মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ

বিনয় ঘোষ

মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ

এ কথা আজ সকলেই স্বীকার করবেন যে আমরা এক অতিদ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে বাস করছি। পরিবর্তনের দ্রুততা এত প্রখর যে তার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে চলাই মহাসমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজকের ধ্যানধারণা কালকে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। আজকের ভালোমন্দ বিচারের মানদণ্ড কালকে বদলাতে হচ্ছে। বন্ধ জলে লগি ঠেলে নৌকা বাইতে আমরা অভ্যস্ত, স্বভাবতই তাই প্রবল খরস্রোতে হাল ধরে রাখাই সম্ভব হচ্ছে না। আগেকার কোনও যুগের সঙ্গে এ যুগের এই বেগবান জীবনের তুলনা করা চলে না। এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ, সকলেই একবাক্যে বলবেন, বৈজ্ঞানিক প্রগতি। অন্য ভাষায় এই বৈজ্ঞানিক প্রগতিকে বলা যায়, সমাজের কাজের জন্য প্রাকৃতিক শক্তির পরিপূর্ণ মুক্তি ও প্রয়োগ। প্রাকৃতিক শক্তির এই মুক্তির সঙ্গে আরও অনেক শক্তির মুক্তি ঘটেছে। তাদের ‘সামাজিক শক্তি’ বলা যায়। প্রাকৃতিক শক্তি (natural forces) এবং সামাজিক শক্তি (social forces), দুয়েরই মুক্তির ফলে, জীবনের ধারার ও গতির আমূল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতির স্তরে স্তরে যে শক্তি এতকাল গোপন ছিল শুধু যে তাকেই আমরা মুক্ত করেছি তা নয়, সমাজের স্তরে স্তরে যে শক্তি চিরকাল উপেক্ষিত ছিল, তাকেও আমরা আজ মুক্ত করেছি, জাগিয়ে তুলেছি। সেই শক্তি হল সমাজের গণতান্ত্রিক শক্তি। এই গণতান্ত্রিক শক্তির ব্যাপকতা ও গভীরতা সম্বন্ধে এতদিন আমাদের সম্যক ধারণা ছিল না। ব্যক্তি—স্বাধীনতা ও গোষ্ঠী—স্বাধীনতার ভিত্তির উপর গণতান্ত্রিক সমাজের সৌধ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা, দেশভেদে দু—চার শতাব্দী আগে, আধুনিক বিজ্ঞানের শুভযাত্রা শুরু হওয়ার দিনে। তারপর ইতিহাসে কত ঝড়ঝঞ্ঝা, কত দুর্যোগ, কত চড়াই—উতরাই পার হয়ে, প্রকৃত গণতন্ত্রের সেই শক্তিকে আজ আমরা আয়ত্তে এনেছি এবং তার বিকাশের পথ উন্মুক্ত করেছি। এই গণতান্ত্রিক শক্তির উৎস কোথায়? উৎস হল সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রত্যেক মানুষ সমাজে আজ প্রত্যেক ব্যক্তির শক্তি অবাধ মুক্তি পেয়েছে, তার বন্ধনহীন স্ফূর্তির সুযোগ এসেছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরমাণুর অন্তর্নিহিত গোপন শক্তির বিকাশ দেখে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছি। কারণ তার বাহ্যপ্রকাশ বা demonstration-এর আড়ম্বর খুব বেশি, তাই আমাদের চোখ ও মন তাতে ধাঁধিয়ে যায়। সমাজে ব্যক্তির ও গোষ্ঠীর শক্তি প্রকাশেরও একটা বাহ্য দিক আছে, সেটাও কম জমকালো নয়। কিন্তু সেটা আমাদের স্পুৎনিক বা হাইড্রোজেন—বোমার মতো নজরে পড়ে না। অথচ প্রকৃতির অ্যাটমের মতো সমাজের অ্যাটম যে ব্যক্তি ও মানুষ, তার শক্তিও কম প্রচণ্ড নয়। সেই ব্যক্তির অন্তর্নিহিত শক্তিও আজ মুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ সমাজের পরমাণুশক্তিও আজ জেগেছে। গণতন্ত্রের আদর্শ দীর্ঘকালের সংগ্রামের পরে, আজ সার্থক হতে চলেছে।

সেই কারণেই আজ সমাজের রূপ বদলে গিয়েছে এবং প্রতিদিন বদলাচ্ছে। যে বিরাট সামাজিক শক্তিকে আজ আমরা জাগিয়ে তুলেছি, তার বহুমুখী বিচিত্র প্রকাশ দেখে আমরা নিজেরই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। সেই শক্তিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রিত করা যায়, কীভাবে তার বৈচিত্র্য ও বিরোধের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করা যায়, আজও তার কলাকৌশল আমরা উদ্ভাবন করতে পারিনি। পরমাণুর প্রচণ্ড শক্তিকে যেমন আমরা ব্যাপক ধ্বংসের কাজে লাগাতে পারি, আবার মানুষের কল্পনাতীত কল্যাণের কাজেও নিয়োগ করতে পারি, তেমনি ব্যক্তির এই আত্মশক্তির প্রখর চেতনাকে, অর্থাৎ বন্ধনহীন ব্যক্তিস্বাধীনতাকে, আমরা সমাজের বিকলন বা disintegration, অথবা সমাজের নবরূপায়ণ বা re-integration—এর জন্য নিয়োগ করতে পারি। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি, অথবা প্রত্যেক সংঘ বা গোষ্ঠী (groups and association), আজ যদি কেবল আত্মশক্তির demonstration—এর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, তাহলে সমস্ত ব্যক্তির ও গোষ্ঠীর শক্তির অন্ধ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষের মধ্যে সমাজটা একটা কুরুক্ষেত্রে পরিণত হবে, এবং সেই কুরুক্ষেত্রের মধ্যে ধর্মাবতার এক ডিক্টেটরের অবতীর্ণ হতেও বিলম্ব হবে না। সামাজিক উচ্ছৃঙ্খলতার জোয়ারের মধ্যে সশব্দে সামরিক কুচকাওয়াজ করে ডিক্টেটর—অবতার এসে তখন বলবেন: ‘হে অমৃতের পুত্ররা। ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত পূর্ণ—স্বাধীনতার জন্য তোমরা লড়াই করেছিলে, সে স্বাধীনতা তোমরা পেয়েছিলে, কিন্তু তার মর্যাদা তোমরা রাখতে পারেনি। তার অপব্যবহার করতে তোমরা দ্বিধা করোনি। তাতে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। অতএব, স্বাধীনতার কথা ভুলে গিয়ে আমার আদেশ পালন করো, আমাকে অনুসরণ করো।’ গভীর হতাশা ও নৈরাশ্যের মধ্যে আমরাই তখন তাঁকে saviour বলে মেনে নেব এবং বিনা দ্বিধায় সমস্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিতেও কুণ্ঠিত হব না। সমজের দ্রুত পরিবর্তন ও ব্যাপক ভাঙনের রূপ দেখে সম্প্রতি একদল দার্শনিক এসে ভয়াবহ সুর তুলেছেন, এবং মিলিটারি অবতারের মোহে আকৃষ্ট হয়ে উঠেছেন। সমাজের ভাঙনটাই তাঁদের কাছে বড় সত্য হয়ে উঠেছে।

এ কথা অবশ্য ঠিক যে সমাজের ভাঙনের দৃশ্য আজ এত ব্যাপকভাবে প্রকট, নীতি শিক্ষা সংস্কৃতি মানবিক সম্পর্ক ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে, যে কেবল সেইদিকে চেয়ে দেখলে আশাভরসার কোনও বন্দরই কোথাও নজরে পড়ে না। কিন্তু সেটা যত ভয়াবহ দিকই হোক, সেটা একটা দিক মাত্র। সমাজের নতুন গড়নেরও একটা দিক আছে, তার দিকেও চেয়ে দেখা দরকার। যে নদীর গতি মন্থর, তার তীর ভাঙা—গড়ার গতিও মন্থর। কিন্তু যে নদী দুর্ধর্ষ বেগবতী ও খরস্রোতা তার ভাঙনের গতিও প্রচণ্ড। যত দ্রুত সে ভাঙে, তত দ্রুত সে নতুন গতিপথ তৈরি করতে পারে না, তার স্থিতি সময়সাপেক্ষ। বহু পুরানো উপমা হলেও, সমাজের গতির সঙ্গে এর তুলনা করা যায়। আগেকার যুগে সমাজের গতি ছিল মন্থর, তাই সমাজের ভাঙন ও গড়নের সঙ্গে মানুষ ধীরেসুস্থে খাপ খাইয়ে নিতে পারত। বর্তমানের সমাজের পরিবর্তনের গতি এত প্রবল যে তার ভাঙনের ব্যপকতার সঙ্গে এবং গড়নের নতুন পদ্ধতি ও পথের সঙ্গে, মানুষ সামাঞ্জস্য স্থাপনে ব্যর্থ হচ্ছে। ভাঙনের রূপ এবং গড়নের নতুন টেকনিক এখনও সম্পূর্ণরূপে আমরা বুদ্ধির আয়ত্তের মধ্যে আনতে পারিনি। গড়নের নতুন কলাকৌশল আরও তৎপরতার সঙ্গে উদ্ভাবন করা এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করাই হল আজকের বড় সমস্যা। তা না হলে, ভাঙন ও গড়নের মধ্যে ‘gap’ বা ব্যবধান এত বেড়ে যাবে যে গড়নের কোনও সম্ভাবনাই পরে আর থাকবে না। তার জন্য সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে, কারণ এ কথা সবসময় মনে রাখা দরকার যে সামাজিক শক্তির বিকাশের মধ্যে spontaneity বা automatism, বা স্বয়ংক্রিয়তা বলে কিছু নেই। সামাজিক শক্তির আধার যে মানুষ, সেই মানুষকেই সচেতন বা সক্রিয়ভাবে তার বিকাশে অংশগ্রহণ করতে হবে। এই সামাজিক গুরুদায়িত্ব বহন করার প্রধান ভার আজ সমাজের নানারকম সভাসমিতি অ্যাসোসিয়েশন ও গোষ্ঠীর উপর পড়েছে। বর্তমান যুগে এই জাতীয় অ্যাসোসিয়েশনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা কী এবং তার দায়িত্ব ও কর্তব্যই বা কী, সে সম্বন্ধেও আজ তাই আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

গোষ্ঠীবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ হওয়া মানুষের অন্যতম সামাজিক বৃত্তি। এ কথা সকলেই জানেন। কিন্তু গোষ্ঠী ও সংঘের শ্রেণিভেদ আছে মানুষের সামজে। সমাজবিজ্ঞানীরা এইসব গোষ্ঠী ও সংঘকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন—Primary Groups ও Secondary Groups—প্রাথমিক গোষ্ঠী বা সংঘ এবং মাধ্যমিক গোষ্ঠী বা সংঘ। কেউ কেউ একে in-groups বা অন্তর্গোষ্ঠী এবং out-groups বা বহির্গোষ্ঠীও বলেন। প্রাথমিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য হল, তা আয়তনে ছোট এবং গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মুখোমুখি পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা থাকে। পরিবার বা family হল এই প্রাথমিক গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। ছোট ছোট ক্লাব ও সংঘ অনেক আছে সমাজে, যাদের সভ্যসংখ্যা কম, উদ্দেশ্যও সীমাবদ্ধ এবং সভ্যদের মধ্যে ব্যক্তিগত ও মুখোমুখি পরিচয়ও কিছুটা আছে। তাদের ঠিক পরিবারের মতো মাধ্যমিক গোষ্ঠীও বলা যায় না, আবার বাইরের বড়ো বড়ো সভা—সমিতির মতো মাধ্যমিক গোষ্ঠী বলা যায় না—intermediate groups—বা মধ্যবর্তী গোষ্ঠী বলা যায়। বড় বড় মাধ্যমিক গোষ্ঠী ও সভার বৈশিষ্ট্য হল, তার উদ্দেশ্যের বন্ধন আছে, সভ্যদের মধ্যে ব্যক্তিগত পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতা নেই। যেমন বড় বড় রাজনৈতিক পার্টি। আজকালকার মধ্যবিত্ত কর্মচারীদের অ্যাসোসিয়েশনও তার দৃষ্টান্ত অ্যাসোসিয়েশনের সকলের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় হয়তো নেই, কিন্তু তবু প্রত্যেকে কতকগুলি সামাজিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন বোধ করেন এবং সেই উদ্দেশ্যের অদৃশ্য বন্ধনেই সংঘবদ্ধ হন। সমাজের ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, যত অতীতের দিকে ফিরে যাওয়া যাবে, তত এই ধরনের ‘গ্রুপ’ ও অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, বিশেষ করে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেলে বড় বড় মাধ্যমিক অ্যাসোসিয়েশন একেবারেই নেই দেখা যায়। প্রাইমারি গ্রুপের সংখ্যাই সেখানে বেশি এবং একেবারে আদিম সমাজে ‘পরিবার’ ছাড়া আর কোনও গ্রুপ বিশেষ নেই। মধ্যযুগে বণিক—কারিগরদের Guild ছিল, ধর্মসংঘ ছিল, কিন্তু আধুনিক যুগের অ্যাসোসিয়েশনের গড়ন বা লক্ষ্য, কোনওটার সঙ্গেই তার তুলনা করা যায় না। আধুনিক গণতান্ত্রিক যুগে, ব্যক্তিস্বাধীনতা (freedom of individual) এবং সংঘ—গঠনের স্বাধীনতার (freedom of association) জন্য, গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ হয়েছে এইসব মাধ্যমিক অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যাবৈচিত্র্যের মধ্যে। সেইজন্য আজ এইসব সুসংগঠিত অ্যাসোসিয়েশন, ইউনিয়ন, সোসাইটি ও সভাসমিতি গণতান্ত্রিক সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগেকার সমাজে এই ধরনের অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। মানুষের সে চেতনা বা অধিকার, কোনওটাই ছিল না। তা ছাড়া, সবচেয়ে বড় কথা, কর্মজীবনের ও মনের প্রসারতা তখন ছিল না। পরিবার, পাড়া ও গ্রামের মধ্যেই জীবনের চলাফেরা কাজকর্ম সব সীমাবদ্ধ ছিল, মনটাও তার বাইরে ডানা মেলতে পারত না। আজকাল মানুষের কর্মজীবন প্রসারিত হয়েছে, ক্ষুদ্র পাড়া বা গ্রাম বা স্থানীয় অঞ্চলের গণ্ডি থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। যে কোনও অফিসের কর্মচারীদের কথাই ধরা যাক। বাঙালি কর্মী যাঁরা, তাঁরাও নিজেদের পাড়া—পল্লি ছেড়ে কত দূরে কাজ করতে আসেন। কলকাতা শহরের বাইরে, ২০/৩০/৪০/৫০ মাইল দূর থেকেও অনেকে হয়তো ‘ডেলি প্যাসেঞ্জারি’ করেন। তারে চেয়েও দূর থেকে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, অনেকে এখানে কাজ করতে এসেছেন। সকলে মিলে সংঘ বা অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলেছেন। এই সংঘ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে মনের ও কর্মজীনের প্রসারতার জন্য। কর্মজীবনের ও মনের এই বিকেন্দ্রণ বা decentralisation, আধুনিক বিজ্ঞান ও গণতন্ত্রের যুগের এটা অন্যতম বিশেষত্ব। সমাজবিদরা একে ‘delocalisation of mind’ বলেছেন। ক্ষুদ্রগণ্ডি পাড়া—পল্লি থেকে বৃহত্তর সমাজ পর্যন্ত মানুষের মন আজ প্রসারিত হয়েছে। এই প্রসারণ সম্ভব হয়েছে এই জাতীয় বড় বড় মাধ্যমিক অ্যাসোসিয়েশনের ভিতর দিয়ে। এই প্রসারণ ভিন্ন গণতান্ত্রিক শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব হত না। ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ গণ্ডির পরিবেশের মধ্যে গণতন্ত্রের বীজ অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষুদ্রতা দীনতা স্বার্থপরতা এবং উগ্র অহংসর্বস্বতা ক্ষুদ্রতর গণ্ডির মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বড় মাধ্যমিক অ্যাসোসিয়েশনে তার সম্ভাবনা থাকে না। সমাজের প্রাথমিক গোষ্ঠী পরিবারের মধ্যে যখন আমরা মানুষ হই, তখন প্রত্যেক পরিবারের শিক্ষাদীক্ষা ঐতিহ্য অনুযায়ী আমাদের চরিত্র গড়ে ওঠে। সব পরিবার এক রকমের নয়, স্বভাবতই তাই সকলের ব্যক্তিচরিত্র একই ছাঁচে গড়ে ওঠে না। পরিবারের ক্ষুদ্র গণ্ডিছাড়িয়ে যখন আমরা বাইরের বৃহত্তর অ্যাসাসিয়েশনে এসে মিলিত হই, তখন আমাদের ব্যক্তিচরিত্রের অনেক দোষত্রুটি মার্জিত ও সংশোধিত হবার সুযোগ পায়। বাইরের অ্যাসোসিয়েশন প্রত্যেক ব্যক্তিচরিত্রের Socialisation-এ বা সামাজিক রূপায়ণে সাহায্য করে। ব্যক্তিচরিত্রের যা কিছু অসমতলতা, তাকে সমাজচরিত্রের সঙ্গে সমতল করে তোলে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তাতে সংযত হয় বটে, কিন্তু বিলুপ্ত হয় না। বিলুপ্ত হয়ে আবার বিপদের সম্ভাবনা থাকে। গণতন্ত্রের বদলে মুষ্টিমেয় দু—একজনের স্বেচ্ছাতন্ত্র সেই সুযোগে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সুতরাং ব্যক্তির বা ব্যক্তিত্বের বিলোপ নয়, তার সংযম নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক রূপায়ণই গণতন্ত্রের আদর্শ। গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে বড় বড় অ্যাসোসিয়েশনেরও লক্ষ্য হওয়া উচিত, ব্যক্তিচরিত্রকে এইভাবে গড়ে তোলা।

প্রত্যেক অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকটি প্রধান লক্ষ্য থাকে, সে কথা আগেই বলেছি। যেমন কর্মচারী বা শ্রমিকদের ইউনয়ন—অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান লক্ষ্য ‘অর্থনৈতিক’। বর্তমান সমাজে আর্থিক বৈষম্য, অন্যায় ও অবিচার আছে বলেই, এই ধরনের অ্যাসোসিয়েশন—ইউনিয়নে সংঘবদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রামে করার গণতান্ত্রিক অধিকার মানুষের আছে। কিন্তু অ্যাসোসিয়েশন গড়ার উদ্দেশ্য যদি কেবল অর্থনৈতিক হয়, তাহলে সেটা কেবল economism ও unionism হয়ে ওঠে। সংগত আর্থিক সাম্য প্রতিষ্ঠা নিশ্চয় গণতন্ত্রের অন্যতম লক্ষ্য, কিন্তু যার জন্য এত কাণ্ড করা, অর্থাৎ যে মানুষের জন্য, সেই মানুষই যদি এর মধ্যে পচে—গলে বিকৃত হয়ে যায়, তাহলে কার জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? সঙ্গে সঙ্গে তাই মানুষের চরিত্রের গণতান্ত্রিক ও বিকাশের দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যে মানুষ ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভার বহন করবে, তার নিজের চরিত্রও তো সেইভাবে গড়ে তোলা দরকার। তার মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধও জাগিয়ে তোলা দরকার। কে বা কারা তা গড়ে তুলবে? গড়ে তুলবে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী, গ্রুপ ও অ্যাসোসিয়েশন। প্রথমে গড়বে primary group বা পরিবার। পরিবারের গড়ন ও পরিবেশকে তার জন্য সুস্থ করতে হবে। তারপর গড়ে তুলবে বাইরের ছোটবড় অ্যাসোসিয়েশন। পরিবারের প্রভাব সমাজে চিরকাল যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তা—ই থাকবে। কিন্তু যে সমাজে গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ যত বেশি হবে, সেই সমাজে মাধ্যমিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রভাব তত বাড়বে মানুষের জীবনে। পারিবারিক গোষ্ঠীবন্ধনও দৃঢ়তা স্বভাবতই তার জন্য খানিকটা শিথিল হবে। পরিবারের চেয়ে আজকের সমাজে বাইরের সভা—অ্যাসোসিয়েশনের আকর্ষণ মানুষের কাছে ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। প্রতিদিন আমরা তা দেখতে পাচ্ছি। সেইজন্য আজ বাইরের অ্যাসোসিয়েশনের সামাজিক দায়িত্ব আরও বেশি বেড়েছে। ব্যক্তিচরিত্রের রূপায়ণে পরিবারের খানিকটা দায়িত্ব আজ বাইরের অ্যাসোসিয়েশনকেই পালন করতে হবে। তার উপর তার নিজস্ব দায়িত্ব তো আছেই। এই দায়িত্ব হল, অ্যাসোসিয়েশনের সভ্যদের ব্যক্তিচরিত্রকে মানবিক ও সামাজিক করে তোলা এবং কেবল অর্থনৈতিক চিন্তা ছাড়াও অন্যান্য আরও অনেক নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে স্বাধীনভাবে ও সুস্থভাবে চিন্তা করতে শেখানো। তার জন্য একটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যসূচিও প্রত্যেক অ্যাসোসিয়েশনের থাকা উচিত। যেমন সমাজের নানা রকমের সমস্যা নিয়ে মধ্যে মধ্যে আলাপ—আলোচনা করা, দেশের শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি ও শিল্পকলার গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে, তার সুস্থ বিকাশে সহায়তা করা।

১৯৫৮

সকল অধ্যায়

১. বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ
২. মার্কসবাদ ও মর্গানবাদ – বিনয় ঘোষ
৩. বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা – বিনয় ঘোষ
৪. গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ
৫. মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ
৬. শিবনাথ শাস্ত্রী – বিনয় ঘোষ
৭. সমাজপতি মহারাজা নবকৃষ্ণ – বিনয় ঘোষ
৮. ঠাকুর পরিবারের আদিপর্ব ও সেকালের সমাজ – বিনয় ঘোষ
৯. বিদ্যাসাগর-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১০. রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১১. বিবেকানন্দ-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১২. জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ
১৩. অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৪. সমাজবিজ্ঞানীর এ কোন শোচনীয় পরিণতি! – বিনয় ঘোষ
১৫. মেহনত ও প্রতিভা – বিনয় ঘোষ
১৬. দীবনন্ধু মিত্র বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও বাঙালি সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৭. বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদিপর্ব – বিনয় ঘোষ
১৮. তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ
১৯. সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ
২০. ‘গেট টু-গ্যাদার’ – বিনয় ঘোষ
২১. অর্থনীতির ভোজবাজি – বিনয় ঘোষ
২২. গৃহভৃত্যদের সামাজিক ভূমিকা – বিনয় ঘোষ
২৩. স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ
২৪. রামমোহন রায়ের জীবনচরিত – বিনয় ঘোষ
২৫. এক পুরুষের দুস্তর ব্যবধান – বিনয় ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন