বিনয় ঘোষ
‘আমি শৈশবাবধি বিদ্যাসাগরের চেলা।’ একথা শিবনাথ শাস্ত্রী বলতেন। তাঁর পিতা পণ্ডিত হরানন্দ ভট্টাচার্য এবং মাতুল পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ উভয়েই ছিলেন বিদ্যাসাগরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। কাজেই বাল্যকাল থেকে বিদ্যাসাগর শিবনাথকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। শিবনাথের কৈশোর বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারকর্মের দ্বিপ্রহর। যৌবনে জীবনের সকল রকমের সমস্যা ও সংকটের মধ্যে বিদ্যাসাগরের সাহচর্য ও পরামর্শ শিবনাথের কাছে সহজলভ্য ছিল। অনেক ক্ষেত্রে শিবনাথ বাস্তবিকই বিদ্যাসাগরের চেলা ছিলেন, কেবল একটি ক্ষেত্র ছাড়া, যেক্ষেত্রে শিবনাথের ব্যক্তিত্বের সমগ্ররূপ অভিব্যক্ত। সেই ক্ষেত্রটি হল ‘ধর্ম’। বিদ্যাসাগরের কাছে ধর্মের কোনও স্বতন্ত্র সত্তা ছিল না, তাঁর মানববোধ ও সমাজবোধের মধ্যে ধর্মবোধ বিলীন হয়ে গিয়েছিল। তাই পৃথক প্রার্থনা ও উপাসনার ভিতর দিয়ে কোনও অধ্যাত্মলোকে তিনি কখনো শাস্তি বা মুক্তি কামনা করেননি। শিবনাথের কাছে ধর্মজীবনই ছিল মুখ্য, জীবনের মূল ভিত। ধর্মের এই ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাঁর মানববোধ ও সমাজবোধ। তাঁর সমগ্র সত্তা ও ব্যক্তিত্ব ধর্মভাবের অলৌকিক রাগে রঞ্জিত। চলিত অর্থে ‘ধার্মিক’ নয়, দার্শনিক অর্থে শিবনাথ ছিলেন প্রকৃত ধর্মপ্রাণ পুরুষ। তাঁর বিচিত্র কর্মবহুল জীবন পর্যালোচনা করতেই দেখা যায়, এই ধর্মপ্রাণতা প্রাত্যহিক জীবনের যাবতীয় মালিন্যের উর্ধ্বে তাঁকে এক ইন্দ্রিয়াতীত স্থৈর্যের রাজ্যে সমাহিত করে রাখত। তাঁর কর্মজীবনেরও সমস্ত শক্তির উৎস ছিল এই ধর্মবোধ। গুরু বিদ্যাসাগর ও চেলা শিবনাথের চরিত্রের মধ্যে পার্থক্য ছিল এইখানে।
পার্থক্য সত্ত্বেও উভয়ের চরিত্রের মধ্যে মিলও ছিল অনেক। বিদ্যাসাগরের শিষ্যত্ব দাবি করার অধিকার ছিল শিবনাথের। চারিত্রিক দৃঢ়তা নিষ্ঠা সমাজচিন্তা উদারতা ও আত্মবিশ্বাস, সব দিক দিয়েই শিবনাথ ছিলেন বিদ্যাসাগরের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী। বালিকাবধূ প্রসন্নময়ীর সঙ্গে যখন পিতার মেজাজের জন্য তাঁর বিচ্ছেদ ঘটল এবং পিতারই আদেশে যখন আঠারো—উনিশ বছর বয়সে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ (বিরাজমোহিনীকে) করতে বাধ্য হইলেন, তখন তিনি লিখেছেন, ‘আত্মনিন্দাতে আমার মন অধীর হইয়া উঠিল।’ ‘এই অবস্থাতে আমি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হইলাম।’ এইসময় ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে তাঁর সংযোগ হল। পিতা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে তিরস্কার করেন। শিবনাথ পিতাকে বলেন, ‘আপনার সকল আজ্ঞা পালন করিতে রাজি আছি, কিন্তু আমার ধর্মজীবনে হাত দিবেন না।’ তখন শিবনাথের ছাত্রজীবন, তিনি দক্ষিণ কলিকাতায় থাকতেন। পুত্রের এই কথাবার্তা শুনে পিতা যখন গ্রামে ফিরে গেলেন, তখন তাঁর বিষণ্ণ মুখ দেখে মা জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলে কেমন আছে। পিতা অধিকতর গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলেন ‘সে মরেছে।’ শিবনাথ লিখেছেন, ‘অমনি আমার মা ”ওগো কি বল গো” বলিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। তাঁহার ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া পাশের বাড়ির মেয়েরা ছুটিয়া আসিলেন। তখন বাবা গম্ভীরস্বরে বলিলেন, সে মরার মধ্যে। সে ব্রাহ্মসমাজে যেতে আরম্ভ করেছে, আমি বারণ করলেও শুনবে না।’
ব্রাহ্মসমাজের এই নতুন ধর্মচেতনার মধ্যে শিবনাথ এক আশ্চর্য প্রাণশক্তির উৎস আবিষ্কার করেছিলেন, এবং সেই শক্তি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, বারংবার মৃত্যু ঘটায়নি। এই বয়সেই তাঁর নতুন ধর্মবিশ্বাস অনুসারে চলবার জন্য তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। তিনি যখন গ্রামের বাড়িতে উপস্থিত থাকতেন তখন কুলদেবতাদের প্রতিমাগুলিকে তিনি নিজেই পুজো করতেন। এবারে তিনি স্থির করে গেলেন ‘ঠাকুরপুজো’ আর করবেন না। ‘গিয়াই মাকে সে সংকল্প জানাইলাম।’ তারপর কী হল?
মা ভয়ে অবশ হইয়া পড়িলেন। বুঝিলেন একটা মহা সংগ্রাম আসিতেছে। আমাকে অনেক অনুরোধ করিলেন। আমিও কোনও মতেই প্রস্তুত হইতে পারিলাম না। ধর্মে প্রবঞ্চনা রাখিতে পারিব না বলিয়া করযোড়ে মার্জনার ভিক্ষা করিলাম। অবশেষে সেই সংকল্প যখন বাবার গোচর করা হইল, তখন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুদগমের ন্যায় তাঁহার ক্রোধাগ্নি জ্বলিয়া উঠিল। তিনি কুপিত হইয়া আমাকে প্রহার করিয়া ঠাকুরঘরের দিকে লইয়া যাইবার জন্য লাঠি হস্তে ধাবিত হইয়া আসিলেন। আমি ধীরভাবে বলিলাম, ‘কেন বৃথা আমাকে প্রহার করিবেন? আমি অকাতরে আপনার প্রহার সহ্য করিব। আমার দেহ হইতে এক একখানা হাড় খুলিয়া লইলেও আর আমাকে ওখানে লইতে পারিবেন না।’ এই কথা শুনিয়া ও আমার দৃঢ়তা দেখিয়া তিনি হঠাৎ দাঁড়াইয়া গেলেন এবং প্রায় অর্ধঘণ্টাকাল কুপিত ফণীর ন্যায় ফুলিতে লাগিলেন। অবশেষে আমাকে পূজার কাজ হইতে নিষ্কৃতি দিয়া নিজে পূজা করিতে বসিলেন। সেই দিন হইতে আমার মূর্তিপূজা রহিত হইল।
লাঠি হস্তে ধাবিত অগ্নিমূর্তি পণ্ডিত পিতা চিরাচরিত বাহ্যানুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্মবিশ্বাসের উগ্র প্রতিমূর্তি, এবং তাঁর সামনে দণ্ডায়মান অটল আত্মবিশ্বাস ও বিনয়ের প্রতিমূর্তি নবীন তরুণ ব্রহ্মোপাসক পুত্র শিবনাথ। পিতার আত্মসমর্পণের মানে হল অন্তরের অনাড়ম্বর অকৃত্রিম সরল ঈশ্বর—উপাসনার কাছে ঢাকঢোল—কাঁসরঘণ্টা—নিনাদিত মূর্তিপ্রান্তে আবদ্ধ দেবতার পুজোর পরাজয়। যেমন প্রসন্নময়ীর ক্ষেত্রে রামচন্দ্রর মতো তিনি পিতৃ—আজ্ঞা পালন করেছিলেন, ধর্মের ক্ষেত্রে তা করেননি, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। তাঁর এই বিদ্রোহ যে আদর্শ—সংঘাতের সাময়িক উত্তেজনাসম্ভূত নয়, সতত ও গভীর সত্যবিশ্বাসে প্রোথিত, ব্রাহ্মসমাজের বিভেদ—বিচ্ছেদের ইতিহাসে তাঁর সত্যনিষ্ঠ বিদ্রোহীর ভূমিকা বিচার করলে তা বোঝা যায়।
১৮৪৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর জন্ম এবং ১৮৭২ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ছাত্রজীবনের শেষ। কিন্তু ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর কর্মজীবনের আরম্ভ। ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কারের কাজে এইসময় থেকে তিনি একাগ্রচিত্তে অগ্রসর হন। বিদ্যাসাগরের চেলা তিনি, কাজেই ১৮৭৬ সালে তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে একটি বিধবাবিবাহ দেন। বিবাহ উপলক্ষে বিদ্যাসাগরের কাছে যান এবং বিদ্যাসাগর বিবাহের সমস্ত খরচ ও কন্যার গহনা দেন। ১৮৬৯ সাল থেকেই ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়। তখন তিনি এফ. এ. পাশ করেছেন। তার আগে থেকেই তিনি ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করতেন এবং ব্রাহ্মধর্মের অন্তর্নিহিত সত্য উপলব্ধি করে মূর্তিপূজাও পরিহার করেছিলেন। এইসময় ব্রাহ্মসমাজের পরিবর্তনের ইতিহাসে প্রথম সংকট দেখা দেয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং কেশবচন্দ্র সেনের মনোভঙ্গির পার্থক্য ব্রাহ্মসমাজে বিচ্ছেদ ঘটায়। ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতি শিবনাথের আকর্ষণ ছিল, কিন্তু তরুণদলের নেতা ছিলেন কেশবচন্দ্র। দেবেন্দ্রনাথের দল রক্ষণশীল এবং কেশবচন্দ্রর দল প্রগতিশীল বলে পরিচিত ছিল, যেমন ইতিহাসে প্রবীণ ও নবীনের দল চিরদিন অভিহিত হয়ে থাকে তেমনি। শিবনাথ স্বভাবতই কেশবচন্দ্রর উন্নতিশীল দলের প্রতি আকৃষ্ট হন। ২২ আগস্ট ১৮৬৯ উন্নতিশীল দল ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের দ্বার উদঘাটন করেন। এইদিন কেশবচন্দ্রর কনিষ্ঠভ্রাতা কৃষ্ণবিহারী সেন, আনন্দমোহন বসু, রজনীনাথ রায়, শ্রীনাথ দত্ত প্রমুখ কুড়িজন যুবকের সঙ্গে শিবনাথ প্রকাশ্যে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। এর ছাব্বিশ বছর আগে, ২১ ডিসেম্বর ১৮৪৩ (৭ পৌষ ১৭৬৫ শক) দেবেন্দ্রনাথও কুড়িজন সহকর্মীর সঙ্গে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথসহ একুশজনের এবং ১৮৬৯ সালে শিবনাথসহ একুশজনের ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ, ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্মের ইতিহাসে দুটি ঐতিহাসিক বাঁক পরিবর্তন।
ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণের পর দেবেন্দ্রনাথ বলেন, ‘ব্রাহ্মসমাজের এ একটা নূতন ব্যাপার। পূর্বে ব্রাহ্মসমাজ ছিল, এখন ব্রাহ্মধর্ম হইল…ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করিয়া আমরা ব্রাহ্ম হইলাম এবং ব্রাহ্মসমাজের পার্থক্য সম্পাদন করিলাম।’ দেবেন্দ্রনাথের দীক্ষাকালে ব্রাহ্মধর্মের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা হয়, শিবনাথের দীক্ষাকালে হয় ব্রাহ্মধর্মের পর্বান্তর। শিবনাথ লিখেছেন: ‘আমি উন্নতিশীল দলের সঙ্গে হাড়ে হাড়ে বাঁধা পড়িলাম। অথচ শুনিয়া অনেকে আশ্চর্য বোধ করিবেন যে ইহার পরও আমি তাঁহাদিগের সঙ্গ হইতে লজ্জাবশতঃ দূরে থাকিতাম, তখন আমি প্রতিদিন ব্রহ্মোপসনা করিতাম (যদিও উপবীতটা তখন ছিল), কিন্তু ব্রাহ্মদের সঙ্গে বড় মিশিতাম না। মধ্যে মধ্যে রবিবারে প্রাতে কেশববাবুর কলুটোলার বাড়িতে উপাসনাতে যোগ দিতে যাইতাম, কিন্তু কীর্তনের সময় ব্রাহ্মদিগের অনেকে গড়াগড়ি দিতেন, নানাপ্রকার চিৎকার করিতেন ও পরস্পরের পা ধরাধরি করিতেন, কেশববাবুর পায়ে পড়িতেন, এজন্য ভাল করিয়া উপাসনাতে যোগ দিবার ব্যাঘাত হইত। সেই কারণে সর্বদা যাইতাম না।’
শিবনাথ শাক্তবংশের সন্তান, কাজেই বৈষ্ণবদের ভবোন্মত্ত কীর্তন ও ঢলাঢলি তাঁর কোনওদিনই ভালো লাগত না। তিনি শুধু ব্রাহ্ম ছিলেন না, শক্তিবাদে বিশ্বাসী ব্রাহ্ম ছিলেন। ব্রাহ্মরা যখন কেশবচন্দ্রকে ‘প্রভু ত্রাণকর্তা’ বলে সম্বোধন করে তাঁর চরণ ধরে গড়াগড়ি দিতেন এবং ভাবাচ্ছন্ন হয়ে তাঁর চারিদিকে ঢলাঢলি করতেন, তখন শিবনাথের কাছে তা যে শুধু বুদ্ধিভ্রম বা চিত্তবিকার বলে মনে হত তা নয়, ব্রাহ্ম হিসাবে নৈতিক বিচ্যুতি বলেও মনে হত। আদর্শ ও নীতির ক্ষেত্রে মুখে বলা ও কাজে করার মধ্যে কোনও পার্থক্য শিবনাথ কল্পনা করতে পারতেন না। তাই ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেবার কিছুদিন পরে তিনি পারিবারিক নিগ্রহ ও বিচ্ছেদবেদনা সহ্য করেও ব্রাহ্মণের উপবীত ত্যাগ করেছিলেন। তার জন্য পিতা আঠারো—উনিশ বছর তাঁর মুখদর্শন করেননি এবং তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপও করেননি।
কেশবভক্তদের বৈষ্ণব আচরণ লক্ষ করে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু কেশবচন্দ্র নিজে যে ভক্তিবাদ ও অবতারবাদের মোহজালে জড়িয়ে পড়েছেন বা পড়তে পারেন, এ কথা সহজে তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি কেশবচন্দ্রর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন বলে তাঁর প্রতি আকর্ষণও সহজে ছিন্ন হয়নি। কেশবচন্দ্রর কাছে তিনি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও নির্ভরতা এবং সমাজসেবার বিভিন্ন দিকে শিক্ষালাভ করেছেন। অনেকদিন থেকে কেশব ছিলেন শিবনাথের গুরু। দেবেন্দ্রনাথ—কেশবের মতো শেষ পর্যন্ত কেশব—শিবনাথের মধ্যেও ব্রাহ্ম মতাদর্শের ব্যাপারে বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অবতারদের গহ্বরে কেশব ক্রমে তলিয়ে যেতে থাকেন, এবং তাঁর এমন অবস্থা হয় যে নিজেকে ‘জননী’ ও ভক্তদের ‘সন্তান’ ছাড়া তিনি আর কিছুই ভাবতে পারতেন না। কেশবভক্তদের মুখে পাপ—পুণ্য ভক্তি—মুক্তি ঈশ্বর—অবতার ইত্যাদি কথা অবিরাম উচ্চারিত হত। ১৮৭৫—৭৬ সালের কথা মনে করে বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন :
They were almost always talking of sin and salvation, of prayer and divine worship. All these unrealities of the current ideals and practcies of Samaj seriously influenced the generation of youthful students to which I belonged. I had, therefore, not only no attraction for the Brahmo Samaj when I first care to Calcutta, but even felt an increasing repulsion towards it.
শিবনাথের নিজের উক্তিতেও বিপিনচন্দ্রর এই অভিমতের সমর্থন পাওয়া যায়। ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসগ্রন্থে (ইংরেজি) শিবনাথ লিখেছেন যে কেশবচন্দ্রর অভ্যুদয়কালে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি দেশের তরুণদের যে আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা ছিল, ১৮৭৬ সালের আগেই তা প্রায় শেষ হয়ে যায় (‘wellneigh ceased before 1876’)। ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণের আগ্রহও তরুণদের মধ্যে যথেষ্ট কমে যায়। কেশবচন্দ্রর নৈতিক বিভ্রান্তির প্রভাব থেকে ব্রাহ্মসমাজকে রক্ষা করার জন্য শিবনাথ এইসময় ‘সমদর্শী’ নামে একটি গোষ্ঠী স্থাপন করে এই নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। আনন্দমোহন বসু, দুর্গামোহন দাস, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়—এঁরা ছিলেন গোষ্ঠীভুক্ত, শিবনাথ ছিলেন গোষ্ঠীনেতা ও পত্রিকা—সম্পাদক। ১৮৭৭ সালে শিবনাথ আর—একটি ব্রাহ্ম—চক্র (‘Inner circle’) গঠন করেন এবং তাতে বিপিনচন্দ্র পাল, সুন্দরীমোহন দাস, আনন্দচন্দ্র মিত্র প্রভৃতি যোগ দেন। ১৮৭৮ সালের গোড়াতেই বিখ্যাত কুচবিহার—বিবাহের গুজব কলকাতা শহরে রাষ্ট্র হয়ে যায়। কেশবচন্দ্র নিজেই ১৮৭২ সালের তিন—আইন বিবাহের বিধিবদ্ধতার জন্য আন্দোলন করেন, এবং শেষকালে সেই আইন ভঙ্গ করে কুচবিহার রাজপরিবারে নিজ কন্যার বিবাহ দিতে প্রস্তুত হন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর দিনপঞ্জিতে লিখেছেন (৩১ জানুয়ারি ১৮৭৮) :
কেশববাবু যে কেন এরূপ অবিবেচনার কার্য করিতেছেন, দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইতেছি। তাঁহাকে Principled Man বলিয়া শ্রদ্ধা ছিল, সে শ্রদ্ধাও আর থাকে না। তাঁহার এরূপ কার্যে সমাজের বিশেষ অমঙ্গল হইবে। অতএব ইহা লইয়া ঘোরতর আন্দোলন করা আবশ্যক, কারণ তাহা হইলে সমাজের মুখ রক্ষা হইবে।
আন্দোলন চালাবার জন্য ‘সমালোচক’ নামে একখানি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা হয়, শিবনাথ তার সম্পাদক হন। কিন্তু আন্দোলন ও প্রতিবাদে কেশবচন্দ্রকে বিরত করা সম্ভব হয়নি। কেশবচন্দ্র নিজে কুচবিহার গিয়ে, অনেকটা হিন্দু মতে, রাজপরিবারে নাবালিকা কন্যার বিবাহ দেন (৬ মার্চ ১৮৭৮)। তার ফলে ব্রাহ্মসমাজের বাদপ্রতিবাদের পরিণতি হয় বিচ্ছেদ। বিদ্রোহী ব্রাহ্মরা কেশবচন্দ্রর দল ছেড়ে এসে ১৫ মে ১৮৭৮ সালে টাউন হলে সভা ডেকে ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৮৭৯ সালে মাঘোৎসবের সময় কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বর্তমান স্থানে তার ভিত স্থাপন করা হয়। ব্রাহ্মসমাজের এই দ্বিতীয় ও শেষ বিদ্রোহের প্রধান নায়ক শিবনাথ শাস্ত্রী। জীবনের বাকি দিনগুলি তিনি এই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের কাজেই উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি বলেছেন : ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সংস্রবে যাহা কিছু করিয়াছি, তাহাই আমার জীবনের প্রধান কাজ।’ সমাজের বাংলা মুখপত্র ‘তত্ত্বকৌমুদী’ ও ইংরেজি ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’ পত্রিকা সম্পাদন করতেন শিবনাথ।
বিপিনচন্দ্র তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে শিবনাথের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল এবং শিবনাথের ব্রাহ্মধর্মাদর্শের প্রতি তাঁর অনুরাগও ছিল আন্তরিক। এই অনুরাগ আকর্ষণের কারণ হল, শিবনাথের ব্রাহ্ম আদর্শের মধ্যে স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের সুর উচ্চগ্রামে ধ্বনিত হত। বিপিনচন্দ্রের ভাষায় বলা যায়, ‘Social freedom and national emancipation were both organic elements of Shivanath’s religion and piety.’ শিবনাথ ছিলেন আজন্ম ‘ডেমোক্রাট’, আদর্শের নামে স্বেচ্ছাচারিতা অথবা ব্যক্তিগত প্রভুত্বের ঘোরতর বিরোধী। কেশবচন্দ্রর গুরুবাদ ও একনায়কত্বের কোনও স্থান নেই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে এবং সাধারণ কথার সামাজিক তাৎপর্য যে ‘সাধারণ’ ছাড়া অন্য কিছু নয়, এ কথা সমাজকর্মীদের কাছে তিনি প্রথমেই ঘোষণা করেছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা হল, ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপূর্ণ প্রকাশ ও চরিতার্থতা তিনি লক্ষ করেছিলেন রাষ্ট্রিক স্বাধীনতার মধ্যে। ধর্ম ও দেশপ্রেম তাই শিবনাথের ব্রাহ্ম আদর্শের মধ্যে একাত্ম হয়ে মিশে গিয়েছিল।
‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠার আগে শিবনাথ যে ব্রাহ্ম—চক্র গঠন করেন তার জন্য একটি প্রতিজ্ঞাপত্র রচিত হয়। রচনা করেন শিবনাথ। তার মূলকথাগুলি হল :
প্রতিমাপূজা করব না। কথায় ও কাজে জাতিভেদ মানব না। পরিবারে ও সমাজে স্ত্রী—পুরুষের সমান অধিকার স্বীকার করব। নিজেরা একুশ বছরের আগে বিবাহ করব না এবং কোনও বালিকাকে ষোলো বছরের আগে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করব না। স্ত্রীলোক ও জনসাধারণের মধ্যে যথাসাধ্য শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করব। দেশের লোকের শক্তি শৌর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যায়ামচর্চা, অশ্বারোহণ, বন্দুকচালনা অভ্যাসের কথা প্রচার করব। স্বায়ত্তশাসনই শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা, দুঃখ দারিদ্র্য—দুর্দশায় নিপীড়িত হলেও বিদেশি গভর্নমেন্টের অধীনে কখনোই দাসত্ব স্বীকার করব না।
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে বাংলার ও ভারতের প্রথম মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘ভারত—সভা’ (ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন) স্থাপিত হয় ২৬ জুলাই ১৮৭৬। শিবনাথ তাঁর বন্ধু আনন্দমোহন বসুর সঙ্গে এই রাজনৈতিক সভা স্থাপনের পরিকল্পনা সম্পর্কে পরামর্শ করার জন্য বিদ্যাসাগরের কাছে যান। বিদ্যাসাগর প্রথম সভাপতি হন, এই তাঁদের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁদের উৎসাহ দিলেও সভাপতি হতে সম্মত হননি। মধ্যবিত্ত রাজনীতির আবেদন—নিবেদন ও নেতৃত্বের দলাদলির কথা মনে করেই বোধহয় বিদ্যাসাগর দূরে থাকতে চেয়েছিলেন। কংগ্রেস—পর্বের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত রাজনীতির পথপ্রদর্শকদের মধ্যে ছিলেন শিবনাথ, আনন্দমোহন ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু শিবনাথের পূর্বোক্ত ব্রাহ্মচক্রে প্রতিজ্ঞাপত্রের মধ্যে—’দেশের লোকের শক্তি ও শৌর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যায়ামচর্চা বন্দুকচালনা অভ্যাসের কথা প্রচার করব’—এই প্রতিজ্ঞাটি থেকে মনে হয় ‘বিদ্যাসাগরের চেলা’ শিবনাথও হয়তো তাঁর গুরুর মতো মধ্যবিত্তের নিবেদনপ্রধান রাজনীতির অসারতা বুঝতে পেরে, কতকটা হতাশায়, প্রধানত ধর্মকর্ম ও সমাজকল্যাণধর্মে আত্মোৎসর্গ করেছেন।
১৩৭৬ । ১৯৬৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন