রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ

বিনয় ঘোষ

রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ

রবীন্দ্রজীবনের অর্ধেক কেটেছে উনিশ শতকে, আর বাকি অর্ধেক বিশ শতকে। ঘটনাটা উনিশ—বিশের মতো সামান্য নয়, চিন্তা করলে এর অসামান্যতা ধরা পড়ে। রবীন্দ্রজীবনের দুই শতকের এই বিভাগটাতে আরও ভালো করে তলিয়ে দেখা উচিত।….

দুই অর্ধেকের পার্থক্য আছে। একটি শেষের অর্ধেক, আর—একটি গোড়ার অর্ধেক। কারও শেষ ভালো কারও গোড়া ভালো। যেমন উনিশ শতকের শেষ ভালো, বিশ শতকের গোড়া ভালো। বিশ শতকের শেষ হয়তো আরও অনেক ভালো, কিন্তু আপাতত তা আমাদের বুদ্ধির নাগালের বাইরে।…

উনিশ শতকের শেষ ভালো এইজন্য যে সেটা হল ভাঙা—গড়ার যুগ। ভাঙন ও গড়ন যেযুগে পাশপাশি চলতে থাকে তার প্রথম পর্বে সমাজমন্থনের ফলে অমৃত ও গরল দুইয়েরই উত্থান হয়। কোনটা অমৃত কোনটা গরল; এবং কেনই বা অমৃত আর কেনই বা গরল, তা স্থির—ধীরভাবে বিবেচনা করে বুঝবার শক্তি সমাজের বেশির ভাগ লোকেরা থাকে না। বিচার—বিশ্লেষণ ও সমীকরণের কাজ আরম্ভ হয় পরে, যখন প্রথম চিন্তালোড়নের ফেনা—বুদবুদ মিলিয়ে যেতে থাকে। রামমোহন—ইয়াং বেঙ্গল—বিদ্যাসাগর এই প্রাথমিক আলোড়নের স্রষ্টা। বাংলার নিস্তরঙ্গ কূপমণ্ডূক সমাজে প্রচণ্ড আঘাত করে এঁরা যে তরঙ্গবিক্ষোভ সৃষ্টি করেছিলেন, তার ভিন্নমুখী স্রোতগুলির নির্দিষ্ট খাতে বেছে নিয়ে প্রবাহিত হতে সময় লেগেছিল অনেক। নবযুগের ভাববিপ্লবের সময় প্রথমে ভিন্নমুখী চিন্তাধারাগুলি পরস্পর মিলিত হয়ে একটা জটিল আবর্ত রচনা করে। উনিশ শতকের প্রথম অর্ধেকে বাংলার মানসলোকে এই ধরনের চিন্তাবর্ত রচিত হয়েছিল। দ্বিতীয় অর্ধেকের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, চিন্তার স্রোতগুলি স্পষ্ট রূপ ধরে নির্দিষ্ট খাতে তখন বইতে আরম্ভ করেছিল। কোনটা বলিষ্ঠ অগ্রপন্থী, কোনটা বা দোদুল্যমান মধ্যপন্থী, কোনটা পশ্চাদপন্থী—তা সাধারণ লোকের কাছেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। পথ বেছে নেওয়ার মধ্যে তখন কোনওরকম গোঁজামিল দেওয়া সম্ভব ছিল না। সমাজের মধ্যে মধ্যে এমন বিচিত্র সব ঘটনা—সমাবেশ হয় যে দুই পথে দুই পা দিয়ে চলতে বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের খুব একটা অসুবিধে হয় না। সেরকম সুযোগ রবীন্দ্রনাথের জন্মকালে বিশেষ ছিল না। সমাজের দেহে যেমন, সমাজের মনেও তেমনি শ্রেণিভেদ তখন প্রকট হয়ে উঠেছিল।…

প্রথমে চিন্তালোড়নটা বাংলা দেশে প্রধানত হিন্দুসমাজের মধ্যে কেন্দ্রীভূত ছিল বলে, উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দেখা যায় যে সমাজচিন্তার সমস্ত ডালপালা যখন দেশের মাটিতে মূল গাড়তে চাইছে, তখন তার সমস্ত প্রাণশক্তির জোগান দিচ্ছে ‘হিন্দুত্বের’ ঐতিহাসিক চেতনা। নতুন স্বাদেশিকতাবোধের উন্মেষ হচ্ছে বটে, কিন্তু হিন্দুত্বের গাঢ় রঙে তা রঞ্জিত। দেশমাতৃকার ধ্যানমূর্তি গড়ছে তখন দেশের লোক, রবীন্দ্রনাথ সেই মায়ের কোলেই জন্মগ্রহণ করলেন, অথচ গাঢ় বা ফিকে কোনও রঙের ছোপ তাঁর মনে একটুও লাগল না। রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিকতাবোধ কোনওদিন সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শে কলুষিত হয়নি। ‘জীবনস্মৃতি’র পাঠকরা জানেন, হিন্দু মেলার সামাজিক কলকোলাহল রবীন্দ্র—পরিবারেই প্রতিধ্বনিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি ঠাকুর পরিবারের যুবকরা এই নব্যজাতীয়তার উদ্বোধনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। জাতীয় জাগরণের এই উষাকালে রবির উদয় মনে হয় গভীর তাৎপর্যে পূর্ণ।…

১৮৬০ সালে বাইশ বছরের যুবক কেশবচন্দ্র সেন তাঁর প্রথম রচনা ‘Young Bengal, This is for you’ প্রকাশ করেন। তৎকালের তরুণদের আহ্বান করে তিনি বলেন: ‘Rest assured, my friend, if in our country intellectual progress went hand in hand with religious development, if our educated countrymen had initiated themselves in living truths of religion, patriotism would not have been a matter of mere oration and essay, but a reality in practice.’ নবযুগের শিক্ষার মধ্যে এই ‘living truth of religion’—এর অভাবকেই কেশবচন্দ্র ‘godless education’-এর ফল বলেছিলেন। তরুণ বাংলাকে নতুন জীবনমন্ত্রে জাগিয়ে তোলার জন্য কেশবচন্দ্রর এইসব বক্তৃতা, তাঁর ব্রাহ্মধর্মের দীক্ষা, আচার্যপদে অভিষেক, সংগত সভা, ক্যালকাটা কলেজ, ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকা প্রভৃতি স্থাপন (১৮৬০—৬২), সাহিত্যক্ষেত্রে দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীলদর্পণ’ নাটক, মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের জন্মকালের ঘটনা। তারপর রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় স্বামী বিবেকানন্দর জন্ম (১৮৬৩), আদি ব্রাহ্মসমাজ ও ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের ভেদ (১৮৬৬), হিন্দু মেলা বা জাতীয় মেলার অধিবেশন আরম্ভ (১৮৬৭), বঙ্কিমচন্দ্রর ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ (১৮৭২), বেলঘরিয়ার তপোবনে কেশবচন্দ্রর সঙ্গে রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রথম সাক্ষাৎ ও আলাপ (১৮৭৫)—এইসব ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটতে থাকে। সমাজচিন্তার বিভিন্ন প্রবাহের যে নির্দিষ্ট খাতের কথা বলেছি, এই সময় থেকে সেগুলি স্পষ্টাকারে রেখায়িত হতে থাকে।…

‘সঞ্জীবনী’, ‘ভারতী’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকা মারফত রবীন্দ্রনাথ যে সামাজিক আদর্শসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ‘নবজীবন’ ‘প্রচার’ ‘বঙ্গবাসী’ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে, আজও তার সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত রচনা করা হয়নি। উনিশ শতকের শেষ দুই দশকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জাতীয় ও সামাজিক প্রগতির জন্য, মানবধর্মের অকৃত্রিম সত্যের জন্য যে লড়াই করেছিলেন, মনে হয় বাকি জীবনে সুসংহত বিপরীত চিন্তার সঙ্গে আর কখনো তাঁকে সেরকম লড়াই করতে হয়নি। চিন্তার এই সংঘাতের ইতিহাস যতদিন না লুপ্ত ও দুষ্প্রাপ্য পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হব, ততদিন রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তার (social thoughts) অনুশীলন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ‘হিং টিং ছট’ কবিতা, ‘গোরা’ উপন্যাস প্রভৃতি রচনার প্রকৃত মানসিক পশ্চাদভূমি অনুধাবন করাও সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। যোগেন্দ্রচন্দ্র—শশধর তর্কচূড়ামণিদের বক্তব্য কী ছিল তা না জানলে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যও সম্পূর্ণ বোঝা যাবে না। রবীন্দ্র প্রতিভার অনুশীলনে এটা একটা বড় ফাঁক রয়ে গিয়েছে, ভরাট করা প্রয়োজন।

‘গোরা’ উপন্যাসটিকেও একটি হিং টিং ছট কবিতা বলা যায়। অন্তরালবর্তী ভাবগত সাদৃশ্যের দিক দিয়ে বলছি। চরিত্রায়ণের অপূর্ব দক্ষতায় প্রত্যেকটি চরিত্র মনে গভীর দাগ কেটে যায়, কাউকে চেষ্টা করেও ভোলা যায় না। তবু চরিত্রায়ণের চেয়ে জীবন ও জাতির আদর্শের রূপায়ণই গোরার বড় কথা। চরিত্রের চেয়ে বক্তব্য অনেক বড়। কী সেই বক্তব্য? নায়ক গোরার জীবনের বিশাল সৌধ কেনই বা তিনি বৈদেশিক জনকত্বের বালুচরের উপর গড়ে তুললেন? কেনই বা সে রহস্যের আবরণ নায়কের কাছে উন্মোচন করলেন না পরিণতির আগে পর্যন্ত? এ কি হিন্দুধর্মের তর্কচূড়ামণিদের প্রতি নির্মম বিদ্রুপ? তামার তাসের প্রাসাদ রচনা? ব্রাহ্মধর্মের প্রতিও নির্মম কটাক্ষ আগাগোড়া ‘গোরা’র মধ্যে করা হয়েছে। হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মধর্মের মিলনের ইঙ্গিতও যথেষ্ট রয়েছে ‘গোরা’র মধ্যে। ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম আদি গুরু রাজনারায়ণ বসু ‘হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়েছিলেন অত্যুগ্র ব্রাহ্মদের প্রকৃতিস্থ করার জন্য। ‘গোরা’তে রবীন্দ্রনাথ কি তা—ই করেছেন? অথবা এই কথা বলতে চেয়েছেন যে সকল ধর্মের বাইরের মেকি খোলসটা পরিত্যাজ্য, বাকি আদত সত্তাটুকু সকলেরই সমান মহৎ ও শ্রেষ্ঠ, এবং সেটা মানবধর্ম তথা বিশ্বমানবধর্ম? এরকম অনেক প্রশ্ন জাগে মনে, রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তার ক্রমবিকাশের ধারাটিকে, সমস্ত ফাঁক ভরাট করে ধরতে না পারলে এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া সহজ নয়।…

প্রতিভার কালনিরপেক্ষতায় যাঁরা বিশ্বাসী তাঁদের সঙ্গে আমার মতের মিল হবে না কোনওদিন, হবার প্রয়োজনও নেই। অনাদিকালের এই তর্ক অনন্তকাল ধরে চলবে, এবং তা চলে তো চলুক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সমাজচেতনার যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আদৌ নড়বড়ে বলে মনে হয় না। তিনি নিজে তাই তাঁর প্রতিভার কালসাপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন, এবং কাব্যাকারে তার সুন্দর উত্তর দিয়ে গিয়েছেন ‘আমি যদি জন্ম নিতেন কালিদাসের কালে’ কবিতায়। আরও অনেক রচনায় তার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে।…

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রে তাঁর পিতা দ্বারকানাথের প্রভাব উল্লেখ্য বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথের জীবনেও পিতা দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব যতই প্রত্যক্ষ ও গভীর হোক—না কেন, মনে হয় পিতার পুত্রের চেয়ে বিশ্বকবি তাঁর পিতামহের প্রকৃত পৌত্র ছিলেন অনেক বেশি। ‘বিদ্যাসাগরচরিত’—এ রবীন্দ্রনাথ নিজে ঈশ্বরচন্দ্রর পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের চরিত্র সবিস্তারে বর্ণনা করে বলেছেন, ‘এই দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁহার পৌত্রকে আর কোনো সম্পত্তি দান করিতে পারেন নাই, কেবল যে অক্ষয়সম্পদের উত্তরাধিকারবণ্টন একমাত্র ভগবানের হস্তে, সেই চরিত্র—মাহাত্ম্য অখণ্ডভাবে তাঁহার জ্যেষ্ঠ পৌত্রের অংশে রাখিয়া গিয়েছিলেন।’ কেবল ‘দরিদ্র’ কথাটির বদলে ‘অতুল ঐশ্বর্যশালী’ কথাটি বসিয়ে বলা যায় যে প্রিন্স দ্বারকানাথ তাঁর চরিত্রমাহাত্ম্য অখণ্ডভাবে তাঁর নবম পৌত্রের অংশে রেখে গিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের জীবনী ও আত্মজীবনী দুইই আছে, কিন্তু কিশোরীচাঁদ মিত্রর একখানি অসম্পূর্ণ ইংরেজি জীবনী ছাড়া দ্বারকানাথের কিছু নেই। দেবেন্দ্রনাথের চরিত্রে ধ্যানগম্ভীর আত্মমুখী প্রশান্তি রবীন্দ্র চরিত্রে বর্তেছিল বটে, কিন্তু রবীন্দ্র প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য যে বলাকার উদ্দাম সচলতা, যে ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’র আবেগ, যে দুর্বার দুরন্ত অভিযানের অনির্বাণ বাসনা, তা একান্তভাবে দ্বারকানাথের ‘material’-ঐশ্বর্যমুখী চরিত্রের ‘ideological’ বা ‘intellectual’—ঐশ্বর্যমুখী রূপান্তর। ‘Money’ এবং ‘Talent’, ‘Wealth’ এবং ‘Erudition’—এই দুটি হল শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদনের প্রধান মানদণ্ড। প্রথমটি (Money বা Wealth) দ্বারকানাথ অর্জন করেছিলেন, দ্বিতীয়টি অর্জন করেছিলেন তাঁর পৌত্র রবীন্দ্রনাথ। দুয়েরই ‘common factor is motive energy and a powerful dynamic’—যা পিতামহ ও পৌত্র উভয়েরই প্রচুর পরিমাণে ছিল। নব্যযুগের ‘econonic entrepreneur’ দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আদর্শ ‘intellectual entrepreneur’ এবং দ্বারকানাথ ও রবীন্দ্রনাথের মিলনেই রেনেসাঁসের অখণ্ড চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে।…

তাঁর জীবনের ‘hero’ কে? এপ্রশ্ন একবার রবীন্দ্রনাথকে করা হয়েছিল। তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন—’রামমোহন রায়’। এই প্রশ্ন বা উত্তর কোনোটাই আমরা আজও ভালো করে বিচার করিনি। ঠাকুর পরিবারের (রবীন্দ্র—শাখার) আদর্শের মূল যে রামমোহনের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ভাবধারার মধ্যে কত গভীরভাবে নিহিত ছিল তা দ্বারকানাথ ও দেবেন্দ্রনাথের জীবন থেকেই বোঝা যায়। দ্বারকানাথ ছিলেন তাঁর মানসপুত্র। রামমোহনের আদর্শই রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্যকর্মে ও চিন্তাধারায় পরিব্যপ্ত। ভারতপথিক রামমোহন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘ভারতের চিত্ত সেদিন মনের অন্ন নূতন করে উৎপাদন করতে পারছিল না, তার খেত ভরা ছিল আগাছার জঙ্গলে। সেই অজন্মার দিনে রামমোহন রায় জন্মেছিলেন সত্যের ক্ষুধা নিয়ে। ইতিহাসের প্রাণহীন আবর্জনা বাহ্যবিধির কৃত্রিমতায় কিছুতে তাঁকে তৃপ্ত করতে পারলে না। কোথা থেকে তিনি নিয়ে এলেন সেই জ্ঞানের আগ্রহে স্বভাবত উৎসুক মন, যা সম্প্রদায়ের বিচিত্র বেড়া ভেঙ্গে বেরল, চারিদিকের মানুষ যা নিয়ে ভুলে আছে তাতে যার বিতৃষ্ণা হোলো। সে চাইল মোহমুক্ত বুদ্ধির সেই অবারিত আশ্রয় যেখানে সকল মানুষের মিলনতীর্থ। এই বেড়াভাঙ্গার সাধনাই যথার্থ ভারতবর্ষের মিলনতীর্থকে উদ্ঘাটিত করা। এইজন্যেই এ—সাধনা বিশেষভাবে ভারতবর্ষের, যেহেতু এর বিরুদ্ধতাই ভারতে এত প্রভূত, এত প্রবল।’ রবীন্দ্রনাথের জীবনসাধনা সম্বন্ধেও তাঁর নিজের এই উক্তি প্রযোজ্য।…

অগাধ জলধিতুল্য রবীন্দ্র—সাহিত্যের সম্যক পর্যালোচনা করতে হলে তার কালানুক্রমিক পর্বভেদ করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হেতু পর্বভেদে মতভেদ দেখা দিতে পারে। তা দিলেও উপায় নেই, এই পথেই অগ্রসর হতে হবে। দেহের বা বয়সের বিকাশের সঙ্গে যেমন মনের বিকাশ হয়, তেমনি দেশকালের বা সমাজের বিকাশের সঙ্গে ব্যক্তিত্বেরও বিকাশ হয়, সমান্তরাল পথে সরল গতিতে নয়, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির নিরন্তর ঘাতপ্রতিঘাতে। ১৮৭৫ সালে ‘হিন্দু মেলার উপহার’ কবিতা প্রকাশ থেকে ১৯৪১ সালের ‘শেষ লেখা’ পর্যন্ত রবীন্দ্র সাহিত্যের রচনাকালের একটা চলনসই ভেদপর্ব এইভাবে করা যেতে পারে :

প্রথম পর্ব : ১৮৭৫—৯৯। বয়স ১৪ থেকে ৩৯ বছর, প্রায় সম্পূর্ণ যৌবনকালটা বলা চলে। রবীন্দ্রনাথের গভীর জাতীয়তাবোধ ও আন্তর্জাতিকতাবোধ, বাংলা ভাষা, লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির প্রতি নিবিড় অনুরাগ এইসময় পাকা বনেদের উপর গড়ে ওঠে। কবি কাহিনী, বাল্মীকি প্রতিভা, সন্ধ্যা সঙ্গীত, বৌঠাকুরাণীর হাট, প্রভাত সঙ্গীত, বিবিধ প্রসঙ্গ, প্রকৃতির প্রতিশোধ, রাজা ও রাণী, বিসর্জন, চিত্রাঙ্গদা, সোনার তরী, চিত্রা, বৈকুণ্ঠের খাতা, পঞ্চভূত, কণিকা পর্যন্ত সাহিত্যকর্মের অগ্রগতি। বাংলার লোকসংস্কৃতির পুনরনুশীলনে প্রায় একুশ—বাইশ বছর বয়স থেকে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। সমাজচিন্তার অগ্রসরগতি যাতে অবরুদ্ধ না হয় তার জন্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে এইসময় তাঁকে কঠোর আদর্শসংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়।

দ্বিতীয় পর্ব : ১৯০০—১৫। বয়স প্রায় ৪০ থেকে ৫৫ বছর। ক্ষণিকা, নৈবেদ্য, চোখের বালি, আত্মশক্তি, বাউল, স্বদেশ, ভারতবর্ষ, খেয়া, নৌকাডুবি, প্রাচীন সাহিত্য, লোকসাহিত্য, সাহিত্য, আধুনিক সাহিত্য, রাজা প্রজা, সমূহ, সমাজ, শারদোৎসব, শিক্ষা, ধর্ম, প্রায়শ্চিত্ত, গোরা, গীতাঞ্জলি, ডাকঘর, চৈতালি, ছিন্নপত্র, অচলায়তন, গীতালি পর্যন্ত এই পর্বের সাহিত্যযাত্রা। স্বদেশিযুগের মন বহু রচনার মধ্যে সক্রিয়। চিন্তার পরিণতি, অগ্রগতি এবং দূর থেকে দূরান্তের অভিযানের উৎকণ্ঠাও লক্ষণীয়।

তৃতীয় পর্ব : ১৯১৬—৩০। বয়স প্রায় ৫৬ থেকে ৭০ বছর। ফাল্গুনী, ঘরে—বাইরে, বলাকা, চতুরঙ্গ থেকে লিপিকা, পূরবী, সংকলন, রক্তকরবী, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, মহুয়া পর্যন্ত সাহিত্যের অগ্রগতি। দেহের যৌবন উত্তীর্ণ হলেও মনের যৌবন কাণায়—কাণায় ভরা। যৌবনোত্তরকালে রবীন্দ্র—প্রতিভার এই বৈশিষ্ট্যও লক্ষণীয়। সমাজচেতনার প্রাখর্য কমেনি, বরং বেড়েছে এবং তার সঙ্গে জীবন—আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়েছে।

চতুর্থ পর্ব : ১৯৩১—৩৯। বয়স সত্তরের কোঠায় চলেছে। ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে আরম্ভ করেপুনশ্চ, দুই বোন, মানুষের ধর্ম, মালঞ্চ, শ্যামলী, কালান্তর, প্রান্তিক, সেঁজুতি, আকাশ—প্রদীপ পর্যন্ত সাহিত্যযাত্রা। নতুন পৃথিবী, নতুন সমাজ, নতুন মানুষ ও নতুন জীবনকে বুঝবার আবেগপূর্ণ আকুতি রবীন্দ্রনাথের সত্তরের সাহিত্যে পরিস্ফুট।

পঞ্চম পর্ব : ১৯৪০—৪১। বয়স আশির কোঠায় পড়ল। জীবনেরও শেষ হল। তবু এ—ও একটা স্বাতন্ত্র্য—উজ্জ্বল পর্ব। দ্বিতীয় বিশ্ব—মহাযুদ্ধ এর পটভূমি। দেবাসুর সংগ্রামে মানবসভ্যতার চূড়ান্ত সংকট। ‘নবজাতক’ থেকে শুরু করে সানাই, তিন সঙ্গী, রোগশয্যায়, আরোগ্য, জন্মদিনে, সভ্যতার সংকট, শেষ লেখা পর্যন্ত সাহিত্যের যাত্রাশেষ। নতুন জীবনের অঙ্গীকারে আস্থা আশিতে আরও আবেগমুখী হচ্ছিল মনে হয়। কালক্রমে রবীন্দ্র—মানসের এই বিচিত্র অভিব্যক্তি অত্যাশ্চর্য নয় কি?….

কালানুক্রমিক আলোচনায় লাভ এই যে রবীন্দ্র—মানসের আঁকাবাঁকা ঊর্ধ্বগতির পথরেখাটি তাতে ধরা পড়তে পারে। পূর্বোক্ত পর্বভেদ থেকে এইটাই বোঝা যায় যে রবীন্দ্রনাথের বয়স যত প্রবীণ হয়েছে, তাঁর মন তত নবীন হয়েছে, কিন্তু তাঁর সেই মন কখনো দেশকালের চেতনাভূমি থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়নি। অতএব দেশকালের পরিবর্তনশীল আবেষ্টনের সঙ্গে, এবং সমাজচিন্তার সংঘাতমুখর অগ্রসরগতির সঙ্গে যোগ রেখে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকীর্তির অনুশীলন করলে তার বিশালতা ও বিশিষ্টতা দুইই উপলব্ধি করা সম্ভব হতে পারে।

১৯৬১

……………………………………….

* লেখকের নোটবই থেকে টুকরো চিন্তাগুলি সংকলিত।

সকল অধ্যায়

১. বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ
২. মার্কসবাদ ও মর্গানবাদ – বিনয় ঘোষ
৩. বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা – বিনয় ঘোষ
৪. গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ
৫. মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ
৬. শিবনাথ শাস্ত্রী – বিনয় ঘোষ
৭. সমাজপতি মহারাজা নবকৃষ্ণ – বিনয় ঘোষ
৮. ঠাকুর পরিবারের আদিপর্ব ও সেকালের সমাজ – বিনয় ঘোষ
৯. বিদ্যাসাগর-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১০. রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১১. বিবেকানন্দ-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১২. জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ
১৩. অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৪. সমাজবিজ্ঞানীর এ কোন শোচনীয় পরিণতি! – বিনয় ঘোষ
১৫. মেহনত ও প্রতিভা – বিনয় ঘোষ
১৬. দীবনন্ধু মিত্র বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও বাঙালি সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৭. বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদিপর্ব – বিনয় ঘোষ
১৮. তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ
১৯. সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ
২০. ‘গেট টু-গ্যাদার’ – বিনয় ঘোষ
২১. অর্থনীতির ভোজবাজি – বিনয় ঘোষ
২২. গৃহভৃত্যদের সামাজিক ভূমিকা – বিনয় ঘোষ
২৩. স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ
২৪. রামমোহন রায়ের জীবনচরিত – বিনয় ঘোষ
২৫. এক পুরুষের দুস্তর ব্যবধান – বিনয় ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন