শনি – সন্তোষকুমার ঘোষ

বাবরি চুলের নীচে কামানো ঘাড়, পাউডারের ছোপ, ডানধারে বোতামওয়ালা পাঞ্জাবির তিনটে বোতামই খোলা। গোঁফের অতি সূক্ষ্ম অগ্রভাগে কী একটা কুটিল সংকল্পের ইঙ্গিত।

ভয়ে যমুনার মুখ শুকিয়ে গেল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বিনুনি করছিল, আস্তে আস্তে পিছিয়ে এল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল, কপালে এবং মধ্যে ক-ফোঁটা ঘাম জমেছে। আবার একটু ক্রিম ঘষতে হল।

তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে যমুনা নেমে এল নীচে। যদি নিরস্ত করতে পারে , আলের ওপর শুয়ে পড়েও ঠেকাতে পারে সর্বনাশের বন্যাজল।

কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই লোকটা ঢুকে পড়েছে! কপাটটা ভেতর থেকে দিয়েছে ভেজিয়ে।

দরজার বাইরে ধুলোয় থপ করে বসে পড়ল যমুনা। মেয়াদ তো ফুরিয়ে এসেছে। আর ঘন্টাখানেক পর এ ধুলোটুকুর ওপরও আর কোনো অধিকার থাকবে না। নরেশ যখন সব জানতে পারবে। যেমন আছে, এই পোশাকেই মাথা নীচু করে বেরিয়ে যেতে হবে, হয়ত ওই লোকটার সঙ্গেই, কালাপাহাড়ি নিষ্ঠুরতা নিয়ে আজ যে হানা দিয়েছে। বিষশ্বাস বাসুকি উঠে এসেছে পাতালের নিমন্ত্রণ নিয়ে।

দরজার ওপর কান পাতল যমুনা। বন্ধ ঘরের কথাবার্তা কিছু বোঝবার উপায় নেই। কেবল ফিস ফিস শব্দে একটা হীন চক্রান্তের ইঙ্গিত।

লোকটা যা বলবার সব বলেছে সন্দেহ নেই। ওর সাপুড়ের ঝাঁপি খুলেছে। যমুনার জীবনে একটিমাত্র মিথ্যা, একটিমাত্র প্রবঞ্চনা ফুল হয়ে উঠেছিল, তার এক-একটি পাপড়ি খুলছে।

যমুনার লোভ হল, একবার শোনে উত্তরে কী বলছে নরেশ। সে কি বিশ্বাস করেছে? বিশ্বাস না করেই বা উপায় কী? লোকটা এত তোড়জোড় করে যখন এসেছে, তখন কি আর উপযুক্ত প্রমাণ-দলিল না নিয়েই এসেছে।

দু-একবার মৃদুকন্ঠ শোনা গেল নরেশের। কথাগুলো যমুনা বুঝতে পারল না, কিন্তু স্পষ্ট যেন দেখতে পেল, অপ্রত্যাশিত, মর্মান্তিক সত্যের আঁচ লেগে চোখ-মুখ পুড়ে কালো হয়ে গেছে। কঠিন আঙুলের শিরাগুলো উঁচু হয়ে উঠেছে, চেয়ারের হাতল শক্ত মুঠিতে ধরে মাথা নীচু করে বসে আছে। পানপাত্র একবার নিঃশেষ করে লোকে যেমন শূন্যপাত্র এগিয়ে দিয়ে আবার ভরে দেবার নির্দেশ দেয়, তেমনিভাবে একটু একটু শুনছে নরেশ, ওর মাথাটা বুঝি একটু একটু টলছে , বলছে, তারপর, তারপর।

যমুনা জানে তারপর কী। ওই লোকটা বেরিয়ে যেতেই নরেশ নেমে আসবে টলতে টলতে। রাগে ঘৃণায় আরক্ত চোখে তাকাবে যমুনার দিকে। তারপর? লাথি মারবে, না চুলের ঝুঁটি ধরবে? নাকি গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে সদরে?

দিক। যমুনাও শক্ত করে বেঁধেছে মন। দু-দিনের স্বর্গসুখ যদি ঘুচেই যায়, যাক তবে। আস্তে আস্তে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল যমুনা। অল্প অল্প পা টলছে। তবু রেলিং ধরে অনায়াসেই উঠতে পারল ওপরে।

টেবিলের ওপর বিকেলে তুলে আনা ফুলগুলি এখনো অম্লান। বিছানার ওপর নতুন ভাঁজভাঙা চাদরটা পরিপাটি! সমস্ত মুখটা তেতো হয়ে গিয়ে একটা কান্না এল যমুনার। এ বিছানায় আর কোনোদিন শোওয়া হবে না। ফুলতোলা বালিশের মসৃণ ওয়ারগুলোর ওপর যমুনা একবার হাত বুলিয়ে নিল , ভিজে ওঠা কপোল বালিশের ঈষদুষ্ণ কোমলতার মধ্যে ডুবিয়ে চোখ বুজে রইল খানিকক্ষণ। এ স্বপ্ন যতক্ষণ থাকে, থাকনা।

কিন্তু একটু পরেই উঠতে হল তাকে! সারা শরীরে একটা অস্থিরতা, বুক জ্বলছে, গলা জ্বলছে। কতক্ষণে যাবে ওই লোকটা, কতক্ষণে ওপরে উঠে আসবে নরেশ।

আঁচলের চাবির গোছা খুলে যমুনা টেবিলের ওপর রাখল। গয়না সামান্যই আছে গায়ে, এগুলো প্রায় সবই নিয়ে যাবে। নতুন ব্যবসায়ের এগুলোই হবে পুঁজি।

কিন্তু এই দুল জোড়াটা? এটা নরেশের দেওয়া। এটাকে তো খুলে যেতে হবে। আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যমুনা চোখ থেকে গড়িয়ে নামা চোখের জলের ভিজে দাগ ঘষে ঘষে তুলল আঁচল দিয়ে। তারপর দুল জোড়া খুলতে চেষ্টা করল। কিন্তু কেঁপে যাওয়া হাত কেবলি ফসকে গেল। কানের গোড়ার চুলের সঙ্গে দুল জোড়া এমন জড়িয়ে গেছে, যে কিছুতেই খোলা গেল না। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল। যাক তবে। নিজ হাতেই নরেশ এটা খুলবে। হয়ত দেবে একটা হ্যাঁচকা টান, কানের লতি যাবে ছিঁড়ে, কয়েক ফোঁটা রক্ত আর চুলে জড়ানো দুল জোড়া নরেশ রেখে দেবে পকেটে। একটু ব্যথা হয়ত করবে যমুনার, শির শির করবে কান দু-টো, শরীরটা যাবে কাঠের মতো নিস্পন্দ হয়ে, দাঁতে চাপা ঠোঁট দিয়ে একটা যন্ত্রণাসূচক অব্যয় বেরিয়ে আসতে চাইবে। কিন্তু তবু সে এমন বেশি কী! যমুনা একবার দেখতে চায় কতো নিষ্ঠুর হতে পারে নরেশ।

টাইমপিস ঘড়িটা বাজছে টিক টিক করে। যমুনা তাকিয়ে দেখল সাড়ে ছ-টা। ওই শব্দ জানান দিচ্ছে, ফুরিয়ে এল, যমুনার বধূজীবনের পরমায়ু ফুরিয়ে এল। ওই শব্দের সঙ্গে তাল মেলে একমাত্র যমুনার আতঙ্কিত হৃৎস্পন্দনের। নিজের বিবাহিত জীবনের এই ক-টা দিনকে মনে মনে থিয়েটারের দুই অঙ্কের মধ্যবর্তী বিরতির সঙ্গে তুলনা করল যমুনা। অন্ধকার, রুদ্ধদ্বার প্রেক্ষাগৃহ, হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল, কয়েক মিনিটের জন্যে সব ক-টা দরজা গেল খুলে, কিন্তু তারপরেই আবার অন্ধকার।

অন্ধকার ছাড়া কী! নদেরচাঁদ বাই লেনের দিনগুলিকে অন্ধকার ঘরের দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কী মনে হতে পারে। আবার যমুনা ফিরে যাবে সেখানেই। মাকে গিয়ে বলবে, তোমার উচ্চাকাঙক্ষার অনেক সেলামি দিলুম মা, এবার ক্ষ্যামা দাও। আমি যা তাই থাকতে দাও।

তখন কী ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে হয়ে যাবে মাতঙ্গের মুখ? কী যে উদ্ভট খেয়াল হয়েছিল মাতঙ্গের। নিজের সারাজীবন কেটেছে নদেরচাঁদ লেনের পাঁকে, যেখানে সন্ধ্যা হতেই বেসুরো হারমোনিয়ামের আওয়াজ আর ঘুঙুরের বোল ওঠে। রাত একটা দু-টো পর্যন্ত শোনা যায় রিক্সার ঠুন ঠুন , প্রমত্ত নিশাচর বীটের পাহারাওয়ালাকে পালিয়ে ফেরে।

কিন্তু এ জীবনে মাতঙ্গের রুচি ছিল না। সে স্বপ্ন দেখত একটি ছোটো নীড়ের যেখানে সন্ধ্যাবেলা শাঁখ বাজে, ধূপ-সুরভিত ঠাকুর ঘরে একটিমাত্র স্নিগ্ধ ঘৃতদীপ জ্বলে।

মাতঙ্গের চোখের ওপর টিয়া বাড়ি কিনলে, তারও বয়স হয়েছিল, সেই বাড়িতে গ্যাঁট হয়ে বসে মাসি হয়ে। আর মাতঙ্গকে শেষ বয়সে করতে হল বাড়ি বাড়ি দাসীবৃত্তি। সময় থাকতে গুছিয়ে নিতে পারেনি, ওর চেহারাটাই দুষমনি করেছে ওর সঙ্গে। ভারি গলায় গান উঠত না, মোটা আঙুলে বাজত না বাজনা। এখনো বাজে না, কাঁসার বাসনে শালপাতার বাজনা বাজিয়েই মাতঙ্গের জীবন গেল। টিয়া ওকে করুণা করত। বলত, তুই নিজে তো কিছুই করতে পারলিনি মাতঙ্গ, তোর মেয়েটাকে আমায় দে। ভরা-ভরা শরীর, রোজগারের সময় তো এই। গলাটাও মিঠে, ওকে আমি এমন গান শেখাবো যে লক্ষ্ণৌয়ের বাঈজিরাও হার মানবে।

টিয়া মাসির বাড়ির সেই হাতে খড়ির দিনগুলি মনে হতেই গায়ে এখনও কাঁটা দেয়। বিকেল হতেই দল বেঁধে গা ধোওয়া। পাতা কেটে, চুল বেঁধে খয়েরি টিপ পরা। তারপর খোলা দরজার দু-পাশের রক ঘেঁষে দু-সার দিয়ে দাঁড়ানো। ওদের মধ্যে তরঙ্গ আবার ছিল সবচেয়ে সাহসিকা। মাঝে মাঝে সে বেরিয়ে গিয়ে সদর রাস্তা কি পার্ক থেকে খদ্দের নিয়ে আসত। সুবিধে পেলে রাস্তার লোকের হাত ধরে টানাটানি করতেও পেছপা হত না।

কোলে একটা বেড়ালের ছানা, ডান হাতে বিড়ি, তরঙ্গের চেহারাটা স্পষ্ট মনে আছে যমুনার।

প্রথম প্রথম যমুনার বুক ঢিপ ঢিপ করত। চৌকাঠ পেরিয়ে সংকীর্ণ প্যাসেজটাতে দাঁড়িয়ে লোকগুলো দেশলাই জ্বালত, কিন্তু সিগারেট ধরানোর পরেও নেবাতো না কাঠি। একে একে সবার মুখের সুমুখ দিয়ে পুড়ে আসা কাঠিটিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যেত। সৌরভী, তরঙ্গরা কুৎসিত একটা গালাগালি দিত, কিম্বা খিলখিল হেসে গড়িয়ে পড়ত এ ওর গায়ে। আর যমুনা দু-হাত দিয়ে ওর মুখটা দিত আড়াল করে। মনে মনে প্রার্থনা করত, হে ভগবান, আমাকে যেন পছন্দ না করে।

তবু কেউ না কেউ পছন্দ করতই। সেই অপরিচিতদের নিয়ে দরজায় খিল দিতে গিয়ে হাত সরত না, বুক দুর দুর করত, সমস্ত শরীর আসত অবশ হয়ে। ওদের হাতে জড়ানো বেলফুলের মালার উগ্র সুবাস ছাপিয়ে উঠত পানীয়ের গন্ধ।

পরদিন সকালে আবার যে-কে-সেই। স্নান শেষে শরীরটাকে মনে হত প্রথম বর্ষার ভেজা মাটির মতো স্নিগ্ধ, সরস, নরম।

টিয়া মাসি কোনো কোনো দিন নিয়ে যেত গঙ্গায়। ঘাটের উড়ে ঠাকুরের হাতে তিলক কেটে টিয়া মাসি ফিরত এক ঘড়া গঙ্গাজল নিয়ে। ঘরদোর বিছানায় সেই জল ছিটিয়ে দিত মাসি। বলত পাপ, পাপ, পাপে চারদিক ভরে গেল।

প্রথম প্রথম বিস্মিত হত, পরে শুধু মজা পেত যমুনা। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর এই টিয়া মাসিরই আবার অন্যরূপ। সে তার চুলগুলোকে আলগা একটা গিঁট দিয়ে স্তূপ করে রেখেছে মাথার ওপর, মাংসল শরীরটার আবরণ ঢিলে করে দিয়ে হিসেব নিচ্ছে সকলের কাছে।

সহজ হিসেবের ওপর আরেকটা উপরি হিসেব ছিল টিয়া মাসির। আইনকে নলচের আড়াল দিয়ে চুপে চুপে চোলাই মদের ব্যবসা চালাত। অবশ্য যারা আসত ওদের কাছে, তাদের অনেকেই আগে থেকে চুর হয়ে আসত। কিন্তু তবু প্রায়ই এখানে এসে ওদের তেষ্টা পেত। তখন হয়ত নিশুতি রাত। কোথায় আছে নির্ঝরিণী?

আছে। টিয়া মাসির কাছে আছে। ওর তোষক ঢাকা তক্তাপোশের আলগা পাটাতনের নীচে চোরা-সিন্দুকে ঝকঝকে বোতল সর্বদাই মজুত। খিল খুলে এক একটি মেয়ে বাইরে আসে, টিয়া মাসি বারান্দার কোণেই দাঁড়িয়ে। কীরে, কী চাই? কাছে এসে অন্তরঙ্গ সুরে ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করে।

মেয়েরা চোখ টিপে জিজ্ঞাসা করে, আছে?

আছে। ক-বোতল?

সন্তর্পণে তোশক তুলে, তালা খুলে চোরা-সিন্দুকের রহস্য উন্মোচন করে টিয়া মাসি। আঁচলে দশ-বিশ টাকার নোট বাঁধতে বাঁধতে বলে, ভাগ এবার। পালা। যতো সব পাপ জুটেছে এখানে।

মুখ টিপে টিপে হাসে মেয়েরা। আর ক-বোতল আছে টিয়া মাসি? তখন টিয়া মুখ খুলে গাল পাড়তে শুরু করে। বোতল? কিসের বোতল। সিন্দুক ভর্তি সবতো গঙ্গাজল।

শুধু গঙ্গাজল, মাসি?

হাসতে হাসতে মেয়েরা চলে যায়, টিয়া মাসিও হাসতে শুরু করে। এ মাসে যদি পঞ্চাশ বোতল চালাতে পারিস সৌরভী, তবে তোর কুকুরের বরাদ্দ আধপো মাংস আমি একপো করে দেবো।

ক্রমেই সয়ে আসছিল। কিন্তু তবু যেদিন সৌরভীর ঘরে একটা লোক খুন হল, সেদিন ভয় পেয়েছিল যমুনা। পুলিশ এল, ওদের সবাইকে ধরে নিয়ে গেল থানায়। জেরা করলে কত রকম। সৌরভীকে বুঝি মারধোরও করেছিল। ওদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হল গলির মোড়ের পানওয়ালাটাও।

তারপর ওরা একদিন ছাড়াও পেল। লোকে বলে টিয়া মাসি ঘুষ খাইয়েছিল পুলিশকে। কিন্তু সৌরভীকে ওরা রেখে দিল। সব কাহিনি যখন জানা গেল, তখন গায়ে কাঁটা দিয়েছিল যমুনার। ওই লোকটা সম্প্রতি সৌরভীর ঘরে কিছু দিন ঘন ঘন আসতে শুরু করেছিল। ফুরফুরে বাবু ছিল লোকটা। পায়ে পাম্পসু, গায়ে মিহি পাঞ্জাবি। দামি সিগারেট ছাড়া খেত না। পকেটের রুমাল সর্বদাই এসেন্সে ভুর ভুর করত। সেই লোকটাকে মোড়ের পানওয়ালার সঙ্গে ষড় করে মারলে সৌরভী। লোকটা রোজ সন্ধ্যাবেলাতেই আসবার আগে ওই দোকান থেকে পান কিনে খেত। পানের সঙ্গে কী একটা ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল সেদিন, লোকটা টলতে টলতে সৌরভীর বিছানা পর্যন্ত এসেই কাৎ হয়ে গড়িয়ে পড়ল। তারপর গভীর রাতে সেই পানওয়ালাটা আর সৌরভী—

সৌরভী? উঃ ভাবতেও শিউরে উঠে শরীর। ময়লা ময়লা বোকা বোকা চেহারার এই মেয়েটির সঙ্গেই যমুনার ছিল সবচেয়ে বেশি ভাব। ভারি আমুদে ছিল সৌরভী, কথায় কথায় হাসত। তার পেটে পেটে এত—

দশ বছর জেল হয়েছিল বুঝি সৌরভীর।

সেই থেকে সন্ধ্যা হলেই গা ছম ছম করত যমুনার। প্রায় মাস ছ-য়েক ও-বাড়িতে কেউ আসত না। যতদিন মামলা চলেছিল, পুলিশ থাকত দরজার সামনে পাহারা।

টিয়া মাসি কিন্তু বেশি ঘাবড়ায়নি। খালি বলত, বাসাটা বদলাতে হবে। এটার বড়ো বদনাম হয়েছে।

তোমার ভয় করে না টিয়া মাসি?

ভয়? মেজেয় পানের পিক ফেলে টিয়া মাসি বলেছে—থুঃ। এই চল্লিশ বছরের জীবনে এই নিয়ে কম সে কম দশটা খুন দেখলুম।

শেষ পর্যন্ত বাসা আর বদলায়নি টিয়া মাসি। খালি যে ঘরে সৌরভী থাকত সেই ঘরটা চুনকাম করে দিলে। দেয়ালে ঘটা করে দিলে গঙ্গাজলের ছিটে।

মাতঙ্গ মাঝে মাঝে দেখতে আসত ওকে। যমুনা বলত, এখান থেকে আমাকে নিয়ে চল, মা।

আদর করে ওর মাথাটা বুকের কাছে নিয়ে উকুন বেছে দিত মাতঙ্গ, বলত, নিয়ে যাবোরে, বাবা। তোর বিয়ে দেবো।

বিয়ে দেবে! প্রথমদিন কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল যমুনা , সোজা হয়ে উঠে বসেছিল। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে মা। আমাদের কি বিয়ে হয়, বেশ্যার মেয়েদের?

বেশ্যার মেয়েদের! চোখ দু-টো মাতঙ্গের একবার জ্বলে উঠেছিল, তারপর ওর দৃষ্টি সুদূর হয়ে গিয়েছিল।

হয় কিনা জানিনে, তবে আমি তোর বিয়ে দেবো, দেখিস। আস্তে আস্তে দৃঢ়তার সঙ্গে মাতঙ্গ বলেছে।

যেদিন থেকে পরের বাড়ির ঝি-গিরির কাজ নিয়েছে মাতঙ্গ, সেদিন থেকেই ওর মাথায় এই ভূত চেপেছে। গৃহস্থবাড়ির রূপ কাছে এসে দেখতে পেয়েছে, আর যত দেখেছে, ততই তার মনে মোহ জমেছে ফোঁটা ফোঁটা মধুর মতো। তকতকে উঠোন আর সাজানো গুছানো ছোটো একটি ঘর—এমনি বাড়ি যদি একটি তার হত! এখানেও কলহ আছে, নীচতা আছে, কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আছে অনির্বচনীয় একটু মাধুর্য , পরিপূর্ণ শুচিতা আর শ্রী। এ ঘর মাতঙ্গ কখনো পাবে না , সে বয়স নেই, কিন্তু পায় যেন যমুনা। কিন্তু সে কেমন করে? কোন পথে এই পঙ্কজকে সে পৌঁছে দেবে পূজার বেদিমূলে। উপায় যা হোক একটা কিছু স্থির করতে হবে, ততদিন যমুনা থাক নদেরচাঁদ বাই লেনে।

সৌরভীর খালি ঘরে নতুন যে মেয়েটি এল, তার নাম শ্যামা। বেশিদিন আসেনি কলকাতায়। এই বছর চারেক হল।

মোটে চার বছর?

তুমি বলছ ভাই মোটে? আমার মনে হয় এক যুগ হয়ে গেল। বলতে বলতে কেঁদে ফেলে শ্যামা , কাঁদতে কাঁদতে ওর স্খলনের ইতিহাস বলে, গ্রামের বালবিধবার অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের সম্ভাবনা, কলঙ্কের ভয়ে কলকাতায় পালিয়ে আসা—

তারপর, তারপর? উৎসুক রুদ্ধকন্ঠে যমুনা জিজ্ঞাসা করে।

ম্লান একটু হাসে শ্যামা। বলে, তার আর পর নেই।

তরঙ্গ মাঝখানে তীর্থে গিয়েছিল, কয়েকমাস বাদে ফিরে এল ফ্যাকাশে হয়ে।

কী হয়েছিল তোর তরঙ্গ?

কী হয়নি তাই জিজ্ঞেস কর বরং। টাইফেট, নিমুনিয়া, আরো কত কী।

চেহারা কিন্তু তোর বড্ড খারাপ হয়ে গিয়েছে তাই।

দু-হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল তরঙ্গ। বলে, বেঁচে যে আসতে পেরেছি, এই ঢের। বাবা বিশ্বনাথের কৃপা।

শ্যামার কিন্তু বিশ্বাস হয় না তরঙ্গের গল্প। যমুনাকে বলে, বিশ্বাস করলি তুই ওই মাগির গাঁজাখুরি গল্প। অসুখ হয়েছিল না হাতি। ও নিশ্চয়ই পোয়াতী হয়েছিল, নষ্ট করে এসেছে, আর নইলে ওর ছেলে হয়েছিল, সেটাকে ভাসিয়ে দিয়েছে জলে।

ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে যমুনা, বুঁজে আসা গলায় জিজ্ঞাসা করেছে, তুমি জানলে কী করে?

অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল শ্যামা। কথাটা না শোনার ভান করে দূরের চারতলা বাড়ির ছাতের দিকে চেয়েছিল। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন হতে সামান্য একটু হেসে বলেছিল, চেহারা দেখলেই আমরা টের পাই যে। আমার হয়েছিল।

তোমার ছেলে হয়েছিল? উত্তেজিত গলায়, প্রায় চিৎকার করে, জিজ্ঞাসা করেছিল যমুনা।

পায়ের নখ দিয়ে সিমেন্ট ঘষতে ঘষতে শ্যামা জবাব দিয়েছিল,—হয়েছিল।

কী করেছ সেটাকে? জলে ভাসিয়ে দিয়েছ?

না। খুব নীচু গলায় শ্যামা ধীরে ধীরে একবারো-না-কাঁপা গলায় বলেছিল, গলা টিপে মেরেছি!

অনেকক্ষণ কোনো কথা বলেনি কেউ। তারপর শ্যামা বুঝি জোরে হেসে উঠেছিল। তোর মনটা এখনো কাঁচা আছে যমুনা। তোকে এখানে মানায় না, গেরস্তের ঘরে মানাত। দিব্যি ঘোমটা টেনে, নোলক পরে বসে থাকতিস।

তরঙ্গের সঙ্গে ঘেন্নায় তিনদিন কোনো কথা বলতে পারেনি যমুনা। বিবর্ণ, ওই পাংশু মেয়েটিই কি তার সদ্যোজাত শিশুকে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছে জলে? বিশ্বাস হয় না। শ্যামা বলেছিল, ছেলে তো কেউ চায় না, তাই মেরেছে , এই যদি মেয়ে হত, তবে দেখতিস কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে এসে হাজির হত তরঙ্গ, অসুখ টসুখের কথা আর সাজাতে হত না।

মাথার ঠিক মাঝখান দিয়ে টেরি কাটা এই বাবরি চুলওয়ালা লোকটার সঙ্গে শ্যামার ঘরে আলাপ। লোকটা প্রায় সন্ধ্যাতেই শ্যামার অতিথি হত! শ্যামা নিজে নাচতে জানত না, তাই মাঝে মাঝে যমুনার ডাক পড়ত। লোকটা একদিন ফরাসের ওপরই ঘুঙুর শুদ্ধ পা জোড়া জড়িয়ে ধরেছিল যমুনার। এমন পাখির মতো হালকা পা তোমার, থিয়েটারে নামো না কেন?

থিয়েটারে? বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞাসা করেছিল যমুনা।

হ্যাঁ, ডায়না থিয়েটারে নাচ শেখায় লোকটা , নাট্যকার হবে শীগগিরি! মাঝে মাঝে বগলে করে একটা এক্সারসাইজ খাতা নিয়ে আসত, সেইটেই ওর স্বরচিত নাটক , সুভদ্রাহরণ কী ওই জাতীয় নাম হবে। শ্যামার ঘরে বন্ধ দরজার আড়ালে সেই নাটকের মহলা হত। লোকটা একটু একটু করে পড়ে শোনায়, এক এক চুমুক খায়, আর রক্তিম মুখচোখে যমুনার দিকে চেয়ে ওর অভিনয় কৌশলের তারিফ করে বলে, এ নাটকে হিরোয়িনের পার্ট তোর বাঁধা। আমি শ্রীমন্তবাবুকে বলে রেখেচি। থিয়েটারে কিন্তু এসব যমুনা-টমুনা চলবে না, তখন তোর নাম হবে মিস রোজ।

মিস রোজ? গোলাপি রঙের ছিটে লাগত যমুনার গালে, শ্যামার নতুন কেনা তাকিয়াটার ওপর গড়িয়ে পড়ত হাসতে হাসতে।

শেষ পর্যন্ত যমুনা ডায়না থিয়েটারে হিরোয়িনের ভূমিকায় নামত কিনা বলা যায় না। কিন্তু মাতঙ্গ একদিন এসে সব ওলট-পালট করে দিল।

দুপুরবেলা একদিন এসে বললে, আয় আমার সঙ্গে।

কোথায় মা? রাত্রি জাগরণের পর সমস্ত শরীরে শৈথিল্য এসেছিল, ফোলা ফোলা চোখ যমুনার, একটা হাই তুলে জিজ্ঞাসা করলে, কোথায় মা?

মাতঙ্গ ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললে, যা, চোখে মুখে জল দিয়ে আয়। এক জায়গায় তোর বিয়ের কথা কয়েছি, চটপট তৈরি হয়ে নে।

সাজতে গিয়ে সেদিন বার বার হাত কেঁপে গেল যমুনার। পছন্দ আর হয় না। ছাপা শাড়ি পছন্দ যদি বা হল ব্রাউজের সঙ্গে আর মেলে না। চুলটাই বাঁধলে কতো রকম করে।

সাজগোজ সারা করে বেরিয়ে যখন এল, তখন মাতঙ্গ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, তুই এ কী করছিস বলতো যমুনা!

ভয়ে যমুনার মুখ শুকিয়ে গেল। কী মা?

এমনধারা সেজেছিস কেন? ভদ্রলোকের বাড়ি যাচ্ছিস, না বেশ্যাবিত্তি কত্তে যাচ্ছিস লা? খোল শীগগির ওই রঙচঙে শাড়িটা, একটা ফর্সা লাল পেড়ে কিছু পর। অত গয়নাও পরতে নেই, মোছ গালের রঙ।

ভদ্রলোকের বাড়ি কাজ করে রুচিও কিছু ভদ্রলোকের মতো হয়েছে মাতঙ্গর।

যমুনা যেন মাটির সঙ্গে মিশে গেল। কম্পিত হাতে মাতঙ্গ যা-যা বললে অবিকল তাই করলে। কলে গিয়ে ফের মুখ ধুয়ে এল। মুছে ফেললে কপালের কাচপোকার টিপ। পাতা কেটে চুল বেঁধেছিল অভ্যাস অনুযায়ী সেটা খুলে চুলগুলোকে সংবরণ করলে সাধারণ একটি খোঁপায়।

মাতঙ্গ খুশি হয়ে বললে, এই তো দিব্যি মানাচ্ছে। মা আমার যেন সরেস্যতী।

রাস্তায় নামতে যত রাজ্যের সংস্কার এসে জড়িয়ে ধরে পা দুটো, নাছোড় প্রণয়ীর মতো। মোড়ের রহমৎ গাড়োয়ানের ছেলেটা, পানের দোকানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ইয়ার্কি দিচ্ছিল, সে কী একটা রসিকতা করলে। ওরিয়েন্টাল খেমটা পার্টির ম্যানেজার রকে দাঁড়িয়ে শিস দিলে একবার। ‘স্পিশাল সেলুনের’ লম্বা জুলফিওয়ালা কারিগরটা ভ্রূ-ভঙ্গি করলে। অন্যদিন যমুনা হয়ত এক মুহূর্ত দাঁড়াত, মুচকি হাসত একটু , আজ ভ্রূক্ষেপ করল না। একে তো মা সঙ্গে যাচ্ছে, তাতে আবার যমুনা যাচ্ছে ভদ্রলোকের বাড়িতে। চালচলনটাও করতে হবে তেমনি। আজ তো মৃগয়া নয়! লোল কটাক্ষ আর ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি, সব রেখে যেতে হবে পেছনে, এই নদেরচাঁদ লেনে।

সারা রাস্তা মাতঙ্গ যমুনাকে তোতাপাখি পড়াতে পড়াতে নিয়ে গেল। দায়িত্ব তো কম নয়, ঝুঁকিও নয় সামান্য। মেকিকে মন্ত্রবলে খাঁটি করে দেবে মাতঙ্গ, লোহাকে স্পর্শমণি ছুঁইয়ে করবে সোনা।

কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের এক গলিতে ‘সমাজ সংস্কারক’ অফিস। টেবিলের সম্মুখে সম্পাদক কাজ করছিলেন। সৌম্যমূর্তি, সাদাকালো মেশানো দাড়ির আড়ালে অনিশ্চিত একটা বয়স লুকানো।

মা নমস্কার করলে, মার দেখাদেখি যমুনাও।

মাতঙ্গ বললে, আমার মেয়ে। এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একেবার যমুনাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সম্পাদক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, হুঁ। অনেকক্ষণ কী চিন্তা করলেন। নিস্তব্ধ কক্ষ। ওর পায়ের কাছে বসে যমুনা ওঁর বুকপকেটের চেন লাগানো ঘড়িটার অতি ক্ষীণ টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পেল না।

হঠাৎ খানিকক্ষণ বাদে সম্পাদক সোজা হয়ে বসলেন চেয়ারে। একবার ওর, একবার মার, মুখের দিকে চেয়ে বললেন, তোমার উদ্দেশ্যের সঙ্গে আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

তবে—

মাতঙ্গ বললে, যদি কোনো উদার ছেলে পাইতো—

দাড়িতে হাত বুলিয়ে সম্পাদক বললেন, পাবে। কয়েকটি জানাশোনা ছেলে আছে আমার হাতে। এ রকম বিয়ে আমরা গোটাকতক দিয়েছিও। আমরা শুধু কাগজে কলমেই সমাজ সংস্কার করি না, হাতে কলমেও করি। কিন্তু—

কিন্তু কী? না, সামান্য একটু ছলনার আশ্রয় নিতে হবে। একেবারে গণিকার গর্ভজাত মেয়েকে বিয়ে করতে কোনো পাত্র সহজে রাজি হবে না। তার চেয়ে, চশমা খুলে পেকেটে রেখে সম্পাদক বললেন, তার চেয়ে ধরো যদি ওদের বলি—

আস্তে আস্তে সম্পাদক ওঁর কৌশলটা ব্যক্ত করলেন। যমুনা দিনকতক থাকবে ওঁদের সমিতি পরিচালিত আশ্রমে। মফঃস্বল থেকে এসেছে, দুর্বৃত্তদের হাতে নিগৃহীতা, স্বজন পরিত্যক্তা কুমারী, এই ধরনের একটা বিশ্বাস্য গল্প তৈরি করে চালাতে হবে।

আশ্রমে এসে বেশিদিন থাকাও হল না। মা রোজ এসে খোঁজ নিত। আসতেন ‘সমাজ সংস্কারকের’ সেই প্রবীণ সম্পাদক গিরিজাবাবু। এখানে আরো ক-টি মেয়ে আছে। তাদের সঙ্গে ভালো করে আলাপ হ’ল না। যমুনা সংকুচিত হয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত। এখানকার মেয়েরাও মিশুক নয় তেমন। সব যেন কেমন ঠান্ডা, বোবা, স্থির। কথা বললে, শান্ত চোখে তাকায় কেবল। যে অতি তরল, অতি মুখর জীবনের সঙ্গে যমুনার পরিচয়, এ তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

একদিন এক পাত্র এসে দেখেও গেল ওকে। পরে শোনা গেল তার পছন্দও হয়েছে। যখন দেখতে এসেছিল তখন তার মুখের দিকে তাকাতে সাহস করেনি যমুনা, কিছুতেই স্মরণ করতে পারল না তার মুখ। পরে শুনলে, নাম নরেশ, কাছাকাছি মফঃস্বলের কী একটা জায়গার ডাক্তার। বিপত্নীক। শুনেছে যমুনার কল্পিত দুর্ভাগ্যের কাহিনি। বিয়ের আপত্তি নেই।

বিয়ের সেই নির্দিষ্ট দিনটি এল। সেদিন শ্রাবণ মাস, সারাদিন বৃষ্টি। বিকেল হতেই চারধারে অন্ধকার হয়ে এল। আশ্রমের গলিটায় থৈ থৈ জল। এমন দিনে কি কারুর বিয়ে হয়! আলো পর্যন্ত জ্বলল না রাস্তায়। এমন দিনে দুর্যোগে লোকে ঘরে বাসি মড়া রাখে, তবু রাস্তায় বার করে না।

শিরশিরে হাওয়া, যমুনা সেদিন গা ধোয়নি পর্যন্ত। কিন্তু তবু গলির বাঁকে সন্ধ্যার একটু পরেই ছ্যাকরা গাড়ি দেখা গেল একটা, আর সেটা থামল আশ্রমের ঠিক সমুখেই।

দরজা খুলে প্রথমে নামলেন, ‘সমাজ সংস্কারক’ সম্পাদক গিরিজাবাবু। তাঁর পিছনে আরেকজন লোক কোচা হাতে রকে লাফিয়ে উঠল, সন্তর্পণে, জল বাঁচিয়ে। এই কি বর?

সন্দেহ কী? হেলে পরা টোপরটাকে সোজা করে বসিয়েছে মাথায়। মুখে দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছিল, মুছতে গিয়ে চন্দনের ফোঁটাগুলোও গেল মুছে।

তারপর আস্তে আস্তে আলো জ্বলল, শাঁখও বাজল। আশ্রমের মেয়েরা উলু দিল। গিরিজাবাবু পুরুত নিয়েই এসেছিলেন, তিনি মন্ত্র পড়লেন, বিয়ে হল।

নতুন জীবন শুরু হল যমুনার।

পরদিন এসেছিল মাতঙ্গ। দূর থেকেই দেখলে নরেশকে, কেননা নরেশ তার পরিচয় জানে না। যমুনাকে তার নতুন পরিচ্ছদে কত রকম করে যে দেখল মাতঙ্গ, ঠিক নেই। সিঁথিতে সিঁদুর তুলেছে যমুনা, এ সাফল্য যেন যমুনার একার নয়, মাতঙ্গেরও। সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে মাতঙ্গ ওর সারাজীবনের স্বপ্ন সফল করেছে। যমুনাকে প্রমোশান দিয়েছে ভদ্রসমাজে।

নরেশকে বেশি কিছু দিতে হয়নি , মোট দু-হাজার টাকা, সর্বসাকুল্যে খরচ হয়েছে সাতশো। মাতঙ্গের নিজের বলতে আর সামান্যই অবশিষ্ট আছে।

তুমি এবার কি করবে মা?

আমি? মাতঙ্গ হেসে বলেছিল আমার জন্যে ভাবিসনি। আমার চলে যাবে, আমি তো এবার নিশ্চিন্ত। যে ক-দিন শরীর কুলোবে খেটে খাবো, তারপর তীর্থটীর্থ—

যমুনার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠেছিল, নিজের বলতে মাতঙ্গ কিছুই রাখেনি, সব উজাড় করে দিয়েছে মেয়েকে।

যমুনার মনে আশঙ্কা ছিল, হয়তো নরেশ ওকে জেরা করবে, ওর অতীত জীবনের খুঁটিনাটি জানতে চাইবে। দুর্বৃত্তদের হাতে ওর অপমানের একটা কাহিনি রচিত হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা সব সময় যমুনার ভালো খেয়াল থাকত না। হয়ত কী বলতে কী বলে বসবে, সামঞ্জস্য থাকবে না কাহিনিতে।

কিন্তু নিশ্চিত হল নরেশের কথায়।

আমি শুনেছি সব, ওর একখানা হাত হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে নরেশ বললে, তোমার দুর্ভাগ্যের কথা। এতে তোমার কোনো লজ্জা নেই, এ লজ্জা আমাদের, আমাদের সমাজের, যাঁরা তোমাকে বাঁচাতে পারেনি।

ঈষৎ উষ্ণ করতল নরেশের, তবু যমুনার হাত যেন হিম হয়ে এল। পুরুষের স্পর্শ জীবনে এর আগেও বহুবার পেয়েছে,—বহু পুরুষের স্পর্শ পেয়েছে,—কিন্তু নরেশের আজকের এই আশ্বাস-বলিষ্ঠ স্পর্শের সঙ্গে কোনো অনুভূতির তুলনা নেই। পঙ্ক থেকে উঠে এসে প্রথম নবধারা জলে স্নান করার শুদ্ধ অভিজ্ঞতা।

নরেশ আবার বললে, আমি কিছু শুনতে চাইনে। তোমার অতীত ফুরিয়ে গেছে। বর্তমান আর ভবিষ্যতে কোনো ফাঁকি না থাকলেই হল।

মফঃস্বল শহরে ওদের যৌথ জীবনে তৃতীয় কেউ ছিল না। নরেশ কাজের মানুষ, সকাল থেকে বেরিয়ে যেত, ফিরত দুপুরে, খেয়ে দেয়ে আবার বেরুত, দেখা হত আবার সেই সন্ধ্যায়। সেই সন্ধ্যাটুকুই ওদের দু-জনের যৌথ।

মাঝে মাঝে বুক দুরদুর করত। কী জানি, কোথায় বুঝি ত্রুটি ঘটে যাবে, নরেশ ধরে ফেলে দেবে ও মেকি , ওর আসল পরিচয় ফুটে উঠবে পারদের মতো।

কিন্তু আশ্চর্য, সে সব কিছুই হল না। নরেশ কাজের মানুষ, এ সব খুঁটিয়ে দেখার মতো অবসর নেই তার। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক একবার বুড়ি ছুঁয়ে যাবার মতো বাড়ি আসছে , একটুখানি হেসে কি একটু হাসি নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ছে।

আর সন্ধ্যাগুলো? অল্প অল্প হাওয়ায় পাতাগুলো কাঁপে, তির্যক একটু চাঁদের আলো জানালা গলে মেজেয় গড়িয়ে পড়ে, ছড়িয়ে পড়ে। সে সন্ধ্যা শুধু ঘন হয়ে বসবার, স্তব্ধ চোখে তাকাবার।

বেশ কাটল দু-টি মাস।

বৃথাই যমুনা ভয় করছিল , অশুভ এতটুকু ছায়াও পড়ল না।

কিন্তু কোথা থেকে দিন তিনেক আগে এসে উদয় হয়েছে এই বাবরি চুলওয়ালা লোকটা। কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে এসেছে।

নরেশের হাত ধরে আলের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাঠ পার হয়ে নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে খালি পায়ে বালির ওপর দৌড়ে দেখেছে পা বসে যায় কতোখানি , একটু দূরে বাবলা গাছ , কাঁটায় আঁচল গেছে জড়িয়ে, হলুদ ফুল তুলে পড়েছে খোপায়। কোঁচড় ভরে তুলেছে কাশের গুচ্ছ।

তারপর হাত ধরাধরি করে আবার পা টিপে টিপে আলের রেখা ধরে ফিরে এসেছে। নরেশ দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে ক্লাবে না-ডিসপেন্সারিতে।

গেট খুলে বাবরিওয়ালা লোকটা চোরের মতো পা টিপে টিপে এসেছিল পেছনে।

নরম মাটিতে পায়ের শব্দ হয়নি। সিঁড়িতে পা দিয়েও যমুনা টের পায়নি পেছনে লোক আছে। দু-টো সিঁড়ি পেরুতেই আঁচলে টান পড়ল। চমকে ফিরে দাঁড়াল যমুনা। ভীত, চকিত একটা আর্তস্বর কণ্ঠে অর্ধোচ্চারিত হয়েই থেমে গেল। অন্ধকারে একেবারে মুখোমুখি এসে যে দাঁড়িয়েছে তার বাবরি চুলের নীচে রক্তিম চোখ দু-টো জ্বলছে গনগনে উনুনের মতো।

বিচিত্র হাসি খেলে গেল যমুনার মুখে।

কী চাও?

ওর আচল তখনো লোকটার মুঠোতে। বললে, তোমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি।

ফিরিতে নিতে? কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল যমুনার, নিজের কাছেই অপরিচিত শোনাল।

ফিরিয়ে নিতে। নিষ্ঠুর নিশ্চিন্ত কণ্ঠে লোকটা বললে। তারপর আপাদমস্তক দেখে নিলে যমুনাকে। দেখলে ওর সীমন্তের সিঁদুর-রেখা, হাতের শঙ্খবলয়, এয়োতির চিহ্ন। হেসে উঠল ব্যঙ্গশাণিত গলায়। বাঃ, ভোল তো দিব্যি পালটেছ সুন্দরী। কিন্তু আমি তোমায় ভুলিনি। পোশাক বদলালে ভেতরটা বদলায় না। তোমাকে ফিরে যেতে হবে।

কোথায়?

ডায়না থিয়েটারে। তোমার হিরোয়িন হবার কথা ছিল মনে নেই? তোমার মনে নেই। আমার আছে। অনেক খোঁজ নিয়ে তবে নাগাল পেয়েছি।

যমুনার ইচ্ছে হ’ল কেঁদে উঠে লোকটার পা দু-টো জড়িয়ে ধরে। নতুন জীবন নিয়ে পরীক্ষা তার, আদর্শ সংসার, উদার দেবতুল্য স্বামী—

কিন্তু স্বর ফুটল না, একটি কথাও বলতে পারল না। লোকটার চোখ দুটি রক্তাভ, কিন্তু সে তো শুধু নেশাতেই নয়, অনুরাগেও। কী এক অদ্ভুত সর্বগ্রাসী চাউনি ওর সর্বাঙ্গে রসনা লেহন করছে। এই দুঃসাহসী লোকটা চায় কী।

এখানে তুমি উড়ে এসে জুড়ে বসেছো। এ তোমার স্থান নয়। সত্যি করে বলো যমুনা, তোমার ছিটগ্রস্ত মায়ের খেয়াল মেটাতে তুমি নিজের সঙ্গে লুকোচুরি করছ না? এই সোনার শিকলে কি অস্বস্তি হচ্ছে না? সত্যি করে বলো পা দু-টি চঞ্চল হয়ে উঠছে না একজোড়া ঘুঙুরের জন্যে। নদেরচাঁদ লেনের মেয়ে তুমি, রকে এসে দাঁড়াতে—

থিয়েটারের বই লেখে লোকটা। কথাগুলো লেখে যেমন, বলেও তেমনি সাজানো। আর শুনতে পারেনি যমুনা। ঝুঁকে পড়ে হাতের কাছে শক্ত গোছের একটা কি পেয়েছিল, সেইটা ছুঁড়ে মেরেছিল লোকটার মুখে।

কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল লোকটার গাল বেয়ে। এক হাতে ক্ষতস্থানটা চেপে ধরে বললে, ঠিক লাগল না, ফসকে গেল। হাত তোমার এখনো তৈরি হয়নি।

চাপা, ত্রুদ্ধকণ্ঠে যমুনা বললে, যা—ও।

যাচ্ছি। কিন্তু কাল সকালে আবার ফিরে আসবো।

পরদিন সকালে যমুনা উৎসুক হয়ে রইল, ওর মুখটা এক একবার বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। নরেশ বেরিয়ে গেল। গদার মা এল বাসন মাজতে। কিন্তু লোকটার দেখা নেই। আশায় আশঙ্কায় যমুনার বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। কে জানে লোকটার মত পরিবর্তন হয়েছে কিনা। হয়ত সে ফিরেই গেছে। কিন্তু এতদূর অবধি খুঁজে খুঁজে এসেছে যে সে কি ফিরে যাবে এত সহজেই?

স্নান, এমন কি খাওয়া দাওয়াও শেষ হল। নরেশ এল বেলা দেড়টা-দুটোয়। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সে শুয়ে পড়ল বিছানায়। এ সময়টা নরেশ একটু গড়িয়ে নেয়। আজ আর যমুনা নরেশের কাছে বসল না। আজ তার প্রতীক্ষার পালা। কতক্ষণে রাহু আবার এসে দেখা দেবে কে জানে। শেষে বেলাও পড়ে এল। পশ্চিমের রাস্তার ধারের নারকেল গাছটার ছায়া এসে ঘরে পড়ল, তবু যখন লোকটা এল না তখন যমুনা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল , কুগ্রহ হয়ত কেটে গেছে।

চা খেয়ে নরেশ গেছে তৈরি হয়ে নিতে, যমুনা আয়নার সমুখে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে, হালকা সুরের একটা গানও এসেছে মনে, এমন সময়—

সেই কামানো ঘাড়, বাবরি চুল আর ভাঁটার মতো দু-টি চোখ।

শ্যামার ঘরের সেই লোকটা। নদেরচাঁদ বাই লেনে ফিরে যাবার খেয়া নৌকার মাঝি।

সিঁড়িতে চটিজুতোর পায়ের শব্দ। নরেশ উঠে আসছে। যমুনা অনুভব করল ওর হাত-পা হিম হয়ে আসছে। নরেশ জেনেছে সব। জেনেছে যমুনা দুর্বৃত্তের উচ্ছিষ্ট অথচ নিরপরাধ নারী নয়। সে নিতান্তই পণ্যস্ত্রী! দেহের পবিত্রতা তার নষ্ট হয়েছে একটিমাত্র দুর্ঘটনায় নয়, অর্থের বিনিময়ে। আত্মদানের পৌনঃপুনিকতায়।

চটি জুতোর শব্দ চলে এসেছে ওপরে। এখুনি ঘরে ঢুকবে নরেশ। বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ল যমুনা, বালিশে মুখ গুঁজল। হাত-পা অসাড়, কেবল পিঠটা উঠছে ফুলে ফুলে।

কতক্ষণ আচ্ছন্ন হয়েছিল খেয়াল নেই, হঠাৎ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, নরেশ ওর শিয়রে বসে। চোখের পাতা, কপাল, চুল কেমন ভিজে-ভিজে। বালিশ শুদ্ধ মাথাটা নরেশের কোলে। আস্তে আস্তে নরেশ ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

ভয় পেয়েছিলে? সস্নেহে জিজ্ঞাসা করল নরেশ।

মিট মিট করে আরেকবার তাকাল যমুনা। এত সুখ বিশ্বাস করা যায় না। এখনও সে এ ঘরেই আছে, এখনও তাকে তাড়িয়ে দেয়নি নরেশ!

কী হয়েছিল? নরেশ আবার জিজ্ঞাসা করলে।

কিছু না, ক্ষীণকণ্ঠে যমুনা বললে, মাথাটা ঘুরে উঠেছিল একটু। তারপর ভয়ে ভয়ে বললে, শুনেছ সব?

নরেশ ধীরে ধীরে বললে, শুনেছি।

আমাকে এবার তাড়িয়ে দেবেতো?

পাগল, নরেশ বললে, এত ঠুনকো কারণেই সংসারটাকে ভেঙে দেবো,—তেমন কাপুরুষ আমি নই। তোমাকে যখন বিয়ে করেছি তখনই কি আমার সংস্কারমুক্ত মনের পরিচয় পাওনি?

বিশ্বাস করতে পারছিল না যমুনা। রুদ্ধকন্ঠে বলল, পেরেছি।

সেই উদারতাকেই আরেকটু প্রসারিত করে দিলাম। তোমাকে তো বারবার বলেছি, তোমার অতীত নিয়ে তো তুমি নও, তোমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়েই তুমি।

আরো কী কী যেন বলছিল নরেশ। পঙ্ক থেকে হাত দুটি তুলে ধরেছে যমুনা সূর্যালোকের দিকে, নরেশ তাকে আবার ঠেলে দেবে না। সুখাবেশে চোখ দুটি মুদিত হয়ে এল যমুনার। নরেশ বড়ো, নরেশ উঁচু, নরেশ মহৎ সে জানত, কিন্তু সে মহত্ত্ব যে এমন অভ্রস্পর্শী তা কখনও অনুমান করতেও পারেনি।

লোকটা চলে গেছে?

গেছে। আমি দিয়েছি বিদায় করে। তুমি একটু শান্ত হয়ে ঘুমোও মণি।

সেদিন বহুক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছিল যমুনা। পাথরের একটা বোঝা নেমে গেছে। স্বামীর সঙ্গে লুকোচুরি শেষ হয়েছে আজ। মহত্ত্বের শুচিস্পর্শে নরেশ ওর সমস্ত গ্লানি মুছে নিয়েছে। এখন থেকে সুস্থ, সহজ জীবন যমুনার। শেষ হল পদে পদে কুণ্ঠার বিড়ম্বনা। শেষ পাতাটিও খসে গেছে, এবার শুধু নতুন, সবুজ পাতা। ওর স্বর্গ অটুট রইল। লাইসেন্স রিনিউ করে নিয়েছে যেন, অত্যল্পকালের মেয়াদ নয়। নিরেনববুই বছরের ইজারা।

কিন্তু সেই নিরেনববুই বছর ন-মাসেই ফুরিয়ে যাবে, তাকি যমুনা তখন জানত।

সেই ঘটনার দিন তিনেক বাদে ‘সমাজ সংস্কারক’ সম্পাদক গিরিজাবাবু এসেছিলেন। সামান্য একটু রোগা হয়েছেন গিরিজাবাবু, কপালে কিছুটা কুঞ্চন, কিন্তু চোখে যেন দিব্য একটা জ্যোতি এসেছে।

প্রণাম করল যমুনা, নরেশ কলরব করে অভ্যর্থনা করল। যমুনার আনত মাথা সস্নেহে শুধু একবার স্পর্শ করলেন গিরিজাবাবু। স্বরোপিত চারা গাছটিকে সতেজ হয়ে উঠতে দেখে আত্মপ্রসাদের হাসিতে যেন মুখখানা ভরে গেছে তাঁর। বললেন, এদিকে কাজ ছিল একটু। তাই একদিন নেমে তোমাদের দেখে গেলুম।

বেশ, বেশ। ভারী খুশি হয়েছি।

নরেশের দিকে চেয়ে বললেন, তোমার কি খুব কাজ আছে নরেশ? দু-টো কথা ছিল।

নরেশ বললে, কিছুমাত্র না। আসুন।

দু-জন মিলে আবার ঘরে ঢুকলেন। ততক্ষণ যমুনা রান্নাঘরে বসে নানারকম খাবার তৈরি করলে।

সন্ধ্যার গাড়িতে গিরিজাবাবু চলে গেলেন। যাবার সময় আবার আশীর্বাদ করে গেলেন। সুখী হয়ো। কোনো অকল্যাণ যেন তোমাকে কখনো স্পর্শ না করে।

এরপর আরো দু-মাস কেটেছে। মাঝে মাঝে কেবল মায়ের কথা মনে পড়ে মন খারাপ হত। কোথায় আছে মাতঙ্গিনী? এখনো কি দাসীবৃত্তি করছে? যমুনার ইচ্ছে ছিল মাকে কাশী চলে যেতে লিখবে। সেখানে না হয় দু-চার টাকা করে হাত খরচ পাঠানো যাবে।

কিন্তু ইতিমধ্যে সব গোলমাল হয়ে গেল। তিন দিন নরেশের অসুখটা চাপা ছিল। অল্প অল্প জ্বর, বুঝতে পারেনি। ক্রমে চোখ দু-টি রক্তবর্ণ হয়ে উঠল, অল্প অল্প কাশির লক্ষণ দেখা দিল। কিসের পর কী ঘটল ভালো বুঝতে পারেনি যমুনা। সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন এলোমেলো, অসম্বন্ধ। যখন বুঝতে পারল তখন হাতের নোয়া শাঁখা ফেলতে হয়েছে, সিঁথির সিঁদুর গেছে মুছে। আর অপরিমেয় সর্বনাশ ওর পরণের শাড়ির সব রঙ কেড়ে নিয়ে সাদা করে দিয়ে গেছে।

সব হিসেব খতিয়ে দেখা গেল, বেশি কিছু রেখে যেতে পারেনি নরেশ।

অতি সামান্য কিছু নগদ, আর এই বাড়িখানা।

কী করবে, কিছু স্থির ছিল না। ভালোমত কিছু স্থির করবার আগেই কলকাতার টিকিট কিনে গাড়িতে উঠে বসল।

সঙ্গে বেশি কিছু আনেনি। নিত্যব্যবহার্য দু-চারখানা কাপড়, হাতখরচের টাকা কিছু, আর নরেশের ছবি একটা।

অবলা আশ্রমের গিরিজাবাবু তাঁর ঘরে বসে চিঠি লিখছিলেন। যমুনাকে ঢুকতে দেখে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। প্রণাম করতে বললেন, বোসো। আস্তে আস্তে বললেন, কিছু জানতে পারিনিতো?

আশ্রমেই একটা ঘর ওর জন্যে নির্দিষ্ট হল। সেই ঘরের দেওয়ালে নরেশের প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে রাখল যমুনা। প্রতিদিন ধূপ ধুনোয় সেই প্রতিকৃতির উপাসনা, তাজা ফুলের মালা ফোটোটার গায়ে ঝুলিয়ে দিত।

ক্ষণকালের জন্যেও যে মানুষটি ওকে পূর্ণ মূল্য দিয়েছিল, তার আসন যমুনার মনে চিরদিনের জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। বেঁচে থাকতে তবু নরেশের দু-চারটে দোষ ত্রুটি চোখে পড়ত। মর দেহ ত্যাগ করে সে যমুনার কাছে দেবত্ব লাভ করল।

গিরিজাবাবু একদিন বললেন, তোমার মার বড়ো অসুখ যমুনা, একদিন দেখতে যেয়ো।

খোলার ঘরের মেজেয় ময়লা বিছানায় পড়ে আছে মাতঙ্গিনী। যমুনা ডাকলে, মা।

চোখ দু-টো যেন অতি কষ্টে মেলে একবার চাইল মাতঙ্গ। এসেছিস? যমুনার নিরাভরণ হাত দুটির দিকে চেয়ে মাতঙ্গীর চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে যমুনার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

যমুনা স্থির করেছিল এখানেই থেকে যাবে, অন্তত মা সেরে ওঠা পর্যন্ত। আশ্রম থেকে ওর জিনিসপত্র আনিয়ে নিলে।

মাতঙ্গ মনে মনে খুশি হল। এখানে তুই থাকবি মা? থাক তবে। কিন্তু একটু অস্বস্তিও যেন বোধ করছে মাতঙ্গ। সর্বস্ব ব্যয় করে মেয়েকে সে সমাজের ওপর তলায় তুলে দিয়েছে, আবার এখানে এসে বাস করলে যমুনা নেমে আসবে না তো। জীবনের আগাগোড়া ফাঁকির মধ্যে ওই একটুমাত্র সান্ত্বনা আছে মাতঙ্গের, তার মেয়ে ভদ্র। বিধবা হলেও ভদ্র।

বিকেলের দিকে দু-শিশি ওষুধ হাতে করে যে লোকটা ঘরে ঢুকল তাকে দেখে যমুনার সমস্ত প্রত্যঙ্গ হিম হয়ে এল।

সেই বাবরি চুল, কামানো ঘাড়, লাল চোখ, কালো দাঁত।

চিনে চিনে আবার এসেছে শনি, পথ শুঁকে শুঁকে।

বোঝা গেল লোকটাও কম বিস্মিত হয়নি। আড়চোখে একবার যমুনার দিকে তাকিয়ে সে মাতঙ্গিনীর কাছে গিয়ে বসল। ওষুধের শিশি দুটো রাখল শিয়রে। চাপা গলায় সেবনবিধি সম্বন্ধে কী যেন বললে মাতঙ্গকে।

মাতঙ্গ বললে, যা বলবে আমার মেয়েকে বলো বাছা। ওই তো এসেছে। একটু থেমে বললে, কপাল পুড়িয়ে এসেছে।

যমুনার মনে হল লোকটার মুখে বিচিত্র একটুখানি হাসি খেলে গেল যেন, শেষ পর্যন্ত যেন বাজি জিতে গেল। সেই অর্থাৎ যমুনাকে আসতে হল তো আবার নদেরচাঁদ বাই লেনে।

মাতঙ্গ বললে, আমার অসুখে গঙ্গাধরই দেখাশুনা করছে। বড়ো ভালো ছেলে গঙ্গাধর।

কিন্তু ততক্ষণে কঠিন হয়ে গেছে যমুনা। মন স্থির করে ফেলেছে। লোকটার ভুল ভেঙে দিতে হবে। সে যে নেমে আসেনি সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে। আস্তে আস্তে উঠে সরে গেল সেখান থেকে।

কিন্তু পালাবে কোথায়। অহরহ সঙ্গে সঙ্গে লেগে আছে গঙ্গাধর। ওষুধের গেলাস ধুতে কলতলায় যমুনা উঠে গেছে যদি, গঙ্গাধরও গেছে পিছনে। যমুনার ওঠা বসায়, চলায় ফেরায় অনুক্ষণ ওর শিকারী দৃষ্টি যমুনাকে অনুসরণ করছে।

কী চায় লোকটা? এখনো কি ও আশা রাখে যমুনা ‘ডায়না’ থিয়েটারে যোগ দেবে, ওর লেখা নাটকে হবে হিরোয়িন?

শ্যামা বললে, তাই। খবর পেয়ে শ্যামা দেখা করতে এসেছিল। যমুনার মুখে আদ্যোপান্ত শুনে বললে, হবে না? ও একেবারে হন্যে কুকুরের মতো হয়ে আছে যে, তোকে ওই থিয়েটারে নিয়ে যাবে কথা দিয়ে থিয়েটারের মালিকের কাছ থেকে টাকা খেয়েছিল যে।

টাকা খেয়েছিল? যমুনা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

খেয়েছিল তো। শ্যামা বললে। ডায়না থিয়েটারের মালিক সুদাম শীলকে আমি চিনি। ওর স্বভাবই ওই। টাকা দিয়ে যেখানে মনের মতন জিনিস পাওয়া যায় সেখানে সে পেছপা হয় না।

তারপর?

তারপর তুই চলে গেলি। টাকাটা এদিকে ও ভেঙে ফেলেছে। ফেরত না দিতে পেরে চাকরি যায় যায়। সেই থেকে কেবল তোর খোঁজ করে বেরিয়েছে। …একটু হুঁসিয়ার থাকিস ভাই।

মাতঙ্গ সেরে উঠছিল। যমুনা সেইদিনই আশ্রমে চম্পট দিলে।

রাহু এসে উদয় হল সেখানেও।

সন্ধ্যাবেলা সবে নরেশের ফটোতে মালা ঝুলিয়েছে যমুনা। ধূপ জ্বালাতে যাবে, এমন সময় বাইরের জানালার কাছে ছায়া পড়ল। কার আবার! গঙ্গাধরের। দুটো শিক ধরে একদৃষ্টে চেয়ে আছে যমুনার দিকে। পা দুটো একবার কেঁপে উঠল যমুনার। এক্ষুণি অবশ্য জানালাটা বন্ধ করে দিতে পারে, কিম্বা দারোয়ান ডেকে ধরিয়ে দিতে পারে লোকটাকে। কিন্তু তাতে কি নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে? তার চেয়ে শেষ বোঝাপড়া হয়ে যাক আজ।

কী চাই? কঠিন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে যমুনা।

গঙ্গাধর একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিল।—দরজা খোল, বলছি।

আজ নিঃশঙ্ক হয়ে গেছে যমুনা। কোথা থেকে অদ্ভুত একটা সাহস এসেছে। দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে নিয়ে এল গঙ্গাধরকে। ধূপের গন্ধে দীপের আলোয় রহস্যময় হয়ে আছে ঘরখানা। সেই ঘরের মেজেয় মুখোমুখি দাঁড়াল দু-জনে।

এবার বলো।

আমার সঙ্গে চলো। পুরানো কথারই পুনরাবৃত্তি করলে গঙ্গাধর। নির্বিকার কণ্ঠে, অক্লেশে। এতটুকু বিচলিত হল না।

আর সঙ্গে সঙ্গে যমুনা যেন ফেটে পড়ল। লজ্জা করে না, জানোয়ার। কার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলছ জানো না তুমি।

তবু মিটি মিটি হাসছে গঙ্গাধর—লোকটা আসলে শয়তান—কার সম্মুখে?

হিড় হিড় করে ওকে যমুনা টেনে নিয়ে এল নরেশের ফটোর সামনে।—চেয়ে দেখো, আমার স্বামী। উনি আজ নেই, কিন্তু আমি ওঁরই। দেবতা ছিলেন উনি, আমাকে টেনে তুলেছিলেন। মহৎ ছিলেন, আমার সব কিছু জেনে শুনেও ওঁর পাশে স্থান দিতে ইতস্তত করেননি। আর তুমি—

নির্লজ্জের মত হাসতে হাসতে গঙ্গাধর বললে, আমি কী?

তুমি হীন, নীচ, কীট, কৃমি তুমি। টাকা ঘুষ খেয়ে আমাকে থিয়েটারের মালিকের কাছে বেচে দিতে চেয়েছিলে , কিংবা এখনো চাও।

তাই। অনায়াসে বললে গঙ্গাধর। এখনো চাই। টাকাও খেয়েছি সত্যি। কিন্তু একলা, কিন্তু একলা কি আমি? তোমার স্বামী—

টাকা খেয়েছিলেন? চিৎকার করে উঠল যমুনা।

খেয়েছিলেন। শান্ত গলায় গঙ্গাধর বললে, উত্তেজিত হয়ো না, তিনিও টাকার লোভেই তোমাকে বিয়ে করেছিলেন। নতুন ডাক্তার, তখনো পসার জমেনি, পণের টাকায় ডিসপেন্সারি সাজিয়েছিলেন, তোমার মার টাকায়, একটি একটি করে জমানো টাকায়। তখন জানতেন, তুমি ভদ্রঘরের মেয়ে, অদৃষ্টের ফেরে একবার মাত্র লাঞ্ছিত হয়েছ। তারপর যখন জানলেন, তুমি তা নও, তোমার জন্ম এবং বৃত্তি কোনোটাই গৌরবের নয়—

তুমিই জানিয়েছিলে, তারপর?

তখন তোমার দেবতা—

কী।

না, গ্লানি নয়, আত্মধিক্কার নয় , — কেননা তিনি উদার ছিলেন। কিন্তু হয়ত ভেবে দেখলেন, উপরি উদারতাটুকুর জন্যে কিছু উপরি টাকা চাই। ভদ্রঘরের মেয়ের জন্যে যদি তিন হাজার পেয়ে থাকেন, তবে গণিকার মেয়ের জন্যে চাই অন্তত আরো তিন হাজার। সহজ হিসেবে সেই মর্মে দাবি জানিয়ে চিঠিও দিলেন গিরিজাবাবুর মারফত তোমার মাকে। পেয়েও গেলেন। অতো টাকা তোমার মার ছিল না। সব কুড়িয়ে কাড়িয়ে হল এগারোশো। আর চারশো টাকা নিজে থেকে দিয়ে গিরিজাবাবু রফা করলেন দেড় হাজারে।

টকটকে লাল দেখাচ্ছে যমুনার মুখ। ধূপ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রদীপের সলতের বুক জ্বলছে। রুদ্ধ কণ্ঠে শুধু বললে, মিথ্যুক।

কর্ণপাত না করে গঙ্গাধর বললে, সেই ব্যাপারটার ফয়সালা করতেই তো গিরিজাবাবু সেবার তোমাদের ওখানে গিয়েছিলেন।

মিথ্যুক, মিথ্যুক।

গঙ্গাধর মৃদু হেসে বললে, প্রমাণও আছে। জামার পকেট থেকে বার করলে অতি জীর্ণ পুরনো একখানা কাগজ। বাড়িয়ে দিলে যমুনার দিকে।

কম্পিত হাতে যমুনা টেনে নিল কাগজটা! নরেশের হস্তাক্ষর .

‘শ্রদ্ধেয় গিরিজাবাবু, আপনি আমার সহিত প্রতারণা করিয়াছেন। ভদ্রঘরের মেয়ে বলিয়া যাহাকে বিবাহ করিয়াছি, সম্প্রতি জানিয়াছি সে জন্মকুলটা। আপনাকে অভিযুক্ত করিতে পারিতাম, জেলেও পাঠাতে পারিতাম। কিন্তু অতদূর যাইতে চাহি না। ভাবিয়া দেখিলাম, যাহা হইবার তাহা তো হইয়াছে। যদি সমাজচ্যুত নারীকে বিবাহ করিবার সাহস আমার থাকে, তবে পতিতাকে গ্রহণ করিবারও আছে। কিন্তু একটি কথা। আমার এখন কিছু হাত টানাটানি চলিতেছে। যদি যমুনার মাতাকে বলিয়া কিছু টাকা—অন্তত তিন হাজার—

অক্ষরগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এল। চিঠি থেকে মুখ তুলে একবার গঙ্গাধরের দিকে চাইল যমুনা। নরেশের ফটোর পাশে দাঁড়িয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে লোকটা নির্লজ্জ, নির্বিকার বিড়ি টানছে। মুখে পরিচিত সেই বিচিত্র হাসি।

হাতের কাছে ফুলদানি ছিল একটা। যমুনার একবার মনে হল, সেটা তুলে নিয়ে প্রাণপণে আঘাত করে লোকটাকে। কিন্তু আশ্চর্য, সেটাকে তুলতে পারল না কিছুতে। ওর সমস্ত জোর নিমেষে যেন কোথায় অন্তর্হিত হয়েছে, আঙুলগুলোও অবশ। ঝাপসা চোখে নরেশের ছবি আর গঙ্গাধরের মুখ একাকার হয়ে গেছে?

সকল অধ্যায়

১. বিচারক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. ডালিম – চিত্তরঞ্জন দাশ
৩. চন্দ্রমুখী – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪. ঠিকানায় ‘বুধবার’ – জগদীশ গুপ্ত
৫. কুসুম – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৬. আদরিণী – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
৭. সাকীর প্রথম রাত্রি – রমেশচন্দ্র সেন
৮. হিঙের কচুরি – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. মেলা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১০. মন্দ লোক – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. দন্ত কৌমুদী – বনফুল
১২. গোষ্পদ – যুবনাশ্ব
১৩. ইতি – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
১৪. খট্টাঙ্গ পুরাণ – শিবরাম চক্রবর্তী
১৫. দুকানকাটা – অন্নদাশংকর রায়
১৬. চাচা কাহিনি – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৭. বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৮. অঙ্গার – প্রবোধকুমার সান্যাল
১৯. নমুনা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২০. চোর! চোর! – বুদ্ধদেব বসু
২১. বারবধূ – সুবোধ ঘোষ
২২. ট্যাক্সিওয়ালা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
২৩. বাইজি – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৪. তিমিরাভিসার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. জামাই – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
২৬. তলানি – নবেন্দু ঘোষ
২৭. মাশুল – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
২৮. শনি – সন্তোষকুমার ঘোষ
২৯. আঙুরলতা – বিমল কর
৩০. সুর্মা – রমাপদ চৌধুরী
৩১. ঘরন্তী – বিমল মিত্র
৩২. প্রাণ-পিপাসা – সমরেশ বসু
৩৩. বাগাল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৪. ছদ্মবেশিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. নরক – প্রফুল্ল রায়
৩৬. পহেলি পেয়ার – বুদ্ধদেব গুহ
৩৭. নিরুদ্দেশ প্রাপ্তি হারানো – সমরেশ মজুমদার
৩৮. বেওয়ারিশ লাশ – জাহান আরা সিদ্দিকী
৩৯. ঝরা পাতা – তসলিমা নাসরিন
৪০. নিজের সঙ্গে দেখা – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন