কুসুম – হেমেন্দ্রকুমার রায়

ক.

সে পতিতা। জীবনের ক্ষণিক ভ্রমেতে নয়,—বিধাতার বিধানে সে পতিতা। …পঙ্কের ভিতরে পদ্মের মতই কুসুম ফুটিয়া উঠিয়াছিল।

ঘরে ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বলিয়া উঠিবার আগেই, পথের ধারের বারান্দায় কুসুম তাহার রূপের প্রদীপ উজল করিয়া বসিয়া থাকিত। তাহার প্রাণ তখন কাঁদিত, মুখ হাসিত।

রাস্তার লোকগুলা যেন ‘ঊর্ধ্বমুণ্ড’ ব্রত গ্রহণ করিয়াছে,—সকলের চোখ তাহার উপরে! তাহাদের সেই নিষ্ঠুর, ক্ষুধিত ও ঘৃণিত দৃষ্টির মাঝে কুসুম, বিশ্বের নারী জাতির প্রতি মৌন ধিক্কারকে ফুটিয়া উঠিতে দেখিতে পাইত।

রাস্তায় গাড়ির পর গাড়ি ছুটিতেছে। এক-একখানা গাড়ির খড়খড়ি কপাট সব তোলা। কিন্তু কুসুম দেখিত, খড়খড়ির ফাঁকে ফাঁকে কুললক্ষ্মীদের কৌতূহলী দৃষ্টি বাহিরের মুক্ত আলোর দিকে একাগ্র হইয়া আছে। সে দৃষ্টি কুসুমের উপর পড়িলেই সচকিত হইয়া উঠিত। কুসুমের মনে হইত, সে পবিত্র নয়নের নির্মল দৃষ্টি যেন বিদ্যুতাগ্নির মত তার দেহ মনকে ঝলসাইয়া দিয়া যাইতেছে। মরমে মরিয়া কুসুম, বারান্দার রেলিঙে মাথা রাখিয়া বসিয়া থাকিত। দেহের ভিতর হইতে তাহার নারী প্রাণ যেন কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিত, ‘এ রূপের প্রদীপ নিবিয়ে দাও,—ওগো কঙ্কালের বাঁধন খুলে দাও।’

খ.

বারান্দা হইতে কুসুম সেদিন উৎকণ্ঠিত হইয়া দেখিল, ট্রামগাড়ি থেকে নামিতে গিয়া একটি ভদ্রলোক পা ফস্কাইয়া রাস্তার উপরে পড়িয়া গেলেন। গাড়িসুদ্ধ লোক হাঁ হাঁ করিয়া উঠিল, কিন্তু গাড়ি না থামাইয়া চালক আরও জোরে গাড়ি চালাইয়া দিল।

পাথরে মাথা ঠুকিয়া বৃদ্ধ একেবারে অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। তাঁহার চারিপাশে ক্রমেই লোক জড় হইতে লাগিল।

একজন বলিল, ‘ওহে, মাথা দিয়া রক্ত পড়চে যে।’

আর একজন বলিল, ‘মরে যায় নি ত।’

আর একজন বলিল, ‘উঁ হু?’

আর একজন বলিল, ‘মরে নি, কিন্তু মরতে কতক্ষণ। চলহে এখনি পুলিশটুলিস এসে পড়বে, আর সাক্ষী মেনে থানায় ধরে নিয়ে যাবে।’

বারান্দার উপরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া আকুলচোখে কুসুম দেখিল, সবাই গোলমালই করিতেছে, বৃদ্ধকে সাহায্য করা কাহারও ইচ্ছা নয়।

কুসুম আর থির থাকিতে পারিল না, তাড়াতাড়ি উপর হইতে নামিয়া আসিল।

ভিড় ঠেলিয়া সে ভিতরে গেল। অচেতন বৃদ্ধের দিকে একবার চাহিয়া কুসুম বলিল, ‘আপনারা এঁকে দয়া করে আমার ঘরে তুলে দিয়ে আসবেন? নৈলে ইনি মারা যাবেন।’

তিন-চারজন লোক ছুটিয়া আসিল।

ভীরের ভিতরে ফিসফিস করিয়া একজন বলিল, ‘বুড়োটা এর কে রে?’

আর একজন বলিল, ‘হেঁ! তা আর বুঝতে পারচ না ম্যাড়াকান্ত?’—সে একটা অর্থপূর্ণ ঈশারা করিল। অনেকেই হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।

কুসুম সে সব কানেও তুলিল না। চোখ নামাইয়া সে মাটির দিকে তাকাইয়া রহিল।

চারজন লোকে ধরাধরি করিয়া বৃদ্ধকে তুলিয়া ধরিল। তখনও তাঁর জ্ঞান হয় নাই , মাথায় রক্ত পড়াও বন্ধ হয় নাই। তাঁর মুখ একদিকে হেলিয়া আছে,—হাত দুখানি অসহায়ভাবে দুদিকে ঝুলিয়া পড়িয়াছে। কুসুম আস্তে আস্তে হাত দুটি আবার বৃদ্ধের বুকের উপরে তুলিয়া দিল।

পিছন হইতে কে একটা অসভ্য উচ্চকন্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘যত্ন করবার এমন মনের মানুষ পেলে আমিও বাবা, দিনে দুশোবার ট্রাম থেকে পড়ে যেতে রাজি আছি।’

গ.

একরাত একদিন গিয়াছে, বৃদ্ধ তেমনি অজ্ঞান।

কুসুম একরকম খাওয়া-দাওয়া ভুলিয়া তাঁহার সেবাশুশ্রূষা করিতেছে।

সে নিজের কাপড় ছিঁড়িয়া বৃদ্ধের ক্ষতস্থানে বাঁধিয়া দিয়াছে , রাতভোর জাগিয়া বিছানার পাশে বসিয়া তাঁকে পাখার হাওয়া করিয়াছে। বাড়ির তলায় একজন ডাক্তার থাকিত, কুসুম তাহাকে ডাকাইয়া আনিয়াছিল।

কিন্তু সকাল গেল, বিকাল গেল—কৈ রোগীত এখনো চোখ মেলিয়া চাহিলেন না। কুসুম ভাবনায় পড়িল। সন্ধ্যার সময়ে বৃদ্ধের গায়ে হাত দিয়া কুসুম দেখিল, গা যেন আগুন।

ভয় পাইয়া তখনি সে চাকরকে একজন নামজাদা ডাক্তার ডাকিয়া আনিতে বলিল।

ডাক্তার আসিল। সে বয়সে যুবক। সবে বিলাত হইতে ফিরিয়াছে।

পরীক্ষার পর ডাক্তার বলিল, ‘এঁর অবস্থা বড় ভালো নয়।’

কুসুম কাতরে বলিল, ‘তবে কি হবে?’

‘ভালো করে চিকিৎসা হলে, বিশেষ কোনো ভয় নেই।’

রোগীর মাথায় ‘ব্যাণ্ডেজ’ বাঁধিয়া ও ‘প্রেসক্রিপসন’ লিখিয়া ডাক্তার উঠিয়া দাঁড়াইল।

কুসুম, ডাক্তারের হাতে ‘ভিজিট’-এর টাকা ক’টা গুঁজিয়া দিল।

আঙুল দিয়া টাকাগুলি অনুভব করিতে করিতে কুসুমের দিকে চাহিয়া ডাক্তার বলিল, ‘ইনি তোমার কে?’

কুসুম কি উত্তর দিবে ভাবিতেছে, কিন্তু তার আগেই ডাক্তার বলে, ‘ইনি বুঝি…’

ডাক্তার কি বলিবে, সেটা আগে থাকিতেই আন্দাজ করিয়া তাহার কথা শেষ না হইতে হইতেই কুসুম সবেগে মাথা নাড়া দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘না, না, না।’

তবে?

কুসুম অল্প দু-চার কথায় সব বুঝাইয়া দিল।

ডাক্তার খানিকক্ষণ কি ভাবিল। তারপর বলিল, ‘দেখ, তুমি এক কাজ কর এঁকে কাল সকালেই হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও। সেখানে ভালো চিকিৎসাও হবে, আর হঠাৎ কিছু হলে তোমারও কোন দায়দোষ থাকবে না।’

দরজার কাছে দাঁড়াইয়া এক প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক ডাক্তারের কথা একমনে শুনিতে ছিল। এখন, হঠাৎ সে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া বলিল, ‘আমিও তাই বলি ডাক্তারবাবু! দ্যাখদিকিন, কোথাকার আপদ কার ঘাড়ে এসে পড়ল। ও ছুঁড়ির মতিচ্ছন্ন হয়েছে, আমার কথাতে কিছুতেই ও কান পাতবে না। আপনাদের পাঁচজনের দয়ায় কোন রকমে দু’টাকা পাঁচটাকা ঘরে আসে, তা ও হ্যানরে-ত্যানরে, রুগীরে ডাক্তার রে, ওষুধ রে পত্তি রে, ভালোমানসের ওসব কি পোষায়, না ভালো দ্যাখায়? তা তুই—’

কোন রকম উত্তরের অপেক্ষা না রাখিয়া আপনমনে সে গড়গড় করিয়া বলিয়া যাইতেছিল, কিন্তু কুসুম অধীর হইয়া বলিয়া উঠিল, ‘যা তুই থাম বলছি।’

‘থামব? কেন থামব? হক কথা বলব, না—’

‘ফের যদি ফ্যাচ-ফ্যাচ করবি না, তাহলে এই ঘট দিয়ে—’ বলিতে বলিতে কুসুম জলের ঘটির দিকে হাত বাড়াইল।

কুসুমের মা ভয় পাইয়া ঘর থেকে বাহির হইয়া নীচে নামিয়া গেল, এবং সেখান হইতে অকথ্য ভাষায় মেয়েকে গালি পাড়িতে লাগিল।

সে দিকে কান না পাতিয়া কুসুম ডাক্তারকে বলিল, ‘এঁর জ্ঞান হবে কখন?’

ডাক্তার এতক্ষণ চুপটি করিয়া কি এক চোখে কুসুমের দিকে চাহিয়াছিল। তাহার প্রশ্ন শুনিয়া বলিল, ‘আজ রাতেই জ্ঞান হতে পারে। তবে, বলা যায় না।’

তারপর হাত বাড়াইয়া বিছানার উপর হইতে টুপিটা তুলিয়া লইয়া বলিল, ‘তবে, আমি এখন চল্লুম।’

‘আসুন’, —কুসুম ডাক্তারকে নমস্কার করিল।

যাইতে যাইতে হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িয়া ডাক্তার বলিল, ‘দেখ, তোমার ‘ভিজিটে’র টাকা ফিরিয়ে নাও।’

কুসুম বিস্ময়স্বরে বলিল, ‘কেন?’

ডাক্তার স্নিগ্ধচোখে কুসুমের চকিত চোখের দিকে চাহিয়া শুধু বলিল, ‘না।’

কুসুম অত্যন্ত সন্দেহ ও বিরক্তির সহিত কহিল, ‘কেন নেবেন না, বলুন আপনি।’

কুসুমের মনের ভাব বুঝিয়া ডাক্তার মুখ টিপিয়া নীরব হাস্য করিল। তারপর হাতের টাকাগুলো ঝন ঝন-শব্দে বিছানার উপরে ছুঁড়িয়া দিয়া, জুতা মসমস করিতে করিতে তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল।

কুসুম খানিকটা ঘাড় হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আপনমনে অস্ফুট ও দুঃখিত কন্ঠে বলিল, ‘এমন পোড়া মন নিয়ে সংসারে এসেছি যে, সাধুকেও সন্দেহ হয়।’

ঘ.

অনেক রাতে রোগীর জ্ঞান হইল।

পাশ ফিরিয়া থামিয়া থামিয়া তিনি বলিলেন, ‘বুক জ্বলে যাচ্ছে—একটু জল।’

পাখার বাতাস করিতে করিতে তখন কুসুমের সবে একটু তন্দ্রা আসিয়াছে। রোগীর গলা শুনিয়া ধড়মড় করিয়া সে উঠিয়া বসিল। তাড়াতাড়ি কুঁজা হইতে একটা কাচের গেলাসে জল গড়াইয়া সে রোগীর মুখের কাছে ধরিল।

জলপান করিয়া রোগী আরাম পাইলেন। কুসুম তাঁহার তপ্ত কপালে আপনার ঠাণ্ডা হাতদুখানি আলতোভাবে বুলাইয়া দিতে লাগিল। তিনি ‘আঃ’ বলিয়া চোখ বুঁজিলেন।

খানিক পরে আবার তাহার তৃষ্ণা পাইল। কুসুম আবার জল দিল।

রোগী খানিকক্ষণ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন, ‘কে? মা সুধা’?

মুখ ফিরাইয়া কুসুম বলিল, ‘না, না! আমি পোড়াকপালী!’

রোগী চোখ খুলিয়া আপনা-আপনি বলিলেন, ‘এত রাত অবধি জেগে আছিস মা।’ মা! সে-কি কথা, সে কি সুর।—কুসুমের সারা বুক ভরিয়া উঠিল। খাটের পরে মাথা রাখিয়া সে একমনে, সেই সুর আপন মনের মধ্যে উল্টাইয়া পাল্টাইয়া শুনিতে লাগিল।

তার বোধ হইল, সে যেন এই বিপন্ন বৃদ্ধের আপন কন্যা। বাবা যে কেমন, কুসুম তো একথা কখনোই জানে নাই, —আজ যেন তারই একটা অজানা আনন্দের আভাস প্রাণে তার জাগিয়া উঠিল।

হঠাৎ ঘরের দরজায় বাহির হইতে করাঘাত হইল।

কে ডাকিল, ‘কুসুম!’

কুসুম শুনিয়াও শুনিল না। সে তখনও বুঝি মা-ডাক শুনিতেছে।

‘কুসুম! —অ আমার কুসুম কলি।’

কুসুম চুপ।

‘ও কুসুম, শুনচ?’ সঙ্গে-সঙ্গে আগন্তুক বাজখাই গলায় একটা গান ধরিয়া বসিল। সেত গান নয়—যেন ষাঁড়ের ডাক !

এবারে কুসুমের মনে ভারি ভয় হইতে লাগিল, —রোগী যদি শুনিতে পান?

(হঠাৎ গান থামাইয়া) ‘ওগো কুসুম,—ও—’ কিন্তু কথা শেষ হইতে না হইতেই হঠাৎ নীরবে দরজাটা খুলিয়া গেল এবং বিদ্যুতের মত বাহিরে মুখ বাড়াইয়া নিম্ল অথচ তীব্রস্বরে কুসুম বলিল, ‘ফের যদি কুসুম কুসুম করবে, তাহলে ঝাঁটা মেরে বিষ ঝেড়ে দেব। বেরোও এখানে থেকে—।’

যেমন সহসা দরজাটা খুলিয়াছিল অমনি সহসা আবার বন্ধ হইয়া গেল।

ঙ.

পরদিনের সন্ধ্যাবেলা। কুসুম জানালার কাছে একলাটি বসিয়াছিল !

আজ সকালে রোগীর জ্বর হঠাৎ বাড়িয়া উঠাতে কুসুম ভয় পাইয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও রোগীকে হাসপাতালে পাঠাইয়া দিয়াছে। না দিয়া আর উপায় কি?

আপন জীবনের মলিনতা, কুসুমকে সবসময়েই কাতর করিয়া রাখিত। ওই মলিনতার ভিতরে থাকিয়াও, সে যে একটা ভালো কাজ করিতে পারিয়াছে, এটা ভাবিয়াও মন তার সন্তোষ ও পুলকে ভরিয়া উঠিতেছিল।

আর, রোগীর উপরে তার কেমন একটা মায়াও পড়িয়া গিয়াছিল। রোগীর সেই রোগকাতর মুখখানি এখনও তার প্রাণের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারিতেছিল।

দিনের ভিতরে চার-পাঁচবার চাকর পাঠাইয়া কুসুম রোগীর খবর লইয়াছে। জানিয়াছে যে, রোগীর বাড়ির লোকেরা কেমন করিয়া সংবাদ পাইয়া হাসপাতালে আসিয়াছে।

তিন-চারদিন পরে শুনিল, রোগীর জ্বর বন্ধ হইয়াছে, কাল তিনি নিজের বাড়িতে ফিরিবেন।

একটা অস্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া কুসুম ভগবানকে ধন্যবাদ দিল। ঠিক করিল আজই সে রোগীকে একবার দেখিতে যাইবে।

চ.

হাসপাতালের সুমুখে আসিয়া কুসুম গাড়ি হইতে নামিল। ফুলদার রেশমী চাদরখানি মাথার উপরে টানিয়া দিয়া চাকরের সঙ্গে চলিল। চাকর তাহাকে রোগীর ঘর চিনাইয়া দিল। আস্তে আস্তে দরজা ঠেলিয়া কুসুম ভিতরে ঢুকিল।

একটা বালিশে ঠেসান দিয়া বৃদ্ধ বসিয়া আছেন। পাশে একটি যুবক ও একটি বয়স্কা রমণী। বৃদ্ধ কি কথা কহিতেছিলেন,—হঠাৎ কুসুমকে ঢুকিতে দেখিয়া বলিতে বলিতে থামিয়া গেলেন।

কুসুম সঙ্কুচিতভাবে আগাইয়া গিয়া বৃদ্ধের পায়ে মাথা ছোঁয়াইয়া ভক্তিমতী কন্যার মত প্রণাম করিল।

কুসুমের দিকে চাহিয়া বিস্মিত বৃদ্ধ বলিলেন, ‘কে মা তুমি?’

কুসুম মৃদুস্বরে বলিল, ‘আমাকে চিনতে পারছেন বাবা?’

ভালো করিয়া কুসুমের মুখ দেখিতে দেখিতে বৃদ্ধ বলিলেন, ‘হুঁ, চিনি-চিনি করচি বটে! বোধ হয়—বোধ হয়, অসুখের সময়ে তোমাকে কোথায় দেখেচি। তাই নয় কি?’

কুসুম ঘাড় নাড়িয়া জানাইল। হ্যাঁ।

‘রোসো—রোসো, মনে পড়েচে। তুমি কি আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলে, আমাকে জল খেতে দিয়েছিলে?’

ট্রাম থেকে পড়ে গেলে পর আপনাকে আমি আমার ঘরে তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। আপনি আমার বাড়িতে দু-রাত ছিলেন। তারপর আপনার জ্বর বেড়ে ওঠাতে আমি ভয় পেয়ে আপনাকে এখানে পাঠিয়ে দি। আপনি ভালো আছেন শুনে একবার দেখে যেতে এসেছি।

বৃদ্ধ মুখ নীচু করিয়া কি ভাবিতে লাগিলেন। তারপর, কুসুমের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার খরচোখে দেখিয়া লইয়া চিন্তিতভাবে বলিলেন, ‘তোমার ঘরে, তোমার হাতে আমি জল খেয়েচি, —বল কি , অ্যাঁ!’

বৃদ্ধের ভাব দেখিয়া কুসুম থ হইয়া গেল।

তীব্রস্বরে বৃদ্ধ বলিলেন, ‘হ্যাঁ—হ্যাঁ, আরও মনে পড়চে। তুমি আমাকে দুধ আর সাবুও খেতে দিয়েছিলে।’ একটু থামিয়া হঠাৎ বিছানার উপরে সোজা হইয়া বসিয়া, উগ্রকন্ঠে তিনি আবার বলিয়া উঠিলেন, ‘গণিকা তুই,—জানিস, আমি ব্রাহ্মণ।’

কুসুমের মাথা হেঁট হইয়া গেল।

‘আমার জাত মেরেছিস? তার চেয়ে আমি মরে গেলাম না কেন? আমি মরে গেলাম না কেন? পাপিষ্ঠা, আবার কি করতে এখানে এসেছিস তুই?’

কুসুম কিছু বলিতে পারিল না। আড়ষ্ট ও জড়সড় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

বৃদ্ধ কর্কশস্বরে বলিলেন, ‘কথা ক! বল, কি চাস তুই? বখশিষ?’

বখশিষ!—কুসুমকে ঠিক যেন কে একটা ধাক্কা মারিল। গর্বিতভাবে হঠাৎ মাথা তুলিয়া দৃঢ়স্বরে সে বলিল, ‘হ্যাঁ?’

বালিশের তলা থেকে একখানা দশটাকার নোট বাহির করিয়া, বৃদ্ধ অবজ্ঞাভরে কুসুমের দিকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন। নোটখানা কুসুমের গায়ে লাগিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।

কুসুম হেঁট হইয়া নোটখানা তুলিয়া লইল। তারপর কোন দিকে না-চাহিয়া নতমুখে দৃঢ়পদে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।…

কুসুম, রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইল।

একটা খোঁড়া ভিখারী হাত পাতিয়া বলিল, ‘মা, কিছু ভিক্ষে দাও মা।’

কুসুম অত্যন্ত তাড়াতাড়ি নোটখানা ভিখারীর হাতে গুঁজিয়া দিল।

ভিখারী প্রথমটা হতভম্ব হইয়া গেল। তারপর কুসুমের পায়ের তলায় পড়িয়া গদগদ কণ্ঠে বলিল, ‘জয় হোক রাজা-মা,—জয় হোক।’

কিন্তু সে জয়ধবনি কুসুমের কানে প্রবেশ করিল না। বধির হইয়া সে রৌদ্রদীপ্ত আকাশের অনন্ত নীলিমার দিকে চাহিল,—হায়, তাহার অশ্রু-অন্ধ চোখে বিশ্ব আজ অন্ধকার—অন্ধকার!

সকল অধ্যায়

১. বিচারক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. ডালিম – চিত্তরঞ্জন দাশ
৩. চন্দ্রমুখী – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪. ঠিকানায় ‘বুধবার’ – জগদীশ গুপ্ত
৫. কুসুম – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৬. আদরিণী – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
৭. সাকীর প্রথম রাত্রি – রমেশচন্দ্র সেন
৮. হিঙের কচুরি – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. মেলা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১০. মন্দ লোক – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. দন্ত কৌমুদী – বনফুল
১২. গোষ্পদ – যুবনাশ্ব
১৩. ইতি – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
১৪. খট্টাঙ্গ পুরাণ – শিবরাম চক্রবর্তী
১৫. দুকানকাটা – অন্নদাশংকর রায়
১৬. চাচা কাহিনি – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৭. বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৮. অঙ্গার – প্রবোধকুমার সান্যাল
১৯. নমুনা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২০. চোর! চোর! – বুদ্ধদেব বসু
২১. বারবধূ – সুবোধ ঘোষ
২২. ট্যাক্সিওয়ালা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
২৩. বাইজি – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৪. তিমিরাভিসার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. জামাই – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
২৬. তলানি – নবেন্দু ঘোষ
২৭. মাশুল – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
২৮. শনি – সন্তোষকুমার ঘোষ
২৯. আঙুরলতা – বিমল কর
৩০. সুর্মা – রমাপদ চৌধুরী
৩১. ঘরন্তী – বিমল মিত্র
৩২. প্রাণ-পিপাসা – সমরেশ বসু
৩৩. বাগাল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৪. ছদ্মবেশিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. নরক – প্রফুল্ল রায়
৩৬. পহেলি পেয়ার – বুদ্ধদেব গুহ
৩৭. নিরুদ্দেশ প্রাপ্তি হারানো – সমরেশ মজুমদার
৩৮. বেওয়ারিশ লাশ – জাহান আরা সিদ্দিকী
৩৯. ঝরা পাতা – তসলিমা নাসরিন
৪০. নিজের সঙ্গে দেখা – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন