জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ

বিনয় ঘোষ

জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ

পলাশির যুদ্ধ বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা দিকস্তম্ভ। পলাশির আগেও যুদ্ধ হয়েছে অনেক, বিখ্যাত সব যুদ্ধ, কিন্তু কোনও যুদ্ধের প্রভাব—প্রতিক্রিয়া আমাদের জাতীয় জীবনে এমন সুদূরপ্রসারী হতে পারেনি। তার কারণ, বাংলার জাতীয় জীবনের ইতিহাসের দিক থেকে পলাশির রণাঙ্গনে সংঘাত হয়েছে দুই যুগের, কেবল দুই জাতের নয়। বিদেশি বণিকের মানদণ্ড যেমন রাজদণ্ডরূপে দেখা দিয়েছে, তেমনি একটা যুগ অস্তাচলে গিয়ে তার সঙ্গে। সেই যুগটাকে আমরা নবাবি আমল এবং সামন্তযুগ বলতে পারি। অন্যান্য যুগের মতো সামন্তযুগেও আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের ভালোমন্দ বিচারের একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ড ছিল, একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। নবযুগের নতুন পরিবেশে সেই মানদণ্ড ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে লাগল। বিদেশি ইংরেজ বণিকরা একহাতে আমাদের রাজদণ্ড কেড়ে নিয়ে, আর—একহাতে নবযুগের এই নতুন মানদণ্ডটি আমাদের দিয়েছিলেন। অর্থনীতি, শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতি—জীবনের কোনওক্ষেত্রেই অবশ্য এই বিদেশি শাসকরা নিজেদের স্বার্থের খাতিরে, নবযুগের এই নতুন মূল্যায়নের মানদণ্ডটি প্রয়োগের অবাধ স্বাধীনতা আমাদের দেননি। তার ফলে আমাদের যুগোপযোগী অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে, মধ্যপথে এসে থেমে গিয়েছে, দিগভ্রান্ত হয়েছে। কিন্তু তবু আমরা বাধাবিপত্তির মধ্যেও জীবনের সব ক্ষেত্রে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছি। নবযুগের নতুন মানদণ্ড নিয়ে এই অগ্রগমনে, ইতিহাসের সন্ধিক্ষণের প্রথম পর্বে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পাদ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত বাংলা দেশের যে কয়েকটি পরিবার নানাদিক থেকে আমাদের সাহায্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, শোভাবাজারের রাজপরিবার, পাইকপাড়ার রাজপরিবার, ভূকৈলাসের রাজপরিবার প্রভৃতির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জয়নারায়ণ ঘোষাল এই ভূকৈলাসের রাজপরিবারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কৃতী বংশধর।

নবযুগের এই নতুন পরিবার—প্রতিষ্ঠাতাদের (Family-founders) এযুগের প্রথম উদ্যোগী সংস্কৃতি—রচয়িতা বলা যায়। পরিবারই হল সমাজের ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠীভিত্তি, তাই পরিবার থেকেই নতুন যুগের আলোক বাইরের বৃহত্তর সমাজে বিচ্ছুরিত হয়েছে। কেবল যে আমাদের দেশে হয়েছে তা নয়, সব দেশেই হয়েছে। প্রাচীন বা মধ্যযুগে পরিবারের কোনও ইতিহাস ছিল না, তার কারণ জীবন্ত সমাজের সক্রিয় ‘সেল’ (cell) বা ‘ইউনিট’ হিসেবে পরিবারের কোনও স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকৃত হত না। কেবল সকলের অধীশ্বর শাসকরাজার পরিবারের অস্তিত্বই স্বীকৃত হত। আমাদের দেশে ব্রাহ্মণরা যে ‘কুলপঞ্জি’ রচনা করতেন, তা সামাজিক শুচিতা রক্ষার জন্যে ব্যবহৃত হত, আর কোনও কাজে লাগত না। পারিবারিক প্রাধান্যের ইতিহাস আধুনিক যুগের ইতিহাস এবং সেইসব পরিবার যে প্রধানত ধনিক পরিবার, বিত্তশালী পরিবার, তার কারণ স্বোপার্জিত বিত্তই এ যুগের সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রধান স্তম্ভ। যুগটা ধনতান্ত্রিক, সামন্ততান্ত্রিক নয়। এ যুগে বিত্তের কৌলীন্যই স্বীকৃত, কুলের কৌলীন্য নয়। স্বোপার্জিত বিত্তের জোরেই বাংলা দেশে যাঁরা পারিবারিক ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ভূকৈলাসের রাজারা অন্যতম। ইতালীয় ও ইয়োরোপীয় রেনেসাঁসের ইতিহাসেও দেখা যায়, কয়েকটি বিত্তবান পরিবারই নতুন সংস্কৃতিধারার পরিচালক ছিলেন। বাংলা দেশের নবযুগের ইতিহাসেও তার বিশেষ ব্যতিক্রম হয়নি।

জয়নারায়ণ ঘোষাল স্বরচিত ‘করুণানিধানবিলাস’ কাব্যে বংশপরিচয় প্রসঙ্গে লিখেছেন :

বিষ্ণুর কনীয় সুত কন্দর্প ঘোষাল।

কৈশোরে কিশোর প্রেমে হইল রসাল।।

ঐ গুণে লোলা অতি হইয়া সদয়া।

দেশাধিপ রাজকার্যে তাঁরে নিয়োজিয়া।।

গোবিন্দপুরেতে বাস দিলেন তাঁহার।

গড়্যা বেহালা খিদিরপুরে নিরন্তর।।

তস্য তিন সুত কৃষ্ণচন্দ্র প্রথম।

গোকুলচন্দ্র রামচন্দ্র অতীব উত্তম।।

তাঁর পাঁচ পুত্র নাম ক্রমে বলি শুন।

বৃন্দাবনচন্দ্র পরে রামনারায়ণ।।

হরিনারায়ণ লক্ষ্মীনারায়ণ চতুর্থ।

পঞ্চ গঙ্গানারায়ণ হয় হে যথার্থ।।

বিধাধীনে পাঁচজনের বংশ হইল হীন।

কৃষ্ণচন্দ্রের এক পুত্র আমি মাত্র দীন।।

পলাশির যুদ্ধের আগে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, জয়নারায়ণের পিতামহ কন্দর্প ঘোষাল, হাওড়া জেলার বাকসাড়া গ্রামের পৈর্তৃক বাস ছেড়ে নতুন কলকাতা শহরে গোবিন্দপুর অঞ্চলে উঠে আসেন। এখন যেখানে ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা প্রতিষ্ঠিত, পূর্বে তার নাম ছিল গোবিন্দপুর। ভাগীরথীর পশ্চিম তীর ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রথমে যাঁরা নতুন মহানগরে ভাগ্যান্বেষণে আসেন, তাঁরা এই গোবিন্দপুর অঞ্চলেই বসতি স্থাপন করেন কলকাতার প্রাচীন বনেদি পরিবারের পূর্বপুরুষরা অনেকেই গোবিন্দপুরের আদি বাসিন্দা। নতুন কেল্লা নির্মাণের সময় এঁরা উত্তরে ও দক্ষিণে জমিজমা পেয়ে চলে যান। শেঠ—বসাকরা, ঠাকুর ও শোভাবাজারের দেবরা যান উত্তরে সুতানুটিতে, ঘোষাল পরিবার ও অন্যান্য আরও অনেকে যান দক্ষিণে বেহালা—সরশুনার দিকে। কিছুদিন গড়—বেহালা অঞ্চলে বাস করে কন্দর্প ঘোষাল, ১১৬১ সনে পলাশির যুদ্ধের আগে খিদিরপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। প্রায় ২০০ বছর অর্থাৎ আটপুরুষ ধরে, ভূকৈলাসের রাজারা বংশানুক্রমে খিদিরপুরে বাস করছেন। জয়নারায়ণের জন্ম হয় গোবিন্দপুরে, ১৭৫১ সালে, পলাশির যুদ্ধের ছ—বছর আগে।

কন্দর্পর কালে ভূকৈলাসের রাজপরিবারের বিশেষ কোনও প্রতিষ্ঠা ছিল না, থাকবার কথাও নয়। তাঁর মধ্যমপুত্র, জয়নারায়ণের পিতৃব্য গোকুলচন্দ্র ঘোষালই এই পরিবারের আদি প্রতিষ্ঠাতাদের শীর্ষস্থানীয়। কুলগত বৃত্তি ছেড়ে তিনিই প্রথম স্বাধীন বাণিজ্যবৃত্তি অবলম্বন করেন। এই বৃত্তিনির্বাচনে তিনি যুগধর্মই পালন করেছিলেন। সামন্তযুগে বৃত্তি ছিল কুলগত ও বংশানুক্রমিক। যাজন অধ্যাপন শাস্ত্রব্যাবসা ছাড়া ব্রাহ্মণরা অন্য ব্যাবসা করলে সমাজে পতিত হতেন। কায়স্থরা প্রধানত রাজস্ববিভাগে ও জমিদারের কাছারিতে চাকরি করতেন। বাণিজ্য তাঁদেরও কুলগত পেশা ছিল না। বাণিজ্য করতেন সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, তাম্বূলীবণিক, তন্তুবণিক প্রভৃতি বণিকশ্রেণি। সামন্তসমাজে বণিগবৃত্তির মর্যাদা ছিল না। নবযুগে বণিগবৃত্তির মর্যাদা স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হল। অবাধ বাণিজ্যের উদ্যমের মধ্যে যুগধর্মের প্রকাশ হতে থাকল। পলাশির যূদ্ধের পর, কলকাতার তথা বাংলার সমাজে এই যুগধর্মের প্রকাশ হয়েছিল বাঙালি ‘বেনিয়ানদের’ মধ্যে। এ দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ও স্বাধীন ইংরেজ বণিকদের ‘এজেন্ট’ ও দালাল ছিলেন বাঙালি বেনিয়ানরা। অষ্টাদশ শতাব্দীর এই বেনিয়ানরা ছিলেন একাধারে ‘interpreter, head book-keeper, head-secretary, head-broker, the supplier of cash and cash-keeper’। ‘টু মেন ধাপুড়—ধুপুড়, ওয়ান ম্যান সেঁকে দেয়’—গোছের (ঢেঁকির বর্ণনা) ইংরেজি বিদ্যের জোরে সে যুগে সে প্রতিপত্তি তাঁরা অর্জন করে গিয়েছেন, এ যুগের ইংরেজি বুলিদুরস্তদের কাছে তা রূপকথা বলে মনে হবে। পলাশির যুদ্ধের আগে পর্যন্ত ব্রাহ্মণ—বৈদ্য—কায়স্থদের মধ্যে বিশেষ কেউ কুলবৃত্তি ছেড়ে বানিজ্যের এ পথে অগ্রসর হননি। তখন কলকাতার বাঙালি শেঠ—বসাকরাই প্রধানত ‘এজেন্ট’—এর কাজ করতেন। পলাশির পরে কুলবৃত্তির বন্ধন ছিন্ন করে, ব্রাহ্মণ—বৈদ্য—কায়স্থরা স্বাধীন বাণিজ্যেরপথে অগ্রসর হন এবং বুদ্ধিবলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অসাধারণ প্রতিষ্ঠান পান। গোকুল ঘোষালের সমসাময়িক বেনিয়ানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বারাণসী ঘোষ, হৃদয়রাম ব্যানার্জি, অত্রুর দত্ত, মনোহর মুখার্জি, মদন দত্ত প্রভৃতি। এঁদের সমকক্ষ প্রতিপত্তিশালী বেনিয়ান তখন খুব অল্পই ছিলেন।

গোকুল ঘোষাল ছিলেন গভর্নর ভেরেলস্টের বেনিয়ান। মহারাজা নবকৃষ্ণর সমসাময়িক তিনি এবং তাঁর প্রতিপত্তিও নবকৃষ্ণর সমতুল্য ছিল। সেকালের ‘মেয়র্স কোর্ট’—এর দলিলপত্র থেকে গোকুল ঘোষালের বাণিজ্যিক প্রতিপত্তির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা অবিশ্বাস্য মনে হয়। বাংলা দেশে ও বাংলার বাইরে প্রায় সর্বপ্রকারের পণ্যের বাণিজ্যে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন। নানা রকমের কাপড়চোপড়, মসলিন—মলমল, আফিম—তামাক, কাঠ—চিনি ইত্যাদি কোনও কিছুই বাদ ছিল না। সাহেবসমাজে ও ধনিক বাঙালি সমাজে তাঁর যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। ১৭৭৯ সালে গোকুল ঘোষালের মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্রদের মধ্যে কেউ পিতার মতো কৃতী পুরুষ হতে পারেননি। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র জয়নারায়ণ ঘোষালই তাঁর কৃতিত্বের ধারা ভিন্ন ক্ষেত্রে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন।

বাঙালি বেনিয়ানদের স্বাভাবিক ঐতিহাসিক পরিণতি হওয়া উচিত চিল আধুনিক ক্যাপিটালিস্ট বা শিল্পপতিশ্রেণির বিকাশে। ধনতন্ত্রের প্রথম পর্বের প্রয়োজনীয় বিত্তসঞ্চয়, ‘primary accumulaion’, প্রচুর পরিমাণে তাঁরা করেছিলেন। দেশীয় শিল্প—বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠায় সেই সঞ্চিত বিত্তের নিয়োগ একান্ত কাম্য ছিল। কিন্তু এ দেশি বেনিয়ান—বণিকদের সে কামনা ইংরেজ শাসক—বণিকদের স্বার্থে চরিতার্থ করা সম্ভব হয়নি। নবযুগের বেনিয়ান—বণিকরাও তাই শেষ পর্যন্ত স্থাবর ভূসম্পত্তি কিনে জমিদারশ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন, ইয়োরোপের বণিকদের মতো শিল্পপতিশ্রেণিতে উন্নীত হতে পারেননি। বাংলা দেশের একটা গতিশীল সামাজিক শ্রেণি এইভাবে স্থিতিশীল শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে।

গোকুল ঘোষাল প্রচুর অর্থব্যয় করে ধনসম্পত্তি কিনেছিলেন। জয়নারায়ণ ঘোষাল পিতৃব্যের বেনিয়ানি ও বাণিজ্যবৃত্তি অনুসরণ করেননি। তিনি প্রধানত সরকারি চাকরি করে বিপুল ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন। সংস্কৃত, বাংলা, ফারসি, হিন্দি, ইংরেজি ভাষা অল্প বয়সে শিখে, তিনি যৌবনেই দায়িত্বশীল রাজকার্যের যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। ইংরেজ মহলে তঁর বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল এবং তখনকার পদস্থ ইংরেজদের ঘনিষ্ঠ সাহায্যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবানও হয়েছিলেন। ভূসম্পত্তির মালিকানা ও নিশ্চিন্ত চাকুরিজীবন জয়নারায়ণকে কূপমণ্ডূক করে তোলেনি। জীবনের ও সমাজের নতুন অভাব, নতুন প্রয়োজন তিনি স্বীকার করতেন ও বুঝতেন যুগধর্মের বিরুদ্ধাচরণ তিনি সাধারণত করেননি। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হয়েও ধর্মান্ধ গোঁড়ামিকে তিনি খানিকটা বর্জন করে চলেছেন। এই উদার প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই জয়নারায়ণ নবযুগের বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

দেবদেবালয় জয়নারায়ণ প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেক, দানধ্যানেও কার্পণ্য করেননি। কিন্তু তার জন্য তিনি শ্রদ্ধেয় হলেও, স্মরণীয় নন। সেকালের রাজরাজড়া ও জমিদাররা অনেকে এই মহৎ কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁদের মহত্ত্বের সেইসব নিদর্শনের সঙ্গে তাঁদের নামও প্রায় লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ইতিহাসে তাঁদেরই স্বাক্ষর অক্ষয় হয়ে থাকে, যাঁরা তার সম্মুখগতিতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। জয়নারায়ণ তা—ই করেছিলেন বলেই স্মরণীয়। কীভাবে করেছিলেন, তার দু—একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি।

আধুনিক যুগপযোগী শিক্ষার প্রতি জয়নারায়ণের কতখানি অনুরাগ ছিল কাশীতে তাঁর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়। কাশীর বিদ্যালয়ে পাঠারম্ভ হয় ১৮১৮ সালের ১৭ জুলাই থেকে। জয় নারায়ণের এই বিদ্যালয় প্রসঙ্গে রেভারেন্ড লং সাহেব লিখেছেন :

Banares, the city of temples and citadel of idolatry, the Athens for Hindu students from various parts of India, was one of the first places in India where a Hindu came forward to offer an English education to his countrymen, and to connect it also with the Holy Scriptures.

কলকাতা শহরে তার আগেই ইংরেজি শিক্ষার সূচনা হয়েছে। ১৮১৭ সালে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার প্রধান বিদ্যায়তন হিন্দু কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রধানত এ দেশবাসীদের উদযোগেই। কিন্তু বাংলা দেশের বাইরে, কাশীর মতো প্রাচীন বিদ্যাতীর্থে, আধুনিক শিক্ষার আলোকবর্তিকা একজন বাঙালিই বহন করে নিয়ে যান, তিনি জয়নারায়ণ ঘোষাল। ধর্মপ্রাণ হিন্দু হয়েও তিনি কীভাবে চার্চ মিশনারির সোসাইটির সংস্পর্শে এসে, কাশীর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, তার বিচিত্র কাহিনী জয়নারায়ণ নিজেই একখানি চিঠিতে বর্ণনা করে গিয়েছেন। চিঠিখানি তখনই লন্ডনের চার্চ মিশনারি সোসাইটিকে লিখেছিলেন, ১৮১৮ সালে। সেই দীর্ঘ ইংরেজি চিঠির মর্ম এই :

কয়েক বছর হল আমি অসুস্থ হয়ে কলকাতা ছেড়ে কাশীবাস করছি। অনেক চেষ্টা করেও সুস্থ হতে পারিনি। জোনাথান ডানকান তখন কাশীর ‘রেসিডেন্ট এজেন্ট’, তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। তিনি ইয়োরোপীয় সার্জেনদের দিয়ে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, কিন্তু তাতেও আমার নিরাময় হয় না। এইসময় শুনতে পাই আর—একজন হিন্দু ভদ্রলোক হুইটলি নামে এক সাহেব বণিকের উপদেশ মেনে নাকি সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয়েছেন। আমিও হুইটলি সাহেবের শরণাপন্ন হলাম; তিনি আমাকে একখানি New Testament ও Book of Common Prayer দিলেন, পড়তে বললেন এবং ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে অনুরোধ করলেন। এইসময় তিনি প্রায়ই আমার কাছে আসতেন এবং খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতেন। অনেক চিঠিপত্রও তিনি আমাকে ধর্ম বিষয়ে লিখেছেন। ওষুধপত্তর তিনি বিশেষ আমাকে দেননি, সামান্য দু—একটি বলে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কথামতো চলে আমি সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হই। কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ‘যিশুখ্রিস্টের জন্য আমি কী করতে পারি বলুন?’ তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য এবং সর্ববিদ্যা ও সর্বভাষা শিক্ষার জন্য আপনি যদি কাশীতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলেই খ্রিস্টসেবা করা হবে। তাঁর কথাতেই আমি স্কুল প্রতিষ্ঠায় উদযোগী হই। …হুইটলি সাহেবের কাছে রেভারেন্ড সাহেবের কথা প্রায় শুনতাম। মনে মনে কামনা করতাম যদি তিনি কাশী আসেন, তাহলে স্কুলের ভার তাঁর উপর দিয়ে নিশ্চিন্ত হই। অবশেষে তিনি কাশীতেই এলেন। তাঁর কাছে চার্চ মিশনারি সোসাইটির কথা সব শুনি এবং তাঁদের কার্যাবলির রিপোর্ট পাঠ করার সুযোগ পাই। তারপরেই সিদ্ধান্ত করি যে চার্চ মিশনারি সোসাইটির কলকাতা কমিটির উপরেই স্কুলের দায়িত্ব দেব এবং তাঁদেরই স্কুল—পরিচালনার জন্য যে সম্পত্তি আমি দান করেছি তার ট্রাস্টি করব।

এর মধ্যে অবশ্য ৪৮০০০ হাজার টাকা দিয়ে বাঙালি টোলায় যে বাড়ি আমি তৈরি করেছি, সেই বাড়িতে একটি স্কুলের কাজ আরম্ভ হয়েছে এবং অ্যাডলিংটন সাহেব সেখানে ইংরেজি পড়ান। এইভাবে আমার দীর্ঘদিনের কামনা সার্থক হতে চলেছে। কিন্তু কেবল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আমার বিশ্বাস আধুনিক শিক্ষার দ্রুত প্রসারের জন্য কাশীতে অবিলম্বে একটি Prnting Press প্রতিষ্ঠা করা দরকার। প্রেস না হলে স্কুলপাঠ্য নতুন নতুন বই ছাপা সম্ভব হবে না এবং শিক্ষার বিস্তারও হবে না। শিক্ষার প্রসারের জন্য ছাপাখানা অবশ্য প্রয়োজন। আমার তাই একান্ত ইচ্ছা, চার্চ মিশনারি সোসাইটি যত শীঘ্র সম্ভব কাশীতে একটি Press নিয়ে প্রতিষ্ঠা করুন এবং একজন কি দু—জন ভালো মিশনারি কর্মী পাঠান প্রেস তদারক করবার জন্য। যাঁদের তাঁরা পাঠাবেন তাঁরা যেন বিদ্বান ব্যক্তি হন, আধুনিক ইতিহাস—বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে যেন তাঁদের বিশেষ জ্ঞান থাকে, কারণ কাশী এ দেশের প্রাচীন বিদ্যাসমাজ, বহু পণ্ডিতের বাস এখানে। এঁদের জ্ঞানার্জনস্পৃহা ও অনুসন্ধিৎসা নিবৃত্তির ক্ষমতা থাকার দরকার তাঁদের। তা যদি তাঁরা করতে পারেন এবং স্কুলের সঙ্গে যদি একটি প্রেস প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে আমার বিশ্বাস শ্রীরামপুরের মিশনারিদের মতো এবং কলকাতার স্কুল বুক সোসাইটির মতো কাশীতেও আমরা আধুনিক শিক্ষার প্রসারে সফল হব।

আদালতের রেকর্ডস্তূপে ও অন্যান্য স্থানের দলিলপত্রে ভূকৈলাসের রাজপরিবার সংক্রান্ত যত নথিপত্র আছে এবং এখনও যা পাওয়া যায়, তার মধ্যে আমার ধারণা, জয়নারায়ণ ঘোষালের এই দপত্রখানির ঐতিহাসিক মূল্য ও তাৎপর্য সবচেয়ে বেশি। এই পত্রের মধ্যে জয়নারায়ণের চরিত্র যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তেমন আর কোনওখানেই হয়নি। নিজে হিন্দু হয়েও এবং হিন্দুধর্মের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আস্থা রেখেও, তিনি ভিন্নধর্মের প্রতি কত শ্রদ্ধাবান ছিলেন, এই চিঠি থেকে তা বোঝা যায়। এ উদারতা তখনকার হিন্দুসমাজে খুবই দুর্লভ ছিল। উদারতার সঙ্গে তিনি মানসিক বলিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন পত্রে, তা—ও যে—কোনও বিদ্রোহীর বলিষ্ঠতার সঙ্গে তুলনীয়। দেবদেবালয় প্রতিষ্ঠায় ও ধর্মচিন্তায় মগ্ন থেকেও, তিনি যুগোপযোগী প্রত্যেক সমস্যা সম্বন্ধে, বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষার প্রসার সম্বন্ধে কত গভীরভাবে চিন্তা করতেন, তা তাঁর বিদ্যালয়সহ ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার আগ্রহ থেকে বোঝা যায়। কেবল ইংরেজি বিদ্যালয় নয়, ছাপাখানার ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্বন্ধে এই চেতনা এ দেশের খুব অল্প লোকের মধ্যেই ছিল। রামমোহনের যুগের প্রথম পর্বে, রামমোহনের প্রগতিশীল ভাবধারার অন্যতম সমর্থক এ বাহক ছিলেন জয়নারায়ণ।

বাংলা ১১৫৪ সনে, ইং ১৭৮৭ সালে, পিতা কৃষ্ণচন্দ্রর সঙ্গে জয়নারায়ণ কলকাতায় অনাথ আশ্রম ও ‘ইন্ডাস্ট্রি হাউস’ প্রতিষ্ঠার জন্য গভর্নর—জেনারেলকে যে পত্র লেখেন তা—ও তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। অক্ষম ও বেকারদের জন্য ‘ইন্ডাস্ট্রি হাউস’—এর পরিকল্পনা ইংলন্ডে করা হলেও, তখন এ দেশের ইংরেজরাও তা ভাবতে পারেননি।

জয়নারায়ণের সাহিত্যকীর্তি সম্বন্ধে এখানে আলোচনা করব না, কারণ সে আলোচনা বিস্তৃত না হলে তাঁর প্রতি বিচার করা হবে না। তাঁর ‘করুণানিধানবিলাস’ কাব্য সম্বন্ধে কেবল একটি কথা বলব। ১২২১ সনে, অর্থাৎ ১৮১৪ সালে জয়নারায়ণ এই কাব্য রচনা শেষ করেন। কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাব্য হলেও, লীলার ক্ষেত্র বাংলা দেশ এবং কাল আধুনিক। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের বাঙাল সমাজ ও সংস্কৃতির বিস্তৃত বিবরণ ‘করুণানিধানবিলাস’ কাব্যে আছে। সেকালের বাংলার উৎসব—পার্বণ, পোশাক—পরিচ্ছদ, ধর্মকর্ম, আচার—অনুষ্ঠান ইত্যাদি বিষয়ে একখানি আকরগ্রন্থ ‘করুণানিধানবিলাস’।

১৮২১ সালে, বাংলা ১২২৮ সনের ২৫ কার্তিক জয়নারায়ণের মৃত্যু হয়। তাঁর একমাত্র পুত্র কালীশংকর ঘোষাল, কালীশংকরের পুত্রদের মধ্যে সত্যকিংকর, সত্যচরণ ও সত্যশরণ ঘোষাল, এই প্রগতিশীল ভাবধারাকে যত দূর সম্ভব সর্বক্ষেত্রে বহন করে নিয়ে গিয়েছেন। হিন্দু কলেজে কাশীতে ২০ হাজার টাকা দান করেছিলেন। রামমোহনের ‘আত্মীয় সভার’ সঙ্গে কালীশংকরের সংযোগ ছিল এবং ভূকৈলাসের রাজবাড়িতে মধ্যে মধ্যে ‘ব্রাহ্মসামজ’—এর বৈঠকও হত। সেকালের অন্যতম বিদ্বৎসভা ‘গৌড়ীয় সমাজ’—এর ও অধিবেশন হত এই রাজবাড়িতে। বাংলা দেশের প্রায় প্রত্যেক প্রগতিশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সভাসমিতি ও প্রতিষ্ঠান—অনুষ্ঠানের সঙ্গে ভূকৈলাসের রাজপরিবারের পূর্বপুরুষদের সংযোগ ছিল। নবযুগের বাংলার ইতিহাসে প্রধানত এই কারণেই তাঁরা স্মরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন।

১৯৬০

সকল অধ্যায়

১. বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ
২. মার্কসবাদ ও মর্গানবাদ – বিনয় ঘোষ
৩. বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা – বিনয় ঘোষ
৪. গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ
৫. মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ
৬. শিবনাথ শাস্ত্রী – বিনয় ঘোষ
৭. সমাজপতি মহারাজা নবকৃষ্ণ – বিনয় ঘোষ
৮. ঠাকুর পরিবারের আদিপর্ব ও সেকালের সমাজ – বিনয় ঘোষ
৯. বিদ্যাসাগর-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১০. রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১১. বিবেকানন্দ-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১২. জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ
১৩. অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৪. সমাজবিজ্ঞানীর এ কোন শোচনীয় পরিণতি! – বিনয় ঘোষ
১৫. মেহনত ও প্রতিভা – বিনয় ঘোষ
১৬. দীবনন্ধু মিত্র বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও বাঙালি সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৭. বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদিপর্ব – বিনয় ঘোষ
১৮. তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ
১৯. সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ
২০. ‘গেট টু-গ্যাদার’ – বিনয় ঘোষ
২১. অর্থনীতির ভোজবাজি – বিনয় ঘোষ
২২. গৃহভৃত্যদের সামাজিক ভূমিকা – বিনয় ঘোষ
২৩. স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ
২৪. রামমোহন রায়ের জীবনচরিত – বিনয় ঘোষ
২৫. এক পুরুষের দুস্তর ব্যবধান – বিনয় ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন