নরক – প্রফুল্ল রায়

দুপুরবেলা নেকীপুর টৌন বা টাউন থেকে সাগিয়া যখন বেরিয়ে পড়েছিল, আকাশের গায়ে দু-এক টুকরো নিরীহ ভবঘুরে মেঘ এলোমেলো ভেসে বেড়াচ্ছে। চারপাশের নরম মায়াবী রোদের তখন ছড়াছড়ি।

ভাদ্রমাস শেষ হয়ে এল। গোটা বর্ষার জলে ধুয়ে ধুয়ে আজকাল আকাশ আশ্চর্য নীল হয়ে উঠেছে। মনে হয়, মাথার ওপর কে দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত পর্যন্ত অলৌকিক একখানা আরসি আটকে রেখেছে। একটু আধটু কালচে মেঘ যে রোজ চোখে না পড়ে, এমন নয়। কিন্তু সেগুলো ঘন হতে না হতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়।

সেদিক থেকে আজকের দিনটা একেবারে আলাদা। দুপুরের সেই মেঘের টুকরোগুলো হাওয়ায় তো উড়ে গেলই না, বরং এক কোণে জমাট বাঁধতে লাগল, শুধু তাই না, দিগন্তের তলা থেকে নিরেট পাথরের চাংড়ের মতো আরো অজস্র মেঘ দ্রুত উঠে এসে ভাদ্রের উজ্জ্বল নীলাকাশকে ক্রমশ ঢেকে ফেলতে শুরু করল।

সাগিয়া আসছে নেকীপুর টৌন থেকে, যাবে আরেক টৌন জনকপুরে। নেকীপুর থেকে খাড়া দক্ষিণে সে সরু পাকা সড়ক অর্থাৎ পাক্কীটা চলে গেছে সেটা ধরে মাইল চারেক হাঁটলে নৌহার নদীর পারঘাটা। নৌহর বিখ্যাত কোশী নদীর মূল ধারা থেকে বেরিয়ে অনেকটা ঘুরপথে আবার কোশীতেই গিয়ে মিশেছে। খেয়া নৌকায় নদী পেরিয়ে ওপারে নামলে ফের পাকা সড়ক। সেখান থেকে সাইকেল রিকশায় মাইল সাতেক গেল জনকপুর।

কিন্তু জনকপুর টৌন অনেক দূরের কথা, নেকীপুর থেকে বেরিয়ে মাইল দুই যেতে না যেতেই সাগিয়া টের পায়, দিনের আলো দ্রুত নিভে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে একবার মুখ তুলে তাকায় সে। কোথাও নীলাকাশের চিহ্নটুকু নেই। ভারী ঘন কালো মেঘের স্তর ছাড়া মাথার ওপর কিছুই চোখে পড়ে না।

এখনও অনেকটা রাস্তা সাগিয়াকে যেতে হবে। তা ছাড়া মাঝখানে রয়েছে একটা মাঝারি নদী। সে যে নেকীপুরে ফিরে আজকের রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে আবার জনকপুর রওনা হবে, তারও উপায় নেই। কেননা জগনাথজি আজ সকালে তার মজুরি মিটিয়ে দিয়ে সাহারসা চলে গেছে। জগনাথজি ছাড়া নেকীপুরের দু-একজনকে সে যে চেনে না তা নয়, কিন্তু তার মতো জঘন্য মেয়েমানুষকে কেউ ঘরে ঢুকতে দেবে না। কেননা সাগিয়ার মুখ দেখাও পাপ, তার ছায়া মাড়ালে দশ বার নাহানা করে শরীর শুদ্ধ করতে হয়।

একেবারে মরিয়া হয়েই সাগিয়া হাঁটার গতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি, তবে যে-কোনো মুহূর্তে আকাশ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে। সমস্ত চরাচর জুড়ে যা মেঘ জমেছে তাতে একবার শুরু হলে সে দুর্যোগ কবে থামবে, আদৌ থামবে কিনা, কে জানে। তার আগেই তাকে নৌহর নদী পেরিয়ে ওপারে পৌঁছুতেই হবে।

সাগিয়ার দিকে এবার ভালো করে তাকানো যেতে পারে। পৃথিবীর সব চেয়ে ওচা রাণ্ডিটুলি বা বেশ্যাপাড়া যদি কোথাও থাকে, সেটি হল জনকপুরে। সাগিয়া সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা।

তার বয়স তিরিশের কাছাকাছি। কিন্তু এখনও ততটা দেখায় না। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জানোয়ারের পাল সাগিয়ার শরীরটাকে ময়দা ডলার মতো ডলে চলেছে। তারপরও সে একেবারে শেষ হয়ে যায়নি।

লম্বাটে মুখ সাগিয়ার। গায়ের রং মাজা তামার মতো। চোখের তলায় কালির ছোপ পড়েছে ঠিকই, লক্ষ করলে গালে ছিট-ছিট মেচেতাও দেখা যাবে, চেহারায় ফুটে উঠতে শুরু করেছে কর্কশ কাঠিন্য। সবাই ঠিক, তবু রাতের পর রাত কুত্তার পালের কামড়াকামড়ি এবং ধামসানোর পরও সাগিয়ার শরীরে খানিকটা চটক এখনও থেকে গেছে। এর একটা বড়ো কারণ তার প্রায় অটুট স্বাস্থ্য।

সাগিয়ার শরীরে এখনও চর্বি জমতে শুরু করেনি। হাত-পায়ের হাড় বেশ পুরু আর মজবুত। সরু কোমর তার, মাংসল ভরাট বুক, কোমরের তলায় বিশাল অববাহিকা, কণ্ঠার হাড় গজালের মতো ফুঁড়ে বেরোয়নি। ছোটো কপাল, ঘন কালো চুল খুলে দিলে কোমর ছাপিয়ে নেমে যাবে।

এই মুহূর্তে সাগিয়ার পরনে খেলো রঙচঙে সিল্কের শাড়ি আর লাল টকটকে ব্লাউজ। পায়ে কাঁচা চামড়ার সস্তা স্লিপার। দুই হাতে রুপোর কাংনা, কানে ঝুটো পাথর বসানো চাঁদির করণফুল, গলায় চাঁদিরই চওড়া হার, নাকে নাকফুল। চুলগুলো প্রকাণ্ড খোপায় আটকে একটা রুপোর পাত বসানো কাকই বা চিরুনি গুঁজে দেওয়া হয়েছে। হাতের আঙুলে গোটা তিনেক চাঁদির আংটি, পায়ের আঙুলে চুটকি। দুই ভুরুর মাঝখানে উল্কিতে আধখানা চাঁদ, থুতনিতেও উল্কি রয়েছে—সেটা ফণাতোলা ছোটো একটা সাপ।

সাগিয়ার ডান হাতে ঝুলছে ফুললতাপাতা-আঁকা টিনের একটা সুটকেস। সেটার ভেতর রয়েছে কিছু জামা-কাপড়, খোলা স্নো-পাউডার, কজরৌটি (কাজললতা), আলতার শিশি, এমনি সব কাজের জিনিস।

দিন চারেক আগে নেকীপুরে এসেছিল সাগিয়া। জগনাথই লোক পাঠিয়ে তাকে জনকপুর থেকে নিয়ে যায়।

জগনাথ হল ‘লালদাসিয়া’ কায়াথ। বয়স পঞ্চাশের ওপর। কিন্তু এই বয়সেও মেয়েমানুষের জন্য তার শরীরে সারাক্ষণ আগুন জ্বলছে। তার কারণ পার্বতী।

পার্বতী জগনাথের স্ত্রী—অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে-করা বিশুদ্ধ ধর্মপত্নী। কিন্তু এই মেয়েমানুষটির জন্য জগনাথের প্রাণে সুখ-শান্তি বলতে কিছু নেই, তার ‘তনমন’ একেবারে ছারখার হয়ে গেছে। বিয়ের বছরখানেক বাদেই এক দুর্ঘটনায় কোমরের তলার দিকটা পড়ে যায় পার্বতীর। তারপর প্রায় তিরিশ বছর পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে আছে সে। একসময় সুন্দরীই ছিল, কিন্তু একনাগাড়ে বছরের পর বছর ভুগে এবং বিছানায় শুয়ে থেকে শরীরে শাঁস বলতে এখন আর কিছুই নেই। চোখ এক আঙুল ভেতরে ঢুকে গেছে, চুল হেজে হেজে পাটের ফেসো। হাড়ের ওপর শুকনো ঢিলে চামড়া খোলসের মতো আটকে আছে। বুকের ধুকপুকুনিটুকু না থাকলে মনে হতো, সে বেঁচে নেই।

জগনাথ আরো একবার বিয়ে করতে পারত, পারেনি পার্বতীর বাপুজি অর্থাৎ তার শ্বশুরের ভয়ে। শ্বশুর রামধারীজি বিরাট জমিমালিক, প্রচণ্ড দাপট তাঁর। জগনাথ যে জীবনে দাঁড়াতে পেরেছে, সমাজে সে যে একজন পয়সাওলা ‘সরগনা আদমি’ (মান্যগণ্য ব্যক্তি) সেটা রামধারীজির কারণেই। তিনি চোখ লাল করে হাতের আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়েছিলেন, দুসরা শাদি করা চলবে না জগনাথের। মেয়ের ঘরে সৌতিন ঢুকবে, এতে তাঁর প্রচণ্ড আপত্তি।

কাজেই দ্বিতীয় বার বিয়েটা করা হয়ে ওঠেনি জগনাথের। কিন্তু শরীর বলে তো একটা ব্যাপার আছে। রুগ্ন রতিশক্তিহীন গিধের মতো স্ত্রীকে নিয়ে সে কী করবে? ধর্মপত্নীর জন্য তো আমৃত্যু ব্রহ্মচর্য পালন করা যায় না। তাই লুকিয়ে চুরিয়ে ধুরন্ধর বিল্লির মতো তাকে খিদে মেটাতে হয়।

জগমোহন বিরাট কাঠের কারবারি। সাহারসায় তার আসল গদি। বাড়িও সেইখানেই। তবে নেকীপুরেও তার একটা গোলা আছে। এখানকার গোলা চারপাশের যাবতীয় ভালো টিম্বার যোগাড় করে সাহারসায় পাঠায়। সাহারসার গদি থেকে সে-সব চালান যায় বড়ো বড়ো শহরে—পাটনায়, ধানবাদে, কলকাতায়, এমন-কি সুদূর বোম্বাইতেও।

জগনাথ সময় পেলেই নেকীপুরের গোলায় চলে আসে। আসার কারণ দুটো। এখানকার কাজকর্ম তদারক করা আর জনকপুর থেকে সাগিয়াকে আনিয়ে কয়েকটা দিন একটু আনন্দে কাটানো। এতে তার পরমাত্মার শান্তি। অটুট স্বাস্থ্যবতী, চটকদার আওরতটাকে তার খুব মনে ধরেছে। প্রায় বছর দশেক ধরে জগনাথের জন্য বছরে অন্তত সাত-আটবার জনকপুর থেকে নেকীপুরে যাতায়াত করতে হচ্ছে সাগিয়াকে।

সাগিয়া যখন নৌহর পারঘাটায় পৌঁছল, তখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি, তবে মেঘের ভারে আকাশ অনেকখানি নেমে এসেছে। দিগন্তকে এফোঁড় ওফোঁড় করে ছুরির ফলার মতো বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছে। পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড তোলপাড় করে থেকে থেকেই বাজ পড়ছে। সেই সঙ্গে চলছে একটানা মেঘের গর্জন। খোলা নদীর ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া সাঁই সাঁই ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে।

ক-দিন আগে যখন ওপার থেকে এপারে এসে সাগিয়া নেমেছিল, নৌহর তখন আশ্চর্য শান্ত। বর্ষার জলে যদিও সে ভরে ছিল পূর্ণ যুবতীর মতো, কিন্তু এতটুকু অস্থিরতা ছিল না তার। সেই নৌহরকে এখন আর চেনা যায় না। তার নীলাভ জলে সীসার রং ধরেছে, চারিদিক উথাল-পাথাল করে বড়ো বড়ো ঢেউ উঠছে।

আয়োজনটা যেভাবে হয়েছে তাতে উত্তর বিহারের এই অঞ্চল পৃথিবী থেকে একেবারে মুছে যাবে কিনা, কে জানে।

পারঘাটে একটি মাত্র নৌকোই রয়েছে। চেনা নৌকো। এটাই যাত্রী নিয়ে এপার ওপার করে।

মাল্লা নৌকোটা ছাড়তে যাচ্ছিল, সাগিয়াকে দেখতে পেয়ে হেঁকে ওঠে, ‘ওপারে যাবে?’

নদীর চেহারার দিকে তাকিয়ে রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিল সাগিয়া। পলকা খেয়া নৌকোয় ওপারে যাবে কি যাবে না ভাবতে একটু সময় লাগে তার।

মাল্লা তাড়া লাগায়, ‘কা যাওগী? এরপর আর কিন্তু নৌকো পাবে না।’

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবার মতো সময় নেই। ঊর্ধ্বশ্বাসে সাগিয়া নৌকোয় গিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মাল্লা বৈঠার ধাক্কায় নৌকোটাকে পার থেকে দূরে নিয়ে যায়।

নদী এখন প্রবল তোড়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটছে। বিশাল বিশাল ঢেউ তীব্র আক্রোশে সাগিয়াদের নৌকোটাকে মোচার খোলার মতো ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।

মাল্লা লোকটা যেমন দুর্ধর্ষ তেমনি হুঁশিয়ার এবং একজন চতুর যোদ্ধাও। উত্তর বিহারের এই নদী, তার স্রোতের টান সম্পর্কে বিপুল অভিজ্ঞতা তার। এই মুহূর্তে হালের বৈঠাটাকে ঢালের মতো ধরে রেখে দাঁত চেপে সে শুধু ঢেউ কাটিয়ে যাচ্ছে।

সাগিয়া এতক্ষণ লক্ষ করেনি, নিজের অজান্তেই এবার তার চোখ অন্য যাত্রীদের ওপর গিয়ে পড়ে। লোক বেশি না, সবসুদ্ধ জন পাঁচেক। সবাই নৌকার মাঝখানে খোলা পাটাতন আঁকড়ে বসে আছে। ওদের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। তারা জানে না নৌকোটা শেষ পর্যন্ত নৌহর পেরিয়ে ওপারে পৌঁছোতে পারবে কিনা।

যাত্রীদের মধ্যে চারজন নিরীহ চেহারার সাদাসিধে দেহাতি। পঞ্চম যাত্রীটির দিকে তাকিয়ে রীতিমতো অবাকই হয় সাগিয়া। দেখামাত্র বোঝা যায় উঁচু জাতের, বড়ো বংশের মানুষ। বয়স চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ। গায়ের রঙ টকটকে, মসৃণ ত্বক, লম্বাটে ভরাট মুখ, ভাসা ভাসা চোখ, টান টান চেহারা। কাঁধে, গলায় বা চিবুকের তলায় সামান্য মেদ অবশ্য জমেছে। তাঁকে দেখে মনে হয়, অত্যন্ত শুদ্ধ এবং নিষ্পাপ।

এই মুহূর্তে তার পরনে সাদা ধবধবে ধুতি আর পাঞ্জাবি, পায়ে ভারী চপ্পল। সঙ্গে মাঝারি মাপের একটি চামড়ার সুটকেস ছাড়া আর কিছুই নেই।

সাগিয়া নিজে যথেষ্ট ভয় পেয়েছে, কিন্তু ওই মানুষটির আতঙ্কের শেষ নেই। তাঁর চোখের তারা স্থির। ভয়ার্ত মুখ থেকে পরতে পরতে রক্ত নেমে গিয়ে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। শুকনো ঠোঁট দুটো অল্প অল্প নড়ছে তাঁর। অস্পষ্ট কাঁপা গলায় বিড়বিড় করে কিছু বলছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর সাগিয়া চারটি মাত্র শব্দ শুনতে পায়, ‘ভগোয়ান রামচন্দ্রজি, আপহী ভরসা—’ তিনি হয়তো ধরেই নিয়েছেন মেঘের চাপে নুয়ে পড়া আকাশের তলায় নৌহরের প্রচণ্ড জলস্রোতে মৃত্যু অবধারিত।

কড়-কড় শব্দে আকাশটাকে করাতের মতো চিরে দিয়ে কাছাকাছি উদোম নদীর ওপর কোথায় যেন বাজ পড়ে। পলকের জন্য ঝলসে যায় চারপাশ। চমকে সেই ভীত নিষ্পাপ মানুষটির দিক থেকে মুখ ফেরায় সাগিয়া। তার চোখ কিছুক্ষণের জন্য ধাঁধিয়ে যায়।

দেহাতি চারজন ভীরু চাপা গলায় গোঙানির মতো অদ্ভুত সুরে অনবরত আওড়াতে থাকে, ‘হো কিষুণজি, তেরে কিরপা—’ তাদের কণ্ঠনালী থেকে শব্দ বেরুতে না বেরুতেই হাওয়ার ঝাপটা উড়িয়ে নিয়ে যায়।

মাল্লাটা বিপুল পরাক্রমে নদীর সঙ্গে যুঝে যাচ্ছে। তার ধ্যানজ্ঞান এখন একটাই। বৈঠাটাকে জলের ভেতর আড়াআড়ি রেখে যেমন করে হোক কোনাকুনি নৌকোটাকে নদীর ওপারে নিয়ে যাওয়া। সে গলুইর কাছ থেকে সাহস যোগাতে থাকে, ‘ডরো মাত ভেইয়া। বারীষ শুরু হবার আগেই তোমাদের ওপারে পৌঁছে দেব।’

নৌহর খুব একটা বড়ো নদী নয়। কোথাও সেটা আধ মাইলের বেশি চওড়া হবে না।

প্রায় ঘন্টাখানেক একটানা লড়াইয়ের পর নৌকোটা যখন নদীর মাঝামাঝি এসে পড়েছে সেই সময় বাতাস যেন হঠাৎ খেপে উঠল। সঙ্গে মেঘের স্তরগুলো গলে গলে শুরু হল বৃষ্টি। প্রথমে ফোঁটায় ফোঁটায়, তারপর প্রবল তোড়ে। চরাচরের ওপর লক্ষ কোটি সীসার ফলা যেন আকাশ থেকে ছুটে আসছে। আচমকা নদীর ঢেউগুলো পাহাড়ের মতো ফুলে ফেঁপে চারিদিক তোলপাড় করে ফেলতে থাকে। জলস্রোতে এখন কয়েক লক্ষ বুনো হাতির শক্তি।

একটানা মেঘের ডাক, থেকে থেকে বিজলী চমক, বাজের গর্জন, উলটোপালটা ঝড়ো হাওয়া আর নদীর বেপরোয়া উন্মত্ত স্রোত, সব মিলিয়ে আজকের এই বিকেলটা পৃথিবীর আদিম দুর্যোগের দিনে যেন ফিরে গেছে।

যে-দিকেই তাকানো যাক, এখন সমস্ত কিছু ঝাপসা। উজ্জ্বল সূর্যালোক, শরতের স্নিগ্ধ নীলাকাশ, ঝিরঝিরে সুখদায়ক হাওয়া, পৃথিবীতে কোনোদিন এসব ছিল বলে মনে হয় না।

নৌকোটা একবার ঢেউয়ের মাথায় উঠছে, পরক্ষণে অতল খাদে যেন নেমে যাচ্ছে, আবার তখনই তিরিশ হাত উঁচুতে উঠে আসছে।

শরীরের সমস্তটুকু শক্তি দিয়ে সবাই পাটাতনের কাঠ আঁকড়ে ধরে আছে। হাওয়া এবং নদীর যা জোর, যে-কোনো মুহূর্তে এক ঝাঁকুনিতে তাদের নৌকো থেকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। একবার স্রোতের মধ্যে গিয়ে পড়লে কে কোথায় ভেসে যাবে, কে জানে!

এখন দু-হাত দূরের কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়। তবু সাগিয়া টের পায় অন্য সকলে পাটাতনের কাঠ ধরে বসে থাকলেও সেই শুদ্ধ মানুষটি একেবারে উপুড় হয়ে শুয়ে দু-হাতে নৌকোর কানাত জাপটে ধরে পড়ে আছেন।

দেহাতিরা এখন সমানে বলে যাচ্ছে, ‘মর গিয়া, মর গিয়া—’ কিছুক্ষণ আগেও কিষুণজির ওপর তাদের অটুট আস্থা ছিল। তারা ভেবেছিল তাঁর কৃপায় নিরাপদে নদীর ওপারে পৌঁছে যেতে পারবে। এখন সেই বিশ্বাসটা আগাগোড়া টলে গেছে।

মেঘ এবং একটানা বৃষ্টিতে চারিদিক ঝাপসা হয়ে গেলেও বোঝা যাচ্ছে নৌকোটা পারের কাছকাছি চলে এসেছে। কিন্তু এই দুর্যোগে নদীর অলৌকিক শক্তির সঙ্গে একটা মানুষ কতক্ষণ আর যুঝতে পারে? হঠাৎ এতক্ষণ পর জলস্রোতের মারাত্মক চাপে মাল্লার হাতের বৈঠা কাঠির মতো মট করে ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নৌকোটা গোঁত খেয়ে দু-পাক ঘুরেই সটান উলটে গিয়ে স্রোতের তোড়ে ভেসে যেতে থাকে।

নৌকোটা পাক খাওয়ার সময় দেহাতিদের শেষ চিৎকারটা শোনা গিয়েছিল, ‘বিলকুল খতম হো গিয়া। বঁচাও—’

বৈঠা ভেঙে গিয়ে নৌকোর উলটে যাওয়াটা এতই আকস্মিক যে আগে থেকে কেউ তা আন্দাজ করতে পারেনি। জলের টানে ভেসে যেতে যেতে সাগিয়া ভেবেছিল, আর বাঁচবে না। পরক্ষণেই স্বয়ংক্রিয় কোনো পদ্ধতিতে মনে পড়ে যায়, সে সাঁতার জানে। তৎক্ষণাৎ তার রক্তের ভেতর দিয়ে বিজরী চমকের মতো কিছু খেলে যায়। যদিও শাড়ি এবং জামা ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে বসে গেছে এবং তার ফলে সাঁতরাতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে, তবু জলের ওপর প্রাণপণে ভেসে থেকে সাগিয়া পারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

খানিকটা যাবার পর হঠাৎ তার চোখে পড়ে, ডান পাশে প্রায় কুড়ি হাত তফাতে কিছু একটা ভেসে যাচ্ছে। বৃষ্টির তোড় এখনও কমেনি, দিনের আলোর ছিটে ফোঁটাও আর নেই, তবু তারই ভেতর বোঝা যায় ওটা একটা মানুষ। নিজের অজান্তে, হয়তো কোনো অপার্থিব শক্তি সাগিয়াকে ডুবন্ত লোকটার দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু জলস্রোতে তাকে এত জোরে টেনে নিয়ে চলেছে যে সাগিয়া কোনোভাবেই তার কাছে পৌঁছোতে পারে না। লোকটা ক্রমশ দূরে, আরও দূরে ভেসে যেতে থাকে।

সাগিয়ার ওপর অলৌকিক কিছু একটা যেন ভরে করে। এই খ্যাপা নদীর মারাত্মক স্রোত থেকে কাউকে বাঁচাতে যাওয়া যে কতখানি বিপজ্জনক, তার খেয়াল থাকে না। মরিয়া হয়ে দু-হাতে জল কেটে সে এগিয়ে যায় এবং অনেকক্ষণ যুঝবার পর শেষ পর্যন্ত লোকটার কাছে এসে তার কাঁধের কাছটা জামাসুদ্ধ ধরে ফেলে। সাগিয়া বুঝতে পারছিল তার নিজের নাকমুখ দিয়ে গল গল করে জল ঢুকে যাচ্ছে, পায়ের শিরায় টান ধরে গেছে। কিন্তু এখন কোনো কিছু ভাবার সময় নয়। নিজেকে এবং লোকটাকে স্রোতের ওপর ভাসিয়ে রেখে এবার সে পারের দিকে যেতে থাকে। মাঝে মাঝে চোরা ঘূর্ণি উঁচু উঁচু ঢেউ লোকটাকে ছিনিয়ে নিতে চায় কিন্তু সাগিয়া হাতের মুঠি মুহূর্তের জন্য আলগা করে না, তার হাত সাঁড়াশির মতো লোকটার কাঁধ চেপে ধরে থাকে।

জলস্রোতের ওপর দিয়ে ভাসিয়ে ভাসিয়ে এক-সময় লোকটাকে যখন নদীর পারে তুলে আনে তখন সাগিয়ার জীবনী শক্তি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।

নৌহর নদীর পার ধরে পঞ্চাশ হাত চওড়া বাদামি ডাঙা চলে গেছে। লোকটাকে তোলবার পর বালির ওপর হাঁপায় সাগিয়া। এতক্ষণ জলে থাকার কারণে তার হাত-পা সিঁটিয়ে গেছে। শীতে গায়ের চামড়া কেঁপে কেঁপে ওঠে।

বৃষ্টির দাপট এবার কমে এসেছে, তবে একেবারে থামেনি, ঝির ঝির করে পড়েই যাচ্ছে। আকাশে মেঘ খানিকটা পাতলা হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ আগেও সমস্ত চরাচর মেঘে এবং বৃষ্টিতে এত ঝাপসা হয়ে ছিল যে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছিল না। এখন মেঘের স্তর ফাটিয়ে ফ্যাকাসে আলোর একটু আভা ফুটতে শুরু করেছে।

অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে হাতের ভর দিয়ে উঠে বসে সাগিয়া এবং দু-হাত দূরে পড়ে থাকা সেই লোকটার দিকে চোখ পড়তে চমকে ওঠে। লোকটা আর কেউ না—উঁচু জাতের বড়ো বংশের শুদ্ধ নিষ্পাপ মানুষ বলে সাগিয়া যাঁকে মনে করেছিল—তিনিই।

কয়েক পলক মানুষটির দিকে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সাগিয়া। তারপর হঠাৎ কোনো যান্ত্রিক নিয়মে তাঁর দিকে ঝুঁকে ডাকে, ‘শুনিয়ে—শুনিয়ে—’

মানুষটি সাড়া দেন না, নড়াচড়ারও লক্ষণ নেই তাঁর।

দ্বিধান্বিতের মতো বসে থাকে সাগিয়া। হঠাৎ তার মনে হয় মানুষটি বেঁচে আছেন তো? আরো ঝুঁকে দ্রুত একটা হাত তাঁর নাকের তলায় নিয়ে আসে। অনেকক্ষণ পর পর তিরতির করে একটু নিঃশ্বাস পড়ছে।

দুশ্চিন্তা এবং উদবেগ অনেকটা কেটে যায় সাগিয়ার, ভেতরে ভেতরে সে আরাম বোধ করে। মানুষটি বেঁচেই আছেন। সে আবার ডাকতে থাকে, ‘শুনিয়ে—’

এবারও উত্তর নেই।

হঠাৎ কেমন যেন সন্দেহ হয় সাগিয়ার। মানুষটির কাঁধের কাছটা ধরে আস্তে আস্তে ঝাঁকুনি দিতে থাকে, ‘ইধর দেখিয়ে—’ বলতে বলতে মুখটা আরো নামিয়ে আনে। মানুষটির চোখ পুরোপুরি বোজা। সাগিয়া টের পায়, একেবারে বেহুঁশ হয়ে আছেন তিনি। হঠাৎ অত্যন্ত বিপন্ন বোধ করে সে। একবার ভাবে, এই মানুষটি সম্পর্কে তার আর কোনো দায় নেই। প্রবল দুর্যোগের মধ্যে খ্যাপা নদী থেকে তাঁকে উদ্ধার করে পারে তুলে দিয়েছে। এরপর আর কী করতে পারে সে? পরক্ষণেই অসীম দায়িত্ববোধ সাগিয়ার মাথায় চেপে বসে। নিজেকে বারবার ধিক্কার দিয়ে ভাবে, এই অবস্থায় মানুষটাকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। জ্ঞান ফেরার পর সুস্থ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত সাগিয়াকে তাঁর কাছে থাকতেই হবে।

এখন অল্প অল্প বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। আকাশের যা চেহারা, মেঘ কিছুটা হাল্কা হলেও নতুন উদ্যমে আবার ধবংসের বাকি কাজটুকু যে-কোনো মুহূর্তে শুরু হয়ে যেতে পারে।

মানুষটি জলে কাদায় এবং বালিতে মাখামাখি হয়ে আছেন। এভাবে খোলা আকাশের নীচে পড়ে থেকে অনবরত ভিজতে থাকলে শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচানো যাবে কিনা সন্দেহ। যেমন করেই হোক তাঁকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে হবে কিন্তু কীভাবে?

ভালো করে চারপাশ দেখে নেয় সাগিয়া। এই অঞ্চলটা তার অচেনা নয়। সে আন্দাজ করে নেয়, জনকপুরের দিকের পারঘাটা থেকে স্রোতের টানে প্রায় মাইলখানেক দক্ষিণে চলে এসেছে।

জায়গাটা ভয়ঙ্কর নির্জন। একটা মানুষও কাছে-দূরে কোথাও চোখে পড়ছে না। মানুষ দূরের কথা, পাখি-টাখি, জন্তু-জানোয়ার, এমনকি পোকামাকড় পর্যন্ত নেই। অসময়ের এই প্রচণ্ড দুর্যোগে সবাই নৌহরের আশপাশ থেকে উধাও হয়ে গেছে।

একটা লোক পাওয়া গেলেও ধরাধরি করে মানুষটাকে পারঘাটা পর্যন্ত যাওয়া যেত। কিন্তু তার আর উপায় নেই। যা করার সাগিয়াকে একাই করতে হবে।

মানুষটার হাতে-পায়ের আঙুল, এবং ঠোঁট সিঁটিয়ে গেছে। অনেকক্ষণ জলে ভেজার কারণে তাঁর গায়ের চামড়া অত্যন্ত সাদা আর রক্তশূন্য দেখায়।

সাগিয়া বুঝতে পারছে, মানুষটি প্রচুর জল খেয়েছিলেন। প্রথমেই তাঁর পেট থেকে জলটা বার করে দেওয়া দরকার। পিঠের দিকটা ধরে তাঁকে আস্তে আস্তে বসিয়ে দেয় সাগিয়া, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথাটা বুকের ওপর ঝুলে পড়ে, দুই হাত দু-দিকে এগিয়ে যায়। সেই অবস্থাতেই তাঁকে ঝাঁকাতে থাকে সাগিয়া। বারকয়েক ঝাঁকুনি দিতেই মুখ দিয়ে খানিকটা নীলচে জল বেরিয়ে আসে। এরপর তাঁকে উপুড় করে শুইয়ে পিঠে চাপ দিতে থাকে সাগিয়া। এবার হড় হড় করে নাকমুখ দিয়ে আরো জল বেরোয়।

গায়ে হাত ঠেকাতেই টের পাওয়া গিয়েছিল মানুষটির গা ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে আছে। যেমন করে হোক এঁর শরীরে উষ্ণতা ফিরিয়ে আনতে না পারলে বাঁচানোর আশা নেই। সাগিয়া মনস্থির করে ফেলে, মানুষটাকে পারঘাটায় নিয়ে যাবে। যত দুর্যোগই হোক, ওখানে পৌঁছে গেলে লোকজন পাওয়া যাবেই। এরকম বেহুঁশ একটি মানুষকে দেখলে কেউ নিশ্চয়ই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না, সবাই হাত বাড়িয়ে দেবে।

একটাই বাঁচোয়া, নদীর পারটা এবড়ো-খেবড়ো বা জলে কাদায় থকথকে নয়, ঝোপঝাড় জঙ্গলও নেই এখানে। মাইলের পর মাইল মসৃণ বাদামি বালি পাটির মতো পড়ে আছে।

সাগিয়া মানুষটিকে আবার তুলে বসিয়ে দেয়। আগের মতোই ঘাড় ভেঙে মাথাটা বুকের ওপর নেতিয়ে পড়ে, হাত দুটোও শরীর থেকে আলগা হয়ে ঝুলতে থাকে। সাগিয়া মানুষটির দুই বগলের তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আঁকড়ে ধরে।

মাথার ওপর মেঘের ভারে নেমে আসা আকাশ, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, পাশে ফুঁসতে থাকে খতরনাক নদী—এর মধ্যেই জেদি, একরোখা, অনমনীয় এক মেয়েমানুষ সম্পূর্ণ অচেনা এক বেহুঁশ পুরুষকে বালির ওপর দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে চলে।

খানিকটা যাবার পর মানুষটিকে বালিতে শুইয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ জিভ বার করে কুকুরের মতো হাঁপায় সাগিয়া। তারপর আবার টানতে থাকে। এইভাবে জনকপুরের দিকের পারঘাটায় যখন পৌঁছোয়, তার জীবনশক্তি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

পারঘাটের পাশে অনেকগুলো ঝাঁকড়া মাথা পিপর গাছ। সেগুলোর তলায় বেশ কয়েকটা দোকান। তার কোনোটা চায়ের, কোনোটা পান-বিড়ি-খৈনির, কোনোটা লিট্টির, কোনোটা জিলবি-গুলাবজামুন আর নমনকিনের। দোকানগুলোর গা ঘেঁষে বয়েল গাড়ি আর সাইকেল রিকশা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সারা দিন এবং বেশ খানিকটা রাত পর্যন্ত মানুষজনের ভিড়ে জায়গাটা গমগম করে।

কিন্তু এই মুহূর্তে দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ। একটা সাইকেল রিকশাও চোখে পড়ছে না। লোকজনও নেই। দুর্যোগের চেহারা দেখে সব উধাও হয়ে গেছে। পারঘাটা এখন একেবারেই নিঝুম। শুধু দুটো বয়েল গাড়ি এখনও চলে যায়নি। নির্জন সুনসান পারঘাটে ওরা কী আশায় দাঁড়িয়ে আছে, কে জানে।

মানুষটাকে বালিতে শুইয়ে প্রায় ধুঁকতে ধুঁকতে পিপর গাছগুলোর তলায় চলে আসে সাগিয়া। সাইকেল রিকশা নেই, বয়েল গাড়িতেই মানুষটিকে তুলে নিয়ে যেতে হবে। তিনি কোথায় থাকেন—কোনো টৌনে বা গাঁওয়ে, কী তাঁর নাম, সাগিয়া জানে না। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত জানার উপায়ও নেই।

সাগিয়া ঠিক করে ফেলেছে, মানুষটিকে জনকপুরের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে সে তাদের টৌলিতে চলে যাবে। কিন্তু বিনা ভাড়ায় বয়েল গাড়ির প্রাণীদুটো এক কদমও নড়বে না। এতক্ষণে সাগিয়ার মনে পড়ে নৌকোটা গোঁত খেয়ে উল্টে যাবার পর তার টিনের সুটকেসটা জলে ডুবে যায়। তবে জগনাথ চারদিনের মজুরি যে আশিটা টাকা দিয়েছে সেটা কোমরে শাড়ির খুঁটে বেঁধে রেখেছিল। দ্রুত তার হাত সেখানে চলে যায়। টের পায় টাকাগুলো ওখানেই আছে।

একটা গাড়োয়ানের সঙ্গে দশ টাকায় ভাড়া ঠিক করে সাগিয়া। তারপর দু-জনে ধরাধরি করে বেহুঁশ মানুষটিকে গাড়িতে তুলে ফেলে। চার চারটে দিন তার হাড়মাংস ডোলে পিষে জগনাথ যা দিয়েছিল সেই কষ্টের মজুরি থেকে দশটা টাকা চলে যাবে। রীতিমতো আক্ষেপই হয় সাগিয়ার। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই।

জনকপুর নোংরা নগন্য শহর। একধারে আরো নগন্য, আরো নোংরা অতি হতচ্ছাড়া চেহারার হাসপাতালে পৌঁছে দেখা গেল, সেখানকার একমেব ডাক্তারটি নেই। পঞ্চাশ মাইল দূরে বিয়ের বরাত নিয়ে গেছে। আজ তো ফিরবেই না, কবে ফিরবে তার কিছু ঠিক নেই। হাসপাতালে যারা আছে, ডাক্তারের হুকুম ছাড়া কাউকে ভর্তি করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

এদিকে বৃষ্টির দাপট কিছুক্ষণের জন্য কমে এলেও আবার প্রবল তোড়ে পড়তে শুরু করেছে। হাওয়ার জোরও বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।

পারঘাটে বয়েল গাড়িতে ওঠার সময় সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছিল। এখন বেশ রাত হয়ে গেছে। মেঘের কারণে অন্ধকার এত ঘন যে মনে হয়, চারিদিকে কালো কালো নিরেট দেয়াল খাড়া হয়ে আছে।

সাগিয়া ভেবে রেখেছিল, কোনোরকমে হাসপাতালে পৌঁছুতে পারলে তার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু এখন সে কী করবে? এই সম্পূর্ণ অজানা মানুষটিকে নিয়ে কোথায় যাবে? দুশ্চিন্তায়, উদবেগে তার মাথার ভেতর যেন আগুনের চাকা ঘুরতে থাকে।

এদিকে বয়েল গাড়ির গাড়োয়ান ভাড়া চুকিয়ে তাকে ছেড়ে দেবার জন্য অনবরত তাড়া দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়েই সাগিয়া স্থির করে ফেলে, মানুষটিকে তাদের টোলায় নিয়ে যাবে। ভাড়ার ওপর আরো দু-টাকা বাড়তি দেবার কড়ারে গাড়োয়ান তাদের সেখানে পৌঁছে দেয়।

বেশ্যাপাড়াটা শহরের শেষ মাথায়। খান দশ বারো ধসে-পড়া টিনের চালের ফুটিফাটা ঘর নিয়ে এই টোলা। দু-সারিতে ঘরগুলো মুখোমুখি কোনোরকমে খাড়া হয়ে আছে, মাঝখান দিয়ে সরু প্যাচপেচে দমচাপা গলি। ঘরগুলোর হাল এমনই ঝরঝরে, যে-কোনো মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।

জনকপুরের পয়সাওয়ালাদের মহল্লায় বিজলি এসে গেছে, কিন্তু এদিকে তার চিহ্নমাত্র নেই।

বয়েল গাড়ির মাঝখানে ছইয়ের তলা থেকে সাগিয়া দেখতে পায় তাদের টোলার মুখে একটা ভাঙাচোরা টালির চালের তলায় সেজেগুজে বসে আছে মেয়েরা। বিজরী, শুগা, লছিমা, পঞ্ছী, এমনি আট দশজন। দু-তিনটে কালি-পড়া লণ্ঠন তাদের সামনে।

অন্যদিকে এই সময় চিটেগুড়ের গায়ে মাছির মতো একটা থিকথিকে ভিড় যেন এখানে আটকে থাকে। এই নরকে যারা আসে তারা হল মাতাল, গাঁজাখোর, চোর-জোচ্চোর, খুনি এবং গরমি বা ক্ষয়রোগী। দুনিয়ার একেবারে নীচের স্তরের এই সব জঘন্য কৃমিকীটেরা ছাড়া রাণ্ডিটোলার ছায়া আর কেউ মাড়ায় না। কিন্তু আজ তারাও আসেনি।

বয়েল গাড়ি দেখে মেয়েগুলোর মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল। এই দুর্যোগের মধ্যেও হয়তো একটি খদ্দের এসেছে। কিন্তু ছইয়ের তলা থেকে সাগিয়ার গলা শুনে তাদের উৎসাহ পুরোপুরি নিভে যায়। সগিয়া ডাকতে শুরু করেছে, ‘এ শুগা, এ লছিমা—তোরা জলদি এখানে আয়।’

কারো ওঠার লক্ষণ নেই। কর্কশ গলায় শুগা শুধু বলে, ‘কায়?’

‘একগো আদমিকে ধরে নামাতে হবে—পুরা বেহোঁশ।’

এবার মেয়েমানুষগুলোর চোখে-মুখে সামান্য ঔৎসুক্য ফুটে ওঠে। তারা পায়ে পায়ে উঠে আসে। ভাঙাচোরা চোয়াড়ে মুখ তাদের। রাতজাগার কারণে চোখের নীচে স্থায়ী কালির ছোপ। কোনোকালে এদের চেহারায় ছিরিছাঁদ এবং সামান্য লালিত্যও ছিল বলে মনে হয় না।

তাড়াতাড়ি গাড়োয়ানের ভাড়া চুকিয়ে বেহুঁশ মানুষটিকে দেখিয়ে সাগিয়া মেয়েমানুষগুলোকে বলে, ‘ধর—’

একজন জিজ্ঞেসা করে, ‘এ কৌন রে?’

সাগিয়া বলে, ‘পরে বলব।’

দু-জন লণ্ঠন তুলে ধরে। বাকি ক-জন সাগিয়ার সঙ্গে ধরাধরি করে মানুষটিকে টোলার ভেতরে নিয়ে আসে।

সাগিয়ার ঘরের দেয়াল মাটির। এক দেয়ালে ছোটো ছোটো দুটো জানালা, সে দুটোর পাল্লা পেটানো টিনের। আরেক দেওয়ালে খেলো ক-টা ক্যালেন্ডার ঝুলছে, সেগুলোতে গণপতি, দুর্গা, রামচন্দ্রজি, বজরংবলী এবং শিবের ধ্যাবড়া-ধ্যাবড়া ছবি। তার পাশাপাশি খবরের কাগজ এবং পুরোনো ক্যালেন্ডার থেকে কেটে ফিল্মের প্রায়-উদোম লাস্যময়ী নায়িকাদের কিছু ছবি সেঁটে দেওয়া হয়েছে। দেব-দেবী এবং হিরোইনদের এই সহাবস্থানে কোনো পক্ষেরই বোধ হয় আপত্তি নেই। এক কোণে পুরোনো ঘুণে-কাটা তক্তাপোশের একটি পায়া নেই, সেখানে ইঁট পেতে কাজ চালানো হচ্ছে।

তক্তাপোশে ময়লা বিছানা। দিন কয়েক সাগিয়া এখানে না থাকায় তার ওপর প্রচুর ধুলোটুলো জমেছে। তক্তাপোশটার তলায় এনামেলের তোবড়ানো হাঁড়িকুঁড়ি, টিনের তোরঙ্গ, শিশি বোতল, কৌটোবাটা, কাঠের বাক্স, সিলভারের কিছু বাসন-কোসন, এমনি নানা টুকিটাকি জিনিস ডাঁই হয়ে আছে। কোণের দিকে একটা কেরোসিন কাঠের আলনায় দু-চারটে শাড়ি ঝুলছে।

বেহুঁশ মানুষটিকে মেয়েমানুষগুলোর হাতে রেখে দ্রুত বিছানাটা ঝেড়ে, বাক্স থেকে পরিষ্কার চাদর বার করে পেতে দেয় সাগিয়া, বলে, ‘শুইয়ে দে।’ কথা বলতে বলতে ক্ষিপ্র হাতে তক্তাপোশের তলা থেকে লণ্ঠন বার করে ধরিয়ে নেয়।

মেয়েগুলো মানুষটিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল। শুগা বলে, ‘বিলকুল ভিজে গেছে আদমিটা। কাপড়া উপড়া বদলে না দিলে বুখার ধরে যাবে।’

হাঁ—বলতে বলতে অসহায় চোখে এদিক সেদিক তাকায় সাগিয়া। তার ঘরে পুরুষের পরার মতো জামাকাপড় নেই।

লছিমা তার মনোভাব বুঝতে পেরে বলে, ‘তোর শাড়িই পরিয়ে দে। এখন ধোতি-ওতি কোথায় পাবি?’

সাগিয়া দ্রুত আলনা থেকে দুটি শাড়ি নামিয়ে আনে।

লছিমা একপাশ থেকে বলে, ‘কাপড়া উপড়া খুলে নাঙ্গা করে শাড়ি পরা সাগি—’ বলে অশ্লীল ভঙ্গি করে চোখ টিপে দাঁত বার করে হাসে। দশ বছর বয়েস থেকে নিয়মিত বিড়ি ফোঁকা এবং খৈনি খাওয়ার কারণে তার দাঁত এবং মাড়ি হেজে গিয়ে চিরস্থায়ী কালো ছোপ ধরে গেছে।

অন্য মেয়েমানুষগুলো কুৎসিত শব্দ করে হাসে। সাগিয়া তাদের দিকে তাকায় না। প্রথমে একটা শাড়ি মানুষটির পেট থেকে নীচের অংশে চাপা দিয়ে আস্তে আস্তে ভেজা ধুতির গিঁটটা খুলে তলার দিক থেকে টেনে নামিয়ে দেয়।

এতক্ষণ মেয়েগুলো ভালো করে মানুষটাকে লক্ষ করেনি। এবার তার মুখের দিকে চোখ পড়তে থমকে যায়। ফিস ফিস করে নিজেদের ভেতর বলাবলি করে, ‘বহোত খুবসুরত আদমি।’

আসলে এমন সুপুরুষ চেহারার মানুষ দুনিয়ার এই ওঁচা রাণ্ডিটোলায় আসে না। এমনিতেই সাগিয়ার সম্পর্কে এখানকার মেয়েমানুষগুলোর প্রচণ্ড ঈর্ষা। কারণ এখনও তার চেহারায় অনেকটাই চটক থেকে গেছে। বাজারে সাগিয়ার শরীরের প্রচণ্ড চাহিদা। এখানে যে-ই আসুক, সাগিয়ার জন্য সর্বস্ব দিতে রাজি। অন্য মেয়ে দু-টাকা পেলে সে পায় পাঁচ গুণ। সাগিয়া আবার সবাইকে তার বিছানায় তোলে না। ‘বগুলা চুনি চুনি খায়’-এর মতো সে বেছে বেছে পছন্দমতো লোককে ঘরে ঢোকায়। কিন্তু অন্য মেয়েমানুষগুলোর পছন্দ অপছন্দ নেই। পোকায়-কাটা, পচা-গলা ঘেয়ো চেহারার লোক এলেও বাছাবাছির ব্যাপার থাকে না। যে-ই আসুক খাতিরদারি করে ঘরে ঢোকাতে হয়। সব দিক থেকেই তারা সাগিয়ার কাছে মার খাচ্ছে। এমনকি আজও বয়েল গাড়ি করে যাকে সাগিয়া নিয়ে এসেছে তার মতো সুন্দর আদমি তারা সারা জীবনে আদৌ আর দেখেছে কিনা মনে করতে পারে না। সাগিয়ার নতুন সৌভাগ্যে তাদের বুকের ভেতরটা হিংসেয় পুড়তে থাকে।

পঞ্ছী বলে, ‘আদমিটা বহোত পাইসাবালা, না রে?’

মানুষটার পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে সাগিয়া বলে, ‘জানি না।’

‘ঝুট।’

‘কা ঝুট?’

‘আদমিটাকে টানতে টানতে নিয়ে এলি, আর বলছিস জানিস না! বাতা না, বাতা। আমরা কেউ ভাগ চাইব না, একগো পাইসা ভি নহী।’

সাগিয়া সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করে, ‘বিশোয়াস কর, আমি আদমিটাকে আগে দেখিনি। একই নাওয়ে নদী পেরুবার সময় দেখেছি।’

কিন্তু তার কথার একটি বর্ণও কেউ বিশ্বাস করে না। ঈর্ষায় জ্বলতে-জ্বলতে লছিমা বলে, ‘তুই কি আর এই পচা নালিয়ায় পড়ে থাকবি? জরুর আদমিটা তোকে এখান থেকে নিয়ে পাকা কোঠিতে তুলবে, সোনাচাঁদিতে গা মুড়ে দেবে।’

সাগিয়া উত্তর দেয় না। হাজার বললেও এরা বুঝবে না। সে নীচু হয়ে লেপ্টানো পাঞ্জাবি এবং গেঞ্জি মানুষটার গা থেকে খুলে ফেলে।

ওধার থেকে শুগা আর বিলাখী কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই চাপা গলায় লছিমা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হো রামচন্দজি, এ কাকে নিয়ে এসেছিস—বামহন! এই নরকে বামহনকে নিয়ে এলি!’ বলে মানুষটির খোলা গায়ে সাদা ধবধবে পৈতার মোটা গোছা দেখিয়ে দেয়।

সগিয়া চমকে ওঠে। ব্রাহ্মণ সম্পর্কে আজন্মের সংস্কার তাকে মারাত্মক পাপবোধে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। অজান্তে সে কাকে রাণ্ডিটোলায় এনে তুলেছে।

ঘরের অন্য মেয়েগুলোও চুপ, সবারই ধারণা, এখানে একজন ব্রাহ্মণকে টেনে আনাটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ।

একসময় তোহরি নামের আওরতটা বলে, ‘বামহন হলে কী আর করা! বেহুঁশ আদমিটাকে এখন তো আর বাইরে ফেলে দেওয়া যায় না। যা বারীষ, হুঁশ ফিরলে আর বারীষ থামলে রিকশা ডেকে তুলে দেওয়া যাবে।’

মোটামুটি তোহরির কথাটাই সবাই মেনে নেয়। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

দুর্যোগের রাতে অভাবনীয় একটি মানুষ সম্পর্কে আরো কিছুক্ষণ আলোচনা করে দারুণ অস্বস্তি নিয়ে মেয়েমানুষগুলো চলে যায়। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে রাণ্ডিটোলার এ জঘন্য বেশ্যার বিছানায় আবিষ্কার করে মানুষটির কী প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা ভাবতেও কারোর সাহস হয় না।

সবাই যাবার পর ঘরের এক কোণে গিয়ে ভেজা শাড়িটাড়ি বদয়ে নেয় সাগিয়া। তারপর আরেকটা শুকনো কাপড় নিয়ে তক্তাপোষের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। এই ঘরের বায়ুস্তরে এবং প্রতিটি জিনিসে লক্ষ কোটি পাপের বীজাণু থিক থিক করছে। কিন্তু একবার যখন মানুষটিকে এখানে এনে তুলেছে তখন তাঁকে বাঁচিয়ে তোলা ছাড়া আপাতত আর কিছু করার নেই।

শুকনো শাড়ি দিয়ে মানুষটির মাথা এবং গা মুছে দিয়ে, আরেকটা চাদর বার করে গলা পর্যন্ত ঢেকে দেয় সে।

বাইরে তুমুল বৃষ্টি চলছে। ঝাঁঝরা টিনের চাল যেন চুরমার হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে ঝড়ের দাপটও বাড়ছে, মড় মড় করে গাছের ডাল ভেঙে পড়ার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া বাজের গর্জন এবং মেঘের ডাক তো আছেই।

সেই দুপুরবেলা নেকীপুর থেকে চার মাইল হেঁটে পারঘাটায় এসেছিল সাগিয়া। তারপর মাঝ নদীতে নৌকাডুবির পর থেকে যা যা ঘটেছে তাতে ক্লান্তিতে শরীর একেবারে ভেঙেচুরে আসছে। কাঁধের কাছ থেকে হাতদুটো আর কোমরের তলার দিকটা একেবারে খসে পড়বে যেন। সেই সঙ্গে ঘুমে চোখ জুড়ে আসছে, খিদেও পেয়েছে মারাত্মক। এখন চুলা জ্বেলে মাড়ভাত্তা বা দু-চারখানা বাজরার রোটি যে বানিয়ে নেবে সেটুকু শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। একটা কৌটোয় চারটি শুকনো চিড়ে আছে। তাই চিবিয়ে এক পেট জল খেয়ে শুয়ে পড়বে।

চিড়ে বার করতে যাবার আগে আস্তে আস্তে ডাকে সাগিয়া, ‘শুনিয়ে—শুনিয়ে—’

নাঃ, মানুষটির জ্ঞান এখনও ফেরেনি। চোখ তাঁর আগেরই মতোই বোজা। কীভেবে কপালে হাত রাখে সাগিয়া। বেশ গরম লাগছে। জ্বর আসছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

সাগিয়া আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। কোনোরকমে দুটি চিঁড়ে এবং জল খেয়ে স্যাঁতসেতে মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়তে পড়তে অদ্ভুত একটা কথা মনে হয়। এই ঘরে কোনো পুরুষ ঢুকেছে আর তার সঙ্গে সে এক বিছানায় শোয়নি, এটা ভাবা যায় না। একজন সুপুরুষ ব্রাহ্মণ তার নোংরা তক্তাপোশে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে এবং সে রয়েছে মেঝেতে, এমন অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম ঘটল। ভাবতে ভাবতে একসময় চোখ বুজে আসে তার।

হঠাৎ দরজায় চলছেই, টিনের চালে হাজারটা বুনো ঘোড়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে—এমনই বৃষ্টির তোড়।

ঝড়বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে জড়ানো মাতালের গলা ভেসে আসে, ‘তোহরকা বাপ শালী রাণ্ডি। দরবাজা খোল—’

চেনা গলা, নাম তরজুলাল। লোকটা জনকপুরে টাঙা চালায়। খুব বদমেজাজি এবং খতরনাক। রোজ একটা না একটা ঝামেলা পাকিয়েই যায়। সারাদিন দারু খেয়ে টং হয়ে থাকে। কথায় কথায় ছুরি চালিয়ে দেয়। এই সব কারণে বার কয়েক জেলও খেটেছে।

সাগিয়া চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘আজ চলা যাও—’

শরাবীর গলা কয়েক পর্দা উঁচুতে চড়ে, ‘খোল বলছি রাণ্ডি, না হলে লাথ মেরে দরবাজা তুড়ে ঢুকব।’

একপলক ইতস্তত করে সাগিয়া। তক্তাপোষে শায়িত মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ঘরে আদমি আছে। আজ যাও—’

কিছুক্ষণ বিপুল তোড়ে খিস্তি করে যায় তরজুলাল। তারপর বলে, ‘এই বারীষে কুত্তা বিল্লি বেরুতে পারে না, আর তুই শালী পাসিঞ্জার ঢুকিয়ে ফেললি! ভুচ্চরকা ছৌরী।’ এরপর নতুন উদ্যমে অকথ্য গালাগাল দিতে দিতে সে চলে যায়।

আরো কিছুক্ষণ পর আবার দরজায় ধাক্কা। এবার এসেছে গাঁজা-ভাংয়ের দোকানের মালিক ভৈরোনাথ। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিতে কুকুর-বেড়াল বেরুতে না পারলেও রাণ্ডিটোলার খদ্দেররা ঠিকই বেরিয়ে পড়ে। মানুষের চেয়ে নোংরা জানোয়ার পৃথিবীতে জন্মায়নি।

ভৈরোনাথকেও ভাগিয়ে দেয় সাগিয়া। এমন দুর্দান্ত দুর্যোগের রাতটা বিলকুল বিফলে যাবে। এটা ভাবতেও পারেনি সে। তরজুলালের মতো ভৈরোনাথও অকথ্য খিস্তি দিতে দিতে চলে যায়।

তারপর কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল, সাগিয়ার খেয়াল নেই। আচমকা গোঙানির শব্দে সে ধড়মড় করে উঠে বসে। শোওয়ার আগে লণ্ঠনটা নিভু নিভু করে রেখেছিল, চাবি ঘুরিয়ে আলোর তেজ বাড়াতেই চোখে পড়ে তক্তাপোশে সেই মানুষটি ছটফট করছেন, আর মাঝে মাঝেই কাতর শব্দ করে উঠছেন।

দ্রুত উঠে গিয়ে তক্তাপোশের পাশে দাঁড়ায় সাগিয়া। অনেকটা ঝুঁকে ডাকতে থাকে, ‘শুনিয়ে, শুনিয়ে—’

মানুষটি চোখ মেলে তাকান, কিন্তু উত্তর দেন না। ঘোর-লাগা লাল-টকটকে চোখ তাঁর। বিড় বিড় করে কী বকে যান। তাঁর কপালে হাত দিয়ে চমকে ওঠে সাগিয়া। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।

এই মুহূর্তে কিছু একটা করা দরকার, কিন্তু কী করবে, ভেবে পায় না সাগিয়া। শেষ পর্যন্ত দরজা খুলে বাইরে এসে পাশের ঘরের তোহরির ঘুম ভাঙিয়ে মানুষটির নতুন উপসর্গের কথা জানায়। তারপর উদবিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করে, ‘অব কা করে?’

মাঝরাতে ঘুম ভাঙাবার জন্য প্রথমটা খেপে গিয়েছিল তোহরি। তারপর সবটা শুনে একটু নরম হয়ে বলে, ‘তোর কাছে পাইসা আছে?’ পরক্ষণে ফের কী ভেবে বলে, ‘আছেই তো। নেকীপুরের লকড়িবালার কাছ থেকে বহোত কামাই করে এসেছিস।’

জগনাথের দেওয়া মজুরি থেকে বারোটা টাকা এর মধ্যেই খরচ হয়ে গেছে। সাগিয়া ভেবেছিল কোনোরকমে হুঁশ ফিরলেই মানুষটিকে রিকশা ডেকে তুলে দেবে। কিন্তু এখন সে অথৈ দরিয়ায় গিয়ে পড়ল। প্রথমত, ক-দিনে জ্বর সারিয়ে মানুষটিকে চাঙ্গা করতে পারবে তার ঠিক নেই। দ্বিতীয়ত, এঁর জন্য হাতের পুঁজি কিছুই খুব সম্ভব আর থাকবে না। তা ছাড়া আর একটি মাত্র ঘর। একটা লোক তক্তাপোশ জুড়ে পড়ে থাকলে খদ্দের ঢোকানো যাবে না। মানুষটা যত দিন থাকবেন, তার কামাই বন্ধ।

সাগিয়ার মনোভাব খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছিল তোহরি। সহানুভূতির গলায় এবার বলে ‘বৈদ ডাকতে হবে। নইলে জলদি জলদি বামহনকে সারিয়ে বাড়ি পাঠানো যাবে না।’

সাগিয়া তার একটা হাত ধরে বলে, ‘চল, বৈদকে ডেকে আনি।’

তোহরি অবাক, ‘এত্তে বারীষমে!’

‘হ্যাঁ। আদমিটার বহোত বুখার—’

তোহরি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার ঘরে পাঠিয়ে দেয়। এই ভয়ঙ্কর ঝড় বৃষ্টিতে এবং এত রাত্তিরে বৈদ বা ডাক্তারকে কিছুতেই বাড়ি থেকে বার করে আনা যাবে না।

পরদিন সকালে দুর্যোগ অনেকটা কেটে যায়। বৃষ্টি যদিও অল্প অল্প পড়ছে, আকাশ বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। পাতলা, ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু মেঘ অবশ্য এখনও চোখে পড়ে।

কাল বাকি রাতটুকু আর ঘুমোয়নি সাগিয়া। কাছে বসে অসহায়ভাবে মানুষটির একটানা গোঙানি শুনে গেছে। রোগকাতর বেহুঁশ মানুষটিকে নিয়ে সে কী করবে ঠিক করে উঠতে পারেনি। মাঝে মাঝে কপালে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। তারপর দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই বৈদ সহায়জিকে ডেকে এনেছে।

পাওনলাল সহায় জাতে কায়াথ বা কায়স্থ হলেও রাণ্ডিটোলার বাসিন্দারা ডাকলে চলে আসে। এই কারণে জনকপুরের উঁচা জাতের লোকেরা রোগ-বিমার হলে তার কাছে যায় না, তাকে একরকম একঘরে অচ্ছুত করে রেখেছে। কিন্তু পাওনলাল প্রচণ্ড বেপরোয়া, দুর্জয় সাহস তার। সে বলে, বৈদের কাছে যে রোগিই আসুক, তার চিকিৎসা না করাটা পাপ। বেশ্যা আসুক, ধাঙর আসুক, চামার আসুক, কাউকেই ফেরায় না পাওনলাল। ডোম-দোসাদ-মেথর, চোর-ডাকু, অসুস্থ হয়ে যে-ই ডাকুক সে ছুটে যায়। এতে কে কী ভাবল, কে কী বলল, গ্রাহ্যই করে না।

মাঝবয়সি পাওনলালের গায়ে শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস থাকে ধুসো আলপাকার কোট। পরনের ধুতিটা এতই খাটো যে হাঁটুর আধ হাতের বেশি নামেনি। কাঁচাপাকা চুল চামড়া ঘেঁসে ছাঁটা, পায়ে কাঁচা চামড়ার ভারী জুতো। কোটের বুক পকেটে কালো কারে বাঁধা পুরোনো আমলের গোল ঘড়ি। দাড়ি কামানোর সময়-টময় বিশেষ পায় না। তাই গালে আট-দশ দিনের খামচা খামচা দাড়ি প্রায়ই জমে থাকে। কোথাও বেরুলে তার হাতে একটা টাউস টিনের বাক্স ঝোলে। পাওনলালের চিকিৎসার বিশেষ কোনো পদ্ধতি নেই। কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি এবং অ্যালোপ্যাথি—তিন রকম নিয়মই দরকার মতো কাজে লাগায়, তার বাক্সে কবিরাজি বড়ি যেমন আছে, হোমিওপ্যাথিক গ্লোবিউলের কাঁড়ি কাঁড়ি শিশি এবং অ্যালোপ্যাথিক ট্যাবলেট আর ইনজেকশনের সরঞ্জামও তেমনি রয়েছে। রোগ সারানোটাই আসল কথা, কোন নিয়মে, কী পদ্ধতিতে সারানো হল, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর আদৌ দরকার নেই।

সাগিয়ার ঘরে ঢুকে তক্তাপোশে শায়িত মানুষটির দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে পাওনলাল বৈদ। বলে, সর্বনাশ, এ কাকে এনে তুলেছিস?

পাওনলাল আসার খবরটা এখানকার ছোট্ট রাণ্ডিটোলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সবাই এসে সাগিয়ার ঘরের সামনে ভিড় করে দাঁড়ায়।

সাগিয়া ভয়ে-ভয়ে শুধোয়, ‘কাকে এনেছি!’

পাওনলাল বলে, ‘ইনি শাস্ত্রীজি—রামসীতা মন্দিরের বড়ো পুরোহিত শিউশঙ্কর শাস্ত্রী।’ তারপর একটানা যা বলে যায় তা এইরকম, শিউশঙ্করের মতো আজীবন ব্রহ্মচারী, এমন সৎ, পবিত্র এবং শাস্ত্রজ্ঞ ভূভারতে আর একজনকেও পাওয়া যাবে না। জনকপুরে, শুধু জনকপুরে কেন, আশেপাশে একশো মাইলের মধ্যে তাঁর মতো শ্রদ্ধেয় তাঁর মতো সম্মানিত মানুষ দ্বিতীয় কেউ নেই। শাস্ত্রীজির পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সব কিছু শুদ্ধ। এমন একটি মানুষকে এই নরকে টেনে এনে তাঁর মারাত্মক ক্ষতি করা হয়েছে। খবরটা জানাজানি হলে শিউশঙ্করের সুনাম এবং মর্যাদা একেবারে ধবংস হয়ে যাবে। তাছাড়া জনকপুরের মানুষ সাগিয়াদের ছেড়ে দেবে না। রামসীতা মন্দিরের মাননীয় পুরোহিতকে রাণ্ডিটোলায় টেনে এনে ভ্রষ্টাচারের পথে ঠেলে দেবার কারণে তাদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে।

সাগিয়ারা শিউশঙ্করকে আগে না দেখলেও তাঁর নাম প্রচুর শুনেছে। জনকপুরের হাওয়ায় ভেসে ভেসে তাঁর মহত্ত্ব এবং ব্রহ্মচর্যের নানা খবর এই নরক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।

সাগিয়া শিউরে ওঠে। দরজার বাইরে অন্য মেয়েমানুষগুলো ভয়ে কাঁপতে থাকে।

সবার প্রতিনিধি হিসেবেই হাতজোড় করে করুণ মুখে সাগিয়া বলে, ‘হামনিকা কোই কসুর নহী পাওনজি—’ তারপর কীভাবে, কোন অবস্থায় নিতান্ত নিরুপায় হয়েই নৌহর নদী থেকে শিউশঙ্করকে তুলে এনেছে, সব কিছু কাঁপা ভয়ার্ত গলায় বলে যায়।

কঠোর মুখ করে তাকিয়ে ছিল পাওনলাল। সব শোনার পর তাঁর কাঠিন্য অনেকটা কেটে যায়। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলে, ‘হাঁ, ওই অবস্থায় ফেলে আসা যায় না। পরে শাস্ত্রীজিকে এর প্রায়শ্চিৎ করে নিতে হবে।’ বলতে বলতে শিউশঙ্করের কপালে একটা হাত দিয়েই সরিয়ে নেয়। টিনের বাক্স থেকে থার্মোমিটার, স্টেথোস্কোপ ইত্যাদি বার করে প্রথমে জ্বরটা দেখে দেয়, তারপর স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক পিঠ পরীক্ষা করে বলে, ‘জ্বর তো অনেক। সুঁই (ইনজেকশন) দিতে হবে’ বলে তক্ষুনি সিরিঞ্জ এবং ওষুধের অ্যাম্পুল বার করে শিউশঙ্করের ডান হাতে ইনজেকশন দেয়। তারপর এক গাদা বড়ি দিয়ে বলে, ‘হুঁশ ফিরলে সকালে, দুপুরে আর সন্ধ্যায় তিন বার দুটো করে খাওয়াবি।’

‘জি’—ঘাড় হেলিয়ে দেয় সাগিয়া।

‘দুপুরের মধ্যেই হুঁশ ফিরে আসবে। তখন গরম দুধ খাইয়ে দিস। রাতে এসে আমি আরেকটা সুই দিয়ে যাব।’

‘লেকেন পাওনজি—’

‘কী?’

‘শাস্ত্রীজিকে কি আমার খাওয়ানো ঠিক হবে।’

পাওনলাল বুঝতে পারে, নিজের ছোঁয়া দুধ খাওয়াতে চাইছে না সাগিয়া। বলে, দুঃসময়ে উপায় না থাকলে খাওয়াতে দোষ নেই। তবে দুধ ছাড়া অন্য কিছু যেমন ভাত, রোটি একেবারেই যেন না দেওয়া হয়। এমনিতেই পূর্বজন্মের কোনো পাপের কারণে এই নরকে আসতে হয়েছে শিউশঙ্করকে। ছোঁয়া অন্ন তাঁর পবিত্র শরীরে ঢুকলে মৃত্যুর পর তাঁর যে নরকবাস হবে তা অনন্ত। সে-পাপের আর প্রায়শ্চিত্ত নেই।

সাগিয়া আঁতকে উঠে বলে, ‘নহী নহী, মরে গেলেও ভাত খাওয়াব না।’

‘আর একটু সুস্থ হলেই শাস্ত্রীজিকে পাঠিয়ে দিবি। দেখিস কেউ যেন এখান থেকে তাঁকে বেরুতে না দ্যাখে।’

‘হ্যাঁ।’

‘এবার দশটা টাকা দে। আমার ফি, রিকশাভাড়া, দাওয়া আর সুঁই-এর দাম।’

পাওনলাল লোকটা যেমন হিসেবি তেমনি হুঁশিয়ার। নিজের পাওনাকড়ি বুঝে নিয়ে সে চলে যায়।

তারপর রাণ্ডিটোলার বাসিন্দাদের মধ্যে একটা গোপন পরামর্শ-সভা বসে। প্রথমে তারা এটুকুই জেনেছিল, বেহুঁশ মানুষটা ব্রাহ্মণ। তাতেই তাদের আজন্মের সংস্কারে ধাক্কা লাগে। কিন্তু পাওনলালের কাছে যখন জানতে পারল মানুষটি শিউশঙ্কর শাস্ত্রী—তখন থেকেই উৎকণ্ঠা, শঙ্কা এবং চাঞ্চল্য বহুগুণ বেড়ে গেছে। পাওনলালের কথামতো তারা ঠিক করে ফেলে, শাস্ত্রীজি যখন এখানে এসেই পড়েছেন, তাঁর মর্যাদা এবং সম্মান যাতে এতটুকু নষ্ট না হয় সেদিকে নজর রাখবে। সন্ধে নামতে না নামতেই এখানে চোর বজ্জাত শরাবী ইত্যাদি ইত্যাদি যত হারামজাদাদের ছৌয়ারা ঝাঁকে ঝাঁকে হানা দিতে থাকে। যে ক-দিন শাস্ত্রীজি থাকবেন, তাদের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। বাইরের লোক এখানে আসা মানেই শাস্ত্রীজির খবরটা চারিদিকে চাউর হয়ে যাবে। তাঁর মুখে চুনকালি লাগে, এমন কাজ তারা হতে দেবে না।

দুপুরবেলা মেঘ কেটে টলটলে সোনালি রোদ বেরিয়ে পড়ে। ঝির ঝির করে হাওয়া বইতে থাকে। আজ আকাশের দিকে তাকালে কে বলবে, কাল ওই রকম একটা মারাত্মক দুর্যোগ এই অঞ্চলটার ঘাড় মুচড়ে সব কিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে।

তোহরি আর লছিমার দুটো বড়ো বোতলে গঙ্গাজল ছিল। কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলে তাতে গঙ্গাপানি মিশিয়ে মেয়েমানুষগুলো প্রথমে পুরো রাণ্ডিটোলাটা ধুয়ে ফেলে।

শুধু তাই না, কয়েক মাস আগে দুটো স্টিলের ঢাকনাওলা বড়ো বাটি কিনেছিল সাগিয়া। সে- দুটো আনকোরা নতুন রয়ে গেছে। বাক্স থেকে একটা বাটি বার করে কাছাকাছি এক খাটাল থেকে টাটকা দুধ এনে জ্বাল দিয়ে রাখে। শাস্ত্রীজির হুঁশ ফিরলে খাওয়াতে হবে।

পাওনলাল বৈদ যা বলেছিল, অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। দুপুরের কিছুক্ষণ বাদে জ্ঞান ফিরে আসে শিউশঙ্করের। লাল টকটকে চোখ মেলে সাগিয়ার দিকে তাকান। ঘোরলাগা জড়ানো গলায় বলেন, ‘তুমি কে?’

বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে সাগিয়ার। আবছা গলায় বলে, ‘আমাকে চিনবেন না।’

আর কোনো প্রশ্ন করেন না শিউশঙ্কর। আস্তে আস্তে আবার তাঁর চোখ বুজে আসে।

ফিসফিস করে সাগিয়া ডাকে, ‘শুনিয়ে, দুধ পী—’ এই পর্যন্ত বলে থেমে যায়।

শিউশঙ্কর সাড়া দেন না, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। সেই ঘুম সহজে ভাঙতে চায় না।

একসময় বিকেল পেরিয়ে সন্ধে নেমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শরাবী জানোয়ারেরা ঝাঁকে ঝাঁকে হানা দিতে থাকে। তোহরি, লছিমা, শুগা এবং আরো কয়েকটি মেয়েমানুষ তাদের ভাগিয়ে দেয়। ফূর্তি করতে যারা এসেছিল, আশাভঙ্গের কারণে খিস্তি করতে করতে তারা চলে যায়।

একজন বলে, ‘কা রে, সতী পার্বতী বন গয়ী? শালী রাণ্ডি—’

আরেকজন বলে ‘বেওসা বন্ধ কর দিয়া? ইধরি মন্দির বনেগা—কা?’

যাদের উদ্দেশ্যে বলা, তারা উত্তর দেওয়া প্রয়োজন বোধ করে না।

রাতে পাওনলাল আবার আসে। রোগি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে আরেকটা ইনজেকশন দিয়ে চলে যাবার কিছুক্ষণ বাদে জ্বরটা অনেক নেমে যায় শিউশঙ্করের, বিকেলের সেই ঘুমটাও ভাঙে। তার চোখে সেই ঘোর ঘোর ভাব অতটা আর নেই। তিনি দেখতে পান তক্তাপোশের পাশে নীচের ফাঁকা জায়গাটায় কয়েকজন মেয়েমানুষ বসে আছে। তাদের চোখেমুখে ভয়, উদবেগ এবং গভীর দুর্ভাবনার ছাপ। তিনি জানেন না, এই মেয়েমানুষেরা আজ প্রায় সারা দিনই এখানে পালা করে বসে আছে। মাঝে মাঝে দু-একজন উঠে গিয়ে কোনোরকমে দুটো চালডাল ফুটিয়ে, খানকতক রোটি সেঁকে নাকেমুখে গুঁজে এসেছে। আর শরাবীরা যখন সদর দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছিল তখন শুধু বার কয়েক উঠে গিয়ে ভাগিয়ে এসেছে।

শিউশঙ্কর অবাক নির্জীব চোখে প্রতিটি মেয়েকে দেখতে দেখতে বলেন, ‘তোমরা কারা?’

সাগিয়াই উত্তর দেয়, ‘আমরা কেউ না দেওতা।’

‘আমি এ ঘরে এলাম কী করে? এখানকার কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’

সাগিয়া বলে, ‘ঝড়তুফানে কাল তৌহর নদীতে নৌকাডুবি হয়েছিল—মনে আছে?’

আস্তে মাথা হেলান শিউশঙ্কর, ‘হাঁ। তুমি জানলে কী করে?’

‘আমি সেই নৌকায় ছিলাম।’

‘আমি খেয়াল করিনি।’

সাগিয়া এবার বলে তুফানে নৌকো উল্টে যাবার পর সে কীভাবে শিউশঙ্করকে এখানে নিয়ে এসেছে।

কৃতজ্ঞ চোখে সাগিয়ার দিকে তাকান শিউশঙ্কর। ‘—তুমিই তাহলে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ! ভগোয়ান রামচন্দ্রজি তোমার কল্যাণ করবেন।’

সাগিয়া এবার ভয়ে ভয়ে জানায়, বৈদজিকে ডেকে শিউশঙ্করকে দেখানো হয়েছে। তাঁকে দু-দু-বার সুঁই দেওয়া হয়েছে। বৈদ প্রচুর দাওয়া দিয়ে গেছে, এবং বলেছে রোগির হুঁশ ফিরলে যেন দুধ খাওয়ানো হয়। নইলে শরীরে তাকত আসবে না। তিনি কি এখন দুধ খাবেন?

মাথা নাড়েন শিউশঙ্কর, অর্থাৎ খাবেন।

সাগিয়া ভয়ে ভয়ে বলে, ‘লেকেন—’

‘কী?’

‘আমি—আমাদের ছোঁয়া কি খাবেন?’

মৃদু হাসেন শিউশঙ্কর, ‘খাব না কেন? নিয়ে এসো। ভুখ লাগছে।’

‘আমরা—আমরা নরকের পোকা দেওতা। আর এটা দুনিয়ার সব চেয়ে নোংরা জায়গা।’ বলতে বলতে সাগিয়ার ঠোঁট কাঁপতে থাকে।

এতক্ষণে শিউশঙ্কর বুঝে ফেলেছেন, তাঁকে কোথায় এনে তোলা হয়েছে। প্রথমটা শিউরে ওঠেন তিনি। আবহমান কালের সংস্কারে তাঁর চোখমুখ এবং শরীরের মাংসপেশি কুঁকড়ে যেতে থাকে। অসহ্য কষ্টে তাঁর হৃৎপিণ্ড যেন ফেটে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

শিউশঙ্করের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে মারাত্মক ভয় পেয়ে যায় ঘরের সব ক-টি মেয়েমানুষ। রুদ্ধশ্বাসে তারা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। তারপরেই ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যান শিউশঙ্কর। স্নিগ্ধ হেসে বলেন, ‘তুমি আমার জীবন দিয়েছো। দুধ নিয়ে এসো।’

সাগিয়া এবং অন্য মেয়েমানুষগুলোর রক্তের ভেতর দিয়ে বিজরী চমকে যায়। সাগিয়া দৌড়ে দুধের বাটিটা নিয়ে এসে আস্তে আস্তে তাঁর মুখে ঢেলে দিতে থাকে। অন্য মেয়েগুলো হাতজোড়া করে বসে থাকে।

দুধ খাওয়ার পর ওষুধ খেয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়েন শিউশঙ্কর।

পরদিন সকালে অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেন শিউশঙ্কর। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে সাগিয়াকে বলেন, ‘একটা রিকশা ডেকে দাও, এবার আমি যাব।’

সাগিয়া আঁতকে ওঠে, ‘লেকেন—’

‘কী হল?’

‘এই দিনের বেলা আপনাকে এই নরক থেকে বেরুতে দেখলে জনকপুরের আদমিরা কী বলবে!’

‘কে কী বলল, কে কি ভাবল, এ নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। তোমরা, বিশেষ করে তুমি আমার প্রাণ দিয়েছ, এটা মৃত্যু পর্যন্ত মনে থাকবে।’

সাগিয়া বলল, ‘কিরপা করে এই নরকের কথা মনে রাখবেন না।’

কিছুক্ষণ পর রাণ্ডিটোলার বাইরের রাস্তায় একটা সাইকেল রিকশায় গিয়ে ওঠেন শিউশঙ্কর। সাগিয়া এবং অন্য মেয়েমানুষগুলো হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে।

একটু পরে রিকশা চলতে শুরু করে।

মেয়েমানুষগুলো ভাবে, একটি দিনের জন্য এখানে স্বর্গের পবিত্রতা নেমে এসেছিল। এরপর আহ্নিক এবং বার্ষিকগতির নিয়মে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আসবে—যাবে, কিন্তু এই দিনটি আর কখনও ফিরে আসবে না। হয়তো গুছিয়ে এইভাবে তারা ভাবতে পারছে না, তবে ভাবনাটা মোটামুটি এই রকমই।

আর চলতে চলতে সাগিয়ার মুখটাই শুধু মনে পড়ছে শিউশঙ্করের। সে বার বার নরকের কথা বলছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে স্বর্গ এবং নরকের মাঝখানের সীমারেখাটা যেন ধরতে পারছিলেন না শিউশঙ্কর।

সকল অধ্যায়

১. বিচারক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. ডালিম – চিত্তরঞ্জন দাশ
৩. চন্দ্রমুখী – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪. ঠিকানায় ‘বুধবার’ – জগদীশ গুপ্ত
৫. কুসুম – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৬. আদরিণী – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
৭. সাকীর প্রথম রাত্রি – রমেশচন্দ্র সেন
৮. হিঙের কচুরি – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. মেলা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১০. মন্দ লোক – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. দন্ত কৌমুদী – বনফুল
১২. গোষ্পদ – যুবনাশ্ব
১৩. ইতি – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
১৪. খট্টাঙ্গ পুরাণ – শিবরাম চক্রবর্তী
১৫. দুকানকাটা – অন্নদাশংকর রায়
১৬. চাচা কাহিনি – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৭. বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৮. অঙ্গার – প্রবোধকুমার সান্যাল
১৯. নমুনা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২০. চোর! চোর! – বুদ্ধদেব বসু
২১. বারবধূ – সুবোধ ঘোষ
২২. ট্যাক্সিওয়ালা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
২৩. বাইজি – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৪. তিমিরাভিসার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. জামাই – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
২৬. তলানি – নবেন্দু ঘোষ
২৭. মাশুল – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
২৮. শনি – সন্তোষকুমার ঘোষ
২৯. আঙুরলতা – বিমল কর
৩০. সুর্মা – রমাপদ চৌধুরী
৩১. ঘরন্তী – বিমল মিত্র
৩২. প্রাণ-পিপাসা – সমরেশ বসু
৩৩. বাগাল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৪. ছদ্মবেশিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. নরক – প্রফুল্ল রায়
৩৬. পহেলি পেয়ার – বুদ্ধদেব গুহ
৩৭. নিরুদ্দেশ প্রাপ্তি হারানো – সমরেশ মজুমদার
৩৮. বেওয়ারিশ লাশ – জাহান আরা সিদ্দিকী
৩৯. ঝরা পাতা – তসলিমা নাসরিন
৪০. নিজের সঙ্গে দেখা – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন