স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ

বিনয় ঘোষ

স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ

বাংলার জাতীয় জীবনে স্বদেশিযুগ (১৯০৫—১১) কতকটা যেন ব্যক্তির জীবনে বয়ঃসন্ধিকালের মতো বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। সত্যকার স্বদেশপ্রেম ও স্বজাতিপ্রীতি ছিল তার প্রেরণার প্রধান উৎস। কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব প্রত্যক্ষভাবে সে যুগের আন্দোলনকে প্ররোচিত করেছিল বটে, কিন্তু তার ব্যাপক তরঙ্গ—বিক্ষোভকে কেবল রাজনীতির চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারেনি। রাজনীতি অর্থনীতি শিক্ষা—সংস্কৃতি প্রভৃতি জাতীয়—জীবনের সর্বক্ষেত্রে আন্দোলনের ঘাতপ্রতিঘাত দেখা গিয়েছিল। ‘স্বদেশি আন্দোলন ও বাংলার নবযুগ’ গ্রন্থের লেকখদ্বয় স্বদেশিযুগের এই ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যকে পর্যাপ্ত উপকরণ সমর্থিত আলোচনার ভিতর দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।

প্রথমে স্বদেশি আন্দোলনের দেশি—বিদেশি বহুমুখী প্রেরণার উৎসগুলি নির্দেশ করা হয়েছে। পরে তা আদর্শ, কর্মসূচি, জাতীয় শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে, রবীন্দ্রনাথ বিপিনচন্দ্র অরবিন্দ প্রমুখ মনীষী ও নায়কদের বিশিষ্ট দানের কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তৎকালের বিভিন্ন পত্রিকার এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের ভূমিকাও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। শেষে বিচার করা হয়েছে আন্দোলনের গতি ও প্রকৃতি। পাশ্চাত্য জীবনাদর্শ আমাদের স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্যবোধ সজাগ করেছে, এবং ইংরেজি ভাষা ও শিক্ষা প্রাদেশিকতার সংকীর্ণ গণ্ডি ভেদ করে সমগ্র ভারতের এক অখণ্ড মূর্তির রূপায়ণে সাহায্য করেছে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে—রামমোহন, ইয়াংবেঙ্গল, বিদ্যাসাগরের কালে—জাতীয়তাবোধের যে প্রভাতি কাকলি শোনা যায়, দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম প্রহরে তারই সশব্দ জাগরণ ও চঞ্চলতা ধ্বনিত হতে থাকে। সিপাহি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, একাধিক কৃষক বিক্ষোভ, হিন্দু মেলা, ইন্ডিয়ান লিগ, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ইলবার্ট বিল ইত্যাদির আন্দোলন—আলোড়ন এই জাগরণের ইন্ধন জোগায়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাও (১৮৮৫) এইসময় স্বদেশি ভাবধারাকে নানাদিক দিয়ে পরিপুষ্ট করে। শিখ মারাঠা রাজপুত প্রভৃতি ভারতের বিভিন্ন জাতির অভ্যুত্থান ও অতীত বীরত্বের কাহিনি লোকচিত্তে আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। বৈদেশিক রাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও আমাদের জাতীয়তাবোধের প্রেরণা সঞ্চার করে, তার মধ্যে উল্লেখ্য হল—আয়ার্ল্যান্ডের জাতীয় আদর্শ, ইতালির ম্যাটসিনি, গ্যারিবল্ডি, কাভুর, কার্বোনারি আন্দোলন, জার্মানির বিসমার্কের জাতীয় ঐক্যের সংগ্রাম, ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম, জারের বিরুদ্ধে রুশ জনগণের বিদ্রোহ, বুয়র যুদ্ধে সাম্রাজ্যলিপ্সু ইংরেজের ভাগ্যবিপর্যয়, এশিয়ার চীনের সংগ্রাম ও জাপানের বিস্ময়কর উত্থান। জাতীয়তার যজ্ঞে সকল দেশের আহুতি তখন সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে। এইভাবে দেশবাসীর মনে যখন দেশের দুঃখদুর্দশা ও পরাধীনতার বেদনা—প্রতিকারের সংকল্প ক্রমে বিদ্রোহোন্মুখ হয়ে উঠেছে তখন ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করে সহস্র শিখায় তাকে প্রজ্বলিত করে তুলেছেন।

১৯০১ সালে বাংলা বিভাগের প্রস্তাব উপস্থাপনের সময় থেকে ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকার কর্তৃক এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরে, সারা বাংলা দেশে, এবং ক্রমে ক্রমে ভারতবর্ষে কীভাবে স্বদেশি আন্দোলনের আদর্শ ও বাণী বিস্তারলাভ করে, তার বিবরণ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। ‘বয়কট’ ‘স্বদেশি’ ‘জাতীয় শিক্ষা’ ‘স্বরাজ’ প্রভৃতি কথার অর্থ ও ভাবধারা ব্যাখ্যাত হয়েছে। সে যুগের অন্যতম নায়ক সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘The Swadeshi Movement is—patriotic in the first instance and only economic or industrial in the second.’ গ্রন্থকারদ্বয় এই অভিমত সমর্থন করেন বলে মনে হয়। সতীশচন্দ্রর উক্তি নিঃসন্দেহে ঠিক, এবং অরবিন্দর ভাষায় বলা যায়, স্বদেশি আন্দোলন আমাদের মতো উন্মার্গ লক্ষ্যভ্রষ্ট জাতির ‘return to ourselves’—চেতনার একটা প্রবল আলোড়ন। বিপিনচন্দ্র একেই ‘আত্মিক’ আন্দোলন বলতে চেয়েছেন। আলোচ্য গ্রন্থে স্বদেশি আন্দোলনের এই আদর্শবাণী রূপটিকে তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস আছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, স্বদেশি আন্দোলনের যেমন একটা ঐতিহাসিক ইন্ধন ছিল (বঙ্গবিভাগ), বিশুদ্ধ দেশপ্রেমের প্রেরণা ছিল, তেমনি তার কোনও বাস্তব জাতীয় অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কি না? অবশ্যই ছিল। দেশপ্রেম তার মুকুটমণি, এবং সেই মণির জ্যোতিতে এই অর্থনৈতিক অভীপ্সা ম্লান হয়ে থাকলেও ঐতিহাসিকের কাছে তার গুরুত্ব যথেষ্ট। এই অর্থনৈতিক গুরুত্ব প্রসঙ্গে অবাঙালি ও বাঙালি দু—জন দেশনেতার বক্তব্য এখানে নিবেদন করছি। মহামতি গোখলে স্বদেশি আন্দোলনের প্রকৃতি ও লক্ষ্য প্রসঙ্গে এক ভাষণে (Lucknow, 9th February, 1907) বলেছিলেন :

Whoever tries to spread in the country a correct knowledge of the industrial conditions of the world and points out how we may ourselves advance, is a promoter of the Swadeshi cause. Whoever again contributes capital to be applied to the industrial development of the country must be regarded as a benefactory of the country and a valued supporter of the Swadeshi movement. Then those who organise funds for sending Indian students to foreign countries for acquiring industrial or scientific education—and in our present state we must, for some time to come, depend upon foreign countries for such education—or those who proceed to foreign countries for such education and try to start new industries on their return, or those who promote technical, industrial and scientific education in the country itself—all these are noble workers in the Swadeshi field. These three ways of serving the Swadeshi cause are, however, open to a limited number of persons only. But there is a fourth way, which is open to all of us, and in the case of most, it is perhaps, the only way in which they can help forward the Swadeshi movement. It is to use ourselves, as far as possible, Swadeshi articles only and to preach to others that they should do the same. The mass of the people—can all render a most important and a most necessary service to the Swadeshi cause by undergoing a little sacrifice to extend a kind of voluntary protection to Swadeshi industries in their early days of stress and struggle.

গোখলের এই ভাষণে স্বদেশি আন্দোলনের অর্থনৈতিক তাৎপর্য বিস্তারিত করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য শিল্প—বাণিজ্যোন্নত দেশের দিকে চেয়ে যাঁরা স্বদেশের অনুরূপ শিল্পসমৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হবেন তাঁরা স্বদেশি আন্দোলনের প্রকৃত সমর্থক বুঝতে হবে। যাঁরা ভারতীয় ছাত্রদের শিল্পশিক্ষা ও বিজ্ঞানশিক্ষার জন্য বিদেশে অর্থব্যয় করে পাঠাতে কুণ্ঠিত হবেন না, এবং যাঁরা বিদেশ থেকে বৈজ্ঞানিক শৈল্পিক ও ব্যাবহারিক টেকনিক্যাল বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে স্বদেশে ফিরে স্বদেশি শিল্পের প্রতিষ্ঠায় ও প্রসারে উদযোগী হবেন, তাঁদের স্বদেশি আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ কর্মী বলে শ্রদ্ধা করতে হবে। যাঁরা নিজেদের সঞ্চিত মূলধন (capital) শিল্পপ্রতিষ্ঠায় প্রয়োগ করবেন, তাঁদেরও স্বদেশি আন্দোলনের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ বলতে হবে। স্বদেশসেবার এই তিনটি পথ দেশের স্বল্পসংখ্যক লোকের জন্য উন্মুক্ত। এ ছাড়া আরও একটি চতুর্থ পথ আছে, যা সর্বসাধারণের সহজগম্য। সেই পথটি হল, বিদেশি পণ্যদ্রব্য বয়কট বা বর্জন করে যত দূর সম্ভব কিছু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেও স্বদেশি পণ্য ব্যবহার করা। তাতে স্বদেশেই শিল্পোদ্যমকে উৎসাহিত করা হবে, এবং বাল্যাবস্থায় দেশীয় শিল্প দেশীয় সাধারণের পোষকতায় প্রতিপালিত হবে। তৎকালের অর্থতত্ত্বের সংরক্ষণ নীতির সমর্থন ও প্রয়োগ যখন বৈদেশিক শাসনাধীনে স্বদেশের শিল্পোন্নতির উদ্দেশ্যে আদৌ সম্ভব ছিল না, তখন দেশপ্রেমের আদর্শ সম্মুখে তুলে ধরে বিদেশী পণ্য ‘বয়কট’ ও স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের নীতি প্রচারের ভিতর দিয়ে দেশবাসীর পক্ষে তার ফললাভের চেষ্টা করা স্বাভাবিক। এই ভাষণের মধ্যে গোখলে তাই বলেছেন, ‘The German Economist—List—Whose work on Political Economy is the best that Indian students can consult’, মহাদেব গোবিন্দ রানাডের অর্থনৈতিক প্রবন্ধাবলি (Essays on Indian Economics গ্রন্থে সংকলিত) পাঠ করলেও জাতীয়তাবোধের বিকাশে অর্থনৈতিক চেতনার এই স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়। বাংলার স্বদেশি আন্দোলনের অন্যতম হোতা রাসবিহারী ঘোষ বলেছিলেন (Welcome Address to the Calcutta Congress 1906), ‘The Swadeshi movement is only a prelude to our determination to enter into the great brotherhood of the trading nations of the West—And if you want, come with me to the exhibition on the other side of the street, which I hope you have not boycotted, and I will show you what this movement, the implication of which with politics is a mere accident in Bengal from which many of us would gladly dissociate it, has already done for us [emphasis added]’ এই ভাষণেই তিনি বলেছিলেন, ‘The Swadeshi movement has been the principal motive power in the industrial development of the country, and I would remind those who say that Bengal can only talk that in the course of the persent year more than ten lakhs or rupees have been given by Bengalees for the encouragement of technical education.’

স্বদেশি যুগে দেশপ্রেমের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গের অন্তরালে, লোকচক্ষুর বাইরে আরও গভীরে, দেশের মধ্যবিত্ত ও ধনিকশ্রেণির অর্থনৈতিক আত্মপ্রতিষ্ঠার অভীপ্সা যে কত প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল, তা কেবল গোখলে ও রাসবিহারী ঘোষের নয়, তৎকালের আরও বহু বিশিষ্ট নেতার উক্তি থেকে নির্দেশ করা যায়। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে বাংলার ও ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তির বিস্তার থেকেও তার আভাস পাওয়া যেতে পারে। এ কথাও মনে রাখা দরকার যে এই অর্থনৈতিক প্রেরণাই মূলত স্বদেশি যুগে জাতীয় শিক্ষাদর্শের রূপায়ণে ক্রিয়াশীল ছিল। লেখকরা প্রসঙ্গত এই অর্থনৈতিক দিকের কথা আলোচনা করেছেন বটে, কিন্তু বিষয় অনুপাতে তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেননি। তার কারণ মনে হয় তাঁদের আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। ইতিহাসের বাস্তব ব্যাখ্যা বলতে যা বোঝায় (যদিও তার মধ্যে আদর্শবাদেরও যথাযথস্থান আছে) তাতে লেখকরা বিশ্বাসী নন, এ কথা তাঁরা স্পষ্টই স্বীকার করেছেন। বর্তমান সমালোচক ‘ইতিহাস’ সম্বন্ধে ভিন্নমত পোষণ করেন, এবং তার বাস্তব ব্যাখ্যাতেও বিশ্বাসী। তা সত্ত্বেও লেখকদের মত, যুক্তি, তথ্য পরিবেশন ও বিন্যাস—পদ্ধতি শ্রদ্ধা ও সমাদরের যোগ্য, এ কথা স্বীকার করতে তাঁর কুণ্ঠা নেই। স্বদেশের আন্দোলনের গতি ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে লেখকরা হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন প্রসঙ্গে তা পুরোপুরি রক্ষণশীল ছিল না বলে যে বক্তব্য নিবেদন করেছেন, তা—ও বিলক্ষণ তর্কসাপেক্ষ এবং সকলের কাছে গ্রাহ্য বিবেচিত হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এ—ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। প্রত্যেক লেখকের স্বাতন্ত্র্যের অধিকার আছে, আলোচ্য গ্রন্থের লেখকদেরও তা পূর্ণমাত্রা আছে। তা—ই বলে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারীকে তা নিন্দনীয় ও অপাঙক্তেয় বলে বর্জন করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। লেখকদের যে একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এইটাই বড় কথা। সাধারণত আমাদের দেশে ইতিহাস—রচনায় তা থাকে না এবং না—থাকার জন্য বিস্তর বিক্ষিপ্ত তথ্যের কঙ্কালসমাকীর্ণ গোরস্থানে ইতিহাস পাঠকদের বিভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে হয়। স্বদেশি আন্দোলনের আলোচ্য ইতিহাস—রচয়িতারা সেই জাতীয় তথ্য—শবাকীর্ণ কোনও ইতিহাসের শ্মশান রচনা করেননি বলে ধন্যবাদের পাত্র। তাঁদের আদর্শবাদী সুর আগাগোড়া বইখানির মধ্যে তথ্যস্তূপের ভিতর দিয়েও ঝংকৃত হয়ে উঠেছে এবং তার ফলে রচনা ভাবসংহতি লাভ করেছে। বাংলা ইতিহাস—সাহিত্যে বইখানি এই কারণে যোগ্য মর্যাদা লাভ করবে।

স্বদেশি আন্দোলনের অন্যতম বিশিষ্ট নায়ক ছিলেন উপাধ্যায় ব্রাহ্মবান্ধব। এটি তাঁর সন্ন্যাসজীবনের নাম, আসল নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৬১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার পশ্চিমে মাইল পঁয়ত্রিশ—ছত্রিশ দূরে খন্নান গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। রবীন্দ্রনাথের মতো ১৯৬১ সাল ব্রহ্মবান্ধবেরও জন্মশতবর্ষ বলে স্মরণীয়। ১৯০৭ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। ষোলো—সতেরো বছর বয়সে কলেজের পড়াশুনো বন্ধ করে কয়েকজন বন্ধু মিলে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করে ভারত উদ্ধারের বাসনায় গোয়ালিয়র অভিমুখে যাত্রা করার সময় থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিরিশটা বছর তাঁর উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে কেটে গিয়েছে। এই তিরিশটা বছরের অন্তত তিরিশটা দিন হয়তো তিনি প্রাত্যহিক কর্ম থেকে বিশ্রাম নিয়েছেন, কিন্তু পুরো একটি দিনও চিন্তা থেকে বিরত হয়েছেন কিনা সন্দেহ। অর্থচিন্তা নয়, স্বার্থচিন্তাও নয়, পরাধীন দেশের স্বরাজচিন্তা ও দেশের মুক্তিচিন্তা। কৈশোরের গোড়া থেকে যৌবনের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত এই চিন্তা যেন তাঁর সমগ্র চিত্তকে আচ্ছন্ন করে ছিল। কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনই যদি তাঁর জীবনের চরম কাম্য হত তাহলে ব্রহ্মবান্ধব আরও অনেক লোকপ্রিয় দেশকর্মীর মতো আমাদের কাছে শ্রদ্ধেয় হয়ে থাকতেন। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শ ছাড়াও ব্রহ্মবান্ধব আরও একটা ‘সত্য’ ও ‘আদর্শ’—এর সন্ধানে জীবনটাকে উৎসর্গ করেছিলেন। জীবনের ‘সত্য’ কী, এক—একটা জাতি ও সমাজকে যুগ যুগ ধরে ধারণ করে আছে যে ‘ধর্ম’ তারই বা স্বরূপ কী, ‘ব্যক্তি’ ও বিশ্ব’, ‘সৃষ্টি’ ও ‘স্রষ্টা’র মধ্যে সম্পর্ক কী—এ—ও তাঁর জীবনের একটা বড় জিজ্ঞাসা ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সৈনিক ছিলেন তিনি, এইটাই তাঁর একমাত্র শ্রেষ্ঠ পরিচয় নয়। তাঁর মধ্যে যে ‘ব্যক্তিটি’, যে ‘আদত মানুষটি’ রাজনীতির অন্তরালেও আত্মগোপন করে ছিল, তার পরিচয় ছাড়া যে—কোনও ব্রহ্মবান্ধবচরিত বিকলাঙ্গ বলে মনে হবে।

পূর্বপ্রকাশিত অণিমানন্দর The Blade ও প্রবোধচন্দ্র সিংহর ‘উপাধ্যায়’ নামে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় লেখা দুখানি ভালো জীবনচরিত আছে। প্রবোধচন্দ্রর লেখা অধুনা দুষ্প্রাপ্য। এই কারণে শ্রীহরিদাস মুখোপাধ্যায় ও শ্রীমতী উমা মুখোপাধ্যায় রচিত জীবনী বহুদিনের একটা বড় অভাব পূরণ করবে। পূর্বে স্বদেশি আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে লেখকদের কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করেছি। ব্রহ্মবান্ধবের জীবনের রাজনৈতিক পশ্চাৎপট উভয়ের করতলগত। ‘স্বরাজ’, ‘বন্দেমাতরম’ প্রভৃতি অতীব দুষ্প্রাপ্য পত্রিকারও সন্ধান করে তাঁরা পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং তার আলোকে উপাধ্যায়ের জীবনের সর্বদিক সুকৌশল পাঠকদের চোখের সামনে উদঘাটিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। উপাধ্যায় ব্রহ্মবান্ধবের এরকম বিস্তারিত জীবনবৃত্তান্ত, আবশ্যকীয় পটভূমিসহ, পূর্বে আর প্রকাশিত হয়নি। তাঁর জীবনের প্রত্যেকটি পর্ব, ব্রাহ্মধর্ম ক্যাথলিক ধর্ম হিন্দুধর্ম প্রভৃতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া এবং তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাঁর জীবনের স্বপ্ন, ধ্যানধারণা ও জপতপ চিন্তা স্বরাজসাধনার কাহিনি এই চরিতকথার মধ্যে বিবৃত হয়েছে। বোলপুরে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় গঠনে রবীন্দ্রনাথ ও ব্রহ্মবান্ধবের মধ্যে যোগাযোগ সম্পর্কে পূর্বে যে তর্কবিতর্ক হয়েছে, লেখকরা নথিপত্রাদির সাহায্যে তারও অবসান ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া একাধিক দুষ্প্রাপ্য পত্রিকা ও পুলিশের গোয়েন্দা—বিভাগের গোপন রিপোর্ট থেকে এমন অনেক তথ্য বইখানিতে পরিবেশিত হয়েছে যা পাঠকদের অনুসন্ধিৎসা নতুন পথে পরিচালিত করবে।

দ্বিতীয় জীবনীগ্রন্থের লেখক শ্রীবলাই দেবশর্মা বর্ধমানের একজন প্রবীণ দেশকর্মী। তাঁর সৌভাগ্য, রাজনৈতিক জীবনে তিনি ব্রহ্মবান্ধব সান্নিধ্য ও প্রত্যক্ষ প্রেরণা লাভ করেছিলেন। ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় উপাধ্যায় যে তাঁকে রাজনৈতিক সৎসাহসের জন্য ‘ধানি লঙ্কা’ বলে বিশেষিত করেছিলেন, সে কথা লেখক আজও ভুলতে পারেননি। কলকাতায় ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার অফিসে উপাধ্যায়ের সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎ পরিচয় হয়। সে আজ চুয়ান্ন—পঞ্চান্ন বছর আগেকার কথা, যখন কলকাতা শহর থেকে বর্ধমানের ‘দূরত্ব’ আরও অনেক বেশি ছিল, এবং গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে কিশোর—যুবকদের গতায়াতও ছিল অনেক কম। শ্রীবলাই দেবশর্মা তাঁর যৌবনের সেইসব রাজনৈতিক স্মৃতিকথা ব্রহ্মবান্ধবের চরিতাবৃত্তি প্রসঙ্গে বিবৃত করেছেন। তার ফলে বইখানির আস্বাদই আলাদা হয়েছে। ঠিক জীবনচরিত একে বলা যায় না। লেখক নিজেও তা বলতে চাননি। ‘গ্রন্থকারের নিবেদন’—এ তিনি বলেছেন, ‘ইহাতে উপাধ্যায় মহাশয়ের জীবনের ঘটনাবলির ইতিবৃত্ত দেওয়া হয় নাই, দিবার চেষ্টাও করি নাই। তাঁহার জীবন অপেক্ষা মহৎ ও বৃহৎ ছিল ব্রহ্মবান্ধবের ভাবাদর্শ। কলির অন্ধকারাবৃত্ত সন্ধ্যায় তিনি যে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন, তাহারই রশ্মিরেখা এই গ্রন্থের উপজীব্য।’ তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকা কিছু কিছু পুলিশের অবিশ্রান্ত উপদ্রবের কবল হইতে অদ্যাবধি রক্ষা করিয়া আসিতেছি। আচার্যের স্মৃতির অভিজ্ঞান স্বরূপে ঐগুলি রক্ষা করিতেছি।’ এ বইয়ের একজন কৌতূহলী পাঠক প্রত্যেকেই তাই প্রত্যাশা করবেন ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার দু—একটি পৃষ্ঠার প্রতিলিপি। যে পত্রিকা অধিকাংশ বাঙালির স্বচক্ষেই দেখার সুযোগ হয়নি, এবং প্রধানত যে পত্রিকার উপাদান অবলম্বন করে ব্রহ্মবান্ধব চরিতকথা বর্ণিত হয়েছে, তার কপি লেখকের নিজের কাছে থাকা সত্ত্বেও কেন তার প্রতিলিপি বইতে সন্নিবেশিত করতে তিনি দ্বিধাবোধ করেছেন তা বোঝা কঠিন। সমালোচকদের ধারণা, এই প্রতিলিপি দিলে এবং ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার নির্বাচিত কিছু রচনা পরিশিষ্টে সংযোজন করলে বইখানির মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। তৎসত্ত্বেও রচনার ভিন্ন স্বাদের জন্য উপাধ্যায়ের এই জীবনকথা পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে। আদর্শবাদী ব্রহ্মবান্ধবের ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাঠকরা এ বই থেকে কিছুটা পাবেন।

কিন্তু ব্রহ্মবান্ধবের এই দুখানি জীবনচরিত পাঠ করে বর্তমান সমালোচকের মতো অন্য পাঠকরা উপকৃত হলেও তৃপ্ত হবেন কি না সন্দেহ। তার কারণ, ব্রহ্মবান্ধবের জীবনের বেগবান ধারা ও জীবনজিজ্ঞাসার কথা স্মরণ করলে মনে হয় ‘ব্যক্তি’ হিসেবে তিনি দুর্জ্ঞেয়। তাঁর এই ব্যক্তিত্বের দুর্জ্ঞেয়তার দ্বার উদ্ঘাটন করার দায়িত্ব কোনও জীবনীকারই গ্রহণ করেননি। এই ব্যক্তিত্বের জন্যই, এবং মানুষ হিসেবে এই একাকিত্বের জন্যই তিনি, কেবল বাঙালি জাতির নয়, সমগ্র ভারতবাসীর বিস্ময়ের পাত্র। ব্রহ্মবান্ধবের কথা যত চিন্তা করা যায় তত মনে হয় যে দুয়ে দুয়ে ঠিক চারের মতো তাঁর জীবনটাকে সরল পাটিগণিতের সূত্রে বিশ্লেষ করা যায় না। তা অনেক মেহনত করার পরেও আরও কিছু অব্যক্ত থেকে যায়। তাঁর জীবন কেবল একজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী দেশসেবকের জীবন নয়, একটা বিরাট মনের দুরন্ত অভিযান। স্বরাজসাধনা সেই দুর্গম যাত্রাপথের একটি বিশিষ্ট, এবং নিঃসন্দেহে গৌরবমণ্ডিত, সুকর্ম। চঞ্চল প্রাণের অফুরন্ত স্ফূর্তি এই রক্তমাংসে গঠিত মানুষের বুদ্ধি, মন ও আত্মাকে জীবনসত্যের সন্ধানে কতখানি অস্থির ও অতৃপ্ত করতে পারে, ব্রহ্মবান্ধব তার মূর্ত প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ যেমন, ব্রহ্মবান্ধবও তেমনি জীবনজিজ্ঞাসায় সতত অস্থির ও চঞ্চল—ব্রাহ্ম, ক্যাথলিক, হিন্দু কোনও দ্বীপেই তিনি কূলের সন্ধান পাননি, সর্বদাই তাঁর মনে হয়েছে, ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে!’ কিন্তু কেন?

বাংলা সাহিত্যেও ব্রহ্মবান্ধবের একটা বিশিষ্ট দান আছে যা তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয় কর্মকীর্তির তলায় চাপা পড়ে আছে বলে আমরা স্মরণ করি না। কিন্তু তাঁর সাহিত্যকীর্তিরও এমনই একটি বিশিষ্টতা আছে যা বাস্তবিকই প্রকৃত কোনও সাহিত্যানুরাগীর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। সন্ধ্যা, স্বরাজ, বঙ্গদর্শন প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর যে রচনাবলি বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে তা একত্রে সংকলিত হলে বাংলা সাহিত্যের একটা লুপ্ত সম্পদ পুনরুদ্ধৃত হতে পারে। আশার কথা, এদিকে বিচক্ষণ প্রকাশকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে এবং তার প্রথম প্রচেষ্টা ‘ব্রহ্মবান্ধবের ত্রিকথা’। ‘বিলাত যাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি’, ‘বাংলার পাল—পার্বণ’, ও ‘আমার ভারত উদ্ধার’ নামে উপাধ্যায়ের তিনটি রচনা এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছেবলে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রহ্মবান্ধব ত্রিকথা’। দু—একটি উদ্ধৃতি ছাড়া আসল রচনার স্বাদ বোঝানো সম্ভব নয় বলে উপাধ্যায়ের নানা জাতের রচনা থেকে দু—চারটি করে লাইন এখানে তুলে দেওয়া হল—

আমি একজন ইংরেজি—পড়া সন্ন্যাসী। আজকাল অনেকানেক সন্ন্যাসী বিলাতে গিয়ে শাস্ত্রের বুকনি—মিশানো বক্তৃতা করে খুব হাততালি খায়। আমরাও একদিন শখ হোলে যে বিলাতের হাততালি খাবো। কলিকাতা মুম্বই মাদ্রাজের হাততালি খুব খেয়েছি—এখন দেখি একবার চম্পকবরণ হাতের হাততালি কেমন মিষ্টি। সন্ন্যাসীর মন যেমনি খেয়াল অমনি উঠা।

—বিলাত যাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি

আগামী শুক্রবার জামাইষষ্ঠী। এই জামাইষষ্ঠীর কথা মনে হইলে আমার মনে এক অপূর্ব ভাবের সঞ্চার হয়।

জামাই হওয়া আমার ভাগ্যে ঘটে নাই। পাতানো সম্পর্কেও কেহ কখন আমাকে জামাই বলিয়া ডাকে নাই। আর এ কাটামোয় যে জামাই হইব সে আশাও নাই। চুল সাদা হইয়া আসিয়াছে—গাল তোবড়াইয়া গিয়াছে—দাঁতগুলি হল হল করিয়া নড়িতেছে। দেহটি রসবিহীন পল্লববিরহতি পাদপের ন্যায় কোন প্রকারে তিষ্ঠিয়া আছে। বসন্তের মলয়ানিলে অঙ্গ আর শিহরিয়া উঠে না। এখন প্রাণে যা মাঝে মাঝে সাড় হয় তাহা কেবল কাঠঠোকরার ঠকঠকানির জ্বালা বই আর কিছু নয়।

—বাংলার পাল—পার্বণ

যখন আমার বয়স চৌদ্দ পনরো, তখন সুরেন বাঁড়ুজ্যে একটা নূতন আন্দোলন আরম্ভ করেন। কালী বাঁড়ুজ্যে, আনন্দমোহন বসুও আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। লেকচারে লেকচারে দেশ মাতিয়া উঠিল। আমার ত খাওয়া—দাওয়া নাই; শ্যামের বাঁশী শুনিয়া যেমন গোপীজন উন্মত্ত—আমিও তদ্বৎ। আমার পিতামহী বলিতেন—নেকচারই দেশটাকে খেলে।

লেকচার না শুনিলে প্রাণ হাঁপাইয়া উঠিত—কিন্তু লেকচার শুনিয়া হাততালি দিয়া যখন বাড়ি ফিরিতাম তখন মনে হইত—প্রাণটা যেন খালি খালি—ভরে নাই। এই রকমে বৎসর দুই কাটিয়া গেল—এন্ট্রেন্স পাশ করিয়া কলেজে উঠিলাম। তখন বয়স সতেরো বৎসর। ঐ কাঁচা বয়সে প্রাণটা কেমন উড়ু উড়ু করিতে লাগিল। সুরেন বাঁড়ুজ্যের সঙ্গে ভারত উদ্ধার করা কিছুতেই পোষাইবে না—মনে হইতে লাগিল। —আমার ভারত উদ্ধার বিশ শতকের গোড়ায় বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য—পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েও যিনি বাংলা গদ্যরচনায় এরকম অনুপম প্রসাদগুণের সঙ্গে অবলীলাক্রমে শ্লেষ, হাস্যরস এবং ওজস্বিতার মিশ্রণ ঘটাতে পারেন, তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার স্বকীয়তা অস্বীকার করা অসম্ভব। কেউ কেউ হয়তো বলবেন যে তাঁর রচনায় হুতোমি বাকভঙ্গির প্রভাব স্পষ্ট। তাঁর চলতি ভাষার রচনা ও রঙ্গরসিকতার মধ্যে হুতোমের ছায়াসঞ্চরণ সম্ভব হলেও, সাধুভাষার রচনায় তার প্রতাত্মার সন্ধান করা হাস্যকর। ব্রহ্মবান্দবের বাংলা রচনা নিজস্ব ওজস্বিতার, সারল্যে ও মাধুর্যে সমুজ্জ্বল, এবং তার চেয়েও বিস্ময়কর হল যে বঙ্কিম—রবীন্দ্র যুগের মধ্যাহ্নেও তা দুই মহারথীর প্রভাবমুক্ত। ‘ব্রহ্মবান্ধবের ত্রিকথা’য় উপাধ্যায়ের তিনটি দুষ্প্রাপ্য ও উৎকৃষ্ট রচনা প্রকাশ করে, বাঙালি পাঠকদের তার অপূর্ব রসাস্বাদনের সুযোগ দিয়ে, প্রকাশকরা সকলের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। তাঁরা যে পথনির্দেশ করেছেন, সেই পথ ধরে যদি কেউ ব্রহ্মবান্ধবের আরও অন্যান্য বাংলা রচনা, যা বিভিন্ন সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায় অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, সেগুলি সংকলন করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন তাহলে বাংলা দেশের বহু সাহিত্য—ইতিহাস পাঠক যে বিশেষ উপকৃত হবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অবশ্য এ কাজ বেশ দুরূহ ও আয়াসসাধ্য, কারণ উপাধ্যায়ের অনেক রচনা তাঁর যে ‘সন্ধ্যা’ ও ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল আজ তা অতীব দুষ্প্রাপ্য। তবু রত্নোদ্ধারের সম্ভাবনায় ক্লেশ স্বীকার করতে, তা ব্যর্থ হবে না। বাংলা রচনার সঙ্গে যদি তাঁর যৌবনের ইংরেজি রচনাগুলি The Sophia, The Twentieth Century প্রভৃতি পত্রিকা থেকে উদ্ধার করে গ্রন্থাকারে পুনর্মুদ্রিত করা যায় তাহলে উনিশ শতকের শেষ পর্বের বাংলা তথা ভারতের সামাজিক ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ অনুসন্ধিৎসুদের আয়ত্তে আসতে পারে। কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর পরবর্তী ব্রাহ্ম আন্দোলন, খ্রিস্টধর্মান্দোলন, বেসান্তের থিয়োফিস্ট আন্দোলন এবং রামকৃষ্ণ—বিবেকানন্দর হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের গতি ও প্রকৃতি ব্রহ্মবান্ধবের এই ইংরেজি রচনাবলি থেকে নির্ণয় করা সহজ হবে। আশা করি, দূরদর্শী প্রকাশকরা এ কাজে অগ্রণী হবেন।

১৩৬৮

……………………………………………………..

স্বদেশি আন্দোলন ও বাংলার নবযুগ। হরিদাস মুখোপাধ্যায়, উমা মুখোপাধ্যায়। সরস্বতী লাইব্রেরী, কলকাতা।

উপাধ্যায় ব্রহ্মবান্ধব ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। হরিদাস মুখোপাধ্যায়, উমা মুখোপাধ্যায়।

ফার্মা কে. এল. মুখোপাধ্যায়, কলকাতা।

ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। শ্রীবলাই দেবশর্মা। প্রবর্তক পাবলিশার্স, কলকাতা।

ব্রহ্মবান্ধবের ত্রিকথা। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রা. লি., কলিকাতা।

সকল অধ্যায়

১. বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ
২. মার্কসবাদ ও মর্গানবাদ – বিনয় ঘোষ
৩. বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা – বিনয় ঘোষ
৪. গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ
৫. মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ
৬. শিবনাথ শাস্ত্রী – বিনয় ঘোষ
৭. সমাজপতি মহারাজা নবকৃষ্ণ – বিনয় ঘোষ
৮. ঠাকুর পরিবারের আদিপর্ব ও সেকালের সমাজ – বিনয় ঘোষ
৯. বিদ্যাসাগর-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১০. রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১১. বিবেকানন্দ-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১২. জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ
১৩. অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৪. সমাজবিজ্ঞানীর এ কোন শোচনীয় পরিণতি! – বিনয় ঘোষ
১৫. মেহনত ও প্রতিভা – বিনয় ঘোষ
১৬. দীবনন্ধু মিত্র বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও বাঙালি সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৭. বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদিপর্ব – বিনয় ঘোষ
১৮. তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ
১৯. সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ
২০. ‘গেট টু-গ্যাদার’ – বিনয় ঘোষ
২১. অর্থনীতির ভোজবাজি – বিনয় ঘোষ
২২. গৃহভৃত্যদের সামাজিক ভূমিকা – বিনয় ঘোষ
২৩. স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ
২৪. রামমোহন রায়ের জীবনচরিত – বিনয় ঘোষ
২৫. এক পুরুষের দুস্তর ব্যবধান – বিনয় ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন