বিনয় ঘোষ
রাজা রামমোহন রায়ের পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত বাংলা বা ইংরেজি ভাষাতে আজও লেখা হয়নি। ‘পূর্ণাঙ্গ’ বলতে বোঝায় এমন কোনও জীবনচরিত যার মধ্যে রামমোহনের জীবনের প্রত্যেকটি কর্মকীর্তি, চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণা তাৎকালিক সামাজিক প্রতিবেশের আলোকে পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক মর্যাদায় প্রতিফলিত হতে পারে। শ্রীমতী সোফিয়া ডবসন কোলেটের The Life and Letters of Raja Rammohun Roy (১৯০০) এবং নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত’ (১৮৮১, ১৯২৮) যখন লেখা হয়েছিল তখন অনুসন্ধানীর দৃষ্টিতে বহু ঐতিহাসিক তথ্য ও ঘটনা অনুদঘাটিত ছিল, যার ফলে এই জীবনীগুলি অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে। এমনকী রামমোহনের জীবনের অনেক পরিচিত ঘটনা ও কর্মের প্রকৃত তাৎপর্যই আমাদের কাছে পরিষ্কার ধরা পড়েনি। শ্রীদিলীপকুমার বিশ্বাস ও শ্রীপ্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি কোলেটের রামমোহন—জীবনীর যে নূতন পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন, তাতে রামমোহন সম্বন্ধে অনুসন্ধানলব্ধ অধিকাংশ প্রয়োজনীয় তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে এবং তার ফলে বইখানির উপযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। কোলেট ও তাঁর অসমাপ্ত রচনার লেখক রেভারেন্ড স্টিড লিখিত মূল গ্রন্থের পাঠ্যবস্তুর কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। পাদটীকা, অতিরিক্ত তথ্য ও পরিশিষ্টের মধ্যে নূতন তথ্যগুলি সম্পাদকরা সযত্নে পরিবেশন করেছেন।
রামমোহন কর্মজীবন ও তৎকালের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্যাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে শ্রীযতীন্দ্রকুমার মজুমদার মহাফেজখানার দলিলপত্রাদি থেকে সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলি ১৯৩৮—৪১ সালের মধ্যে প্রকাশিত তিনখানি গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে, ১. Letters and Documents Relating to the Life of Raja Rammohun Roy, vol. I (1791-1830); ২. Raja Rammohun Roy and the Last Moghuls; A Selection from Official Records 1803-1895, with a Historical Introduction; ৩. Raja Rammohun Roy and Progressive Movements in India: A Selection from Records 1775-1845, with a Historical Introduction. এই তিনটি গ্রন্থকে রামমোহন—জীবনীর অপরিহার্য আকরগ্রন্থ বলা যেতে পারে। দুঃখের বিষয় তিনখানি বইয়ের একটিও বর্তমানে পাওয়া যায় না এবং অদূর ভবিষ্যতে এগুলি পুনমুদ্রণের কোনও ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে কি না তা—ও বলা যায় না। কোলেটের রামমোহন—জীবনীর সম্পাদকরা যথেষ্ট পরিমাণে এই বই তিনখানির উপকরণের উপর নির্ভর করেছেন এবং এ ছাড়াও অন্যান্য তথ্য এ দেশি ও বিদেশি অনুসন্ধানীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। এদিক দিয়ে কোলেটের এই নূতন পরিবর্ধিত রামমোহন—জীবনীর সংস্করণটিকে কেবল সম্পাদকদের একটি প্রশংসনীয় কর্ম বললে অল্পোক্তি করা হয়, কারণ এরকম অকাতর পরিশ্রম, ধৈর্য ও একনিষ্ঠা বাস্তবিকই বর্তমান কালের সাহিত্যকর্মে দুর্লভ। যে—পরিমাণ তথ্য কোলেটের মূল গ্রন্থের সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে, তাতে স্বচ্ছন্দে একটি নূতন জীবনীগ্রন্থ রচনা করা সম্ভব হত এবং হয়তো তা করলে একদিক থেকে আরও ভালো হত, কিন্তু সম্পাদকরা অনায়াসে নূতন জীবনীকার হবার সেই লোভটুকু বর্জন করেছেন। কর্তব্যবোধের কাছে খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা ম্লান হয়ে গিয়েছে।
কোলেটের রামমোহন—জীবনীতে তথ্যঘটিত ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল অনেক, কারণ আজ থেকে প্রায় ৬৫—৭০ বছর আগে ঐতিহাসিক তথ্য সন্ধানের সুযোগ—সুবিধা আজকের মতো প্রশস্ত ছিল না এবং অনুসন্ধানীর দৃষ্টি অথবা অনুসন্ধান—পদ্ধতিও তখন সংকীর্ণ ছিল। এইসব ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা সম্পাদকরা যত দূর সম্ভব নূতন তথ্যের আলোকে পরিপূরণ করেছেন। মাত্র কয়েকটি বিষয় আমরা এখানে উল্লেখ করছি :
১।। ইদানীং কেউ কেউ রামমোহনের তিব্বতযাত্রা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য হল রামমোহন নিজে তা কখনোও কোনও রচনায় কোন দিন প্রকাশ করেননি এবং তাঁর দেশভ্রমণের বিবরণাদি থেকে এমন কোনও সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না যে তিনি তিব্বতে পনেরো—ষোলো বছর বয়সে গিয়েছিলেন। বয়সের দিক থেকেও তখনকার দিনে একজন তরুণের পক্ষে দুর্লঙ্ঘ্য গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করে তিব্বতযাত্রা সম্ভব নয় বলে মনে হয়। এ কথা অবশ্য ঠিক যে রামমোহন নিজে কোনওখানেই ‘তিব্বত’ কথাটি তাঁর দেশভ্রমণের বিবরণের মধ্যে উল্লেখ করেননি। তা না করলে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ থাকে, কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় না যে রামমোহন তিব্বত যাননি। ডক্টর কার্পেন্টার দু—দু—বার রামমোহনের নিজের মুখ থেকে শুনেছিলেন তাঁর তিব্বতযাত্রার বিস্তারিত বিবরণ এবং তারপরে এ বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকার কোনও কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না। রেভারেন্ড ম্যাকডোনাল্ড তাঁর রামমোহন—স্মৃতিতে লিখেগিয়েছেন (১৮৭৯) যে রামমোহন যখন পাটনায় ছিলেন তখন বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে এবং আদিবাসীদের ধর্মকর্ম ও আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণা সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলেন। সেখান থেকেই তাঁর তিব্বতযাত্রার আগ্রহ জাগতে পারে এবং মনে হয় তা—ই জেগেছিল। তিব্বতে গিয়ে তিনি দু—তিন বছর ছিলেন এবং সেখানকার বৌদ্ধধর্মের বিশেষ রূপ এবং লোকধর্মের বিশিষ্টতা লক্ষ করেছিলেন। রামমোহনের আত্মজীবনী—পত্র, যা তাঁর মৃত্যুর পরে বিলাতের ‘এথেনিয়াম’ ও ‘লিটারারি গেজেট’ পত্রিকায় তাঁর সেক্রেটারি স্যান্ডফোর্ড আর্নট প্রকাশ করেন—তাতে তিনি লিখেছেন যে প্রায় ষোলো বছর বয়সে তিনি হিন্দুসমাজের পৌত্তলিকতার যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে একটি নিবন্ধ রচনা করেন। তার জন্য তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা মনঃক্ষুণ্ণ হন এবং তিনিও দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। প্রধানত হিন্দুস্থানের সীমান্তের মধ্যেই তাঁর পর্যটন সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু সীমান্তের বাইরেও কোনও কোনও দেশে (‘some beyond the bounds of Hindoostan’) তিনি গিয়েছিলেন। এত দূর বলেও কেন তিনি ‘তিব্বত’ কথাটি উল্লেখ করেননি, তা নিয়ে তর্ক করা বৃথা। তবে হিন্দুস্থানের সীমান্তের বাইরে বলতে যে ‘তিব্বত’ বোঝায় না, তা ভাববারও কোনও যুক্তিসংগত কারণ নেই। তার উপর ডক্টর কার্পেন্টার যখন স্বকর্ণে রামমোহনের নিজের মুখ থেকে এই ভ্রমণের বৃত্তান্ত শুনেছিলেন, তখন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা বৃথা। সমর্থনযোগ্য বলে মনে হয় (Supplementary Notes, p. 12-13)।
২।। প্যারীচাঁদ মিত্রর সহোদর কিশোরীচাঁদ মিত্রর রামমোহন সম্বন্ধে একটি রচনাতে তাঁর সরকারি কর্মজীবনে অসাধু উপায়ে উৎকোচগ্রহণের সম্ভাবনার পরোক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইঙ্গিতটি কিশোরীচাঁদের নিজের নয়, তবে ঘটনার বিবৃতি থেকে মনে হয় যেন এরকম অভিযোগ কেউ কেউ করতে চেয়েছেন যে দশ বছরের মতো ইংরেজ সরকারের অধীনে কাজ করে রামমোহন এত টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছিলেন যা দিয়ে বাৎসরিক দশ হাজার টাকা আয়ের মতো জমিদারি কিনতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি। এ অভিযোগ যে ভিত্তিহীন তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কারণ দশ বছর নয়, কোম্পানির অধীনে বিভিন্ন সময়ে চাকরি রামমোহন বছর দুই, কি তার কিছু বেশি কাল, করেছিলেন। চাকরির আগে তিনি কলকাতা শহরে, প্রায় ১৭৯৭ সাল থেকে, তেজারতি ও মহার্জনি কারবার করে অর্থ উপার্জন করেছেন। ১৮১০ সালের মধ্যেই দেখা যায় যে বাৎসরিক দশ হাজার টাকার বেশি আয়ের জমিদারি তাঁর কেনা হয়ে গিয়েছে এবং তখন তাঁর সরকারি চাকরির মেয়াদ মোট এক বছরও হয়নি। কাজেই সরকারি চাকরির সঙ্গে তাঁর জমিদারি কেনার বা তার আয়ের কোনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক নেই, ছিলও না। তা ছাড়া, সরকারি চাকরি, বিশেষ করে ডিগবির সংস্পর্শে বা অধীনে চাকরি করার উদ্দেশ্য ছিল অন্য, অর্থোপার্জন নয়। চাকরির অর্থ তাঁর বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। সুশিক্ষিত ইংরেজদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসে তাঁদের জাতীয় চরিত্রের দোষগুণ বিচার করা এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়াই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তথ্য ও যুক্তি সহযোগে সম্পাদকরা এ বিষয়টি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন (Supplementary Notes, p. 54-58)।
৩।। রামমোহনের কলকাতার গৃহসম্পত্তির বিবরণ (পৃঃ ৯৬—৯৭) এবং তাঁর বেদান্তবাদে বিশ্বাসের কথা (পৃঃ ৯৭—১০০) আলোচনা করে তন্ত্রশাস্ত্রানুরাগের বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টি বাস্তবিকই জটিল। আলোচ্য গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক শ্রীদিলীপকুমার বিশ্বাস এ বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রবন্ধাকারে অন্য পত্রিকায় পূর্বে আলোচনা করেছেন। কুলাবধূত হরিহরনন্দন তীর্থস্বামীর আসল নাম নন্দকুমার বিদ্যালংকার। রামমোহনের যখন চৌদ্দ বছর বয়স তখন থেকে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, ব্রাহ্মসমাজের প্রথম আচার্য, হরিহরানন্দর কনিষ্ঠভ্রাতা। এঁরা নদিয়া জেলার (হুগলির নয়) পালপাড়ার অধিবাসী। পালপাড়ার অধিবাসীরা আজও হরিহরানন্দের সাধনস্থান এবং বাস্তুভিটা অনুসন্ধানীদের সাগ্রহে দেখিয়ে দেন। তবে ঐতিহাসিক দলিলপত্রে সঠিক ভিটার কোনও প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। হয়তো নদিয়া জেলার কালেক্টরেটে খোঁজ করলে কৃষ্ণনগরের রাজবংশের দানপত্রাদি থেকে এঁদের পারিবারিক ইতিহাসের কিছু বিবরণ সংগ্রহ করা যেতে পারে। যা—ই হোক, হরিহরানন্দ রামমোহনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে উদার মতাবলম্বী ছিলেন। সতীদাহ তিনি সমর্থন করতেন না। তন্ত্রশাস্ত্রে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ছিল এবং ‘কুলার্নবতন্ত্র’ ও ‘মহানির্বাণতন্ত্র’—এর ভাষ্যকার হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতিও তিনি অর্জন করেছিলেন। হরিহরানন্দর সাহচর্যে রামমোহন নিজেও তন্ত্রশাস্ত্রে বিশেষ অনুরাগী হয়েছিলেন এবং তাঁর নিজের ধর্মবোধ ও ধ্যানধারণা কত দূর পর্যন্ত তন্ত্রের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিল তা অনুসন্ধানের বিষয় (Supplementary Notes, p. 101-2)।
৪।। ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। এই বিদ্যায়তনের পরিকল্পনার গোড়া থেকেই রামমোহন সংশ্লিষ্ট ছিলেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠাকালে প্রধানত বিদ্যালয়েরই স্বার্থে, তাঁর পক্ষে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকা সম্ভব হয়নি, অনেকটা স্বেচ্ছায় তিনি দূরে সরে গিয়েছিলেন। এই বিষয়টি নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বহু গবেষণা হয়েছে এবং কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন যে রামমোহন এ দেশের প্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা ও প্রতিষ্ঠার সঙ্গে একেরেই যুক্ত ছিলেন না। এ কথা বলে তাঁরা এইটাই বোধহয় ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন যে এ দেশে ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য বিদ্যাশিক্ষার প্রবর্তনে রামমোহনের বিশেষ কোনো দান নেই। আমাদের দেশের বেশ লব্ধপ্রতিষ্ঠ ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মধ্যে কয়েকজন এই মিথ্যাকে সত্য বলে প্রমাণ করার জন্য এমন উৎকট উৎসাহ প্রকাশ করেছেন যে তাঁদের অনুসন্ধানের মধ্যে পক্ষপাত বিচারবুদ্ধির চেয়ে গোষ্ঠীগত ও ধর্মগত বিদ্বেষই বেশি প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে হয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে যথেষ্ট। ‘হিন্দু কলেজ’ সংক্রান্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আদি পরিকল্পক হলেন ডেভিড হেয়ার এবং হেয়ার কয়েকজন বিদ্যানুরাগী বন্ধুবান্ধব নিয়ে একদিন রামমোহন রায়ের গৃহেই এ বিষয়ে প্রথম আলোচনা করেন। তা—ই করাই স্বাভাবিক। তবু বিদ্যালয় স্থাপিত হবার পরে রামমোহনকে কেন তার পরিচালকবর্গের মধ্যে দেখা গেল না, কেন তিনি দূরে সরে রইলেন, তা—ই নিয়ে যত বিভ্রান্তির উৎপত্তি হয়েছে পরবর্তীকালে। তার কারণ হল ‘হিন্দু কলেজ’—এর প্রধান উদযোগীদের মধ্যে রাধাকান্ত দেবের মতো হিন্দুসমাজের কর্ণধাররা ছিলেন (‘হিন্দু কলেজ’ নামকরণ থেকে তা বোঝা যায়) এবং তাঁরা রামমোহনের ধর্মীয় ও সামাজিক মতামতকে সনাতন হিন্দুসমাজের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করতেন। পাশ্চাত্য বিদ্যার শিক্ষায়তনটিকে তাঁরা এই ধর্মীয় গোঁড়ামির ভিত্তির উপর স্থাপিত করেছিলেন বলেই রামমোহনের মতো উদারধর্মী ব্যক্তির পক্ষে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংস্রব রাখা সম্ভব হয়নি এবং বিদ্যালয়ের পরিচালকরাও তা রাখতে দেননি। হিন্দু কলেজের কর্তৃপক্ষের এই ধর্মগোঁড়ামি যেকত দূর উগ্র ছিল তা কলেজ থেকে শিক্ষক ডিরোজিওকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার ঘটনা থেকে এবং রামমোহনের অন্যতম বন্ধু ও সহযোগী উইলিয়াম অ্যাডামসকে শিক্ষকপদে নিযুক্ত করার আপত্তি থেকে (১৮৩২) পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। অ্যাডামসকে হিন্দু কলেজের শিক্ষক নিযুক্ত করার বিরুদ্ধে মতামত জানিয়ে রাধাকান্ত দেব লিখেছিলেন : “For my part, I cannot entrust the morals and education of those I regard, to such a one that was once a Missionary, then a Vaidantic or disciple of Rammohun Roy and lastly a Unitarian.” (১৯ জানুয়ারি ১৮৩২)। যে বিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের রামমোহন সম্বন্ধে এই ধারণা, তাঁরা কখনোও কোনওদিক থেকে তাঁর সহযোগিতা কামনা করতে পারেন না। আর যে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের মধ্যে অধিকাংশই রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের মুখপাত্র, সেখানে যে রামমোহন ও তাঁর সহযোগী বন্ধুদের কোনও স্থান হতে পারে না, এবং স্থান করে নিতে গেলেও যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তা কল্যাণকর হতে পারে না, এইটুকু বিচারবুদ্ধি রামমোহনের ছিল মনে করা যেতে পারে। কাজেই রামমোহন স্বেচ্ছায় যে হিন্দু কলেজের সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই (Supplementary Notes, p. 102-4; সংযোজন ও সংশোধন, পৃ. ৪১৩)।
৫।। ‘ব্রহ্মসভা’, ‘ব্রহ্মসমাজ’, ‘ব্রাহ্মসমাজ’ কোনটি রামমোহনের দেওয়া আদি নাম, তা নিয়ে সম্প্রতি কিছুটা বাদানুবাদ য়েছে। কেউ—কেউ এমন কথা বলতে চেয়েছেন যে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামটি পরবর্তীকালে রচিত, রামমোহন প্রদত্ত নয়। ২০ আগস্ট ১৮২৮ ‘ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয় (বুধবার, ৬ ভাদ্র ১৭৫০ শকাব্দ)। ওইদিন পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ উপাসনা বিষেয়ে যে প্রথম ব্যাখ্যান পাঠ করেন তার মুদ্রিত পুস্তিকার আখ্যাপত্রে দেখা যায় ‘ব্রাহ্মসমাজ, কলিকাতা’ লেখা আছে (চিত্র ৭, পৃঃ ২৩২)। ব্রাহ্মসমাজগৃহের জমির বিক্রয় কবলায় (৬ জুন ১৮২৯) ‘ব্রহ্মসমাজ’ নামের উল্লেখ আছে, ‘ব্রহ্মসভা’র নয়। ‘ব্রহ্মসমাজ’ ও ‘ব্রাহ্মসমাজ’ কথা দুটির পার্থক্য গ্রাহ্য করার মতো নয়। লন্ডন থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ১৮৩২ রামেমোহন তাঁর পুত্র রাধাপ্রসাদ রায়কে একখানি চিঠি লেখেন (চিত্র ৮, পৃঃ ২৪০)। এই চিঠিতে অন্যান্য কথার মধ্যে তিনি লেখেন : ‘এই অবকাশে ব্রাহ্মসমাজের কাজের নিমিত্ত এক গীত পাঠাইতেছি…।’
প্রসঙ্গত সম্পাদকরা এ বিষয়ে আরও একটি কথা উল্লেখ করেছেন যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। ‘মহপরিনির্বাণতন্ত্র’ গ্রন্থে ‘ব্রহ্মণ’—এর পূজারি, ‘তত্ত্বচক্র’—এর অধিকারীদের বলা হয়েছে ‘ব্রাহ্ম’ বা ‘ব্রাহ্ম্য’। হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী নিজে ‘মহাপরিনির্বাণতন্ত্র’—এর একটি ভাষ্য রচনা করছিলেন এবং রামমোহন তন্ত্রের প্রতি অনুরাগী হয়েছিলেন তাঁর সাহচর্যে। ব্রহ্মণ—এর উপাসক ও ব্রহ্মতত্ত্বের সাধকদের ‘ব্রাহ্ম’ নামে অভিহিত করার প্রেরণা তিনি এই তন্ত্রশাস্ত্র থেকে পেতে পারেন। কাজেই ‘ব্রাহ্ম’ ও ‘ব্রাহ্মসমাজ’ কথা দুটি পরবর্তীকালে রচিত হয়নি, রামমোহনের কাল থেকেই প্রচলিত ছিল। সাধারণ লোকের মধ্যে, অথবা সমসাময়িক পত্রিকায়, গোড়ার দিকে অবশ্য ‘ব্রহ্মসভা’ (Brahma Sabha) ও ‘ব্রাহ্মসামজ’ (Brahmo Samaj) দুটি নাম চলিত ছিল, কিন্তু তাতে প্রমাণিত হয় না যে রামমোহন ‘ব্রহ্মসভা’ নামকরণ করেছিলেন, পরে তা পরিবর্তিত হয়ে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ হয়েছে (Supplementary Notes, p. 239-42)।
৬।। রামমোহনের জীবদ্দশাই তাঁর ব্যক্তিচরিত্র সম্বন্ধে কুৎসা প্রচারের চেষ্টা হয়েছে। এই কুৎসার মধ্যে একটি হল—রাজারাম রায় রামমোহনের রক্ষিত কোনও মুসলমান রমণীর গর্ভজাত সন্তান; তাঁর নিজের বিবাহিত স্ত্রী—র সন্তান নন। দ্বিতীয়টি কুৎসাটি হল—রামমোহন ইংলন্ডে গিয়ে একজন ইংরেজ মহিলার পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন। দুটি কুৎসাই শুধু যে ভিত্তিহীন তা নয়, ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত অপবাদ। যুগে যুগে এরকম অপবাদ নূতন ধর্মপ্রবর্তক ও সমাজসংস্কারকদের অনেক সহ্য করতে হয়েছে, কম বেশি পৃথিবীর সকল দেশে। আমাদের দেশের কূপমণ্ডূক সমাজে স্বার্থলোভী মানুষের মন নিয়ে উঠেছে কদর্য ভাগাড়ের মতো। কাজেই স্বার্থে স্বার্থে যখন সংঘাত বেধেছে, ধর্মের ক্ষেত্রে, সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে অথবা অর্থলোকের প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, তখন সেই নোংরা মনের ভাগাড়ে নিন্দা—কুৎসার বীজাণু ছাড়া আর কিছুই বাসা বাঁধতে পারেনি। আর সমস্ত নিন্দা ও কুৎসার মধ্যে অবৈধ যৌনসম্পর্কের কুৎসার এমন একটি অদম্য আকর্ষণ আছে এই শ্রেণির ব্যাধিগ্রস্ত অসুস্থ লোকের কাছে যে, যে—কোনও ব্যক্তির চরিত্রহননের পক্ষে তাঁরা এটিকে ব্রহ্মাস্ত্র বলে মনে করেন। বর্তমানকালেও এই জাতীয় কুৎসাপ্রবণতা থেকে সমাজের শিক্ষিত ভদ্রশ্রেণিও মুক্ত হতে পারেননি, শুধু সনাতন নারীঘটিত নিন্দার সঙ্গে রাজনীতির যুগে, রাজনৈতিক দালালির নিন্দাটুকু যুক্ত হয়েছে মাত্র। রামমোহনের যুগে রাজনীতির রূপ এরকম বীভৎস ছিল না, কাজেই অসহায়ের মতো রামমোহনকে কেবল অপর নিন্দাটির অপমানই সহ্য করতে হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, এরকম অপমান ‘বিধবাবিবাহ’ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরকেও অনেক সহ্য করতে হয়েছে।
রাজারাম রায় রামমোহনের নিজেরসন্তান নন, দত্তক নন, আশৈশব পুত্রবৎ পালিত একজন এ দেশীয় সন্তান। তিনি হিন্দুর, না মুসলমানের, না খ্রিস্টানের, না ইহুদির, কার সন্তান তা আজও জানা যায়নি। হরিদ্বারের মেলায় কোম্পানির কর্মচারী ডিক সাহেব তাঁকে দেখতে পান, তারপর তিনিই তাঁকে কিছুদিন পালন করেন। যখন সাহেবের স্বদেশে ফিরে যাবার সময় হয়, তখন তিনি রামমোহনের হাতে তাঁকে সমর্পণ করে যান। তারপর রামমোহনের কাছেই তিনি পুত্রবৎ স্নেহে পালিত হন। রাজারামের এই ইতিহাস ডক্টর ল্যান্ট কার্পেন্টার ১৮৩৫ সালে একটি চিঠিতে জানান। এইরকম কথা হয়েছে যে বিলাতযাত্রাকালে রামমোহনের সঙ্গী মুসলমান ভৃত্য ‘সেখ বকসু’ হলেন রাজারাম। কিন্তু শেখ বকসু ও রাজারাম যে একই ব্যক্তি নন তা দু—জনেরই ইংলন্ড থেকে স্বতন্ত্র জাহাজে কলকাতা ফেরার ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। সেখ বকসু ‘জেনেবিয়া’ জাহাজে করে ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৩ কলকাতায় ফেরেন, রাজারাম ফিরে আসেন ‘জাভা’ জাহাজে ১৮৩৮ সালের আগস্ট মাসে। রাজারাম ইংলন্ডে ‘বোর্ড অফ কন্ট্রোল’ কেরানির কাজ করেন প্রায় তিন বছর, কলকাতায় ফিরে এসে সরকারের রাজনৈতিক দপ্তরে মাসিক ২০০ টাকা বেতনে কিছুদিন কাজ করেন। ব্রাহ্ম আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যও ছিলেন। এরপর তাঁর সম্বন্ধে আজগুবি জল্পনাকল্পনার আর কোন অবকাশ থাকতে পারে বলে মনে হয় না (Supplementary Notes p. 297-301)।
রামমোহনের সমাজচিন্তা ও রাজনৈতিক চিন্তা সম্বন্ধে সম্পাদকরা অনেক নূতন তথ্য পরিবেশন করেছেন। তার মধ্যে ব্রিটিশ স্যোশালিজমের আদি প্রবর্তক রবার্ট ওয়েনের সঙ্গে রামমোহনের সাক্ষাৎ, সোশ্যালিস্ট আদর্শ সম্বন্ধে আলোচনা ও ওয়েনের সঙ্গে ধর্ম বিষয়ে তাঁর মতভেদ ইত্যাদির কথা জানা যায়। রামমোহনের গভীর মানবতাবোধ তাঁকে স্বাভাবিক কারণেই সোশ্যালিজমের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু ওয়েন প্রমুখ সোশ্যালিস্ট চিন্তানায়কদের ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকল্যাণ ও মানবকল্যাণচিন্তাকে তিনি সমর্থন জানাতে পারেননি। কৃত্রিমতা ও শঠতা থেকে মুক্ত অকৃত্রিম ধর্মবোধ যে মানবকল্যাণের পরিপন্থী নয়, এ বিশ্বাস রামমোহনের যে কত গভীর ছিল তা রবার্ট ওয়েনের কাছে লিখিত তাঁর পত্রখানি (১৮৩৩) থেকে বোঝা যায়। পত্রখানি নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি থেকে সম্প্রতি পাওয়া গিয়েছে এবং গ্রন্থের পরিশিষ্টে (পৃঃ ৪৯৪—৯৫) উদ্ধৃত হয়েছে।
এ ছাড়া রামমোহন ও জেরেমি বেন্থামের মধ্যে যে সমস্ত চিঠিপত্রের আদানপ্রদান হয়েছিল, তার মধ্যে তিনখানি চিঠি পরিশিষ্টে উদ্ধৃত হয়েছে (পৃঃ ৪৯০—৯৩)। রামমোহনের প্রতি বেন্থামের কতখানি শ্রদ্ধা ছিল তা বেন্তামের পত্রখানি থেকে বোঝা যায়। বেন্থাম, ওয়েন প্রমুখ যুগচিন্তানায়কদের সঙ্গে রামমোহনের যে প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যের ও ভাব আদানপ্রদানের সুযোগ হয়েছিল, সেকালে কেন, পরবর্তীকালেও কারও বিশেষ তেমন হয়নি। ইংলন্ডের রাজনৈতিক জীবনের এক যুগসন্ধিক্ষণে তিনি এই মনীষীদের সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন এবং তার ফলে তাঁর নিজের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারাও প্রভাবিত হয়েছিল মনে হয়। তিনি জীবিত থাকলে এবং স্বদেশে ফিরে এলে হয়তো আমরা তাঁর কাজকর্ম ও চিন্তার মধ্যে তার পরিচয় পেতাম।
কোলেটের রামমোহন—জীবনীকার নূতন পরিবর্ধিত সংস্করণে সম্পাদকরা আরও যে সব তথ্য সংযোজন করেছেন তা ‘অতিরিক্ত টীকা’, ‘সংযোজন ও সংশোধন’ এবং ‘পরিশিষ্ট’—এ মুদ্রিত হয়েছে। শুধু এইগুলির জন্যই মূল গ্রন্থের রূপান্তর ঘটেছে বলা চলে। রামমোহনের জীবনের যে—কোনও দিক ও বিষয় নিয়ে যাঁরা গবেষণা করবেন, তাঁদের কাছে এই কারণেই বইখানি অপরিহার্য বলে মনে হবে। তার সঙ্গে সম্পাদকের কৃতিত্ব দেখলে মনে হবে, ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে সত তা ও নিষ্ঠা ছাড়া ফাঁকি দিয়ে বাস্তবিকই কোনও বড় কাজ করা যায় না এবং যাঁরা সেরকম কাজ করেন, যেমন বর্তমান গ্রন্থের সম্পাদকরা বলেছেন, তাঁরা কোনও আশু ফললাভ বা খ্যাতিলাভের আকাঙ্ক্ষা নিয়েও তা করেন না।
১৩৭২
………………………………………………………………
Sophia Dobson Collect, The Life an Letters of Raja Rammohun Roy: Edited by Dilip Kumar Biswas and Prabhatchandra Ganguly, Sadharan Brahma Samaj, Calcutta, Third Edition, 1962
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন