বিনয় ঘোষ
কথাটা বেশি দিনের না হলেও, মনে হচ্ছে অনেকদিনের। কাব্য করছি না, এমনি বলছি। তখন কলকাতায় বেশ কিছুটা সবুজ রং দেখা যেত, বালিগঞ্জের মতো শৌখিন পাড়ার কোনও কোনও অঞ্চলে ঘুরলে ঝিঝিপোকার শব্দের সঙ্গে গ্রাম্য হাওয়ার স্নিগ্ধতা অনুভব করা যেত। ভূতপ্রেতরা যে দু—চার জায়গায় বড় বড় গাছের মাথায় পা ঝুলিয়ে না বসে থাকত তা নয়। অন্তত রাতের অন্ধকার একটু গাঢ় হলে, তা—ই মনে হত। অথচ ১৯৩৯ সালের কথা, যে বছর হিটলার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ঘোষণা করেন। মনে হয় সেদিনের কথা, যদিও তিরিশ বছর হয়ে গিয়েছে। পথেঘাটে লোকচলাচল তখন অনেক কম ছিল, বিশেষ করে চলন্ত মেয়েদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তা ছাড়া মেয়েরা তখন মেয়েদের মতো চলত, পুরুষরা চলত পুরুষের মতো, রাস্তাঘাটে আজকালকার মেয়ে—পুরুষের মতো উলটোপালটা চলার ধরন ছিল না, মানে ওটা ‘ট্যাবু’ ছিল। অর্থাৎ স্ত্রী—স্বাধীনতা তত্ত্বগতভাবে শতবর্ষ আগে স্বীকৃত হলেও, সামাজিক জীবনে তখনও থিতিয়ে বসেনি। পথেঘাটে প্রকাশ্যে তরণ ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে অবাধে চলাফেরা করছে বা কথাবার্তা বলছে এ দৃশ্য তখন প্রায় দেখাই যেত না। তখন খাঁটি তেল—ঘি মিলত, দশ পয়সার গাওয়া ঘি একথালা কাঁকরহীন সুস্বাদু ভাত আলুভাতে দিয়ে চেটে মুছে খেয়ে ফেলা যেত। বর্ষার সময় চার আনা দিয়ে এক সের ওজনের একটা ইলিশ মাছ কিনে বহু দরিদ্র কেরানি তখন বাড়ি ফিরেছে এবং তা দিয়ে পরিবারে বেশ মহোৎসবও হয়েছে। এসব শুনলে মনে হবে যেন আকবরের যুগের কথা বলছি, অথচ মোটেই তা নয়, এই সেদিনকার হিটলারের যুদ্ধ ঘোষণার যুগের কথা, মধ্যে শুধু একটা জেনারেশন (৩০ বছর), আর দুটো টিনএজারের ঢেউ। তারই মধ্যে ইলিশ মাছের চার আনা সের থেকে দশ টাকা কিলো দাম, প্রায় চল্লিশগুণ মূল্যবৃদ্ধি।
ইলিশ মাছটা একটা প্রতীকবিশেষ। সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে, ১৯৩৯—৪০ থেকে ১৯৬৯—৭০ সালের মধ্যে, আমরা একলাফে প্রায় চল্লিশ ধাপ এগিয়ে গিয়েছি। অগ্রগতির বেগ এত প্রচণ্ড বলেই মনে হয় ১৯৩৯ সাল আকবর বাদশাহের কাল। সামান্য বলবিদ্যার সূত্র জানা থাকলে কালিক নৈকট্য সত্ত্বেও এই দূরত্ববোধের রহস্য কী তা বোঝা সহজ হবে। যেমন শম্ভু (মিত্র), বিজন (ভট্টাচার্য বা ‘গোষ্ঠ’) এবং আমি বিনয় (ঘোষ)—এই তিনজনের বসবাস কলকাতা শহরে যথেষ্ট কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের চোখাচোখি বছরের পর বছর হয় না, কথাবার্তা হয় না, এমনকী কে কোথায় আছে বা আদৌ আছে কি না তা কেউ জানি না। যে যার ‘সিলেব্রিটি’র ধান্দায় ব্যস্ত, এবং অনেক কাছাকাছি থেকেও প্রত্যেকে আমরা অনেক দূরে। শম্ভুর কথা বুঝি, কারণ শম্ভু যতই নাটক আর ‘বহুরূপী’ আর অভিনয় করুক, আর যতই না কেন সে ‘স্বনামধন্য’ হোক, চিরকালই সে বৌদ্ধভাবাপন্ন, অর্থাৎ নিস্পৃহ উদাসীন আত্মমগ্ন ও নিঃসামাজিক বা ‘অ্যা—সোশ্যাল’। বিশেষণগুলো একটু জোর করেই প্রয়োগ করছি, তা না হলে শম্ভুর শুধু খোলসটাকেই চেনা যাবে, আদত শম্ভুকে চেনা যাবে না। শম্ভু যেমন প্রাণ খুলে হাসতে পারে, তেমনি কারও কান্না দেখে আকাশের দিকে চেয়ে কবিতাও আবৃত্তি করতে পারে। সবই তার কাছে ‘ফ্যাক্ট’, হাসিটাও ‘ফ্যাক্ট’—কান্নাটাও ‘ফ্যাক্ট’—বেঁচে থাকাও ‘ফ্যাক্ট’, মরে যাওয়াও ‘ফ্যাক্ট’, মধ্যে আর কোনও কিছু নেই। খাঁটি ‘ইন্টেলেকচ্যুয়াল’—এর একটা ‘সোশিয়োলজিক্যাল মডেল’ শম্ভু। বিজন ঠিক তার বিপরীত। বিজন খাঁটি ‘ইমোশ্যনাল’ টাইপ। সে হাসতে যত না পারে তার চেয়ে ঢের বেশি পারে কাঁদতে। বিজন যেমন কাঁদতে পারে, তেমনি কাঁদাতে পারে। বিজনের মধ্যে একটা পাঁচ বছরের ‘শিশু’ চিরকাল লুকিয়ে আছে। মনে হয় জীবনের বহু বিপর্যয়ের মধ্যেও বিজনের ভিতরের সেই শিশুটি এখনও সাবালক হয়নি। আর শম্ভু? যেমন ছিল ঠিক তেমনিই আছে, স্বনামধন্যতা তার নিজের কাছে নিজের মূল্য এতটুকু বাড়ায়নি। আমিও যেমন ছিলাম তেমনি আছি, অন্তত যারা আমাকে চেনে ও জানে তাদের কাছে। কিন্তু সারাজীবন আমার একটা মুশকিল হয়েছে, আমার চরিত্রের মারাত্মক একটা গুণ বা গলদের জন্য। সেটা হল ‘বুদ্ধি’ ও ‘হৃদয়’ এই দুইয়ের মধ্যে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব। তার ফলে নিজে যেমন নির্যাতিত হয়েছি, বহু রামশ্যামের দ্বারা পদে পদে প্রতারিত হয়েছি, তেমনি অন্যদের প্রতিও অবিচার কম করিনি।
সে যা—ই হোক, এই বুদ্ধি ও হৃদয়ের দ্বন্দ্বের জন্য শম্ভু ও বিজন দু—জনের প্রতিই আকৈশোর আমার প্রবল আকর্ষণ ছিল। কিন্তু সাহিত্যকর্মের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল স্কুলের ছাত্রজীবন থেকে এবং সে সাহিত্য (সর্বপ্রথম স্কুল—ম্যাগাজিনে প্রকাশিত) স্বভাবতই অত্যন্ত রোমান্টিক ও হৃদয়সর্বস্ব। কলেজের ছাত্রজীবনে এই ধারাই কিছুদিন চলল—অর্থাৎ কবিতা আর গল্প লেখা। বি. এ. পড়ার সময়, তিরিশের দ্বিতীয় ভাগে, রং বদলাতে লাগল। গল্প, কবিতা ও তার সঙ্গে ছোট ছোট নাটিকা লিখতে লাগলাম, কিন্তু ক্রমেই তার সুর অন্যরকম হতে থাকল। সুরটা বিদ্রোহের সুর, কিন্তু বিদ্রোহটা অনেকটা নিরাকার। এইসময় স্পেনের গৃহযুদ্ধও ইয়োরোপে ফ্যাসিজমের অভ্যুদয়ের পর কমিউনিজম ও মার্কসিজমের ঢেউ এসে লাগল মনে। রুশ বিপ্লব, কমিউনিজম সবই তখন অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ব্যাপার। বয়স তখন আঠারো—উনিশ। বেশ মনে আছে, এক বন্ধু লুকিয়ে লুকিয়ে লেনিনের বই নিয়ে কলেজে আসত এবং ক্লাসে পিছনের বেঞ্চে বসে বইগুলো দেখেই শিহরন হত, মনে হত যেন এক—একটা আগুনে—বোমা হাতে নাড়াচাড়া করছি। একদিকে লেনিন, অন্যদিকে র্যালফ ফস্প, স্টিফেন স্পেন্ডার, কডওয়েল, সিসি ডেলুইস প্রমুখ তখনকার মার্কসীয় কবি—সাহিত্যিকদের সাহিত্য এইসময় আমার সাহিত্যচিন্তা ও কর্মকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে।
অল্পদিনের মধ্যে আমার লেখা ‘শিল্প, সংস্কৃতি ও সমাজ’ (১৯৩৯—৪০) এবং ‘নূতন সাহিত্য ও সমালোচনা’ প্রকাশিত হয়, বয়স তখন বাইশ—তেইশ বছর। আমার লেখায় কমিউনিস্ট গোঁড়ামি ও উগ্রতা বেশি ছিল বলে তখনকার অভিজাত মার্কসীয় বুদ্ধিজীবীরা (যাঁরা সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে নীতির পক্ষপাতী, আজ পর্যন্ত) আমাকে প্রায় একঘরে করে ফেলেছিলেন। খুব সহজেই আমি কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ আমার আর্থিক বা অন্য কোনওরকমের আভিজাত্য ছিল না যাতে কমিউনিস্ট (নেতা) মহলে প্রতিপত্তি থাকতে পারে। কথাটা খুবই বেখাপ্পা মনে হতে পারে কিন্তু অত্যন্ত খাঁটি কথা। কেবল একজনের কথা আমার আজও মনে আছে এবং যতদিন বেঁচে থাকব মনে থাকবে—তিনি হলেন জনাব মুজফফর আহমদ। মুজফফর সাহেব আমার চরম আর্থিক দুর্গতির মধ্যে নানা রকমের লেখার কাজ দিয়ে (ন্যাশনাল বুক এজেন্সির) আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং সর্বদা সস্নেহে খোঁজখবর করেছেন। বাংলা দেশে এরকম একজন আদর্শ মানুষ ও আদর্শ কমিউনিস্ট আজও আমার চোখে পড়েনি। আমার মনে আছে, ফ্যাসিজম—বিরোধী রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও সোভিয়েত রাশিয়া সম্বন্ধে রচনা তখন আমি অনর্গল লিখছি, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র রবিবাসরীয় বিভাগের প্রধান রচনাটি সেইসময় প্রায় আমার একচেটিয়া ছিল। এই লেখাগুলির সূত্র ধরে মুজফফর সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়, যোগাযোগ করে দেন এক বন্ধু। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে ‘অ্যাভিনিউ বোর্ডিং’—এ তখন মুজফফর সাহেব থাকতেন মনে আছে। তঁর সম্বন্ধে কত গল্প শুনেছি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি, কিন্তু সামনে উপস্থিত হয়ে আলাপ করে মনে হল এরকম সহজ মানুষ দেখিনি। মুজফফর সাহেবের মতো অকৃত্রিম মানবিকতা ও আদর্শনিষ্ঠার প্রতিমূর্তি একজন সত্যিকার মানুষের সঙ্গে আমার কমিউনিস্ট আদর্শানুরাগের প্রথম পর্বে যদি পরিচয় না হত, তাহলে আজ পর্যন্ত অন্তত আমাদের দেশের কমিউনিস্টদের (নেতৃস্থানীয়) প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বজায় রাখা সম্ভব হত কি না সন্দেহ। আার ‘সোভিয়েত সভ্যতা’ নামে দুই খণ্ড বই আমি মুজফফর সাহেবকেই উৎসর্গ করি, আর ‘আন্তর্জাতিক রাজনীতি’ নামে ফ্যাসিজম—বিরোধী রচনাসংকলন উৎসর্গ করি বিজন ভট্টাচার্যকে। তা ছাড়া ‘ভারত ও সোভিয়েত মধ্য এশিয়া’ ‘সোভিয়েতবিরোধী চক্রান্ত’ বইগুলি মূলত মুজফফর সাহেবের প্রেরণাতেই লিখি। এখন এসব লেখার কথা ভুলে গিয়েছি, কোনওদিন আর এই বইগুলোর পুনরাবির্ভাব সম্ভব হবে না। আজ মনে হয় কোথায় ‘সোভিয়েত সভ্যতা’ আর কোথায় আমি।
এইসময় সাপ্তাহিক ‘ভারত’ পত্রিকা নবপর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করে, সম্পাদক পরলোকগত অধ্যাপক অতীন্দ্রনাথ বসু। গোপালদা (গোপল হালদার), অতীনবাবু জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তখন উভয়েই কমিউনিজম—বিরোধী। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার লেখার জন্য তাঁরা আমার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। আমার মনে আছে, আমি তখন পৈর্তৃক পরিবার থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে লেখাপড়ার কাজ করার জন্য, মনোহরপুকুরে অশ্বিনী দত্ত রোডে একটি গ্যারাজের উপরের ঘরে একলা থাকি, নিজে রান্না করে খাই ও লিখি। একদিন প্রবল বর্ষণ হচ্ছে এমন সময় সুন্দর সুপুরুষ এক ভদ্রলোক আমার ঘরে ঢুকলেন। তিনি অতীন বসু। পরিচয় হল, অতীনবাবু বললেন ‘ভারত’ পত্রিকায় নিয়মিত রাজনৈতিক লেখা লিখতে। আমার মতামত (কমিউনিস্ট) জানা সত্ত্বেও তিনি এই অনুরোধ করছেন দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই উদারতা অতীনবাবুর ছিল। তাঁর গোষ্ঠীর কয়েকজনের ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি আমাকে ‘ভারত’ পত্রিকায় লেখার অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন। এই ‘ভারত’ পত্রিকার অফিসে অতীনবাবুই আমাকে গোপালদার (গোপাল হালদার) সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন, গোপালদা তখনও কমিউনিজমে বিশ্বাসী হননি। কিন্তু প্রথম পরিচয়েই আমি মুগ্ধ হই, তারপর গোপালদা যখন মার্কসবাদে অনুরাগী ও বিশ্বাসী হন, তখন থেকে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয় এবং তিনি আজ পর্যন্ত আমাকে বিশেষ স্নেহ ও প্রতীর চোখে দেখেন। গোপালদার সঙ্গে অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক মতামতের মিল হয়তো আজ হবে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি নিঃসংকোচে বলব এরকম উদারহৃদয় নিষ্ঠাবান মানুষ আজকের দিনে সত্যিই দুর্লভ। ‘ভারত’ পত্রিকা থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ইংরেজি ‘ফরয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকায় গোড়া থেকেই সহকারী সম্পাদকরূপে যোগ দিলাম, গোপালদাও ছিলেন। এই পত্রিকার জন্যে যে কত লেখা লিখেছি এবং পপুলার প্রিন্টিং ওয়ার্কসে (মধু রায় লেনে) রাত জেগে, চাচার হোটেলে খেয়ে কাটিয়েছি তার ঠিক নেই। ‘ফরয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকার লেখা থেকে আরম্ভ করে প্রোডাকশন তদারক করার বেশির ভাগ দায়িত্ব আমার উপর থাকত। আমার অন্যতম সহযোগী ছিলেন তখন বন্ধু শ্রীপ্রসাদ উপাধ্যায়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র তখন বাইরে কংগ্রেস বিদ্রোহীর বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁর ‘সম্পাদকীয়’ প্রবন্ধ রাতে (অনেক সময় গভীর রাতে) টেলিগ্রাম—আকারে আসত এবং রাতভর বসে তার কপি তৈরি করে আমাকে প্রেসে কম্পোজ করিয়ে, গ্রুপ দেখে ছাপার ব্যবস্থা করতে হত। ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’—এর পর সত্যেনদার (সত্যেন মজুমদার) ‘অরণি’ পত্রিকার পর্ব। আমি ও সরোজ দত্ত (পুলিশ দ্বারা নিহত বলে কথিত) সত্যেনদার ডান হাত ও বাঁ হাত।
এদিকে সোৎসাহে আমরা ফ্যাসিস্ট—বিরোধী আন্দোলন আরম্ভ করেছি। F.S.U. (Friends of the Soviet Union) এবং ‘ফ্যাসিস্ট—বিরোধী লেখক সংঘ’ স্থাপিত হয়েছে ৪৬ নং ধর্মতলা স্ট্রিটে। ‘এফ.এস.উ.—কে রঙ্গ করে ‘ফেচু’ বলা হত। এইসময় ‘ইপতা’ও (I.P.T.A.—Indian Peoples Theatre Association) সংক্ষেপে ইপতা বলা হত। স্থাপিত হল। গান আর নাটকের উৎসব আরম্ভ হল। ‘সোভিয়েটভূমি বিশ্বশ্রমিকপ্রিয়’ গান আন্তর্জাতিকের সুরে আমরা সর্বত্র, সভাসমিতির অনুষ্ঠানে গাইতাম। লিডার বিনয় রায়—আর গাইয়ে আমি, স্বর্ণকমল (ভট্টাচার্য), চিনুবাবু (চিন্মোহন সেহানবীশ), স্নেহাংশুবাবু (স্নেহাংশু আচার্য বর্তমানে পাবলিক প্রসিকিউটর), দিলীপ বসু, শ্রীমতী সুজাতা দেবী, শ্রীমতী সুপ্রিয়া দেবী (স্নেহাংশুবাবুর স্ত্রী) প্রভৃতি। একটি গান ইংরেজি থেকে অনুবাদ করা হয়েছিল এইভাবে—
লালফৌজের প্রতি-আক্রমণে
নাকসি সৈন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ়
কিন্তু গানের মধ্যে এরকম ভয়াবহ শব্দসমাবেশ সত্ত্বেও আমরা সুন্দরভাবে ইন্টারন্যাশনালের সুরে গাইতে পারতাম, এখনও আমি মাঝেমধ্যে বাথরুমে গাইতে গাইতে নিজের মনে হাসি। গান আর নাটক অভিনয়ের রীতিমতো জোয়ার এনে দিলাম আমরা। নাটক দরকার। আমি লিখলাম ‘ল্যাবোরেট রী’, বিখ্যাত অভিনেতা মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য লিখলেন ‘হোমিওপ্যাথি’, বিজন লিখল ‘জবানবন্দী’। শম্ভু ও বিজন দু—জনকেই আমিই টানতে টানতে ‘ইপতা’র আন্দোলনের মধ্যে এবং কমিউনিস্ট আদর্শের সংস্পর্শে নিয়ে আসি। বিজনকে টানতে কষ্ট হয়নি, সহজেই সে এদিকে চলে আসে। শম্ভুকে নিয়ে খুব বেগ পেতে হয়েছিল। শম্ভু তখন ফ্রয়েড আর রাসেল নিয়ে বিভোর, দিনের পর দিন বহু যুক্তিতর্ক আমার সঙ্গে… ফ্রয়েড ও রাসেল বনাম মার্কস। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিনরাত পড়ে আর গলা ছেড়েও অভিনয়—আবৃত্তি করে। অভিনয়—আবৃত্তি করা আর পড়া ছাড়া শম্ভুর আর কোনও কাজ ছিল না। এই দুটোই তার জীবনের সর্বগ্রাসী নেশা। কিছুতেই শম্ভু ৪৬ নং ধর্মতলায় যাবে না, শেষে অনেক বুঝিয়ে, ‘আমরা নাটক রিহার্সাল দিচ্ছি, তুই দেখবি কেমন হচ্ছে’ এইসব বলতে বলতে তার ইচ্ছা হল যাবার। কারণ নাটক আর অভিনয়ের কথা শুনে তার পক্ষে আর চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। তারপর যা শম্ভুর পরিণতি হল তা তো সকলেরই জানা আছে। তৃপ্তি (শ্রীমতী তৃপ্তি মিত্র, শম্ভুর স্ত্রী এবং বিখ্যাত অভিনেত্রী বর্তমানে) তার আগে থেকেই আসতেন, অভিনয়ও করতেন। ছেলেবেলা থেকেই এদিকে তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তখন তৃপ্তিদেবী নিতান্তই বালিকা, সত্যেনদার (মজুমদার) ভাগনি, আমাদের বিশেষ প্রীতির পাত্রী। সুজাতা—সুপ্রিয়াদেবী দুই বোন খুব ভালো অভিনয় করতেন, পরে তাঁদের তৃতীয় ছোটবোন সুচিত্রাদেবীও (বিখ্যাত গায়িকা) আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। বিখ্যাত অভিনেতা পরলোকগত মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য মশায়কে শম্ভুই আমাদের দলে টেনে নিয়ে আসে। দল বেশ জমে ওঠে। চল্লিশের গোড়া থেকে আমাদের নাটকগুলির অভিনয় রীতিমতো একটা সাড়া জাগায় চারিদিকে। বহু জায়গায় অভিনয় হয়। মনোরঞ্জনবাবু ও শম্ভুই প্রধান অভিনেতা। তারপর বিজনের ‘নবান্ন’ নাটক রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বিজনের রচনা নয় শুধু, তার অভিনয়েও সকলে অভিভূত হয়ে যায়। শম্ভু আর বিজনের অভিনয় ও মনোভঙ্গির মধ্যে অনেক পার্থক্য। কিন্তু তা থাকলেও গণনাট্য আন্দোলনে দু—জনের দান অতুলনীয়। আর আমি নিজে তো নাটক অভিনয় গান কবিতা গল্প ইত্যাদি রাজ্য থেকে অন্য এক রাজ্যে এমনভাবে নির্বাসিত ও নিমজ্জিত হয়ে গেয়েছি, যে বছরে একটা সিনেমা বা নাটক দেখি কি না সন্দেহ। এমনকী শম্ভু—বিজনের নাটকও দু—একটা ছাড়া দেখিনি।
চল্লিশের গোড়ায় গননাট্য আন্দোলনে আর যাঁরা বিশেষ উৎসাহী ছিলেন ও সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে সুধী প্রধান, সুনীল চট্টোপাধ্যায় (পল্টুবাবু, ‘কেরানী’ নাটকের লেখক) এঁদের নাম করতে হয়। সুধীবাবুর উৎসাহ, কর্মদক্ষতা ও সংগঠনশক্তি ছিল অদ্বিতীয়, এরকম অক্লান্ত কর্মী সত্যিই সচরাচর দেখা যায় না। গণনাট্য আন্দোলন সুধী প্রধানের কাছেও যথেষ্ট ঋণী। পল্টুবাবু (সুনীল চট্টোপাধ্যায়) আজ সকলের অন্তরালে আছেন, অনেকেই হয়তো তাঁর কথা জানেন না। কিন্তু আমি জানি আধুনিক নাট্য আন্দোলনে তাঁর দান অনেক দিক থেকে স্মরণীয়। পল্টুবাবু আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন, নিস্পৃহ কিন্তু মেয়েদের মতো অভিমানী। কোনওদিন তিনি লোকচক্ষুর সামনে আসার চেষ্টা করেননি, পরদার আড়ালে থেকে অনেক গুরুদায়িত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। ‘কেরানী’ নাটক, আমার যত দূর মনে পড়ছে, বোধহয় আধুনিক নাট্য আন্দোলনে তাঁর সর্বপ্রথম দান ও কীর্তি। শুধু নাটক লেখায় নয়, নাটক প্রযোজনায় পল্টুবাবুর কৃতিত্বের কথা অনেকেই জানেন না। গণনাট্য সংঘের বহু নাটকের প্রযোজনায় পল্টুবাবুর যথেষ্ট দান ও কৃতিত্ব আছে। বাস্তবিক গুণী লোক পল্টুবাবু, নাটক সম্বন্ধে ও নাট্যপ্রযোজনায় তাঁর চমৎকার জ্ঞান আছে। আজকে যাঁরা নতুন নাট্য আন্দোলন করছেন তাঁরা হয়তো এখন কিছুটা তাঁকে কাজে লাগাতে পারেন, যদিও ইদানীং তিনি নানা কারণে অত্যন্ত মনমরা হয়ে গিয়েছেন।
একটা কথা মধ্যে মধ্যে আমার মনে হয়। চল্লিশে ইপতা—র নাট্য আন্দোলন যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল বাংলা দেশে, আজকের নাট্য আন্দোলনে অনেক প্রতিভাবান প্রযোজক—অভিনেতা থাকা সত্ত্বেও কেন সেরকম আলোড়ন হচ্ছে না? অবশ্য সামাজিক পরিবেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, প্রায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলা চলে? কিন্তু তবু মনে হয়, বিষয়ে কিছু ভাববার আছে। জীবন ‘অ্যাবসার্ড, জগৎ ‘অ্যাবসার্ড’, সমাজ ‘অ্যাবসার্ড’, অতএব ‘অ্যাবসার্ড ড্রামা’—ভালোকথা। ‘অ্যালিয়েনেশন’ সত্য নয় শুধু, বিরাট মার্কসীয় সত্য আজকের সামাজিক জীবনে। সে কথাও ঠিক। শিল্পোন্নত টেকনোলজিক্যাল সমাজে মজুরশ্রেণির বিরাট অংশও ‘অ্যালিয়েনেটেড’, যেমন উপরের ম্যানেজার—এগজিকিউটিভ এবং মধ্যের বিশাল উৎপাদন—সম্পর্কশূন্য ‘স্যালারিয়েট’ স্তর। সবই ঠিক কথা। কিন্তু তবু মনে হয় এ বিষয়ে ভাববার আছে। ‘রিয়ালিটি’ বা সামাজিক সত্য কখনো কোনওদিনই একরঙা নয়, ‘প্রিজম্যাটিক’ বা সাতরঙা, বিশেষ করে বর্তমানে ‘প্রিজম্যাটিক’ তো বটেই। যাঁরা সাম্প্রতিক নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের শক্তি ও প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা আছে বলেই নিবেদন করছি, তাঁরা এই কথাটা ভেবে দেখবেন, বিশেষ করে একালের নাট্যকাররা।
১৯৬৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন