সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ

বিনয় ঘোষ

সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ

রতিকেলির অপূর্ব ভাস্কর্যের নিদর্শনগুলির সামনে দাঁড়িয়ে, কোনও মিউজিয়ামে, মনে করুন যদি কোনও বৃদ্ধ বারবনিতা, কলকাতার রামবাগান অঞ্চলের (হায় রাম!) কোনও ‘স্বনামধন্য’ বিনোদিনী দাসী, হঠাৎ শিউরে উঠে, দু—হাত দিয়ে চোখ ঢেকে, মাথা হেঁট করে, দাঁতে জিব কেটে বলে, ‘ছি ছি লজ্জায় মরি? নারায়ণ, নারায়ণ’ এবং তারপর নিজের ঘরে (অর্থাৎ চেম্বারে) ফিরে গিয়ে, গায়ে—মাথায় পবিত্র গঙ্গাজলের ছিটে দিয়ে, গলবস্ত্র হয়ে দেয়ালে—টাঙানো শ্রীকৃষ্ণর ‘বস্ত্রহরণ’ ছবির দিকে চেয়ে বলে, ‘ঠাকুর। এ কী করলে? এ চোখে এই পাপ দৃশ্যও দেখতে হল?’—তাহলে যা হয়, এ—ও ঠিক তা—ই নয় কি? অর্থাৎ সরকার বা পুলিশের সাহিত্য—শিল্পকলার শ্লীলতা বিচারের ব্যাপারটা? Moral-Immoral-এর বিচারক হওয়ার প্রহসনটা? আমার তো তা—ই মনে হয়।

কথাটি কিন্তু বোদলেয়ারের : ‘All the imbeciles of the Bourgeoisie who interminably use the words “immoral”, “immorality”, “morality in art” and other such stupid expressions, remind me of Louise Villedieu, a five-frame whore who once went with me to the Louvre. She had never been there before, and began to blush and cover her face with her hands, repeatedly plucking at my sleeve and asking me, as we stood before deathless statues and pictures, how such indecencies could be flaunted in public.’

Journals and Notebook 1851-62

আপনার চিঠি পেয়ে এবং ‘মহেঞ্জোদরো’ পত্রিকার লেখাটি পড়ে প্রথমে এই কথাই আমার মনে হল। এ বিষয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করেছেন। জানি না, কী ভাষায়, কেমন করে আমার বক্তব্য আপনার কাছে নিবেদন করব। কলাকৈবল্যের সাধনা করে বাংলা ভাষায় রূপবিদ্যার শব্দসঞ্চার হয়তো অনেকটা সমৃদ্ধ হয়েছে, কিন্তু বাকি সকল বিদ্যার ভাণ্ডার প্রায়শূন্য বললে অত্যুক্তি হয় না। এ যে কী যন্ত্রণা তা তো বুঝতেই পারেন! লেখার সময় যদি ভাষা খুঁজে বেড়াতে হয়, তাহলে তার চেয়ে ট্র্যাজেডি লেখকের কাছে আর কিছু হতে পারে না। কাজেই এ বিষয়ে যতটুকু বলা যেতে পারে তার অনেকটাই বাংলা ভাষার মাধ্যমে বলা সম্ভবহবে না, বেশ কিছুটা ঈশারা—ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করতে হবে এবং তা বুঝে নিতে হবে। তা ছাড়া ভাষার একটা সামাজিক প্রতিবন্ধকও আছে, সেখানেও শ্লীলতা—অশ্লীলতার প্রশ্ন উঠতে পারে। ‘সভ্যতা’ কথার নির্গলিত সংজ্ঞা ‘কৃত্রিমতা’, যে যত বেশি ‘কৃত্রিম’, সে তত বেশি ‘সভ্য’। সভ্যসমাজে কৃত্রিমতার উপচার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কৃত্রিম সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে, এবং মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকশ্রেণি তাদের মধ্যে অন্যতম। এই ভদ্রলোকদের ভদ্রতার মানদণ্ড অনবরত বদলাচ্ছে। আগে ভদ্রলোকের ছেলে ইংরেজি মাইনর স্কুলে পড়লেই মর্যাদা রক্ষা হত, এখন কোনও ট্যাঁসের নার্সারিতে না পড়লে মান বজায় থাকে না। আগে আমরা মামাবাড়ি যেতাম, দেশবাড়িতে যেতাম, এবং তাতেই আমাদের ‘চেঞ্জ’ হত। এখন কোনও শৈলাবাসে বা সমুদ্রতীরে যেতে হয়, অন্তত বছরে একবার বোনাসের টাকা পেয়ে তো বটেই, তা না হলে কোনও ভদ্রলোকের ইজ্জত থাকে না। এরকম সতত—পরিবর্তনশীল হাজার প্যারাফার্নেলিয়া। ভাষা তার মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম। শুধু ভাষা নয়, তার প্রকাশভঙ্গিও। আগে সহজ স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে কথা বলাই ছিল ভদ্রলোকের রীতি, এখন যাঁর কণ্ঠস্বরে অস্বাভাবিকতা ও কৃত্রিমতা না থাকে তাঁকে ভদ্রলোক বা কালচারড বলেই মনে হয় না। ভাষারও ভদ্র—অভদ্রের পোশাকি রূপ কেবল বদলায়। ধাপে ধাপে সমাজের যত উপরের স্তরে ওঠা যায় তত দেখা যায় যে ভাষা ও তার ভঙ্গি ক্রমেই বেশি কৃত্রিম হয়ে উঠেছে, কৃত্রিমতার বৈচিত্র্যও বাড়ছে—আচরণের কৃত্রিমতা, পরিচ্ছদের কৃত্রিমতা, চলনের কৃত্রিমতা, বলনের কৃত্রিমতা। কথার ধ্বনি যে শুধু কণ্ঠ্য—তালব্যের আড়স্টতায় বিকৃত হচ্ছে তা নয়, ভাষাকেও সেন্সরের ডান্ডাবেড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হচ্ছে। কত ‘শব্দ’ যে সামান্য সংলাপের ক্ষেত্র থেকেও নির্বাসিত হচ্ছে তার ঠিক নেই। আমি—আপনি যে ভাষার কথাবার্তা বলতে পারি, সেই ভাষায় কোনও অভিজাত নীতিবাগীশ ব্রাহ্ম—বৈঠকে কথা বলা নিষেধ, কারণ আমাদের কথ্য ভাষায় এমন অনেক শব্দ থাকবে বা উচ্চারিত হওয়ামাত্রই তাঁরা হয়তো বৈঠক ছেড়ে প্রস্থান করবেন। তাঁদের ব্রাহ্ম আভিজাত্যে সেটা ‘অশ্লীল’ বলে মনে হবে।

ঠিক এইরকম ধাপে ধাপে সমাজের নিচের স্তরের দিকে নেমে এলে দেখা যায় যে সেখানে মানুষের জীবন যত বেশি স্বাভাবিক ও অকৃত্রিম; ভাষাও তত বেশি স্বাভাবিক ও অকৃত্রিম। সেই স্বাভাবিক অকৃত্রিমতা উপরতলার সভ্য ভদ্রলোকদের কাছে যথেষ্ট ‘অশ্লীল’ মনে হতে পারে, কিন্তু তাদের কাছে সে কথা বললে তারা অশ্লীলতার অর্থই বুঝতে পারবে না। বরং তারা অবাক হয়ে যাবে। হবারই কথা। আমাদের মতো রাংতামোড়া অভিজাতদের কাছে যা ‘অশ্লীল’, অকৃত্রিম অনভিজাতদের কাছে তা ‘স্বাভাবিক’। তাদের যেসব কথার মধ্যে প্রাণপ্রাচুর্য সূর্যকিরণের মতো ঝলমল করে ওঠে, আমাদের কাছে তা অন্ধকার প্রেতলোকের অশ্লীল ও অশ্রাব্য কিচিরমিচির বলে মনে হয়। ‘হাসি’র সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায়। অভিজাত ও ভদ্রলোকরা মেপেজুকে হাসেন, সেটা শালীনতা ও শ্লীলতার শ্রেষ্ঠ মানদণ্ড এবং যাঁর হাসি যত বেশি ওষ্ঠের বঙ্কিমতাবদ্ধ, তিনি তত বেশি শালীন, শ্লীল ও সভ্য। কিন্তু প্রকৃতির নিকটতম আত্মীয় যারা, তাদের হাসি শ্রাবণের গুরুগম্ভীর মেঘগর্জনের মতো অফুরন্ত প্রাণোচ্ছ্বাসের বর্ষণের সঙ্গে ধ্বনিত হয়। এই হাসির ধ্বনিও অভিজাতদের কানে কর্কশ ও অশ্লীল চিৎকার বলে মনে হয়। তাই বলছিলাম, আমাদের এই সভ্যসমাজে যেমন উপরের স্তরে ‘verbal censorship’ আছে, তেমনি ‘laughter cenorship’—ও আছে এবং ‘moral censorship’-ও আছে। সাহিত্যের যে ‘moral censorship’, সেটা অনেকটাই আমার কাছে ‘lingual censorship’ বলে মনে হয়। সে—কথা পরে বলছি। আপাতত এই ভাষাগত সেন্সরশিপ যেহেতু আমার উপরেও প্রযোজ্য তাই আমার বক্তব্য শ্লীলতার বন্ধনে আড়ষ্ট হতে বাধ্য। কারণ ‘One curious result of this isolation has been the dropping out from middle-class language of the entire vocabulary of sexual instruction of excretion’…

Alex Comfort : Sex and Society

ইংরেজি ‘obscenity’ ও ‘pornography’ কথা দুটির অর্থই নিশ্চয় বাংলায় ‘সাহিত্যে অশ্লীলতা’ বলতে প্রকাশ পায়। কিন্তু ‘অবসিনিটি’ কথার অর্থ কী? ‘পর্নোগ্রাফি’—ই বা কাকে বলে? কথাটা যদি ‘obscena’ কথা থেকে এসে থাকে, তাহলে তার মানে হয়—প্রকাশ্যে যেসব দৃশ্য বা ‘scene’ দেখানো যায় না। কিন্তু ট্রাইবাল নৃত্য—উৎসবে প্রকাশ্যে যা দেখানো যায়, একসময় সভ্যসমাজের রঙ্গমঞ্চে তা দেখানো যেত না, আবার ইদানীং তা অনেকখানি দেখানো যায় এবং আরও ভবিষ্যতে হয়তো পুনরায় ট্রাইবাল স্তরেই তা দেখানো সম্ভব হবে। তাই ‘অবসিন’—এর পূর্ণচ্ছেদ কোথাও টানা যায় না এবং তার নির্দিষ্ট গণ্ডিও কিছু নেই। ইংরেজি ‘pornography’ কথার অর্থ শুনেছি ‘pertaining to harlots’ অথবা ‘the graph of the harlot’ এবং তা—ই যদি অর্থ হয় তাহলে ‘harlot’ কাকে বলে জানতে হয়। টাকার বিনিময়ে যে স্ত্রীলোক বাজারের কমোডিটির মতো তার দেহ বারোজনের কাছে বেচতে পারে, সেই ‘বারবনিতা’। কিন্তু যারা মত বেচে, বুদ্ধি বেচে, প্রতিভা বেচে, বিবেক বেচে—স্ত্রী—পুরুষ নির্বিশেষে—বর্তমান পণ্যসর্বস্ব সমাজে, তারা কি মর্তলোকের স্বর্গের এঞ্জেলের ‘সাবস্টিটিউট’, না ‘প্রস্টিটিউট’? যে বিজ্ঞানীরা অ্যাটম বোমার গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছেন, তাঁরা কি ‘savant’, না ‘harlot’? আর ধর্ম দেবদেবী বা ধর্মসাহিত্যের কথাই যদি ওঠে তাহলে বোদলেয়ারের ভাষাতেই তার জবাব হল—‘the most prostituted being of all is the ultimate being, that is God, since he is the supreme lover to each individual.’ এই অর্থে তো বারবনিতাদের ‘goddess’-ও বলা যায়। তাহলে আভিধানিক অর্থের গণ্ডির মধ্যে পর্নোগ্রাফি’, ‘অবসিনিটি’, ‘ইম্মরালিটি’ ইত্যাদি কথাগুলিকে বন্দি করা যায় না। অন্তত সাহিত্য—শিল্পকলার ক্ষেত্রে করা সম্ভব নয়। সামাজিক ইষ্ট—অনিষ্টের প্রশ্ন যদি ওঠে, তাহলে আমাদের দেশে তথাকথিত ‘সদসাহিত্য’ বা ‘সৎগুরু—সাহিত্য’কে সর্বাপেক্ষা অনিষ্টকর ‘পর্নোগ্রাফি’ বলে বাতিল করতে হয়। আর জলজ্যান্ত গুরুজি বা বাবাজিদের আখড়াগুলির কথা যদি ওঠে, তাহলে সেগুলিকে ন্যুডিস্ট ক্লাবের চেয়েও অনেক বেশি অপবিত্র ও অশ্লীল বলে মনে হয়। একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। ‘কর্তাভজা দল’ বলে একটি ধর্মসম্প্রদায় ব্রিটিশ আমলে বাংলা দেশে গজিয়ে উঠেছিল, অনেকেই জানেন। তারই একটা বিবরণ সেদিন ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় পড়ছিলাম (১২৭০ সাল, ২৩ চৈত্র তারিখের)। বিবরণটি এই : ‘আমাদের সম্বাদদাতা এ বিষয়ের একটি দৃষ্টান্ত দর্শন করিয়া আসিয়াছেন। তিনি দেখিয়া আসিয়াছেন, বর্তমান কর্তাবাবু একটি শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন, অনেকগুলি স্ত্রীলোক তাঁহার চতুর্দিকে বসিয়া কেহ পদসেবা করিতেছে, কেহ গা টিপিয়া দিতেছে, কেহ মুখে আহারদ্রব্য প্রদান করিতেছে, কেহ বা অঙ্গে চন্দন লেপন করিতেছে এবং কেহ কেহ বা গলদেশে পুষ্পমাল্য পরাইয়া দিতেছে। আমরাও অনেক লোকের মুখে শুনিয়াছি, এই ধর্মাবলম্বদিগের মধ্যে শ্রীবৃন্দাবনের প্রকৃত কৃষ্ণলীলাটাই অনুষ্ঠিত হয়। কোনো কোনো কর্তা কুলবালাদিগের বস্ত্র হরণ করিয়া বৃক্ষে আরোহণ করেন, রমণীরা করজোড় করিয়া বৃক্ষতল হইতে উহার প্রার্থনা লয়।’ একশো বছর আগেকার বিবরণ। ঠিক বস্ত্রহরণের দৃশ্য না হলেও, ভক্তবেশে (অবশ্যই ভণ্ড) আমাদের দেশে বহু গুরুজির আখড়ায় ঘুরে ঘুরে এর সমতুল্য দৃশ্য আমি স্বচক্ষে দেখেছি। দেখে দেখে আমার ধারণা হয়েছে যে আমাদের দেশে আজও, বিংশ শতাব্দীর বার্ধক্যে, এই ধরনের গুরুভজনকেন্দ্রগুলিতে যে নারী পুরুষের উন্মত্ত ভিড় হয়, তার কারণ আমাদের সমাজে ক্লাব, নাইটক্লাব ইত্যাদির মধ্যে অতৃপ্ত অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষা বাষ্পীয়করণের ব্যবস্থা বা সুযোগ নেই। এমনকী, সাধারণ সামাজিক জীবনযাত্রাতেও প্রতিপদে নারী পুরুষের স্বচ্ছন্দ মেলামেশায় এত রকমের ট্যাবু ও কানাকানি—গুজগুজানির বাধা যে আমাদের স্বাভাবিক যৌনজীবনের ধারা সাবলীল গতিতে সমুদ্রাভিমুখী না হয়ে, আকৈশোর কেবল নর্দমার পাঁকের দিকে ধাবিত হতে চায়। আর সে এমনই পচা পাঁক যে তাতে কোনওকালে দৈবক্রমে পদ্ম ফুল ফোটে না। আর আমাদের উদার হিন্দুধর্ম জিনিসটা আজও এমন পদার্থ হয়ে আছে যে তার মধ্যে অজস্র পাঁক ভরতি খাল কেটে ফেলতে একটুও কষ্ট হয় না। তাই বোধহয় এ দেশের ধর্ম—সাহিত্য ধর্মচিত্র ইত্যাদির মধ্যে ‘পর্নোগ্রাফি’ ও ‘অবসিনিটি’র উপাদানের এত প্রাচুর্য। মন্দির ভাস্কর্যের কথা বলছি না। একালের ‘বিট’ বা ‘হাংগ্রি’ যে—কোন জেনারেশনই হোক—না কেন, কারও সাহিত্য রতিকেলির নির্লজ্জ প্রকাশে তার কাছে ঘেঁষতে পারে না। একটু চিন্তা করলেই দেখা যায়, যত গণ্ডগোল ভাষা নিয়ে, ভাবপ্রকাশের ভঙ্গি নিয়ে, যে কথা একটু আগেই বলেছি—ভাব নিয়ে নয়, বিষয়বস্তু নিয়েও নয়। রিরংসা, মৈথুন প্রভৃতি শব্দনিহিত ভাব সুশ্লীল সাহিত্যে স্বচ্ছন্দে চলতে পারে, কিন্তু এর নিগলিতার্থ যদি গ্রাম্য মেঠো ভাষায় প্রকাশ করা হয়, তাহলে সংস্কারদোষেই তা কানে রূঢ় ও অশ্লীল শোনাবে। ভঙ্গিটাও খুব বড় কথা। কত বড় কথা তা বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। নির্বাক ভঙ্গিও ভয়ংকর রকমের অশ্লীল হতে পারে। রাস্তার বকাটে ছোঁড়াদের বিতণ্ডার মৌখিক ভাষা ও দৈহিক ভঙ্গি থেকে তার আভাস পাওয়া যায়। রতিরঙ্গের একই বিষয়বস্তু ভাষা ও ভঙ্গির সমন্বয়গুণে একজন শিল্পীর হাতে অতীব রমণীয় শিল্প হতে পারে, আবার তারই দোষে আর—একজনের হাতে তা এমনই অপাঠ্য নোংরা বস্তু হতে পারে যা পাঠকের বিবমিষা উদ্রেক ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। একই মাটি কাদা করে গায়ে ছিটানো যায়, আবার তা—ই দিয়ে সুন্দর প্রতিমাও গড়া যায়। জানি না, কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারলাম কি না, তবে আমার ধারণা তাই। অর্থাৎ অশ্লীলতার বিচারে ভাষা ও ভঙ্গিই মুখ্য, ভাব গৌণ। নর—নারীর প্রেম, যৌনসম্পর্ক ও জীবন নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীর সকল দেশে সাহিত্য রচিত হয়েছে, আজও হচ্ছে, কিন্তু আজও যে তাতে আমাদের অরুচি হয় না তার কারণ যুগে যুগে শিল্পীরা সেই ভাববস্তু নতুন নতুন পরিবেশন করে নতুন আস্বাদের খোরাক জুগিয়েছেন।

আধুনিককালে সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে যাঁরা অতিষ্ঠ হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে লরেন্স (D.H. Lawrence) নিশ্চয় অন্যতম। কাজেই এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য স্মর্তব্য। লরেন্স বলেছেন: ‘Pornography is the attempt to insult sex, to do dirt on it. This is unpardonable. Take the very lowest instance, the picture-postcard sold under-hand, by the underworld, in most cities. What I have seen of them have been of an ugliness to make you cry. The insult to the human body, the insult to a vital human relationship! Ugly and cheap they make the human nudity, ugly and degraded they make the sexual act, trivial and cheap and nasty.’ কথা হল এই পিকচার পোস্টকার্ডকে কি আর্ট বলব? খাজুরাহ—কোনার্ক মন্দিরের রতিকেলিকলা, যা মৈথুন ভাস্কর্যে রূপায়িত, তার সঙ্গে কি এই পিকচারকার্ড তুলনীয়? হিন্দু মন্দিরের মৈথুন ভাস্কর্য সম্বন্ধে অ্যালেক্স কমফর্ট বলেছেন : ‘The erotic art of the Hindu temples is primarily didactic…What is presented is an experience, edifying, practical, and symbolic, of the way of Release, the contemplation of art. Another mode of Release is the experience of sexual ecstasy. The lovers of the maithuna groups both celebrate and demonstrate this… they stimulate our desire for this sort of Release in exactly the same way that a flower show stimulates out wish to have gardens.’ (Sex and Society) মৈথুন ভাস্কর্য আর পিকচারকার্ডের তুলনা করতে হলে লরেন্সের ভাষায় বলা যায়—একটি ‘sex flow’, আর—একটি ‘dirtlust’ বা ‘excrement flow’, এবং প্রথমটি ‘creative’, দ্বিতীয়টি ‘de-creative’। যে লরেন্স লেডি চ্যাটার্লির জন্যে ক্রুশবিদ্ধ হতে চলেছিলেন, তিনিই বলেছেন : ‘This is the secret of really vulgar and pornographical people : the sex flow and the excrement flow is the same to them….Then sex is dirt and dirt is sex and sexual excitement becomes a playing with dirt…This is the condition of the common, vulgar human being whose name is legion… And this is the source of all pornography.’

লরেন্সের এই উক্তি বর্ণে বর্ণে আমি সমর্থন করি। ফার্নেসের গলিত ধাতুর মতো ধমনির রতিপ্রবাহ, আর অর্গলবদ্ধ পীড়িত যৌনগ্রন্থির ক্লেদ—নিঃসরণ, নিশ্চয় এক পদার্থ নয়। বর্তমানের জনতা—সমাজে (mass society) নিষ্পেষিত লক্ষ্যহীন জীবনের বিকৃত বাসনার এই অবক্ষেপ, নির্জন নিঃসঙ্গ জনতা—সমুদ্রে মানুষের আত্মবিলুপ্তির এই ঊর্ধ্বশ্বাসী উৎকণ্ঠা—এগুলিই একালের মানুষের বেদন—বিনোদনের অন্যতম পন্থা। সমাজবিজ্ঞানীরা এই মানসিক অবস্থাকে ‘complete de-spiritualisation of emotions’ বলেছেন। এই পরিবেশে স্বভাবতই সিনেমায়, খেলার মাঠে, ময়দানের রাজনৈতিক সভায়, জনতার মিছিলে, দলীয় দাঙ্গায় এবং সাহিত্যে—সর্বত্রই মানুষ শুধু ক্ষণস্থায়ী উত্তেজনা—সন্ধানী, যে উত্তেজনার কৃত্রিম উত্তাপে তার স্তূপীকৃত মানসিক গ্লানি ও ক্ষুধার্ত গ্রন্থির দ্রুতক্ষরণ হতে পারে। এ কথা অনস্বীকার্য যে সিনেমার পরেই সাহিত্য বর্তমানে মানুষের এই মানসিক ক্লেদ—নিঃসরণের পথ মসৃণ করছে এবং ‘crime’ ও ‘sex’ (অর্থাৎ ‘dirt’) হয়েছে তার প্রধান উপজীব্য। ‘And this is the source of all pornography.’ কিন্তু ‘সাহিত্যে অশ্লীলতা’র প্রতি সরকার বা পুলিশের যে মনোভাব তা যেমন হাস্যকর তেমনি নিন্দনীয়। তার বিচারক হবারও কোনও নৈতিক অধিকার তাঁদের নেই। তাঁরা যখন তথাকথিত ‘অশ্লীল সাহিত্যে’র মুদ্রিত আক্ষরিক রূপ দেখে ‘ছি! ছি!’ করেন, অথবা তার বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান চালান সামাজিক ‘corruption’-এর অজুহাতে তখন রামবাগানের বিনোদিনী দাসীর কথাই মনে হয়। ‘Cockburn Rule’ বা ‘Obscene Publications Act’ অনুযায়ী যদি অশ্লীল সাহিত্যের বিরুদ্ধে সামাজিক ‘করাপশন’—এর অভিযোগ করা হয়, তাহলে সেই অভিযোগে প্রত্যেকটি সরকারি ও পুলিশি কর্মকে সকলের আগে সমাজকল্যাণের স্বার্থে দমন করতে হয়। যে সরকারের কর্মনীতি এবং যে সমাজের জীবনযাত্রা থেকে পদে পদে মানুষ জালিয়াতি—জুয়াচুরি, অপরাধ—ঘৃণা, হিংসা—জিঘাংসা শিখছে, পথে পথে, দেয়ালে দেয়ালে, শোরুমে, বৈদ্যুতিক বিজ্ঞাপনে যেখানে অ্যাডোলেসেন্টদের জন্যে ‘ম্যাস্টারবেশন’ ও ‘করাপশন’—এর উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে ছড়িয়ে আছে, সেখানে কোনও বিশেষ সাহিত্যরচনার বিরুদ্ধে অশ্লীলতা ও নীতিহীনতার অভিযোগ করে দমন করা নিতান্তই হাস্যকর বলে মনে হয়। তবু তাঁরা তা কেন করেন? কারণ অশ্লীলতার যে প্রত্যক্ষ ‘psychophysical excitement’, যা সেন্সরকর্তারা উচ্চকণ্ঠে প্রচার করেন তার বিরুদ্ধে তাঁদের ক্রোধের উদ্রেক হয়, ‘because they are upset by their own response to it’ (Alex Comfort)। অনুসন্ধান করলে হয়তো দেখা যাবে যে এই নীতি প্রহরীরাই পর্নোগ্রাফি ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের পিকচারকার্ডের সবচেয়ে বড় কালেক্টর।

১৯৬২

সকল অধ্যায়

১. বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ
২. মার্কসবাদ ও মর্গানবাদ – বিনয় ঘোষ
৩. বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা – বিনয় ঘোষ
৪. গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ
৫. মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ
৬. শিবনাথ শাস্ত্রী – বিনয় ঘোষ
৭. সমাজপতি মহারাজা নবকৃষ্ণ – বিনয় ঘোষ
৮. ঠাকুর পরিবারের আদিপর্ব ও সেকালের সমাজ – বিনয় ঘোষ
৯. বিদ্যাসাগর-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১০. রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১১. বিবেকানন্দ-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১২. জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ
১৩. অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৪. সমাজবিজ্ঞানীর এ কোন শোচনীয় পরিণতি! – বিনয় ঘোষ
১৫. মেহনত ও প্রতিভা – বিনয় ঘোষ
১৬. দীবনন্ধু মিত্র বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও বাঙালি সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৭. বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদিপর্ব – বিনয় ঘোষ
১৮. তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ
১৯. সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ
২০. ‘গেট টু-গ্যাদার’ – বিনয় ঘোষ
২১. অর্থনীতির ভোজবাজি – বিনয় ঘোষ
২২. গৃহভৃত্যদের সামাজিক ভূমিকা – বিনয় ঘোষ
২৩. স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ
২৪. রামমোহন রায়ের জীবনচরিত – বিনয় ঘোষ
২৫. এক পুরুষের দুস্তর ব্যবধান – বিনয় ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন