অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ

বিনয় ঘোষ

অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ

পাতলুন আঁটলুম, বড়লোক চাটলুম, তারপর কী? কী? কী? জিজ্ঞাসা করেছেন, আধুনিক কবি। কিছুই না। জীবনটা খাড়া—বড়ি—থোড়। খাড়া—বড়ি—থোড়। খাড়া—বড়ি, খাড়া—বড়ি, থোড়—থোড়—থোড়।

হয়তো তা—ই। হয়তো কেন, সত্যিই তা—ই। পৃথিবীতে যত সমুদ্র, তত বালুতট এবং সমস্ত বালুতটে যত বালুকণা আছে তার একটিমাত্র বালুকণা—মানুষ। সেই বালুকণার জীবন নিয়ে এত প্রশ্ন কেন? জীবনটা যদি সত্যিই খাড়া—বড়ি—থোড় হয়, জেমস জয়েসের (James Joy‘ee) ভাষায়—‘their weatherings and their marryings and their buryings and their natural selections’—‘a humanpest cycling (pis!) and recycling (pas!)’—তাহলে এত প্রশ্ন কেন? যেহেতু বালুকণাগুলো বালু নয়, মানুষ—এবং বালুতটে আমরা বাস করি না, বাস করি জীবনের তটে—সমাজে।

থোড়—বড়ি—খাড়া ছন্দ চক্রবৎ ঘূর্ণনের ছন্দ। পিস্টনের ছন্দ, বৈদ্যুতিক হাতুড়ির ছন্দ। যন্ত্রযুগেরই সমাজের যান্ত্রিক ছন্দ। যন্ত্রের প্রথম আবির্ভাবকালে সত্যদর্শী অনেক কবি তাকে কাব্যে রূপায়িত করতে চাননি। ওয়াল্ট হুইটম্যান বা টেনিসন সকলে নন এবং প্রবল উচ্ছ্বাসের বশবর্তী হয়ে তাঁরা হুইটম্যানের মতা ‘হু—র—রে’ বলে বিজ্ঞান ও যন্ত্রকে অভিনন্দন জানাননি :

Hurrah for positive science!
long live exact demonstration!

এডগার অ্যালান পো—র (Edgar Allan Poe) মতে কেউ কেউ বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ কুৎসিত রূপ প্রত্যক্ষ করে তাকে—‘vulture whose wings are dull realities’—বলে বর্ণনা করেছিলেন। যন্ত্রবিজ্ঞানের যুগে ব্যস্তবাগীশ জীবনের কথা ভেবে ম্যাথু আর্নল্ডের মতো যাঁরা বলেছিলেন :

this strange disease of modern life
with its sick hurry, its divided aims—

তাঁদের কথা সত্য হয়েছে কি মিথ্যে হয়েছে, তা নিয়ে তর্কের অবতারণা করে লাভ নেই, কারণ তর্কে সব ‘বস্তু’ মেলে না। বিজ্ঞানের আশীর্বাদকে কোন কবি ও শিল্প উপেক্ষা করেননি। মানুষের জীবন ও সামজকে অনেক সংকীর্ণতা থেকে বিজ্ঞান যে মুক্তি দিয়েছে এ কথা ঊনিশ শতকের শিল্পী ও দার্শনিকরা জানতেন, এবং আজকের বিশ শতকের শিশুরাও তা জানে। সমস্যাটা বিজ্ঞান বা যন্ত্র নিয়ে নয়, যন্ত্রের ক্রীতদাস মানুষকে নিয়ে। বহু যুগের শিশু—মানুষ বিজ্ঞানের প্রচণ্ড শক্তি আয়ত্ত করে হঠাৎ যেদিন যৌবনে পদার্পণ করল, সেদিন সেই শক্তির দাসত্বের কথা তার সুদূর কল্পনাতে স্থান পায়নি। কিন্তু যন্ত্রযুগের অগ্রগতি যত দ্রুত হতে থাকল তত গোলামের প্রভাব বাড়তে লাগল প্রভুর উপর। বিজ্ঞান ও যন্ত্রের যত উন্নতি হল, মানুষের তত উন্নতি হল না। বৈজ্ঞানিক শক্তি বিকাশের তালে তালে মানবিক শক্তির অবনতি ঘটতে লাগল। দুর্বৃত্তের হাতে ধারালো অস্ত্র দিলে যা হয়, অথবা দুষ্টবুদ্ধি বালকের হাতে আগুন, মানুষের হাতে বিজ্ঞানেরও অবস্থা হল তা—ই। সুতরাং অপরাধটা বিজ্ঞানের নয়, বিজ্ঞানীর নয়, যন্ত্রের নয়, যন্ত্রীরও নয়—অপরাধ মানুষের স্বভাবের ও প্রবৃত্তির। সমস্যাও বিজ্ঞান বা যন্ত্রের নয়—সনাতন মানুষের।

দেখা গেল, মানুষের জীবনের নিভৃততম কোণটি পর্যন্ত যন্ত্র চুপিসারে প্রবেশ করেছে। যন্ত্রের মতো মানুষও হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক। সম্প্রতি এই যন্ত্রের জীবনেও যুগান্তকারী সব ঘটনা ঘটছে। অনেক বিস্ময়কর যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে এতদিন, অনেক অসাধ্যসাধনও তারা করেছে, কিন্তু পদে পদে তাদের কর্মশক্তি নিয়ন্ত্রণ করেছে যন্ত্রকুশলী শ্রমিক, টেকনিশিয়ান ও ইঞ্জিনিয়ার। যন্ত্র এবারে নিজেই সাবালক হয়ে উঠছে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিপ্রহরে যন্ত্র পরনির্ভর না হয়ে ক্রমেই আত্মনির্ভর হয়ে উঠেছে। বর্তমান যুগ স্বয়ংক্রিয় আত্মনির্ভর যন্ত্রের যুগ অর্থাৎ অটোমেটিক যন্ত্রের যুগ। যন্ত্রের স্বয়ংক্রিয়তা (automation) যত দ্রুত বাড়ছে, তত যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের প্রত্যক্ষ সম্পর্কটুকু দিন দিন ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রের উপর মানুষের যেটুকু কন্ট্রোল’ ছিল, তা—ও আর থাকছে না। মানুষের মতো যন্ত্রও আজ তার স্বাতন্ত্র্য অর্জন করছে। কিন্তু মানুষ যখন তার স্বাতন্ত্র্যকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হচ্ছে তখনই ঠিক যন্ত্র হয়ে উঠেছে আত্মনির্ভর ও আত্মপ্রতিষ্ঠ। এই দুইটি ঘটনার সমাবেশ—মানুষর স্বতন্ত্রতা বর্জন এবং যন্ত্রের স্বাতন্ত্র্য অর্জন—সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাসে বোধহয় সবচেয়ে বড় বৈপ্লবিক ঘটনা। এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে মানুষ এখনও সচেতন নয়, কারণ পরিবর্তনের দ্রুততা এত ক্ষিপ্র ও অপ্রত্যাশিত যে চেতনাস্তরে তা সহজে দাগ কাটতে পারছে না। তা না পারলেও, যান্ত্রিক অটোমেশনের প্রবল সামাজিক প্রতিক্রিয়া তার জন্য বন্ধ হয়ে থাকবে না। দ্রুত পরিবর্তনের সময় সামাজিক চেতনার প্রবাহ সহজে তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে না। ধীরেসুস্থে চেতনার তরঙ্গ সৃষ্টি হতে থাকে এবং যখন বাইরের পরিবর্তনের আঘাতে তাতে ঢেউ ওঠে, তখন চোখ মেলে সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখা যায় যে তার বাহিরে তো বটেই, পুরানো অন্তরটা পর্যন্ত ক্ষয়ে ক্ষয়ে একেবারে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছে। বলা যায় না আমাদের আধুনিক যুগের এই উনিশশতকী পুরানো অন্তরটা এরই মধ্যে অন্তঃসারশূন্য হয়ে গিয়েছে কি না। বলা যায় না! অনুভূতিতে মনে হয়, সেইসব সুন্দর সুন্দর নিটোল আদর্শ, ভাবঅনুভাব, ধ্যানধারণা, যা দিয়ে শতবর্ষ আগে বিজ্ঞানের শৈশবকালে মানুষ তার মানসলোকে স্বর্গ রচনা করেছিল, আজ বিজ্ঞানেরই অভিশাপে সেই স্বর্গ থেকে সে নির্বাসিত হয়েছে। অনেক সোনার স্বপ্ন, অনেক হিরের টুকরো সব ধারণা, অনেক নীলকান্তের মতো নীতিকথা, অনেক গিরিশৃঙ্গের মতো উত্তুঙ্গ সব মানবিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক আদর্শ—সব একে একে যন্ত্রের নির্মম ঘর্ঘর শব্দে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। কবি টি.এস. এলিয়টের কালযন্ত্রের (Time Machine) চেয়ে কঠোর এই যন্ত্র, কারণ আধ্যাত্মিক কবি—কল্পনা—মণ্ডিত নয় তার রূপ। এ যেন কতকটা জেমস জয়েসের ‘হোলমোল মিলহুইলিং ভিকোসাইক্লোমিটার’ (‘Wholemole Millwheeling Vicociclometer’)—যে ভিকোসাইক্লোমিটার যন্ত্রের খাঁজকাটা চক্রে বিদ্ধ হয়ে আমরা—সমাজের সোনার চাঁদ ছেলেরা থেকে আরম্ভ করে বাতিল বাউন্ডুলেরা পর্যন্ত—সতত ঘুরপাকি খাচ্ছি। এবং জীবনের চারিদিকে একটি ‘বিষাক্ত বৃত্ত’ (vicious circle) রচনা করে, তার মধ্যে বন্দি হয়ে পরম আত্মতৃপ্তি লাভ করছি।

চক্রবৎ ঘূর্ণ্যমান ভিকোসাইক্লোমিটার যুগে আমরা পৌঁছে গিয়েছি বললেও ভুল হয় না। আজকের যুগকে কেবল যন্ত্রযুগ বললে সবটুকু বলা হয় না। বলা উচিত ‘অটোমেটিক যন্ত্রের যুগ’ বা ‘অটোমেশনের যুগ’। এর মধ্যে যান্ত্রিক অটোমেশন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যন্ত্রবিদ, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, শিল্পপতি, শ্রমিক প্রভৃতি সমাজের প্রায় সর্বশ্রেণির লোকের মধ্যে বিপুল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। অটোমেশনের সামাজিক প্রতিক্রিয়া যদি একমুখী বা দ্বিমুখী হত, তাহলে এত বেশি উত্তেজনার সৃষ্টি হয়তো হত না। এ কেবল বিস্ময়ের উত্তেজনা বা চাঞ্চল্য নয়, মানুষের বুদ্ধির চরম বিকাশকালে তার ভিতপর্যন্ত কাঁপিয়ে তোলার উত্তেজনা। মনে হয় যেন, মানুষের পর্বতপ্রমাণ বুদ্ধির গলার পিছনে থেকে কে অজ্ঞাতসারে দড়ির ফাঁস পরিয়ে দিয়েছে। বুদ্ধি যখন স্পুৎনিকের দম নিয়ে আকাশ ফুঁড়ে উড়তে চাইছে তখনই আবার ডানাকাটা বলাকার মতো মাটিতেই আছড়ে পড়তে চাইছে সে, এবং বুদ্ধিবিভ্রম ঘটছে পদে পদে। যান্ত্রিক অটোমেশন যে মানুষের ক্ষুরধার বুদ্ধির বিজয় অভিযানের অকাট্য প্রমাণ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন রাজ্য এবং কার রাজ্য জয়ের অভিযান এই অননুমেয় অটোমেশন? কার জন্য অটোমেশন, কীসের জন্য অটোমেশন?

এ প্রশ্ন আজ মানুষের মনে জেগেছে এবং যত দিন যাচ্ছে তত প্রশ্নটি জটিলতর হয়ে উঠছে। সমাজে যখন কোনও সমস্যা দেখা দেয় তখন সমাজের নানা লোক নানাদিক থেকে সেই সমস্যার ব্যাখ্যা—বিচার করতে চেষ্টা করে। অটোমেশনের ক্ষেত্রেও তা—ই হয়েছে। নানা শ্রেণীর লোকের নানা মতের কলরব শোনা যাচ্ছে অটোমেশন কেন্দ্র করে। কয়েকটির পরিচয় দিচ্ছি। প্রথমে ধনিকশ্রেণীর কথা বলব। আজকের টেকনোলজিক্যাল অগ্রগতি প্রধানত ধনিকদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার পোষকতার জন্য যে সম্ভব হয়েছে, এ কথা বোধহয় গরিবরাও অস্বীকার করবেন না। ধনিকশ্রেষ্ঠ আমেরিকার শিল্পপতিরা অটোমেশনকে সানন্দে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন’ :

We stand on the threshold of a golden future. The worker should await it with hope; not fear. Automation is the magic key to the creation of wealth, and not a crude instrument of destruction; the worker’s talent and knowledge will continue to be rewarded in the coming fabulour earthly paradise served by the infallible, tireless activity of automation, guided by electronic instruments, the magic carpet of our free economy is advancing towards horizons of which we have never even dreamed.

আমেরিকার শিল্পপতিদের বক্তব্য হল : আমরা এক স্বর্ণযুগের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। অটোমেশন সেই স্বর্ণযুগের অগ্রদূত। শ্রমিকদেরও তার প্রতীক্ষায় থাকা উচিত—আশান্বিত হয়ে, সন্ত্রস্ত হয়ে নয়। অটোমেশন হল সেই সোনার চাবিকাঠি যার স্পর্শে অফুরন্ত সম্পদ উৎপন্ন হবে, কোনও কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে না। ভবিষ্যতের অটোমেশনের যুগের ভূস্বর্গে দক্ষ শ্রমিকদের জ্ঞানবিদ্যার ও প্রতিভার কদর বাড়বে ছাড়া কমবে না। অটোমেশনের অভ্রান্ত ও অক্লান্ত কর্মকুশলতা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে, আমদের অবাধ অর্থনীতির ‘ম্যাজিক কার্পেট’ এক নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে চলেছে, আগে যার স্বপ্নেও আমরা নাগাল পাইনি কোনদিন।

মার্কিন শিল্পপতি—সমিতির অটোমেশনের ভূস্বর্গের এই ব্লুপ্রিণ্টে ‘শ্রমিক’দের লক্ষ্য করে অনেক আশার বাণী শোনানো হয়েছে। ধান ভানতে শিবের গীত নিশ্চয়ই তাঁরা গাননি, শোনানোর উদ্দেশ্য একটা কিছু আছে। মুনাফাপ্রণোদিত ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অটোমেশন আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হতে পারে। যে যন্ত্র মানুষ চালাত, সেই যন্ত্র কেবল সুইচ টিপে দিলে যখন নিজেই চলতে থাকবে, তখন মানুষ অচল হয়ে যাবে। এই অচল মানুষেরাই হল কলকারখানার শ্রমিকরা। যে শিল্প কারখানায় আগে দশ হাজার শ্রমিক কাজ করত এবং প্রত্যেকে আট ঘণ্টা করে কাজ করে যা উৎপাদন করত, সেই কারখানায় যখন সব অটোমেটিক যন্ত্র চলতে থাকবে, তখন হয়তো এক হাজার দক্ষ শ্রমিক তার দ্বিগুণ পণ্য উৎপাদন করবে। সুতরাং অটোমেশনের ফলে ধনপতি মুনাফাখোররা এক ভয়ংকর উভয়সংকটের সম্মুখীন হয়েছেন। একদিকে বিকট বেকার সমস্যা প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরের মতো হাঁ করে তাঁদের গিলতে আসছে। অন্যদিকে উৎপন্ন পণ্যপ্রাচুর্যের ফলে বাজারে তার আমদানি চাহিদা ছাড়িয়ে উপচে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। মুনাফার অঙ্ক ঠিক রাখার জন্য তৈরি বাজারদরের কৃত্রিম বাঁধও সেই প্রাচুর্যের ফলে মূল্যহ্রাস এবং যান্ত্রিক স্বয়ংক্রিয়তার ফলে কর্মীছাঁটাই বা বেকার সমস্যা। এই দুই সংকটের সাঁড়াশি আক্রমণে ধনিক প্রভুরা আজ উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছেন। শিল্পপতিদের ব্লুপ্রিন্টে তাই বলা হয়েছে, শ্রমিকদের আহ্বান করে, ‘অটোমেশনের জন্য তোমরা ভয় পেয়ো না, আমরা তা—ই দিয়ে ভূস্বর্গ রচনা করব।’

অটোমেশন—ভূস্বর্গের খবর এর মধ্যেই কিছু পাওয়া গিয়েছে। আমেরিকার ট্রেড ইউনিয়নের (A.F.L.) আন্তর্জাতিক সেক্রেটারি ডেলানে (Dewlaney) বলেছেন:

The new machinery can free man from routine and the monotony of labour, but it can also deprive him of work and wages. It can substantially improve living standards and create general abundance, but it can also be the cause of growing surpluses which cannot be utilised because the consumer will not have the necessary purchasing power. It is at present impossible to say whether automation will lead to abundance, or on the contrary, to poverty.

নতুন অটোমেশন যন্ত্র মানুষকে মেহনতের রুটিন ও একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিতে পারে যেমন, তেমনি তাকে কর্ম ও মজুরি থেকে বঞ্চিত করতে পারে। মানুষের জীবনযাত্রার স্তরের উন্নতি ও প্রাচুর্যের সৃষ্টি হতে পারে যেমন, তেমনি আবার প্রাচুর্যের মধ্যেও মানুষের আর্থিক অনটনের জন্য তা ভোগে না লাগতে পারে। এইজন্য এখনই ঠিক বলা যায় না যে অটোমেশনের সামাজিক ফলাফল কী হবে—না হবে।

আমেরিকার বিখ্যাত গণিতবিদ মানসযন্ত্রবিদ্যার (Cybernetics) অন্যতম প্রবর্তক, অধ্যাপক নর্বার্ট ওয়াইনার (Norbert Weiner) অটোমেশনের ভয়াবহ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ইঙ্গিত করে বলেছেন : ‘It is perfectly clear that this (অর্থাৎ অটোমেশন) will produce an unemployment situation with which…even the depression of the 1930’s, will seem a pleasant joke.’ অটোমেশন অদূর ভবিষ্যতে এমন ভীষণ বেকার সমস্যার সৃষ্টি করবে, যার কাছে ১৯৩০—এর ঐতিহাসিক সংকটের কথা মনে হবে একটা মনোরম মশকরার মতো।

মজুরনেতা ও ম্যাথামেটিশিয়ান, কারও ভবিষ্যবাণী হেসে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। ১৯৫৫ সালে আমেরিকার ক্লিভল্যান্ডের একটি আধা—অটোমাইজড কারখানায় ২০০ শ্রমিক প্রতিদিন খেটে ১০০০ রেডিয়ো—সেট তৈরি করত। ১৯৫৮ সালের মধ্যে কারখানাটি পুরো অটোমাইজড হবার ফলে মাত্র চারজন ইঞ্জিনিয়ার গোটা কারখানার কাজ চালাচ্ছে। ১৯৫৩ সালের শেষে আমেরিকার মন্দা—বাজারের ভাঁটার টানে পিটসবার্গের লোহা—ইস্পাতের কারখানায় প্রায় ৪০,০০০ শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়। কারখানা, বলা বাহুল্য, অনেকখানি অটোমাইজড, তাই পরে ১৯৫৫ সালেই দেখা যায় যে কারখানার উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু ১৪,০০০ বেকার শ্রমিককে কাজে পুনর্নিয়োগ করা হয়নি। আমেরিকার তৈল—পরিশোধন কারখানায় অটোমেশনের ফলে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে, কর্মীর সংখ্যা ১৪৭,০০০ জন থেকে ১৩৭,০০০ জন হয়েছে, অর্থাৎ দশ হাজার কর্মী বেকার হয়েছে। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে উৎপাদন বেড়েছে আগের তুলনায় শতকরা ২২ ভাগ, প্রায় এক চতুর্থাংশ। তা ছাড়া, বিশেষজ্ঞরা হিসেব করে দেখেছেন যে অদূর ভবিষ্যতেই, অটোমেশন—ইলেকট্রনিক—সাইবারনেটিক্স ইত্যাদির অগ্রগতির ফলে, বর্তমানে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কার্যপরিচালনার জন্য সেক্রেটারি, ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যাণ্ট, স্টেনো—টাইপিস্ট—ক্লার্ক, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, অডিটর, বুক—কিপার প্রভৃতির যে বিপুল কলেবর বৃদ্ধি হয়েছে, তার শতকরা ৮০ ভাগ, অর্থাৎ পাঁচ ভাগের চার ভাগ ছাঁটাই করে দিলেও কাজকর্ম স্বচ্ছন্দে চলে যাবে, আটকাবে না। অটোমেশনের জন্য কেবল মজুর—টেকনিশিয়ান—ইঞ্জিনিয়াররা নয়, আপিসের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীরা পর্যন্ত কর্মচ্যুত হবে। আধুনিক অর্থনীতির অন্তঃসারশূন্য বাকচাতুরীতে এই বেকার সমস্যাকে বলা হয় ‘technological unemployment’। কিন্তু বেকার যে সে বেকারই, তাকে বিকৃত করে যা—ই বলা হোক—না কেন। বিখ্যাত ব্রিটিশ পণ্ডিত ম্যাগনাস পাইক (Magnus Pyke) বলেছেন : In the United States, where the progress towards ‘‘automation” is further advanced than it is “Great Britain, the gradually increasing freedom from the need to do paid work is being called ‘technological unemployment.’ বিখ্যাত মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ফন্স ও সেপ্পার্ড পরিষ্কার করে বলেছেন যে ‘the rational meaning of thje introduction of automatic machines in industry is that they lead to very substantiol reductions is wages expenditure per unit of production.’ অটোমেশনের ফলে উৎপাদনের প্রত্যেক ইউনিটের মজুরি খরচ যথেষ্ট কমে যায়। তা—ই যদি হয়, তাহলে কারখানা অটোমাইজড (automised) হলে কর্মীদের মজুরিও কমিয়ে দিতে হয়, অথবা তদের কর্মচ্যুত করতে হয়। অটোমেশনের ফলে তা—ই হচ্ছে। ভূস্বর্গের বদলে ভূ—নরকের কুৎসিত পরিবেশে ক্রমে বেকার জীবনের বিভীষিকা বাড়ছে এবং দুঃস্বপ্নের এক দৈত্যপুরী রচনা করছে অটোমেশন।

অতঃপর তাহলে উপায় কী? ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ পল আইনজিগ বলেন যে অটোমেশনজনিত বেকার সমস্যা একেবারে সমাধান করা সম্ভব হবে না, কারণ অটোমশনের ফলে যে সংখ্যক লোক বেকার হবে, অটোমেটিক যন্ত্র নির্মাণের কারখানায় তাদের সকলকে কাজে নিযুক্ত করা সম্ভব হবে না—“It would be unwise to overemphasize the unemployment potentials in these new industries and assume that their growth will be sufficient to take care of displacements in the older industries. সুতরাং বেকারদের জন্য আইনজিগ বিকল্প কর্মের যে প্রস্তাব করেছেন তা এই :

 ১. সব রকমের শিল্পীর কাজকর্মের চাহিদা বাড়বে। মানুষ শ্রমশিল্পের অপ্রীতিকর মেহনত থেকে মুক্তি পেয়ে কলাশিল্পের নিরলস চর্চায় আত্মনিয়োগ করবে।

 ২. শ্রমশিল্পের কারখানা থেকে যারা মুক্তি পাবে তারা কৃষিকর্ম করবে।

 ৩. মেয়েরা বাইরের কাজকর্মের গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়ে গৃহকর্মে মনোনিবেশ করতে পারবে।

আইনজিগের এই বিকল্প সমাধান অনেকেরই হয়তো হাসির উদ্রেক করবে, কিন্তু সমাধানের আর উপায়ই বা কী? আইনজিগের প্রস্তাব শুনে মনে হয়, ভবিষ্যতে আবার আমরা গোরু চরাব, লাঙল চষব, মেয়েরা রান্নাবান্না করবে এবং সকলে ছবি আঁকবে। সব কাজকর্মই হবে শখের ব্যাপার, প্রয়োজনের তাগিদে কেউ কিছু করবে না। কিন্তু সমাধান কি তাতেও হবে? সমাধানের সত্যিকার উপায় অবশ্যই সোশ্যালিজম, কিন্তু সে তো এখনও বুদ্ধিমান মানুষের কাছে আকাশকুসুম হয়ে আছে। সোশ্যালিজমের পরীক্ষা যেসব দেশে আরম্ভ হয়েছে, সেখানে যান্ত্রিক অর্থনৈতিক পরীক্ষার উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আটপৌরে জীবনের অর্থনৈতিক সমাধান হলেই মানুষের চিরকালের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এরকম ধারণা সোশ্যালিস্ট ‘lotuseater’—দের মধ্যে আজও অনেকের থাকলেও, ধারণাটা যে সত্য নয় তা যেসব দেশে কিছুকাল ধরে সোশ্যালিজমের পরীক্ষা চলেছে, সেইসব দেশের রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকটের স্বরূপ বিচার করলে পরিষ্কার বোঝা যায়। অবশ্য বিচারটা খোলা—চোখে করতে হবে। অন্ধ আদর্শবাদের ঠুলি পরে নয়। সোশ্যালিজমের লক্ষ্য হল, নতুন মানুষ ও নতুন সভ্যতা গড়ে তোলা, তার ভিত্তি আর্থিক না মানবিক, তা আজ প্রত্যেক সোশ্যালিস্ট আদর্শবাদীর গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। সোশ্যালিজম মানুষের সামনে এক নতুন সভ্যতার স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল। সেই সভ্যতায়, মানুষ আশা করেছিল, অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক উৎপীড়ন, রাষ্ট্রিক একনায়কত্ব—এসব তো থাকবেই না, মানবিক সদগুণের পূর্ণ বিকাশ হবে, লোভ—হিংসা—বিদ্বেষ ক্ষমতা—লোলুপতা ইত্যাদি মানবসমাজ থেকে ধীরে ধীরে নির্মূল হয়ে যাবে এবং মানুষের স্বাধীন চিন্তাভাবনার বিকাশের পথে কোথাও কোন অন্তরায় থাকবে না। কিন্তু মানুষের এই স্বপ্ন ও প্রত্যাশা সার্থক হয়েছে কি? তার চেয়েও বড় কথা, সার্থক হবে কি কোন দিন?

এত বড় প্রশ্নের উত্তর দেবার সাধ্য আমাদের নেই। আমরা দেখেছি, সোশ্যালিজমের সংগ্রাম যান্ত্রিক টেকনোলজির সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। প্রতিযোগিতা চলেছে—শ্রেষ্ঠ ধনতান্ত্রিক দেশের টেকনোলজির সঙ্গে, শ্রেষ্ঠ সমাজতান্ত্রিক দেশের টেকনোলজির। অর্থাৎ নিছক যন্ত্রের প্রতিযোগিতা। কিন্তু কথা তা ছিল না। অন্তত যখন সমাজতন্ত্রের রঙিন ফানুশ পৃথিবীর সর্বস্বহারা অসহায় মানুষের সামনে ওড়ানো হয়েছিল। যন্ত্রের প্রতিযোগিতার প্রয়োজন যে নেই তা নয়, যথেষ্ট আছে। ধনতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক উৎপাদনের প্রতিযোগিতা করতে হলে, এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাচুর্য আনতে হলে যন্ত্র ও টেকনিকের দিক থেকে পিছিয়ে থাকলে চলে না। তাদের সমকক্ষ তো হতেই হয়, ছাড়িয়ে যেতে পারলে আরও ভালো হয়। সোশ্যালিস্ট দেশের এ উদ্যম প্রশংসনীয়। কিন্তু সোশ্যালিজমের মতো অত বড় একটা আদর্শ যদি কেবল যান্ত্রিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। পণ্যময়তা ও যন্ত্রময়তাই যদি তার ধর্ম হয়ে ওঠে, এবং সেই প্রচুর পণ্য ও বিরাট বিরাট সব যন্ত্রের তলা দিয়ে যদি আসল মানুষ ড্রেনের আবর্জনার মতো ভেসে যায়, অথবা যদি তারা সেইসব ‘ভিকোসাইক্লোমিটার’ যন্ত্রের নাটবল্টু শ্যাফট—হুইল কলকবজায় পরিণত হয়, তাহলে ইতিহাসের অন্য সব বড়—বড় আদর্শের মতো, বাস্তব আচরণকালে সোশ্যালিজমেরও চরম বিকৃতি ঘটেছে বলে মনে করতে হবে।

কথা ছিল, ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে সোশ্যালিজমের সংগ্রাম হবে আদর্শের সংগ্রাম, নীতির সংগ্রাম, মানবতার সংগ্রাম, নতুন সমাজ—সভ্যতা গড়ার সংগ্রাম। কথা ছিল সাধারণ মানুষ অকুতোভয়ে তাদের জীবন বলিদান দেবে সেই মহান আদর্শের জন্যে। তারপর যখন বাস্তবে রূপায়িত হবে সেই আদর্শ তখন মানুষের জীবনধারণের গ্লানি আর থাকবে না, মানুষকে মানুষ আর শোষণ করবে না, ক্রীতদাস যুগের স্বেচ্ছাচারী প্রভুর মতো চাবুক মেরে শাসন করবে না, মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রীতির সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য স্থাপিত হবে, যুগযুগান্তর পরাধীন মানুষ স্বাধীন হবে, মুষ্টিমেয় একদল মানুষ ‘রাষ্ট্র’ (state) নামক বিকট ভিকোসাইক্লোমিটার যন্ত্রের স্টিমরোলার সাধারণের বুকের উপর দিয়ে নির্বিবাদে চালাবে না, অর্থের পদমর্যাদার ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের লোভ—মোহ মানুষের থাকবে না, মানুষের সমাজ থেকে হিংসা—বিদ্বেষের বিষ ধুয়ে মুছেযাবে, এবং প্রেম—ভালোবাসা—মমতা—মানবতা ইত্যাদি যা ধনতান্ত্রিক সমাজের cashnexus-এ আবদ্ধ হয়ে প্রাণহীন যান্ত্রিকতায় পরিণত হয়েছে, সমাজতত্ত্বের সোনার কাঠির স্পর্শে তা প্রাণময় মানবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু এত কথার একটি কথাও কি সত্য হয়েছে? প্রায় অর্ধশতাব্দীর সোশ্যালিজমের পরীক্ষার পরে যে সমাজ ও সভ্যতার চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার নতুনত্ব কোথায়? আকাশ বিদীর্ণ করে মানুষের কত ‘স্লোগান’, কত লড়াইয়ের আওয়াজ, বুকফাটা আর্তনাদের মতো শহর গ্রামের পথে পথে ধ্বনিত হয়েছে, হাজার হাজার ‘মাইকে’ প্রতিধ্বনিত হয়ে কত ছোট—বড়—মাঝারি নেতার কত কোটি কোটি গালভরা কথা ঘুমপাড়ানি গানের মতো সাধারণ মানুষকে স্বপ্নের কোলে ঘুম পাড়িয়েছে, উৎসাহিত করেছে তাদের দলে দলে মৃত্যুবরণ করতে, কিন্তু তার বিনিময়ে তারা পেয়েছে কি? তারা পেয়েছে এমন একটি সমাজ যেখানে বড় বড় যন্ত্র চলছে, বিকটাকার সব মহাযন্ত্র, অটোমেটিক যন্ত্র, যেখানে স্পুৎনিক উড়ছে চন্দ্রালোকে—কিন্তু যেখানে মানুষের সনাতন শঠতা, দীনতা ও ক্ষমতালোলুপতার খেলা শেষ হয়নি, যেখানে নিষ্ঠুরতা আকাশ ফুঁড়ে উঠেছে স্পুৎনিকের মতো, যেখানে অটোমেটিক যন্ত্রের মতো দেবতুল্য নেতারা রাতারাতি দানবমূল্য হয়ে যায় এবং কালকের নরকের কীট আজকেই চতুর্দোলায় চড়ে লক্ষ লক্ষ লোকের শোভাযাত্রার ঢেউয়ে হেলেদুলে চলে বেড়ায়, যেখনে বন্দি মানুষের লক্ষ বছরের স্বপ্ন, স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও বাকশক্তি স্ফূর্তির স্বপ্ন ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছে, এবং যেখানে ধনতান্ত্রিক জগতের সঙ্গে সর্বাত্মক মারণাস্ত্রের ও অটোমেটিক যন্ত্রের প্রতিযোগিতা চলছে সমাজতন্ত্রের নামে। জীবনের কী আছে সেখানে? ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী—র, পিতার সঙ্গে পুত্রের, প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের সমস্ত স্বাভাবিক ও মানবিক সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে সেখানে। এবং সকলেই রাষ্ট্রযন্ত্র ও পার্টিযন্ত্রের গুপ্তচর হয়ে এক অভিশপ্ত চক্রান্তের পাতালপুরীতে বাস করছে। শিল্পী পাস্তেরনাক (Boris Pastemak) তাই ‘ডক্টর জিভাগো উপন্যাসে’ লারার মুখ দিয়ে বলেছেন :১০ ‘The whole human way of the life has been destroyed and ruined. All that’s left is the naked human soul stripped to the last shred…You and I are like Adam and Eve, the first two people who at the beginning of the world had nothing to cover themselves with…and now at the end of it we are just as naked and homeless.’ এত স্লোগান, এত মেঠো বক্তৃতা, এত বেতার—প্রেসের প্রচার ও পোস্টার, গোলগাল নাদুসনুদুস মোলায়েম বুলির এত বিপুল বন্যা, এত শহিদের শোণিতসমুদ্র, এত স্ট্যাটিসটিক্সের ভেলকি, এত ‘ইডিয়োলজি’র অ্যালকোহল পানের পর, রাম—রাবণের এত প্রলয়ংকর যুদ্ধের শেষে—অবসন্ন মানুষ চোখ মেলে দেখছে যে আজও সে সোনালি আদর্শের স্বর্ণমৃগের পশ্চাদ্ধাবন করছে, সমাজের দুশমন রাবণদের বধ করা সম্ভব হয়নি, এবং সাম্যের রামরাজ্যও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তা সমস্যা আদিকালেও যা ছিল আজও তা—ই আছে, কেবল তার বাইরের আবরণটা বদলেছে মাত্র। সোশ্যালিস্ট দেশেও আমরা অটোমেটিক যন্ত্রপুরী প্রতিষ্ঠা করেছি, ঠিক ধনতান্ত্রিক দেশের মতো। মানুষের মন এক ইঞ্চিও উন্নত হয়নি। মানুষের বোধশক্তি এক কাঁচ্চাও বাড়েনি। মানুষের ‘মনুষ্যত্ব’ চূর্ণ করে দিয়েছে অটোমেটিক যন্ত্র এবং তার প্রতিরূপ পলিটিক্যাল পার্টি, বাকি আমরা সকলে ফাঁপা মানুষ—‘hollow men’—

Our dried voices, when
We whisper together
Are quiet and meaningless

T.S. Eliot

আমরা সব ধুঁকছি, আর বেঁচে আছি, মরতে মরতেও বলছি বাঁচতে চাই, কিন্তু বাঁচছি কই! মরছি ক্যান্সারে আর কার্ডিয়াক হেমারেজে—স্লোগানের ক্যাপসুলে মোড়া বড় বড় সব আদর্শ চর্বিতচর্বণ করছি—আর ধুঁকছি। ডক্টর জিভাগোর সমস্ত উক্তির মধ্যে আমার সবচেয়ে স্মরণীয় হল এইটি :

Microscopic forms of cardiac hemorrhages have become very frequent in recent years. They are not always fatal. Some people get over them. It’s a typical modern disease. I think its cause are of a moral order. The great majority of us are required to lead a life of constant, systematic duplicity. Your health is bound to be affected if, day after day, you say the opposity of what you feel, if you grovel before what you dislike and rejoice at what brings you nothing but misfortune. Our nervous system isn’t just a fiction, it’s part of our physical body and our soul exists in space and is inside us, like the teeth in our mouth. It can’t be violated with impunity.

Dr. Zhivago, P. 483

সম্প্রতি ”কার্ডিয়াক হেমারেজ” মানুষের একটা সাধারণ ব্যাধি হয়েছে। সব সময় তা হয়তো ভয়াবহ হয় না। অনেকে তার আঘাত এক—আধবার সামলেও ওঠে। এটি একটি টিপিক্যাল আধুনিক ব্যাধি। কিন্তু আমার মনে হয় এ ব্যাধির কারণ হল নৈতিক কারণ। আজকাল সর্বদাই আমরা একটা কৃত্রিম দ্বৈতজীবন যাপন করতে বাধ্য হই। সমাজের অবস্থা যদি এরকম হয় যে দিনের পর দিন আমরা যা অনুভব করি ঠিক তার বিপরীত কাজ করতে বাধ্য হই, যদি আমাদের ঘৃণ্য বস্তুর সামনে প্রতিদিন নতজানু হয়ে চলতে আমরা বাধ্য হই এবং যা নিশ্চিত আমাদের দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে তার সামনে আনন্দ প্রকাশ করি, তাহলে আমাদের দৈহিক স্বাস্থ্য কখনোই ঠিক থাকতে পারে না। দেহের খাঁচার মধ্যেই মনের বসতি, এবং আমাদের স্নায়ুতন্ত্রটা একটা কাল্পনিক পদার্থ নয়, মুখের ভিতরে যেমন দাঁত থাকে, দেহের ভিতরে তেমন থাকে আত্মা। খুশিমনে কারও উপর নির্যাতন করা যায় না।’

শিল্পী পাস্তেরনাকের এই উক্তির মধ্যে অটোমেটিক যান্ত্রিক সমাজের শোচনীয় পরিণতির করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। বর্তমান সমাজে মানুষের সতত দ্বৈতজীবন যাপনের যন্ত্রণার কথা তিনি উল্লেখকরেছেন। এই দ্বিখণ্ডিত সত্তার ঘাতপ্রতিঘাতে মানুষের দেহ ও মন দুইই তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। তবু মানবের ছদ্মবেশী যন্ত্রযুগের সর্বশক্তিমান দানবেরা সাধারণ মানুষকে অনবরত ঘুমপাড়ানি শোনাচ্ছে—স্বর্ণকান্তি সামাজিক আদর্শের ঘুমপাড়ানি গান। তাহলে আমরা চলেছি কোথায় এবং অটোমেশনের যুগের শেষই বা কোথায়?

গণতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্র নয়, প্রজাতন্ত্র বা গণতন্ত্র কিছুই নয়, রাজনৈতিক মন্ত্রে কোন রামতন্ত্রই ভূমিষ্ঠ হবে না। যা হবে এবং যেটুকু হবে যন্ত্রের কৃপায়, বিশেষ করে অটোমেটিক যন্ত্রের অনিরুদ্ধ অভিযানের ফলে। অটোমেশন আর যা—ই করুক বা না করুক, ধনতন্ত্রের বিশাল স্কাইস্ক্রেপার নিশ্চিত ভূমিসাৎ করে দেবে। অটোমেশনের ধ্বংসাভিযান কোনও মন্ত্রের বলে ধনতন্ত্র প্রতিরোধ করতে পারবে না। অটোমেটিক যন্ত্রের জয় ধনতন্ত্রে অবশ্যম্ভাবী ক্ষয়ে পরিণত হবে। কিন্তু ধনতন্ত্রের সেই ধ্বংসস্তূপের উপর নতুন কোন ‘তন্ত্র’ গড়ে উঠবে? আপাতত তো মনে হয় ‘ধনতন্ত্র’ বা অটোমেটিজম। সাম্য ও সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন মানুষ চিরকাল দেখবে, কিন্তু আজকের রঙ্গমঞ্চে তার ব্যঙ্গাভিনয় দেখে মনে হয়, স্বপ্ন সহজে বাস্তবে পরিণত হবে না।

এর মধ্যে যন্ত্রতন্ত্রের জয় হবে। অটোমেটিক যন্ত্র প্রচুর পরিমাণে চাহিদাতিরিক্ত পণ্য উৎপন্ন করবে। যন্ত্রের মতো মানুষও ভোজন—রমণ—মরণের চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে প্রয়োজনাতিরিক্ত সন্তান উৎপাদন করবে। যন্ত্রের বন্যায় অনর্গল জনসংখ্যা বাড়বে, যন্ত্র বাড়বে, পণ্য বাড়বে, এবং সমাজবিজ্ঞানের নিয়মে স্বরাজ হবে যন্ত্রের প্রতিবিম্ব। প্রেম—ভালোবাসা—স্নেহ—মায়া—মমতা—দয়া—উদারতা—ক্ষমা—করুণা প্রভৃতি মানবিক গুণগুলি অটোমেটিক ভোজন—রমণযন্ত্রের চক্রে চূর্ণ হয়ে যাবে। অটোমেশনের যুগে মানুষ হবে ‘outsider’—নিজের সমাজে, নিজের পরিবারে ও জীবনে অজ্ঞাতকুলশীলের মতো। আলব্যেয়র কামুর (Albert Camus) বিখ্যাত নায়ক ম্যরসোর (Meursault) মতে। মায়ের মৃত্যুর কথা সে যন্ত্রের মতো বর্ণনা করবে : ‘Mother died to-day, or may be yesterday. I can’t be sure’—ঠিক যন্ত্রের মতোই নির্মম উদাসীন—’মা আজ মারা গিয়েছেন। কালও হতে পারে। ঠিক জানি না।’ হেমিংওয়ের (Ernest Hemingway) একটি গল্পের নায়ক (Soldiers Home) ক্রেবসে—র সঙ্গে তার মায়ের কথোপকথন হচ্ছে এইভাবে :

মা : তুই কি আমাকে একটুও ভালোবাসিস না, ক্রেবস?

ক্রেবস : না।

মা একবার টেবিলের উপরে ছেলের মুখের দিকে চাইলেন। চোখ দিয়ে তাঁর জল ঝরতে লাগল। ক্রেবস বলল, ‘শুধু তোমাকে নয়, আমি তো কাউকেই ভালোবাসি না, মা!’

মা তখন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমি তোর মা, তোকে পেটে ধরেছি, বুকে করে মানুষ করেছি—’ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি।

ক্রেবস অস্বস্তিবোধ করতে লাগল, মায়ের কান্না দেখে তার মনে হল যেন তার গা বমি—বমি করছে।

ক্রেবস ও ম্যরসোর অটোমেটিক সমাজের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।

অবশেষে খুনি ম্যরসোর বিচার হচ্ছে যখন আদালতে তখন প্রসিকিউটর জুরিদের আহ্বান করে বললেন : ‘Gentlemen of the jury, I would like you to note that, on the day after his mother’s funeral, that man was visiting a swimming pool, starting a liason with a girl are going to see a comic film.’ জুরির বেঞ্চে আমরা ক্যাপিটালিস্ট ও সোশ্যালিস্ট উভয় দেশের সমাজনেতাদের বসিয়ে, মানুষ সম্বন্ধে এই অভিযোগ করতে পারি। ট্র্যাজেডি সেইখানে। ধনতান্ত্রিক সমাজের যান্ত্রিকতা ও নির্মম হৃদয়হীনতা সমাজতান্ত্রিক সমাজের পাঁজর পর্যন্ত জর্জরিত করেছে। যন্ত্রের প্রতিযোগিতায় দুই সমাজের মানুষই অমানুষ ও যান্ত্রিক হয়ে গিছে। সবার উপরে অটোমেটিক যন্ত্র, টেকনিক ও চতুর স্ট্যাটিসটিক্স হয়েছে সবচেয়ে বড় সত্য। ছাপাখানা—রেডিয়ো—টেলিভিশনের মহাযন্ত্রের জাদুতে আজকের সত্য কাল মিথ্যা হচ্ছে। কালকের মিথ্যা হচ্ছে পরশুর চরম সত্য।

অটোমেটিক যন্ত্রযুগের জীবনশিল্পীরা তাই বর্তমান সমাজের যান্ত্রিক মানুষের ভয়াবহ চিত্র তাঁদের সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছেন—অপরাধ শিল্পীদের নয়। এই যান্ত্রিক সমাজ মহা—উৎসাহে যাঁরা গড়ে তুলেছেন—সমস্ত মানবিক অনুভূতি, বোধ ও মহৎ গুণকে পদদলিত করে—অপরাধ তাঁদের। শিল্পীদের নির্দোষ মাথার উপর রাজনৈতিক কটূক্তি বর্ষণ করা বৃথা। ভিকোসাইক্লোমিটার তন্ত্রের মতো সমাজে, ভোজন—রমণ—মরণের চক্রে ঘূর্ণ্যমান মানুষের অটোমেটিক জীবন যতদিন না শেষ হবে, ততদিন ওই অভিসম্পাত থেকে আমাদের মুক্তি নেই। ততদিন—ততদিন কেবল ওই ‘পাতলুন আঁটলুম, বড়লোক চাটলুম’, আর মধ্যে মধ্যে নেশাখোরের মতো প্রশ্ন—’জীবনটা কী!’ অটোমেটিক যন্ত্রে ঘূর্ণনের শব্দ, ‘খাড়া—বড়ি—থোড় আর থোড়—বড়ি—খাড়া!!!’

১৩৬৫। ১৯৫৮

.

১. Calling All Jobs : Introduction to the Automatic Machine Age: New York, November 1956

২. International Labour Organisation : 89 Session Report, 1956

৩. Norbert Weiner : The Human Use Human Beings : London 1954, p. 162

৪. S. Lilley : Automation And Social Progress, London 1957. p, 117

৫. The Challenge of Automation : Paper Delivered at the National Conference on Automation Washington. 1955

৬. Magnus Pyke : Automation, its Purpose and Future : London 1956 p. 179

৭. W.A. Faunce and H.L. Sheppard : Automation, Some Implications for Industrial Relations : Transactions of the Third World Congress of Sociology, vol.1, Part 1, 1956 : p. 167

৮. Automation and Technological Change : Hearings before Sub-Committee on Economic Stabilisation, etc.: Washington 1955

৯. Paul Einzig : The Economic Consequences of Automation : London 1957, pp. 58-60

১০. Boris Pasternak : Dr. Zhivago : Translated by Max Hayword and Manya Harari : 1958, pp. 402-3

সকল অধ্যায়

১. বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ
২. মার্কসবাদ ও মর্গানবাদ – বিনয় ঘোষ
৩. বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা – বিনয় ঘোষ
৪. গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ
৫. মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ
৬. শিবনাথ শাস্ত্রী – বিনয় ঘোষ
৭. সমাজপতি মহারাজা নবকৃষ্ণ – বিনয় ঘোষ
৮. ঠাকুর পরিবারের আদিপর্ব ও সেকালের সমাজ – বিনয় ঘোষ
৯. বিদ্যাসাগর-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১০. রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১১. বিবেকানন্দ-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১২. জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ
১৩. অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৪. সমাজবিজ্ঞানীর এ কোন শোচনীয় পরিণতি! – বিনয় ঘোষ
১৫. মেহনত ও প্রতিভা – বিনয় ঘোষ
১৬. দীবনন্ধু মিত্র বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও বাঙালি সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৭. বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদিপর্ব – বিনয় ঘোষ
১৮. তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ
১৯. সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ
২০. ‘গেট টু-গ্যাদার’ – বিনয় ঘোষ
২১. অর্থনীতির ভোজবাজি – বিনয় ঘোষ
২২. গৃহভৃত্যদের সামাজিক ভূমিকা – বিনয় ঘোষ
২৩. স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ
২৪. রামমোহন রায়ের জীবনচরিত – বিনয় ঘোষ
২৫. এক পুরুষের দুস্তর ব্যবধান – বিনয় ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন