতনকে দিত গঙ্গাধর।
বৈঠকখানায় বেরিয়ে এসে রতনকে দেখে গঙ্গাধর প্রথমটা তাই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিল, কোনও নতুন খবর-টবর।
গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবির হাতটা সরিয়ে হাতে রিস্টওয়াচের সোনার চেনটার কড়া লাগাতে লাগাতে গঙ্গাধর প্রশ্ন করলে, কী খবর রতন?
হাত কচলাতে কচলাতে রতন বললে, আজ্ঞে খবর একটা আছে। বিয়ে করেছি।
বিয়ে! তুই। আঁতকে উঠল যেন গঙ্গাধর!
বোকা-বোকা হাসি রতন বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ। ওই যে রাত-বিরেতের মদ বেচত বিপত্তারিণী, তার মেয়ে সুর্মা।
হুঁ বলে চুপ করল গঙ্গাধর। অর্থাৎ আরও কিছু শুনতে চায়।
রতন বললে, তা বউটার জন্যে ও-পাড়া ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। রোজগারপাতি নেই—
তা আমি কী করব? গঙ্গাধর যেন অধৈর্য হয়ে ওঠে।
রতন হাত কচলাতে কচলাতে বলে, কিছু টাকা দিতেন তো একটা চায়ের দোকান করতাম। গঙ্গাধর তাকাল রতনের মুখের দিকে, কী যেন খুঁজল। তারপর ধীরে ধীরে বললে, কোথায়? আজ্ঞে, আমার ওই বাসার সামনেই একটা ঘর আছে খালি, ওইখানেই করব ভাবছি।
কত টাকা লাগবে?
রতন বললে, উপস্থিত একশো টাকা পেলেই—
কথা শেষ করতে দিল না গঙ্গাধর। বললে, ঠিক আছে, কাল গিয়ে ঘরটা দেখে আসব, তারপর—
আজ্ঞে, কখন আসব তাহলে?
বিনয়ে গলে পড়ল রতন। এত সহজে টাকাটা পেয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি সে। তাই মনটা খুশি হয়ে উঠল। এত খুশি হল যে পরের দিন গঙ্গাধরকে দোকানঘরটা দেখিয়ে এনে একেবারে তার একতলার ছোট্ট ঘরখানার সামনে গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ির দরজা খুলে বললে, আজ্ঞে, একটু চা-টা খেয়ে যাবেন না?
তাই চ। নেমে পড়ল গঙ্গাধর।
তারপর সুর্মাকে দেখল। দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। এমন ছিমছাম সুন্দর মেয়েটা এতকাল ও পাড়ায় ছিল অথচ খবরটা দেয়নি রতন? মনে মনে একটু রাগও হল, একটু ঈর্ষাও হয়তো বা।
রতন পরিচয় করিয়ে দিল . ইনি গঙ্গাধরবাবু, টাকা দিচ্ছেন তোমার সেই দোকান করবার।
ইনিই তাহলে টাকাটা দিচ্ছেন? কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল সুর্মা। বললে, আপনাদের মতো লোক থাকতে আমাদের আর ভয় কি বলুন?
না, না। গঙ্গাধর অন্তরঙ্গ স্বরে বলে ওঠে—আমরা থাকতে তোমাদের কোনও ভয় নেই।
ভয় নেই বলল বটে গঙ্গাধর, কিন্তু ভয় যেন বেড়ে গেল সুর্মার।
শেঠেদের এই ছোকরা বাবুটিকে দূর থেকে কয়েকবার দেখেছে সে এর আগে, ও পাড়ার অনেকে দু-একটা রসিকতা করত গঙ্গাধরকে নিয়ে।
কিন্তু সামনাসামনি এই প্রথম দেখল সুর্মা। না, লোকটা ভালোই।
রতনের বন্ধু নিশ্চয়ই তা না-হলে দোকান করার জন্যে এতগুলো টাকা দিয়ে দেয়!
রতন ফিরে আসতেই সুর্মা বললে, বাবুটি লোক ভালো। তোমার বন্ধু বুঝি?
রতন বললে, হ্যাঁ বন্ধু বলতে পারো, অনেকদিনের। তবে খুব বড়োলোক তো। তাই একটু আপনি-আজ্ঞে করি, এই আর কী!
সুর্মা বললে, তা টাকা যখন দিচ্ছেন, দোকানটা ভালো করে চালাতে হবে।
বলে নিজেই উঠে পড়ে লাগে সুর্মা। দোকানঘরের চুনকাম থেকে শুরু করে কাচের গেলাস কেনা পর্যন্ত সব-কিছু নিজে দেখেশুনে করে দেয়।
প্রথম প্রথম নিজেও দোকানের দু-একটা কাজ করছিল, খদ্দেরগুলো বড়ো বেশি খিদে খিদে চোখে তাকায় বলেই পর্দার আড়ালে চলে গেল সুর্মা।
ও যেখানে মানুষ হয়েছে সেখানকার মেয়েরা কারও চোখকে ভয় পায় না। কিন্তু সুর্মা যে সে-জীবনটাকে ভুলে যেতে চায়।
সুর্মা বোধহয় সত্যিকার ভালোবেসে ফেলেছে রতনকে। এমনভাবে ভালোবেসে ফেলেছে যে অতীতের আতঙ্ক দেখলেই ভয় পায়। সব ভুলে গিয়েও নতুন করে ঘরসংসার বাঁধতে চায়। সুখী হতে চায় শুধু রতনকে নিয়ে।
চায়ের দোকানটায় লাভ কিন্তু তেমন হয় না। একটু একটু করে ধারের অঙ্ক বেড়ে ওঠে আর একটু একটু করে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে গঙ্গাধর।
মাঝেমাঝেই আসে সে রতনের বাড়িতে। আর সুর্মাও বেশ বুঝতে পারে কার টানে ছুটে আসে গঙ্গাধর। দোকানের ভালোমন্দ নিয়ে সুর্মার সঙ্গে রতনের সঙ্গে এমনভাবে আলোচনায় মেতে ওঠে গঙ্গাধর, যেমন তারই দোকান, যেন লাভ-লোকসানের ওপর তার ভবিষ্যতও নির্ভর করছে। প্রথমে প্রথমে কোনও সন্দেহ হয়নি সুর্মার! রতনের বন্ধু, টাকা ধার দিয়ে রতনকে দোকান করে দিয়েছে, ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আর ভয় সত্যিই কাউকে পায় না সুর্মা। নিজের ভালোমন্দ নিজেই বোঝে। বিরক্ত হলেও যার দিকে তাকায় তার সাধ্য নেই ফিরে তাকাবার। আসল ভয় রতনকে। কখন কী ভুল বোঝে।
সুর্মা জানে, ও ও-পাড়ার মেয়ে। ওর মা সারাজীবন ব্যবসা করছে।
ছেলেবেলা থেকে সকলকেই ব্যবসা করতেই দেখেছে ও। তাই ওর সবসময়ে ভয়, রতন না ওকে ভুল বোঝে, ওকে অবিশ্বাস করে। ভুল বোঝা অসম্ভব নয়, অবিশ্বাস করারই কথা। তবু সুর্মা যে অন্য ধরনের, অন্য জাতের মেয়ে তা রতন বুঝবে কী করে!
এদিকে ঘন ঘন যাতায়াতের ফাঁকে গঙ্গাধর যেন কেমন-কেমন চোখে তাকায় তার দিকে। যেন ইশারায় ইঙ্গিতে কী বলতে চায়।
এক-এক সময় রাগ হয় সুর্মার। ইচ্ছে হয় তার মুখের সামনে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে। পারে না। কেমন একটা সঙ্কোচ।
দু-একদিন ভেবেছে রতনকে বলবে, তোমার বন্ধু লোক ভালো নয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত বলতে পারেনি। কী জানি, যদি রতন তারই দোষ দেখে। যদি ভাবে, ও-পাড়ার মেয়ে, তার আবার এত সতী-সতী ভাব কেন!
অনেক ভেবেচিন্তে শেষপর্যন্ত আর বলতে সাহস পায়নি। আর বলেনি যে, ভালোই করেছে।
চায়ের দোকানটা আর চলে না। রেখে লাভ নেই। শুধু ধারের অঙ্কই বেড়ে চলেছে। আর যতই ধার বাড়ে ততই গঙ্গাধরকে ভয় পায় সুর্মা।
রতনকে বলে, ও দোকান তুলে দাও তোমার। অন্য কিছু চেষ্টা করো।
হাসে রতন। অনেক কিছু স্বপ্ন দেখেছিল। সুর্মাকে নিয়ে বাঁধবে ভেবেছিল।
এদিকে একটা ছেলে আসছে সুর্মার কোলে। কিন্তু সুর্মার চেহারায় সে জলুস নেই। চোখ দুটো যেন বসে যাচ্ছে ক্রমশ। রক্তশূন্য ফ্যাকাসে চেহারা হয়ে গেছে তার।
সবই দেখতে পায় রতন। দেখেও কিছু করবার নেই।
বলে, ও পাড়াতেই ফিরে যাও সুর্মা, তোমার মায়ের কাছে।
ত্রুদ্ধ চোখ তুলে তাকায় সুর্মা। যেন সম্ভব হলেই দৃষ্টি দিয়ে পুড়িয়ে ফেলত সে রতনকে। তিল তিল করে যদি না-খেয়ে মরতেও হয় তবু ও পাড়ায় ফিরে যাবে না সুর্মা। ওদের হাসি ঠাট্টা, বিপত্তারিণীর শ্লেষ সহ্য করতে পারবে না বলেই কিনা কে জানে! হয়তো তা নয়। ওই জীবনটাই পছন্দ নয় তার। ওই জীবনের চেয়ে মৃত্যু ভালো।
নতুন বাসাটায় উঠে এসে সেই সত্যটা যেন নতুন করে চোখে পড়েছে তার! আশেপাশের পাঁচটা বাড়ির বউ-ঝিদের সঙ্গে দেখা হয়, গল্প করে। দুপুরে দু-একজন বেড়াতে যাবার জন্য ডাকে।
নানান উপদেশ দেয় তারা। এ সময় কী খাওয়া উচিত, কোনটা উচিত নয়। তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে এক-এক সময় সুর্মা ভুলে যায় যে, সে এ পাড়ার লোক নয়, অন্য পাড়ার। ভুলে যায় যে এত অন্তরঙ্গতা, এত হাসিঠাট্টা সব বন্ধ হয়ে যাবে একমুহূর্তে, যদি কেউ জানতে পারে এ জীবনের অধিকার নিয়ে সে জন্মায়নি!
এখানে যেন অনেক বেশি আনন্দ, অনেক বেশি মর্যাদা। তাই এই জীবনটার ওপর এতখানি লোভ তার। তাই ফিরে যেতে বললেই চটে যায় সুর্মা।
বলে, না-খেয়ে মরব, তবু—
হাসে রতন। দুর্বল অসহায় মানুষের মতো হাসে।
কী করবে বেচারি! সুর্মা বোঝে দোষ রতনের নয়। দোষ ভাগ্যের। যে ভাগ্য নিয়ে এসেছিল ও, সে পথ থেকে সরে আসতে গিয়েই তো এমন অবস্থা।
গঙ্গাধর আসে। বলে, অন্য কিছু ব্যবসা শুরু করো রতন। কথার সঙ্গে একটু ইশারাও ছুঁড়ে দেয়।
জোড় হাত করে রতন। বলে, ও কথাটা বলবেন না আজ্ঞে, সুর্মা ও-লাইনে যেতে দেবে না।
কিন্তু কোন লাইনে যে যাবে তা ঠিক করতে পারে না রতন। দিনকয়েক একটা ছাপাখানায় কাজ পায়। তারপর আবার বেকার। এটা-ওটা ব্যাবসা করার চেষ্টা করে।
এমনিভাবে দিনের পর দিন বছরের পর বছর কেটে চলে। এদিকে দু-দুটো ছেলে হয়েছে সুর্মার।
চেঁচায় আর কাঁদে ছেলে দুটো। খিদের জ্বালায়।
সুর্মার চেহারাও একেবারে শুকিয়ে কালি হয়ে গেছে। মেয়েছেলে বলে মনেই হয় না।
গঙ্গাধর মাঝে মাঝে আসে। খোলাখুলিই বলে, আমার কাছে থাকো তো বলো সুর্মা, সব ব্যবস্থা করে দেব। বিরক্ত হয়, ভয় পায় সুর্মা। কিন্তু রাগে না। রাগবার মতো শক্তিটুকুও যেন নেই তার!
হাঁপাতে হাঁপাতে কোনও রকমে বলে, আপনি আসবেন না আর, আসবেন না এখানে।
তবু রতনকে কিছু বলতে পারে না সুর্মা। বলতে পারে না, তোমার বন্ধুটিকে আসতে বারণ করো।
বললেও বারণ করতে কি পারত রতন? সে সাহস কোথায় তার, সোজা হয়ে দাঁড়াবার জোর কোথায় শরীরে?
রতনের নিজেরই মাঝে মাঝে মনে হয়, সুর্মাকে বিয়ে করে তাকে ও পাড়া থেকে নিয়ে এসে ভুল করেছে সে। তা না-হলে হয়তো গঙ্গাধরের মতোই কারও কাছে থাকতে পেত সুর্মা, কিংবা তার মা বিপত্তারিণীই সব বিপদ তাড়াত।
ক্রমশই যেন ভেঙে মুষড়ে পড়ে রতন। সুর্মা তবু মনে জোর আনতে চায়। রতনকে খুশি করার জন্যে এক-একদিন পুরোনো হারমোনিয়ামটা টেনে এনে গান গাইতে বলে।
গান গায় রতন। কিন্তু সে গলা নেই। তবু সেই পুরোনো দিনের রেশটা মনে পড়ে যায়। মুগ্ধ হয়ে শোনে সুর্মা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্বপ্নে-ঘেরা মধুর দিনগুলো—যখন গান শেখাত রতন আর শিখত সুর্মা।
এমনিভাবে চলছিল দিনগুলো।
তারপর হঠাৎ একদিন ফিরল না রতন।
অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল সুর্মা। ভাবল, কোথাও কোনও কাজে আটকে পড়েছে। হয়তো কাজ পেয়েছে কোনও।
সে-রাতটা আশায় আশায় কাটল। কিন্তু পরের দিনও ফিরল না রতন। পরের পরের দিনও। এমনি করে আশায় আশায় রতনের পথ চেয়ে দিনের পর দিন কেটে গেল। রতন আর ফিরল না।
কেউ ভাবলে, গাড়িচাপা পড়ে মারা গেছে। কেউ ভাবলে, বউকে ফেলে পালিয়েছে।
ও-পাড়ায় বিপত্তারিণীর কাছেও কী করে যেন খবর পৌঁছে গেল।
ও-মেয়ের আর মুখ দেখবে না ভেবেছিল সে, তবু মেয়ের বিপদের কথা শুনে এল দেখা করতে।
বললে, ফিরে চ সুর্মো।
সুর্মা হাসল। চলে যাওয়ার হলে অনেক আগেই যেতাম। তুমি ফিরে যাও। আমি না-খেয়ে মরব, তবু—সেই এক প্রতিজ্ঞা।
উপায় না-দেখে গালাগালি দিতে দিতে চলে গেল বিপত্তারিণী।
বিপত্তারিণী যেতে না-যেতে বিপদ নিজেই এসে হাজির হল।
গঙ্গাধর এসে বলল, আমার কাছে থাকবে তো চলো সুর্মা, রতন আর ফিরবে না।
হাসল সুর্মা। বললে, আপনার বাড়িটা তো চিনি। যাওয়ার হলে আমি নিজেই গিয়ে হাজির হব। বলে গঙ্গাধরকে বিদেয় করে দিল সুর্মা।
কিন্তু শেষপর্যন্ত আর পারল না সে। হঠাৎ একদিন সকালে উঠে দেখল ছোটো ছেলেটা নড়ছে না। বুকে হাত দিয়ে টের পেল না কিছু।
তারপর হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল সুর্মা। বুঝতে পারল ছেলে আর নড়বে না। না-খেয়ে আর আধপেটা খেয়ে মরে গেছে ছেলেটা।
মরে গেছে?
চোখ মুছল সুর্মা। তারপর বড়ো ছেলেটাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল একবারে গঙ্গাধরের বৈঠকখানায়।
ঠিক তেমনিভাবে একদিন রতন এসে দাঁড়িয়েছিল। আর এমনিভাবেই ঘড়িটা চেনটা হাতে বাঁধতে বাঁধতে এসে দাঁড়িয়েছিল গঙ্গাধর।
সুর্মাকে দেখে সপ্রশ্ন চোখে তাকাল গঙ্গাধর। ঠিক এমনটি যেন কোনওদিন আশা করতে পারেনি।
সুর্মা হাসল ম্লানভাবে। বললে, এলাম।
খুশি হয়ে উঠল গঙ্গাধর। এ মেয়েটা একদিন তার মনে নেশা ধরিয়েছিল। তখন রূপ ছিল সুর্মার। কিন্তু রূপ হারিয়েও দারিদ্র্যের মধ্যেও মেয়েটা কীসের জোরে সব লোভ জয় করেছিল ভেবে পায় না গঙ্গাধর। যে বার বার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, তার রূপ নেই আজ, তবু তাকেই মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয় না।
সুর্মা বললে, আমাকে নয়, আমার ছেলেকে বাঁচান।
সুর্মাকে আশ্রয় দিল গঙ্গাধর। দিল যা কিছু চাইতে পারে সুর্মা, যা কিছু বাসনা।
এতদিন শুধু ভালোবাসার স্বপ্ন দেখেছিল সুর্মা। এবার দেখতে পেল ঐশ্বর্যের সুখ।
এমনি করেই বছরের পর বছর কেটে গেল। চেহারা বদলে গেল সুর্মার। বিলাসে, বৈভবে সারা দেহে তার নতুন করে যৌবন এল যেন। আর সেই যৌবনকে বিকশিত করে তুলল গঙ্গাধরের ঐশ্বর্য। জড়োয়া গহনায় বহুমূল্য বসন-ভূষণে অপ্সরীর রূপ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে একদিন থমকে দাঁড়াল সুর্মা।
কে? রতন?
রতন কিন্তু তখনও যেন চিনতে পারছে না সুর্মাকে। এই তার সুর্মা? এমন রূপ তার?
অথচ রতনের চেহারা শীর্ণ ভিক্ষুকের মতো। নোংরা শতচ্ছিন্ন কাপড়। একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি উশকোখুশকো চুল, চোখ দুটো পাগলের মতো ঘোলাটে।
রতন চাপা গলায় বললে, হ্যাঁ সুর্মা।
নিজের ঘরে নিয়ে গেল সে রতনকে, বললে—এসো, আমার ঘরে এসো।
সুর্মার ঘরে ঢুকল রতন, সঙ্কোচের সঙ্গে। তাকাল চারপাশের দেয়ালের ছবিগুলোর দিকে, দামি দামি আসবাবপত্রের দিকে।
বললে, সুর্মা, এ-সব তোমার? এ-সব?
হ্যাঁ। বিষণ্ণ হাসল সুর্মা।
রতন ধীরে ধীরে বলল, আমি সব দেখেছি সুর্মা, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি।
সুর্মা প্রশ্ন করে, কিন্তু কোথায় ছিলে তুমি এতদিন? কেন ফেলে গিয়েছিলে আমাকে?
চুপ করে থাকে রতন, দু-চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। বলে, তোমার জন্যেই গিয়েছিলাম সুর্মা, ভেবেছিলাম যেমন করেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তারপর এসে নিয়ে যাব তোমাকে—
সুর্মার চোখ দুটোও চিকচিক করে উঠল।
বললে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে না কেন?
অনেক কষ্ট, সে অনেক দুঃখ সুর্মা। কিন্তু পারলাম না, এত চেষ্টা করেও পারলাম না। কান্নায় ভেঙে পড়ে রতন।
হঠাৎ রতনের পিঠে হাত রাখল সুর্মা। বললে, ভেঙে পোড়ো না। শোনো—
মুখ তুলে তাকাল রতন। বললে, চলে যাবার আগে একবার ছেলেটাকে দেখে যেতে চাই সুর্মা। দেখাবে? ম্লান হাসি হাসল সুর্মা। সায় দিয়ে ঘাড় নাড়ল। তারপর বললে, শোনো চলো, আমাকে নিয়ে চলো। আবার জীবন শুরু করব আমরা, নতুন করে চেষ্টা করবে নিজের পায়ে দাঁড়াবার।
যাবে, যাবে সুর্মা? কথাটা যেন বিশ্বাস হয় না রতনের। এমন নির্ঝঞ্ঝাট, এমন আরামের জীবন ছেড়ে সত্যিই যাবে সুর্মা।
হ্যাঁ যাব। যাব আমি।
উঠে দাঁড়ায় সুর্মা। তারপর দ্রুতপায়ে ভিতরে চলে যায়। বোসো তুমি। এখনই যাব, যাব তোমার সঙ্গে। বিস্মিত হয় রতন। মনে মনে খুশি হয়। এত ভালোবাসা? এত গভীর টান তার ওপর?
না, রতন আবার দাঁড়াবে, আবার—
সুর্মার এত টাকা, এত অলঙ্কার, এই মূলধন নিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করবে সে, জীবন শুরু করবে। সুখি হবে। নানা কল্পনায় রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে রতন। আনন্দে ফুরফুর করে ওঠে তার মন।
চলো।
সুর্মার কথায় চমকে চোখ তোলে রতন। ছেলের হাত ধরে এসে দাঁড়িয়েছে সুর্মা।
দুহাত বাড়িয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নেয় রতন, কিন্তু পরমুহূর্ত্তেই সুর্মার দিকে স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে চমকে ওঠে। এ কী! সমস্ত গহনা খুলে ফেলেছে সুর্মা, পোশাক বদলে এসেছে। একখানা সাদাসিধে শাড়ি আর দুহাতে শাঁখা।
সুর্মা আবার বললে, চলো।
বিস্মিত হল রতন। কিন্তু তোমার গায়ের গয়নাগুলো কী হল সুর্মা? তোমার জিনিসপত্তর?
হাসল সুর্মা, দুঃখ-কষ্টকে তো আমি ভয় পাই না। যত দুঃখই পাই, যত কষ্ট হোক, তোমার সঙ্গেই চলেছি, এই তো সবচেয়ে বড়ো সুখ।
কিন্তু-কিন্তু সুর্মা, তোমার টাকা, তোমার গয়না এসব না দিলে কী নিয়ে ব্যবসা করব, কী করে দাঁড়াব আবার?
হঠাৎ যেন চিৎকার করে উঠল সুর্মা। বললে, না না, যে আমাকে সব দিয়েছে, তাকে তো কিছুই দিইনি আমি। কি দিয়েছি? না, না, তার দেওয়া কোনও কিছুই আমি নিয়ে যেতে পারব না—পারব না।
পারবে না? কেমন যেন বিরক্ত হল রতন।
অট্টহাসি হেসে উঠল সুর্মা। না পারব না। যে আমাকে বিশ্বাস করে সব দিয়েছে, আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছে, তার দেওয়া একটা কানাকড়িও আমি নিতে পারব না।
রতন স্তম্ভিত বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সুর্মার মুখের দিকে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন