বিনয় ঘোষ
মানবসমাজের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরে শিল্পকলার রীতিবৈচিত্র্যের বিকাশ হয়েছে। সমাজের সর্বস্তরের শিল্পরীতি (art forms) এক নয়। যেমন প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত নৃত্যকলার ইতিহাস প্রবহমান, কিন্তু সর্বযুগের নৃত্যরীতি নিশ্চয় এক নয়। আদিম যুগের সংগীত, লোকসংগীত, মধ্যযুগের দরবারি সংগীত, আর আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক সংগীতের মধ্যে প্রকরণভেদ অনস্বীকার্য। সাহিত্য বোধহয় সমস্ত শিল্পকলার মধ্যে কনিষ্ঠ, অন্তত লেখ্য—সাহিত্য তো বটেই। মুখে মুখে রচিত ছড়া বা গান, কথা বা কাহিনি সাহিত্য হলেও লেখ্য—সাহিত্যের মধ্যে গণ্য নয়। লেখ্য—সাহিত্যের আগে চাই বর্ণমালা এবং সাহিত্যরচনার উপযোগী ভাষা। ভাষাও তো আদিমকাল থেকে আছে এবং তার মাধ্যমে ভাববিনিময়ও করছে মানুষ দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু ভাববিনিময়টা লৈখিক প্রত্যক্ষ স্তর থেকে পরোক্ষ মৌখিক স্তরে উঠতে অনেক সময় লেগেছে। এই বিলম্বের কারণের মধ্যেই ভাষা ও সাহিত্যের পারস্পরিক সম্পর্কের অন্তর্নিহিত রহস্যটুকু লুকিয়ে রয়েছে। মনের ভাব মুখে প্রকাশ করতে কোনও কষ্ট হয় না, তার জন্য প্রকাশরীতি আয়ত্ত করতে হয় না। অবশ্য লক্ষ করলে দেখা যায়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিগত স্তরে, আধুনিক সমাজেই বেশি, মৌখিক ভাষায় প্রকাশরীতিরও তারতম্য আছে। একই মনের কথা একজন কৃষক যেভাবে ও ভঙ্গিতে প্রকাশ করে, একজন সুশিক্ষিত ভদ্রলোক সেভাবে করেন না। কেবল ভাষার নয়, ভঙ্গিরও পার্থক্য থাকে তার মধ্যে। কৃত্রিম শহরে কালচারের মধ্যে যাঁরা টবের ফুলের মতো গড়ে ওঠেন, তাঁদের ভাষা ও কথনভঙ্গি গ্রাম্য ভদ্রলোকদের মতো কখনোই নয়। সুতরাং মৌখিক ভাষারও প্রকাশরীতি আছে। এবং এই রীতির গুরুত্ব এত যে আজকাল আমরা কথোপকথনের সময় ভাষার চাইতে রীতি বা ভঙ্গির উপর জোর দিই বেশি। ভঙ্গিগত পার্থক্যই ভদ্রতা—অভদ্রতার সীমারেখা টানে, ভাষাগত পার্থক্য সেখানে নগণ্য। ভঙ্গির গুরুতা তাই অস্বীকার করার উপায় নেই। তা না করেও বলা যায়, মৌখিক ভাষার ভঙ্গিগত বৈশিষ্ট্যও আমরা স্বাভাবিকভাবে পারিবারিক নার্সারিতে আয়ত্ত করি। বালকের মুখের কথা শুনেই বোঝা যায় যে সে সাধারণ কেরানির সন্তান, না কোনও অভিজাত পিতার সন্তান। এই ভঙ্গি বালককে কষ্ট করে শিখতে হয় না, অনুকরণের মধ্য দিয়ে সে স্বভাবতই শেখে; লেখ্য ভাষা সেভাবে আয়ত্ত করা কঠিন। তার জন্য শিক্ষা ও অনুশীলন প্রয়োজন হয়। যা মুখে বলা সহজ, তা লিখে বলতে গেলে বোঝা যায় যে কত কঠিন। তার কারণ, মনের অসংলগ্ন ও অসংযত ভাবসমষ্টি মৌখিক স্তরে আত্মপ্রকাশে যতখানি আশকারা পেয়ে থাকে, লৈখিক স্তরে তা কখনোই পায় না, বা পেতে পারে না। বলবার সময় না হলেও লেখবার সময় তার উপর কড়া নজর রাখতে হয় এবং রীতিমতো শাসনও করতে হয়। তার উপর ভাষারও একটা রূপ দিতে হয়, যে রূপ সর্বজনগ্রাহ্য। ভঙ্গির প্রশ্ন তো আছেই।
এত কড়া সব নিয়মকানুন মেনে চলতে হয় বলেই শিল্পকলার ক্ষেত্রে ‘সাহিত্যের’ সমাগম হয়েছে অনেক পরে। তা—ও যখন হয়েছে তখন ছন্দবদ্ধ কাব্যের মধ্যেই হয়েছে তার স্ফূর্তি। শিল্পকলার ইতিহাসে ‘সাহিত্য’ যেমন সর্বকনিষ্ঠ (আধুনিক ‘সিনেমা’ ছাড়া), তেমনি কেবল সাহিত্যের ইতিহাস বিচার করলে আবার গদ্যসাহিত্য কনিষ্ঠ। কাব্যসাহিত্য বয়সে অনেক প্রবীণ, গদ্যসাহিত্যের তুলনায়। তার কারণ লেখ্য ভাষার মাধ্যমে কাব্যসাহিত্যের প্রকাশের জন্য যে মানসিক সংযম, চিত্তস্থৈর্য ও ভাবানুভাব—শাসনের প্রয়োজন হয়েছিল, গদ্যভাষার ও গদ্যসাহিত্যের বিকাশের পূর্বে তার চেয়ে বহুগুণ প্রয়োজন হয়েছিল এইসব গুণাধিকারের। কাব্যসাহিত্যের বিকাশকালে অতখানি সংযম, দৃঢ়তা ঋজুতার প্রয়োজন হয়নি সামাজিক কারণেই। সমাজের তাগিদ ছিল না ততটা, তাই প্রস্তুতিও অনাবশ্যক ছিল। সামাজিক জীবনযাত্রা ছিল সাবলীল। কতকটা অবলীলাক্রমে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনটা কেটে যেত একঘেয়ে একটানা বাঁধাধরা অনুষ্ঠানের ছন্দে। পরিবর্তনের স্রোত নিশ্চয় ছিল, কিন্তু তা এত মন্থর ও মন্দগতি যে অনুভূতিতে তার নাগাল পাওয়া দায় হত। এহেন পরিবেশে মানুষের মনের ভাবরাজি সহজেই আত্মপ্রকাশ করেছে ছন্দবদ্ধ কাব্যে। কাব্যের ছন্দ ও সুরের একটা ধারাও বহমান ছিল আগে থেকে। সংগীতই ছিল তার শ্রেষ্ঠ রূপ। লেখ্য কাব্যসাহিত্যের মাতামহী এই সংগীত। সংগীতের ধারাতেই তাই কাব্যের প্রথম প্রকাশ। এবং কাব্যই মানুষের প্রথম লেখ্য—সাহিত্য।
গদ্যসাহিত্য বয়সে নবীন। তার আত্মপ্রকাশের পূর্বে মানুষের যে মানস—প্রস্তুতির প্রয়োজন, ইতিহাসের মধ্যযুগ পর্যন্ত তার কোনও লক্ষণ দেখা যয়নি। মনের ধর্ম ছিল তখন নিষ্ক্রিয়। সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে নির্বিবাদ নিবেদনেই ছিল তার তৃপ্তি। মন ছিল নির্জিবের মন। মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণ থেকে মানুষের এই আত্মতৃপ্তির ভাব কাটতে আরম্ভ করল। যেসব প্রত্যয় ও ধারণা মানুষের মনের নিভৃত নীড়ে ডানা গুটিয়ে ছিল, তারা বিশেষ জ্ঞানলাভের (বিজ্ঞান) আকাঙ্ক্ষায় পক্ষ বিস্তার করতে চাইল—বন্ধনের মেঘমুক্ত যুক্তির ও বুদ্ধির আকাশে। দেবতা, শাশ্বত মহাকাল প্রভৃতি স্থির প্রত্যয়ের বনিয়াদ সর্বপ্রথম কেঁপে উঠল মানুষের মনে। প্রথম আত্মচিন্তা করতে শিখল মানুষ। অর্থাৎ মানুষকে আবিষ্কার করল মানুষ। তার সঙ্গে সমাজ এল এবং মহাকালের বদলে পরিবর্তনশীল কাল। প্রশ্নকাতর সন্ধানী মন সহজে তৃপ্তি পায় না। জীবনের ও সমাজের অনেক বিধিবন্ধন, শাস্ত্রীয় অনুশাসন মানুষ আর নির্বিবাদে, ঈশ্বর ও ধর্মের দোহাই দিয়ে, মানতে চাইল না। নির্বিবাদ স্বীকৃতির বদলে বিবাদোত্তীর্ণ স্বীকৃতির যুগ এল। বিবাদ ও বিতর্ক, প্রশ্ন ও উত্তর, বুদ্ধিনির্ভর স্বাধীন যুক্তি ও অন্বীক্ষার এই ঐতিহাসিক যুগেই গদ্যসাহিত্যের বিকাশ হল। ইয়োরোপে ইংলন্ডে ষোড়শ—সপ্তদশ শতাব্দী থেকে, আমাদের দেশে অষ্টাদশ—ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে। জিজ্ঞাসু ও জটিল মনের ভাবপ্রকাশের স্বাভাবিক ভাষা হল গদ্যভাষা। বাঁধাধরা ছন্দের চৌহদ্দির মধ্যে বহুমুখী মনের প্রকাশ সম্ভব নয় বলেই লেখ্য ভাষা কাব্যিক রূপ থেকে গদ্যের মধ্যে আত্মপ্রসারের সুযোগ পেল। পরবর্তীকালে জীবন ও সমাজ—মানসের এই জটিলতার জন্য কাব্যও ছন্দমুক্তির পথে অভিযান শুরু করল। অক্ষর ও মাত্রার পরিমিত ছন্দের ভিতর দিয়ে কাব্যের স্ফূর্তি আর সম্ভব হল না। বিচিত্র সব নবনব ছন্দের সন্ধানে কাব্যের পরীক্ষা চলতে লাগল। আজও চলছে।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের প্রধান বাহন ছিল পয়ার ছন্দ। পয়ারের একটা নিজস্ব স্বচ্ছন্দতা আছে, যা আট—ছয় তালের পুনরাবৃত্তির মধ্যেও অক্ষুণ্ণ রাখা যায়। তার ভিতর দিয়ে দার্শনিক বিচার বা তত্ত্বকথাও যে প্রকাশ করা যায় না তা নয়। প্রাচীন কাব্যে সেরকম নিদর্শন অনেক আছে। কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে যখন পরস্পর—বিরোধী প্রশ্ন, প্রত্যয় ও সমস্যা বিক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং সেই বিক্ষুব্ধ ও আলোড়িত মন যখন ভাষার ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে চায় তখন আর তার পক্ষে পয়ারের আট—ছয়ের মাত্রাজ্ঞান মেনে চলা সম্ভব হয় না। গদ্যভাষার বিকাশের জন্য এই মানসিক পরিবেশের প্রয়োজন। গদ্যভাষাকে এইজন্যই ‘language of discourse’ বলা হয়। পয়ার ছন্দে বিচার—বিতর্ক যে করা যায় না তা নয়। কিন্তু বিতর্কের এক কৃত্রিম অবাস্তব সামাজিক অবস্থা কল্পনা করেই তা করা সম্ভব। প্রতিপক্ষ সেখানে সমাজে থাকলেও কবির কাছে তিনি কল্পনায় বিরাজমান। সমাজের সঙ্গে এই বিচার—বিতর্কের কোনও প্রত্যক্ষ যোগ থাকে না এবং তার কোনও প্রত্যক্ষ ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়াও হয় না সমাজ—মানসে। সুতরাং পয়ারের বন্ধন ছিন্ন করে তখনই প্রকৃত গদ্যভাষার জন্ম হয়, যখন ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই মানসলোকে বিচার—বিবাদ—বিতর্কের প্রেরণা পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে এবং তা প্রকাশ করার ব্যাকুলতা বাড়ে।
বাংলা দেশে এই সামাজিক ও মানসিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। গদ্যভাষায় লেখার চেষ্টা তার আগেও হয়েছে। চিঠিপত্রে, দলিল—দস্তাবেজে, উৎকীর্ণ শিলালিপিতে কিছু—কিছু তার নিদর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে সংস্কৃত ও ফারসি কথার সমারোহ এত বেশি যে বাংলা গদ্যভাষা বলে তার পরিচয় দেওয়া যায় না। তা ছাড়া, প্রাণহীন চিঠিপত্রে বা দলিল—দস্তাবেজে যে প্রকৃত গদ্যভাষার বিকাশ হয় না বা হতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা গদ্য ভাষার আদিরূপের যেসব নিদর্শন পাওয়া যায়, একমাত্র ছন্দহীন বিন্যাস ছাড়া তার মধ্যে গদ্যের আর কোনও বিশিষ্টতা নেই। নিছক আক্ষরিক ইতিহাসের দিক থেকে, বাংলা গদ্যভাষার প্রাথমিক নমুনা হিসেবে তার কিঞ্চিৎ মূল্য থাকলেও, গদ্যসাহিত্যের বিচারে তার বিশেষ কোনও স্থান নেই। উনিশ শতকের গোড়া থেকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা অথবা পাদরিসাহেবরা বাংলা গদ্যভাষায় যেসব পাঠ্যপুস্তক বা ধর্মগ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হন, তাতে গদ্যভাষার খানিকটা অনুশীলন সম্ভব হলেও, গদ্যসাহিত্যের সমৃদ্ধি তেমন হয়নি। তবু বাংলা গদ্যের ইতিহাসে বাঙালি পণ্ডিত ও সাহেব পাদরিদের এই রচনাকালকে প্রস্তুতির পর্ব বলা যায়। এই প্রস্তুতিপর্বেরই প্রান্তে দেখা যায়, রামমোহন রায় ধর্মসংস্কারও সমাজসংস্কারের কর্মে অবতীর্ণ হয়েছেন। সমাজের মধ্যে তখন এমন সব সমস্যা দেখা দিয়েছে, যার বিচার—বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তার জন্য রামমোহন যে কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, সভা ও বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া, তার মধ্যে পুস্তক—পুস্তিকা প্রকাশ ও আলোচনাই প্রধান। এই আলোচনা, বিচার—বিবাদ—বিতর্কের ভিতর দিয়ে সমাজের বুকে যে আলোড়নের সৃষ্টি হল, তা বাংলার সামাজিক ইতিহাসে অভিনব ও যুগান্তকারী। মানুষের বুদ্ধি, যুক্তি ও বিবেচনাশক্তির অবাধ গতি ও ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের আকাশে নতুন সূর্যোদয় হল। গদ্যসাহিত্যের বিকাশ হল। গদ্যসাহিত্যের গর্বের বিষয় হল এই ইতিহাস। কারণ কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসের অধিকাংশ যে পেট্রনের স্তাবকতায় ও প্রশস্তিতে কলঙ্কিত, গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে সেই কলঙ্কচিহ্ন নিতান্তই গৌণ। পরাধীনতা ও গোলামির পরিবেশে কাব্যের বিকাশ হয়েছে কিন্তু গদ্যের হয়নি। ব্যক্তির আত্মচেতনা ও বুদ্ধিস্বাতন্ত্র্য থেকে গদ্যের বিকাশ ও অগ্রগতি। অকস্মাৎ এই উক্তি হয়তো মনে হবে কাব্যের অবমাননার জন্য, কিন্তু ইতিহাস তার সাক্ষী। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে যে নতুন কাব্যের জন্ম হয়েছে আধুনিক যুগে, তা গদ্যের অনুগামী এবং এই বোধের তীব্রতার জন্যই দেখা যায় যে কাব্য ক্রমেই গদ্যপ্রাণধর্মী হয়ে উঠেছে।
রামমোহনের যুগেই বাংলা দেশে প্রকৃত গদ্যসাহিত্যের ভিত রচিত হয়েছে। লেখকের আত্মচেতনা, আত্মবিশ্বাস, বুদ্ধি, যুক্তিদীপ্ত স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রাবল্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যে কীভাবে গদ্যসাহিত্যে রূপায়িত হল রামমোহনের রচনাবলি তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। কলকাতা শহরে এসে বসবাস করবার অল্পদিন পরেই রামমোহন অনুবাদ ও ভাষ্যসহ ‘বেদান্তগ্রন্থ’ প্রকাশ করেন (১৮১৫ সালে)। কোনও পেট্রনের ধর্মাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থের জন্য নয়। একান্ত সামাজিক প্রয়োজনে। পাদ্রিসাহেবদের হিন্দুধর্মবিরোধী অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য হিন্দুধর্মের একেশ্বরবাদ ও নিরাকার ব্রহ্মবাদ যুক্তিপ্রমাণসহ প্রতিপন্ন করার বিশষ প্রয়োজন ছিল তখন। তার জন্যই বেদান্তের অনুবাদ। রাজসভায় সপারিষদ পেট্রনকে পড়বার জন্য নয়, সমাজের বহুজনের মধ্যে প্রচার করার জন্য বেদান্তের অনুবাদ তিনি করেছিলন। তাঁরই জন্য তাঁর নতুন যে বাহনের প্রয়োজন হয়েছিল, সেই বাহন গদ্যভাষা। গদ্যভাষার এই নতুন বাহন সম্বন্ধে তাই বেদান্তগ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন :
প্রথমত বাংলা ভাষাতে আবশ্যক গৃহব্যাপার নির্বাহের যোগ্য কেবল কতকগুলিন শব্দ আছে এ ভাষা সংস্কৃতের যেরূপ অধীন হয় অন্য ভাষার ব্যাখ্যা ইহাতে করিবার সময় স্পষ্ট হইয়া থাকে দ্বিতীয়ত এ ভাষায় গদ্যকে অদ্যাপি কোনো শাস্ত্র কিম্বা বর্ণনে আইসে না ইহাতে এতদ্দেশীয় অনেক লোক অনভ্যাস প্রযুক্ত দুই তিন বাক্যের অন্বয় করিয়া গদ্য হইতে অর্থবোধ করিতে হঠাৎ পারেন না…(বেদান্ত গ্রন্থ ইং ১৮১৫)।
কেবল গদ্যভাষার গড়ন সম্বন্ধে নয়, তার সামাজিক ভূমিকা ও গুরুতা সম্বন্ধে রামমোহন যে কতখানি সচেতন ছিলেন তা এই বক্তব্যটুকু থেকে বোঝা যায়। সাধারণ লোকের গদ্যভাষা পাঠের অভ্যাস নেই, তার পদবিন্যাসের সঙ্গেও তারা পরিচিত নয়। শব্দেরও দারিদ্র্য আছে যথেষ্ট। দৈনন্দিন জীবনের উপযোগী কিছু শব্দ তখন বাংলা ভাষার একমাত্র সম্বল। তা—ই দিয়ে গদ্যভাষার ভিত গড়ে তোলা যে কত কঠিন, তা রামমোহন প্রথমেই উপলব্ধি করেছিলেন। কাব্যাভ্যস্ত কানও তার প্রতিবন্ধক। গদ্যের নতুন বাগভঙ্গি ও পদবিন্যাস সম্বন্ধে পাঠকদের উদ্দেশে তাই তিনি বলেছেন :
বাক্যের প্রারম্ভ আর সমাপ্তি এই দুইয়ের বিবেচনা বিশেষ মতে করিতে উচিত হয়। জে ২ স্থানে যখন যাহা যেমন ইত্যাদি শব্দ আছে তাহার প্রতি শব্দ তখন তাহা সেইরূপ ইত্যাদিকে পূর্বের সহিত অন্বিত করিয়া বাক্যের শেষ করিবেন। যাবৎ ক্রিয়া না পাইবেন তাবৎ পর্যন্ত শেষ অস্বীকার করিয়া অর্থ করিবার চেষ্টা না পাইবেন। কোন নামের সহিত কোন ক্রিয়ার অন্বয় হয় ইহার বিশেষ অনুসন্ধান করিবেন জে হেতু এক বাক্যে কখন ২ কয়েক নাম এবং কয়েক ক্রিয়া থাকে ইহার মধ্যে কাহার সহিত অন্বয় ইহা না জানিলে অর্থজ্ঞান হইতে পারে না…(বেদান্তগ্রন্থ)।
গদ্যভাষার বাগ্ভঙ্গি ও পদবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য যথাসাধ্য বোধগম্য করে ব্যাখ্যানের চেষ্টা এইভাবে রামমোহনের পূর্বে আর কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। বাংলা ভাষায় রামমোহন একখানি ব্যাকরণও লিখেছিলেন। গদ্যভাষা যে প্রধানত সামাজিক ভাববিনিময়ের সামাজিক সাহিত্য রচনার ভাষা, তা রামমোহন রায় বিশেষভাবে অবগত ছিলেন বলেই তাকে সর্বজনবোধ্য করে তোলার জন্য তাঁর এই ব্যাকুলতা। ‘যখন’ ‘যাহা’ ‘যেমন’ ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে ‘তখন’ ‘তাহা’ ‘সেইরূপ’ ইত্যাদি শব্দকে অন্বিত করে বাক্য শেষ করতে হবে, ‘ক্রিয়া’ না—পাওয়া পর্যন্ত কোনও বাক্যে অর্থ করবার চেষ্টা করা উচিত নয় এবং অর্থ করবার আগে কোন নামের সঙ্গে কোন ক্রিয়া অন্বিত তা—ও জানা দরকার। মনে হয় যেন, বাঙালি পাঠককে রামমোহন গদ্যভাষায় হাতেখড়ি দেবার চেষ্টা করছেন। যে গদ্যভাষায় বাংলা গদ্যসাহিত্য গড়ে উঠেছে আধুনিক যুগে, তার প্রথম সচেতন স্রষ্টা রামমোহনকে বলতে তাই অত্যুক্তি হয় না। ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে, যুক্তিতর্ক, বিচার—বিশ্লেষণ ও বাদানুবাদের ভিতর দিয়ে, রামমোহন বাংলা গদ্যভাষার প্রথম বলিষ্ঠ বনিয়াদ গড়ে তুলেছেন এবং তার সামাজিক ও সাহিত্যিক রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন। অনুশীলন ও চর্চার অবসর তিনি তেমন পাননি বলে, এবং সদ্যোজাত গদ্যভাষার দৈহিক গড়নের দিকেই তাঁকে বেশি সচেতন দৃষ্টি দিতে হয়েছিল বলে, রামমোহনের গদ্যভাষা সামাজিক রূপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সাহিত্যিক রূপে বিকাশলাভ করেনি। তা না করলেও, গদ্যভাষার অন্যতম ঐতিহাসিক ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন তিনি। সামাজিক সংযোগধর্ম। এই সামাজিক ধর্মপালনে ব্যর্থতাই গদ্যভাষার চরম ব্যর্থতা বলে স্বীকৃত। তার জন্য আজন্মকাল থেকে গদ্যভাষার প্রধান গুণ হল প্রসাদগুণ সরলতা প্রাঞ্জলতা ও সবলতা। গদ্যভাষা অক্ষমের ভাষা নয়, দুর্জ্ঞেয় মিস্টিকেরও ভাষা নয়। তার সামাজিক দায়িত্ব কাব্যের চাইতে অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ও স্বপ্রকাশ। রামমোহনের রচনায় বাংলায় গদ্যভাষার এই সামাজিক গুণের প্রাধান্যই স্বীকৃতি পেয়েছে।
রামমোহনের সমসাময়িক ও পরবর্তীকালে গদ্যভাষার দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে, সামাজিক জীবনের দ্রুত প্রবাহের জন্য। বাইরের সমাজের সঙ্গে গদ্যভাষার ও গদ্যসাহিত্যের সম্পর্ক যে কত প্রত্যক্ষ ও গভীর তা ১৮৩০ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত বাংলা গদ্যের ধাপে ধাপে অগ্রগতি থেকে বোঝা যায়। এইসময় সামাজিক আন্দোলনের পুরোভাগে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই গদ্যভাষার প্রধান রচয়িতা ছিলেন। যেমন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলা সাময়িকপত্রের মাধ্যমেই এইসময় গদ্যভাষা গঠিত হতে থাকে এবং আলোচনা ও বিতর্কই তার উপজীব্য হয়ে ওঠে। অক্ষয়কুমার ও বিদ্যাসাগর গদ্যভাষার গড়নের কাজে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘বিদ্যাসাগর বাঙ্গলাভাষার প্রথম শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাঙ্গলায় গদ্যসাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথম বাঙ্গলা গদ্যে কলা—নৈপুণ্যের অবতারণা করেন।’ বাংলা ভাষার একজন অদ্বিতীয় শিল্পীর এই স্বীকৃতি কেবল পূর্বসূরির কাছে ঋণস্বীকার বা শ্রদ্ধাপ্রকাশ নয়। এর মধ্যে ঐতিহাসিক সত্যেরই স্বীকৃতি রয়েছে। রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের সমসাময়িককালে যাঁরা বাংলা গদ্যভাষা রচনা করেছেন, অনেক দিক দিয়ে গদ্যের কাঠামো তৈরিতে তাঁরা সাহায্য করেও, তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যটি ধরতে পারেননি। তাই বাইরের কাঠামো বা স্ট্রাকচার তৈরির জন্যই তাঁদের মেহনত করতে হয়েছে বেশি। কাব্যের ছন্দ ও শব্দের ঝংকারের মধ্যে, ধ্বনি—প্রতিধ্বনির মধ্যে তার সৌন্দর্য যেমন স্বভাবতই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, তেমনি গদ্যভাষারও যে নিজস্ব একটা গতির সৌন্দর্য আছে, যা শব্দবিন্যাস ও বাগভঙ্গির ভিতর দিয়ে প্রকাশ করা যায়, সে সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের আগে আর কোনও গদ্যরচয়িতা তেমন সজাগ ছিলেন না। হয়তো নতুন যুগের মানুষের ভাবপ্রকাশের বাহন গদ্যভাষার এই সৌন্দর্য সম্বন্ধে তাঁদের বোধও ছিল না তেমন। রামমোহন যে এ সম্বন্ধে একেবারে অচেতন ছিলেন তা মনে হয় না। কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামাজিক কারণেই বাংলা গদ্যের শৈল্পিক রূপায়ণে তিনি মনোনিবেশ করতে পারেননি। রামমোহনের গদ্যরচনা পড়লে বোঝা যায়, গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল শব্দজনতাকে তিনি সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত করতে পারেননি। সে—কৌশল তাঁর অনায়ত্ত ছিল। তাঁর সমকালীন পরবর্তী লেখকরাও এই পদবিন্যাস ও শৃঙ্খলার কলাকৌশল আয়ত্ত করতে পারেননি। আয়ত্তের প্রথম আভাস পাওয়া গেল বিদ্যাসাগরের রচনা থেকে। ১৮৪৭ সালে যখন তাঁর ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ প্রকাশিত হল, তখনই বোঝা গেল, বাংলা গদ্যভাষা তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করেও অদূর ভবিষ্যতে সাহিত্যেরও বাহন হয়ে উঠবে। বিদ্যাসাগর এই ভাষায় লিখলেন :
পরিশেষে, নানা সঙ্কট হইতে উত্তীর্ণ হইয়া, রাজা নির্দিষ্ট প্রেতভূমিতে উপনীত হইলেন; দেখিলেন, কোন স্থলে অতি বিকটমূর্তি ভূতপ্রেতগণ, জীবিত মনুষ্য ধরিয়া, তাহাদের মাংস ভক্ষণ করিতেছে; কোন স্থলে ডাকিনীগণ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালক ধরিয়া, তদীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চর্বণ করিতেছে। (বেতাল পঞ্চবিংশতি, ১৮৪৭)
এ ভাষা কেবল গদ্যভাষা নয়, গদ্যসাহিত্যও। শব্দচয়ন ও বিন্যাসের ভিতর দিয়ে ভাষার শিষ্টতাগুণের প্রতি রচয়িতা যে গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তা বাংলা গদ্যে একেবারে নতুন। রামমোহন রায় ‘অন্বয়’ সম্বন্ধে পাঠকদের বিস্তারিত উপদেশ দিয়েও যা করতে পারেননি, বিদ্যাসাগর তা অনায়াসেই করতে পেরেছিলেন, করবার কলাকৌশলটি আয়ত্তে ছিল বলে। রামমোহন ‘যখন’ শব্দের সঙ্গে ‘তখন’, ‘যেমন’ শব্দের সঙ্গে ‘তেমন’, বাক্যের সঙ্গে ক্রিয়ার অন্বয় সম্বন্ধে পাঠকদের সচেতন হতে বলেও তার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারেননি। কিন্তু গদ্যের পদবিন্যাস বা বাক্যের অন্বয় সম্বন্ধে এত কথা না বলেও বিদ্যাসাগর সার্থক হয়েছিলেন সুন্দর গদ্যরচনায়। তার কারণ কমা সেমিকোলন পূর্ণচ্ছেদ দিয়ে তিনি প্রথমত উচ্ছৃঙ্খল শব্দজনতাকে শৃঙ্খলিত করেছিলেন পদে পদে। বাক্যের অসংযত গতির মধ্যে সংযম এনেছিলেন। কোন শব্দের সঙ্গে কোনটা অন্বিত, কোথায় বাক্যের আরম্ভ, কোথায় সমাপ্তি, তা পাঠককে ভেবেচিন্তে সাবধান হয়ে সন্ধান করতে হয় না। স্বচ্ছন্দে সে গদ্যরচনা পাঠ করতে পারে। শদ থেকে শব্দান্তরে, কর্তা কর্ম থেকে ক্রিয়ায়, বাক্য থেকে বাক্যান্তরে যাত্রা করতে তার কোনও বাধা থাকে না। শব্দের ভিড়ের মধ্যে অন্বয়ের সূত্র হারাবারও কোনও সম্ভাবনা থাকে না। পাঠান্তে অর্থবোধ সহজেই হয়। শব্দের জনতাকে একবার এইভাবে সংযম শিক্ষা দিতে পারলে তখন তার নিজস্ব শ্রীবৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়। বিদ্যাসাগর সেদিকেও দৃষ্টি দিয়েছিলেন। শব্দের বিন্যাস—সংযম ও ধ্বনিমাধুর্যের সংমিশ্রণ তিনিই ঘটিয়েছিলেন বাংলা গদ্যভাষায়। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক শিল্পী বলে অভিনন্দিত করেছেন।
অল্পকালের মধ্যেই বাংলা গদ্যভাষা বিদ্যাসাগরের হাতে বেগবতী ও বলবতী হয়ে উঠল। রামমোহনের মতো তাঁকেও সংস্কার আন্দোলনে বহু সামাজিক সমস্যার বিচারে, বিতর্কে ও বাদানুবাদে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। সমাজজীবনের প্রত্যক্ষ ঘাতপ্রতিঘাতে, বাংলা গদ্যভাষার প্রথম শিল্পী বিদ্যাসাগর, গদ্যের নীরস যুক্তি ও বুদ্ধির মধ্যে প্রাণের আবেগও সঞ্চারিত করেন। যুক্তির ও বুদ্ধির অনিরুদ্ধ বেগের সঙ্গে যখন শিল্পী বিদ্যাসাগর তাঁর রচনায় প্রাণের আবেগও মিশিয়ে দিলেন, তখন গদ্য নিঃসন্দেহে কাব্যের পাশে তার স্বতন্ত্র সাহিত্যিক আসন সগর্বে অধিকার করে বসল। যেমন—
ধন্য রে দেশাচার! তোর কি অনির্বচনীয় মহিমা! তুই তোর অনুগত ভক্তদিগকে, দুর্ভেদ্য দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ রাখিয়া, কি একাধিপত্য করিতেছিস। তুই ক্রমে ক্রমে আপন আধিপত্য বিস্তার করিয়া, শাস্ত্রের মস্তকে পদার্পণ করিয়া, ধর্মের মর্মভেদ করিয়াছিস, হিতাহিতবোধের গতিরোধ করিয়াছিস, ন্যায়—অন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করিয়াছিস। (বিধবাবিবাহ, ১৮৫৫)
শব্দগুলি যেমন বলিষ্ঠ তেমনি বেগবান। ক্রিয়াপদের প্রসারতায় বেগ সঞ্চারিত হয়েছে পদে পদে। পদবিন্যাসে শ্লিষ্টতাগুণ অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অথচ বাক্যের এমনই গড়ন ও গতি যে তরঙ্গের উত্থান—পতনের অনুভূতি তার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলংকারিকেরা ‘স্টাইল’ বা বাক্যরীতির যে কয়টি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে গদ্যভাষা প্রসঙ্গে প্রধান হল ‘শ্লেষগুণ’ ও ‘প্রসাদগুণ’। এই দুটি গুণেই বিদ্যাসাগরের ভাষা উজ্জ্বল। শ্লেষগুণই বোধহয় গদ্যরীতির প্রাণ। দণ্ডী বলেছেন, ‘শ্লিষ্টমস্পৃষ্ঠশৈথিল্যম্’। অর্থাৎ শ্লিষ্টবাক্য তাকেই বলে, শৈথিল্য যাকে স্পর্শ করতে পারে না। অথচ বামনের মতো তা হবে মসৃণ—’মসৃণত্বং শ্লেষঃ’। আঁটসাঁট বাক্যের গঠনের মধ্যে বিদ্যাসাগর এই মসৃণতা দান করে, সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যভাষার সাহিত্যিক ‘স্টাইল’ প্রবর্তন করেন। দীর্ঘ—সমাসবদ্ধ ও মহাপ্রাণ বর্ণের বাহুল্যদোষে মধ্যে মধ্যে বিদ্যাসাগরের গদ্যরচনা মন্থরগতি, সংস্কৃতগন্ধী ও ভারাক্রান্ত হয়েছে সত্য। তাঁর কালে সংস্কৃত ভাষার অপ্রতিহত প্রতাপ খর্ব হয়নি। এ কথা স্মরণ করে, যদি পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রর সাহিত্যিক রচনার সঙ্গেও বিদ্যাসাগরের রচনার তুলনা করা যায়, তাহলে দেখা যায়, বঙ্কিমচন্দ্রও বিদ্যাসাগরের দোষ থেকে মুক্ত হতে পারেননি। সংস্কৃতের প্রতিপত্তির যুগে বাস করেও বিদ্যাসাগর যে গদ্যভাষা সাহস করে রচনা করেন তা—ই পরবর্তীকালে আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ভাষারূপে প্রচলিত ও গৃহীত হয়েছে। দীর্ঘ—সমাস ও মহাপ্রাণ বর্ণের মধ্যে সুকৌশলে স্বল্পপ্রাণ বর্ণের ও ছোট ছোট টুকরো কথার সন্নিবেশে বিদ্যাসাগর যে আদর্শ বৈদর্ভী গদ্যরীতির ভিত গড়ে তুলেছিলেন, আজও তা সাধুরীতির সীমানার মধ্যে খুব বেশি বদলাবার প্রয়োজন হয় না। বাংলা গদ্যরীতির আজ নতুন নতুন পরীক্ষা চলছে, তার ভাঙন—গড়নের পর্ব চলছে। সমাজের জীবনস্রোতের প্রখরতা, গভীরতা ও জটিলতা বৃদ্ধির জন্য ক্রমেই সাধুভাষা ও কথ্য ভাষার ব্যবধান ভেঙে যাচ্ছে। কথ্য ভাষার প্রাণপ্রবাহ ও গতিশীলতা লেখ্য—গদ্যরীতির মধ্যে সঞ্চারিত করে তার নতুন ভিত রচনার চেষ্টা হচ্ছে। তার জন্য আজ বোধহয় আমরা বাংলা গদ্যের শব্দদৈন্য ঘোচাবার জন্য সংস্কৃতের দ্বারস্থ হবার প্রয়োজন আরও বেশি করে বোধ করছি। যতদিন তা বোধ করব এবং যতদিন সাধুভাষার গণ্ডি একেবারে অতিক্রম করতে পারব না আমরা, ততদিন বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদি শিল্পী বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতির অনুশীলন করা আমাদের স্বার্থেই প্রয়োজন হবে।
১৩৬৪
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন