বিনয় ঘোষ
Think of an image. Multiply by ten. Square the product. Add prestige, Take away the thing that first made you think of it. Sell it. Print it. Filmit, Broadcast it. And the answer’s Unreality.
Boorstin : The Image
সম্প্রতি বঙ্গসমাজে কয়েকটি বিচিত্র উপসর্গ দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল ‘গেট টু—গ্যাদার’। আগেকার দিনে সামাজিক সম্মেলন হত, শুভকর্ম ও উৎসব—পার্বণ উপলক্ষ করে। এখনও যে হয় না তা নয়। সাধারণ মধ্যবিত্তরা এই সম্মিলনেই মিলিত হন এবং সকলে মিলেমিশে গল্পগুজব ও খাওয়াদাওয়া করেন। গানবাজনার আসরও বসতে পারে এবং তার সঙ্গে অন্যান্য আমোদপ্রমোদের অনুষ্ঠান হতেও বাধা নেই। এই ধরনের সমাবেশে বাঙালির নিজস্ব একটা মজলিসি পরিবেশ রচিত হত এবং তার মধ্যে বাঙালির বংশগত মেজাজ স্বতঃস্ফূর্তির প্রচুর অবকাশ পেত। এ হল সেই গ্রাম পঞ্চায়েতের বটতলা এবং গৃহস্থের চণ্ডমণ্ডপের অবিমিশ্র ধারা। সম্প্রতি মধ্যবিত্তের একটি স্তরে যে ‘গেট টু—গ্যাদার’—এর প্রবল ধারা বইছে, তার সঙ্গে আগেকার এই ধারার কোনও সম্পর্ক নেই। বটতলা বৈঠকখানার সামাজিক সমাবেশের আধুনিক সাংস্কৃতিক রূপায়ণ অবশ্য হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে এই গেট টু—গ্যাদারি কালচারের বিশেষ কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালের একটি বিশেষ সামাজিক উপসর্গ হল ‘গেট টু—গ্যাদার’। এর মধ্যে ‘ইংলিশ’ প্রভাবের চেয়ে ‘আমেরিকান’ প্রভাব অনেক বেশি প্রত্যক্ষ বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও স্বাধীনতালাভের পর এ দেশের মধ্যবিত্তশ্রেণির একটি স্তরে এই উপসর্গ সংক্রামক হয়ে উঠেছে। এই স্তরটি মধ্যবিত্তের মধ্যস্তর ও উচ্চস্তরের একটি মিশ্রস্তর, অর্থাৎ middle-middle ও upper-middle—এর একটি সংমিশ্রণ। মধ্যবিত্তের এই উচ্চমধ্যস্তরের সামাজিক গড়ন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বে যা ছিল, পরে আর তা নেই। না—থাকার অন্যতম কারণ হল, গত মহাযুদ্ধের অস্বাভাবিক পরিবেশে আমাদের সমাজজীবনে এমন কতকগুলি দুষ্টগ্রহের প্রবেশ ঘটেছে যার উৎপাত থেকে আমরা কবে যে মুক্তি পাব তার ঠিক নেই এবং আদৌ পাব কি না তা বলা যায় না। অর্থলোভ জাল জুয়োচুরি স্বার্থপরতা হৃদয়হীনতা ইত্যাদি সর্বপ্রকারের দোষ মানবসমাজে সর্বকালেই ছিল, অবস্থাগুণে মধ্যে মধ্যে তার প্রাবল্যও দেখা গিয়েছে। কিন্তু বিগত মহাযুদ্ধের পর থেকে সমাজ যত জনতাসমাজের (mass society) বিকট মূর্তি ধারণ করতে আরম্ভ করেছে, তত এই সমস্ত সামাজিক ব্যাধিও দৈত্যের আকার ধারণ করে যেন সমগ্র সমাজটাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। আগে মানুষের দানবসত্তা সমাজের চোরাগলিতে নিঃশব্দে প্রেতের মতো ঘুরে বেড়াত, সুস্থ সাধারণ মানুষ তাদের মানবসত্তা বিসর্জন দিয়ে কোনওদিন তার মধ্যে নিমজ্জিত হত না। বর্তমানের জনতাসমাজে মানুষের দানবসত্তা ও মানবসত্তার মধ্যে সমস্ত ব্যবধান যেন দ্রুত ঘুচে যাচ্ছে। তার অজস্র দৃষ্টান্ত প্রতিদিন আমরা সমাজের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। ক্ষণিকের উত্তেজনা এখন মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী সঞ্চালক হয়েছে। সত্য বা মিথ্যা যা—ই তার উৎস হোক—না কেন—(এবং সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য বানাতে একালের সংবাদপত্র যখন সর্বময় কর্তা)—তার মধ্যে উত্তেজনার খোরাক থাকলেই যথেষ্ট। আজকাল যত সহজে আমরা মানুষকে হত্যা করতে পারি, অপমান করতে পারি, তত সহজে মানবেতর কোনও জীবজন্তুকেও তা করতে পারি না। দার্শনিক অর্থে নয়, একেবারে প্রাত্যহিক ব্যাবহারিক জীবনের অর্থে আজ মানুষের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য আবর্জনার কীটের চেয়েও কম। তা—ই হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ বাইরের সমাজে সর্বক্ষেত্রে যখন আবর্জনার স্তূপ জমে পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠেছে, তখন মানুষও অতিদ্রুত সেই আবর্জনার ঘৃণ্য কীটে পরিণত হচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরে এই ঘৃণ্য কীটের দল আজ কিলবিল করছে।
‘গেট টু—গ্যাদার কালচার’ এই ধরনের একশ্রেণির সামাজিক কীট আমাদের সমাজে রোপণ করছেন। প্রথম পর্বে, অর্থাৎ বর্তমান বিংশ শতকের চতুর্থ দশকে, এই কালচার প্রধানত কালোবাজারি চোরাকারবারি ও নৃত্যগোপালি নেপোদের (অর্থাৎ দালালদের) মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ইংরেজ—আমেরিকান—অস্ট্রেলিয়ান—নিগ্রো প্রভৃতির সান্নিধ্যে ও অনুকম্পায় যাঁরা গত যুদ্ধের সময় মুঠো—মুঠো রাস্তার ধুলোর বিনিময়ে বস্তা বস্তা টাকা রোজগার করেছিলেন তাঁরা এই বিদেশি অনুগ্রাহকদের কাছে গেট টু—গ্যাদারে প্রথম দীক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর এই আপস্টার্ট বিত্তশালীদের স্তর থেকে ‘গেট টু—গ্যাদার’—এর বিগলিত ধারা মধ্যবিত্তের অন্যান্য স্তরে প্রবাহিত হতে থাকে। মধ্যবিত্তের এই স্তরটি হল স্বাধীন ভারতের পঞ্চবার্ষিক যোজনার বংশধরদের স্তর। দেশের শিল্পায়নের ফলে সমাজে একশ্রেণির টেকনোক্র্যাট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ম্যানেজার এগজিকিউটিভ ও অফিসারের দ্রুত বিকাশ হয়েছে এবং তিনটি যোজনার ভিতর দিয়ে মুদ্রাস্ফীতির চাপে এদের কলেবর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মধ্যবিত্তের মধ্যস্তরের বিরাট একটা অংশ এই White Collar—গোষ্ঠী দখল করে বসেছে। এদের মধ্যে ‘Ad-men’ (Advertisement-men) ও ‘manager’—দের প্রতাপপ্রতিপত্তি সবচেয়ে বেশি। সামাজিক কর্মজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র administration যত শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে জটিল হচ্ছে, তত সর্বক্ষেত্রে ম্যানেজারদের সংখ্যা বাড়ছে—‘there are more managers in every sphere of modern society, and the managerial type of man becomes more important in the total social structure.’ (Wright Mills)। এই ম্যানেজারদের সঙ্গে আছেন যাঁদের ‘Ad-men’ বলা হয় তাঁরা। বর্তমান যুগ বিজ্ঞাপনের যুগ। গভর্নমেন্টের প্রচারবিভাগ থেকে আরম্ভ করে বাইরের বড় বড় প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সর্বত্র এই বিজ্ঞাপনের প্রভাব স্বীকৃত। আধুনিক সমাজে তাই বিজ্ঞাপনী প্রতিভাদের প্রতাপ ও কদর কারও চেয়ে কম নয়। বস্তুত পণ্যপ্রধান সমাজের বাজারে আজ তাই ‘ad-men’ যাঁরা তাঁদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য। বলা বাহুল্য, এঁদের সঙ্গে একালের ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনিশিয়ানরাও আছেন। ম্যানেজোর অ্যাড—মেন ইঞ্জিনিয়ার—টেকনিশিয়ান এবং বহু রকমের গ্রেডের বিচিত্র নামধারী অফিসার—এই নিয়ে বিরাট একটি ক্রমবর্ধমান গোষ্ঠী মধ্যবিত্তের উপরের স্তরে গজিয়ে উঠেছে, তাঁদের সামাজিক জীবনের অন্যতম আনন্দোৎসব এই ‘গেট টু—গ্যাদার’।
সাম্প্রতিক সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় এঁদের বলতে হয় ‘the booming middlclass’ এবং এই ‘বুমিং’ মধ্যবিত্তরা আজ কলকাতা শহরের সুপারমার্কেটে, হোটেল—বার—রেস্তরাঁয় এবং নৈশ ক্লাবে নতুন এক কালচারের প্রবর্তন করছেন। একজন বিদেশি সমাজবিদ এই কালচারের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে বলেছেন—‘It’s bye-bye, upstair chambermaid—ta ta, liveried chauffeur—good riddance to the largnette, limousine, and solid gold lavartory. The new Good Life is casual, de trilled, comfortable, fun—and isn’t it marvellous.’ সামান্য কিছুটা সংশোধন করে আধুনিক বাঙালি সমাজে এর ব্যাখ্যা এইভাবে করা যেতে পারে—
এ হল বাই—বাই, হা ডু—ডু সো—গ্ল্যাড টু মিট ই উ—ওনার ড্রিভন অ্যামব্যাসাডার—ফিয়েস্ট্যাণ্ডার্ড হেরাল্ড, ডিন্যাশনালাইজড ড্রেস, ট্রাউজার—টেরিলিন বুশশার্ট, ফক্স ট্রটাদি ফ্লোর—ড্যান্স, ড্রিঙ্ক ও বুফে ডিনার, মিস্টার—মিসেসদের ফ্রেটারনিটি, মধ্যে মধ্যে ব্যাস্টার্ড বাংলায় কথোপকথন, ব্যান্ড ও হুলা—হুলা, অবশেষে ‘জনগণমন’ জাতীয় সংগীত, তারপর আবার গুডনাইট বাই—বাই—টা—টা—Casual release, passing diversion and fun।
এই হল সাম্প্রতিক ‘গেট টু—গ্যাদারি’ কালচারের বৈশিষ্ট্য, যাকে স্বাধীনতা—উত্তর যুগের নব্য আপস্টার্টদের প্রবর্তিত এক বিচিত্র ব্যাস্টার্ড কালচার বলা যায়। Thanks to inflation and foreign air (বিশেষ করে আমেরিকান), এ কালচারের পরিপূর্ণ রূপ কী হবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না।
১৯৬২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন