বিনয় ঘোষ
সামাজিক ইতিহাস রচনায় যাঁরা সিদ্ধহস্ত তাঁদের মধ্যে ইংরেজ ঐতিহাসিক ট্রেভেলিয়ান অন্যতম। এক্ষেত্রে জিন হেখট একেবারে নবাগত না হলেও অভিজ্ঞতায় নবীন। তাঁর অনুসন্ধানী মনের নবীনতা বিস্ময়কর। সমাজের অনাদৃত আনাচকানাচ থেকে এমন সব উপকরণ তিনি সংগ্রহ করতে পারেন, ঐতিহাসিকের কাছে যা অমূল্য সম্পদ। সেই ধরনের উপকরণ আহরণ করে জিন হেখট সম্প্রতি যে ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংলন্ডের গৃহভৃত্যশ্রেণি’র ইতিহাস রচনা করেছেন, তা সমাজেতিহাস—সাহিত্যের সম্ভার নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করবে।
ট্রেভেলিয়ান তাঁর বিখ্যাত বইয়ের* ভূমিকায় সামাজিক ইতিহাস রচনার লক্ষ্য, পদ্ধতি, উপকরণ সন্ধান, নির্বাচন ও বিশ্লেষণ সম্বন্ধে যেসব কথা বলেছেন, তা আলোচ্য বই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। তিনি বলেছেন, সামাজিক ইতিহাসের ‘নেগেটিভ’ সংজ্ঞা হল, যা রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, তা—ই সামাজিক ইতিহাস। তারপর কথাটাকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, কোন জাতির ইতিহাস থেকে রাজনীতি বর্জন করা অবশ্য শক্ত, কিন্তু জাতির ইতিহাসের নামে সমাজবর্জিত রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত এত বেশি রচনা করা হয়েছে যে এখন তার অভাবপূরণের জন্য বিপরীত পদ্ধতি অবলম্বন করাও দোষের নয়। আমাদের জীবদ্দশায় তৃতীয় আর এক ধরনের ইতিহাস—রচনার প্রচলন হয়েছে তার নাম অর্থনৈতিক ইতিহাস। তার ফলে অবশ্য সামাজিক ইতিহাস—রচনার সুবিধা হয়েছে যথেষ্ট। কারণ বিশেষ অবস্থার মধ্য থেকেই বিশেষ বিশেষ সামাজিক জীবনযাত্রার উদ্ভব হয় এবং সেই বিশেষ সমাজজীবন থেকে রাজনৈতিক ঘটনাবলির উৎপত্তি হয়। তা সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার্য যে, সমাজেতিহাস ভিন্ন অর্থনৈতিক ইতিহাসের বন্ধ্যাত্ব ঘোচে না এবং রাজনৈতিক ইতিহাস জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু কেবল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করাই সামাজিক ইতিহাসের লক্ষ্য নয়। তার নিজস্ব কর্তব্যও কম নয়। অতীতকালের লোকজন কীভাবে প্রাত্যহিক জীবনযাপন করত, কী চিন্তা করত, কল্পনা করত, ধর্ম শিক্ষা সাহিত্য সংগীত শিল্পকলা ইত্যাদির ভিতর দিয়ে কেমনভাবে তাদের সংস্কৃতি প্রকাশ হত—এসব বিষয় সামাজিক ইতিহাসের অন্তর্গত। কিন্তু অতীতের এসব কথা জানা কত কঠিন। ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদরা প্রাচীন দলিলপত্র, চিঠিপত্র, পত্রিকা ইত্যাদি ঘেঁটে অতীতের কত অজানা তথ্য পুনরুদ্ধার করেছেন। কেবল এইগুলি পাঠ করতে যে—কোনও লোকেরসারাটা জীবন কেটে যেতে পারে। তারপরেও মনে হয়, এসব তথ্যও যথেষ্ট নয়। যদি লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রত্যেকের জীবনকাহিনি জানা যেত, তাহলে সামাজিক ইতিহাস—রচনার সুবিধা হত। তা যখন জানবার উপায় নেই তখন সমাজেতিহাস রচয়িতার কয়েকটি বিশেষ নির্বাচিত বিষয়ের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। সমগ্র সামাজিক সত্যের সম্পূর্ণ জটিলতা তাতে প্রকাশ পেতে পারে না। কিন্তু তা ছাড়া পথও নেই। ট্রেভেলিয়ানের নিজস্ব উক্তি হল :
The generalisation which are the stock-in-trade of the social historian, must necessarily be based on a small number of particular instances, which are assumed to be typical, but which cannot be the whole of the complicated truth.
এ উক্তির অর্থ সমাজেতিহাস অনুসন্ধিৎসুদের অনুধ্যেয়। সুনির্বাচিত তথ্য ও ‘টিপিক্যাল’ তথ্য গ্রন্থন ভিন্ন সামাজিক তথ্যের অগাধ সমুদ্রে ঐতিহাসিকের লক্ষ্যতরি দিগভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা। একশ্রেণির ঐতিহাসিক আছেন, তথ্যের যান্ত্রিক ক্যাটালগিং যাঁরা পবিত্র কর্তব্য মনে করেন। দিগনির্ণয়ের অথবা সূত্রায়ণের পক্ষপাতী নন তাঁরা। আমাদের দেশে এখনও ঐতিহাসিক এষণা চর্বিত তথ্যচর্বণের এই আদিম স্তরে নিবদ্ধ।
At bottom, I think, the appeal of history is imaginative. Our imagination craves to behold our ancestors as they really were, going about their daily business and daily pleasure. Carlyle called the antiauarian or historical researcher ‘Dryasdust’. Dryasdust at bottom is a poet.
ট্রেভেলিয়ানের এউক্তি অবিস্মরণীয়। ধূলিরুক্ষ তথ্যান্বেষী যদি কবি—কল্পনাবর্জিত হন, তাহলে সামাজিক ইতিহাস—রচনার স্পৃহা তাঁর ত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়। জিন হেখট ‘ড্রাই অ্যাজ—ডাস্ট’ অন্বেষক হয়েও কবিধর্মী। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ সমাজ থেকে তাই এমন একটি ‘টিপিক্যাল’ বিষয় তিনি নির্বাচন করেছেন, যা আপাতদৃষ্টিতে নগণ্য হলেও তখনকার জীবনযাত্রার বহু আবছা—অজানা দিকগুলিতে অপ্রত্যাশিত আলোকসম্পাত করতে সক্ষম হয়েছে। সমাজেতিহাসের অন্বেষণক্ষেত্রের সাংস্থানিক চিত্র যে কত জটিল এবং অনৃজু রেখায়নে পরিক্ষিপ্ত, জিন হেখটের আলোচ্য গ্রন্থপাঠে তার আভাস পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংলন্ডের গৃহভৃত্যশ্রেণির জীবনেতিহাস, তাৎকালিক সমাজের সর্বশ্রেণির ও সর্বস্তরের মানুষের জীবনকে নানাদিক থেকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। শুধু তা—ই নয়, তার বিশ্লেষণরশ্মির তীব্র বিচ্ছুরণে সাম্প্রতিক সমাজের অস্থিবিন্যাসের আকালিকতা বা অ্যানাক্রনিজম পর্যন্ত ধরা পড়েছে। এইখানেই তাঁর সমাজেতিহাস রচনার প্রয়াস সার্থক হয়েছে মনে হয়।
সামাজিক ইতিহাস—রচয়িতার তল্লাশযোগ্য তথ্যকন্দরের মধ্যে প্রধান হল দিনপঞ্জি স্মৃতিকথা চিঠিপত্র, প্রাচীন পত্রিকা ও সংবাদপত্র, ভ্রমণবৃত্তান্ত ও সাহিত্য। জিন হেখট সব ক—টি কন্দর থেকেই পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ‘ভূমিকা’য় তিনি বলেছেন—
A good deal of the material employed in the study has been extracted from the usual quarries of the social historian: diaries, memoirs, letters, magazines, newspapers, the accounts of travellers, and literary works. Much has also been taken from pamphlets and treaties on social and economic problems of the day. And of course, a wealth of data has ben drawn from contemporary works on service, servants and household management.
প্রথম অধ্যায়ে হেখ্ট ভৃত্যদের ‘চাহিদা’ ও ‘সরবরাহ’ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংলন্ডে বিভিন্ন চাকুরিজীবী শ্রেণির মধ্যে ভৃত্যশ্রেণী বৃহত্তম শ্রেণি ছিল। মধ্যযুগ তখন অস্তমিত, তা সত্ত্বেও গৃহভৃত্যের সংখ্যাবৃদ্ধির কারণ কী? এই সময় ইংলন্ডের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার যে অতিদ্রুত পরিবর্তন হয়, তার ফলেই ভৃত্যশ্রেণির চাহিদা বাড়তে থাকে এবং চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ ক্রমে বৃদ্ধি পায়। শিল্প—বাণিজ্যের বিস্তারের ফলে সমাজে মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশ হয়। একদা যারা অখ্যাত ও অজ্ঞাত ছিল সমাজে, অর্থোপার্জনের নানারকম স্বাধীন সুযোগ পেয়ে তারা নিজেদের শ্রেণিমর্যাদা স্থাপনে সক্ষম হয়। নতুন নতুন ধনিক অভিজাত বংশে গড়ে ওঠে। নতুন ঘরবাড়ি, নতুন পরিবারের সংখ্যা বাড়ে। বাণিজ্যযুগের নতুন সংগতিপন্ন বণিকশ্রেণি আভিজাত্যের প্রতিযোগিতায় সেকালের লর্ড ডিউকদের হার মানাতে চান। তাঁদের জন্য বিলাসিতার সমস্ত উপকরণের চাহিদা বেড়ে যায়। এইসব উপকরণের মধ্যে ঘরবাড়ি আসবাবপত্তর পোশাক—পরিচ্ছদের মতো চাকর—চাকরানিও অপরিহার্য। নতুন ধনিক, বণিক ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বিলাসিতার বাসনা চরিতার্থের জন্য চাকরশ্রেণির চাহিদা অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বাড়তে থাকে। দু—দিকের চাপেই বাড়তে থাকে। এদিকে নতুন অভিজাতশ্রেণি জাঁকজমকের বাহুল্যের জন্য যেমন লালায়িত হয়ে ওঠেন, তেমনি ওদিকে বনেদি অভিজাত যাঁরা, তাঁরা মধ্যবিত্তশ্রণির ‘চ্যালেঞ্জ’ নিজেদের অপস্রিয়মাণ সামাজিক মর্যাদারক্ষার জন্য আরও বেশি সচেতন হন। সামর্থ্যের অতীত হলেও, চাকর পোশার প্রয়োজন তাঁরা আরও বেশি করে অনুভব করতে থাকেন। শিল্প—বাণিজ্যযুগের নতুন সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে, উদীয়মান ও অস্তমান অভিজাতশ্রেণির এই মর্যাদার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে, দুই শ্রেণির পক্ষ থেকেই চাকরশ্রেণির চাহিদা অসম্ভব বেড়ে যায়। মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে তাই চাকুরিজীবীদের মধ্যে গৃহভৃত্যরাই প্রধান হয়ে ওঠে।
যে পরিবারে চাকর—চাকরাণীর সংখ্যা যত বেশি, সেই পরিবারের মর্যাদা তত বেশি। চাকরই পরিবারে মর্যাদার প্রামাণ্য মানদণ্ড। স্কুলের ছাত্রছাত্রী বালক—বালিকারাও সে সম্বন্ধে সচেতন। জনৈক পাদরিসাহেবের কন্যা তাঁর বাল্যজীবনের স্মৃতিকথায় লিখেছেন :
I was interrogated by many of the young ladies as to the station of my father, or rather respecting the figure he made in the world. ‘Does your papa keep a coach?’—‘No’.—‘How many servants have you?’—‘Four’—‘Dear; only think Miss’s papa does not keep a coach, and they have only four servants.’
(Memoirs of the Life of the Late Mrs. Catherine Cappe,
1824, p. 40, quoted by Hecht)
মধ্যযুগের লর্ডদের তুলনায় নবযুগের উচ্চশ্রেণির চাকরের বিলাসিতা অবশ্য অনেক কম ছিল। তখন লর্ডদের পরিবারে শতাধিক ভৃত্যপোষণ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যকালে ওয়ারিকের আলী ৬০০ জন চাপরাশি নিয়ে পার্লামেন্টে যেতেন। তাঁর চেয়ে ক্ষুদ্রতর জীব, কেন্ডলের ডেপুটি—স্টুআর্ড যেতেন ২৯০ জন চাপরাশি নিয়ে। ক্রমে এই চাকরের সংখ্যা এইসব পরিবারে কমতে থাকে। ষোড়শ শতাব্দীতে গড়পড়তায় শ—খানেক দাঁড়ায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে আরও কমে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দেখা যায় পরিবারপ্রতি ভৃত্যসংখ্যা চল্লিশ—পঞ্চাশজন এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পরিবারের আয়তনহ্রাসের সঙ্গে তুলনা করলে এ সংখ্যাও যথেষ্ট বেশি। জিন হেখট অনেক পরিবারের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে দশ থেকে পনেরো—কুড়িজন ভৃত্য প্রতিপালিত হত। পরিবার ও ভৃত্যসংখ্যার তালিকা দিয়ে হেখট তা ভালো করেই প্রমাণ করেছেন।
প্রত্যক্ষ তথ্যাশ্রিত বিশ্লেষণ ছাড়াও হেখট সমাজবিজ্ঞানের প্রত্যয় প্রয়োগ করে সমস্যাটি বিচার করবার চেষ্টা করেছেন। যেমন নাগরিক সমাজে, লন্ডনের মতো বর্ধিষ্ণু শহরে, ভৃত্যসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন যে ব্যক্তিগত সম্পর্কশূন্য সমাজে বাহ্যরূপের পরিচয়টাই প্রধান হয়ে ওঠে। নাগরিক সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তার নৈর্ব্যক্তিকতা। মধ্যযুগের গ্রাম্য সমাজের প্রত্যক্ষ ব্যক্তিসম্পর্ক ও কুলগত পরিচয়ের বন্ধন অনেক দৃঢ় ছিল। সেখানে বাহ্য আড়ম্বরের প্রয়োজন হত বিলাসিতার জন্য বা পদমর্যাদার জন্য, আত্মপরিচয়ের জন্য নয়। নাগরিক সমাজে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে সকলেই অজ্ঞাতকুলশীল। কৌলিক পরিচয়ের মূল্য সেখানে অল্প ও সতত পরিবর্তনশীল। বস্তুত, নৈর্ব্যক্তিক নাগরিক সমাজে নৈকষ্য কৌলীন্যের দাবি তাঁদেরই গ্রাহ্য হয় যাঁদের বাইরের বিত্তসমারোহ যত বেশি। সুতরাং নতুন শহরে আভিজাত্য ও ভদ্রতার উপচারবৃদ্ধি হওয়া স্বাভাবিক। আত্মমর্যাদা ঘোষণার তাগিদে লন্ডনের মতো শহরে তাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভৃত্যশ্রেণির কলেবর স্ফীত হয়েছিল। মধ্যযুগের বড় বড় বনেদি যৌথ পরিবার ভেঙে ক্ষুদ্রায়তন হলেও এবং তার পোষ্য ভৃত্যসংখ্যা পূর্বের তুলনায় কমে গেলেও, সমাজের নতুন শ্রেণিবিন্যাসে যেহেতু বিত্তবান শিল্পপতি, বণিকশ্রেণি ও মধ্যবিত্তের সংখ্যা প্রাধান্য বাড়ছিল, সংগতিপন্ন পরিবারের সংখ্যাবৃদ্ধি হচ্ছিল, সেইহেতু চাকর—চাকরাণির মোট সংখ্যাও চাহিদানুপাতে ক্রমে বেড়ে যাচ্ছিল। এই সময় তাই সর্বশ্রেণির চাকুরিজীবীর মধ্যে চাকররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণিভুক্ত হয়েছিল।
ভৃত্যশ্রেণির চাহিদাবৃদ্ধির সামাজিক কারণ বিশ্লেষণ করে জিন হেখট তার সরবরাহের কেন্দ্রগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। আলোচ্য গ্রন্থের এই অংশটুকু, পুরাতন সমাজের ভাঙন ও নতুন সমাজের গড়নের ইতিহাসের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। ঐতিহাসিক অন্তর্দৃষ্টি যাঁদের আছে তাঁরা ইতিহাসের ভাঙা—গড়ায় অন্তর্নিহিত এই ছন্দটিকে আবিষ্কার না করে তৃপ্ত হন না। তা না করতে পারলে, স্তূপীকৃত তথ্যের পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করবার পরেও চারিদিকে চেয়ে কেবল অর্থহীন শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। জিন হেখট প্রধানত সমাজবিজ্ঞানী, তাই তিনি এই ধরনের শূন্যবাদী ইতিহাসচর্চার সার্থকতা হৃদয়ঙ্গম করতে অক্ষম। আলোচনার প্রত্যেক স্তরে তথ্যানুগ হয়েও তিনি তার প্রমাণ দিয়েছেন যথেষ্ট।
সমাজের কোন স্তর থেকে এই ভৃত্যশ্রেণির উৎপত্তি হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে হেখট দেখেছেন যে গ্রামের কৃষকশ্রণির স্তর থেকেই চাকর—চাকরাণির আমদানি হত বেশি। তার মধ্যে চাষিদের ছেলেমেয়ে ও খেতমজুররাই প্রধান। গ্রামের ভূস্বামীরা নিজেদের জমিদারির অধীন চাষি—প্রজাদের ভিতর থেকে চাকর—চাকরাণি রিক্রুট করতেন, কারণ তাতে ভৃত্যদের বশ্যতা ও প্রভুভক্তি সম্বন্ধে তাঁরা অনেক বেশি নিরুদবিগ্ন হতে পারতেন। খুদে জমিদার, অর্থাৎ এখানকার গাঁতিদার—জোতদারদের সমকক্ষ যাঁরা, তাঁরা অনেক সময় আশপাশের কোনও বড় জমিদারি থেকে ভৃত্য নিয়োগ করতেন, দূরাঞ্চলের লোক পছন্দ করতেন না। তারও কারণ ছিল ওই নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা। লক্ষণীয় হল গ্রামের এই শ্রেণির লোক যারা চাকরের পেশা গ্রহণ করত, সাধারণত তারা গ্রামাঞ্চলে থাকতে চাইত না, শহরে আসতে চাইত। শহরের ভৃত্য—পালকরাও গ্রামের ভৃত্য নিয়োগ করতে চাইতেন, তার কারণ শহরের ভৃত্যদের কুকর্মপ্রবণতায় তাঁরা বিচলিত হতেন। তা সত্ত্বেও অবশ্য অভিজ্ঞ শহুরে চাকরদের বিশেষ কর্মদক্ষতার জন্য চাকরির অভাব হত না। মুখ্য ভৃত্যের কাজ গ্রাম্যরা পেতেন না, শহুরে চাকরের অধীনে ছোট পদে বহাল হয়ে তাঁদের কাজ করতে হত।
গ্রাম্য ভৃত্যরা গ্রামে না থেকে শহরে আসতে চাইত একাধিক কারণে। শহরের আকর্ষণ গ্রামের তুলনায় নিঃসন্দেহে বেশি ছিল এবং তার বৈচিত্র্যও ছিল। শহরের বেতন, সুখস্বাচ্ছন্দ্য, জীবনযাত্রা ভৃত্যশ্রেণিরও কাম্য হওয়া স্বাভাবিক। শহরের ভৃত্যরা ছুটির দিনে গ্রামে ফিরে গিয়ে এইসব নাগরিক সুখের কথা গ্রাম্য মজলিশে বর্ণনা করত। গ্রাম্য ভৃত্যদের নগরাকর্ষণ আরও তীব্র হত তাতে। সমসাময়িক একজন লেখক এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে :
The plough-boys, cow herds, and lower-hinds, are debauched by the appearance and discourse of those coxcombs in livery, when they make their summer excursions. They desert their dirt and drudgery, and swarm up to London, in hopes of getting into service, where they can live luxuriously and wear fine clothes.
(Somollet’s Humphry Clinker, Works, VII, 108,
quoted by Hecht)
এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের নতুন ‘এনক্লোজার’ নীতিও ভাসমান ভৃত্যশ্রেণির সংখ্যাবৃদ্ধির কারণ হয়েছিল। পুরাতন গ্রাম্য সমাজের ভিত ভেঙে দিয়েছিল এনক্লোজার নীতি। ভূসম্পত্তির অখণ্ডতা প্রতিষ্ঠার জন্য এই যে এক—এলাকাভুক্তির অভিযান, এর আঘাত স্বল্পবিত্ত দরিদ্র খণ্ডভূমির মালিক প্রজাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। তারা কৃষিজীবী থেকে শ্রম জীবীশ্রেণিতে রূপান্তরিত হল। একীকরণের ফলে যেখানে আবাদি জমি চারণভূমিতে পরিণত হল (পশম—ব্যবসায়ীদের ভেড়ার পালের জন্য), সেখানে গ্রাম—কে—গ্রাম উৎসন্নে গেল। গ্রামবাসীরা নগরাভিমুখী হতে বাধ্য হল। নতুন নগরে কারখানার মজুরের চাইতেও তখন গৃহভৃত্যের চাহিদা বেশি। কারখানা বসছিল, কিন্তু তার চাইতে আরও দ্রুত হারে মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা বাড়ছিল। সুতরাং মজুরশ্রেণির তুলনায় ভৃত্যশ্রেণির সংখ্যাবৃদ্ধি হচ্ছিল লন্ডনে ও তার আশপাশে। নবযুগের সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রথম পর্যায়ের এই বৈশিষ্ট্যটি জিন হেখট সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। শ্রমশিল্পের ও কলকারখানার ক্রমিক প্রসারের ফলে ভৃত্যশ্রেণি ধীরে ধীরে শ্রমজীবী শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। পরবর্তীকালে তার জন্য পরিবারে ভৃত্যসংকট দেখা দিয়েছে। কিন্তু সে অনেক পরের কথা, ইংলন্ডে উনিশ শতকের প্রথম পাদে শিল্পবিপ্লব সার্থক হলেও, শেষ পাদ থেকে এই লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে যেমন সম্প্রতি নাগরিক পরিবারে, একই কারণে, এই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে।
কেবল কৃষকশ্রেণির স্তর থেকেই ভৃত্যের আমদানি হত না, গ্রামের কারুশিল্পী, দোকানদার ও কারিগরদের মধ্য থেকেও যথেষ্ট পরিমাণে হত। এ সম্বন্ধে হেখ্ট তথ্যপ্রমাণসহ উক্তি করেছেন :
In addition to the agrarian population the artisan class of the rural regions also contributed to the supply of domestics…In London, too, and in the smaller towns, the children of craftsmen and manufacturers were taken as domestics. Thus, arguing in 1763 that certain industries were undermanned, an essayist lamented the diversion of young hands from productive work : (London Chronicle, 1773 XIII, quoted by Hecht) :
নাগরিক আকর্ষণ এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে গ্রাম্য পেশার বংশানুক্রমিক বন্ধন ছিন্ন করেও শিল্পী—কারিগরদের মন নগরাভিমুখে ধাবমান হত। কেবল নাগরিক বিলাসিতার ও স্বাচ্ছন্দ্যের বৈচিত্র্যই যে একমাত্র আকর্ষণ ছিল তা নয়, তার চাইতে আরও অনেক বড় আকর্ষণ ছিল নতুন নাগরিক সমাজের আন্তঃশ্রেণিক গতিশীলতা (ইন্টারক্লাস মোবিলিটি)। গ্রাম্য শ্রেণিবিন্যাস নিশ্চল, নাগরিক শ্রেণিবিন্যাস সচল। গ্রাম্য কর্মকারের গ্রাম্য সমাজের শীর্ষস্তরে আরোহণ করার কোনও সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই। নাগরিক সমাজে সে স্বচ্ছন্দে জীবনসংগ্রামের সাফল্যের জোরে শীর্ষস্তরে উঠতে পারে। নগরজীবনের এই বন্ধনহীন গতিশীলতাই ছিল প্রধান আকর্ষণ, যার জন্য কেবল কৃষিজীবীরা নয়, শিল্পজীবীরাও নগরে এসে ভিড় করত এবং প্রথমে ভৃত্যশ্রেণিভুক্ত হয়ে নগরবাসের ব্যবস্থা করত।
নানা রকমের গ্রাম্য মেলায় ও হাটবাজারে কীভাবে চাকুরিপ্রার্থী চাকর—চাকরানিদের সমাবেশ হত, জিন হেখ্ট তারও সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। পরিবারের কর্তারা এইসময় মেলায় ও বাজারে গিয়ে, দরদস্তুর করে, চরিত্রপথ দেখে, ভৃত্য পছন্দ করতেন। শহরের কাছাকাছি সরাইখানাতেও ভৃত্যরা এসে জমা হত। গ্রাম্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আসত তারা এবং শহরবাসীরা সরাইয়ের মালিকের কথায় তাদের কাজে নিয়োগ করতেন। রেজিস্ট্রার আপিসও ছিল ভৃত্যদের জন্য। মালিক ও ভৃত্যরা উভয়েই ‘ফি’ দিয়ে নাম লিখিয়ে রাখত এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ভৃত্য মালিক পেত, মালিকও ভৃত্য পেত। এইসব নিয়োগকেন্দ্র দুর্নীতির প্রশ্রয়ও দিত যথেষ্ট। গ্রাম্য মেয়েরা, যারা চাকরানির কাজের সন্ধানে আসত শহরে, তাদের জাল মালিকের হাত দিয়ে নগরের বারাঙ্গনাপল্লিতে চালান করারও কোনও অসুবিধা হত না।
ভৃত্য শ্রেণির চাহিদা ও সরবরাহ সমস্যার নানাদিক সম্বন্ধে আলোচনা করে, হেখট পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে যথাক্রমে ভৃত্যদের পদবিন্যাস, ‘প্রভু—ভৃত্যের সম্পর্ক’, ‘ভৃত্যদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য’, ‘আমোদপ্রমোদ অবসর’, ‘আর্থিক পুরস্কার’ ও ‘সামাজিক অগ্রগতি’ সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। কেবল জ্ঞাতব্য তথ্যের দিক থেকে নয়, সামাজিক ইতিহাসের ধারা—বিশ্লেষণের অপূর্ব নৈপুণ্যের দিক থেকে প্রত্যেকটি অধ্যায় বারংবার পঠিতব্য। এত তথ্য এবং তথ্যান্তর্গত ভাবসম্পদ এত সমৃদ্ধ যে সমালোচনার স্বল্প পরিসরে তার আভাস দেওয়াও দুরূহ।
গ্রন্থের শেষ অধ্যায়টি সবচেয়ে আকর্ষণীয় বলে আমার মনে হয়েছে। এই অধ্যায়ে জিন হেখট প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন, কীভাবে এই ভৃত্যশ্রেণি তখনকার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও স্তরের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগসূত্র স্থাপন করতে সাহায্য করেছে। দেবতার বাহনের মতো সমাজের উচ্চশ্রেণির বাহন হয়ে, নিজেদের অনুচীকির্ষার জন্য, ভৃত্যরা প্রভুদের ‘মডেল’ হয়ে সমাজে চলতে চেয়েছে। সে বাসনা হাস্যকর হলেও অদম্য এবং তার প্রকাশও অপ্রতিরোধ্য। উচ্চশ্রেণিই সমাজে সংস্কৃতির ধারক, কিন্তু তার বাহক সেই শ্রেণি—বহির্ভূত সাধারণ মানুষ। ভৃত্যশ্রেণি এই বাহকদের মধ্যে একসময় নাগরিক সমাজে অগ্রগণ্য ছিল। উপরতলার আচরিত সংস্কারের পরিচয় নিচের তলায় তারা বহন করে আনত এবং সাংস্কৃতিক প্রসার ও লেনদেনের পথ প্রশস্ত করে দিত। কীভাবে করত?
In one way or another, then the subordinate classes gained a certain familiarity with the manners of elite; and for the most part, they sought to imitate as closely as possible. This was natural. In virtually all societies that possess social solidarity the highest social strata tend to be taken as medels by the strata beneath. Imitation may not be carried very far; in fact, where there are specific tabus against it, or where there are wide fissures in the social structure, it may scarcely occur at all. Nevertheless, the tendency normally exists, and in eighteenth century England it existed under optimum conditions (pp. 203-204)
হেখ্টের এই গুরুত্বপূর্ণ উক্তি প্রণিধানযোগ্য। সংস্কৃতির বাহক হিসেবে ভৃত্যশ্রেণি সমাজের উপরের স্তর থেকে সাধারণ স্তরে, কোন জাতীয় উপাদান বহন করে নিয়ে যেতে পারে, সে সম্বন্ধে অনেকে কৌতূহলী হতে পারেন। তথ্যপ্রমাণসহ জিন হেখ্ট এ সম্বন্ধে উত্তর দিয়েছেন যে, পোশাক—পরিচ্ছদ, আদবকায়দা, আচার—ব্যবহার, অভ্যাস, ধ্যানধারণা, সবই ভৃত্যরা বহন করে নিয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক আদর্শ থেকে হ্যাট পরার ভঙ্গি পর্যন্ত ভৃত্যদের মধ্য দিয়ে সমাজে প্রচলিত হওয়া সম্ভব।
The cultural elements thus relayed were of all sorts; articles of clothing, gestures, moral values, ideas. A new atitude towards church or state was as likely to be passed on as a new way of cocking a hat…During the whole of the preceding century servants had been similarly effective in disseminating their employer’s views (pp. 221-222).
গৃহভৃত্যশ্রেণির এই সাংস্কৃতিক ভূমিকা উদ্ঘাটনে জিন হেখ্ট সফল হয়েছেন এবং এই সাফল্যের মধ্যেই তাঁর ভৃত্যশ্রেণির সামাজিক ইতিহাস—রচনা সবচেয়ে বেশি সার্থকতা লাভ করেছে। সংগৃহীত তথ্যস্তূপের ভিতর থেকে তিনি সমাজেতিহাসের অন্তঃসলিলা প্রাণপ্রবাহটি খনন করে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন এবং চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। এ কাজ সম্ভব হয়েছে, কারণ হেখট কেবল ইতিহাসের অনুরাগী নন, সমাজবিজ্ঞানেরও অনুশীলক। তাই যে অন্তর্দৃষ্টি ও তথ্যোত্তীর্ণ কল্পনাশক্তি ভিন্ন কোনও ইতিহাসেষণাই কখনো সার্থক হতে পারে না, হেখটের তার অভাব হয়নি। আমাদের দেশের ইতিহাস রচনা এখনও তথ্যসংকলনের প্রাথমিক স্তরে আবদ্ধ। ঐতিহাসিকদের একপেশে বিশেষজ্ঞতা তথ্যাতিরিক্ত কল্পনার পরিপন্থী। তাই এ দেশে ‘ক্রনিকল’ শ্রেণির ইতিহাস যত লেখা হয়েছে, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ইতিহাস—রচনার প্রয়াস তার শতাংশের একাংশ হয়নি। যাঁরা ইতিহাসের অধ্যাপনা করেন এবং ইতিহাসের ছাত্র, তাঁদের সকলেরই কর্তব্য এই অন্বেষণ—বিশ্লেষণ পদ্ধতির পরিবর্তনের ধারার সঙ্গে সংযোগ রাখা। যে ভৃত্যশ্রেণি হেখটের আলোচ্য বিষয়, তারা ইংলন্ডের ও লন্ডনের। আমাদের বাংলা দেশে কলকাতা শহরে অষ্টাদশ—ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই ভৃত্যশ্রেণির বিচিত্র সমাগম ও সংখ্যাবৃদ্ধি হয়েছিল। তার ইতিহাস রচনা করতে পারলে বাংলার সামাজিক ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায় রচনা সম্পূর্ণ হতে পারে এবং সমাজের নানাদিক ভৃত্যদের জীবনালোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে। জিন হেখ্টের বইখানি পড়তে পড়তে এই কথাই আমার বারবার মনে হচ্ছিল।
১৩৬৩
…………
The Domestic Servant Class in 18th Century England. By J. Jean Hecht. Routledge & Kegan Paul. London.
* G. M. Trevelyan—English Social History
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন