বিনয় ঘোষ
ব্যক্তিচরিত্রের রূপায়ণে পরিবেশগত ও বংশগত প্রভাবের আপেক্ষিক গুরুত্ব নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে আজও তর্কের অবসান হয়নি। তর্ক না করেও উভয়েরই প্রভাব স্বীকার করে নিতে বাধা নেই। কিন্তু এই প্রভাবের কথা স্বীকার করেও মনে রাখা দরকার যে মানুষ যন্ত্র নয়, পরিবেশ ও বংশগতির ঘাতপ্রতিঘাত কোনও মানুষকে হাতুড়ির মতো পিটিয়ে তৈরি করে না, কামারশালে লোহার যেমন তার হাতিয়ারকে করে। তা যদি হত তাহলে একই পরিবেশে, একই বংশে বিভিন্ন চরিত্রের ও গুণের মানুষ তৈরি হত না। ব্যক্তির সঙ্গে বংশগতির অথবা ব্যক্তির সঙ্গে বাইরের সামাজিক পরিবেশের সম্পর্ক যান্ত্রিক বা mechanical নয়, দ্বান্দ্বিক বা dialectical; ব্যক্তি নিষ্ক্রিয় নয়, পরিবেশের ক্রীড়নক নয়। একই পরিবেশে, এরকম অনেক দেখা যায়, কেউ হয় সন্ন্যাসী, কেউ হয় ডাকাত, কেউ হয় চলিত ব্যবস্থার স্থাবক ও সেবক, কেউ হয় বিদ্রোহী ও বিপ্লবী। কেন এমন হয়? ব্যক্তি ও তার সমগ্র পরিবেশের সঙ্গে সংঘাত—বিরোধের প্রতিক্রিয়ার পার্থক্যের জন্য। সবই যদি জিন—ক্রোমোজোম ও সামাজিক ঘটনাবর্তের যান্ত্রিক লীলা হত তাহলে সমাজে এত রকমের মানুষ ও এত বিচিত্র মানসতার বিকাশ দেখা যেত না। বস্তুত প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে বাইরের সমাজের একটা challenge-response-এর সম্পর্ক থাকে, অর্থাৎ পদে পদে contradiction ও confrontation-এর সম্পর্ক। এই সম্পর্ক স্থাপন করার মধ্যে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির পার্থক্য ঘটে—একেবারে নিছক ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে—এর কিছু পার্থক্য থাকেই, যাকে আমরা স্বাতন্ত্র্য বলি, কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে সংঘাত বিরোধের ভিতর দিয়ে বহু ব্যক্তির মধ্যে সংগতির ভিত্তিতে এক—একটা বৃত্ত বা গোষ্ঠী গঠিত হয়। যেমন উনিশ শতকের ইতিহাসে আমাদের বাংলা দেশে হয়েছে। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ থেকে রামকৃষ্ণ—বিবেকানন্দ পর্যন্ত অনেক চিন্তানায়ক ও সমাজনায়কের আবির্ভাব হয়েছে বাংলা দেশে, স্বাতন্ত্র্য ও পার্থক্যও দেখা গিয়েছে। এই ঘটনাবর্তের পরিবর্তনকে যদি আমরা সামাজিক ঋতুপরিবর্তন মনে করি, তাহলে বলতে পারি যে বিভিন্ন সামাজিক ঋতুতে, পরিবেশের ঘাতপ্রতিঘাতজনিত মানসিক প্রতিক্রিয়া ও response-এর দিক থেকে, বিভিন্ন সামাজিক বৃত্ত রচিত হয়েছে, এবং পরিবেশ ক্রমে যত জটিল ও বিরোধমুখর হয়েছে, সামাজিক বৃত্তেরও তত বৈচিত্র্যসহ বিস্তার হয়েছে। যেমন উনিশ শতকের প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে সংঘাতমুখী বিভিন্ন সামাজিক বৃত্তের বিস্তার ও বৈচিত্র্য অনেক বেশি দেখা যায়। আবার এ—ও দেখা যায় যে নতুন কালানুবর্তী যে আদর্শসংঘাত, idological battle, উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই প্রধানত তা ঘটেছে এবং সংঘাতকালে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মুখোমুখি শিবির—সন্নিবেশও হয়ে গিয়েছে। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে উনিশ শতকের এই দুই অর্ধাংশের ঠিক সন্ধিক্ষণে আমরা দেখতে পাই, যদিও আদর্শসংগ্রামে তাঁর শিবির—নির্বাচনের কাজ প্রথমার্ধেই শেষ হয়ে যায়।
১৮২০ থেকে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত মেদিনীপুরে বীরসিংহ গ্রামের গ্রামীণ পরিবেশে বিদ্যাসাগরের বাল্যজীবন কাটে। তারপর ১৮২৯ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত—২৯ বছরের মধ্যে—প্রায় ২২ বছর তাঁর শুধু কলকাতার গোলদিঘির সংস্কৃত কলেজের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে কেটে যায়, তার মধ্যে ১২ বছর কয়েক মাস ছাত্রজীবন, বাকি ১০ বছর সংস্কৃত কলেজের কর্মজীবন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের প্রারম্ভেই, সাত—আট বছরের মধ্যে—সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষতাকালে, তাঁর সমাজকর্ম ও শিক্ষাকর্মের চূড়ান্ত বিকাশ হয়। তারপর উনিশ শতকের শেষ দশকের গোড়া পর্যন্ত (১৮৯১) তিনি বেঁচে থাকলেও প্রায় ৩২—৩৩ বছর, এই দীর্ঘ সময়টাকে আমরা তাঁর কর্মজীবনের অপরাহ্ণকাল বলে চিহ্নিত করতে পারি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিদ্যাসাগরের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাল—চরিত্র ও ব্যক্তিত্বগঠনের দিক থেকেও যা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ কাল—সম্পূর্ণ কৈশোর ও যৌবন—কলকাতা শহরের এমন এক পরিবেশে এবং এমন একটি স্থানে কেটেছে—যা উনিশ শতকের বাংলার আদর্শসংঘাতের কেন্দ্রস্থল বলে গণ্য হতে পারে। ১৮৫০ সাল, অর্থাৎ তাঁর যখন ত্রিশ বছর বয়স—তার মধ্যেই তিনি এই আদর্শসংগ্রামের ক্ষেত্রে তাঁর শিবির ও স্থানটি বেছে নিয়েছেন।
আদর্শসংগ্রামের যে শিবির বিদ্যাসাগর বেছে নিয়েছিলেন সেই শিবিরে প্রথম সারিতে সংগ্রামরত পুরুষ যাঁদের আমরা দেখতে পাই তাঁরা হলেন—রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, ডিরোজিও, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরও কয়েকজন। এই আরও কয়েকজনের মধ্যে যাঁর নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয় তিনি অক্ষয়কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগরের সমবয়সি এবং দেবেন্দ্রনাথ ও বিদ্যাসাগর উভয়েরই কর্মজীবনে অন্যতম সহকর্মী ও সহযোগী। রুগণ দেহের বোঝা সারাজীবন বহন করেও যে কী বিরাট বলিষ্ঠ মন ও চিন্তার অধিকারী হওয়া যায়, অক্ষয়কুমার তার একটি বিশেষ উল্লেখ্য নিদর্শন। এই ব্যক্তিসমাবেশের পাশাপাশি আমরা কয়েকটি সামাজিক বৃত্তের বা গোষ্ঠীরও সন্নিবেশ দেখতে পাই। এই বৃত্ত ও গোষ্ঠীগুলি হল। আত্মীয় সভা, ব্রাহ্মসমাজ, ইয়াং বেঙ্গল ও তত্ত্ববোধিনী সভা। এইসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিয়ে যে সামাজিক শিবির উনিশ শতকের প্রথমার্ধে গঠিত হয়, বিদ্যাসাগর সচেতনভাবে সেই শিবিরেই তাঁর স্থান বেছে নেন। এই শিবিরের আদর্শসংগ্রাম ও সমাজকর্মের উত্তরাধিকার তিনি বহন করেছেন এবং নিজের চরিত্রবলে ও বিচারবুদ্ধিতে তাঁর যে নিজস্ব প্রতিক্রিয়া হয়েছে প্রতিবেশের সংঘাতে, তাঁরই জন্য সেই সংগ্রামকে নতুন এক উন্নততর পর্যায়ে তিনি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। এর বিপক্ষ শিবিরে আমরা দেখতে পাই রাধাকান্ত দেব, আশুতোষ দে, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য অনেক রাজা—মহারাজা ধনাঢ্য ব্যক্তিকে এবং বৃত্ত ও গোষ্ঠীর মধ্যে দেখতে পাই ধর্মসভা, গৌড়ীয় সভা প্রভৃতি। সামাজিক শ্রেণিগতভাবে বিচার করলে উভয় পক্ষেই নতুন ধনাঢ্যদের সমাবেশ দেখা যায় বটে, কিন্তু প্রথম শিবিরের তুলনায় দ্বিতীয় রক্ষণশীল শিবিরে সনাতনপন্থী ধনিকদের সংহতি অনেক বেশি দৃঢ়, মধ্যযুগীয় ফিউডাল মনোভাব ও সংস্কার তাঁদের মধ্যে অনেক বেশি প্রবল, সামাজিক ধর্মীয় আচার—আচরণে তাঁরা অত্যধিক প্রাচীনপন্থী এবং নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্ত এলিটের সংখ্যা তাঁদের মধ্যে নিতান্তই নগণ্য। রামমোহনের ‘আত্মীয় সভা’র কালে নব্যশিক্ষিত এলিট—গোষ্ঠীর বিকাশই হয়নি বলা চলে, কাজেই তাঁর সভায় প্রধানত নব্যজমিদারশ্রেণির মধ্যে উদারপন্থী কয়েকজনকে দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তী ইয়াংবেঙ্গল দল ও তত্ত্ববোধিনী গোষ্ঠীর মধ্যে অধিকাংশই নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্ত, যাঁরা বাস্তবিকই সমাজজীবনে নতুন লক্ষ্য অভিমুখী গতি সঞ্চারিত করেছিলেন। এই নতুন লক্ষ্যমুখী গতিসঞ্চারকদের মধ্যে বিদ্যাসাগর ছিলেন অন্যতম।
বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন ১৮২৯ সালের জুন মাসে। দু—মাসের মধ্যে বেণ্টি সতীদাহ ও সহমরণপ্রথা অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। হিন্দুসমাজের ধর্মাচারে সোজাসুজি হস্তক্ষেপ, কাজেই গোঁড়া হিন্দুসমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য মাসখানেকের মধ্যেই ‘ধর্মসভা’ স্থাপিত হয় এবং বিশিষ্ট পণ্ডিতদের মধ্যে যাঁরা ধর্মসভার অধ্যক্ষ মনোনীত হন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন হরনাথ তর্কভূষণ, নীলমণি ন্যায়ালংকার, জয়গোপাল তর্কালংকার, রামজয় তর্কালংকার, শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি, নিমাইচাঁদ শিরোমণি, জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, নাথুরাম শাস্ত্রী। এই পণ্ডিতদের মধ্যে অনেকে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করতেন এবং বিদ্যাসাগরের শিক্ষক ছিলেন। এই পণ্ডিত অধ্যাপকদের মুখেই তিনি ধর্মসভার কর্মবৃত্তান্ত শুনতে শুনতে নিশ্চয় রামমোহনের কথা শুনেছেন, সতীদাহপ্রথা সম্বন্ধে শুনেছেন এবং তাঁর কিশোর মনে এ দেশের শাস্ত্রীয় শাসক ও দেশাচার সম্বন্ধে ধীরে ধীরে একটা ধারণারও বিকাশ হয়েছে। সংস্কৃত কলেজের তদানীন্তন পরিবেশ অন্যদিক থেকেও তাঁর এই ধারণা সুস্পষ্ট করতে সহায় হয়েছে। সেই পরিবেশ রচনা করেছেন হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিওর শিষ্যবৃন্দ ১৮২৯—৩০—৩১ সালের মধ্যে। সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু কলেজ ছিল একই প্রাঙ্গণে, এমনকী একই গৃহে বলা চলে। মধ্যে সংস্কৃত কলেজ, দুইপাশের দুটি সংলগ্ন একতলা গৃহে হিন্দু কলেজের সিনিয়র ও জুনিয়র ডিপার্টমেন্ট, পরে যা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও হিন্দু স্কুলে পরিণত হয়। ডিরোজিয়ানরা এইসময় হিন্দুসমাজের গোঁড়ামি কূপমণ্ডূকতা আচার—অনুষ্ঠান ইত্যাদির কঠোর সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন, এমনকী নব্যপ্রগতিবাদের মাদকতায় হিন্দুধর্মকেও লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করতে প্রায় বদ্ধপরিকর হন। সংস্কৃত কলেজের প্রাঙ্গণ থেকেই এই প্রচণ্ড বিক্ষোভেরতরঙ্গ ওঠে, ঠিক যখন বিদ্যাসাগর কৈশোরে পদার্পণ করছেন। রামমোহন অথবা তাঁর ব্রাহ্মসমাজ তাঁদের সুসংযত স্থিরবুদ্ধির জন্য যা করতে পারেননি, ইয়াং বেঙ্গল নতুন প্রগতিশীল পাশ্চাত্য জীবনদর্শন ও আদর্শের উন্মাদনায় তা করতে পেরেছিলেন। ধর্মসভার অত্যুগ্র গোঁড়ামি ও আস্ফালনের কাছে যখন ব্রাহ্মসমাজের সংযত উদারতা স্থিমিত মনে হচ্ছিল, তখন ইয়াং বেঙ্গলের অত্যুগ্র প্রগতিবাদ, অন্তত কিছুটা, ধর্মসভাকে যথাস্থানে আবদ্ধ করতে পেরেছিল। এই বিক্ষোভে আর—একদিক থেকে ইন্ধন দেন ডাফ—হিল প্রমুখ খ্রিস্টান মিশনারিরা। নব্যশিক্ষিত তরুণদের হিন্দুসমাজ ধর্মবিরোধী মনোভাবে উৎসাহিত হয়ে তাঁরা খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দিতে থাকেন, উদ্দেশ্য এই সুযোগে তরুণদের ধর্মান্তরিত করা। ঠিক এইসময় রামমোহন রায় ইংলন্ড চলে যান (১৮৩০, নভেম্বর), তার এক বছরের মধ্যে ডিরোজিওর অকস্মাৎ মৃত্যু হয় (১৮৩১, ডিসেম্বর) এবং রামমোহনের মৃত্যু হয় দু—বছরের মধ্যে, ব্রিস্টলে ১৮৩৩, সেপ্টেম্বর সমাজ সংগ্রামে যে শিবিরে বিদ্যাসাগরের স্থান, সেই শিবির প্রায় কান্ডারহীন হয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, তখন বিদ্যাসাগরের বয়স তেরো এবং তিনি সংস্কৃত কলেজে সাহিত্য শ্রেণির ছাত্র। কিশোর বিদ্যাসাগর স্বচক্ষে এই বিক্ষোভের দৃশ্য অনেক দেখেছেন এবং স্বকর্ণে এই আলোড়ন ও আদর্শগত বাদপ্রতিবাদের ধ্বনিও শুনেছেন। তাঁর মন প্রস্তুত হবার মতো পরিবেশ পেয়েছে, বোধহয় উনিশ শতকের সবচেয়ে ঐতিহাসিক সংঘাতমুখর পরিবেশ। এই পরিবেশের মুখোমুখি মোকাবিলার জন্য দাঁড়াতে হলে কোন দিকে দাঁড়াতে হবে, সে সম্বন্ধেও কিছুটা ধারণা তাঁর হয়তো হয়েছে, কেবল দাঁড়াবার ভঙ্গিটি বা সংগ্রামের পন্থা—কৌশল ঠিক করার মতো বয়স তাঁর হয়নি।
দু—রকমের সামাজিক দৃশ্য দেখেছেন বিদ্যাসাগর তাঁর ছাত্রজীবনে। এক রকমের দৃশ্য হল, হিন্দুসমাজের শাস্ত্রীয় গোঁড়ামি ও দেশাচারের অন্ধ দাসত্ব এবং তার বিপরীত বিদেশি পাশ্চাত্য আদর্শানুগত্যের একই রকমের উন্মাদনা। এটি হল আদর্শগত সংগ্রামের দৃশ্য। আর—একটি দৃশ্য হল, প্রাচীন ও নবীন জেনারেশনের সংগ্রাম। গোঁড়ামি ও দেশাচারপ্রীতি প্রধানত সমাজের বৃদ্ধ—প্রৌঢ়তন্ত্রের আদর্শ, এবং অবাধ অগ্রগতি অনুরাগ প্রধানত সমাজের তরুণতন্ত্রের আদর্শ, তরুণদের আদর্শপ্রীতির মধ্যে উচ্ছ্বাস ও আতিশয্য থাকা স্বাভাবিক এবং বৃদ্ধ—প্রৌঢ়দের উৎকট গোঁড়ামিও অস্বাভাবিক নয়। তরুণ বয়সে তরুণদের আদর্শসংগ্রামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু তার কতটুকু উচ্ছ্বাস—আতিশয্য এবং কতটুকু গ্রহণযোগ্য নয়, তা বিচার করার মতো বয়স যখন বিদ্যাসাগরের হয়েছে, তখন তিনি করেছেন। তা—ই বলে তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করেননি কোনওদিন। তাঁর নিজের বুদ্ধিগ্রাহ্য আদর্শের ক্ষেত্রে তিনি আপসপন্থী ছিলেন না, তা সে শিক্ষার ক্ষেত্রেই হোক আর সমাজের ক্ষেত্রেই হোক।
উনিশ শতকের তিরিশের গোড়াতে ডিরোজিও ও রামমোহনের মৃত্যুর ফলে ব্রাহ্মসমাজ ও ইয়াং বেঙ্গলের কার্যকলাপ কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। তা ছাড়া ইয়াংবেঙ্গলের উৎসাহের প্রথম তরঙ্গোচ্ছ্বাসও তখন অনেকটা স্থির হয়ে থিতিয়ে যায়। তিরিশের শেষদিক থেকে এই ধারার নতুন বাঁক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এইসময় আমরা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সমাজের এই শিবিরে প্রবেশ করতে দেখি, ১৮৩৯ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে। দেবেন্দ্রনাথের বয়স তখন ২২ বছর, বিদ্যাসাগরের বয়স ১৯ এবং বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজে ন্যায়শ্রেণির ছাত্র। পরিবার—আত্মীয়স্বজনের মধ্যে মাত্র দশজনকে নিয়ে যে তত্ত্ববোধিনী সভা স্থাপিত হয়, সেই সভার সভ্যসংখ্যা তিন—চার বছরের মধ্যে শতাধিক হয় এবং আরও কয়েক বছরের মধ্যে পঞ্চাশের দশকে প্রায় আটশো পর্যন্ত হয়। অধিকাংশ সভ্যই শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেণিভুক্ত। অর্থাৎ উনিশ শতকের মধ্যভাগে তত্ত্ববোধিনী সভা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিসভাতে পরিণত হয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে প্রভাববিস্তারের দিক থেকে বিচার করলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তত্ত্ববোধিনী সভার মতো আর কোনও শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের বিদ্বৎসভাই হোক বা সমাজসভাই হোক, উনিশ শতকে এরকম ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এ কথাও মনে রাখা দরকার যে দেবেন্দ্রনাথ যখন তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন তখন ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেননি, যদিও সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য তিনি সমস্ত শাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্ব এবং বেদান্তপ্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার করা বলে ব্যক্ত করে দিলেন। ১৮৪২ সালে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন, ১৮৪৩ সালে নিজে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন এবং ব্রাহ্মসমাজ পরিচালনা ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের দায়িত্ব তত্ত্ববোধিনী সভার উপর অর্পণ করেন। ১৮৪৩ সালেই ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশিত হয়। ঠিক এইসময় বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের পাঠ শেষ করে, ২২ বছর বয়সে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। দেবেন্দ্রনাথের বয়স ২৪/২৫, বিদ্যাসাগরের বয়স ২১/২২, দু—জনেই যুবক। তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করে দেবেন্দ্রনাথ ১৮২৯—৩০—এর প্রগতিশীল চিন্তাধারার মূল প্রবাহকে অব্যাহত রেখে তার বিদেশিভাবাপন্নতা, অসংযত উগ্রতাকে একটি সংযত সমন্বিত রূপ দিতে চেয়েছিলেন এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের হিন্দুধর্মবিদ্বেষী অপপ্রচার ও ধর্মান্তরের অভিযানকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলেন। সমাজসংস্কার ও শিক্ষাসংস্কার কর্মে প্রগতিশীল পথেই তত্ত্ববোধিনী সভার অভিযান আরম্ভ হয় এবং তার মুখপত্র হয় ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’। মনে হয় এ যেন দেবেন্দ্রনাথ কতকটা অজ্ঞাতসারেই, ঠিক কর্মজীবনে প্রবেশের মুখে, বিদ্যাসাগরের সামাজিক জীবনে সচলতার জন্য, সংস্কৃত কলেজের বাইরে, একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন।
তত্ত্ববোধিনী সভা হল বিদ্যাসাগরের অন্যতম কর্মক্ষেত্র, সংস্কৃত কলেজের বাইরে। ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে সভার যে সম্পর্ক ছিল, তার সঙ্গে বিদ্যাসাগর প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, কিন্তু তার অর্থ নিশ্চয় এই নয় যে তিনি প্রচলিত হিন্দুধর্মের সমর্থক ছিলেন, তার আচার—সংস্কার মেনে চলতেন এবং একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। বিদ্যাসাগর আদৌ নাস্তিক ছিলেন না, তিনি একেশ্বরবাদীই ছিলেন এবং তাঁর ‘হরি’ই ছিলেন তাঁর কাছে ব্রহ্মস্বরূপ। অধ্যক্ষ ক্ষুদিরাম বসু, যিনি বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন, তিনি বিদ্যাসাগরের ধর্মমত সম্বন্ধে লিখেছেন : ‘তাঁর ধর্মজীবন সম্বন্ধে এই বলা যায় যে তাঁর ধর্মজীবন কর্মগত ছিল। কাজই তাঁর কাছে ধর্ম। তিনি একেশ্বরবাদী ছিলেন, বোধোদয়ে আমরা তার নিদর্শন পাই। প্রতিমাপূজা তিনি লৌকিকভাবেই দেখতেন কেন না বাড়িতে তো কোনদিন পূজা হতে দেখিনি। তিনি বলতেন—যেটা পারবি সেইটে কর। লোকসেবাই তাঁর ধর্ম ছিল। এক সম্প্রদায়ের উপাসনা দেখে এসে তিনি বলেছিলেন তারা বলছে শুনলাম—আমরা মুশারও পায়ের ধুলো নিচ্ছি; ঈশারও পায়ের ধুলো নিচ্ছি; শ্রীচৈতন্যরও পায়ের ধুলো নিচ্ছি; আরে বাপু ঈশা মুশা শ্রীচৈতন্য তো মরে ভূত হয়ে গেছে; পায়ের ধুলো কি রে বাবা। অনেকদিন কেটেছে এমন যে বিকেল থেকে ঠায় ঘরে বসে গল্পগুজব হতে হতে রাত হয়ে গেছে, এইখানেই খাবার—টাবার এল, সকলের সঙ্গে তিনিও খেলেন, সন্ধা—আহ্নিক করতে তো দেখিনি।’ ধর্ম ও ধর্মাচরণের প্রতি এই যাঁর মনোভাব, যিনি প্রতিমাপূজা করতেন না, অবতারবাদে বিশ্বাস করতেন না, সন্ধা—আহ্নিক করতেন না, তত্ত্ববোধিনী সভার ধর্মাদর্শের প্রতি তাঁর কোনও সহানুভূতি ছিল না, এ কথা ভাববার কোনও কারণ নেই। তার চেয়েও বড় কথা, তত্ত্ববোধিনী সভার প্রধান লক্ষ্য যে ধর্মাদর্শ প্রচার তার প্রতি কোনও সহানুভূতি না—থাকা সত্ত্বেও যে বিদ্যাসাগর ওই সভা ও তার মুখপত্রের সঙ্গে অত ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের কাজ ছাড়ার পরেও যে সেই সভার সম্পাদকের দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেছিলেন ১৮৫৯ সালে, এরকম আশ্চর্য কোনো ঘটনার সঙ্গে তাঁর চরিত্রের কোনো সঙ্গতিই খুঁজে পাওয়া যায় না। কাজেই এ কথা বিশ্বাস করতে বাধা নেই যে, তত্ত্ববোধিনী সভার ধর্মাদর্শ, শিক্ষাদর্শ ও সামাজিক আদর্শের মধ্যে বিদ্যাসাগর তাঁর আদর্শ, মতামত ও বিশ্বাসের একটা বড় রকমের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই কর্মজীনের গোড়া থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত তিনি ওই সভার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে খুঁটিনাটি ব্যাপারে তাঁর ও তাঁর অন্যতম সুহৃদ—সহযোগী অক্ষয়কুমারের মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও তিনি এই সভার উদার সহনশীল পরিবেশেই অবাধে বিচরণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। বিধবাবিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা, মাতৃভাষায় শিক্ষা ইত্যাদির প্রেরণা তত্ত্ববোধিনী সভার সংস্রব থেকে তিনি অফুরন্ত পেয়েছেন এবং তা পেয়েছেন বলেই নির্ভয়ে তাঁর সংস্কারকর্মে এগিয়ে যেতে পেরেছেন। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ ও তার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর সমাজসংস্কারকর্মের প্রধান প্রচারক ও সমর্থকের কাজ করেছেন এবং দেবেন্দ্রনাথ তাতে কোনওদিন বাধা দেননি। মধ্যে মধ্যে তিনি কতকগুলি নাস্তিক বলে বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন বটে, কিন্তু তাঁদের কাজকর্মে ও বিচারবিবেচনায় হস্তক্ষেপ করে রূঢ় কর্তৃত্ব প্রকাশ করেননি। তিনি উভয়েরই প্রতিভা, ক্ষমতা ও যোগ্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এবং সমাজের অগ্রগতির সংগ্রামে তাঁদের মতো যোদ্ধা ও একনিষ্ঠ কর্মী যে অত্যন্ত দুর্লভ তা—ও তিনি জানতেন। যে গোরু দুধ দেয় তার চাট সহ্য করতে হয়, কতকটা এই ধরনের বোধ থেকে দেবেন্দ্রনাথ যথেষ্ট ধৈর্য ধরে বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমারের অনেক উপদ্রব সহ্য করেছেন। এটা তাঁর অপরিসীম ঔদার্যের পরিচায়ক। বস্তুত তত্ত্ববোধিনী সভায় আজকাল আমরা যাকে right-wing, left-wing গোষ্ঠী বলি, এরকম গোষ্ঠী ছিল—বেশ বোঝা যায়। বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন তত্ত্ববোধিনী সভার left-wing গোষ্ঠীভুক্ত। যেখানে বিদ্যাসাগর সেইখানে অক্ষয়কুমার, যেখানে অক্ষয়কুমার সেইখানে বিদ্যাসাগর, একজন আর—একজনের কীর্তি ও মতামত সমর্থনের জন্য উদগ্রীব, এরকম অভিন্নহৃদয় সুহৃদ জীবনের কর্মক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায় না। এদিক দিয়ে, ব্যক্তিগতভাবে বিচার করলে, বিদ্যাসাগরের জীবনে অক্ষয়কুমারের দান অসামান্য বলা চলে।
আর—একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করে বিদ্যাসাগর ও তাঁর যুগের কথা শেষ করব। মনে হয়, বিদ্যাসাগর—চরিত্রের ও তাঁর জীবনের পশ্চাদভূমি অন্তত কিছুটা এর মধ্যে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। যে ঘটনার কথা বলছিলাম, সেই ঘটনাটি এই। বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন, বিধবাবিবাহাদি সমাজসংস্কারকর্ম ও শিক্ষাসংস্কারকর্মের সর্বাধিক সক্রিয় পর্ব তাঁর শেষ হয়ে গিয়েছে। ১৮৬৩—৬৪ সালের কথা। দেবেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অক্ষয়কুমার অর্থাৎ অক্ষয়—গোষ্ঠী একটি স্বতন্ত্র উপাসনা—সমাজ স্থাপন করেন। সেখানে নতুন পদ্ধতিতে উপাসনাও আরম্ভ হয়। এই নতুন উপাসনা—পদ্ধতি রচনায় বিদ্যাসাগর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসগ্রন্থে ও এই কথা উল্লেখ করে লিখেছেন—‘they began to conduct divine service according to a new form framed by themselves and revised by Pandit Iswar Chandra Vidyasagar.’ যদি তা—ই হয় তাহলে বিদ্যাসাগরের ধর্মমতের স্বরূপ সম্বন্ধে, এবং তত্ত্ববোধিনী সভার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে ও পরিবেশে তাঁর যৌবন, কর্মজীবন ও তাঁর যাবতীয় সংস্কারকর্ম যে কতখানি পরিপুষ্ট সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না।*
……
* শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী কর্মমণ্ডলীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিদ্যাসাগরের সার্ধজন্মশতবার্ষিক সভায় প্রদত্ত ভাষণ—২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন