বিনয় ঘোষ
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির গৃহপ্রবেশ উৎসবের সময় দ্বারকানাথ ঠাকুর ‘অনেক অনেক ভাগ্যবান’ সাহেব—বিবিদের নিমন্ত্রণ করে এনে ‘চতুর্বিধ ভোজনীয় দ্রব্য’ ভোজন করিয়ে পরিতৃপ্ত করেছিলেন। কলকাতা শহরের বাঙালি ভাগ্যবানেরাও উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের সংখ্যা পাথুরিয়াঘাটা শোভাবাজার বাগবাজার হাতিবাগান কুমোরটুলি বউবাজার অঞ্চলে তখন খুব কম ছিল না। বড় বড় দেওয়ান বেনিয়ান মুচ্ছুদ্দি ব্যবসায়ী, নিমকমহল ও হাটবাজারের ইজারাদার ও রাজা—মহারাজা খেতাবধারীদের সমাগম হয়েছিল উৎসবে। দ্বারকানাথের বিশিষ্ট বন্ধু ও সহযোগী রামমোহন রায়েরও তখন (১৮২৩ সালে) কলকাতায় থাকার কথা, যদিও ‘ব্রাহ্মসমাজ’ তখনও স্থাপিত হয়নি এবং ‘ইউনিটেরিয়ান সভা’ নিয়ে তিনি ব্যস্ত। উৎসবে রামমোহনও আসতে পারেন, তবে তিনি এসেছিলেন কি না সেখবর তখনকার কোনও সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। একদিকে সাহেব—বিবিদের, আর—একদিকে অভিজাত বাঙালিদের ট্রাউজার—জ্যাকেট—টুপি এবং চোগা—চাপকান—শিরস্ত্রাণাদি সাজসজ্জার বাহারে উৎসব—সভা যে কী বিচিত্র রূপ ধারণ করেছিল তা—ও আজ মানসনেত্রে দেখা ছাড়া উপায় নেই, কারণ কোনও শিল্পী তৈলচিত্রে তা রূপায়িত করেননি, এবং আলোকচিত্রেও তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। স্বচ্ছন্দে কল্পনা করা যেতে পারে যে সেদিন চিৎপুর অঞ্চল ল্যান্ডে—ফিটন—ব্রউহ্যাম—পালকগাড়ি ও ঘোড়ার ভিড়ে দুর্গম হয়ে উঠেছিল এবং সাধারণ লোকের কথা ছেড়ে দিলেও বিচিত্র বেশধারী কোচোয়ান সহিস খিদমতগার মশালচিদের সমাবেশেই জোড়াসাঁকো সরগরম হয়ে উঠেছিল। ঘটনাটা সাধারণ নয়, ‘Prince’ দ্বারকানাথ ঠাকুরের গৃহপ্রবেশ উৎসব।
উৎসবের দিন ২৭ অগ্রহায়ণ ১২৩০ সাল, ইংরেজি ১৮২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার। উৎসবের সময় সন্ধ্যার পরে। আলোকসজ্জা ও আতশবাজির জন্য সন্ধ্যার পরই প্রশস্ত সময়। সাহেবি, বাঙালি ইত্যাদি খানার ‘চতুর্বিধ ভোজনীয় দ্রব্য’—এর বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়নি। শুধু এইটুকু জানা যায় যে ভোজনান্তে উত্তম গান, ইংরেজি বাদ্য ও নৃত্য হয়েছিল। তারপর ভাঁড়েরা সং সেজে উপস্থিত সাহেবলোক ও বাবুদের প্রচুর আমোদ বিতরণ করেছিল এবং তাদের মধ্যে একজন গোবেশ ধারণ করে ঘাস চর্বণ করাতে আমন্ত্রিতদের আহ্লাদের আর সীমা ছিল না।১
জোড়াসাঁকোর নবনির্মিত গৃহে প্রবেশ করার আগে দ্বারকানাথের পূর্বপুরুষরা কলকাতার আরও অনেক গৃহে প্রবেশ করে বাস করেছিলেন। কেবল চিৎপুরে জোড়াসাঁকো ও পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে নয়, তার বাইরে বর্তমান ধর্মতলা এসপ্লানেড ও ময়দান অঞ্চলে, যখন ময়দানের নতুন কেল্লা জুড়ে গঙ্গার তীর ধরে ছিল অধুনালুপ্ত গোবিন্দপুর গ্রাম। জোব চার্নক সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দশকে কলকাতা শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন গঙ্গার পূর্ব তীরে ইংরেজদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের সিদ্ধান্ত করে। তার আগেই অবশ্য বাঙালি তন্তুবণিক শেঠ—বসাকরা আরও উত্তরে বড়বাজারের কাছে সুতাবস্ত্রের হাট বসিয়েছিলেন, যার জন্য অঞ্চলটার নামই ‘সুতানুটি’ হয়েছিল। পশ্চিম তীরে পোর্তুগীজের প্রতিষ্ঠিত বেতোড়ের হাট, পূর্ব তীরে শেঠ—বসাকদের সুতানুটি হাট, কাজেই চার্নকের পক্ষে কুঠির জন্য পূর্বতীর বেছে নেওয়া ভুল হয়নি। গোবিন্দপুর গ্রাম তারও আগে থেকে ছিল কিনা সঠিক জানা যায় না। মনে হয় পূর্বতীরে সুতানুটি হাট আর চার্নকের কুঠি স্থাপিত হবার পর থেকে ভাগ্যান্বেষী বাঙালিরা কিঞ্চিৎ অর্থের ধান্দায় পাশাপাশি গ্রাম থেকে এসে গঙ্গাতীরেই বাসা বেঁধেছিলেন এবং অল্পকালের মধ্যেই কয়েকটি বসতির সমাবেশে সেখানে একটি গ্রাম গড়ে উঠেছিল। বাংলা দেশের গ্রামের বসতি সাধারণত কোনও দেবতা ও দেবালয় কেন্দ্র করে বিন্যস্ত হয়, তাই গ্রামদেবতা গোবিন্দর নামে গ্রামের নাম হয় গোবিন্দপুর।
কলকাতা মহানগর তখন এইরকম কয়েকটি বিক্ষিপ্ত গ্রামের গর্ভে অঙ্কুরাবস্থায় ছিল। ইংরেজ বণিকের আগমনের ফলে তার ভবিষ্যৎ রূপ যাঁরা সেদিন মনশ্চক্ষুতে কিছুটা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ‘ব্ল্যাক—জমিদার’ বলে খ্যাত গোবিন্দরাম মিত্র, মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের পিতা দেওয়ান রামচন্দ্র দেব প্রভৃতি অন্যতম। জোড়াসাঁকো—পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের পূর্বপুরুষও তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন। ভাগ্যলক্ষ্মীর সন্ধানে তিনি আরও অনেকের মতো বাংলার গ্রামাঞ্চল থেকে এসেছিলেন ভাগীরথীর পূর্ব তীরে, ইংরেজের বাণিজ্যকুঠির অদূরে অবস্থিত গোবিন্দপুর গ্রামে। তারপর বংশানুক্রমে অনেক বুদ্ধি ও কৌশল খাটিয়ে তাঁরা সংগ্রাম করেছেন, কত চাকরি আর কত রকমের বাণিজ্য যে করেছেন তার ঠিক নেই। তবেই ভাগ্যলক্ষ্মী প্রসন্ন হয়েছেন তাঁদের প্রতি এবং সেই প্রসন্নতা—পরিবৃত পরিবেশে গোপীমোহন চন্দ্রকুমার প্রসন্নকুমার দ্বারকানাথ দেবেন্দ্রনাথ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভার বিচিত্র বিকাশ হয়েছে ঠাকুরপরিবারে। পরবর্তীকালের বংশধরদের বিচিত্রগামী প্রতিভার জৌলুসে ঠাকুর পরিবারের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি স্বভাবতই ম্লান হয়ে গিয়েছে এবং তাঁদের কীর্তিকলাপও মনে হয়েছে বিস্মরণীয়। কিন্তু তবু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পিতৃপুরুষদের প্রত্যহ স্মরণ করতেন এই মন্ত্রটি উচ্চারণ করে২
পুরুষোত্তমাদ্বলরামঃ বলরামাদ্ধরিহরঃ
হরিহরাদ্রামানন্দঃ রামানন্দান্মহেশঃ
মহেশাৎ পঞ্চাননঃ পঞ্চাননাজ্জয়রামঃ
জয়রামান্নীলমণিঃ নীলমর্ণেরামলোচনঃ
রামলোচনাদ্বারকানাথঃ,
নমঃ পিতৃপুরুষেভ্যো নমঃ পিতৃপুরুষেভ্যঃ।
পুরুষোত্তম থেকে বলরাম, বলরাম থেকে হরিহর, হরিহর থেকে রামানন্দ, রামানন্দ থেকে মহেশ, মহেশ থেকে পঞ্চানন, পঞ্চানন থেকে জয়রাম, জয়রাম থেকে নীলমণি, নীলমণি থেকে রামলোচন, রামলোচন থেকে দ্বারকানাথ ঠাকুর পর্যন্ত পিতৃপুরুষদের তর্পণ করতেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। রামলোচন জ্যেষ্ঠ এবং দ্বারকানাথ তিনি দত্তক গ্রহণ করেছিলেন বলে দ্বারকানাথের জনক রাসমণির পরিবর্তে রামলোচনের নাম করা হয়েছে। দ্বারকানাথের জন্ম হয় আঠারো শতকের শেষ দশকে (১৭৯৪)। তার ঊর্ধ্বে চারপুরুষ পর্যন্ত ঠাকুর বংশের কেউ কলকাতায় আসতে পারেন, কারণ কলকাতা শহরের তখন পত্তন হয়েছে, লোকজনের বসতি বেড়েছে এবং রোজগারের পথও অনেক খুলে গিয়েছে। দ্বারকানাথ থেকে চারপুরুষেরও আগে ঠাকুরদের কারও কলকাতায় আসা সম্ভব নয়, কারণ তাহলে প্রায় চার্নকেরও আগে আসতে হয় এবং তা আসবার কোনও সংগত কারণ থাকতে পারে না। পঞ্চানন—জয়রাম—নীলমণি—রামলোচন, এই হল দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঊর্ধ্বতন চারপুরুষ। কাজেই আঠারো শতকের গোড়ার দিকে পঞ্চানন ঠাকুরকে আমরা দেখতে পাই গঙ্গাতীরের গোবিন্দপুর গ্রামে। কিন্তু এই ঠাকুর মহাশয়ের কথা শুরু করার আগে আরও কয়েক পুরুষ ঊর্ধ্বে পুরুষোত্তম—বলরাম পর্যন্ত কিছু বলা দরকার। মহর্ষি যখন পুরুষোত্তম পর্যন্ত স্মরণ করতেন তখন ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস প্রসঙ্গে তাঁদের কথাও উল্লেখ করতে হয়।
পুরুষোত্তম হলেন দ্বারকানাথ থেকে ঊর্ধ্বতন দশম পুরুষ, রবীন্দ্রনাথ থেকে দ্বাদশ পুরুষ। সাধারণত আমরা সাতপুরুষের কথা উল্লেখ করে থাকি এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে সেই সাতপুরুষের মধ্যে প্রথম পঞ্চানন ঠাকুর একেবারে কলকাতা শহরে পদার্পণ করেছেন দেখা যায়। পঞ্চাননের আরও পাঁচপুরুষ আগে পুরুষোত্তম। একপুরুষে পঁচিশ—তিরিশ বছর ধরে গণনা করলে পুরুষোত্তমকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে নিয়ে যেতে হয়। তখন বাংলা দেশে হুসেনশাহি সুলতানদের পর শূর বংশীয় আফগানসুলতানদের রাজত্বকাল। শ্রীচৈতন্য ও তাঁর গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের আবির্ভাবে সমাজ ও সাহিত্যের পুনরুজ্জীবনে তখন বাংলা দেশে এক নবযুগের সূচনা হয়েছিল। পুরুষোত্তম মধ্যযুগে এই জাগরণকালের লোক।
বাংলা দেশে ঠাকুরবংশে ‘পিরালী’ ব্রাহ্মণ বংশ বলে কথিত। পিরালীদের উৎপত্তি সম্বন্ধে কিংবদন্তি ও কাহিনির অন্ত নেই। কুলাচার্য নীলকান্ত ভট্টর কারিকা থেকে জানা যায় যে সুলতানের একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ কর্মচারী নবদ্বীপের কাছে পিরলিয়া বা পিরল্যা গ্রামে বাস করতেন। এক সুন্দরী মুসলমান কন্যাকে বিবাহ করার জন্য তিনি ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন। পিরল্যা গ্রামে বাস করার জন্য অথবা মুসলমানপ্রীতির জন্য লোকে তাঁকে ‘পিরালী’ বলে ডাকত। এই কাহিনি যদি সত্যও হয় তাহলেও ঠাকুর বংশের সঙ্গে এই প্রেমিক পিরালীর কোনও সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না, কারণ এই পিরালী যদি মুসলমান হয়ে থাকেন তাহলে তাঁর বংশ ব্রাহ্মণ বংশ বলে কথিত হতে পারে না।
অন্য কুলাচার্যদের কারিকায় দেখা যায় যে হুসেন শাহের আমলে জনৈক হিন্দু দেওয়ান যবনের খানা ঘ্রাণের জন্য, ঘ্রাণে অর্ধভোজন ‘থিয়োরি’ অনুযায়ী মুসলমানি খানা আস্বাদনের অপরাধে সমাজচ্যুত হন :
যবনের খানার ঘ্রাণ গেল তোমার নাকে।
কেমনে রইল হিন্দুয়ানী কহত আমাকে।।
বাদশার কথায় জব্দ দেওয়ান লোকে পাইল ভান।
সমাজেতে রাষ্ট্র হইল খানা খায় দেওয়ান।।
পীরের থৈইকা পাইল দোষ নাম হইল পিরারী।
সংস্রবেতে দোষী পিঠাভোগের কুশারি।।
জয়ানন্দর ‘চৈতন্যমঙ্গল’—এ আছে :
পিরল্যা গ্রামেতে বৈসে যতেক যবন।
উচ্ছন্ন করিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণে যবনে বাদ যুগে যুগে আছে।
বিষম পিরল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছে।।
পিরালী ব্রাহ্মণদের উৎপত্তি সম্বন্ধে এরকম আরও অনেক কারিকা, ছড়া ও কবিতা উদ্ধৃত করা যায়। কিন্তু এইসব কাহিনি থেকে যে ঐতিহাসিক সত্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার সঙ্গে কারিকার বা কিংবদন্তীর কাহিনি—কল্পনার সম্পর্ক খুব সুদূর। আসল সত্য এই হওয়া সম্ভব যে, সুলতানি আমলে বাংলার মুসলমান শাসকরা তুর্কিয়ানা পদ্ধতিতে যখন দেবদেউল ধ্বংস ও জাতিধর্ম নাশ করছিলেন তখন নবদ্বীপ ও তার পরিপার্শ্বের একাধিক ব্রাহ্মণপ্রধান গ্রামের উপর দিয়েও সেই ঝড় বয়ে গিয়েছিল। তারপর সেই বিপর্যস্ত গ্রামের ব্রাহ্মণরা আবার হিন্দুসমাজের কাছেও কঠোর দণ্ড পেয়েছিলেন। তখন সমাজে কেবল বৈষ্ণবধর্মের উদারতার বাণীই যে ঘোষিত হচ্ছিল তা নয়, রঘুনন্দন প্রমুখ স্মার্ত ভট্টাচার্যেরাও রক্তচক্ষু বিস্ফারিত করে, নব্য স্মৃতি হাতে নিয়ে তর্জনী তুলে অনাচার—অত্যাচারপীড়িত হিন্দুসমাজকে শাসাচ্ছিলেন। সামাজিক অবস্থা যা হয়েছিল তাতে স্মার্ত পণ্ডিতদের শাসানিকেও দোষ দেওয়া যায় না। তাঁরা ভেবেছিলেন যে মুসলমানদের অত্যাচারে অনর্গল ধারায় অনাচার প্রবেশ করছে সমাজে এবং সমাজ রসাতলে যাচ্ছে। কাজেই স্মৃতি—ধর্মশাস্ত্রের বজ্রবন্ধনে তাঁরা সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে চেয়েছিলেন। বজ্র আঁটুনির ফলে গেরো ফসকা হয়েছিল কি না তা সামাজিক ইতিহাসের বিচার্য বিষয়, আপাতত ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস প্রসঙ্গে আলোচ্য নয়। লক্ষণীয় হল, এইসময় কুলাচার্যরাও সোৎসাহে কুলগ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেন, ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ সকলেরই কুলপঞ্জি তৈরি হয়। মুসলমানদের অত্যাচারে অথবা মুসলমান শাসকদের দরবারে রাজকার্য উপলক্ষে ঘনিষ্ঠতার জন্য যেসব ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্যদের বিচারে জাতিচ্যুত করা হয়েছিল, মনে হয় তাঁদের মধ্যে ‘পিরালী ব্রাহ্মণরা’ অন্যতম। হিন্দুসমাজের বিচারে যবন সাহচর্যের ফলে গ্রামকে গ্রাম দণ্ডিত হওয়াও আশ্চর্য নয়। নবদ্বীপের কাছে পিরল্যাবাসী ব্রাহ্মণরা এইভাবেও দণ্ডিত হতে পারেন।
কলকাতার ঠাকুর পরিবার, কুলাচার্যদের মতে, যশোহর—খুলনার পিঠাভোগের কুশারী—বংশজাত। কুশারীরা তাঁদের বর্ধমান জেলার আদি নিবাস কুশগ্রাম থেকে বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী ও যশোহর—খুলনা জেলার ঘাটভোগ, দামুড়হুদা—পিঠাভোগ প্রভৃতি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েন। পুরুষোত্তমের পিতা জগন্নাথ কুশারী আদি পিরালী শুকদেবের কন্যাকে বিবাহ করে যশোর জেলায় বসবাস করেন। জগন্নাথের বংশধররা এইভাবে পিরালী ব্রাহ্মণদের থাকভুক্ত হন।৩ জগন্নাথ কুশারীর কাল ষোড়শ শতকের প্রথম পর্ব, পুরুষোত্তমের কাল মধ্যপর্ব। উভয়েই মুসলমান রাজত্বের মধ্যাহ্নকালের লোক।৪
পুরুষোত্তমের পুত্র বলরাম, পৌত্র হরিহর, প্রপৌত্র রামানন্দ। রামানন্দর পুত্র মহেশ্বর থেকে পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের উৎপত্তি। মহেশ্বরের পুত্র পঞ্চানন সর্বপ্রথম কলকাতায় আসেন এবং বংশলতা অনুসারে তাঁর আগমনকাল আঠারো শতকের প্রথম পর্ব অনুমান করতে বাধা নেই। ১৭০৭ সালে যখন সম্রাট ঔরঙ্গজীবের মৃত্যু হয় তখন কলকাতা অঞ্চল জরিপ করে দেখা যায় যে ‘বাজার কলকাতা’ অঞ্চলে মোট প্রায় ৫০০ বিঘার মধ্যে কমপক্ষে ৪০০ বিঘায় লোকজনের বসতি ও ঘরবাড়ি আছে, কিন্তু ‘টাউন—কলকাতা’ অঞ্চলে প্রায় ১৭০০ বিঘার মধ্যে মাত্র ২৫০ বিঘায়, ‘সুতানুটি’ অঞ্চলে ১৭৭০ বিঘার মধ্যে মাত্র ১৩৪ বিঘায় এবং ‘গোবিন্দপুর’ অঞ্চলে ১২০০ বিঘার মধ্যে মাত্র ৫৭ বিঘায় লোকবসতি আছে, বাকি সব ধানখেত, কলাবাগান, বাঁশবাগান, পুকুর ও জলাজঙ্গলে ভরতি। তবু বাজার—কলকাতার (বর্তমান বড়বাজার প্রভৃতি অঞ্চল) বসতির ঘনত্ব দেখে বোঝা যায় যে আঠারো শতকের গোড়ার দিকেই শহরের আকর্ষণ বেশ বেড়েছিল, অন্তত আর্থিক আকর্ষণ তো নিশ্চয়ই। তা না হলে বাজার অঞ্চলে লোকের ভিড় হবে কেন? সুতানুটি (বর্তমান উত্তর কলকাতা), টাউন—কলকাতা (বর্তমান মধ্য কলকাতার বউবাজার প্রভৃতি অঞ্চল) ও গোবিন্দপুরে (বর্তমান ময়দানে কেল্লার কাছে) লোকবসতি আদৌ ঘন হয়নি। আগেই বলেছি, বাজার—কলকাতা অঞ্চলে বাঙালি তন্তুবণিক শেঠ—বসাকরা (মুর্শিদাবাদের জৈন ব্যাঙ্কার শেঠরা নন) আগে থেকে বাজার পত্তন করেছিলেন, সেই কারণে এই অঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় লোকবসতি বেশ বেড়েছিল।৫ এ দেশের লোক, প্রধানত বিভিন্ন বণিক সম্প্রদায়, ব্যাবসাবাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এই বাজার অঞ্চলে বসবাস করতে আরম্ভ করেছিলেন। তাহলেও গোবিন্দপুর গ্রামের আকর্ষণও তখন কম ছিল না, কারণ গঙ্গাতীরে ইংরেজদের পুরাতন কুঠি ও কেল্লা গোবিন্দপুরের কাছেই অবস্থিত ছিল (বর্তমান কাস্টমস হাউস ও বড় ডাকঘরের কাছে)। কলকাতা শহরের মূলকেন্দ্র (nucleus) ছিল এই পুরাতন কুঠি—কেল্লা অঞ্চল, এবং এই কেন্দ্রটিকে অর্ধবৃত্তাকারে বেষ্টন করে গোবিন্দপুর থেকে সুতানুটি পর্যন্ত মৌচাকের মতো লোকবসতি গড়ে উঠেছিল। ১৭০৫—০৬ সালে দেখা যায়, কোম্পানির কর্মচারীরা কলকাতার খবর জানিয়ে বিলেতে ডিরেক্টরদের লিখছেন—‘The Town buildings increased and the Streets regular’’—এবং তার চেয়েও বড় সুসংবাদ দিচ্ছেন এই বলে যে ‘people flocking there to make the Neighbouring Jemindars envy them’—অর্থাৎ দলে দলে লোক শহরে আসছে এবং তা—ই দেখে আশপাশের জমিদাররা বেশ ঈর্ষা প্রকাশ করছেন।৬
পঞ্চানন ঠাকুর যদি এইসময় কলকাতায় আরও অনেকের মতো ভাগ্যপরীক্ষার জন্য এসে থাকেন তাহলে যথাসময়েই এসেছিলেন বলতে হবে। বাজার—কলকাতায় যেমন প্রধানত বণিকজাতির বাস ছিল, তেমনি গোবিন্দপুরে মনে হয় প্রধানত ব্রাহ্মণ—কায়স্থ মধ্যবিত্তরা এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কুশারী বংশীয় ব্রাহ্মণ বলেও পঞ্চানন গোবিন্দপুরে বাস করা বাঞ্ছনীয় মনে করতে পারেন। এ ছাড়া সাহেবদের কুঠি, কেল্লা, মালগুদাম ও জাহাজঘাট কাছে বলেও তাঁর গোবিন্দপুরে বাস করার ইচ্ছা হতে পারে। শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণর পিতা, কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্র, এঁরা পঞ্চাননের সময়ে, কিছু আগে বা পরে, কলকাতার গোবিন্দপুর অঞ্চলে এসেছিলেন। অর্থ উপার্জনের জন্য যাঁরা তখন কলকাতায় আসতেন তাঁরা হয় কোম্পানির কলকাতার জমিদারির কাজকর্ম, না হয় ব্যাবসাবাণিজ্য করতেন। কাপড়চোপড় ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের ব্যাবসা তখনও কুলবৃত্তি হিসেবেপ্রধানত বিভিন্ন বণিকজাতির মধ্যে আবদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণ—বৈদ্য—কায়স্থরা তখন জায়গাজমির পত্তনি, বাজারঘাট ও নিমকমহলের ইজারাদারি, জাহাজের বিদেশি নাবিক ও লশকরদের জিনিসপত্তর সরবরাহ অথবা বেনিয়ানগিরি করতেন। পঞ্চানন এর মধ্যে জাহাজের ক্যাপ্টেন ও খালাসিদের মাল সরবরাহের কাজটি বেছে নিয়েছিলেন শোনা যায়। এতে বিলক্ষণ দু—পয়সা রোজগার হত এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন ধরার জন্য ব্যবসায়ীদের যে আগ্রহ প্রকাশ পেত তা—ই থেকে নাকি পরে ‘কাপ্তেন পাকড়াও’ কথা শহরে চালু হয়েছে এবং শহরের বাবুরাও ‘কাপ্তেন’ নামে অভিহিত হয়েছেন। ইংরেজ ক্যাপ্টেন, খালাসি ও বণিকমহলে পঞ্চানন ‘ঠাকুর’ বলে পরিচিত হন। আমাদের দেশে সাধারণ লোক ব্রাহ্মণকে ‘ঠাকুরমশাই’ বলে সম্বোধন করে থাকেন। গোবিন্দপুরের সাধারণ গ্রামবাসীর কাছে পঞ্চানন কুশারীর ‘ঠাকুরমশাই’ নামটি ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এবং এই ‘ঠাকুর’ কথাটি ইংরেজদের মুখে ‘Tagore’ হয়ে যায়। এর মধ্যে কতটুকু কাহিনি আর কতটুকুই বা ইতিহাস তা বলা কঠিন। তবে পঞ্চাননের কালের দিক থেকে বিচার করলে কলকাতা শহরে তাঁর পেশা ও পদবীর রূপান্তর কোনওটাই খুব অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না।
‘পঞ্চাননজ্জয়রামঃ জয়রামান্নীলমণিঃ।’ পঞ্চাননের পুত্র জয়রাম কলকাতায় ইংরেজদের জমিদারির কাছারিতে কাজ করতেন। কলকাতা কালেক্টরেটের দলিলপত্রে কোথাও জয়রামের নাম পাওয়া যায় না। পাওয়া সম্ভবও নয়। কলকাতার জমিদারিতে তখন গোবিন্দরাম মিত্রর অসাধারণ প্রতিপত্তি, ইংরেজদের অধীনে ‘ব্ল্যাক ডেপুটি’ হিসেবে আসলে তিনিই জমিদারির তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁর প্রতাপে কলকাতা—সুতানুটি—গোবিন্দপুরের লোক কাঁপত, ‘গোবিন্দরামের ছড়ি’ প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। কাছারিতে এ দেশের লোক নায়েব, গোমস্তা, আমিন, রাজস্ব আদায়কারী প্রভৃতি নানা রকমের চাকরি পেতেন। জয়রাম গোবিন্দরামের সমসাময়িক ছিলেন বলে মনে হয় তাঁর পক্ষে কলকাতার জমিদারি কাছারিতে কোনও কাজে নিযুক্ত থাকা অসম্ভব নয়। পলাশির যুদ্ধের বছরখানেক আগে ১৭৫৬ সালে (ফারেল সাহেব ১৭৬২ সাল বলেছেন) জয়রামের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুকালে দুই স্ত্রী, তিন পুত্র—দর্পনারায়ণ, নীলমণি ও গোবিন্দরাম—এবং পৌত্ররা জীবিত ছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের শ্লোকে কেবল ‘জয়রামান্নীলমণিঃ’ এবং ‘নীলমর্ণেরামলোচনঃ’ উল্লেখ করা হয়েছে, দর্পনারায়ণের নাম নেই। পরিষ্কার বোঝা যায় যে ঠাকুর পরিবারে দ্বারকানাথ—দেবেন্দ্রনাথ—রবীন্দ্রনাথের শাখা নীলমণি থেকে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। একটি শাখাকে দর্পনারায়ণের শাখা, আর—একটিকে নীলমণি ঠাকুরের শাখা বলা যায়। দেবেন্দ্রনাথ এই কারণে জয়রাম—নীলমণি—রামলোচন দ্বারকানাথের নাম পিতৃপুরুষের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। দর্পনারায়ণের শাখাকে পাথুরিয়াঘাটার এবং নীলমণির শাখাকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার বলা হয়।
পলাশির যুদ্ধের পর পুরাতন কেল্লা তুলে দিয়ে নতুন কেল্লা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। তার জন্য গোবিন্দপুর গ্রাম দখল করে স্থানীয় লোকজনদের কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে শহরের অন্য অঞ্চলে স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা করা হয়। কলকাতার ইংরেজ কর্তারা কোম্পানির ডিরেক্টরদের লেখেন : ‘আমরা গোবিন্দপুর গ্রাম থেকে ”নেটিভ” বাসিন্দাদের অন্যত্র তুলে দিতে বাধ্য হয়েছি, কারণ নতুন কেল্লা এই স্থানে তৈরি করা হবে ঠিক হয়েছে। ইটের পাকা বাড়ির মালিক যাঁরা তাঁদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলা হয়েছে। যাঁরা কাঁচা চালাঘরে থাকতেন তাঁদের অন্যত্র বসবাসের জমি দেওয়া হয়েছে এবং স্থানান্তরের খরচ বাবদ কিছু নগদ টাকাও দেওয়া হবে জানানো হয়েছে।’৭ এই খবরটুকু ছাড়া গোবিন্দপুরের বাসিন্দারা কে কত জায়গাজমি ও নগদ টাকা পেয়েছিলেন, দলিলপত্র থেকে তা জানা যায় না। তবে ক্ষতিপূরণের জন্য উৎখাত হওয়া বাসিন্দাদের যে অনেকদিন ধরে বোর্ডের কাছে লেখালেখি করতে হয়েছিল, সরকারি নথিপত্রের বিবরণ থেকে তা বোঝা যায়।৮ জয়রাম ঠাকুর গোবিন্দপুরের ভদ্রাসন রেখেই গত হয়েছিলেন নিশ্চয়, কিন্তু দর্পনারায়ণ ও নীলমণি তা ছেড়ে আসার জন্য কোম্পানির কাছ থেকে কত ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন কোথাও তার উল্লেখ নেই। তাঁদের বসতবাড়ি পাকা ছিল কি না, এবং থাকলেও কত বড় ছিল তা অনুমান করা সম্ভব নয়। ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থে নগেন্দ্রনাথ বসু পিরালী ব্রাহ্মণ খণ্ডে ঠাকুর বংশের বিবরণ প্রসঙ্গে বলেছেন যে জয়রাম মৃত্যুকালে ধনসায়েরের বাড়ি বাগান পুষ্করিণী বৈঠকখানা ব্যতীত নগদ টাকাও অনেক রেখে যান। কিন্তু এই উক্তির কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ তিনি দেননি। ধনসায়েরই বা কোথায়? ধর্মতলা? আঠারো শতকের মধ্যভাগে কলকাতায় ধর্মতলা অঞ্চলে ‘ধনসায়ের’ নামে কোনও জায়গা ছিল বলে জানা যায় না। ভদ্রাসনের নাম হতে পারে, ‘সায়র’ বা সরোবর—দিঘি হতে পারে, কিন্তু তারই বা প্রমাণ কী? ১৭৫৭ সালের শেষে গোবিন্দপুরের বসতি তুলে দেওয়া হয়, কারণ এই বিষয়ে কোম্পানির কাছে লেখা পূর্বোক্ত চিঠির তারিখ ১০ জানুয়ারি ১৭৫৮। জয়রামের মৃত্যুর অল্পদিন পরের ঘটনা। কাজেই দর্পনারায়ণ ও নীলমণি যদি কোনও বসতবাড়ি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়ে থাকেন তাহলে সেটা গোবিন্দপুরে হওয়াই সম্ভব। এই সময় শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ, কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্র এবং আরও অনেক দর্পনারায়ণ—নীলমণির সমসাময়িক ব্যক্তি উত্তর কলকাতায় সুতানুটি অঞ্চলে নতুন ভদ্রাসন নির্মাণ করে গোবিন্দপুর থেকে উঠে আসেন।
ঠাকুরদের মধ্যে দু—জন অবশ্য কয়েক হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন কোম্পানির কাছ থেকে, কিন্তু সেটা মনে হয় নবাব সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে কলকাতায় ইংরেজদের যুদ্ধের ফলে (১৭৫৬) যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তারই পূরণস্বরূপ। যাঁরা এই ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিখ্যাত পিতা—পুত্র গোবিন্দরাম মিত্র ও রঘু মিত্র (প্রায় ৪ লক্ষ) টাকা পান, শোভারাম বসাক (প্রায় ৪ লক্ষ), রতু (রতন) সরকার (প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার), শুকদেব মল্লিক ও নয়ান মল্লিক (প্রত্যেকে প্রায় ৪০ হাজার), নীলমণি ও হরিকিষণ ঠাকুর (যথাক্রমে ১৮ হাজার ও ১০ হাজার)।৯ হরিকিষণ ঠাকুর নীলমণি ও দর্পনারায়ণের ভাই হতে পারেন। বংশলতায় সব নাম নেই ঠাকুর বংশের এমন অনেক নাম পুরাতন দলিলপত্রে পাওয়া যায়।
১৭৫৮—৫৯ সালে কোনও সময় দর্পনারায়ণ ও নীলমণি ঠাকুর উত্তর কলকাতায় পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে ভদ্রাসন প্রতিষ্ঠা করে বাস করতে আরম্ভ করেন। নগেন্দ্রনাথ বসু কয়েকটি দলিল (বিক্রয়—কোবলা, পাট্টা ইত্যাদি) উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে ১৭৬৪ সালে নীলমণি ঠাকুর সুতানুটি গ্রামে কলকাতা কালেক্টরির জব্দজমি থেকে দু—বিঘে তেরো কাঠা জমি সালিয়ানা ৪ গন্ডা সিক্কা মুদ্রা খাজনায় পাট্টা করে নেন। এর কয়েকমাস পরে তিনি ডিহি কলকাতার প্রান্তে জনৈক রামচন্দ্র কলুর কাছ থেকে ৫২৫ টাকায় ঘরবাড়িসহ সাড়ে দশ কাঠা জমি নিজের নামে কেনেন। তারপর ১৭৬৯ সালে এইসব জমির সংলগ্ন আরও দু—বিঘে সাত কাঠা জমি বসতবাড়িসহ তিনি জনৈক জগমোহন সাহার কাছ থেকে ৯০০০ টাকায় কেনেন। এইসব জমি জুড়ে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের বাসস্থান গড়ে ওঠে।
এইসময় পাথুরিয়াঘাটার দর্পনারায়ণ ও নীলমণি ঠাকুরের ভদ্রাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও, সমাজে তাঁদের বিশেষ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলে মনে হয় না। ব্যাবসাবাণিজ্য বা চাকরিবাকরি করে তাঁরা তখন পর্যন্ত হয়তো প্রতিষ্ঠালাভ করতে পারেননি। কারণ ১৭৬০ সাল থেকে ১৭৭০—৭৫ সাল পর্যন্ত দর্পনারায়ণ বা নীলমণির নাম কোনও সরকারি নথিপত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না, কেবল পূর্বোক্ত ক্ষতিপূরণের তালিকায় ১৮ সেপ্টেম্বর ১৭৫৮) হরিকিষণ ‘Tagoor’—এর সঙ্গে ‘নীলমণি’ নামটি ছাড়া। অথচ ১৭৬০ সাল থেকে দলিলপত্রে বিবিধ প্রসঙ্গে একাধিক ঠাকুরের নাম পাওয়া যায়, যেমন ভবানীচরণ ঠাকুর, শিবনারায়ণ ঠাকুর, দয়ারাম ঠাকুর, হরিকিষণ ঠাকুর, কেবলরাম ঠাকুর ইত্যাদি। চব্বিশ পরগনার জমিদারি নিয়ে ইংরেজরা যখন টাউন হলে নিলাম ডেকে তার ইজারা দেন তখন ভবানীচরণ ঠাকুর (বলরাম বিশ্বাসের সঙ্গে) পিচাকুলির জমিদারি ৩৩,৪০০ টাকায় ডাক দিয়ে কেনেন (৩১ জুলাই ১৭৬০)।১০ গোবিন্দরাম মিত্রর পৌত্র রাধাচরণ মিত্র কোনও প্রতারণার অপরাধে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। তখনকার ইংরেজদের দণ্ডনীতির সঙ্গে আমাদের দেশীয় দণ্ডনীতির গুরুতর পার্থক্যের ফলে সমাজে রীতিমতো বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়েছিল। মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি তার বড় দৃষ্টান্ত। রাধাচরণের ফাঁসির হুকুম হলে কলকাতার সম্ভ্রান্ত বাঙালি ও অবাঙালি বাসিন্দারা দণ্ড মকুব করার জন্য আবেদন করেছিলেন (২৯ জানুয়ারি ১৭৬৬)। আবেদনপত্রের ৯৫ জন স্বাক্ষরকারীর মধ্যে পূর্বের ভবানীচরণ ছাড়া বাকি ছ—জন ছিলেন ঠাকুর বংশের।১১ এঁদের মধ্যে নীলমণি বা দর্পনারায়ণ কারও নাম না—থাকাতে মনে হয় যে ঠাকুরগোষ্ঠীর মধ্যেই এই দুই ভাই প্রধান হয়ে ওঠেননি।
১৭৭৫—৭৬ সাল থেকে বিভিন্ন নথিপত্রে দর্পনারায়ণ ঠাকুরের প্রচুর উল্লেখ দেখা যায়। কলকাতায় ব্যবসায়ী মহলে তখন তিনি যে খুবই গণমান্য ব্যক্তি ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। নীলমণি ঠাকুর ব্যবসায়ী ছিলেন না, থাকলেও তাঁর ভাইয়ের মতো প্রতিষ্ঠা পাননি। মনে হয় সরকারি জমিদারি বিভাগে অথবা কোনও বাণিজ্যকুঠিতে তিনি বাঁধা মাইনের চাকরি করতেন। নগেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন যে নীলমণি সেরেস্তাদারের কাজ করতেন এবং ওড়িশায় থাকতেন। তা হতে পারে এইজন্য যে দর্পনারায়ণের সমসাময়িক দলিলে ব্যাবসাবাণিজ্য অথবা বিষয়সম্পত্তি কেনা—বেচার ব্যাপারে কোথাও নীলমণি ঠাকুরের নাম নেই। দর্পনারায়ণ কলকাতায় থেকে ব্যাবসাবাণিজ্য করতেন এবং নীলমণি বাইরে কোম্পানীর জমিদারিতে চাকরি করতেন, এ কথা সত্য বলেই মনে হয়।
বৈদেশিক বিভাগের নথিপত্রে দর্পনারায়ণ ঠাকুর—‘Who made his fortune as Dewan to Mr. Wheeler and in the Pay Office of that time’—বলা হয়েছে।১২ কিন্তু এইটুকু তাঁর যথেষ্ট পরিচয় নয়। কলকাতা ‘রেভিনিউ কমিটি’, ‘রেভিনিউ বোর্ড’ এবং সম্পত্তির ‘লিজ—ডিড’—এর দলিলপত্র থেকে তাঁর বিষয় যা জানা যায় তাতে মনে হয় রামদুলাল দে সরকার, মদন দত্ত প্রভৃতির মতো তিনি সেকালে অসাধারণ কর্মী পুরুষ ছিলেন। কোথাও তাঁকে বলা হয়েছে ‘বেনিয়ান’, কোথাও ‘merchant of Calcutta’, কোথাও বা নিমক ও বাজারের ইজারাদার ও জমিদারির পত্তনিদার। জানবাজার অঞ্চলে দর্পনারায়ণ অনেক ভূসম্পত্তি কিনেছিলেন, সেখানে বেশ বড় বাজার বসিয়েছিলেন।১৩ চব্বিশ পরগনার নিমকের এজেন্টদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।১৪ নদিয়ার কৃষ্ণনগরের মহারাজা শিবচন্দ্রকে একবার তিনি, বারাণসী ঘোষ ও রামশংকর হালদার মিলে বকেয়া সরকারি রাজস্ব পরিশোধ করার জন্য প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা ঋণ দিয়েছিলেন। সেই টাকা মহারাজা শিবচন্দ্র পরিশোধ করতে পারেননি বলে কমিটির কাছে তাঁরা আবেদন করেছিলেন যে তাঁর মাসোহারা থেকে মাসিক কিস্তিতে যেন ঋণ শোধ করার ব্যবস্থা করা হয় এবং কমিটি আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন।১৫ চব্বিশ পরগনার বড় বড় ইজারাদারদের জামিন হতে দর্পনারায়ণ, আর্থিক জগতে তাঁর এত সুনাম ও প্রতিপত্তি ছিল।১৬
এত বড় কর্মী পুরুষ যিনি ছিলেন তাঁকে শুধু হুইলার সাহেবের দেওয়ান ও পে—অফিসের কর্মচারী বলে পরিচয় দিলে কিছুই বলা হয় না। বিষয়সম্পত্তিও কলকাতায় তিনি যথেষ্ট কিনেছিলেন। রাধাবাজার, তালতলা বাজার প্রভৃতি অঞ্চলে তাঁর সম্পত্তিও ছড়িয়ে ছিল।১৭ এ ছাড়া পরগণা উত্তর শ্রীপুরে (রাজশাহি জমিদারির অধীন) বাৎসরিক ১৩,০০০ টাকা নিট আয়ের প্রায় ২৪৯ বর্গমাইলব্যাপী বিরাট জমিদারিও তিনি ৯১,৫০০ টাকায় কিনেছিলেন।১৮
দর্পনারায়ণ ঠাকুরের সাত পুত্রের মধ্যে গোপীমোহন ঠাকুরের বৈষয়িক বুদ্ধি পিতার মতনই প্রখর ছিল। তখনকার দিনে কলকাতার বৈঠকখানা বাজার, তালতলা বাজার, ধর্মতলা বাজার, জানবাজার, মেছুয়াবাজার, সুতানুটি বাজার, প্রভৃতি বাজারহাট ইজারা নেওয়া, কোম্পানির অনুমতি নিয়ে (বিনা অনুমতিতেও) নতুন হাটবাজার পত্তন করা, কলকাতা শহরের ধনবান লোকদের একটা বড় ব্যবসা ছিল। বাজার ইজারা নিয়ে অথবা পত্তন করে তাঁরা নানা রকমের দোকান প্রতিষ্ঠার ও জিনিসপত্র বেচাকেনার ব্যবস্থা করে দিতেন, কোম্পানির কর্তাদের একটা নির্দিষ্ট টাকা দিতে হত, বাকি যা আয় হত তা তাঁরা নিজেরা ভোগ করতেন। গোবিন্দরাম মিত্র ও মহারাজা নবকৃষ্ণ থেকে রাধাকান্ত দেব, দর্পনারায়ণ ও গোপীমোহন ঠাকুর, মদন দত্ত, বারাণসী ঘোষ এবং আরও অনেকে কলকাতার বাজার থেকে বিলক্ষণ অর্থ উপার্জন করেছেন। দর্পনারায়ণের জানবাজারের কথা বলেছি, গোপীমোহন নতুন চীনাবাজারের প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমান লায়ন্স রেঞ্জের উত্তর—পশ্চিম কোণে প্রায় ৫ বিঘে ১১ কাঠা ১২ ছটাক জমির উপর একদা (১৭৭৫ সালে) একটি রঙ্গালয় স্থাপিত হয়েছিল, যাকে ‘নিউ থিয়েটার’ বলা হত। পরে জনৈক রোওয়ার্থ সাহেব সেখানে একটি নিলেমকুঠি স্থাপন করেন। ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপনে (১৮০৮ সাল) দেখা যায় যে এই বিস্তৃত ভূসম্পত্তি গোপীমোহন ঠাকুর কিনে নিয়েছিলেন নতুন বাজার প্রতিষ্ঠার জন্য—‘Known by the name of the New China Bazar, most of the shop-keepers of the Old China Bazar having agreed to remove their shops to the above mentioned buildings… on which very large investments and various other valuable articles have been purchased.’ ১৮০৮ সালের ২০ নভেম্বর এই নতুন চীনাবাজার খোলা হবে বলে পত্রিকায় ‘নোটিশ’ দেওয়া হয়েছিল এবং জানানা হয়েছিল যে সেখানে ‘Europe and other articles of every description will be found for sale.১৯ গোপীমোহন এই চীনাবাজারের জন্য কতটা পরিমাণ মূলধন নিয়োগ করেছিলেন এবং কত টাকা মুনাফা করতেন তার হিসেব না—পাওয়া গেলেও কল্পনা করতে বাধা নেই।
নীলমণির ক—জন পুত্র ছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন রামলোচন, রামমণি ও রামবল্লভ নামে তাঁর তিন পুত্র ছিল (নগেন্দ্রনাথ বসু ও ফারেল)। কারও মতে তাঁর পাঁচ পুত্র ছিল—রামতনু, রামরতন, রামলোচন, রামমণি ও রামবল্লভ।২০ কলকাতার বিষয়সম্পত্তি কেনা—বেচার ব্যাপারে রামরতন ঠাকুরের নাম পুরাতন লিজ—ডিডের দলিলে দেখা যায়, কিন্তু তাঁর অন্য কোনও ভাইদের, অর্থাৎ নীলমণির অন্য কোনও পুত্রদের বৈষয়িক খবর কিছু পাওয়া যায় না।২১ এতে মনে হয় যে বৈষয়িক সমৃদ্ধির জন্য দর্পনারায়ণ নিজে ও তাঁর পুত্ররা অন্তত কলকাতা শহরে যতটা উদযোগী ছিলেন, নীলমণি বা তাঁর পুত্ররা তা ছিলেন না। নিমকের এজেন্সি, দেওয়ানি বা বেনিয়ানি, কলকাতার হাটবাজারের ইজারাদারি অথবা এই ধরনের কাজকর্ম করে যদি তাঁরা প্রতিষ্ঠা পেতেন তাহলে রেভিনিউ কমিটি বা রেভিনিউ বোর্ডের কাগজপত্রে কোথাও তাঁদের নামের উল্লেখ থাকত।
নীলমণি ওড়িশায় সেরেস্তাদারের চাকরি থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে কলকাতায় যথেষ্ট ভূসম্পত্তি কিনেছিলেন, এ কথা নগেন্দ্রনাথ বসু উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি কলকাতায় থাকতেন না বলে তাঁর ভাই দর্পনারায়ণকে পারিবারিক কর্তব্য পালন করতে হত। উপার্জিত অর্থ নীলমণি তাঁর ভাইয়ের কাছে কিছু গচ্ছিত রাখতেন। দুই ভাই এইভাবে যখন নিজেদের ধনভাণ্ডার পূর্ণ করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে তাঁরা এক পারিবারিক সংকটের সম্মুখীন হন। সংকটটা ঘনিয়ে ওঠে তাঁদের পরলোকগত ছোটভাই গোবিন্দরামের বিধবা পত্নী রামপ্রিয়া ঠাকুরাণির পৃথক হবার ইচ্ছা থেকে। সম্পত্তি বিভাগের জন্য তিনি সুপ্রিমকোর্টে নালিশ করেন। তার ফলে একান্নবর্তী ঠাকুর পরিবার তিনটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়, দর্পনারায়ণ ও নীলমণিও ভিন্ন হতে বাধ্য হন। পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ও পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী হন দর্পনারায়ণ, আর নীলমণি নিজের অংশের বদলে নগদ এক লক্ষ টাকা নিয়ে মিটমাট করে নেন। পৈতৃক বিগ্রহের মধ্যে দর্পনারায়ণ রাধাকান্তর সেবার ভার পান এবং নীলমণি লক্ষ্মীজনার্দন শিলার সেবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কলকাতার আদি বাসিন্দা শেঠ—বসাকদের বিস্তীর্ণ বাগান ছিল উত্তর কলকাতায়। এই বাগানকেই ‘জোড়াবাগান’ বলা হত। নতুন ভদ্রাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নীলমণি ঠাকুর শেঠ বংশীয় বিখ্যাত ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণের কাছ থেকে জোড়াসাঁকো অঞ্চলে বাসের জমি লক্ষ্মীজনার্দন শিলার নামে গ্রহণ করেন। ১৭৮৪ সালের জুন মাস থেকে জোড়াসাঁকোর ভদ্রাসনে নীলমণি—শাখার ঠাকুর পরিবারের বাসের সূত্রপাত হয়।২২ জোড়াসাঁকো অঞ্চল তখন মেছুয়াবাজারের অন্তর্গত ছিল, কিন্তু জোড়াসাঁকো নামটিও তার কম প্রাচীন নয়। গ্রাম্য জীবনকালেই এখানে পুষ্করিণী বা নালার উপর দিয়ে যাতায়াতের জন্য একজোড়া সাঁকো ছিল বলে স্থানীয় লোকের কাছে ‘জোড়াসাঁকো’ নামে তা পরিচিত ছিল। এই কারণে এরকম পরিচয় গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেক স্থানের আছে। উইলসনের বিবরণ থেকে মনে হয় যে শেঠদের যে পুরাতন বাগান ছিল এই অঞ্চলে তার নাম ছিল ‘জোড়া বাড়ি বাগ’। অর্থাৎ একজোড়া বাড়িসহ বাগান ছিল এবং তার জন্যই অঞ্চলটির নাম হয়েছিল ‘জোড়াবাগান’।২৩ ১৭৪২ সালে ফোর্ট উইলিয়ামের প্রেসিডেন্ট ও গভর্নরের কাছে সেনাবিভাগ থেকে একটি রিপোর্ট দাখিল করা হয় কলকাতা শহরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দৃঢ় করার জন্য। তাতে কলকাতার নগর এলাকার মধ্যে সাতটি অঞ্চলে কামান স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়। তার মধ্যে শেঠদের জোড়াবাগানে ছয় কামানের একটি ব্যাটারি স্থাপিত হয়। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কলকাতা শহরের কয়েকটি অতিপ্রাচীন মানচিত্র ও নকশা আছে। তার মধ্যে একটি নকশায় (Plan of Calcutta, by Forresti and Clifers, 1742) পঞ্চম ব্যাটারির উল্লেখ আছে ‘Batarie Zora Sako’ বলে। উইলসন বলেছেন, ‘It is placed at what is now the junction of the Chitpur Road with Ratan Sircar Street, near Lala Babu’s Bazar, below the Jora Sanko Police Station.’ এই উল্লেখ থেকে বোঝা যায় যে ১৭৪২ সালে তো বটেই, তার আগেও স্থানটির ‘জোড়াসাঁকো’ নাম খুব অপরিচিত ছিল না কলকাতার লোকের কাছে। ১৭৮০ সালের পর থেকে কলকাতার প্রাচীন পাট্টা—দলিলেও ‘Jurah Sankoo’ নামের ব্যবহার লক্ষ করা যায় (Deed No 1165, dated Ist February 1786)। নামটি নতুন হলে পাট্টা—দলিলে এইভাবে ব্যবহৃত হত না। ‘জোড়াবাগান’ নামে খ্যাত শেঠদের বাগান আঠারো শতকের আগে, এমনকী ইংরেজরা কলকাতায় কুঠিস্থাপনের আগে থেকেই যে প্রতিষ্ঠিত ছিল তার পরিষ্কার প্রমাণ আছে। ১৭০৭ সালে কৌন্সিলের সদস্যরা শেঠবাগানের খাজনা কমিয়ে দেন এই কারণে যে ‘they being possessed of the Ground which they made into Gardens before we had possession of the Towns.’২৪ কাজেই সপ্তদশ শতকের শেষদিকে শেঠ—বসাকরা যখন সুতানুটিতে সুতার হাট বসিয়ে ওই অঞ্চলে বসবাস করতে আরম্ভ করেছিলেন তার কিছু পর থেকে তাঁদের বাগানটিও গড়ে উঠেছিল। অষ্টাদশ শতকের গোড়া থেকে জোড়াবাগান ও জোড়াসাঁকো নাম কলকাতা শহরে পরিচিত হওয়া মোটেই আশ্চর্য নয়। তাহলে ‘জোড়াসাঁকো’ নামটি পঞ্চানন ঠাকুরের আমলেই পরিচিত হবার কথা এবং তার আঞ্চলিক পরিচিতি হয়তো দর্পনারায়ণ—নীলমণি শাখার ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠার পর শহরময় পরিব্যাপ্ত হয়েছিল।
কিন্তু জোড়াসাঁকোয় নতুন ভদ্রাসন প্রতিষ্ঠার পরেও নীলমণি ঠাকুর ও তাঁর পুত্রদের আমলে এই শাখার ঠাকুর পরিবারের খ্যাতি—প্রতিপত্তি যে কলকাতার সমাজে কত দূর বিস্তৃত ছিল তা বলা কঠিন। বৈদেশিক দপ্তরে বিবিধ বিষয়ের নথিপত্রের মধ্যে ‘Principal Hindoo Inhabitants of Calcutta’ নাম দিয়ে কতকগুলি পরিবারের বিবরণ দেওয়া হয়েছে (১৮৩৯ সাল)।২৫ তর মধ্যে শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণর পরিবার, রাজা সুখময় রায়ের পরিবার, মল্লিক পরিবার, পাইকপাড়ার গঙ্গাগোবিন্দ সিংহর পরিবার, দেওয়ান রামচন্দ্র রায়ের পরিবার, খিদিরপুরের গোকুল ঘোষাল ও জয়নারায়ণ ঘোষালের পরিবার এবং আরও অনেক পরিবার ও ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। এর মধ্যে ঠাকুর পরিবার সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা লক্ষণীয়, এখানে তা অবিকল উদ্ধৃত করছি :
Thakoors. This is an extensive and very rich family—the principal branch of it is that derived from Durpo Nerayun Thakoor who made his fortune as Dewan to Mr. Wheeler and in the Pay Office of that time. He had seven sons. Ram Mohun Thakoor (deceased), Gopee Mohun Thakoor, who died in 1816 after having long been at the head of the family to the great increase of its wealth—Krishna Mohun Thakoor (insane), Peearee Mohun Thakoor (born dumb and now dead), Huree Mohun Thakoor (living now in great respectability), Ladlee Mohun Thakoor. Do and Mohunee Mohun Thakoor who died a year or two ago leaving an infant child. Gopee Mohun left six sons, where of the eldest Soorj Koomar, Thakoor died childless shortly after, Chundur Koomar, Kalee Koomar, Nund Koomar, Hurro Koomar and Prosunno Koomar Thakoors now represent this branch.
ঠাকুর বংশেদ্দ এই বিবরণের মধ্যে নীলমণি ঠাকুরের পরিবারের কোনও পরিচয় নেই। পরে ‘List of the rich Bengalee Gentlemen of Calcutta’ বলে অঞ্চলভেদে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে প্রসন্নকুমার ঠাকুর, ললিতমোহন ঠাকুর (?), শ্যামলাল ঠাকুর ও কানাইলাল ঠাকুরের নাম ছাড়া আর কোনও ঠাকুরের নাম নেই। মেছুয়াবাজার অঞ্চলে দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম সন্নিবেশিত হয়েছে :
Muchhoowa Bazar, Dowarakanath Thakoor, son of Rammunee Thakoor.
জোড়াসাঁকো অঞ্চলে দেওয়ান শান্তিরাম সিংহর পৌত্রদের নাম, গৌরচরণ মল্লিকের পুত্র রূপলাল মল্লিক ও জমিদার শিবচরণ সান্যালের পুত্র মধুসূদন সান্যালের নাম আছে। নীলমণি—শাখার ঠাকুর পরিবারকে জোড়াসাঁকোর অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই শাখার শুধু দ্বারকানাথের নাম ছাড়া আর কোনও নাম নেই এবং দ্বারকানাথও মেছুয়াবাজার অঞ্চলভুক্ত একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। ১৮২৩ সালে দ্বারকানাথের গৃহপ্রবেশ উৎসবের যে খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয় তাতেও ‘জোড়াসাঁকো’ অঞ্চলের নাম নেই।
জোড়াসাঁকো সম্বন্ধে এত কথা বলার কারণ হল এই যে, নীলমণি শাখার ঠাকুর পরিবারের প্রসিদ্ধির সঙ্গে জোড়াসাঁকো যুক্ত হয়েছে অনেক পরে। ‘মেছুয়াবাজার’ বা ‘মেছোবাজার’ নামের কোনও ধ্বনিমাধুর্য নেই, শোভাবাজার শ্যামবাজার বাগবাজার রাধাবাজার বউবাজার বড়বাজার জানবাজার প্রভৃতি কলকাতার আরও অনেক বাজার—পদবিযুক্ত আঞ্চলিক নামের একটা যে সাধারণ শ্রী আছে, মেছুয়াবাজার তা থেকেও বঞ্চিত। স্থানমাহাত্ম্যের কতখানি যে নামমাহাত্ম্যের সঙ্গে জড়িত, ইতিহাসে সেটাও কম কৌতূহলের বিষয় নয়। মেছুয়াবাজার তার নিরাভরণ শ্রীহীন পরিচয়ের জন্য ঠাকুর পরিবারের কাছে উপেক্ষিত হয়েছে। মেছুয়াবাজারের দ্বারকানাথ জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ হয়েছেন, পুরাতন মেছুয়াবাজারের উত্তর—পূর্বাঞ্চল বহু পুরাতন জোড়াসাঁকোর মধ্যে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। দ্বারকানাথের সামাজিক প্রভাব—প্রতিপত্তির প্রবল টানে জোড়াসাঁকো নাম তার আঞ্চলিক সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে ক্রমে দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের আমলে দেশ থেকে দেশান্তরে পর্যন্ত বিস্তারলাভ করেছে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ও ঠাকুরপরিবারের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলতে হয় দ্বারকানাথ ঠাকুরকে।
দ্বারকানাথের জন্মের বছর তিন—চার আগে, ১৭৯০—৯১ সালে, নীলমণি ঠাকুরের মৃত্যু হয়। তিনি তাঁর পৌত্র ও বংশের অন্যতম কীর্তিমান পুরুষকে দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠপুত্র রামলোচন হন পরিবারের অভিভাবক। রামলোচনের পুত্রসন্তান ছিল না, তাই তিনি মধ্যমসহোদর রামমণির পুত্র দ্বারকানাথকে দত্তকপুত্ররূপে গ্রহণ করেন। ঘটনাটি নিয়ে পরে একটি কিংবদন্তিও রচিত হয়। একদিন এক সন্ন্যাসী রামলোচনের গৃহে ভিক্ষা করতে আসেন। রামলোচনের স্ত্রী ভিক্ষা নিয়ে এলে শিশু দ্বারকানাথকে খেলা করতে দেখে তিনি তাঁকে বলেন, ‘মা—এই শিশুটি তোমার খুব সুলক্ষণযুক্ত; এ তোমাদের বংশের গৌরব হবে, ধনদৌলত—মানসম্ভ্রম বাড়াবে, কৃতী ও যশস্বী পুরুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবে।’ সন্ন্যাসীর কথা শুনে স্বামীর সম্মতিক্রমে ১৭৯৯ সালে রামলোচন—পত্নী দেবরপুত্র দ্বারকানাথকে দত্তক গ্রহণ করেন। বোঝা যায়, দ্বারকানাথের সামাজিক প্রতিষ্ঠার পরে কিংবদন্তিটি রচিত হয়েছে এবং তার নায়ক হয়েছেন যথারীতি একজন ভিক্ষুক সন্ন্যাসী।
জ্যেষ্ঠতাত রামলোচনের স্বোপার্জিত সম্পত্তি ও পৈতৃক সম্পত্তির অংশ দ্বারকানাথ পেয়েছিলেন সত্য, আর্থিক অভাব—অনটনের মধ্যে তিনি মানুষ হননি। ঐশ্বর্যের মধ্যেই দ্বারকানাথ ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। পথের ধুলো থেকে তাঁকে কিছু গড়ে তুলতে হয়নি। কিন্তু কেবল এই ঐশ্বর্যের জোরে দ্বারকানাথ ‘প্রিন্স’ বলে পরিচিত হননি। ঠাকুর পরিবারের পঞ্চানন থেকে দর্পনারায়ণ—গোপীমোহন, নীলমণি—রামলোচনের ধারায় দ্বারকানাথ প্রথম নতুন পথ খুলে দেন। তাঁর বহুমুখী উদ্যম ও কর্মশক্তি সেই নতুন প্রবাহপথে বিচিত্র তরঙ্গের সৃষ্টি করে। পশ্চিম থেকে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত বহু জমিদারির মালিক হন তিনি, তাঁর পৌত্র রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে যেসব জমিদারির অপূর্ব প্রাকৃতিক বর্ণনা আছে। এইসব জমিদারি অধিকারের ও তত্ত্বাবধানের ইতিহাস বিচ্ছিন্ন সরকারি দলিলপত্রে টুকরো হয়ে রয়েছে। টুকরোগুলি জোড়া দিলে দ্বারকানাথের বিচিত্র কর্মপ্রতিভার একটা দিকের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। অথচ এ কথাও ঠিক যে সেকেলে জমিদার বলতে সমাজের একটি অন্ধকার কোণ থেকে যে ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে দ্বারকানাথ সেই শ্রেণির জমিদার ছিলেন না। প্রতাপের দিক থেকে নয়, চরিত্র ও প্রবৃত্তির দিক থেকে। প্রতাপ তাঁর হয়তো কোনও প্রবল প্রতাপশালী জমিদারের চাইতে কম ছিল না, কিন্তু মন তাঁর ‘বারোভুঁইয়াদের’ জমিদারির যুগ অতিক্রম করে নিঃসন্দেহে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল। মৃত স্বর্ণপিণ্ডের মতো অসাড় অচৈতন্য মূলধনকে (capital) তিনি মুক্ত বলাকার প্রাণাবেগে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন, ভূসম্পত্তির গর্ভে নিশ্চিন্তে সমাধিস্থ করতে চাননি। কিন্তু পরাধীন দেশের ঔপনিবেশিক পরিবেশে তা সম্ভব হয়নি। তাই দ্বারকানাথের মূলধন ইংরেজদের অভিশাপেই শেষ পর্যন্ত আবার মাটিতেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তবু তার বন্ধনমুক্তির ডানা—ঝাপটানি দেখলে হতবাক হয়ে যেতে হয়। নীলখেত আর নীলকুঠি থেকে আরম্ভ করে চিনির কারখানা, কয়লার খনি, বাষ্পীয় পোত, ব্যাঙ্ক, এজেন্সি হাউস, সংবাদপত্র, নাট্যশালা, সর্বত্র দ্বারকানাথ সাহস করে তাঁর মূলধন বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। পঞ্চানন ঠাকুরের ‘ক্যাপ্টেন পাকড়ানো’, জয়রাম ঠাকুরের আমিনী, দর্পনারায়ণ ঠাকুরের নিমকমহলের ও হাটবাজারের ইজারাদারি, নীলমণি ঠাকুরের সেরেস্তাদারি, গোপীমোহনের চীনাবাজার, রামলোচন—রামমণির স্থির বিষয়বুদ্ধি, সব একত্র করলে দ্বারকানাথের দুরন্ত উদ্যম ও অভিযানের কাছে তা হার মেনে যায়। দ্বারকানাথের জীবনটাকে মনে হয় একটা রূপকথার মতো। জীর্ণ দলিলপত্রের মধ্যে আজও তার অধিকাংশই চাপা পড়ে রয়েছে। যদি তা উদ্ধার করা যায় তাহলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বিচিত্রগামী প্রতিভার আসল উৎসের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।২৬
জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথের গৃহপ্রবেশ উৎসবে সেদিন ইংরেজ ও বাঙালির মিলন—মিশ্রণে প্রাচ্য—পাশ্চাত্যের মিলন সূচিত হয়েছিল। কেবল জোড়াসাঁকোয় নয়, বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতেও এই মিলনের উৎসব হত ঘন ঘন, দ্বারকানাথের উদারতা ও ঐশ্বর্যের প্রকাশে দেশ—বিদেশের মানুষ বিস্মিত হত। মনে হয় যেন দ্বারকানাথের নিজের জীবনটাও ছিল একজোড়া সাঁকোর মতো। একটি সাঁকো দিয়ে বাইরের বা পাশ্চাত্য ভাবধারা আচার প্রথা ভিতরে আসত, আর একটি সাঁকো দিয়ে স্বদেশের ভাবধারা ঐতিহ্য আচারপ্রথা বাইরে যেত। দুই সাঁকোর উপর দিয়েই গতি ছিল অবাধ। সহযোগী রামমোহনের মতো দ্বারকানাথও অস্তগামী মধ্যযুগ ও উদীয়মান নবযুগের সন্ধিক্ষণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের সংস্কৃতিধারার মধ্যে বিশাল একটি সাঁকোর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের উত্তরাধিকারীরা পরবর্তীকালে এই বিশ্ব ভারত—বাংলার সাংস্কৃতিক সাঁকোর বন্ধন আরও দৃঢ় করেছেন।
১৩৬৯। ১৯৬১
.
১. সম্পূর্ণ সংবাদটি এই : ‘নতুনগৃহ সঞ্চার।—মোং কলিকাতা ১১ দিসেম্বর ২৭ অগ্রহায়ণ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে শ্রীযুত বাবু দ্বারিকানাথ ঠাকুর স্বীয় নবীন বাটীতে অনেক ২ ভাগ্যবান সাহেব ও বিবীরদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইয়া চতুর্ব্বিধ ভোজনীয় দ্রব্য ভোজন করাইয়া পরিতৃপ্ত করিয়াছেন এবং ভোজনাবসানে ঐ ভবনে উত্তম গানে ও ইংলণ্ডীয় বাদ্য শ্রবণে ও নৃত্য দর্শনে সাহেবগণে অত্যন্ত আমোদ করিয়াছিলেন। পরে ভাঁড়েরা নানা শং করিয়াছিলেন কিন্তু তাহার মধ্যে একজন গো বেশ ধারণপূর্ব্বক ঘাস চর্ব্বণাদি করিল।’—সমাচার দর্পণ, ২০ ডিসেম্বর ১৮২৩। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় : সংবাদপত্রে সেকালের কথা, প্রথম খণ্ড, ১৩৮—৩৯ পৃষ্ঠা।
২. ঈশানচন্দ্র বসু : শ্রীমহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মজুমদার লাইব্রেরী, ১৯০২ সন; ১২৮ পৃষ্ঠা।
৩. নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থের ‘পিরালী ব্রাহ্মণ’ খণ্ড থেকে সংগৃহীত। এ বিষয়ে নগেন্দ্রনাথ বসুর সমস্ত মতামত ও উক্তি এই বই থেকে গৃহীত হয়েছে।
৪. C. R.Wilson: The Early Annals of the English in Bengal, vol. 1.
৫. Benoy Ghose: ‘Some Old family-founders in 18th century Calcutta. ‘The Setts of Sutanuti in Bengal: Past and Present; vol. LXXIX. Part 1, January-June 1960
৬. Fort William General, dated 31 December 1760 (MS Records)
৭. Letter to Court, January 10. 1758, para 110– ‘We have been obliged to remove all the Natives out of Govindpore, where the new citadel will stand, the brick houses having been valued in the most equitable manner, and when reported to the Board, will be paid for; those who dwelt in thatched houses have had a consideraion made them for the trouble and expense of removing, and have been allowed ground in other parts of the town and outskirts to settle in.’
৮. Proceedings, 1760 onwards, also Rev. Long’s Selections from Unpublished Records 1748-1767
৯. Consultations, September 18, 1758; Long: op, cit. p. 149
১০. Proceedings, July 31, 1760; Long: op, cit. p. 205
১১. Proceedings, January 29, 1766; Long: op. cit. p. 430
১২. Foreign Department Miscellaneous Records (MS), 1839, vol. 131
১৩. Calcutta Commitee of Revenue Proceedings, July 1871, Nos. 52, 74; September 1781, No. 16
১৪. Ibid. February 1776, p. 262; February 15, 1776, p. 510-11; June 21, 1776, p. 1490-92
১৫. Calcutta Committee of Revenue, Proceedings, January 24, 1782 Nos. 3,4 pp. 214-17
১৬. Ibid, December 1777 p. 246
১৭. Leases and Deeds, vols. II and III, No. 627, 26 and 27 August 1783; No. 709, 1784
১৮. James, W. Furrell: The Tagore Family,—A Memoir, London, 1882, pp. 62-63
১৯. Calcutta Gazette, 1st November 1808
২০. Loke Nath Ghose: The Modern History of the Indian Chiefs. Rajas, Zamindars etc. Part II, Calcutta, 1881—‘The Tagore Family’, pp. 160-223
২১. Leased and Deeds, vol. 1, No. 144, 16 January 1781
২২. নগেন্দ্রনাথ বসুর পূর্বোক্ত গ্রন্থ
২৩. Wilson: Early Annals etc, vol. 1. pp. 158-9
২৪. Consultations, II September 1707
২৫. Foreign Department Miscellaneous Records, 1839. vol. 131 (National Archives, New Delhi)
২৬. কিশোরীচাঁদ মিত্রর লেখা ইংরেজিতে দ্বারকানাথ ঠাকুরের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী আছে—Memoir of Dwarakanath Tagore, Calcutta 1870, দ্বারকানাথের আসল কর্মজীবন ও কীর্তিকথার বিবরণ বিশেষ কিছু এই গ্রন্থে সংকলিত হয়নি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অপ্রকাশিত চিঠি থেকে মনে হয়, দ্বারকানাথের এই টুকরো জীবনকথা কিশোরীচাঁদ লিখেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অনুরোধে। হাতের কাছে পারিবারিক সংগ্রহে দ্বারকানাথ সম্বন্ধে যেসব কাগজপত্র ও স্মৃতিচিহ্ন ছিল দেবেন্দ্রনাথ সেইগুলি কিশোরীচাঁদকে দিয়েছিলেন এবং লেখার জন্য পারিশ্রমিক দিতেও সম্মত হয়েছিলেন। কিশোরীচাঁদ নিজে এ বিষয়ে তথ্যাদি অনুসন্ধান করেছিলেন বলে মনে হয় না। সেই কারণে তাঁর লেখা জীবনীটি কতকগুলি প্রশংসাপত্রের সমষ্টি হয়েছে মাত্র, দ্বারকানাথের প্রকৃত জীবনবৃত্তান্ত হয়নি।
লোকনাথ ঘোষের ‘Indian Chiefs, Rajas, Zamindars, etc.’ বইখানি (দুই খণ্ড) এবং Furrell-এর লেখা ‘The Tagore Family’ কলকাতা ও লন্ডন থেকে একই সময়ে (১৮৮১—৮২ সালে) প্রকাশিত হয়। ঘোষ ও ফারেল উভয়েই কিশোরীচাঁদ সম্বল করার ফলে ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসে অনেক ফাঁক থেকে গিয়েছে এবং ভুলভ্রান্তিও আছে। সংশোধন ও সুসম্পূর্ণ করার উপায় হল সরকারি নথিপত্র সমসাময়িক পত্রিকাদি তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন