শৈলেন্দ্র হালদার
অন্ধকারে চোখ মেলে ললিতা প্রথমটায় কিছুই দেখতে পেল না। তবে, একটু আগে, ঘুমের মধ্যে একটা শব্দ সে শুনেছে, তা ঠিক। ঠিক তো? তার ঘুম খুব পাৎলা, একটুতেই ভেঙে যায়। আগেকার দিনে—ছেলেবেলায়—সে ভীষণ ঘুমুত। এমন ঘুমুত যে ভূমিকম্পে বাড়ি ভেঙে পড়লেও তার ঘুম ভাঙত না। একবার—সতেরো বছর বয়েসে—সে তখন সবে নাম লিখিয়েছে—একটি ছেলে এলো তার কাছে, ভারি সুন্দর দেখতে। কত মিষ্টি কথা যে বললে তার হিসেব নেই। ছেলেমানুষ সে, মিষ্টি কথায় ভুলেছিল। ছেলেটিকে থাকতে দিয়েছিল রাত্রে। পরদিন যখন তার ঘুম ভাঙল, ছেলেটি নেই। ললিতার দুহাত ভরা চুড়ি ছিল, তাও নেই। কানে দুল ছিল, তাও অদৃশ্য হয়েছে। পাশের ঘরের মালতী বলেছিল—এখনো ললিতার সে-কথা মনে পড়ে—’এখন আর কাঁদাকাটি করে কী হবে, বল। তোর যেমন বুদ্ধি, তেমনি হবে তো! বলি, রাত্তিরে কখনো কোন বাবুকে ঘরে রাখতে আছে! ফুর্তি করে টাকা গুনে দিয়ে চলে যাও—এর বেশি আবার কার সঙ্গে কী সম্পক্ক! যেমন গিছলি পিরিত করতে, পেলি তো ফল! প্রাণে যে মেরে যায়নি, এই তোর সাত পুরুষের ভাগ্যি। পুরুষমানুষকে কেউ কখনো বিশ্বেস করে, পোড়ারমুখি! আর কী রাক্ষুসে ঘুমই বা তোর—কান থেকে দুল খসিয়ে নিলে, কিচ্ছু টের পেলিনে। আফিং-টাফিং খাইয়েছিল নাকি?….
পুরুষমানুষকে কেউ কখনো বিশ্বাস করে! না—তার পর থেকে, সে অন্তত কখনো করেনি। সর্বদা সজাগ, সর্বদা সতর্ক। অতিথির মনোরঞ্জন করতে তাকে হেসে কথা কইতে হয় , গান গাইতে হয় , অলস কটাক্ষ-বিলাসে, উদ্দীপক দেহভঙ্গিতে মোহ-বিস্তার করতে হয়, কিন্তু তার মনের এক কোণে কড়া পাহারা বসে থাকে সব সময়। মদের নেশাতেও তা ঝিমিয়ে পড়ে না, ঘুমের মধ্যেও তা ঘুমোয় না। সর্বদা সন্ত্রস্ত, সর্বদা সজাগ। কোথায় খুট করে একটু শব্দ হল, অমনি সে জেগে উঠল। তার ঘরেই শব্দ একটা হয়েছে—ঠিক তো? ললিতা চোখ খুলে রেখে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল।
ধ্রাম।—উঃ! সঙ্গে-সঙ্গে ললিতা হাত বাড়িয়ে বেড-সুইচ টিপল!
মশারি তুলে বিছানার বাইরে আসতে-আসতেই তার চোখ পড়ল উল্টো দিকের দেয়ালের বড় আয়নায়। সেখানে দেখল, ঘরের মাঝখানকার গোল টেবিলের পাশে একটা চেয়ার উল্টে গেছে, আর একটা মনুষ্য-মূর্তি চেয়ারটার পিঠে হাত রেখে উঠে দাঁড়াচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে মুখ ফেরাতেই লোকটির সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। ঠিক চোখাচোখি—তার বেশি নয়। কারণ লোকটির মুখ কালো একটা মুখোশে ঢাকা , নাকের দু’পাশে দুটো গর্তের ভিতর দিয়ে কালো একজোড়া চোখ ঝকঝক করছে। লোকটির পরনে—ললিতা একদৃষ্টিতে দেখে নিলে—জিনের একটা হাফপ্যান্ট, অত্যন্ত নোংরা। গায়ে বেখাপ্পা রকম ফর্সা একটা হাত-কাটা শার্ট। খালি পা। মাথার চুল যেন আঠা দিয়ে লেপটে উপর দিকে তুলে দেওয়া হয়েছে।
নিজের অজান্তে ললিতার বুক থেকে একটা চীৎকার উঠে আসছিল, সচেতন চেষ্টায় সে সেটা রোধ করলে। পুরুষ চরিয়ে যাকে খেতে হয়, ফুলের ঘায়ে মূর্ছা গেলে তার চলে না। নিতান্ত নিঃসহায় তার জীবন, সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর। ঘোর বিপদেও রক্ষা করবার কেউ নেই , অনিষ্ট যে-কেউ করতে পারে। বছরের পর বছর অনেক বিপদে, অনেক দুঃখে, অনেক ক্ষতিতে নিজেকে নিজেই সামলাতে হয়েছে , স্বাধীন আত্মরক্ষায় সে অভ্যস্ত। তাই নিস্তব্ধ রাত্রিশেষে একা বন্ধ ঘরে এই আকস্মিক মূর্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ল না। ভয়ে তার বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছিল, কিন্তু সে জানত, বাইরের প্রশান্তি অক্ষুণ্ণ না রাখতে পারলে এ অবস্থায় উপায় নেই।
একটু সময় উভয় পক্ষই নিঃশব্দ, নিশ্চল, তারপর হঠাৎ যেন মোহ থেকে জেগে উঠে ললিতা পিছন দিকে এক পা বাড়াল।
লোকটি শাঁ করে প্যান্টের পকেট থেকে ছোট কালো একটা জিনিস বের করে ললিতার দিকে উঁচু করে ধরলে।—’কোন দিকে এক পা নড়েছ কি মরেছ!’ গম্ভীর, ভীষণ কণ্ঠস্বর নয়, বরং কাঁপছে যেন। ললিতা একটু অবাকই হল। পিস্তলের নলটা একটা হিংস্র নিষ্পলক চোখের মতো তার বুকের দিকে তাকিয়ে আছে, লোকটার তর্জনী একটু যদি নড়ে ওঠে—একটু টান—ভীষণ শব্দ, অনেক ধোঁয়া, খানিকটা আগুন তার বুকের ভিতরে ঢুকে বেরিয়ে গেল। ললিতার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। খুব আস্তে বললে, ‘কী চাও তুমি?’
‘কী চাই?’ মুখোশ ভেদ করে খানিকটা বিকৃত হাসির শব্দ বেরিয়ে এলো, ‘সবাই যা চায়—টাকা।’
‘কিন্তু ঘরে তো কিছু নেই।’
কালো মুখেশের ফাঁকে এক জোড়া কালো চোখ হেসে উঠল যেন।—’বেশ, খুঁজে দেখা যাক, কিছু আছে কি নেই। তোমার ঘুমের ব্যাঘাত করতে হচ্ছে—কিছু মনে করো না। তুমি কি একটু কষ্ট করে চাবিগুলো নিয়ে আমার সঙ্গে আসবে?’ পিস্তলের ঘোড়ার উপর সে যেন আদরে একবার আঙুল বুলোল।
ললিতা মনে-মনে হিসেব করে দেখল যে চীৎকার করে কোন ফল হবার আশা নেই। চীৎকার করে গলা ভেঙে ফেললেও নিচে ভাঙের ঘুমে অচেতন দরোয়ানজীর কানে তা পৌঁছাবে না। দোতলায় রাসমণি হয়তো ছুটে আসতে পারে, কিন্তু তার আগেই লোকটা হয়তো তর্জনী একটু নাড়বে, আর সঙ্গে সঙ্গে…….। লোকজন ডেকে জড়ো করবার অপেক্ষায় সে থাকবে না, তা ঠিক। ললিতা এক ছুটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে? আড়চোখে সে তাকিয়ে দেখল, দরজা বন্ধ , খুলতে যে সময় নেবে, তা পোষাবে না। রাস্তার দিকে ছোটো একটা বারান্দায় যাবার দরজা—সে প্রায়ই সেটা খুলে শোয়, আজ কী মনে করে যেন বন্ধ করেছিল। ও বারান্দায় পৌঁছতে পারলেও এরকম হত , এ-রাস্তায় গভীর রাতেও দুটো-একটা লোক থাকেই, আর উল্টো দিকের পানের দোকানটা তো প্রায় সারারাতই খোলা। কিন্তু তাতেই বা কী লাভ হত? সেই নিষ্পলক, হিংস্র দৃষ্টি—তাকে সে কী করে এড়াবে?
‘শিগগির, শিগগির—বেশি সময় নেই। ভূতের সঙ্গে আমার মিল এই যে ভোর হবার আগেই আমাকে অদৃশ্য হতে হবে।—আর খানিকটা মিল সম্প্রতি চেহারায়—কি বলো?’ আবার অস্পষ্ট হাসি শোনা গেল।
‘কিন্তু সত্যি বলছি—কিছু নেই। হয়তো রোজকার খরচের দু’দশ টাকা—তাতে তোমার খাটনিও পোষাবে না।’
‘কেন—পুরুষমানুষকে ছাগল বানিয়ে যে মুঠো-মুঠো টাকা বার করে নাও, সেসব কী হল?’
‘এটা বোধ হয় জান যে আজকালকার দিনে সবাই ব্যাঙ্কেই টাকা রাখে?
‘হু।’ একটু পরেঃ ‘যাক—যা পাওয়া যায়, তা-ই সই। দু’দশ টাকাও মন্দ নয়। তাছাড়া, গয়না-টয়নাগুলো—তাও কি ব্যাঙ্কে জমা রেখেছ?’
ললিতার বুকের ভিতরটা ধবক করে উঠল। তার আলমারির দেরাজে প্রায় তিরিশ হাজার টাকার অলংকার রয়েছে—সোনা-হিরে-মুক্তোর গা-ঘেঁষাঘেঁষি, আলোর এক রাজ্য। তার সমস্ত জীবনের উপার্জন, তার জীবনের আলো। ও-গুলো যদি নিয়ে যায়—।
‘চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বার কর চাবি।
উপায় নেই, কোনো উপায় নেই। ললিতা নড়তে চাইল, কিন্তু তার পা দুটো অসম্ভব ভারি হয়ে উঠেছে।
‘আঃ, সময় নষ্ট করো না, বলছি! লক্ষ্মী মেয়ের মতো চাবির গোছাটা আমার হাতে তুলে দেবে, না সেটাও আমাকেই কষ্ট করে খুঁজে বার করতে হবে?’
উপায় নেই, উপায় নেই। ললিতা চেষ্টা করল নড়তে—কিন্তু তার শরীর পাথরের মতো স্থির। শুধু তার চোখ মশারির হালকা আবরণ ভেদ করে পড়ল গিয়ে তার বিছানায়, প্রথমে অনির্দিষ্টভাবে, তারপর স্পষ্ট হয়ে বালিশের উপর। কালো মুখোশের নিচে দুই চোখ তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করল।
‘আঃ—thank you’, বালিশ তুলতেই তার নিচে চাবির গোছা পাওয়া গেল ‘Thank you’, চাবিগুলোকে লোকটা আঙুল দিয়ে একটু আদর করল—’এবার তাহলে একটু খুঁজে দেখা যাক—কী বলো?’ যেন ললিতারই অনুমতির জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল।
এতক্ষণে ললিতা তার কণ্ঠস্বর ফিরে পেল। ‘তুমি কত টাকা চাও বলো আমি দিচ্ছি।’
‘বা-বাঃ, এখন যে একেবারে দয়ার অবতার রাণি! কী দেবে? বাজার খরচের দু’দশ টাকা?’
যা তুমি চাও। এক্ষুনি চেক লিখে দিচ্ছি।’
‘চেক?…..বাঃ, আমি ভাঙাতে যাই , আর এদিকে তুমি ব্যাঙ্কে খবর দিয়ে রাখবে—ঠেলবে হাজতে! না, তোমার এ-দয়া নিতে পারলুম না, দুঃখিত।’
‘না—সত্যি। আমি মোটেও খবর দেব না ব্যাঙ্কে। সত্যি তোমাকে দিয়ে দেব—ধর এক হাজার? কাল ঠিক দশটার সময় তুমি কড়কড়ে হাজার টাকা পেয়ে যাবে।
লোকটা যেন একটু ইতঃস্তত করছে। অমনি ললিতা বললে, ‘আচ্ছা, দেড় হাজার! হবে ওতে?’
লোকটা মনে-মনে কী যেন একটু হিসেব করল, তারপর যেন নিজের মনেই বলে উঠল, ‘নাঃ—বেশ্যার কথায় যে বিশ্বাস করে নরকেও তার জায়গা হয় না।
‘তাহলে আমার কথাটা তুমি রাখলে না?’
‘বেশি কথা বোল না—যা বলছি তা-ই কর।’
‘কী করতে হবে, বল।’ এতক্ষণে ললিতা তার স্বাভাবিক আত্মস্থতা ফিরে পেয়েছিল।
‘এই নাও চাবি—ঐ আলমারিটা খোল তো।’
‘দাও।’ ললিতা হাত পাতল। চাবি দিতে গিয়ে লোকটার আঙুল তার হাতে লেগে গেল।
‘বাঃ, বেশ নরম তো তোমার আঙুল।’
‘ও-সব প্যাঁচ আমার উপর চলবে না, সুন্দরী। যাও—খোল আলমারি।’
‘যদি না খুলি?’
আমাকেই খুলতে হবে তাহলে।
‘যদি বাধা দিই?’
‘তাহলে এই যে—’ উঁচোনো পিস্তলটায় (এতক্ষণের মধ্যে সে একবারও সেটা নামায়নি) সে একবার ঝাঁকুনি দিলে।
‘তাহলে আমাকে সত্যি মেরে ফেলবে?’
‘না, মেরে ফেলব কেন? ঠ্যাংটা শুধু একটু খোঁড়া করে দেব, যাতে আমি স্বচ্ছন্দে পালাতে পারি।’
‘তারপর বাকি জন্ম আমি খোঁড়া হয়ে থাকব?’
‘বোধহয়।’
‘না, না, খোঁড়া হয়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না। সে বড় বিশ্রী। তার চেয়ে বরং আমায় মেরে ফেল।’
‘তা ঠিক জায়গায় লাগলে মরেও যেতে পার।’
‘আচ্ছা—তুমি যে আমাকে মেরে ফেলবে, একটু কষ্ট হবে না তোমার?’
‘কষ্ট কিসের? তোমার মতো জঘন্য জীবন যত শিগগির শেষ হয়, ততই ভালো।’
‘তা হোক, তবু—আচ্ছা, আমার মতো সুন্দর মানুষ কখনো দেখেছ?’
কালো মুখোশের নিচে কালো দুই চোখ মুহূর্তের জন্য ললিতার মুখের উপর নিবন্ধ হয়েই আনত হল!—’তোমার সঙ্গে রসালাপ করতে আমি এখানে আসিনি। যা বলছি করো।’
আস্তে-আস্তে ললিতা আলমারির কাছে গেল, লোকটা তার পিছনে। আলমারির দরজাও প্রকাণ্ড, ঝকঝকে আয়না সেখানে ললিতা নিজের ছায়া দেখে একটু স্তব্ধ না হয়ে পারল না। অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে বিচার করলেও মানতে হয় যে সে সুন্দরী। অপরিপূর্ণ ঘুমে ঈষৎ ফোলা-ফোলা তার চোখ—সন্ধ্যাবেলা সে যে সুর্মা মেখেছিল তার কালো আভা এখনো দুঃখের চিহ্নের মতো চোখের কোলে লেগে আছে , একরাশ এলো চুল পিঠে ছড়ানো—কালো, এখনো কালো। কিন্তু আর ক’দিন? দিনে দিনে বয়েস বেড়ে চলে—বয়েস তো কারো কথা শোনে না। তার এমন যে নিটোল মজবুত শরীর—তাও একদিন ভেঙে পড়বে। সময় আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু……অদৃশ্য অপরাজেয়। তার হাত এড়াতে কেউ পারেনি, ললিতা, তুমিও পারবে না। তবু—যে ক’দিন হয়। এখনো হয়তো বছর দশেক মেয়াদ আছে। তার ভাগ্য ভালো, অনেক বাঙালি মেয়ের চাইতেই তার যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হল। জ্বালিয়ে যাও, ললিতা, আর যে-কদিন পার, জ্বেলে যাও, জ্বালিয়ে যাও। আয়নায় ছায়ার মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটলো।
‘চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
ললিতা মুখ ফিরিয়ে সেই কালো মুখোশের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘নিজের চোহারা দেখছিলাম। সুন্দর—কি বলো?’
‘খোল! লোকটির স্বর অধীর আগ্রহে কাঁপছে, ‘খোল!’
‘খুলছি!’ চাবি লাগিয়ে ললিতা হঠাৎ আবদারের সুরে বলে উঠল, ‘তোমার পিস্তলটা নামাও—আমার বড় ভয় করছে।’
‘আমার কথা-মতো চলো—কিছু ভয় নেই তোমার।’
ললিতা চাবি ঘুরিয়ে আলমারি খুলল। উপরের তাকগুলো সব শাড়িতে ঠাসা। সেখানে হাত রেখে ললিতা বললে, ‘তোমার বৌ আছে?’
লোকটি হুমকি দিয়ে উঠল, ‘ফাজলেমি!’
ললিতা হতাশভাবে একটু ঘাড় নেড়ে বললে, ‘কী মুশকিল! ভালো কথা কইলেও যে চটে যায়—’
‘থাক, তোমাকে এখন ভালো কথা কইতে হবে না। কী আছে বের করো দিকি।’
আছে তো এক বোঝা শাড়ি—মরলে পরে সব চিতেয় যাবে আর কি। মেয়েটাও মরে গেল—নইলে অ্যাদ্দিনে কি আর ওর শাড়ি পরবার বয়েস না হত। বলছিলাম কী—ভালো দেখে একখানা বেছে বৌয়ের জন্য নিয়ে যাও—বৌ খুশী হবে। তা তুমি তো চটেই উঠলে। চাও তো আমিই বের করে দিচ্ছি। এই যে, এখানা—’ ললিতা পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উপরের তাকের তলা থেকে আগুনের রঙের একটা শাড়ি টেনে বের করলে—’পছন্দ হয়? খাঁটি বেনারসি সিল্ক—হাজার টাকা এর দাম।’
‘হাজার টাকা?’
‘ছিলেন এক জমিদারবাবু—মৈমনসিং জেলায় বাড়ি। বড্ড ভালোবাসতেন আমাকে। তিনি দিয়েছিলেন এখানা। ভদ্দরলোকের দিলটা খুব খোল ছিল—তা এমন কপাল, অকালে মরে গেলেন। লিভার নাকি পচে গিয়েছিল।’ ললিতা শাড়ির ভাঁজ খুলল, মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল খানিকটা—’ভালো জিনিস—একশো বছরেও কিছু হয় না। নিয়ে যাও না এখানা বৌয়ের জন্য।’
লোকটা হাত দিয়ে শাড়িখানা একটু নেড়ে-চেড়ে বললে, ‘হু’। ভালো জিনিস—না? হাজার টাকা দাম। হাজার টাকা দামের আরো শাড়ি আছে তোমার?’
‘ক—ত! আরো চাই দু’একখানা?’
‘ছাই! বৌ-ফৌ আছে নাকি যে নিয়ে যাব!’
‘ও—তুমি বুঝি বিয়ে করোনি? আহা—কেন গো?’
‘তোমার সঙ্গে এখন ঘরোয়া আলাপ করবার সময় আমার নেই। দেরাজগুলো খোল। গয়না কী আছে দেখি।’
‘হ্যাঁ, গয়না।—দেখছি।’ আগুনের রঙের শাড়িটা এলোমেলো হয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল। ললিতা নিচু হয়ে উপরের দেরাজে চাবি-লাগিয়ে বললে, ‘পিস্তলটা নামাও না ভাই। বড্ড ভয় করছে আমার।’
‘কী ছেলেমানুষের মতো কেবল ভয় করছে! ভয় করছে! আর—দ্যাখো, আমাকে ভাই-টাই বলবে না।’
‘ওমা, কেন? একজনকে ভাই বললে কী দোষ?’
‘আছে দোষ।’
‘কী বল তাহলে?’ ললিতা মুখ ফিরিয়ে চপল হাসি-ভরা চোখ তুলে তাকাল, ‘প্রভু?’ সঙ্গে-সঙ্গে উপযুক্ত থিয়েটারি মুখ-ভঙ্গি করে—’নাথ? প্রাণেশ্বর?’
‘ফাজলেমি—না?’ লোকটা রাগে যেন গর্জাচ্ছে।
‘তুমি একেবারে ছেলেমানুষ কিন্তু।’ ললিতা খিলখিল করে হেসে উঠল।
‘দ্যাখো, বাড়াবাড়ি করবে তো মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। খোল শিগগির দেরাজ।’
ললিতা এক টানে দেরাজ খুলে ফেলল। লোকটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে, ‘ঐ বাক্সটা দেখি।’ তার নির্দেশমতো ললিতা কুমিরের চামড়ার বেশ বড় একটা অ্যাটাশে কেশ বার করে পাশের একটা টিপয়ের উপর রাখল। তারপর লোকটা কিছু বলবার আগেই সেটা খুলে ফেলে বললে, ‘দেখবে এসো।’
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে লোকটা ঝুঁকে তাকাল। খানিকক্ষণ তার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলো না। ললিতা তার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বললে, বেশ সুন্দর না?’
‘বেশ।’ লোকটার গলা দিয়ে স্বর যেন ফুটছে না।
‘বেশ! শুধু বেশ! এত সুন্দর জড়োয়া গয়না তুমি দেখেছ কখনো?’ লোকটা কোন কথা বললে না। ‘এই সব—’ হঠাৎ ললিতার স্বর অত্যন্ত কোমল হয়ে এলো, ‘স—ব তুমি নিয়ে যাবে?
‘আপত্তি আছে তোমার?’
‘আমাকে একেবারে বিধবা করে রেখে যাবে? উঃ, পুরুষের প্রাণ কী নিষ্ঠুর!’
এতক্ষণে লোকটার চোখ অ্যাটাশে কেশ থেকে ললিতার দিকে ফিরল।—’থাক, আর ন্যাকামো করতে হবে না।’
‘ন্যাকামো! একে তুমি ন্যাকামো বলো!’ ললিতার স্বর আবেগে ভারি হয়ে উঠল, ‘বললেই তো! তুমি নিষ্ঠুর, তোমার হৃদয় নেই, তুমি কী করে বুঝবে এই গয়নাগুলোকে আমি কত ভালোবাসি।’
‘ইশ—এত মোহ! এ-কথা কখনো ভাবো, তুমি মরে গেলে এ গয়নাগুলোর কী হবে।’
‘মরে গেলে কী হবে? যা খুশি তাই হবে। সে-কথা ভেবে কী লাভ? মেয়েটা যদি থাকত তাহলে কি আর কোন ভাবনা ছিল? কী সুন্দর ছিল দেখতে—মনের সাধ মিটিয়ে ওকে আমি সাজাতে পারতাম। গয়নাগুলোর দিকে যখনই তাকাই ওর কথাই আমার মনে পড়ে।’
‘তোমার মেয়ের কপাল ভালো—তাই সে মেরেছে।’ লোকটা এক হাতে অ্যাটাশে কেশটা বন্ধ করলে।
‘ও কী? ওটা বন্ধ করছ কেন? সত্যিই কি সব নেবে তুমি?’
‘কত দাম হবে এগুলোর বল তো? হাজার খানেক—?’
‘ওমা, বলে কী!’ ললিতা খিলখিল করে হেসে উঠল, উঃ, হেসে আর বাঁচিনে!
‘চুপ!’ লোকটা হিংস্র স্বরে উঠল। ‘বলো—এখানে কত টাকার গয়না আছে?’
ললিতা শান্তভাবে বললে, ‘তিরিশ হাজারের একটি পয়সা কম না।’
‘কত’
‘তিরিশ হাজার।’
‘তি-রি-শ হা-জা-র!’ পরক্ষণেই স্বর বদলেঃ ‘ও—তিরিশ হাজার বে—শ। আচ্ছা, এবার তোমার দেরাজের অন্যান্য বাক্সগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক।’
‘দেখাচ্ছি। কিন্তু—’ করুণ সুরে ললিতা বললে, ‘কিন্তু আমার একটা কথা রাখবে?’
‘না, রাখব না।’
বেশি কিছু নয়—সামান্য একটা হিরের আংটি , অত জিনিসের মধ্যে টেরও পাবে না তুমি। একজন আমাকে দিয়েছিল?’
‘এ-সবই তো তোমাকে কেউ-না-কেউ দিয়েছিল?’
‘সেজন্যই তো ওগুলোর উপর আমার এত মায়া। সমস্ত জীবন ভরে কত লোকের ভালোবাসা কুড়িয়ে এত-সব জিনিস উপহার পেলাম—আর তুমি হঠাৎ এসে এক ফুঁয়ে সব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছ! আর সব নাও—কিন্তু ঐ আংটিটা কি দিয়ে যেতে পার না? ওটা যে দিয়েছিল, তাকে আমি ভারি ভালোবাসতাম।’
‘ভালোবাসতাম!’ লোকটা হা-হা করে হেসে উঠল। ‘ভালোবাসার কথা তোমার মুখেই মানায়!’
‘যেন তোমার মুখেই মানায়!’ কী জানো তুমি ভালোবাসার? কখনো ভালোবেসেছ কাউকে?’
‘হয়েছে, এখন থামো।’
‘না, কক্ষনো বাসোনি। তাহলে আমার এ-কথাটা তুমি রাখতেই। ওগো—এত করে বললাম—’
‘ওগো-টোগো বোলো না, বলছি।’
‘থুড়ি—ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা, এত জিনিসের মধ্যে সামান্য একটা আংটি রেখে গেলে এমন কী ক্ষতি হয় তোমার!’
‘নাও—এবার ঐ বাক্সটা খোলো তো।’
‘কোনটা? ঐটে? ওটা খুলে কী হবে—ওটাতে কিছু নেই!’
‘কিছু-নয়টাই দেখা যাক।’
‘বেশ।’ চন্দনকাঠের একটা বাক্স—চাবিও ছিল না। টানতেই ডালা উঠে এলো। ‘এটার ভিতর সব চিঠিপত্র! প্রেম-পত্র। এগুলো কি তোমার কোন কাজে লাগবে?’ ললিতা বাক্সটা তুলে এনে টিপয়ের উপর রাখল। ‘আঃ—’ ভিতরের চিঠিগুলো ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে—’এগুলো দেখে কত কথাই যে মনে পড়ে! কত বাবু এলেন—আর গেলন।’
‘সবাই তোমাকে চিঠি লিখত?’
‘ঝুড়ি-ঝুড়ি। সব কি আর রাখা যায়? যাদের সঙ্গে খুব বেশি প্রণয় ছিল, তাদের চিঠিগুলো সব আছে।’
‘কেন রেখেছ?’
‘এমনি—মাঝে-মাঝে দেখতে বেশ মজা লাগে।’ ললিতা বাস্ক থেকে একটা খাম বা’র করল। ‘এটা কার?…..ও—’ চিঠিটা খুলে চোখের সামনে ধরল ললিতা। লোকটা ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধের উপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল।
‘ওগো তুমি অত কাছে এসো না। আমার বড্ড ভয় করে।’
‘ছি ছি। বলে লোকটা সরে গেল।’
‘ছি ছি কেন?’
‘কী-সব লিখেছে!’
‘এ আর কী! আরো কত সব আছে। ভারি রসিক ছিল ছেলেটা বড়োলোকের ছেলে, কলেজে পড়ত। দেদার টাকা উড়িয়েছে এখানে। গুণ-যোগ্যতাও ছিল কিছু। গান গাইতে পারত—পদ্য লিখত, কাগজে ছাপা হত সে-সব, আমাকে দেখাত এনে। একবার আমার নামে মুখে-মুখে ছড়া কেটেছিল, এখনো মনে আছে .
ওগো ললিতা—
প্রাণের প্রদীপে মোর
তুমি সলিতা।
‘তুমি সলিতা—ভারি মজার, না?’ ললিতা হেসে উঠল।
‘হুঁ, এই হচ্ছে কলেজে-পড়া বড়োলোকের ছেলে।’
‘এখন ডিপটি হয়েছে শুনলাম। ওরই আবার এক বন্ধু এসেছিল, কথায় কথা উঠল—বিয়েও করেছে। বি.এ. পাশ বৌ। ভারি মজা লাগে ভাবতে—কত ছেলে যে আমার হাত দিয়ে বেরিয়ে গেল—’ মুহূর্তের জন্য ললিতা যেন অনেক দূরে চলে গেল। ‘তা দ্যাখো’, উপস্থিত সময়ে ফিরে এসে ললিতা বলতে লাগল, ‘এই চিঠিগুলোও তুমি কাজে লাগাতে পার।’
‘কী করে?’
‘তা-ও বুঝতে পারছ না? ধরো এই চিঠিগুলো যদি তোমাকে দিয়ে দিই—ডেপুটি-সাহেব নতুন বিয়ে করেছেন, ব্যাপারটা জানাজানি হোক তিনি তা নিশ্চয়ই চাইবেন না। আর তার জন্য অমন দু-পাঁচশো টাকা কি তোমায় দিয়ে দেবেন!’
‘ছি ছি—আমি বুঝি তা-ই করতে যাব! এ তো blackmailing’
‘তা ইংরেজিতে ওকে যা-ই বলুক, এ করে তুমি পয়সা কিন্তু পেতে পার—যদি পয়সাই চাও!’
‘যদি চাই! কে না চায়?’
‘তাহলে তোমাকে যখন টাকা দিতে চাইলাম—নিলে না কেন? আমি ভাবলাম তোমার বুঝি গয়নাগুলো দিয়েই বিশেষ-কোন দরকার, তাই তুমি ওগুলো নিচ্ছ।’
‘দরকার আর কি! ওগুলো ভাঙিয়ে তিরিশ হাজার টাকা করে নিত কতক্ষণ!’
‘ওমা তুমি ওগুলো বেচতে যাবে নাকি? বলিহারি বুদ্ধি তোমার!’
‘দ্যাখো—মুখ সামলে কথা বলো।’
তুমি কি মনে করছ ওগুলো কোথাও নিয়ে বেচতে পারবে? তুমি কি মনে করেছ আমি পুলিশে খবর দেব না? তুমি কি মনে করেছ, যে ও-রকম গয়না সবারই থাকে যে তোমার হাতে তা দেখামাত্র যে-কেউ সন্দেহ করবে না?’
‘তুমি কি মনে করেছ তোমার লেকচার শুনতে আমি এখানে এসেছি?’
‘শুনলেও ক্ষতি নেই। আমার কাছে তোমার অনেক শেখার আছে। তোমারই ভালোর জন্য বলছি—তুমি যদি ওর একটি গয়নাও বেচতে যাও, অমনি হাতে-হাতে ধরা পড়বে, আর পত্রপাঠ জেল।’
একটু চুপ করে থেকে লোকটা বললে, ‘তা-ই বা মন্দ কী? তবু তো জেলে গেলে খেতে পাব।’
‘কেন, এমনিতে তুমি কি খেতে পাও না?’
‘ও-সব কথা দিয়ে তোমার কী দরকার?’
‘থাক, থাক,’ ললিতা অনুতপ্ত স্বরে বললে, ‘তোমার ইচ্ছা না-হলে কিছু বোলো না। আহা—যে দিন-কাল পড়েছে—দেশে এমন টানাটানি আর কখনো হয়নি।’
‘থাক, তোমাকে আর মায়া-কান্না কাঁদতে হবে না। অভাবের তুমি কী জানো? কত জমেছে, তোমার ব্যাঙ্কে? লাখ-খানেক?’
‘পাগল! অত কী করে হবে? তবে অল্প-স্বল্প কিছু যে নেই, তাও নয়।’
‘তুমি যে দিব্যি পাপের পয়সা জমিয়ে যাচ্ছ—এদিকে কত লোক যে ভালো করে দু’বেলা, খেতে পাচ্ছে না, সে খোঁজ রাখ? বলতে পার, কী অধিকার আছে তোমার এত টাকা ভোগ করবার? মরে গেলে শ্মশানে নিয়ে যাবার লোকও তো তোমার নেই। কী হবে তখন তোমার এত টাকা দিয়ে?’
‘সে-কথা যে আমিও না ভেবেছি, তা নয়! একটা ছেলেকে পুষ্যি রাখব ভাবছি, এমন-একটা ছেলে, সংসারে যার কেউ নেই-টেই। সে-রকম কারো খোঁজ দিতে পার?’ একটু পরে ললিতাই আবার বলল, খোঁজবার আর দরকার কী। এই তো তুমিই আছ। তুমি—হবে আমার ছেলে?’
‘যাওঃ!’
‘যাওঃ কেন? হও না।’
‘রসিকতা, না?’
ললিতা হেসে উঠল!—’ওঃ, ছেলেমানুষ! একেবারে ছেলেমানুষ!’
‘দ্যাখো, ছেলেমানুষ-ছেলেমানুষ কোরো না বলে দিচ্ছি। তোমার বয়স কত শুনি?’
‘ওগো ছেলেমানুষ, এ-ও কি জানো না যে মেয়েমানুষকে কখনো তার বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই?’
‘যাও—যাও—তোমার বয়সের বা অন্য-কোন বৃত্তান্ত জানবার কৌতূহল আমার নেই। আমার যে-বিষয়ে কৌতূহল আছে, তা হচ্ছে তোমার টাকা। শোনো—(খুব গম্ভীরভাবে)—’তুমি তখন যা বলেছিলে, সত্যি?’
‘কী বলেছিলাম?’
‘সেই চেক লিখে দেবার কথা! সত্যি আমাকে দিয়ে দেবে টাকাটা! খবর দেবে না পুলিশে?’
‘সত্যি, সত্যি, সত্যি। তিনবার বললাম! তোমার গা ছুঁয়ে বলছি।’ ললিতা লোকটার হাতের উপর হাত রাখল।
ক্ষিপ্রগতিতে হাত সরিয়ে নিয়ে লোকটা বললে, ‘তাহলে লেখ শিগগির। পাঁচ হাজার টাকা।’
‘পাঁ চ হা জা র?—’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, পাঁচ হাজার। শিগগির। তোমার গয়না-টয়না সব রইল—ও আমি চাইনে। আমার দরকার টাকার। তোমার পাপের বোঝা খানিকটা হালকা করে দিয়ে যাচ্ছি—ভালোই হল তোমার।
‘আমি করব পাপ, আর তুমি তার পুণ্যফল ভোগ করবে। মন্দ নয় ব্যবস্থা।’
‘তোমার হাতে টাকাগুলো মিছিমিছি পড়ে আছে, আমার হলে সেগুলো কাজে লাগবে। সুতরাং আসলে ও-টাকা আমারই। কোথায় তোমার চেক-বই বার করো!’
‘ঐ ড্রেসিং-টেবিলের দেরাজে চেক-বই আর কলম আছে—নিয়ে এসো না।’
‘তুমি যেতে পার না, না?’
‘বড্ড ভয় করছে যে—তোমার পিস্তলটা—’
‘কিছু ভয় নেই। আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে যাব, কিন্তু তোমাকে ছোঁবও না।’
‘ছোঁবেও না। একেবারে ভীষ্ম—’
‘ফের ফাজলামি!’
‘আর করব না—অভ্যাসের দোষ। কিন্তু তোমার পিস্তলটা একটু নামাও না—যদি ধর কোনরকমে ছুটে গেল—’
‘কী ঘ্যানর-ঘ্যানর করছ! এটা সত্যিকারের পিস্তল কিনা যে ছুটে গিয়ে তোমাকে মেরে ফেলবে!’
খানিকক্ষণ ওলোট-পালোট, অস্ফুট দু’একটা চীৎকার। তারপর ললিতা হাত ঝাড়তে ঝাড়তে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল। লোকটা মেঝেতেই বসে আছে , সেই আগুনের রঙের শাড়িটা দিয়ে তার দু’হাত পিঠ-মোড়া করে বাঁধা। একটু দূরে তার পিস্তল আর মুখোশ পড়ে আছে। ভারি কাঁচা মুখ—আঠারোর বেশি বয়স মনে হয় না। ভালো করে যেন দাড়িগোঁফও ওঠেনি। কালো-কালো চোখ। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে দুদিক ভাগ হয়ে পড়েছে। আশঙ্কায়, হতাশায় বিমর্ষ গম্ভীর মুখ! স্থির দৃষ্টিতে মেঝের দিকে সে তাকিয়ে।
ঘরের কোণে একটা টেলিফোন ছিল, ললিতা আস্তে-আস্তে সেখানে গিয়ে মৃদুস্বরে জিগেস করলে, ‘এইবার ডাকি তাহলে পুলিশ?’
লোকটা তার কালো-কালো চোখ তুলে একবার ললিতার দিকে তাকালো , কোন কথা বললে না।
‘যদি কিছু মনে না করো—’ ললিতা টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালো।
‘না, না’ সঙ্গে সঙ্গে লোকটা চীৎকার করে উঠল, ‘না, না।’ দু’ পায়ের গোড়ালিতে ভয় দিয়ে টলতে-টলতে সে উঠে দাঁড়াল—তার পিঠ একটু বেঁকে গেছে, মাথা ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে—মুহূর্তের মধ্যে সে ললিতার কাছে এসে দাঁড়াল। তার পিছনে মস্ত লম্বা শাড়িটা লাল রঙের প্রকাণ্ড একটা লেজের মতো গড়াচ্ছে।
ললিতার তীব্র-চোখ লোকটাকে বিদ্ধ করল।—’বারণ করছ পুলিশ ডাকতে?’
লোকটি মাথা নিচু করে চুপ।
‘নিজেই তোমার শাস্তির ব্যবস্থা করব তাহলে? কী হবে তোমার শাস্তি?’ ললিতা ঠোঁটের এক কোণে কামড়ে ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল!
‘তোমার যা খুশি তা-ই করো,’ নিষ্প্রাণ স্বরে লোকটি বললে, ‘বোকা, আমার মতো বোকা আর হয় না।’
‘সে-কথা মনে করবার কোন কারণ নেই, ভাই,’ মিষ্টি হেসে ললিতা বললে, পুরুষ মানুষ যদি মাঝে মাঝে বোকাই না-বনবে, তাহলে আমাদের চলবে কী করে, বলো!’
লোকটি কথা না-বলে ঘরের চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখল। ‘দুঃখের বিষয়’, তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ললিতা বললে, ‘তোমার পক্ষে এখন পালানো শক্ত। জোর যদি করতে যাও, কিছু লাভ হবে না, বরং চুপচাপ লক্ষ্মী ছেলের মতো বসে থাকো। লাফালাফি করতে গেলে হয়তো হাত-পা ভাঙবে।’ আচ্ছা, লোকটিকে চুপ দেখে ললিতা জিগ্যেস করলে, ‘তুমি কী করে ঢুকলে এ-ঘরে?’
‘পাইপ বেয়ে।’
‘পাইপ বেয়ে! মাগো—ভয় করল না তোমার! যদি পড়ে যেতে!’
‘যেতাম তো যেতাম। অত ভাবলে কি আর চলে।’
‘তাই বলে পাইপ বেয়ে এই তেতলার ঘরে—তোমার এত সাহস, অথচ পুলিশকে তোমার ভয়!’
‘সাহস! সাহসই বটে। অমন দায়ে-পড়া সাহস অনেকেরই হয়।’
‘দায়ে পড়া কেন?’
আমি আর কথা বলতে পারছি না, তুমি যা করবার করো—এই আমি বসলাম।’ লোকটি কোনরকম করে একটা চেয়ারে বসল।
‘তোমার বসে খুব আরাম হচ্ছে না বোধহয়’, ললিতা বললে, ‘তা একটু না-হয় কষ্টই হল। এ-ই তো কষ্ট করবার বয়স।’
লোকটি হঠাৎ উত্তেজিতস্বরে বলে উঠল, ‘আমার হাত খোলা থাকলে এ-জন্য তোমাকে চড় বসিয়ে দিতে পারতাম।’
‘আর সে-জন্যই তোমার হাত দুটো খোলা রাখলাম না।’
লোকটির উত্তেজনা যেন আর এক ডিগ্রি চড়ে গেল, ‘ও-কথা এত শুনেছি যে কাউকে এখন বলতে শুনলেই মারতে ইচ্ছে করে।’
ললিতা খাটের এক প্রান্তে আলগোছে পা ঝুলিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলে, ‘কোন কথা?’
‘এই কষ্ট সইবার কথা। চাকরির খোঁজ করে-করে হয়রান—কোথাও কিছু হয় না। বাড়ি-গাড়ি নিয়ে যারা গ্যাঁট হয়ে বসেছে, তাদের কাছে গেলে এই উপদেশ শুনেছি—’কষ্ট করতে শেখ, ছোকরা, এ-ই তো কষ্ট করবার বয়স।’ কষ্ট! কতই যেন জানেন ওঁর কষ্টের! ইচ্ছে করে—লোকটি হঠাৎ থেমে গেল।
‘থামলে কেন? বলো না, কী ইচ্ছে করে তোমার।’
লোকটি যেমন দপ করে জ্বলে উঠেছিল, তেমনি ফশ করে নিবে গেল। হতাশভাবে মাথা নেড়ে শুধু বললে, ‘না, না।’ স্বচ্ছন্দভাবে একটু নড়তে গিয়ে তার হাতে চোট লাগল।
উঃ!
‘খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার, না? হঠাৎ যেন গরমও হচ্ছে।’ ললিতা উঠে গিয়ে পাখাটা ছেড়ে দিলে। হাওয়ায় লোকটার দু-একটা চুল উড়ে-উড়ে তার কপালের উপর এসে পড়তে লাগল।
হঠাৎ ললিতা বললে, ‘কী সুন্দর তোমার চুলগুলো! কিন্তু অমন বিশ্রী করে লেপটে উল্টে রেখেছিলে কেন?’
‘দ্যাখো, তুমি যদি—’ লোকটি খুব চড়া গলায় আরম্ভ করেই থেমে গেল।
নাঃ, তুমি যেন কেমন! কোন কথা বলি কি ফোঁশ করে জ্বলে ওঠ। মিষ্টি কথা তোমার যেন মুখেই আসে না!’
‘তোমার দু-হাত কষে বেঁধে রাখলে দেখতাম, তোমার মুখ দিয়েই কেমন মধু ঝরে!’
‘ও, সে-কথা! তা তুমি যখন আমাকে পিস্তল নিয়ে শাসাচ্ছিলে, আমি বলিনি মিষ্টি কথা?’
‘বলেছিলে বইকি। মিষ্টি কথা বলেই তো আমাকে পথে বসালে।—উঃ, কী ভীষণ বোকা আমি!’
‘যদি বলো তোমার হাত খুলে দিই।’
লোকটি সন্দেহ-ভরা চোখে ললিতার দিকে একবার তাকিয়ে চুপ করে রইল।
‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার?’
‘বিশ্বাস! লজ্জা করে না তোমার ও-কথাটা উচ্চারণ করতে!’
একটু হেসে ললিতা বললে, ‘লজ্জা-টজ্জা থাকলে কি আর আমাদের চলে ভাই!’
‘সত্যি নেইও।’ তীব্র মুখভঙ্গি করে লোকটি বললে।
‘তোমার সঙ্গে গল্প করতে কিন্তু মন্দ লাগে না, কিন্তু এখন বিশ্রী তোমার মেজাজ!’
‘আর বকতে পারিনে তোমার সঙ্গে।’ একটা হাই তুলে লোকটি বললে, ‘পুলিশ ডাকতে হয় ডাক—আমার ঘুম পাচ্ছে।’
‘পুলিশ এসেই তোমার ঘুমের চমৎকার ব্যবস্থা করে দেবে নাকি?’
‘বসে-বসে আর বকর-বকর করতে হবে না তো।’
‘কিন্তু থানায় নিয়ে গিয়ে যখন দেবে মার—’
‘ইস, মারবে কেন? ভদ্রলোককে কখনো মারে?’
‘চোর আবার কখনো ভদ্দরলোক হয়?’
‘দ্যাখো, চোর-চোর বলো না, বলছি।’
‘নিশ্চয়ই বলব। চোরকে চোর বলব না! চোর! চোর!’
‘আমি চোর নই! আমি চোর নই! (চিৎকার করে)
‘নাঃ, চোর হবে কেন? রাত চারটের সময় পাইপ বেয়ে এমনি একটু শখ করে আমার ঘরে উঠে এসেছিলে। তবু যদি পিস্তলটা সত্যিকারের হত!’
খোঁচা খেয়ে লোকটা এক লাফে উঠে দাঁড়াল। নানারকম মুখবিকৃতি সহকারে হাত দুটো খোলবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে-করতে বলতে লাগল, ‘তুমি! তুমি চোর! তুমি যা করো তা ও তো চুরি! স্রেফ চুরি!’
ললিতা একটু লাজুক-লাজুক ভাবে বলল, ‘আমি মন চুরি করি, আর কিছু না।’
‘উঃ, অসহ্য! অসহ্য!’
‘ও-রকম ধেই-ধেই করে লাফাচ্ছে কেন? নিচে রাসমণি শোয়—সে হয়তো জেগে উঠবে।’
‘ললিতার কথা শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই দরজায় ভীষণ জোরে ধাক্কা পড়ল। ভীত মেয়েলি গলায় শোনা গেল—দিদিমণি, ও দিদিমণি।’ মুহূর্তের মধ্যেই ললিতার মুখের চেহারা একেবারে বদলে গেল। ত্রস্তভাবে সে একবার এদিক ওদিক তাকাল, তারপর চট করে উঠে এসে লোকটার হাত খুলে দিতে-দিতে অর্ধস্ফুট স্বরে বললে, ‘যাও—শিগগির খাটের নিচে ঢোক গে।’
লোকটা হাত ছাড়া পেয়ে পরম আরামে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দরজার বাইরে থেকে আবার শোনা গেল, ‘দিদিমণি, ও দিদিমণি।’
‘যাও’, ললিতা লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে তীব্রস্বরে বললে, ‘শিগগির যাও!’
লোকটা কোন কথা না বলে তৎক্ষণাৎ হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নিচের অন্ধকারে অদৃশ্য হল। স্তূপাকৃত লাল শাড়িটা লাথি মেরে মেরে ললিতা তার পিছনে পাঠিয়ে দিলো, তারপর একবার মুখের উপর হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে গিয়ে দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলে, ‘কী হয়েছে, বিন্দি? চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?’
‘কী হয়েছে, দিদিমণি?’
‘কী হয়েছে?’ ললিতা চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললে, ‘আমিও তো তোকে সে-কথাই জিগেস করছি। তোর হয়েছে কী?’
বিন্দি ঘরের ভিতরে একবার তাকিয়ে বললে, ‘তুমি চোর-চোর বলে চ্যাঁচাচ্ছিলে না গো?’
‘চোর! মাথা-খারাপ হয়েছে নাকি তোর? কী যে বকছিস!’
‘ওমা, আমি যে স্বকর্ণে শুনলুম গো। শুনে উঠে এনু। তুমি চ্যাঁচাচ্ছ-চোর চোর—আর একজন মোটা গলায় বললে, আমি চোর নই, চোর নই—এ যে পষ্ট শুনলুম।’
‘তোর মাথা! ছাইভস্ম কী স্বপ্ন দেখেছিস তার ঠিক নেই, এখন মাঝ-রাত্তিরে উঠে জ্বালাতন করছিস আমাকে।’
বিন্দি একটু দ্বিধার স্বরে বললে, ‘না দিদিমণি, স্বপন নয়। আমার বুকটা যে এখনো ধড়াস-ধড়াস করছে গো।’
‘যা যা, আর বকিসনি—শুয়ে থাক গে। ঘুমটা ভাঙালি তো আমার।’
‘আমি তোমার ঘুম ভাঙতে যাব কেন গো? ভালো মনে করে উঠে এনু। দিন-কাল বড় খারাপ পড়েছে—’
‘নে, হয়েছে, কাল সব শুনব। এখন ঘুমোতে দে?’
বিন্দি তবু একটু অপেক্ষা করল।—’তুমি কিছু শোননি, দিদিমণি? কিচ্ছু না?’
‘কই, না তো।’ তারপর অনাবশ্যকভাবে বললে, ‘আমি বিভোর হয়ে ঘুমুচ্ছিলাম।
‘যাক—ভাগ্যিস কিছু নয়, দিদিমণি। একবার ভাবো দিকি—’
‘হ্যাঁ, ভেবেছি , তুই এখন যা তো,’
দরজাটা আবার বন্ধ করে ললিতা খাটের কাছে গিয়ে ডাকল, ‘বেরিয়ে এসো।’
শুড়শুড় করে বেরিয়ে এলো লোকটি।—দেখলে তো কাণ্ডটা! ললিতা বললে, ‘খুব চ্যাঁচাও আরো—পাড়াসুদ্ধ সব ছুটে আসুক।’
‘আমার দোষ হল?’ খুব ক্ষীণস্বরে যেন ভয়ে-ভয়ে লোকটি জবাব দিলে, ‘চোর-চোর বলে চ্যাঁচালে তো তুমিই।’
ললিতা হেসে উঠল।—’তোমাকে চটাতে এমন মজা লাগে!’ তারপর লোকটির দিকে খাণিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে, ‘কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে তোমাকে। ঠিক যেন সঙ।’ ললিতা হেসে উঠল আবার।
লোকটি আয়নার নিজের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে পড়ল। ললিতা জিগ্যেস করলে, ‘কেন পরেছিলে তুমি ওসব? পাইপ বেয়ে উঠতে সুবিধে হবে বলে?’
লোকটি চুপ করে রইল।
‘বেশ, যেমন এসেছিলে তেমনি এবার পাইপ বেয়ে নেমে যাও। কতক্ষণ আর তোমাকে নিয়ে রাত জেগে বসে থাকব?’
‘না না। পাইপ বেয়ে আমি কিছুতেই নামাতে পারব না।’
‘পারবে না? উঠতে পেরেছিলে কী করে?’
‘কী করে পেরেছিলাম? তাই তো। নিজেই এখন সে কথা ভাবছি।’
‘সে কথা বললে চলবে কেন? উঠতে যখন পেরেছিলে, নামতেও পারবে। নামতেই হবে তোমাকে।’
‘না, না’, লোকটির স্বর এবার ব্যাকুল হ’য়ে উঠল, ‘পারব না। কিছুতেই পারব না। আমি ঠিক পড়ে মরে যাব। দয়া করে আমাকে সিঁড়ির পথটা একটু দেখিয়ে দাও, আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।’
‘বা রে আবদার! এখন আমি হাঁকডাক করে দারোয়ানকে জাগাতে যাই আর কি। দরোয়ান যদি মনে করে, তোমার মতো পোষাক নিয়ে কোন লোক আমার কাছে আসে, তাহলে কি আর আমার মান থাকবে।’
লোকটির মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল।—’তাই তো—’
‘তাই তো তাই তো করে লাভ কী? পাইপ বেয়েই নামতে হবে তোমাকে!’
লোকটি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ম্লানমুখে বললে, ‘নামতে যদি হয়ই তো নামব। এক্ষূনি।’
‘হ্যাঁ, এক্ষুনি।’
‘আচ্ছা!’ লোকটা অদৃষ্টের হাতে আত্মসমর্পণ করল। ‘এক গ্লাস জল দিতে পার আমাকে?’
‘তা আর পারিনে। জল খাবে?’
‘জল খাব।’
‘না অন্য কিছু?’
‘অন্য কিছু আবার কী?’
‘এই যেমন, হুইস্কি—’
‘না, না, ও-সব কিছু না।’
‘না কেন? হুইস্কি খেয়েছ কখনো?’
‘না।’
‘তাহলে দ্যাখো না একটু খেয়ে।’
‘না, জল।’
ললিতা ঘরের কোণের কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে এনে দিলে।
লোকটা ঢকঢক করে সবটা জল খেয়ে বললে, ‘আঃ।’ তারপর আস্তে-আস্তে—যে-জানলা দিয়ে সে ঢুকেছিল, তার দিকে পা বাড়াল!
‘ও কী, চললে?’
‘হ্যাঁ।’ একটু পরে . ‘তোমার কথা আমার মনে থাকবে।’
হঠাৎ ললিতা বলে উঠল, ‘এই—’
লোকটা ফিরে তাকাল।
‘—তোমার জিনিস যে ফেলে যাচ্ছ।’
‘কী জিনিস?’
‘তোমার পিস্তল—আর মুখোশ।’
‘ও থাক গে।’ বলে লোকটি আবার পা বাড়াল। ‘কী হবে আর নিয়ে?’
‘আমারই বা কী হবে রেখে? কেউ দেখলে যদি জিগ্যেস করে, তখন বলবই বা কী?’
‘ফেলে দিও।’
‘ফেলবই বা কোথায়? না, তুমি নিয়েই যাও।’ ললিতা জিনিস দুটো কুড়িয়ে আনল।
‘আচ্ছা দাও, নিয়েই যাচ্ছি।’ লোকটি ফিরে ললিতার কাছে এসে সেগুলো নিতে যাবে এমন সময় প্রকাণ্ড হাড়-ভাঙা হাই এসে তাকে বাধা দিল।—আঃ কী যে ঘুম পাচ্ছে।’ কথাগুলো জড়িয়ে গেল তার।
ললিতা তার ঘুমে-ঘোলা চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জিগ্যেস করলে, ‘আচ্ছা, কেন করলে তুমি?’
‘কী করলাম?’
‘এই যে—’
‘কেন? বুঝতে পার না কেন?’
‘টাকার জন্য?’
লোকটি কথা না বলে ললিতার হাত থেকে তার পিস্তল আর মুখোশ নিতে গেল , কিন্তু সে-দুটো তার হাত ফসকে পড়ল মেঝের উপর।
‘বা—বাঃ, এতই ঘুম পেয়েছে তোমার! এই ঘুম নিয়ে তুমি আবার যাচ্ছিলে পাইপ বেয়ে নামতে।—থাক, ও-দুটো আর কুড়োতে হবে না এখন—না-হয় একটু বসেও যাও। বস না—এখানেই বস।’
লোকটি ভয়ে-ভয়ে আলগোছে খাটের উপর বসল।
মশারিটা চাঁদা করে তুলে ললিতা বসল তার কাছে।—’এইবার বলো।’
‘কী?’ (অস্পষ্টস্বরে)
‘আচ্ছা, তোমার এমন-কী টাকার দরকার হল?’
‘টাকার দরকার সবারই হয়।’
‘সবাই কিছু পায়ও। কী করো তুমি?’
লোকটি বাঁ হাতের আঙ্গুষ্ঠ তুলে মৃদুভাবে একটু সঞ্চালন করল।
‘থাক কোথায়?’
‘মেসে।’
‘কী করে চলে?’
‘চলে না। সেইজন্যই—’
‘ও। তোমার বাবা—!’
বাঁ হাত একবার শূন্যে ঘোরাল সে।
‘মা—’
‘আছেন এক মা।’
‘ভাই-বোন?’
লোকটি আঙুল দিয়ে শূন্যে ঢালু রেখা আঁকলো।
‘অনেক বুঝি?’
‘অনেক।’
‘কোথায় থাকে তারা?’
‘দেশে।’
‘সেখানে—’
‘এই, কোনরকমে।’
‘তুমিই বড়।’
লোকটি মাথা ঝাঁকাল।
‘আর কেউ নাই তোমাদের?’
লোকটি মাথা নাড়ল।
‘হুঁ।’ একটু চুপ করে থেকেঃ ‘বলো না।’
‘কী?’
‘সব বলো।’
‘সবই তো বললাম।’
‘ঐ যাঃ—আসল কথাটাই তো এতক্ষণ জিগ্যেস করা হয়নি। তোমার নামটি কী?’
‘কমল।’
‘বাঃ, বেশ নাম, কমল। কমল, কমল।’ ললিতা দু’একবার নামটা নিজের মনে পুনরাবৃত্তি করলে।
‘ডাকছ কেন?’
ললিতা ছেলেটির এলোমেলো চুলগুলিতে একবার হাত বুলিয়ে আস্তে বললে, ‘কমল।’
উঃ, কী শক্ত করেই বেঁধেছিলে হাত, এখনো টনটন করছে।’
‘খুব লেগেছিল, না? দাও, আমি রগড়ে দিচ্ছি, সেরে যাবে।—না, না, এমনি সুবিধে হবে না। তুমি শোও তো।’
কমল দ্বিরুক্তি না-করে বালিশের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ললিতা তার হাতটি নিজের হাতে নিয়ে কব্জি থেকে আরম্ভ করে আস্তে আস্তে রগড়ে দিতে লাগল।
‘আঃ’, গভীর আরামে কমল চোখ বুজল। তার মুখ সদ্য-মৃত লোকের মতো প্রশান্ত, নিরুদ্বেগ! সেই মুখের দিকে ললিতা তাকিয়ে রইল—মুগ্ধ দৃষ্টিতে। হঠাৎ তার মনে হল বিছানায় যেন সে শুয়ে আছে নিজে, আর পাশে বসে আছে তার মা—সারা রাত সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে—’মাগো আর পারিনে, মরে গেলাম , উঃ, মা, মা-গো।’ তারপর ভোরের দিকে নিতান্ত ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, তবু ঘুমের মধ্যে টের পেয়েছে, মার হাত তার কপালে মুখে, চুলে….সেই তাদের পাড়াগাঁর বাড়ি, খিড়কির পুকুর, উঠোনে ব্রতের আলপনা, মাঘের শীতে রাত থাকতে নাইতে যাওয়া, মাঘমণ্ডলের গান, ‘ওঠো ওঠো সূর্য্যিঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়ে’—মা-গো। ললিতার সারা গা হঠাৎ কাঁটা দিয়ে উঠল, তার চোখ উঠল ছলছলিয়ে।
ঘুমের মধ্যে কমল পাশ ফিরল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন