সমাজবিজ্ঞানীর এ কোন শোচনীয় পরিণতি! – বিনয় ঘোষ

বিনয় ঘোষ

‘অটোমেটিক জীবন ও সমাজ’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার পর কমিউনিস্ট মহলে (তখন অবিভক্ত) বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কুড়ি বছর আগেকার কথা। কবি গোলাম কুদ্দুস সাহেব কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় উক্ত প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর প্রতিবাদে একটি প্রবন্ধ লেখেন (রবিবার, ১ চৈত্র ১৩৬৫)। কালের ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে গুরুত্ব আছে, মনে করে প্রতিবাদ—প্রবন্ধটি এখানে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হল।

—বি. ঘো.

সমাজবিজ্ঞানী শ্রীবিনয় ঘোষ ‘শনিবারের চিঠি’তে ‘অটোমেটিক জীবন ও সমাজ’ নামে যে প্রবন্ধ লিখেছেন তা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই দৃষ্টি আকর্ষণের প্রধান কারণ, শ্রীযুক্ত ঘোষকে লোকে ইতিপূর্বে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সমর্থক হিসাবে জানত, কিন্তু এই প্রবন্ধে সোবিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর প্রকাশ্য বিরোধিতার কথা জানিয়েছেন। এবং এই জানানোর মধ্যে তিনি বিন্দুমাত্র অস্পষ্টতার অবকাশ রাখেননি। একদিক দিয়ে তিনি ভালোই করেছেন। কেননা তিনি যে তাঁর এতদিনের পথ—পরিবর্তন করেছেন সে সম্পর্কে অতঃপর লোকের মনেও কোনও অস্পষ্টতা থাকবে না।

একজন সমাজবিজ্ঞানীর মনে অটোমেটিক বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র এবং জীবন ও সমাজে তার প্রভাব সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা জাগা খুবই স্বাভাবিক। আজ যখন যন্ত্রযুগের নতুন এক পর্যায়ের সূচনা হচ্ছে তখন এইরকম অনুসন্ধিৎসা সমাজবিজ্ঞানীদের মনে না জাগলেই বরং অস্বাভাবিক হত। আর সাধারণ মানুষও সমাজবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে নতুন যন্ত্রযুগের তাৎপর্যের গভীর ব্যাখ্যাই আশা করে।

কিন্তু শ্রীবিনয় ঘোষ কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন? তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে :

স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র মানুষকে যন্ত্রের ক্রীড়নকে পরিণত করেছে। ফলে মানুষের বুদ্ধির ভিত পর্যন্ত আজ কেঁপে উঠেছে। ধনতান্ত্রিক জগতে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র একদিকে বিরাটসংখ্যক মানুষকে বেকার করে এবং অন্যদিকে বিপুল পণ্য সৃষ্টির দ্বারা বাজারের সংকট সৃষ্টি করে আজ এক অন্ধগলিতে প্রবেশ করেছে। এর একমাত্র সমাধান ছিল সমাজতন্ত্র। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিও যন্ত্রের খপ্পরে পড়েছে। সেখানে সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম যান্ত্রিক উৎকর্ষসাধনে সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। কাজেই সমাজতান্ত্রিক দেশেও মানুষ যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। সেখানকার পার্টিও যন্ত্রেরই এক প্রতিচ্ছবি। সেই পার্টিযন্ত্রের নাটবল্টুতে পরিণত হয়েছে মানুষ। অটোমেটিক যুগে মানুষ হবে outsider—নিজের সমাজে নিজের পরিবারে ও জীবনে অজ্ঞাতকুলশীলের মতো।

এই ব্যাখ্যার জন্য বিজ্ঞানের আশ্রয় না নিলেও চলত। স্বয়ং অজ্ঞতার আশ্রয় গ্রহণ করলেই ভালো হত। কারণ যন্ত্রযুগের ইতিহাসের একটা অতি মামুলি ঘটনা হল এই যে, ইংলন্ডে যন্ত্রযুগের প্রথমদিকে অতি নিষ্পেষিত অজ্ঞ শ্রমিকদেরও ধারণা হয়েছিল, যন্ত্র যত নষ্টের গোড়া। তারা দল বেঁধে যন্ত্র ভাঙতে গিয়েছিল। আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল বহু কারখানায়। তারপর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মোটামুটি বুঝতে শুরু করে। বঞ্চনার জন্য দায়ী নয়, দায়ী ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং মালিকশ্রেণি। আর প্রতিকারের উপায় তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সংগ্রাম। এই যন্ত্রকেই একবার যদি মুনাফা শিকারের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে পারা যায় তাহলে সে হবে মানুষের পরম আজ্ঞাবহ দাস। তখন যন্ত্রের যতই উন্নতিবিধান হবে, মানুষের হাড়ভাঙা খাটুনিও ততই কমবে, আয়ও ততই বাড়বে, অবসরও মিলবে ততই বেশি এবং শিক্ষা—সংস্কৃতির সুযোগও সৃষ্টি হবে সেই অনুপাতে। আজ সোবিয়েৎ ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে আমরা সেই প্রক্রিয়াই দেখতে পাচ্ছি। যন্ত্রের উৎকর্ষের মাধ্যমে শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি সেখানে কমিউনিজমের বৈষয়িক ভিত্তি তৈরি হচ্ছে। এত অদূর ভবিষ্যতে মানুষ সেখানে ইচ্ছামতো খাটবে, প্রয়োজনমত জিনিসপত্র পাবে। মানুষের সেই পরম মুক্তির দিন আজ আর সোবিয়েত ইউনিয়নে শুধু আরাধ্য বস্তু নয়। আজ সপ্তবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তা বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে।

এই অবস্থায় একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসাবে শ্রীবিনয় ঘোষের কি উচিত ছিল না মানুষের এই পরম মঙ্গলময় জয়যাত্রাকে স্বাগত করা? তাঁর কি কর্তব্য ছিল না সমাজতান্ত্রিক দেশের বিজ্ঞান এবং যন্ত্রের অগ্রগতি দ্বারা মানবতা বিরোধী মুনাফাশিকারী সাম্রাজ্যবাদীদের চরম পতনের দিন কীভাবে ঘনিয়ে আসছে তা ব্যাখ্যা করা? কিন্তু তিনি উলটে দেখছেন, ‘প্রতিযোগিতা চলেছে শ্রেষ্ঠ ধনতান্ত্রিক দেশের টেকনোলজির সঙ্গে শ্রেষ্ঠ সমাজতান্ত্রিক দেশের টেকনোলজির। অর্থাৎ নিছক যন্ত্রের প্রতিযোগিতা।’

প্রতিযোগিতাটা যে নিছক যন্ত্রে যন্ত্রে নয়, প্রতিযোগিতা যে চলেছে দুই সমাজব্যবস্থার মধ্যে, তা আজকাল প্রতিপক্ষের অনেক লোকের পর্যন্ত চোখ এড়ায় না। অথচ বিনয়বাবুর মতো সমাজবিজ্ঞনীর চোখে পড়ছে না, এটাই আশ্চর্য। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অবশ্য বিনয়বাবু বলতে পারেন, আমি তো ধনতান্ত্রিক দেশের পক্ষও সমর্থন করিনি, আমি তো দুই পক্ষকেই যন্ত্রসর্বস্বতার জন্য গালাগালি দিয়েছি! এমনকী আমি এ কথাও বলেছি যে, অটোমেটিক যন্ত্রের কল্যাণেই ধনতন্ত্রের সমাজতন্ত্রে রূপান্তরঅবশ্যম্ভাবী। সেই সঙ্গে শুধু আমি এইটুকু মাত্র বলতে চেয়েছি যে সমাজতন্ত্রের রাজত্বেও মানুষের বদলে শাসন করবে যন্ত্র! এবং মানুষ নিজেই পরিণত হবে অটোমেটিক যন্ত্রে। অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের সংগ্রামেও মানুষের প্রকৃত মুক্তি নেই। শেষ পর্যন্ত সব ঝুটা হ্যায়। এত বড় সিনিসিজম এবং মানব—বিদ্বেষ কি কল্পনা করা যায়!

বিনয়বাবুর মতো সমাজবিজ্ঞানীর জানা আছে কি না জানি না, আজকের জগতে যখন সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রা উদ্দাম হয়ে উঠেছে তখন সাম্রাজ্যবাদী প্রচারকরাও অনেক সময় সরাসরি তার বিরুদ্ধতা করে তেমন ফল পাচ্ছে না। তাদেরও ঘুরিয়ে কথা বলতে হচ্ছে, প্রচার চালাতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’—এর পাগলা মেহের আলীর মতো তাদেরও মাঝে মাঝে চিৎকার করতে হচ্ছে, ‘সব ঝুটা হ্যায়’।

সবই যদি ঝুটা হয় তাহলে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে আর কী এমন লাভ! পাগলা মেহের আলীর কাছে যা ছিল পাগলামি, ধনতন্ত্রের স্তাবকদের কাছে তা কূটকৌশল।

দ্বিতীয়ত, সমাজবিজ্ঞানী বিনয়বাবু হয়ত এ কথাও ভুলে গিয়েছেন যে, অটোমেটিক যন্ত্রের কল্যাণেই ধনতন্ত্রের সমাজতন্ত্রে রূপান্তর হয় না। রূপান্তরের প্রধান হাতিয়ার শ্রেণিসংগ্রাম এবং শ্রমিকশ্রেণির পার্টি। অটোমেটিক যন্ত্রযুগের বহু আগেই বহু দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিনয়বাবুর প্রচারকৌশল তাঁর নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকেই ধরা পড়বে :

‘ধনতান্ত্রিক জগতের সঙ্গে সর্বাত্মক মারণাস্ত্রের ও অটোমেটিক যন্ত্রের প্রতিযোগিতা চলেছে সমাজতন্ত্রের নামে।’

তাঁর একবার মনে হল না মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধের জন্য সোবিয়েত ইউনিয়নের কী আপ্রাণ চেষ্টাই না চলেছে। তাঁর একবারও মনে হল না যেখানে ধনতন্ত্র নেই, মুনাফার প্রশ্ন নেই এবং বাজারের সমস্যা নেই সেখানে মারণাস্ত্রের এবং যুদ্ধেরও প্রয়োজন হয় না। তিনি একবারও ভেবে দেখবেন না সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে পারমাণবিক এবং হাইড্রোজেন অস্ত্র এবং আন্তর্মহাদেশীয় রকেট আজ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের সংযত হতে বাধ্য করেছে। তাঁর কাছে যুদ্ধাস্ত্র যার হাতেই থাকুক, সেটা মূল্যমূল্য। এইরকম অন্ধতা কি মানবতার পরিপোষক? অথবা, এই অন্ধতা স্বেচ্ছাকৃত?

আমি জানি হাঙ্গেরি, স্তালিন প্রভৃতি ঘটনা নিয়ে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কার কার মনে নানা ব্যাপারে কিছু সন্দেহ এবং দ্বিধার সৃষ্টি হয়। সেটা কতটা সঙ্গত বা অসংগত সে বিচার এখানে করতে বসিনি। কিন্তু এ—ও জানি সোভিয়েত ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির প্রতি প্রকাশ্য শত্রুতামূলক মনোভাব প্রকাশ বা নগ্ন কুৎসা প্রচার, আর ওই সব দেশের নানা প্রশ্নে মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব এ দুয়ের মধ্যেকার পার্থক্য অনেকখানি। কিন্তু বিনয়বাবুর প্রবন্ধ পড়ে মনে হল, তাঁর মনে সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের নিরসন ঘটেছে, তিনি আর সন্দেহের দোলায় দুলছেন না, তিনি ভেবেচিন্তে এখন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছেছেন।

সোবিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে তিনি অতি স্বচ্ছন্দে লিখছেন, ‘জীবনের কী আছে সেখানে? ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী—র, পিতার সঙ্গে পুত্রের, প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের সমস্ত স্বাভাবিক ও মানবিক সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে সেখানে এবং সকলেই রাষ্ট্রযন্ত্র এবং পার্টিযন্ত্রের গুপ্তচর হয়ে এক অভিশপ্ত চক্রান্তের পাতালপুরীতে বাস করছেন।’

বিনয়বাবু যাকে বলে Categorical বা স্থিরনিশ্চয়, তা—ই হয়েছেন। তিনি একটা ‘পজিশন’ নিয়েছেন। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির প্রতি গভীর শত্রুতামূলক আচরণের ইচ্ছা থাকলেই তবে এরকম ভাষা কেউ প্রয়োগ করতে পারেন। কারণ আমরা যারা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হাড়ে হাড়ে চিনেছি, তারাও কেউ কখনো বলি না এই নিষ্ঠুর বর্বর ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও ‘স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী—র, পিতার সঙ্গে পুত্রের, প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের সমস্ত স্বাভাবিক ও মানবিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।’ সমস্ত স্বাভাবিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হলে সমাজ কখনো সমাজ থাকে না। বুর্জোয়ারা সমস্ত মানবিক সম্পর্ককে ‘টাকার সম্বন্ধ’ বা cash naxus—এ দাঁড় করায়। তবু মানুষের গৌরব এই যে, এই দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও মানবিক সম্পর্ক নিঃশেষ হতে চায় না, মানুষ একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। আর মানুষের সচেতন অংশের মধ্যে এই মানবধর্মই শ্রেণিসংগ্রামের রূপ নেয়। অবশেষে একদিন এই মানবিক সম্পর্কই এমন শক্তি সঞ্চয় করে যে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার বিরূদ্ধে সে চরম আঘাত হানে। মানবতা যেখান ধূল্যবলুণ্ঠিত সেই বুর্জোয়া সমাজেও মানবিক সম্পর্কের রূপ যদি এই হয় তাহলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তার কী উজ্জ্বল মহান রূপ উদ্ভাসিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী তা সহজেই অনুমেয়। অথচ আমাদের সমাজবিজ্ঞানীর ধারণা কী? সমাজতান্ত্রিক দেশ—যেখানে শোষণ নেই, প্রতিযোগিতা নেই, মুনাফার বেদিতলে মানবতাকে প্রতিদিন বলি দিতে হয় না এবং যেখানে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করতেও হয় না, সেখানে ‘সকল মানবিক সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে’ এবং সকলে ‘অভিশপ্ত চক্রান্তের পাতালপুরীতে বাস করছে।’ এই কথা আমদের বিশ্বাস করতে হবে। একজন সমাজবিজ্ঞানীর পক্ষে এই অপচেষ্টা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি কঠোর শত্রুতাসাধন ছাড়া আর কী? কিন্তু মজার ব্যাপার, আমাদের এই সমাজবিজ্ঞানী সোবিয়েত পারিবারিক জীবনের এই ভাঙ্গনের চিত্র সংগ্রহ করেছেন ‘ডাঃ জিভাগো’ নামক উপন্যাস থেকে। আমাদের স্বদেশের এবং অন্যান্য দেশের বহু খ্যাত ও অখ্যাত মানুষ সোবিয়েৎ ভ্রমণ করেছেন, তাঁদের তথ্যাদির উপর ভিত্তি করলে হয়তো সমাজবিজ্ঞানের কিছুটা স্বধর্মরক্ষা করা হত এবং ইজ্জতও বাঁচত। কিন্তু আমাদের এই সমাজবিজ্ঞানীর শক্ত খুঁটি হচ্ছে একখানা কল্পনামূলক রচনা—আবার সেটিও সোবিয়েত সমাজব্যবস্থা—বিরোধী মনোভাবের দ্বারা আচ্ছন্ন একজন শিল্পীর ব্যর্থ মনের কল্পনা।

আমাদের এই সমাজবিজ্ঞানীর কি অজানা আছে সোবিয়েত ইউনিয়নের কোন পরিবারে শিশু জন্মালে তার দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে এবং বহু শিশু জন্মালে সেই অনুসারে ভাতাও বেশি বাড়ে, এমনকী বহু সন্তানের জননীকে ‘বীর প্রসবিনী’ উপাধি এবং অর্থ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়? তাঁর কি এটাও জানা নেই যে, সেখানে বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধাদের প্রত্যেকের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা আছে এবং সাতসালা পরিকল্পনায় এই হার মাথাপিছু এক’শ থেকে দেড়শো রুবল আরও বাড়ানোর আয়োজন হচ্ছে? শিশু এবং বৃদ্ধের এমন ব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক দেশের কোথায় আছে? যেখানে বাড়িতে বেকার ভাই বসে থাকে না, যেখানে স্বামী—স্ত্রী সংসারে আয় এবং ব্যয়ের অধিকার সমানভাবে বহন করে, শিশু এবং বৃদ্ধের ভার যেখানে রাষ্ট্র নিয়েছে, লোভ এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা যেখানে অনুপস্থিত, সেখানে পারিবারিক ভাঙন না—আসাই তো স্বাভাবিক। সম্প্রতিকালে অত্যন্ত কমিউনিস্ট—বিরোধী মানুষও যারা সোবিয়েত ভ্রমণ করে এসেছেন তাঁরাও কেউই এ কথা বলেননি, যে সোবিয়েত পরিবারে ভাঙন শুরু হয়েছে। বরং অনেকে এই সাক্ষ্যই দিয়েছেন যে, পারিবারিক সম্পর্ক সেখানে আর উন্নত স্তরে পৌঁছেছে। একমাত্র মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ডালেস এবং এঁর সমগোত্রীয়ের লোক ছাড়া সোবিয়েত পারিবারিক জীবনের এই কুৎসা প্রচার কারও মুখে শুনিনি। সমাজবিজ্ঞানী হয়ে কি বিনয়বাবুর উচিত তাঁদের ভাষ্যকেই নিজের ভাষ্য বলে প্রচার করা? তাঁর কি বোঝা উচিত ছিল না, শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত ধনতান্ত্রিক সমাজেও দুই—একটা ভালো জিনিস ঘটতে পারে, কিন্তু তা দিয়ে যেমন ধনতান্ত্রিক সমাজের সামগ্রিক কদর্যতা ঢাকা পড়ে না, ঠিক তেমনি সমাজতান্ত্রিক সমাজেও দুই—একটা খারাপ জিনিস ঘটতে পারে, কিন্তু তা দিয়ে সে সমাজের সামগ্রিক মানবিকতার চিত্র দেখতে না—পাওয়া অবৈজ্ঞানিক। বরংযতই দিন যাচ্ছে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বর্বর অতীতের রেশ ততই কাটিয়ে উঠছে। আর ধনতান্ত্রিক সমাজ যতই দিন যাচ্ছে ততই আরও গ্লানি এবং কদর্যতায় ভরে উঠছে। নিজের দেশ ভারতের চিত্র সামনে রেখেও একজন সমাজবিজ্ঞানীর কি এই সত্য অনুধাবন করতে পারা উচিত ছিল না?

অথচ কী গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গেই না আমাদের এই সমাজবিজ্ঞানী সোবিয়েতের কুৎসায় মেতেছেন। কীরকম অবিশ্বাস্য অসত্যের বিষবাষ্প তিনি ছড়িয়েছেন লক্ষ করুন :

‘প্রায় অর্ধশতাব্দীর সোশ্যালিজমের পরীক্ষার পরে যে সমাজ ও সভ্যতার চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি তার নতুনত্ব কোথায়? আকাশ বিদীর্ণ করে মানুষের কত স্লোগান, কত লড়াইয়ের আওয়াজ, বুকফাটা আওয়াজের মতো শহরে—বাজারে ধ্বনিত হয়েছে, হাজার হাজার মাইকে প্রতিধ্বনিত হয়ে কত ছোট—বড়—মাঝারি নেতার কত কোটি কোটি গালভরা কথা ঘুমপাড়ানি গানের মতো সাধারণ মানুষকে স্বপ্নের কোলে ঘুম পাড়িয়েছে, উৎসাহিত করেছে তাদের দলে দলে মৃত্যুবরণ করতে। কিন্তু তার বিনিময়ে তারা পেয়েছে কী? তারা পেয়েছে এমন একটা সমাজ যেখানে বড় বড় যন্ত্র চলছে, বিকটাকার সব মহাযন্ত্র, অটোমেটিক যন্ত্র, যেখানে স্পুৎনিক উড়ছে চন্দ্রলোকে—কিন্তু যেখানে মানুষের সনাতন শঠতা, দীনতা ও লোলুপতার খেলা শেষ হয়নি, যেখানে নিষ্ঠুরতা আকাশ ফুঁড়ে উঠেছে স্পুৎনিকের মতো, যেখানে অটোমেটিক যন্ত্রের মতো দেবতুল্য নেতারা রাতারাতি দানবতুল্য হয়ে যায় এবং কালকের নরকের কীট আজকেই চতুর্দোলায় চড়ে লক্ষ লক্ষ লোকের শোভাযাত্রার ঢেউয়ে হেলেদুলে চলে বেড়ায়, যেখানে বন্দি মানুষের লক্ষ বছরের স্বপ্ন, স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও বাকশক্তি স্ফূর্তির স্বপ্ন ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছে …’

সমাজবিজ্ঞানী বিনয়বাবু নামের মধ্যে বিনয় থাকলেও ভাষার মধ্যে তার চিহ্নমাত্র নেই। স্তালিনের শেষজীবনের কয়েকটি গুরুতর ত্রুটির সমালোচনা দেখেই বোধহয় তিনি বৈজ্ঞানিক স্থৈর্য হারিয়ে বলছেন, ‘দেবতুল্য নেতারা রাতারাতি দানবতুল্য হয়ে যায়।’ কিন্তু ‘কালকের নরকের কীট’ তিনি কাকে বলছেন এবং কেন বলছেন? নিছক বলগাহীন উষ্মা প্রকাশ ছাড়া একে কী বলব? সমাজবিজ্ঞানীর ভাষা একটু সংযত হবে বলেই তো লোকে আশা করে। অথচ বিনয়বাবু কী পরিমাণে খেপে গিয়েছেন দেখুন : ‘এত স্লোগান, এত মেঠো বক্তৃতা, এত বেতার প্রেসের প্রচার ও পোস্টার, গোলগাল নাদুসনুদুস মোলায়েম বুলির এত বিপুল বন্যা, এত শহিদের শোণিতসমুদ্র, এত স্ট্যাটিসটিসের ভেলকি, এত ”ইডিয়োলজি”র অ্যালকোহল পানের পর, রাম—রাবণের এত প্রলয়ংকর যুদ্ধের শেষে—অবসন্ন মানুষ চোখ মেলে দেখছে যে আজও সে সোনালি আদর্শের স্বর্ণমৃগের পশ্চাদ্ধাবন করছে, সমাজের দুশমন রাবণদের বধ করা সম্ভব হয়নি, এবং সাম্যের রামরাজ্যও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তার সমস্যা আদিকালে যা ছিল, আজও তা—ই আছে, কেবল তার বাইরের আবরণটা বদলেছে মাত্র।’

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, একজন সমাজবিজ্ঞানীর মুখে শুনতে হল, ‘মানুষের সমস্যা আদিকালে যা ছিল, এখনও তা—ই আছে।’ আমরা এতদিন জানতাম পরিবর্তনশীল কাল এবং পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ক্রিয়াকর্ম এবং সমাজকে বিচার করাই সমাজবিজ্ঞানের একটা মূল আদর্শ এবং পদ্ধতি। কিন্তু এখন দেখছি ‘মানুষের সমস্যা আদিকালে যা ছিল, এখনও তা—ই আছে।’ এ তো শুধু বিপ্লবী মনোভাব পরিত্যাগ নয়, প্রকৃতি ও সমাজ বিচারের ডারউইন প্রবর্তিত ক্রমবিকাশের তত্ত্বকেও পরিহার। মনে হচ্ছে, আমাদের সমাজবিজ্ঞানীর কাছে সবই—অনড়, অচল। চরম পরিহাসের কথা এই যে, চার্লস ডারউইনের শতবার্ষিকী মাত্র কিছুদিন আগে সারা পৃথিবীতে পালিত হয়েছে। বৃদ্ধ আজ কবর থেকে উঠে এলে তরুণ সমাজবিজ্ঞানীকে কী বলতেন? আমাদের এই সমাজবিজ্ঞনী আর—এক জায়গায় লিখছেন, ‘মানুষের মন এক ইঞ্চিও উন্নত হয়নি, মানুষের বোধশক্তি এক কাঁচ্চাও বাড়েনি।’ কিংবা আর এক জায়গায় এই সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, ‘অপরাধটা বিজ্ঞানের নয়, বিজ্ঞানীর নয়, যন্ত্রের নয়, যন্ত্রীরও নয়—অপরাধ মানুষের স্বভাবের ও প্রকৃতির। সমস্যা বিজ্ঞান বা যন্ত্রের নয়—সনাতন মানুষের।’

আমাদের এই সমাজবিজ্ঞানী ‘সনাতন মানুষে’ যখন পৌঁছে গিয়েছেন তখন তিনি প্রায় ক্যাথলিক ধর্মের ‘আদিম পাপ’—এর সন্ধানে বেরিয়েছেন মনে হয়। একে বৈজ্ঞানিক মনোভাবের চেয়ে ধর্মীয় মনোভাব বলাই বেশি সমীচীন।

শ্রীবিনয় ঘোষ একটু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি গ্রহণ করলেই দেখতে পেতেন সোবিয়েৎ ইউনিয়নের সপ্তবার্ষিকী পরিকল্পনার যান্ত্রিক অগ্রগতির কী গভীর মানবিক তাৎপর্য। আমাদের ভারতের মতো অনুন্নত দেশের কথাই ধরা যাক। সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দেশে যন্ত্রবিপ্লবে বাধা দিয়ে কত মহামারি দুর্ভিক্ষ এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং অজ্ঞতা চিরস্থায়ী করে রাখতে চেষ্টা করেছে তা কি আমাদের অজানা? আজও ভারতকে কাঁচামালের বাজারে পরিণত করার সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টা কি লোপ পেয়েছে? কত বাধা ঠেলে ঠেলে একটু একটু করে শিল্পোন্নতি আমরা করেছি তার ইতিহাস আমাদের কাছে একেবারেই চলতি ইতিহাস। আর আজ এ—ও আমরা দেখছি যে, সমাজতন্ত্রের পথে এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির পূর্ণ সহেযোগিতাতেই একমাত্র আমরা ভারতে দ্রুত অগ্রসর হতে পারি। ভারতে আজ যে মনুষ্যত্ব বিফল প্রয়াসের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তারও পূর্ণ বিকাশের পথ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অভিজ্ঞতা ও আদর্শের দ্বারাই অনুপ্রাণিত হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সোবিয়েতের সাতসালা পরিকল্পনা এবং যন্ত্রবিদ্যায় তার অগ্রগতি আমাদের কাছে পরম আশ্বাসের বাণী বহন করেই নিয়ে আসছে। আর শুধু আমাদের কাছেই নয়, এই পরিকল্পনা সমগ্র পৃথিবীর অনুন্নত দেশের নিরন্ন বুভুক্ষু নিষ্পেষিত মানুষের কাছেই মুক্তির ইশারা এবং ভরসা জোগাচ্ছে।

সাম্রাজ্যবাদ তাতে প্রমাদ গনছে। তাদের লুণ্ঠনের কাল শেষ হয়ে আসছে। তাই তারা মরিয়া হয়ে পাচার করছে, সোবিয়েত সাহায্য এবং যন্ত্রপাতি স্বাধীন দেশকে পরাধীন করার অথবা সেখানে কমিউনিজম ছড়ানোর চক্রান্ত, কিংবা মানুষের ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’ অপহরণের কৌশল। দুঃখের বিষয় সমাজবিজ্ঞানী শ্রীবিনয় ঘোষও তাঁর রচনায় সাম্রাজ্যবাদী প্রচারের সুরেই সুর মিলিয়েছেন। আমাদের সমাজ এবং আমাদের বিজ্ঞান উভয়ের পক্ষেই এটা ক্ষতিকর। ভালুকের হাতে খোন্তা তুলে দেওয়া যেমন অন্যায়, তেমনি এরকম সমাজবিজ্ঞানীর প্রতি বিশ্বাস ন্যস্ত রাখাও মারাত্মক।

আমি শুধু স্তম্ভিত বিস্ময় ও বেদনার সঙ্গে ভাবছি, শ্রীবিনয় ঘোষ যিনি একদা ‘সোবিয়েত ও মধ্য এশিয়া’ লিখেছিলেন, তাঁর এই হঠাৎ মত পরিবর্তনের পিছনে কী রহস্য এবং কী অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকতে পারে? তিনি নিজেই বরিস পাস্তেরনাকের নাম করে এক জায়গায় বলেছেন, ‘বর্তমান সমাজের মানুষের সতত দ্বৈত জীবনযাপনের যন্ত্রণার কথা তিনি (পাস্তেরনাক) উল্লেখ করেছেন। এই দ্বিখণ্ডিত সত্তার ঘাতপ্রতিঘাতে মানুষের দেহ ও মন দুই—ই তিলি তিলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।’

এই দ্বৈত জীবনযাপনের যন্ত্রণা’ কি তিনি নিজেও ভোগ করছেন? এবং ‘দ্বিখণ্ডিত সত্তার ঘাত প্রতিঘাতে দেহে ও মনে তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছেন?’

এতদিন তিনি কমিউনিস্ট—বিরোধী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বোধহয় ‘অখণ্ড সত্তা’ ফিরে পেলেন।

সকল অধ্যায়

১. বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ
২. মার্কসবাদ ও মর্গানবাদ – বিনয় ঘোষ
৩. বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা – বিনয় ঘোষ
৪. গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ
৫. মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ
৬. শিবনাথ শাস্ত্রী – বিনয় ঘোষ
৭. সমাজপতি মহারাজা নবকৃষ্ণ – বিনয় ঘোষ
৮. ঠাকুর পরিবারের আদিপর্ব ও সেকালের সমাজ – বিনয় ঘোষ
৯. বিদ্যাসাগর-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১০. রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১১. বিবেকানন্দ-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১২. জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ
১৩. অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৪. সমাজবিজ্ঞানীর এ কোন শোচনীয় পরিণতি! – বিনয় ঘোষ
১৫. মেহনত ও প্রতিভা – বিনয় ঘোষ
১৬. দীবনন্ধু মিত্র বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও বাঙালি সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৭. বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদিপর্ব – বিনয় ঘোষ
১৮. তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ
১৯. সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ
২০. ‘গেট টু-গ্যাদার’ – বিনয় ঘোষ
২১. অর্থনীতির ভোজবাজি – বিনয় ঘোষ
২২. গৃহভৃত্যদের সামাজিক ভূমিকা – বিনয় ঘোষ
২৩. স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ
২৪. রামমোহন রায়ের জীবনচরিত – বিনয় ঘোষ
২৫. এক পুরুষের দুস্তর ব্যবধান – বিনয় ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন