শৈলেন্দ্র হালদার
তার নাম বুধবার।
আর ছ-টা দিন যার যা যাদের, সকলেরই সে বুধবার। …সেই বাড়িটাতে যতগুলি ছোটো ছোটো কুতূহলী কৌতুকপ্রিয় চপলা আনন্দ-মঞ্জরী রূপের পসরা লইয়া বাস করে তারাও চোখ ঠারিয়া আঙুল তুলিয়া বলে—ওই বুধবার।…
কেবল ভৃত্যটির মুখে শোনা যায় বুধবারের সঙ্গে বাবু বিশেষণটি।
বাবু।…
অত্যুক্ত শব্দের অযোগ্য ব্যবহার আর বেশি হইতে পারে না—যেমন হইয়াছে ওই বাবুর প্রয়োগে।
যাহার সংশ্রব হেতু ওই নামটির উদ্ভব হইয়াছে তাহারও সে বুধবার।
ওই একটি দিন…
তার আর কোনো নাম সেখানকার কেউ জানে না। এই বাড়ির বাহিরে সে যে নামেই পরিচিত থাক, মঙ্গলের উষায় তার নিজের কাছটিতেও সে ওই পাওয়া নামটিতেই সত্য হইয়া উঠে।…
ওই একটি দিনের সে আনন্দরাজ।—
মঙ্গলের নিশীথে অনাগতার পদধবনি আকাশে আকাশে বেশি করিয়া বাজে, অভিসারিণীর অঞ্চলগন্ধ বাতাসে বাতাসে বেশি করিয়া নিবিড় হইয়া ওঠে……
রাত্রি প্রভাতে স্বপ্ন ভাঙিয়াই তার সর্বান্তঃকরণ আচ্ছন্ন হইয়া মনে পড়ে, আজ যে বুধবার।—চন্দ্রোদয়ের মতো ধীরে ধীরে দিগন্ত রাঙাইয়া সে মনে পড়ার উদয় হয় না , বিদ্যুতের খরতীব্র আলোকের মতো সে-স্মৃতি ঝলকিয়া উঠে।—
বুধবারটির সে একচ্ছত্র সম্রাট।—
ওই দিনটির উপর আর কাহারো দাবি নাই, তাহার অধিকারের প্রতিপক্ষ নাই, আবার প্রভাত না আসা পর্যন্ত তাহার যৌবন ক্ষিপ্ত অশ্বের মতো ছুটিবে আর ছুটিবে।…
আর ছ-টি দিন সে বন্দী—
নিজেরই সৃষ্ট বন্ধন-পীড়া সহিয়া এক একবার ক্ষণেকের জন্য অসহ্য হইয়া বিদ্রোহী সে শৃঙ্খল ছিঁড়িতে যায়, পেশির বর্তুলগুলি কঠিন হইয়া ওঠে…
কিন্তু তা হবার নয়।
আর ছ-টা দিন কুম্ভকারের চক্রের মতো এক নিশ্বাসে চক্ষের নিমেষে ঘুরিয়া বুধের সন্ধ্যায় সে চক্র কেন বিশ্রাম লয় না!… দীর্ঘ, অফুরন্ত, নিশ্চল—একেবারে অবরুদ্ধ গতি চিরবিশ্রাম!—উদয়াচল উত্তীর্ণ হইয়া দিনকর অন্তসাগরের গর্ভে যদি চিরতরে নিশ্চিহ্ন হইয়া ডুবিয়া যায় তবেই তার বুধবার অক্ষয় হইয়া ওই একটি দিনের সিংহাসন তার চিরদিনের মতো আপনার হইতে পারে,—তবেই এই নিষ্ঠুর বাঁধন-শিকল জীবনের মতো খুলিয়া পড়ে।…
বুধবারটিকে যদি বাঁধিতে পারা যায়!…
বাঁধিবার কত কৌশলই না তার পাগলা খেয়ালে আসে , তার সবগুলিই যেমন অদ্ভুত তেমনি সতেজ।…
ভাবিতে ভাবিতে মন নীল হইয়া ওঠে—
বুক ফাটিতে চায়—
রক্ত-মাংস-মেদ-মজ্জা একত্রে মথিত হইয়া যেন হলাহল উদগিরীত ফেনায়িত হইতে থাকে।…
বুধবারের আগে তার পা বাড়াইবার জো নাই—এমনি কঠিন শাসন। …সাপ যেমন পাকে পাকে জড়াইয়া বাঁধন কসিয়া কসিয়া হৃদপিণ্ড চৌচির করিয়া রক্ত-বমি করাইয়া ছাড়ে, তেমনি আচরণ করে বুধবার ছাড়া বাকি ছ-টা দিন—
তাদের কঠিন নিপীড়নে প্রাণ তার ঝলকে ঝলকে রক্ত-বমন করিতে থাকে।
চুম্বকশলাকার মতো এক লক্ষ্যে শুধু দিনান্তের দিকে চাহিয়া সে শ্বাস টানে—
আর কোনো অবলম্বন, নিজেকে ভুলাইবার ছল তার নাই—
শুধু চাই তার সূর্যাস্ত।…
আকাশে মেঘ করে।—
অকাল অন্ধকারে ধরণী ডুবিয়া যায়—
জল নামে , অন্তহীন তার ধারা , মৃদঙ্গের গভীর ধবনি বাজিয়া চলে—
তালে তালে কাঁপে অন্তহীন নিরবচ্ছিন্ন জল-তরঙ্গের গান।… আকাশের বায়ু, পৃথিবীর মাটি শীতল হইয়া যায়—
তার অন্তর-আকাশে দ্বাদশ সূর্য জ্বলিয়া ওঠে,—মনে হয়, প্রজ্বলিত অগ্নি আর উত্তপ্ত অঙ্গার ছাড়া ব্রহ্মাণ্ডে আর কিছু নাই—
ধরিত্রী তৃষ্ণায় পুড়িয়া শুষ্ক-বুকে উপুড় হইয়া লুকাইয়া পড়িয়াছে , বুঝি তার সংজ্ঞা নাই।…
মেঘ কাটিয়া যায়, জ্যোৎস্না ফোটে, ফুরফুরে হাওয়া ছাড়ে, পথিক বিরহের গান গাইয়া যায়, দিকে দিকে সুর-কুহরণ ভাসিতে থাকে—
কিন্তু এ-সবে ফোঁটায় ফোঁটায় মধু ক্ষরিত হইয়া সরস হয় শুধু তাহারই বুক, অতৃপ্তির অগ্নিদাহে নিঃশেষে শুকাইয়া যাহার প্রাণ মরু হইয়া যায় নাই।…
এ-দেহে কত রক্ত আছে তার হিসাব নাই—
প্রত্যেক কণিকা তার রোমকূপ-পথে অসংখ্য লোলুপ জিহ্বা বাহির করিয়া অনুক্ষণ যাহার অঙ্গের স্পর্শ চাহিতেছে সে কাছে নাই।, ছ-টি দিনের মুহূর্ত গণিয়া দিন বড়ো কষ্টে কাটে…
ছ-দিনের সেই দিনটির সবগুলি মুহূর্তে একটি ক্ষিপ্ত মুহূর্তের মতো না আসিতেই নিরুদ্দেশে বাহির হইয়া যায়। উত্তপ্ত নিশ্বাস ছাড়িয়া সে উত্তপ্ত শয্যার উপর উঠিয়া বসে।
ওই জাগরণক্লান্ত সুষুপ্তা রমণীর সাতটি দিনের একটি দিন সে মূল্য দিয়া কিনিয়া লইয়াছে।… রমণী নিদ্রিতা—
কিন্তু তার ওই অলস এলায়িত অসম্বৃত দেহ, ওই যৌবন, বক্ষ, ওই অধর, ওই চক্ষু, যেন দুনিয়ার পুরুষকে পিপাসিত-কণ্ঠে কেবলি ডাকিতেছে—এসো, এসো।—
পৃথিবীর বুকের উপর দিয়া রমণীর সেই আকুল আহ্বান, নিজেরই দিকে অদৃশ্য সেই কুহক ইঙ্গিত, সুধার শীকরের মতো, অশ্রান্ত বহিয়া চলিয়াছে…
সে-ডাক শুনিয়াছে কেবল সে।—
শয্যাপ্রান্তে, দুয়ারে, সোপানে, রাজপথে,—আরো দূরে, আরো দূরে,—গৃহে , জাগরণে, স্বপ্নে, মৃত্তিকায়, শূন্যে, গ্রহলোকে—ওই একটি রমণীর আহ্বান নিরন্তর ধবনিত হইতেছে তাহারই চিরসঙ্গী হইয়া… ধনুকের জ্যা-র মতো সারা প্রাণ অসহ্য উল্লাসে অনুক্ষণ ঝম ঝম শব্দে টঙ্কার দেয় সেই ধবনিরই কম্পনে।…
এ-যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।—এক নিমেষের মিলন, তারপর দীর্ঘবিরহ।…
অন্তরের বহ্নি তার চক্ষুর দুয়ারে ধক ধক করে।—
শনিবারের রাত্রে সে অসুখে পড়িল।
রোগের যন্ত্রণা ছাপাইয়া এক দুশ্চিন্তাই প্রবল হইয়া উঠিল, সমুখের বুধবারটা বুঝি ফাঁকি দেবে।… রোগশয্যা কন্টকশয্যা হইয়া উঠিল। হৃদপিণ্ড অবিশ্রান্ত ধুক ধুক করিয়া জীবনপ্রবাহের মাত্রা মাপিতেছে , সে ফাঁকি দিয়া একেবারে থামিয়া যায় যাক—
কিন্তু বুধবারের সন্ধ্যা যেন ফাঁকি না দেয়।
লীলা, লীলা, লীলা।
কণ্ঠ শুকাইয়া বারবার কাঠ হইয়া গিয়াছে জিব নাড়িয়া ওই নামটি জপ করিতে করিতে। …ব্যাধির দাহ জুড়াইয়া যাইবে যদি তুমি একবার কাছে আস।….. তোমার ললিত কুসুমিত তনুলতা, তোমার অতল তরল চক্ষু দুটি, তোমার মৃণাল-বাহু, তোমার চিবুক, তোমার ললাট, তোমার অধর, তোমার বক্ষ, তোমার যৌবন—
একটিবার তাদের দিকে চোখ তুলিতেই আমি ব্যাধিমুক্ত হইব , এসো, একবার এসো, দেখা দিয়া যাও।…
কিন্তু এ-অন্তরের ডাক সুদূরবর্তিনীর অন্তরে পৌঁছিল না।—
রূপ দিয়া লীলা তাহাকে কিনিয়াছে, সে কিনিয়াছে অর্থ দিয়া তার বুধবারটিকে।…
বুধবারের সন্ধ্যায় সে চোখ খুলিল।—
আজ কী বার?
বুধবার।
এখন সকাল, দুপুর না সন্ধ্যা?
সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা?
চমকিয়া সে উঠিয়া বসিল।
তার রক্তবর্ণ চক্ষুর ও-দিকে মাথার ভিতর মাথা ফাটাইয়া রক্তা ফুটিতেছিল।
বুধবারের সন্ধ্যা!
তার বিক্ষুব্ধ মস্তিষ্ক এক-মুহূর্তেই স্বচ্ছ শান্ত পরিষ্কার হইয়া গেল—যেমন ঝটিকার পর নদী হয়।…
সে বাহিরে আসিল।—
রাজপথ আলোকিত—সুমুখের দিকে চোখ তুলিয়া সে চলিতে শুরু করিল।…
চলিতে চলিতে দেহের উত্তেজিত শিরাজাল ধীরে ধীরে শিথিল অবশ হইয়া আসিতে লাগিল , উত্তপ্ত বালুকার উপর বায়ু যেমন গতিশীল সর্পিল হইয়া কাঁপে, তার চোখের সম্মুখের সচল অচল বস্তুগুলি ঠিক তেমনি করিয়া কাঁপিতে লাগিল…
পায়ে পায়ে জড়াইয়া আসে—
মাথা বুকের উপর ঝুঁকিয়া নামে—
সর্বশরীরের উপর দৌর্বল্যের সঙ্গে যুঝিতে যুঝিতে যখন সে লীলার বাহিরের দরজায় আসিল তখন তাহার চরম পিপাসায় ক্ষিপ্ত আত্মার জাগরণ-ক্লান্তি সহ্য-শক্তির শেষ সীমায় আসিয়া থর থর করিতেছে।…
লীলা?
প্রাণান্তকর প্রয়াসে আহ্বানটি কণ্ঠমূল পর্যন্ত ছুটিয়া আসিয়া নিজেরই দুর্বলতার ভারে নিশ্চল হইয়া রহিল।—
উন্মুখ অনুচ্চারিত শব্দটি ছটফট করিতে করিতে বুকের ভিতর ঠেলিয়া যাইয়া সেইখানেই আবর্তিত হইয়া তাহার নিশ্বাস-বায়ু চাপিয়া ধরিল।…
ভিতরে দেড়প্রহর রাত্রে তখন বিকৃত-কণ্ঠের হাসির শব্দে আকাশ ফাটিতেছিল।—
অনেক রাত্রে বাহির হইতে আসিয়া যে-ব্যক্তি খবর দিল সে বুধবারকে চিনিত না। বলিল,—একটা লোক পড়ে আছে মুখ গুঁজে, লীলা, তোরই দরজায়।
লীলার কী খেয়াল হল।
চল দেখে আসি কে, একটা নতুন রকম হবে। বলিয়া সে পরনের কাপড় গুছাইয়া লইয়া প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইল!—
দরকার বোধ করিলে লোকটাকে সরাইয়া দিতে হবে।
মিছিল বাঁধিয়া চারপাঁচজনে কলরব করিতে করিতে তামাসা দেখিতে চলিল—
লীলা চঞ্চলচরণে সকলের আগে।
লণ্ঠনের আলো মূর্ছিত লোকটার মুখের উপর ফেলিয়াই লীলা মুখ ফিরাইয়া উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল , বলিল,—’আমারই বুধবার! থাক পড়ে। চল।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন