বিনয় ঘোষ
সমাজের বিভিন্ন স্তরে নানা রকমের চিন্তার বিকাশ হয়েছে মানুষের বিচিত্র বহুমুখী কর্মজীবনের ঘাতপ্রতিঘাতে। মানবচিন্তা বায়ুজীবী নয়, সমাজের বাস্তব উপকরণজীবী। অন্নচিন্তা থেকে অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক চিন্তা, নির্জন আত্মচিন্তা ও ব্যক্তিচিন্তা থেকে জনমুখী সমষ্টিচিন্তা ও রাষ্ট্রচিন্তা সমস্তই বিশেষ বাস্তব সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিবেশ থেকে উদ্ভূত। বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা বা রাজনৈতিক চিন্তারও উদ্ভব হয়েছে একটা বিশেষ সামাজিক পরিবেশ রচিত হবার পরে এবং সেই রাষ্ট্রচিন্তা যে বাংলা দেশের জাতীয় ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবোধে পরিব্যাপ্ত হয়েছে তার কারণও ঐতিহাসিক। প্রবহমান ইতিহাসের তরঙ্গ বাঙালির জীবন ও সমাজকে তখন আলোড়িত করেছে সবচেয়ে বেশি, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মৃদু কম্পনের সঙ্গে তার তুলনাই হয় না। দেশ—বিদেশের বহুবিধ চিন্তার ধারা তখন বাংলার সামাজিক স্তরে (যেমন মধ্যবিত্ত ও ইংরেজি—শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী) মিলিত হয়ে প্রচণ্ড আবর্তের সৃষ্টি করেছে। সেই আবর্ত ও বিক্ষোভের ভিতর দিয়ে বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তাধারা প্রবাহিত হয়েছে ভারত অভিমুখে, একটা অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবোধের দিকে।
ঐতিহাসিক পোলার্ড তাঁর ‘ফ্যাক্টরস ইন মডার্ন হিস্ট্রি’ গ্রন্থে বলেছেন যে কলম্বাস, ভাস্কো—দা গামার ভৌগোলিক আবিষ্কার, বিজ্ঞানীদের প্রাকৃতিক রহস্য উদঘাটন, বাষ্পীয় শক্তি, বিদ্যুৎ ও যন্ত্রাদির আবিষ্কার, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে যাত্রার পথে বড় বড় ঘটনা ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে অনেক ঘটেছে, আজ অনেকেরই তা অজানা নেই। কিন্তু এইসব বড় ঘটনার অন্তরালে সমাজে আরও কতকগুলি ঘটনা ঘটেছে যা নামডাকে বড় না হলেও, ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক থেকে আদৌ উপেক্ষণীয় নয়। পোলার্ডের ভাষায়: ‘These may almost be summed up in one phrase—the advent of the middle classes.’ সমাজে মধ্যবিত্তশ্রেণির অভ্যুদয় এরকম একটি ঘটনা। এই মধ্যবিত্তের অভ্যুদয় না হলে ইয়োরোপে সাহিত্য—শিল্পকলার ক্ষেত্রে রেনেসাঁস, ধর্মের ক্ষেত্রে রিফর্মেশন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে ধনতন্ত্র, অবাধ বাণিজ্য, শ্রমশিল্প ও রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ‘ন্যাশনালিজম’ বা ‘জাতীয়তাবাদ’ কোনও কিছুরই বিকাশ সম্ভব হত না। জনসমাজের একটা অংশ (মধ্যবিত্তশ্রেণি) ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে সর্বাধিক সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সমাজের অগ্রগামিতা অক্ষুণ্ণ রাখতে, যেমন বর্তমানের আর—এক সন্ধিক্ষণে শ্রমজীবী শ্রেণি সেই ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণেই আধুনিক ‘ন্যাশনালিজম’ বা জাতীয়তাবোধ জনমানসে একটা প্রত্যয়রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল, আমাদের বাংলা দেশে ও ভারতবর্ষে তার ব্যতিক্রম হয়নি। অবশ্য হবার কথাও নয়।
যে সমস্ত সামাজিক—অর্থনৈতিক ঘটনার সন্নিবেশের ফলে আধুনিক যুগে গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবোধের বিকাশ সম্ভব হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান হল—যান্ত্রিক মুদ্রণের আবিষ্কার ও প্রসার, বুদ্ধি ও যুক্তির বাহনোপযোগিতার স্তরে জাতীয় ভাষার বিকাশ (অর্থাৎ জাতীয় গদ্যভাষার বিকাশ), ধনতান্ত্রিক শিল্প—বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠা, মধ্যবিত্তশ্রেণির উদ্ভব—বিশেষ করে নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির, আধুনিক যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে ভৌগোলিক অঞ্চলবন্দি মানুষের মুক্তি ও সচলতা (mobility) বৃদ্ধি, সংযোগ সান্নিধ্য ও আদানপ্রদানের স্বাধীনতা এবং ধীরে ধীরে সংকীর্ণ গোষ্ঠীচেতনা থেকে সম্প্রসারিত সমাজচেতনার দিকে মানুষের মানসিক উন্মীলন। ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলা দেশে এতগুলি ঘটনার বিচিত্র সংযোগ ও সংঘাত হয়েছিল উনিশ শতকে, ঐতিহাসিক কারণে। যতটা ব্যাপকভাবে হয়েছিল, আর কোথাও তা হয়েনি। তাই ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলা দেশেই প্রথম আধুনিক সর্বভারতীয় জাতীয়তাবোধ অঙ্কুরিত হয়ে বাংলার বাইরে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে।
নব্যযুগের ভারতের আধুনিক ধর্মচিন্তা, সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রচিন্তার অগ্রদূত হলেন রামমোহন রায়। তাঁর সময়ে পূর্বোক্ত সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনার সমাবেশ হয়েছিল বাংলা দেশে, স্বভাবতই পরিমিতরূপে। রামমোহনের যুগদৃষ্টি প্রতিবেশের পরদা ভেদ করে আধুনিককালের দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল স্বচ্ছন্দে। তাঁর ধর্মচিন্তা তাই সহজে আধুনিক ভারত রাষ্ট্রচিন্তায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রচিন্তা বাংলা দেশে তো বটেই, ভারতের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বমানবচিন্তায় বিলীন হয়ে গিয়েছে। রামমোহনের কালেই ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকা আমাদের দেশে নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন: ‘অতএব যেহেতুক লোকেরদিগের যখন এ প্রকার শ্রেণীবদ্ধ হইল তখন স্বাধীনতাও অদূরে সেই শ্রেণী প্রাপ্তা হইবেক’ (১৩ জুন, ১৮২৯)। এই শ্রেণির সর্বাধিনায়করূপে রামমোহনও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, বাংলার বা বাঙালির স্বাধীনতা নয়, ভারত ও ভারতজনের স্বাধীনতা।
রামমোহনের পর ‘ইয়াং বেঙ্গল’—এর যুগ, বিদ্রোহী তরুণ শিক্ষক ডিরোজিওর ছাত্র ও মন্ত্রশিষ্য বলে যাঁদের ‘ডিরোজিয়ান’ও বলা হয়। উনিশ শতকের তিনের দশক ডিরোজিয়ানদের স্বর্ণযুগ। তিরিশের আগেই ডিরোজিও কবি—কল্পনার পরাধীন ভারতের বন্দিনি মাতৃমূর্তিতে গভীর বেদনা প্রকাশ করে লেখেন :
স্বদেশ আমার। কিবা জ্যোতির মণ্ডলী
ভূষিত ললাট তব; অস্তে গেছে চলি
সে দিন তোমার; হায় সেই দিন যবে,
দেবতা সমান পূজা ছিলে এই ভবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ—দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইয়াং বেঙ্গলের বিতর্কসভা অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন সমাজ, দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা হত, বেশ গরম আলোচনা এবং দেশ—বিদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক আদর্শ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ও ছিল তার মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীকালে, তারুণ্যের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গোত্তীর্ণ বয়সে ডিরোজিওর শিষ্যদের মধ্যে যাঁরা স্বদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। এঁদের দেশপ্রেম কোনওদিন প্রাদেশিকতার বা সাম্প্রদায়িকতার বদ্ধ প্রাচীরের প্রতিবন্ধকে খণ্ডিত হয়নি, সর্বদা এক অখণ্ড ভারতচেতনায় আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু এই ভারতচেতনার বিস্তারের পথ ইয়াং বেঙ্গল গোষ্ঠী প্রশস্ত করতে পারেননি, তার কারণ হল তাঁদের দুর্বলতা ও সংখ্যাল্পতা। শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের স্তর উনিশ শতকের তিরিশে ও চল্লিশে খুব সংকীর্ণ ছিল। ১৯৩৪ সালে, ইংরেজি শিক্ষা সরকারি নীতি হিসেবে গৃহীত হবার (১৮৩৫) আগের বছর, কলকাতার ছোটবড় দশটি স্কুলে মোট ১৮৬৮ জন ছাত্র ছিলেন ইংরেজি শিক্ষার জন্য। তাঁদের মধ্যে পাঁচ—ছ—শোজন প্রকৃত শিক্ষা পেয়েছিলেন কি না সন্দেহ। এই মুষ্টিমেয় যুবকদের পক্ষে প্রকাশ্য সমাজপ্রাঙ্গণে অবতীর্ণ হয়ে কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন বা ভাবধারা প্রচার করা তখন সম্ভব ছিল না। যা সম্ভব ছিল তা—ই তাঁরা করেছিলেন, অর্থাৎ সাহিত্যসভা, বিদ্বৎসভা ইত্যাদি গঠন করে, সভায় আলোচনার ভিতর দিয়ে রাজনৈতিক—সামাজিক ভাবধারা প্রচার করা। আর—একটি প্রচারের পন্থা ছিল প্রেস—অর্থাৎ পত্রিকা। কোনও পন্থাই ভারতচেতনার প্রসারের অনুকূল ছিল না, তাই তার প্রচারও তখন বিশেষ হয়নি। তাতে অবশ্য ভারতচেতনার প্রবক্তা বাঙালির (মুষ্টিমেয় হলেও) জাতীয়তাবোধ খণ্ডিত হয়নি, কেবল তার বহির্মুখী গতি সংকুচিত হয়েছে।
যে সমস্ত সভ্য ও প্রতিষ্ঠান, প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলা দেশে বিগত শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে গড়ে ওঠে, তাদের কার্যকলাপে এর পরিচয় পাওয়া যায়। ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি (১৮৩৮), বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (১৮৪৩), ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৫১) প্রভৃতি কেবল যে উচ্চশ্রেণির প্রত্যক্ষ স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, ভারতবোধের প্রসারেও ব্যর্থ হয়েছিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ভারতবর্ষীয় সভার আমলে সম্পাদক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদযোগে প্রথমে মাদ্রাজ বোম্বাই অযোধ্যা প্রভৃতি অঞ্চলে শাখাকেন্দ্র স্থাপন করে ভারতীয় জাতীয়তাবোধ প্রসারের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা তেমন সার্থক হয়নি।
এদিকে ১৮৫৭ সালের জাতীয় বিদ্রোহ, বাংলা দেশের নীল বিদ্রোহ ও অন্যান্য প্রজাবিদ্রোহের ভিতর দিয়ে বিদেশি শাসক ও এদেশিয় শাসিতদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে একটা বৈরভাব জাগ্রত হচ্ছিল। বিচ্ছিন্ন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতৃত্বহীন ও উদ্দেশ্যহীন হলেও, এই গণ—আন্দোলনের তরঙ্গ সমাজের বিভিন্ন জনস্তরে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। বাঙালি সমাজের মধ্যস্তরও দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল তখন। ১৮৫৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর যেমন উচ্চশিক্ষার বিস্তার হতে থাকে, তেমনি শিক্ষিত মধ্যবিত্তেরও প্রসার হতে থাকে বাংলা দেশে। অন্যান্য অঞ্চলেও হয়, কিন্তু বাংলা দেশের মতো কোথাও হয়নি। ১৮৫৭ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা উত্তর ভারত থেকে বর্মা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল) ২০,০০০ জন প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ১৬,০০০। ১৮৬১ সালে প্রথম এফ. এ. (ফার্স্ট আর্টস বা ইন্টারমিডিয়েট) পরীক্ষা প্রচলিত হয়। ১৮৮১ সালের মধ্যে, কুড়ি বছরে ৫০০০ জন এফ. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাদের মধ্যে বাঙালি ৪০০০ জন। ১৮৫৮ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে ১৭০০ জন গ্র্যাজুয়েট হয়, তাদের মধ্যে ১৫০০ জন বাঙালি। ১৮৬১ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ৪২৩ জন, তাদের মধ্যে ৩৫০ জন বাঙালি। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রসারের ফলে তাঁদের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকদের সম্পর্কেরও পরিবর্তন হতে থাকে। মধ্যবিত্তরা এমনিতেই নিজেদের শ্রেণিগত স্বার্থ সম্বন্ধে অত্যধিক সচেতন, তার বাইরে সহজে তাঁদের দৃষ্টি যায় না। কাজেই শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বার্থের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। তার কারণ, ফার্নিভালের ভাষায় : ‘The diplomas are subject to the law of diminishing returns, which translated into human values, is the law of increasing discontent.’ ‘Educational Progress in South East Asia’ অর্থাৎ ডিপ্লোমা—ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য চাকরির বাজারে তাঁদের দর যত কমতে থাকল, তত শাসকদের প্রতি তাঁদের বিরক্তি ও বিতৃষ্ণা বাড়তে লাগল। তাঁরা নিজেদের সুযোগ—সুবিধা দাবি করতে থাকলেন। দাবি অনুযায়ী শাসকরা নতুন নতুন চাকরিতে তাঁদের বহাল করতে পারলেন না। ক্রমেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে বাঙালি মধ্যবিত্তের সঙ্গে শাসকদের স্বার্থবিরোধ তীব্রতর হতে থাকল। এদিকে জাতীয় বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্ন সব গণবিদ্রোহের ভিতর দিয়ে শাসক—শাসিতের সম্পর্কে বৈরভাব ব্যাপক হল। এইসময় ১৮৬০ সালের পর থেকে তাই দেখা যায়, জাতীয়তাবোধ ক্রমে সংঘবদ্ধ রূপ ধারণ করছে এবং প্রধানত বাংলা দেশ কেন্দ্র করে।
‘হিন্দু মেলা’র অনুষ্ঠান আরম্ভ হল ১৮৬৭ সালের চৈত্রসংক্রান্তি থেকে। এ বছর তার শতবর্ষ পূর্ণ হল। হিন্দু মেলার আগে রাজনারায়ণ বসু ১৮৬১ সালে ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা’ স্থাপন করেন। ১৮৬৫ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগিতায় কলকাতায় ‘স্বাদেশিকের সভা’ গঠিত হয়। রাজনারায়ণ বসুর কাছ থেকেই নবগোপাল মিত্র ‘হিন্দু মেলা’ অনুষ্ঠানের প্রেরণা পান। এই হিন্দু মেলার অনুষ্ঠান থেকে আমাদের জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেম একটা নতুন খাতে বইতে আরম্ভ করে। মেলার নামের মধ্যে যে হিন্দুয়ানির গন্ধটুকু আছে, তা শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের হিন্দু প্রাধান্যের জন্য, সাম্প্রদায়িকতাবোধের জন্য নয়। আসলে স্বাদেশিকতাবোধ এইসময় থেকে স্বদেশের মাটিতে শিকড় গাড়তে থাকে এবং তার একটা বলিষ্ঠ শ্যামল দেশি রূপ ধীরে ধীরে প্রকাশ হতে থাকে। ‘ন্যাশনাল’ ও ‘ইন্ডিয়ান’ কথা দুটি যেন বাংলার সমস্ত অনুষ্ঠান—প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।
মেলার লক্ষ্য হয় ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতালাভ এবং সর্বভারতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। প্রায় প্রত্যেক অধিবেশনে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘গাও ভারতের জয়’ সংগীত গাওয়া হত
মিলে সব ভারত সন্তান, একতান মনপ্রাণ,
গাও ভারতের যশোগান।
ভারতভূমির তুল্য আছে কোন স্থানে?
হিন্দু মেলার সর্বভারতীয় জাতীয়তার রূপ এই সংগীতের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
উনিশ শতকের ষাট থেকে জাতীয়তাবোধের রূপান্তর হতে থাকে এবং তার সর্বভারতীয় রূপ ক্রমেই স্পষ্টতর হয়। ‘হিন্দু মেলা’ থেকে এর উৎপত্তি এবং জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায় এই সর্বভারতীয় জাতীয়তার একটি বিশেষ প্রকাশপর্বের শেষ হয়। যদি বলা হয় যে এই পর্বের, অর্থাৎ জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত জাতীয়তাবোধের এই উদবোধনপর্বের উদগাতা ও প্রেরণাদাতা ছিলেন প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিরা, তাহলে অত্যুক্তি করা হয় না।
হিন্দু মেলার আহ্বানে একটা সর্বভারতীয়তাবোধের তরঙ্গোচ্ছ্বাস এল যেন বাংলা দেশে। কাব্যে, নাটকে, সাহিত্যে, সাংবাদিকতায়, বিদ্বৎসভার আলোচনায়, সর্বত্র এই অখণ্ড ভারতবোধ, পরাধীনতার বেদনাবোধ এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ হতে থাকল। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, নাট্যকার মনোমোহন বসু সকলের রচনায় পরাধীন ভারতের বেদনার ঝংকার শোনা গেল। বাংলা ১২৭৭ সনে হেমচন্দ্রর ‘ভারত সঙ্গীত’ প্রথম প্রকাশিত হল ভূদেব মখোপাধ্যায়ের ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকায় :
বাজ রে শিঙ্গা বাজ এই রবে
শুনিয়া ভারতে জাগুক সবে,
সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে,
সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে
ভারত শুধু কি ঘুমায়ে রবে?
এই কবিতা প্রকাশ করার জন্য ভূদেববাবুকে তখন ইংরেজ সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছিল। হেমচন্দ্রর এই কবিতা তখন বাঙালির মনে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, পরবর্তীকালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি সংগীত এবং নজরুল, ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার আলোড়নের সঙ্গে কতকটা তার তুলনা করা চলে। বাঙালির এই মানসিক আলোড়নের ভিতর দিয়ে একটা বলিষ্ঠ ও সুস্পষ্ট ভারতবোধের বিকাশ হচ্ছিল, যে ভারতবোধ আমাদের উদীয়মান নব্যজাতীয়তাবোধের সঙ্গে একেবারে এক হয়ে মিশে গিয়েছে। ভারতবোধ ও জাতীয়তাবোধের এই আত্মিক মিলনপর্বের ভিতর দিয়ে আমরা উনিশ শতকের সত্তরে পদার্পণ করেছি।
এইসময় রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক মঞ্চে প্রধান নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তাঁর সহযোগী ও সহকর্মীরূপে আরও অনেকে এলেন, যেমন আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, মনোমোহন ঘোষ। ১৮৭৬ সালে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘ভারতসভা’ স্থাপিত হল। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর ‘এ নেশন ইন মেকিং’ গ্রন্থে লিখেছেন :
…the idea that was working in our minds was that the Association was to be the centre of an all-India movement. We accordingly resolved to call the new political body, the Indian Association. The Indian Association supplied a real need. It soon focussed the public spirit of the middle class, and became the centre of the leading representatives of the educated community of Bengal.
শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে স্থাপিত প্রথম সভা হল ভারতসভা। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর আত্মচরিতে এ বিষয় আরও পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন :
যখন ব্রাহ্মসমাজে এই সকল আন্দোলন চলিতেছে (সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হবার আগে—লেখক তখন আনন্দমোহন বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমি, তিনজনে আর—এক পরামর্শে ব্যস্ত আছি। আনন্দমোহনবাবু বিলাত হইতে আসার পর হইতেই আমরা একত্র হইলেই এই কথা উঠিত যে, বঙ্গদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য কোন রাজনৈতিক সভা নাই। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ধনীদের সভা, তাহার সভ্য হওয়া মধ্যবিত্ত মানুষদের কর্ম নয়, অথচ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকের সংখ্যা যেরূপ বাড়িতেছে, তাহাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপযুক্ত একটি রাজনৈতিক সভা থাকা আবশ্যক। …যখন একটা সভা স্থাপন একপ্রকার স্থির হইল, তখন একদিন আনন্দমোহনবাবু ও আমি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত দেখা করিতে গেলাম। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এরূপ প্রস্তাবে বিশেষ উৎসাহ ছিল।
ঠিক হল, ভারতসভা স্থাপিত হবে এবং বিদ্যাসাগর তার প্রথম সভাপতি হবেন। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তির জন্য বিদ্যাসাগর সভাপতি হতে সম্মত হননি। এই একই উদ্দেশ্য নিয়ে, প্রায় একসময়ে, কিছু আগে ও পরে, অমৃতবাজারের শিশিরকুমার ঘোষ ও মতিলাল ঘোষ ‘ইন্ডিয়ান লিগ’ নামে আর—একটি সভা স্থাপন করেন। এ সভা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ভারতসভার সম্পাদক হলেন আনন্দমোহন বসু, সহকারী সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ, প্রথম চাঁদা আদায়কারী সভ্য শিবনাথ শাস্ত্রী। ৯৩ নং কলেজ স্ট্রিটে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ভারতসভার কার্যালয় স্থাপন করা হয়। ঘরটির জীর্ণ অবস্থার কথা মনে করে ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ভারত—উদ্ধার’ কাব্যে লেখেন ‘কড়ি আগে পড়ে কিম্বা দড়ি আগে ছেড়ে’। গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, মনোমোহন ঘোষ, রাজনারায়ণ বসু, নবগোপাল মিত্র, সূর্যকুমার অধিকারী, ভোলানাথ চন্দ্র এবং আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ভারতসভার সভ্য হন।
ভারতসভার সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের বয়সের ব্যবধান বেশি নয়, মাত্র নয় বছরের। বাঙালির ‘ভারতসভা’র স্বাভাবিক পরিণতি ভারতের ‘জাতীয় কংগ্রেস’, এ কথা বললে ভুল হয় না। সুরেন্দ্রনাথ—আনন্দমোহনের বাগ্মিতা, কর্মতৎপরতা ও ভারত—পর্যটন ভারতসভাকে ভারতীয় মধ্যবিত্তশ্রেণির প্রতিনিধিসভায় পরিণত করল এবং বাংলার বাইরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তার শাখাকেন্দ্র স্থাপিত হল। সত্তরে ও আশিতে ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’, ‘ইলবার্ট বিল’ প্রভৃতির আন্দোলনের উত্তাপ এত দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল যে ভারতসভার চাইতে আরও বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব যেন অনিবার্য হয়ে উঠল। এইসময় বাংলার বাইরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষিত বাঙালির প্রভাব কত দূর বিস্তৃত হয়েছিল, হেনরি কটন তাঁর ‘নিউ ইন্ডিয়া’ (১৮৮৫) গ্রন্থে সে সম্বন্ধে লেখেন :
The educated classes are the voice and brain of the country. The Bengalee Baboo now rule public opinion from Peshawar to Chittagong…A quarter of a century ago there was no trace of this; the idea of any Bengalee influence in the Punjab would have been a conception incredible to Lord Lawrence, to a Montgomery, or a Macleod; yet it is the case that during the past year the tour of a Bengalee lecturer, lecturing in English in upper India, assumed the character of a triumphant progress; and at the present moment the name of Surendra Nath Banerjea excites as much enthusiasm among the rising generation of Multan as in Dacca.
ঢাকা থেকে মুলতান, পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম বাঙালির রাজনৈতিক জয়যাত্রা তখন দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষিত হচ্ছে এবং ঘোষণা করেছেন প্রধানত সুরেন্দ্রনাথ, রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের অদ্বিতীয় নায়ক। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংখ্যা তখন বাংলা দেশে যথেষ্ট বেড়েছে এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও শিক্ষিতদের ছোটখাটো গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। সুরেন্দ্রনাথ তাঁদের মুখপাত্র হয়েছেন এবং তাঁদের অভাব—অভিযোগ, দাবিদাওয়া তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে। প্রথম দাবি অর্থনৈতিক, চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ—সুবিধা, সর্বপ্রকার বৈষম্যের বাধা দূর করা। আরও একটি বড় দাবি হল, শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের নতুন সামাজিক মানমর্যাদার দাবি, বিদেশি শাসকরা যা দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। অন্তত সর্বক্ষেত্রে নয়। তা—ই নিয়ে বিদেশি শাসক ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে একটা বিদ্বেষভাব দীর্ঘদিন ধরে ধূমায়িত হচ্ছিল। চল্লিশের ‘ব্ল্যাক অ্যাক্ট’ আন্দোলন থেকে আশির ‘ইলবার্ট বিল’ আন্দোলন পর্যন্ত এই ধূমায়িত বহ্নির উত্তাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে। চল্লিশ থেকে আশির মধ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংখ্যাও অনেকগুণ বেড়ে যায়। আর্থিক সমস্যা কেবল দেশের সাধারণ লোকের জীবনে নয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জীবনেও বেশ প্রকট হয়ে ওঠে। ১৮৮১ সালে দেখা যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দেড় হাজার গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে অর্ধেকের কাছাকাছি বেকার। এই শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যাই বেশি। ভারতসভার রাজনৈতিক আন্দোলন স্বভাবতই তাই অনেক বেশি ব্যাপক ও প্রবল হয়েছিল। তার ভিতর দিয়ে একটা সর্বভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হচ্ছিল। তার তাগিদও ভারতসভার বাঙালি নেতারা অনুভব করছিলেন।
একটি সর্বভারতীয় জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং তার ভিতর দিয়ে ভারতব্যাপী জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ ভারতসভার তরফ থেকে উদ্যোগী হলেন ১৮৮৩ সালে। সভার বিভিন্ন কেন্দ্রের নেতাদের কাছে চিঠি লিখে তিনি একটি ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’ স্থাপনের কথা জানালেন। সকলেই উৎসাহিত হয়ে সম্মতি দিলেন এবং ১৮৮৩ সালের ২৮, ২৯, ৩০ ডিসেম্বর তিন দিন ধরে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে এই জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। প্রথম দিন সভাপতি হলেন রামতনু লাহিড়ী। আনন্দমোহন বসু তাঁর উদবোধন—ভাষণে বললেন যে ন্যাশনাল পার্লামেন্ট বা জাতীয় মহাসভা প্রতিষ্ঠার এই হল প্রথম পদক্ষেপ। দেশবাসীর প্রতিনিধিদের নিয়ে ব্যবস্থা—পরিষদ গঠন করা, সাধারণ শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা, বিচারবিভাগ ও শাসনবিভাগ পৃথক করা, সর্বপ্রকারের কাজকর্মে অধিক সংখ্যায় যোগ্য ভারতীয়দের নিয়োগ করা, জাতীয় ধনভাণ্ডার স্থাপন করা ইত্যাদি বিষয়ে সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই বার্তা প্রচারের জন্য সুরেন্দ্রনাথ আবার ভারত পর্যটনে বেরিয়ে যান (১৮৮৪ সালে)। এবারে তাঁর বক্তৃতায় বিভিন্ন অঞ্চলে ভারতবাসীর মনে যে সাড়া জাগে, যে স্বাদেশিকতার প্রেরণায় তারা উদবুদ্ধ হয়, তারই কথা হেনরি কটন তাঁর ‘নিউ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন।
এরপর ১৮৮৫ সালের ২৫, ২৬, ২৭ ডিসেম্বর কলকাতার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন হলে মহাসমারোহে ন্যাশনাল কনফারেন্সের দ্বিতীয় অধিবেশনের অনুষ্ঠান হয়। এবারের অধিবেশনে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন এবং মুসলমানদের প্রতিষ্ঠান ‘সেন্ট্রাল মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন’ যোগদান করেন। আগেকার অধিবেশনে এঁরা কেউ যোগদান করেননি। জাতীয় সম্মেলন সত্যিকার জাতীয় প্রতিষ্ঠানের রূপধারণ করে। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনী ‘এ নেশন ইন মেকিং’ গ্রন্থে এ কথা পরিষ্কার ভাষায় লিখেছেন :
The moral transformation which was to usher in the Congress movement had thus already its birth in the bosom of the Indian National Conference which met in Calcutta, and to which representatives from all parts of India were invited.
সুরেন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রকৃত জন্ম হয়েছিল কলকাতায় অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল কনফারেন্সের অধিবেশনে। ১৮৮৩ সালে যদি না—ও হয়ে থাকে, ১৮৮৫ সালের দ্বিতীয় অধিবেশনে অবশ্যই হয়েছিল বলা যায়। ১৮৮৫ সালের দ্বিতীয় অধিবেশন প্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ বলেছেন :
While we were having our National Conference in Calcutta, the Indian National Congress, conceived on the same lines and having the same programme, was hilding its first sitting at Bombay. The movements were simultaneous…
বোম্বাইতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হয় এবং তাতে সভাপতিত্ব করেন বাঙালি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। উমেশচন্দ্র বোম্বাইয়ের কংগ্রেস অধিবেশনে সুরেন্দ্রনাথকে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ একই সময়ে কলকাতার ন্যাশনাল কনফারেন্সের অধিবেশন ছেড়ে যেতে রাজি হন না। পরবর্তী বত্রিশ—তেত্রিশ বছর পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রত্যেক অধিবেশনে সুরেন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন, কেবল এই প্রথম অধিবেশন এবং মধ্যে করাচির একটি অধিবেশনে ছাড়া। একথা আত্মজীবনীতে সুরেন্দ্রনাথের বিশেষ করে উল্লেখ করার কারণ হল, বোম্বাইতে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হওয়া ইতিহাসের একটা খেয়ালি ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ কেবল ‘কংগ্রেস’ নামটি ছাড়া কলকাতার ন্যাশনাল কনফারেন্সের অধিবেশনকালে একই সময়ে বোম্বাই অধিবেশনের কোনও ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক তাৎপর্য কিছু নেই। এ সত্য সেদিনকার কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন হয়েছিল বাংলা দেশে কলকাতা শহরে এবং তাতে অবাঙালি দাদাভাই নওরজি সভাপতি হয়েছিলেন। শুধু তা—ই নয়। বোম্বাইতে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনের সঙ্গে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনের কোনও তুলনাই হয় না। জনসাধারণের উৎসাহ—উদ্দীপনার পার্থক্য থেকেই বোঝা গিয়েছিল সেদিন যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলেন কোথায়—বোম্বাইতে, না বাংলার কলকাতা শহরে। কংগ্রেসের এই দ্বিতীয় অধিবেশনের বিবরণ দিয়ে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা সেদিন যা লিখেছিলেন, তার খানিকটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি :
জাতীয় সভার সৃষ্টি দিবসে বোম্বাই নগরে সহস্র সহস্র লোকের সমাগম হইয়াছিল বটে; কিন্তু জাতীয় সভার দ্বিতীয় বৎসরে কলিকাতার মহানগরীতে যে অপূর্ব দৃশ্য ভারতবাসীর দৃষ্টিগোচর হইয়াছে, বোম্বাই সভা স্বপ্নেও তাহা কল্পনা করিতে পারেন নাই। ভারতবাসী যাহা স্বপ্ন বলিয়া ভাবিয়াছিলেন, গত ২৬শে ডিসেম্বরের রাত্রি প্রভাত হইলে চক্ষু মেলিয়া দেখিলেন সে স্বপ্ন নহে, প্রকৃত ঘটনা। কলিকাতার রাজপথ ভারতবর্ষের সমগ্র জাতিতে পরিপূর্ণ, ঘোর কলরবে দিগদিগন্তর প্রকম্পিত; লক্ষ লক্ষ ধনী মানী দীনদরিদ্র, রাজা প্রজায় রাজপথ অবরুদ্ধ করিয়া চলিয়াছেন, শকটে শকটে কলিকাতার বক্ষ প্রতিধ্বনিত হইতেছে, আশায় উৎসাহে উৎফুল্ল নেত্রে ঊর্ধ্বমুখে, প্রাণের আবেগে ভারতবাসী লক্ষ লক্ষ প্রজা কোন ঐশবলে বলীয়ান হইয়া একযোগে, এক পন্থার পথিক হইয়া যেন কোন অপূর্ব জগতে গমন করিতেছেন। পশ্চাতে কেহ ফিরিয়া দেখেন না, সম্মুখে কেহ কার্যান্তরে মনোনিবেশ করেন না, এক লক্ষ্য, এক উদ্দেশ্য অবলম্বন করিয়া হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রীষ্টান মাদ্রাজী মহারাষ্ট্র পার্সী পাঞ্জাবী সকল জাতির প্রতিনিধিগণ বাঙালীর সহিত মিলিত হইয়া জাতীয় সভায় গমন করিতেছেন।
‘সোমপ্রকাশ’ ২০ পৌষ ১২৯৩
‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার এই বিবরণ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, কোনও অতিরঞ্জন এর মধ্যে নেই। জাতীয় জনজাগরণের এই দৃশ্য বাস্তবিকই বোম্বাই সভা, ‘সোমপ্রকাশ’—এর ভাষায়, স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। তাহলে জাতীয় জাগরণের এই কল্লোল বাংলার কলকাতা শহরে কি এমনিতেই শোনা গিয়েছিল? জাতীয় জাগরণের এই কলরব বাংলা দেশে শোনা গিয়েছিল কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে, কারণ হিন্দু মেলা থেকে আরম্ভ করে ভারতসভা, জাতীয় সম্মেলন প্রভৃতি অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে কংগ্রেসের মতো সেদিনকার জাতীয় প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠার পথ বাংলা দেশে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তরাই প্রস্তুত করেছিলেন। এ কথা ঐতিহাসিক সত্য, বাঙালিত্বের বড়াই নয়।
তারপর কংগ্রেসের জাতীয় আন্দোলনের বিচিত্রগতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে যখনই পুরাতন ও নতুন রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল ভাবধারার সংঘাত হয়েছে নীতি ও আদর্শ নিয়ে, তখনই নতুনপন্থী প্রগতিশীল বাঙালিরা আন্দোলেনের গতি ও রূপ পরিবর্তন করতে এগিয়ে এসেছেন। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের মতো নেতারাও যখন রক্ষণশীলতার দিকে ঝুঁকেছেন, তখন বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষের মতো নবাগতরা তাঁদের বাতিল করতে কুণ্ঠিত হননি। বাংলার স্বদেশি আন্দোলনের ফলে কংগ্রেসের মধ্যে যখন স্বরাজ, বিদেশি পণ্য বয়কট, জাতীয় শিক্ষা প্রভৃতি আদর্শের আমদানি হল, তখন (১৯০৭—০৯) ভারতের তিন নেতা কংগ্রেসের মধ্যে জনপ্রিয় দেশনায়ক হয়ে উঠলেন—মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক, পাঞ্জাবের লালা লাজপত রায়, বাংলার বিপনচন্দ্র পাল। ‘লাল—বাল—পাল’ তিনজনের নাম একত্রে ভারতের জনগণের মুখে মুখে তখন উচ্চারিত হত। এঁরা ছিলেন কংগ্রেসের ‘এক্সট্রিমিস্ট’ বা চরমপন্থী দলের নেতা। এঁদের বিরোধীদের বলা হত ‘মডারেট’ বা নরমপন্থী। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বকালে, প্রথম ও শেষ পর্বে, কংগ্রেসের মধ্যে নতুন—পুরাতন যে সংঘাত হয়, বাঙালিদের মধ্যে তার প্রথম পর্বের নেতা ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং শেষ পর্বের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। এইভাবে জাতীয় কংগ্রেসের উৎপত্তিতে যেমন, তার বিকাশ ও অগ্রগতিতে তেমনি বাঙালি রাষ্ট্রনায়করা অগ্রণী হয়েছেন। বাঙালিত্ববোধের চাইতে ভারতবোধ এবং সর্বভারতীয় জাতীয়তাবোধ বরাবরই তাঁদের কাছে মহত্তর আদর্শ বলে গণ্য হয়েছে। প্রাদেশিকতা বা সাম্প্রদায়িকতার বদ্ধকূপে কোনোদিনই তাঁরা মণ্ডূকনীতি পালন করতে পারেননি। এই উদার দেশাত্মবোধের মূল্যও বাঙালিকে কম দিতে হয়নি, আজও দিতে হচ্ছে। কিন্তু মূল্য যতই দিতে হোক, ক্ষতি যতই স্বীকার করতে হোক, বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা সহজেও ওই উদারতা ও প্রগতিশীলতার মহান ঐতিহ্য বর্জন করে সংকীর্ণতার বদ্ধগলিতে প্রবেশ করবে বলে মনে হয় না।
১৩৭৪। ১৯৬৭
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন