বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ

বিনয় ঘোষ

বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ

বাঙালি সদাগরশ্রেণি ইতিহাসের এক বিচিত্র রহস্য ও প্রহেলিকা হয়ে রয়েছেন। বাংলার সামাজিক ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু ছাত্ররা এ কথা অস্বীকার করতে পারেন না। অর্থনীতি ও সমাজনীতির ছাত্রদের উচিত এই প্রহেলিকার সমাধান করা। কিন্তু সমাধান আপাতদৃষ্টিতে যতটা সহজ মনে হয়, আসলে তত সহজ নয়। যে—কোনও কঠিন ‘ক্রসওয়ার্ড পাজল’—এর চেয়েও কঠিনতর এ বাঙালি সদাগরদের ‘পাজ্ল’। সাহিত্যের ছাত্ররা জানেন, বাংলা সাহিত্যের কতটা অংশ জুড়ে বাঙালি সদাগরশ্রেণী বিরাজ করছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান নায়ক বাঙালি সদাগর। লোকসাহিত্যেও সদাগরদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। প্রশ্ন বা প্রহেলিকা এই যে বাংলার সমাজজীবনে বাঙালি সদাগরদের এরকম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, সেই বাঙালি সদাগরশ্রেণি পরবর্তীকালে পুঁজিপতি বা শিল্পপতি শ্রেণিতে পরিণত হতে পারলেন না কেন? যে বিরাট মূলধন তাঁরা বংশানুক্রমিক ব্যবসায়ের ফলে সঞ্চয় করেছিলেন সেই মূলধন কোন রন্ধ্র নিয়ে কোথায় উবে গেল এবং কেন গেল? কেন তাঁরা পুঁজিবাদী যুগে প্রধানত দালাল ও দোকানদারের স্তরে নেমে এলেন? বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা অনুশীলন করলে এই ধরনের অনেক প্রশ্ন মনে জাগে, যার সদুত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। এইজন্যই বাঙালি সদাগরশ্রেণির ইতিহাসকে প্রহেলিকা বলেছি।

পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে এ প্রশ্ন আমার মনে সম্প্রতি বিশেষভাবে জেগেছে। বাংলার সদাগরসমাজের অতীত ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির বিস্তৃত ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে রয়েছে ভাগীরথীর পশ্চিমে রাঢ়দেশে। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে যে নেই তা নয়, কিন্তু বর্তমান বর্ধমান ও হুগলি—হাওড়া জেলায় যেরকম আছে, সেরকম আর কোথাও নেই। বণিকপ্রধান এমন বহুগ্রাম এসব অঞ্চলে এখনও আছে, যার অতীত সমৃদ্ধির স্মৃতি দেখলে আজও অবাক হয়ে যেতে হয়। এখন শুধু এইটুকু বলা প্রয়োজন যে বাঙালি সদাগরশ্রেণির ঐতিহাসিক প্রহেলিকা ভেদ করতে পারলে কেবল যে একটা সামাজিক সমস্যারই সমাধান হবে তা নয়, বাংলার একটা অন্যতম সাংস্কৃতিক প্রহেলিকারও সমাধান হবে। অর্থাৎ বাংলার সদাগরি প্রহেলিকা কেবল সামাজিক প্রহেলিকা নয়, সাংস্কৃতিক প্রহেলিকাও। আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির সংঘাত ও সমন্বয়ে বাঙালি সদাগরশ্রেণি যে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, বাংলার মঙ্গলকাব্যে ও লোকসাহিত্যে তার প্রচুর প্রমাণ আছে। বাংলার কোন অঞ্চলে সদাগরশ্রেণির বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা হয় জানতে পারলে, বাংলার চণ্ডীপূজা, মনসাপূজা ও শিবপূজার আদিকেন্দ্রের, অথবা প্রাধান্যকেন্দ্রের আভাস পাওয়া যেতে পারে। এই কারণে সদাগরশ্রেণির প্রহেলিকাকে সাংস্কৃতিক প্রহেলিকাও বলা যায়।

বাঙালি সদাগরশ্রেণির প্রাচীনতা

বাঙালি সদাগরশ্রেণির প্রাচীনতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে প্রাচীন ইতিহাসের আলোচনা করতে হয়। এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবু যতটা সম্ভব সংক্ষেপে এপ্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করব। বাংলার সদাগরদের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে বাংলা দেশের আর্যীকরণের (Aryanisation) ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কারণ সুবর্ণবণিক গন্ধবণিক তাম্বূলীবণিক প্রভৃতি যেসব বিভিন্ন বণিকজাতি নিয়ে বাঙালি সদাগরশ্রেণি গঠিত তাঁরা কেউ প্রাগার্য জাতির আধুনিক বংশধর নন। নৃতাত্ত্বিক মানদণ্ডে তাঁদের দৈহিক গড়নের বিচার করলে অন্তত তা—ই মনে হয়। দেড় হাজার দু—হাজার বছরের ইতিহাসে সব জাতির মধ্যেই যেমন মিলন—মিশ্রণ হয়েছে, বণিকজাতির মধ্যেও তেমনি হয়েছে। বৈজ্ঞানিকের কাছে অবিমিশ্র বিশুদ্ধ জাতির অস্তিত্ব পৃথিবীর কোনওদেশেই নেই, আমাদের দেশেও নেই। বিশুদ্ধ জাতিস্মরতন্ত্রের ‘সংস্কার’ অশিক্ষা ও কুশিক্ষাজনিত কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। আমাদের দেশের লোকের অস্থিমজ্জায় আজও এই কুসংস্কার আছে। বর্ণাশ্রমপন্থীরা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে এমন এক জাতি—নিউরসিসের সৃষ্টি করেছেন আমাদের দেশে, যা উপড়ে ফেলতে অনেক সময় লাগবে বলে মনে হয়। সে যা—ই হোক, আমাদের দেশের বণিকদের কথা বলি।

প্রাচীন ইতিহাসে বণিকদের কথা বৈদিক যুগ থেকেই পাওয়া যায়। প্রাক—বৈদিক যুগেও সমাজে বণিকশ্রেণি ছিল বলে মনে হয়। অন্তত সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন থেকে বোঝা যায় যে ব্যবসায়ী শ্রেণি তখনও ছিল। বৈদিক যুগেও ছিল। বৈদিক সাহিত্যে বণিকদের বাণিজ্যযাত্রার কথা আছে। বৌদ্ধ যুগেও সে বণিকশ্রেণির বেশ প্রতিপত্তি ছিল, বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে বাংলা দেশের বণিকশ্রেণি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বৈদিক যুগের বণিক বাংলা দেশ পর্যন্ত এসেছিলেন কি না তা বলা যায় না। আসতেও পারেন, না—ও আসতে পারেন, এলেও আসে—যায় না কিছু। কারণ, এসে তাঁরা বাংলা দেশে যে বসবাস করতেন, তা মনে হয় না। আমাদের প্রশ্ন হল, বাংলা দেশে বণিকরা কবে থেকে নিয়মিতভাবে আনাগোনা ও বসবাস করতে আরম্ভ করলেন? কবে থেকে তাঁরা বাংলার গ্রাম্য সমাজে স্বতন্ত্র গোষ্ঠী ও শ্রেণি হিসেবে নিজেদের স্থান করে নিলেন? নদীমাতৃক বাংলা দেশের আদি বাসিন্দাদের মধ্যে জলের ও স্থলের শিকারিরা এবং কৃষিজীবীরাই প্রধান ছিল। পশুপালকরাও ছিল। তাদের মধ্যে জিনিসপত্রের লেনদেন যে ছিল না তা নয়। কিন্তু সেইসব আদিম কৌমসমাজে বৃত্তি হিসেবে বাণিজ্যকে গ্রহণ করে যে স্বতন্ত্র একটি শ্রেণি বিকাশ হয়েছিল, তা মনে হয় না। আজও আমাদের দেশের সাঁওতাল বা অন্যান্য আদিবাসীদের মধ্যে স্বতন্ত্র বণিকশ্রেণির বিকাশ হয়নি দেখা যায়। উৎপাদকরা (Producer) নিজেরাই তাদের উৎপন্ন পণ্যদ্রব্যের লেনদেন করে হাটবাজারে। আদিম কৌমসমাজের এইটাই বিশেষত্ব। মধ্যবর্তী একটি বণিকশ্রেণির বিকাশের সেখানে কোনও সুযোগ নেই। বাংলা দেশের আর্যপূর্ব সমাজেও ছিল না এবং বণিকশ্রেণির স্বতন্ত্র বিকাশ তখন হয়নি। পূর্ব ভারতে ও বাংলা দেশে আর্যদের আগমনের সময় থেকে ধীরে ধীরে বণিকশ্রেণির বিকাশ হতে থাকে।

পূর্ব ভারতে আর্যরা প্রথম আসেন বিদেহতে বা মিথিলায় (উত্তর বিহারে)। মিথিলা থেকে আর্য সংস্কৃতির বিস্তার হয় উত্তরবঙ্গে, মগধে বা দক্ষিণ বিহারে এবং প্রাগজ্যোতিষে বা আসামে। বাংলা দেশ যে মগধের নন্দ ও মৌর্য রাজাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়; খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত তাঁরা রাজত্ব করেন। গ্রিক ঐতিহাসিকরা পাটলিপুত্রের এই রাজাদের প্রাচী ও গঙ্গারিড়ির (গঙ্গারাঢ়ের) রাজা বলেছেন। গঙ্গারিড়ি বা গঙ্গারাঢ়ের মধ্যে যে রাঢ়দেশ ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মৌর্য যুগ থেকেই বাংলার আর্যীকরণ আরম্ভ হয় এবং তখন থেকেই মনে হয় আর্যসমাজভুক্ত বণিকরা বাংলা দেশে নিয়মিতভাবে আনাগোনা ও বসবাস করতে শুরু করেন। প্রধানত নদনদীর তীরেই তাঁরা বসতি স্থাপন করেন এবং ধীরে ধীরে বন্দর ও বাণিজ্য—নগর গড়ে তোলেন। যেসব বন্দর ও বাণিজ্য—নগর তাঁরা গড়ে তোলেন তার মধ্যে তাম্রলিপ্তি বা তমলুক সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ।

গুপ্ত যুগে বাংলা দেশের আর্যীকরণ আরও অনেক সম্পূর্ণ হয়। গুপ্ত রাজারা শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের পশ্চিম থেকে নিয়ে এসে ভূমিদান করে বাংলা দেশে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। সমুদ্রগুপ্ত দিগবিজয়ে বাংলা দেশেও এসেছিলেন। অনেকে মনে করেন যে মহাকবি কালিদাস রঘুর দিগবিজয় কাহিনির মধ্যে সমুদ্রগুপ্তর দিগ্বিজয়েরই ইঙ্গিত করেছেন। কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ থেকে জানা যায় যে তখন বাংলা দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ—পূর্ব অঞ্চলের নৌবাহিনী বিখ্যাত ছিল। গুপ্ত যুগের শাসনব্যবস্থায় দেখা যায় যে ব্যাঙ্কার ও বণিকদের বিশেষ স্থান আছে। ভুক্তির শাসনকার্য চালাতেন উপরিক, নির্বাচিত প্রতিনিধিমণ্ডলীর সাহায্যে। এই প্রতিনিধিমণ্ডলী বা শাসন—পরিষদের নাম ছিল ‘অধিষ্ঠানাধিকরণ’। এই শাসন—পরিষদের সভ্যসংখ্যা ছিল চারজন—

নগরশ্রেষ্ঠী, অর্থাৎ ব্যাঙ্কার বা শেঠদের প্রতিনিধি

প্রথম সার্থবাহ, বা বণিকসমাজের প্রতিনিধি

প্রথম কুলিক, বা উৎপাদক—শিল্পীদের প্রতিনিধি

জ্যেষ্ঠ কায়স্থ, বা রাষ্ট্র দপ্তরের চিফ সেক্রেটারি

চারজনের মধ্যে তিনজন সমাজের অর্থনৈতিক স্তরের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি। তার মধ্যে একজন হলেন নগরশ্রেষ্ঠী বা ব্যাঙ্কার। শ্রেষ্ঠীর বা শেঠের প্রতিনিধিত্ব থেকে বোঝা যায় যে সমাজে ব্যাঙ্কিং বা মহাজনি কারবার বেশ রীতিমতো চালু ছিল এবং শেঠদের বেশ প্রতিপত্তিও ছিল। অবশ্য প্রতিপত্তিটা অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি। প্রতিনিধিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠী ছাড়াও ‘প্রথম সার্থবাহ’ বা বণিকসমাজের একজন প্রতিনিধি থাকতেন। শুধু ব্যাঙ্কার বা মহাজনের নয়, বণিকদের প্রতিনিধিরও বিশেষ স্থান ছিল শাসন—পরিষদে। এর থেকে বণিকশ্রেণির স্বাতন্ত্র্য ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়। এ ছাড়া, উৎপাদকশিল্পীদের প্রতিনিধি থাকতেন। তাঁকে ‘প্রথম কুলিক’ বলা হয়। কৃষিপ্রধান সমাজে এরকম কৃষিবর্জিত পেশার তিনজন প্রতিনিধি শাসন—পরিষদে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু ছাত্ররা এর মধ্যে চিন্তা করবার অনেক খোরাক পাবেন। পণ্য উৎপাদন ও বাণিজ্য সম্পর্কে গুপ্ত যুগের শাসকরা যে বিশেষ সজাগ ছিলেন, তা এই প্রতিনিধি নির্বাচন থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়। গুপ্ত যুগে এই কারণে বাণিজ্যের বিস্তার হয়েছিল যথেষ্ট এবং বণিকশ্রেণির প্রাধান্যও বেড়েছিল। বাংলার প্রাচীন বন্দরে বন্দরে এইসময় বেশ সুসমৃদ্ধ বাণিজ্য—নগরও গড়ে উঠেছিল মনে হয়। এইসময়কার একটি বাণিজ্য—নগরের কথা আমরা চীনা পর্যটকদের বৃত্তান্ত থেকে জানতে পারি, তাম্রলিপ্তি বা তমলুকের কথা। তাম্রলিপ্তি প্রসঙ্গে চীনা পর্যটকরা বণিকদের কথাও উল্লেখ করেছেন। হুয়েন সাং তমলুকের লোকদের রীতিমতো ধনী বলেছেন। ‘কথাসরিৎসাগর’—এও তমলুকের ধনী ব্যবসায়ীদের লঙ্কা ও সুবর্ণদ্বীপের সঙ্গে ব্যবসায়ের কথা আছে। তাম্রলিপ্তি থেকে সুবর্ণভূমির বাণিজ্যপথ ছিল সমুদ্রের উপর দিয়ে, আরাকান ও বর্মা হয়ে। এই পথে মালয় ও সুদূর প্রাচ্য পর্যন্ত বাঙালি সদাগররা বাণিজ্যযাত্রা করতেন। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে টলেমিও এই বাণিজ্যপথের কথা জানতেন। পঞ্চম শতাব্দীতে ফা—হিয়েন তাম্রলিপ্তিতে আসেন বাণিজ্যতরিতে এবং তাম্রলিপ্তি থেকেই সিংহল হয়ে চীনে ফিরে যান। সপ্তম শতাব্দীতে তমলুক থেকে মালয় উপদ্বীপ পর্যন্ত রীতিমতো বাণিজ্যতরি যাতায়াত করত। দক্ষিণ—পূর্ব ছাড়াও, দক্ষিণ—পশ্চিমে বাণিজ্যের আর—একটি জলপথ ছিল তমলুক থেকে। কলিঙ্ক ও কারোম্যাণ্ডাল উপকূল দিয়ে দক্ষিণ ভারত ও সিংহল পর্যন্ত এই পথে বাঙালি সদাগররা যাতায়াত করতেন। জাতকের গল্পে, পেরিপ্লাস গ্রন্থে, প্লিনির লেখায় এই পথের উল্লেখ আছে। এ ছাড়া চীনা পর্যটক আইসিং তমলুক থেকে পশ্চিম দেশে বাণিজ্যযাত্রার স্থলপথের কথা উল্লেখ করে গিয়েছেন। আইসিং বলেছেন যে তাম্রলিপ্তি থেকে স্থলপথে যখন তিনি বুদ্ধগয়ায় গিয়েছিলেন তখন শত শত বণিকও তাঁর সহযাত্রী হয়েছিলেন।

এইসব প্রমাণ থেকে বোঝা যায়, গুপ্ত যুগে বাংলার বাণিজ্যের বিশেষ উন্নতি হয় এবং বাঙালি সমাজে সদাগররা রীতিমতো প্রতিষ্ঠালাভ করেন। গুপ্ত যুগের পর পাল যুগে ও সেন যুগে বাণিজ্যের আরও দ্রুত ক্রমোন্নতি হয় এবং বণিকরাও রীতিমতো প্রতিপত্তিশালী শ্রেণিতে পরিণত হন। নদনদীর তীরে তীরে, তমলুক ছাড়াও আরও অনেক স্থানে তাঁরা বন্দর ও বাণিজ্য—নগর গড়ে তোলেন। মনে হয়, প্রধানত রাঢ়দেশের বা পশ্চিমবঙ্গের নদনদীর তীরেই বাঙালি সদাগরদের বসতি ও পত্তনগুলি গড়ে ওঠে। দামোদর, অজয়, সরস্বতী ও ভাগীরথী—এই কয়টি প্রধান নদনদী ও তাদের শাখাপ্রশাখার তীরেই বাঙালি বণিকদের প্রাচীন বসতি স্থাপিত হয়। এ অনুমান ঐতিহাসিক যুক্তিসহ, কারণ ভাগীরথীর পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম বণিকশ্রেণি বাণিজ্যের উদ্দেশে আনাগোনা করতে থাকেন মগধ থেকে। ভাগীরথীর প্রবাহ তখন আরও পশ্চিম—দক্ষিণমুখী ছিল এবং ক্রমেই পূর্বদিকে এই প্রবাহ সরে গিয়েছে। দামোদর, অজয় ও সরস্বতীও তখন অনেক বড় ও বিস্তৃত নদনদী ছিল। বড় বড় বাণিজ্যতরি যাতায়াত করত এই নদীপথে। বর্তমানের খড়্গেশ্বরী, কানা নদী, কানা দামোদর ইত্যাদি তখন বেশ প্রশস্ত নদী ছিল। দামোদরও পূর্ব থেকে ক্রমে পশ্চিমে সরে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে এইসব নদনদীর তীরে, বর্ধমান ও হাওড়া—হুগলী জেলায় যেরকম বণিকপ্রধান বসতির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়, এরকম আর অন্য কোথাও দেখা যায় না। অতীতের এইসব বণিকপ্রধান বসতির চিহ্ন দেখলে আজও বোঝা যায়, একসময় এইসব গ্রাম ও নগর বাঙালি সদাগরদের সম্পদে কীরকম সুসমৃদ্ধ জনপদে পরিণত হয়েছিল। দামোদর ও অজয় নদের তীরে, ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে, সরস্বতীর তীরে, কানা নদী, কানা দামোদর, খড়্গেশ্বরী বা খড়ি নদীর তীরে, বাঙালি বণিকদের সুসমৃদ্ধ বসতির যেরকম ধারাবাহিক স্মৃতিচিহ্ন দেখা যায়, এবং যা বাংলা দেশের আর কোনও অঞ্চলে এমনভাবে দেখা যায় না, তাতে মনে হয় বাঙালি সদাগরশ্রেণির প্রথম স্থিতি, প্রতিষ্ঠা ও ক্রমবিকাশ প্রধানত পশ্চিমবাংলার এই অঞ্চলেই হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে ঘন ঘন বৈদেশিক অভিযান হয়েছে, হিন্দু যুগ থেকে মুসলমান ও খ্রিস্টান যুগ পর্যন্ত। তার ফলে যে রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, অনেকসময় তা বাণিজ্যের অনুকূল নয় বলে সদাগররা পশ্চিম থেকে পূর্ব তীরে, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে চলে গিয়েছেন। এ ছাড়া ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও বণিকশ্রেণির অবনতি ও দেশত্যাগের অন্যতম কারণ। পশ্চিমবঙ্গের নদনদীর বৈপ্লবিক গতিপরিবর্তন হয়েছে। তার ফলে নদীতীরবর্তী বণিকবসতি ও বাণিজ্য—নগরের সমৃদ্ধি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বড় বড় ইমারত—অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে অসংখ্য জনশূন্য একদা—বণিকপ্রধান গ্রাম আজও পশ্চিমবঙ্গের নদনদীর তীরে তার নির্বাক সাক্ষীরূপে বিরাজ করছে।

মধ্যযুগের সাহিত্যে বণিকদের কথা

হিন্দু যুগের পর মুসলমান যুগেও যে বাঙালি সদাগরদের সমৃদ্ধি ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট ছিল, তার পরিচয় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায়। মঙ্গলকাব্যে ও চৈতন্য—সাহিত্যে পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাঙালি সদাগরশ্রেণির সমৃদ্ধির যে পরিচয় পাওয়া যায় তা লক্ষণীয়। বিপ্রদাসের ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে চাঁদবেনের বাণিজ্যযাত্রার বর্ণনা আছে :

গন্ধেশ্বরী প্রণমে বরিল সাবধানে
অনেক ছাগল করিয়া বলিদানে।
সনকারে প্রবোধ করিয়া নৃপবর
শুভক্ষণে বুহিত্র মেলিল নরেশ্বর।
দ্বিতীয় মেলিল ডিঙ্গা নামে সর্বজয়া
দু’লক্ষ তঙ্কার দ্রব্য তাহাতে ভরিয়া।
তৃতীয় মেলিল ডিঙ্গা নামে জগদ্দল
বারো বরিষের ধরে তণ্ডুল সম্বল।
চতুর্থ মেলিল ডিঙ্গা নাম সুমঙ্গল
যার রূপে দুই কূলে হইল উজ্জ্বল।
পঞ্চমে মেলিল ডিঙ্গা নামে নবরত্ন
যার রূপ দেখিতে দেবের হয় যত্ন।
অষ্টমে মেলিল ডিঙ্গা নামে চিত্ররেখা
জার ধনে আদি অন্ত নাই লেখা জোখা।
সপ্তমে মেলিল ডিঙ্গা নামে শশিমুখী
বহুদূর হইতে যার ছইঘর দেখি।

বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’—এ সপ্তগ্রামের বণিকদের কথা আছে। নিত্যানন্দ বণিকদের ঘরে ঘরে কীর্তন করে বেড়িয়েছিলেন।

সপ্তগ্রামে প্রতি বণিকের ঘরে ঘরে।
আপনে শ্রীনিত্যানন্দ কীর্তন বিহারে।।
বণিক সকল নিত্যানন্দের চরণ।
সর্বভাবে ভাবিলেন লইয়া শরণ।।

মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ধনপতি ও শ্রীমন্ত সদাগরের উপাখ্যানের কথা সকলেই জানেন। ধনপতির পিতৃশ্রাদ্ধের আয়োজন, কুটুম্বসমাগম ও বণিকদের মধ্যে সম্মানপ্রাপ্তির জন্য বিবাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বণিকসমাজের প্রসার ও প্রতিপত্তির যে বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায়, তা বিস্ময়কর বললেও অত্যুক্তি হয় না। ধনপতিধামে প্রায় সাতশত বণিকের সমাগম হয়েছিল, প্রধানত বর্ধমান, হাওড়া ও হুগলি জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে।

একে একে বণিকের কত কব নাম।
সাতশত বেণে আইসে ধনপতিধাম।।

বণিকসভায় কে বেশি সম্মান পাবেন তা—ই নিয়ে যে বিবাদ আরম্ভ হয়, তাতে দেখা যায় :

যেকালে বাপের কর্ম কৈল ধূসদত্ত।
তাহার সভায় বেণে হৈল ষোল শত।।

ধনপতির পিতৃশ্রাদ্ধে সাতশত বণিকের সমাগম হয়েছিল এবং ধূসদত্তর পিতৃশ্রাদ্ধে ষোলোশত বণিকের। সকলেই পশ্চিমবঙ্গের বণিক এবং প্রধানত বর্ধমান ও হুগলি—হাওড়া জেলাতেই অধিকাংশের বাস।

মঙ্গলকাব্যে বাঙালি বণিকদের ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদেরও পরিচয় পাওয়া যায়। বিপ্রদাস বলেছেন যে চাঁদ সদাগরের সর্বজয়া ডিঙাতে দু—লক্ষ টাকার পণ্য ভরা ছিল—’দ্বিতীয় মেলিল ডিঙ্গা নামে সর্বজয়া, দু’লক্ষ তঙ্কার দ্রব্য তাহাতে ভরিয়া।’ সাতখানি ডিঙার সাত রকমের নাম—নরেশ্বর, সর্বজয়া, জগদ্দল, সুমঙ্গল, নবরত্ন, চিত্ররেখা, শশিমুখী। ডিঙাগুলির ডিজাইন বা আকার কেমন ছিল জানা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন মন্দিরের গায়ে কয়েক রকমের নৌকার চিত্র দেখা যায়—পোড়ামাটির ইটের উপর উৎকীর্ণ। বাংলার নদনদীতে এই ধরনের নৌকা যে চলাচল করত তাতে সন্দেহ নেই। সব নৌকাতেই যে পণ্যের পসরা যেত তা নয়, লোকলশকরও যেত সঙ্গে। চাঁদ সদাগরের সাতটি ডিঙ্গার মধ্যে একটিতেই যদি দু—লক্ষ টাকার জিনিস থাকে, তাহলে সাতটিতে মোট কত লক্ষ টাকার জিনিস ছিল তা অনুমান করা কঠিন নয়। এত টাকা মূল্যের জিনিস নিয়ে কোনও সদাগরই একা সমুদ্রপথে বিদেশযাত্রা করতেন না। জলদস্যুর উৎপাত ছিল তখন যথেষ্ট। সঙ্গে ডিঙারক্ষী নিয়েই তাঁরা বাণিজ্যযাত্রা করতেন। বাণিজ্যের মুনাফা থেকে যে তাঁরা কি পরিমাণ ধন সঞ্চয় করেছিলেন তা চাঁদ সদাগরের পণ্যের বহর দেখেই বোঝা যায়।

ধন মানে কুলে শীলে চাঁদ নহে বাঁকা।
বাহির মহলে যার সাত মরাই টাকা।।

—কবিকঙ্কণ

ধনপতির শ্বশুরও লক্ষপতি সদাগর ছিলেন।
সাধুর শ্বশুর আইল নামে লক্ষপতি।
নানাধন লয়ে আইসে সাধুর বসতি।।

—কবিকঙ্কণ

ষোড়শ, সপ্তদশ, এমনকী অষ্টাদশ শতাব্দীতেও দেখা যায়, বাঙালি সদাগররা বেশ প্রচুর পরিমাণে ধনসঞ্চয় করেছিলেন। প্রশ্ন হল, শত শত বৎসর ধরে বাণিজ্য করে বংশপরম্পরায় ধনসঞ্চয় করেছেন যে দেশের সদাগরশ্রেণি, সে দেশে ইংরেজ আমলের আগে পর্যন্ত কেন নতুন ধরনের পণ্যোৎপাদন পদ্ধতিপ্রচলিত হল না, নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হল না, এবং ইংরেজ আমলেও কেন তাঁদের ভিতর থেকে আধুনিক যুগের পুঁজিপতির বিকাশ হল না বেশি। প্রশ্ন খুবই জটিল এবং উত্তরও সহজ নয়।

বাণিজ্যের সম্পদ ও জাতীয় প্রগতি

এ প্রশ্নের উত্তর যত দূর সম্ভব সংক্ষেপে দেবার চেষ্টা করব। বরং কোন পথ ধরে অনুসন্ধান করলে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, তারই ইঙ্গিত করব বলা চলে। কারণ অর্থনীতির কিছুটা জটিল তত্ত্বকথা সবিস্তারে আলোচনা না করলে, এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়াও সম্ভব নয়। এখানে তার অবকাশ নেই বলে সংক্ষেপে ইঙ্গিত করছি। বাণিজ্য প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় কথা হল, বাণিজ্যলব্ধ সম্পদ আর জাতীয় সম্পদ (National Wealth) এক নয়। কথাটা হেঁয়ালি মনে হবে, কিন্তু হেঁয়ালি নয়। দেশের মুষ্টিমেয় বণিকশ্রেণি বাণিজ্য করে যতই ধনসঞ্চয় করুন, তাতে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি হয় না। কেন হয় না? কারণ বণিকশ্রেণি নিজেরা পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করেন না, উৎপন্ন পণ্য নিয়ে লেনদেন করেন, কেনাবেচা করেন। দেশের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন—পদ্ধতির (Mode of Production) পরিবর্তন প্রয়োজন, নতুন পদ্ধতিতে নানাবিধ পণ্যের উৎপাদন প্রয়োজন। শুধু ব্যবহার্য পণ্যের নয় (Consumption goods), উৎপাদনযন্ত্রেরও উদ্ভাবন প্রয়োজন। পুঁজিপতিরা (Capitalists) উৎপাদন—পদ্ধতির পরিবর্তন করে উৎপন্ন দ্রব্যের বৈচিত্র্য বাড়ান, বাজার প্রসারিত করেন। তাই পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থায় জাতীয় সম্পদ বাড়ে। কিন্তু বণিকরা (Merchants)  তা করেন না, বণিগবৃত্তির (Mercantilism) সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কও নেই। সংকীর্ণ অনগ্রসর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে বাণিজ্যের বিস্তার হলে অনেকসময় দেখা যায় যে সেই সংকীর্ণতা আরও কায়েমি হয়। বাংলা দেশেও তা—ই হয়েছে। প্রাচীন সমাজে বাণিজ্যলব্ধ মূলধন বৃদ্ধির ফলে কীভাবে দাসব্যবস্থা কায়েম হয়েছে, কার্ল মার্কস সে কথা উল্লেখ করেছেন। মার্কস বলেছেন, ‘In the antique world the effect of commerce and the development of merchant capital always results in slave economy. বাংলা দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদন—পদ্ধতি প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতিই ছিল, মৌর্য ও গুপ্ত যুগ থেকে ব্রিটিশ যুগের গোড়া পর্যন্ত তার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। সংকীর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে বাণিজ্যের প্রসারের ফলে সেই সংকীর্ণতা আরও বেশি কায়েমি ও দৃঢ়মূল হয়েছে। বাঙালি সদাগররা বাংলার গ্রাম্য সমাজকে যত দূর সম্ভব সংঘবদ্ধ ও সুনিয়ন্ত্রিত করে নিজেদের বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদনের কাজে নিয়োগ করেছেন। কোনও নূতন উৎপাদন—পদ্ধতি তাঁরা উদ্ভাবন করেননি। তার ফলে মার্কস কথিত ‘antique world’—এ যেমন বণিকের মূলধন বৃদ্ধির ফলে ‘slave economy’—র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তেমনি বাংলা দেশেও ধনপতি সদাগরেরা ‘আত্মনির্ভর গ্রাম্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’কে বদ্ধমূল করেছিলেন। সেটা ভেঙে ফেলে নতুন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারেনি।

এই হল আমাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ হল, ধনসঞ্চয় (Saving) অর্থনৈতিক প্রগতির অনুকূল নয়। ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির জন্য যে সঞ্চয় করা হয় তার কোনও অর্থনৈতিক বা সামাজিক মূল্য নেই। যা উৎপাদনের জন্য বা ভোগের জন্য নিয়োগ বা ব্যয় করা হয়, সেই সঞ্চয়ের সামাজিক মূল্য আছে। আমাদের দেশে চিরকাল ব্যক্তিগত ধনসঞ্চয়ের দিকেই মানুষের লক্ষ্য বেশি। তাই চাঁদ সদাগরদের ‘সাত মরাই টাকাও’ দেশের জাতীয় সম্পদ বাড়াতে পারেনি।

তৃতীয় কারণ হল, লেনদেন মাধ্যম (Medium of Exchange) হিসেবে টাকাপয়সার বেশি প্রচলন ছিল না আমাদের দেশে। টাকাপয়সার অসম্ভব দুষ্প্রাপ্যতার (Scarcity) জন্য সুদের হার (Rate of Interest) ছিল অত্যন্ত বেশি। প্রাচীন হিন্দু যুগ থেকে ব্রিটিশ যুগ পর্যন্ত যদি আমাদের দেশের ‘সুদের হার’ যাচাই করে দেখা যায় তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। প্রাচীন হিন্দুধর্মশাস্ত্রে বিভিন্ন রকমের সুদের হার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাতে সুদের যে পরিমাণ হার দেখা যায় তা ভয়াবহ বললে অন্যায় হয় না। সুদের এই উৎকট হার ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আমাদের দেশে টাকাপয়সার দুষ্প্রাপ্যতার জন্য বজায় ছিল। তার জন্য মূলধন বিনিয়োগের বা উৎপাদনবৃদ্ধির কোনও প্রেরণাও উৎপাদক বা ব্যবসায়ীরা পাননি। বাণিজ্যের ফলে বাইরে থেকে প্রচুর পরিমাণে টাকাপয়সা (সোনা) আমাদের দেশে আমদানি হলেও, আমাদের নগদ সোনা বা টাকা সঞ্চয়ের বাসনা চিরকাল এত বেশি যে তার ফলে সমাজে টাকাপয়সারও দুষ্প্রাপ্যতা কোনওদিন কমেনি এবং সুদের হারও কমেনি। কিনস ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এই কথাটি অতি সুন্দরভাবে বলেছেন :

The history of India at all times has provided an example of a country improverished by a preference for liquidity amounting to so strong a passion that even an enormous and chronic influx of the precious metals has been insufficient to bring down the rate of interest to a level whch was compatible with the growth of real wealth.

ভারতের ক্ষেত্রে যা সত্য, বাংলার ক্ষেত্রেও তা মিথ্যা নয়। বাংলার ধনপতি ও চাঁদ সদাগরেরা যথেষ্ট ধনসঞ্চয় করেও তাই ইংরেজ আমলের আগে নতুন কোনও যুগের প্রবর্তন করতে পারেননি। তাঁদের ব্যক্তিগত সঞ্চিত ধন অনেকসময় অযোগ্য বংশধরদের বিলাসিতায় উবে গেছে। ইংরেজ আমলে তাঁরা ইংরেজ বণিক—শাসকদের কূটবুদ্ধিতে খুব সহজেই মধ্যবর্তী দালাল ও মধ্যশ্রেণির দোকানদারে বা আড়তদারে পরিণত হয়েছেন। যাঁরা কিছু দূর অগ্রসর হয়েছিলেন, কলকারখানার দিকে নজর দেবার আগেই ইংরেজরা তাঁদের নতুন জমিদারি কিনিয়ে নব্যযুগের জমিদারি করে দিয়েছেন। রঙ্গতামাসা ও বিলাসিতা করে আড়তদারি ও দালালির সঞ্চিত ধন তাঁরা ফুঁকে দিয়েছেন। তারপর দীর্ঘকাল ইংরেজ আমলে জমিদারি চালিয়ে বাঙালি বণিকদের জমিদারি প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠেছে। নতুন শিল্পোৎপাদনে মূলধন নিয়োগের দুঃসাহস বা সৎসাহস তাঁদের নেই। আজও সেকালের মহাজনি মনোভাব ও সুদের কারবার তাঁরা অনেকেই ছাড়তে পারেননি। আজও সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা সত্ত্বেও বাঙালি ধনিকরা হাড়েমজ্জায় ফিউডাল যুগের ধনিক, বুর্জোয়া যুগের ধনিক নন। বাঙালির জাতীয় অবনতির এ—ও একটা অন্যতম প্রধান কারণ। মর্মান্তিক ও করুণ হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই।

১৯৫২।

.

১. প্রথমে পশ্চিমবঙ্গে ও উত্তরবঙ্গে এবং পরে মধ্য ও পূর্ববঙ্গে আর্যদের প্রভাব ক্রমেই বাড়তে থাকে—’With the infiltration of Magadhan settlers, merchants, soldiers, officials and agriculturists, and Brahmanas, Sramanas and Yatis, to minister to the religious needs of the Brahmanists, Buddhists ad Jains and also to bring within the fold of Aryan or Upper Indian religion and culture the non-Aryan tirbes of the land. (History of Bengal, Dacca University, Vol. 1, p. 373)

২. R. D. Banerjee: The Age of Imperial Guptas, Ch. p, II

৩. R. C. Mazumdar : Subrnadwipa: Vol. 1, p. 7, Vol II. p. 350

৪. Takakusu’s I-tsing p. 31

৫. শ্রীসুকুমার সেন সম্পাদিত বিপ্রদাসের ‘মনসাবিজয়’ কাব্য এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। উদ্ধৃতি এই সংস্করণ থেকে নেওয়া।

 Vipradasas Manasa-Vijaya : Ed. by Dr. Sukumar Sen (Bibliotheca India Series) p. 142

৬. চৈতন্যভাগবত : অন্তখণ্ড, ৫ম অধ্যায়

৭. Karl Marx : Capital, Vol. III, p. 390

M. Dobb : Studies in the Development of Capitalism, Chaps. 2 & 3

৮. P. V. Dane : History of Dharmasastra. Vol. III, pp. 417-430

৯. J. M. Keynes : The General Theory of Employment, chap. 23, p. 337

অধ্যায় ১ / ২৫

সকল অধ্যায়

১. বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ
২. মার্কসবাদ ও মর্গানবাদ – বিনয় ঘোষ
৩. বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা – বিনয় ঘোষ
৪. গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ
৫. মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ
৬. শিবনাথ শাস্ত্রী – বিনয় ঘোষ
৭. সমাজপতি মহারাজা নবকৃষ্ণ – বিনয় ঘোষ
৮. ঠাকুর পরিবারের আদিপর্ব ও সেকালের সমাজ – বিনয় ঘোষ
৯. বিদ্যাসাগর-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১০. রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১১. বিবেকানন্দ-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১২. জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ
১৩. অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৪. সমাজবিজ্ঞানীর এ কোন শোচনীয় পরিণতি! – বিনয় ঘোষ
১৫. মেহনত ও প্রতিভা – বিনয় ঘোষ
১৬. দীবনন্ধু মিত্র বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও বাঙালি সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৭. বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদিপর্ব – বিনয় ঘোষ
১৮. তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ
১৯. সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ
২০. ‘গেট টু-গ্যাদার’ – বিনয় ঘোষ
২১. অর্থনীতির ভোজবাজি – বিনয় ঘোষ
২২. গৃহভৃত্যদের সামাজিক ভূমিকা – বিনয় ঘোষ
২৩. স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ
২৪. রামমোহন রায়ের জীবনচরিত – বিনয় ঘোষ
২৫. এক পুরুষের দুস্তর ব্যবধান – বিনয় ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন