তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ

বিনয় ঘোষ

তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ

বাংলা দেশের প্রাচীনতম ভূভাগ রাঢ় অঞ্চল। রাঢ়ের মাটি গঙ্গার পলিমাটির চেয়েও প্রাচীন। রাঢ়ের নিসর্গ রূঢ়। রূঢ়তার কন্দরে অফুরন্ত প্রাণপ্রবাহের নির্ঝর, উদ্দাম ও গতিশীল। রূঢ়তার বহিরাবরণ ভেদ করে তবে এই নির্ঝরের উচ্ছ্বাসকেন্দ্রে পৌঁছোতে হয়। রাঙামাটি কাঁকর—বালি আর ঝামাপাথরের মধ্যে—মধ্যে সবুজের স্নিগ্ধতা বিকীর্ণ। এই নিসর্গই জয়দেব—চণ্ডীদাসের মধুনিস্যন্দী কাব্যনির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ করেছে, তান্ত্রিক পীঠস্থানে বহু শাক্ত উপাসকের কঠোর শক্তিসাধনার মদিরা যুগিয়েছে এবং লোকায়ত সংস্কৃতির উষ্ণপ্রস্রবণটিকে যুগ যুগ ধরে সজীব করে রেখেছে। রাঢ়ের এই ঐতিহ্যের মধ্যে তারাশঙ্কর জন্মগ্রহণ করেছেন এবং লালিতপালিত হয়েছেন। রূপে ও গুণে, প্রকৃতিতে ও প্রতিভায় তিনি এই ঐতিহ্য সমগ্রভাবে বহন করে চলেছেন। শিল্পী তারাশঙ্করের বলিষ্ঠ জীবনবোধের সঙ্গে রাঢ়ের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের একটা আন্তরিক যোগসূত্র আছে। এই বলিষ্ঠতা রাঢ়ের গণদেবতার বলিষ্ঠতা, ডোম—বাগদি—বাউরি—কাহার—সাঁওতালদের রূঢ় অমার্জিত বলিষ্ঠতা। রঙ্গমঞ্চে জিমন্যাস্টের পেশিনৃত্যকেন্দ্রিক যে বলিষ্ঠতা ভাড়াটিয়া ব্যান্ডবাদ্যের তালেতালে তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে, তার সঙ্গে তারাশঙ্করের বনোয়ারি করালীর বলিষ্ঠতার কোনও সম্পর্ক নেই। শহুরে ড্রয়িং রুমের কৃত্রিম কাগজের ফুলের মতো শৌখিন রংবাহার সাহিত্য তারাশঙ্কর কদাচ রচনা করেননি, করবার মতো শক্তি ও সম্পদও তাঁর ছিল না।

তারাশঙ্করের স্খলন—পতন—ত্রুটি অনেক, তার মধ্যে এইটিই অন্যতম শৌখিন সাহিত্যরচনায় অক্ষমতা। তাঁর বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ এই যে তাঁর শিল্পরুচিবোধ স্থূল ও রুক্ষ, ভাষা অমার্জিত ও দীনহীন, প্রকাশভঙ্গি অতি সাধারণ আটপৌরে। কিন্তুযেটি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেইটিই তাঁর বড় গুণ। সাহিত্যের অঙ্গসজ্জা মনে হয় তাঁর কাছে অত্যন্ত গৌণ, মুখ্য হল সাহিত্যের প্রতিপাদ্য উপজীব্য। একজাতের সাহিত্যিক আছেন যাঁরা কারুশিল্পীর সগোত্র, ভাষার কারুকার্যই তঁদের প্রধান অবলম্বন। এই কারুকার্যমণ্ডিত ভাষার আভরণে সাহিত্য পরিবেশন করাকেই তাঁরা স্টাইলের চূড়ান্ত নিদর্শন বলে মনে করেন। কিন্তু শুধু স্টাইল বা ভাষা সাহিত্যের জীবনশক্তি নয়। অবশ্য অঙ্গসজ্জার মূল্য আছে সাহিত্যে, বিশেষ করে বাইরের রূপসজ্জার সঙ্গে যদি ভিতরের উপাদান—চরিত্রের বা সাহিত্যগুণের সাযুজ্য বজায় থাকে। এই সাযুজ্য, অর্থাৎ রূপ ও গুণের সমন্বয় একমাত্র বিরাট শিল্পপ্রতিভার দ্বারাই সম্ভব। সচরাচর তা ঘটে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাহিত্যরূপ ও সাহিত্যগুণের মধ্যে ব্যবধান থাকে। সাহিত্যের বেসাতি যাঁরা করেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই এই সমন্বয়ের পথ ছেড়ে দূরে চলে যান। কেউ সাহিত্যের রূপচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন, গুণ বা সারবস্তুর কথা ভুলে যান। কেউ সারবস্তুর সন্ধানে এত দূর নিবিষ্ট হয়ে থাকেন যে বহিরঙ্গবিলাসকে মনে করেন অসারতা মাত্র। প্রথম শ্রেণিকে বাকভঙ্গিসর্বস্ব ‘কারিগর’ বলা যায়, দ্বিতীয় শ্রেণিকে বাকপটুতার অভাব সত্ত্বেও ‘জীবনশিল্পী’র স্বীকৃতি দিতে হয়।

সাম্প্রতিককালের বাংলা সাহিত্যে এই জীবনশিল্পীর সম্মান ও স্বীকৃতি যাঁদের প্রাপ্য, তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে তারাশঙ্কর অগ্রগণ্য। তাঁর বাকপটুতা অনেকের তুলনায় দুর্বল, ভাষার জাদুকর তিনি নন, সূক্ষ্মকীট হীরকের মতো দ্যুতি তাঁর রচনা থেকে বিচ্ছুরিত হয় না, বিষয়বিন্যাস ও ঘটনাগ্রন্থন অনেক সময় তাঁর গাঢ়বদ্ধ সংহত নয়, অতিকথন ও অতিবর্ণন মধ্যে—মধ্যে ক্লান্তিকর মনে হয়, পরিমিতিবোধের অভাবের কথাও মনে পড়ে—সমালোচকদের এইসব উক্তির কিছুটা সত্য, কিছুটা অর্ধসত্য, কিছুটা অসত্য। কিন্তু সমস্ত সত্যাসত্যের উপরে যা শ্রেষ্ঠ সত্য তা হল এই যে এসব কোনও কারণেই তারাশঙ্করের শিল্পীসত্তার অখণ্ডতা খণ্ডিত হয়নি, অথবা তাঁর স্বাভাবিক বিকাশও ব্যাহত হয়নি। মানবজীবনের ষড়ৈশ্বর্যের সন্ধান যিনি পেয়েছেন, জীবনের পাথর—মাটি—বালুর স্তর ভেদ করে যিনি মানবতার রসলোকের গভীরে পর্যন্ত পৌঁছেছেন, মর্মে মর্মে যিনি জীবনের জঙ্গমতার স্পন্দন অনুভব করেছেন—দূর থেকে গজদন্ত—মিনারে বসে মানসচক্ষু বিস্ফারিত করে নয়, খুব কাছে থেকে পারিপার্শ্বিকের নিকটতম মানুষের জীবনের সঙ্গে পরমাত্মীয়ের মতো নিজের জীবন যোগ করে, কখনো খুদে জমিদারের মতো, কখনো বা ছন্নছাড়া যাযাবরের মতো, কিন্তু সর্বদাই শিল্পীসুলভ গভীর মমত্ব ও মর্মবেদনা নিয়ে—তাঁর কাছে বাক্যের বর্ণচ্ছটা অথবা ভঙ্গিমার কৃত্রিম বিলাস খুবই অকিঞ্চিৎকর মনে হওয়া স্বাভাবিক। হয়েছেও তা—ই। তা না হলে কৃত্রিম চটকদার পণ্যে তারাশঙ্কর তাঁর সাহিত্যের বজরা ভরে দিতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি, সাহিত্যক্ষেত্রে শৌখিন মজদুরি করা কোনওদিনই তাঁর কাম্য ছিল না। জীবনশিল্পী তারাশঙ্কর জীবনের কুটিল পথকেই নিজের কঠোর সাধনমার্গরূপে বেছে নিয়েছেন। ‘চৈতালি ঘূর্ণি’র মধ্যে এই জীবনপথে তাঁর যাত্রা শুরু, তারপর ‘পাষাণপুরী’, ‘আগুন’—এর ভিতর দিয়ে কালবৈশাখীর প্রমত্ত তাণ্ডব উত্তরণ, ক্ষণস্থায়ী কিন্তু রণঝংকারে ঝংকৃত, অতঃপর আষাঢ়ের গুরু গুরু মেঘগর্জনের সঙ্গে বর্ষণ শুরু ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘কালিন্দী’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’—এর মধ্যে, ‘কবি’র জীবনে আর ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’য় এবং অবশেষে আত্মসমাহিত শ্রাবণের একটানা অবিশ্রান্ত বর্ষণ ‘বিচারক’ ‘রাধা’, ‘পঞ্চপুত্তলী’তে। বর্ষণের শ্রান্তি নেই, শেষ নেই। শেষ আছে। যার শুরু আছে, তার শেষও আছে। জীবনের শেষ, বর্ষণেরও শেষ।

শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বর্ষণের মধ্যে তারাশঙ্করের জন্ম। শহর থেকে অনেক দূরে, সভ্যতার উপেক্ষিতা এক সাধারণ পল্লিগ্রাম লাভপুরে, রাঢ়ের হৃদপদ্মস্বরূপ বীরভূমে, তারাশঙ্করের বাল্যকাল, কৈশোর ও যৌবন কেটেছে। লাভপুরের পরিপার্শ্বে, রাঢ়ের সামগ্রিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে পরিপুষ্ট হয়েছে তারাশঙ্করের সাহিত্যপ্রতিভা। শহরের সঙ্গে পরবর্তীকালে তাঁর যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা জীবিকার তাগিদে। প্রাণের টান সারাজীবন তাঁর গ্রামের প্রতি, গ্রাম্য মানুষের প্রতি, গ্রাম্য সমাজের প্রতি। এই গ্রাম্য সমাজ তাঁর সাহিত্যের সুবিস্তীর্ণ ক্ষেত্র জুড়ে রয়েছে। প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের গ্রাম্য সমাজ। রাঢ়ের এই গ্রাম্য সমাজে তিনি যে শুধু জন্মেছেন তা নয়, তাঁর মানসিকতার বিকাশ হয়েছে এই সামাজিক প্রতিবেশে। তাই দেখা যায়, তারাশঙ্কর তাঁর সাহিত্যপ্রেরণার গঙ্গোত্রীর সন্ধান পেয়েছেন রাঢ়ের গণজীবনে ও গ্রাম্য প্রতিবেশে। প্রতিভার সঙ্গে প্রতিবেশের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ, গভীর না বাহ্য তা নিয়ে বহুকাল ধরে তর্কবিতর্ক হয়েছে। সেই পুরাতন বিতর্কের পর্বতস্তূপে নতুন কোনও উপলখণ্ড সংযোজন করার প্রচেষ্টা পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছু নয়। এ কথা সর্ববাদীসম্মত না হলেও, নিশ্চয় বিজ্ঞানসম্মত যে জীবনের প্রতিবেশ যে—কোনও ব্যক্তির প্রতিভা বা কর্মশক্তিকে অনেকখানি রূপায়িত করে। ‘প্রতিবেশ’ বলতে অবশ্য কেবল সামাজিক প্রতিবেশ বোঝায় না, পারিবারিক প্রতিবেশও বোঝায়। সামাজিক প্রতিবেশ থেকে যদিও ‘পরিবার’ বিযুক্ত নয়, তাহলেও এ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন এইজন্য যে পারিবারিক প্রতিবেশের সঙ্গেই ‘হেরিডিট’ বা বংশগতির প্রভাব সংযুক্ত। কাজেই সামাজিক প্রতিবেশের সমগ্রতা বিচার করলে তার মধ্যে পরিবার ও বংশগতির প্রভাবের কথাও এসে পড়ে। তারাশঙ্করের সাহিত্যের সামাজিক প্রতিবেশ বলতে এই অর্থেই আমরা বিচার করব।

এই সামাজিক প্রতিবেশের প্রাথমিক বৃত্তটি হল বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রাম, এবং সেই বৃত্তের মধ্যস্থ কেন্দ্রবিন্দু হল তারাশঙ্করের বংশ ও পরিবার। কুলীন ব্রাহ্মণদের অন্যতম কেন্দ্র পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর থেকে তারাশঙ্করের প্রপিতামহ লাভপুরে আসেন আনুমানিক ১২২৭ বঙ্গাব্দে, ইংরেজি ১৮১৯—২০ খ্রিস্টাব্দে। লাভপুরে তাঁদের ছ—পুরুষের বাস হল প্রায় দেড়শো বছর, এবং তারাশঙ্কর হলেন চতুর্থ পুরুষ। প্রপিতামহ কৌলীন্যের ব্যবসায়ী ছিলেন, এবং সেই সূত্রে লাভপুরে তাঁর আগমন ঘটে, বসবাসও পাকা হয়। পিতামহ—পিতা সকলেই ছিলেন গোঁড়া কুলীন ব্রাহ্মণ এবং সেকালের সমাজে কৌলীন্যের মর্যাদা ও সুযোগ একাধারে উপভোগ করেছেন। তারাশঙ্করের জন্ম ঊনবিংশ শতকের প্রান্তে ১৮৯৮ সালে লাভপুর গ্রামে। তখনও কৌলীন্যের প্রতিপত্তি সমাজে একরকম অক্ষুণ্ণ ছিল বলা চলে। কৌলীন্যের এই ঐতিহ্যের ভিতর থেকে তারাশঙ্কর দুটি জিনিস পেয়েছেন মনে হয়; একটি হল মানুষের সদগুণাবলির শ্রেষ্ঠতাবোধ, যাকে প্রকৃত কৌলীন্যবোধ বলে, এবং সেই শ্রেষ্ঠতার চৈতন্যজাত আভিজাত্যবোধ; অন্যটি হল প্রাচীন সামাজিক আদর্শকে অন্ধ শাস্ত্রানুগত্য দিয়ে গ্রহণ না করে সজাগ সুবিচার বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করার স্পৃহা। ‘কুলীনের মেয়ে’ গল্পে এবং আরও অনেক রচনায় তিনি কৌলীন্যের সমাজচিত্র এঁকেছেন, কিন্তু কোথাও তার বিকৃত রূপের প্রতি বেদনা প্রকাশ করেননি। মানবিক আত্মার অপমান ও লাঞ্ছনা তাঁকে ব্যথিত করেছে, তার বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ করেছেন। নিজের জীবনের এই বিকৃত কৌলীন্য তিনি বর্জন করেছেন এবং সাহিত্যজীবনে তার ভিতরকার মৃতপ্রায় সদগুণমহিমা ও উদারতা অনুশীলন করেছেন। তাই দেখা যায় সেকালের সমাজের ডাইনোসরের মতো অতিকায় জীব জমিদারদের অবশ্যম্ভাবী ঐতিহাসিক বিলুপ্তির জন্য তিনি যত—না বেদনা বোধ করেছেন, তার চেয়ে শতগুণ বেশি বেদনা অনুভব করেছেন সমাজের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও গ্রাম্য শিক্ষকদের জন্য। পণ্ডিত ন্যায়রত্নদের কথা বলতে বলতে গর্বে তাঁর বুক ফুলে উঠেছে, অভিমানে ও বেদনায় তিনি কাতর হয়েছেন। প্রাচীন বিলীয়মান ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও গ্রাম্যসমাজের প্রতি কোথাও যদি কোনও দুর্বলতা তাঁর মনের কোণে জাগরূক থাকে, একেবারেই নেই এমন কথা বলা যায় না, তাহলে সেই দুর্বলতা হল বিদ্যাকৌলীন্যের প্রতি, বর্ণকৌলীন্য বা বিত্তকৌলীন্যের প্রতি নয়। বিত্তসর্বস্ব সামাজিক ও মানবিক সম্পর্কের প্রতি তারাশঙ্করের বিবমিষা পূর্বাপর তাঁর জমিদার চরিত্র চিত্রায়ণের ভিতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। অবশ্য সেকালের জমিদারদের ঐশ্বর্যবিলাসের প্রতি মধ্যে মধ্যে তাঁর মোহবন্ধন ধরা পড়ে যায় বটে, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, সেই বন্ধন আসলে মানসিক ঐশ্বর্যের বন্ধন। অর্থাৎ সেকালের জমিদার—জায়গিরদারদের অন্তরের ঐশ্বর্যবিলাসের একটা জমকালো রাজকীয় রূপ ছিল। তারাশঙ্করের কল্পনায় এই রূপ অনেক গল্প—উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে এবং পাঠককে সন্তর্পণে তিনি এক রোমান্টিক পরিবেশে নিয়ে যেতে পেরেছেন। ‘রায়বাড়ি’র রাবণেশ্বর রায়, ‘জলসাঘর’—এর বিশ্বম্ভর রায় এবং এরকম আরও কিছু জমিদার চরিত্র তাঁর এই কল্পনারাজ্যের বিচিত্র সৃষ্টি। মানসিক ঐশ্বর্যের কল্পনা, বীর্য ও ঔদার্যের কল্পনা, কিন্তু বাস্তববিমুখ সামাজিক কল্পনা নয়। সমাজে সেদিন পর্যন্ত বিশ্বম্ভর রায়দের অস্তিত্ব ছিল, আজও যে একেবারে নেই তা নয়। একদা যে আভিজাত্যের সঙ্গে শৌর্যবীর্য ও ঔদার্যের বিচিত্র সংমিশণ ঘটেছিল, তার অমানুষিক বর্বরতার মধ্যেও ছিল অবিমিশ্র পৌরুষের দৃপ্ত প্রকাশ। তারাশঙ্করের যা কিছু কাল্পনিক বেদনা তা সবই এই উদারতা ও পৌরুষের প্রতি, নিষ্ঠুরতা বা অমানুষিকতার প্রতি নয়। এই আভিজাত্যের নিশ্চিত ধ্বংসের সঙ্গে তিনি দেখেছেন যে গ্রাম্য সমাজ থেকে পুরাতন পৌরুষ ও উদারতা দুইই অন্তর্ধান করছে এবং অসহায় গ্রাম্য সমাজ মানসিক দৈন্য ও ক্লীবত্বের পঙ্ককুণ্ডে ডুবে যাচ্ছে।

জীবনের প্রাথমিক বৃত্ত লাভপুরের গ্রাম্য সমাজে বসে তিনি সেকালের সামন্তযুগের এই অস্তাচলযাত্রা লক্ষ করেছেন। বৃত্তের কেন্দ্র থেকে, অর্থাৎ পরিবার থেকে পেয়েছেন কৌলীন্য ও জমিদারির আভিজাত্যবোধ, যে বোধ তাঁর উদার মানবিকতাবোধের সঙ্গে সাহিত্যজীবনে মিলিত হয়েছে। খুব বড় জমিদার বংশের তিনি নন এবং এ অঞ্চলে সেরকম বড় জমিদারের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। কিছু জমিজমা, কিছু প্রজা, কিছু মোসাহেব দাসদাসী অনুচর, পুকুর—বাগান, দেবমন্দির, আমলা, পোষ্য ইত্যাদি নিয়ে কয়েক পুরুষ ধরে জমিদারিচালে বাস করছেন, এরকম সম্পন্ন পরিবার বীরভূমে, এবং লাভপুর অঞ্চলেও অনেক দেখা যায়। অতিদ্রুত দুই—এক পুরুষের মধ্যে তাঁরা গ্রাম্য মধ্যবিত্তের স্তরে নেমে এসেছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের দারিদ্র্য আভিজাত্যের ধ্বংসস্তূপের ভিতর দিয়ে উৎকটরূপে প্রকাশ পেয়েছে, তবু তাঁরা ডুবন্ত লোকের মতো পুরাতন আওয়াজের তৃণখণ্ডটিকে আঁকড়ে ধরে সেই আভিজাত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন—এ দৃশ্য কিছুকাল আগেও লাভপুর ও তার পরিপার্শ্বে বিলক্ষণ দেখা গিয়েছে। তারাশঙ্কর এই মজ্জমান গ্রাম্য আভিজাত্যের ভাঙা তরির যাত্রী। একই তরিতে বহু সহযাত্রীর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়েছে। ‘সাড়ে সাত গন্ডার জমিদার’ তিনি বহু দেখেছেন তাঁর গ্রাম্য পরিবেশে। বড় বড় ডাইনোসরদের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারও দু—চারজন যে তিনি এই পরিবেশের মধ্যে না দেখেছেন তা নয়। মধ্যযুগের এইসব অতিকায়, এমনকী ক্ষুদ্রকায়ও, সামাজিক প্রভুদের প্রভাব—প্রতিপত্তি এ অঞ্চলে ‘রাজকীয়’ হবার একটা বড় কারণ হল রাঢ়ীয় জনসমাজের বিশিষ্ট গড়ন ও প্রকৃতি। সমাজের উপরতলার বড়—ছোট জমিদারদের সঙ্গে তারাশঙ্কর এই বিশিষ্ট রাঢ়ীয় জনসমাজের জীবনধারাও গভীর আবেগে অনুশীলন করেছেন। তারাশঙ্করের সমগ্র সাহিত্য রাঢ়ের এই বিস্তীর্ণ উপেক্ষিত জনসমাজের কলরবে মুখর। এই কলরব জীবনের স্বাভাবিক তাগিদে কোথাও উচ্ছ্বাস—ফেনায়িত, কোথাও বিক্ষুব্ধ ও উদ্দাম, কোথাও বা অসংযত।

রাঢ়ের জনসমাজ ও জনজীবদের প্রকৃত রূপ কী? লাভপুরের কথা বলি। নবাবি আমল থেকে ব্রাহ্মণ ‘সরকার’ বংশ গ্রামের জমিদার। এঁদেরই দৌহিত্র—বংশ দুটি করে প্রতিপত্তিশালী জমিদার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একটি তারাশঙ্করের পিতৃবংশ। আগেই বলেছি, এখনকার জমিদার যাঁরা তাঁদের আয় বেশি নয়, আয়তনও জমিদারির বৃহৎ নয়, কিন্তু সংখ্যায় তাঁরা প্রায় একটি গোষ্ঠী বা শ্রেণির তুল্য। এটা শুধু লাভপুর অঞ্চলের নয়, বীরভূম ও উত্তর রাঢ়েরই একটা অন্যতম সামাজিক বৈশিষ্ট্য। যাঁদের হাজার দশেক টাকা আয়ের জমিদারি আছে তাঁরা নিজেদের রাজা—গজা—নবাব—বাদশাহ মনে করেন। পঞ্চাশ থেকে পাঁচশো টাকা, হাজার টাকা বছরে আয় যাঁর তিনিও বুকে চাপড় মেরে বলেন ‘আমি জমিদার’। তাঁদের কথা হল ‘মাটি বাপের নয়, দাপের’। যার মাটি আছে তার দাপ বা দাপট আছে, আয়ের সঙ্গে দাপটের সম্পর্ক কী? এই হল এখানকার জমিদারদের চরিত্র। তার ফলে গ্রাম্য সমাজের দাপটের প্রতিযোগিতা হয়েছে উপরের স্তরে, সামাজিক স্টেটাসের দাপট এবং স্টেটাসের মূল হচ্ছে জন্ম ও মাটি, কুল ও জমিদারি। দুটি মূলই অনড় অচল। জন্মের পরিবর্তন হয় না, মাটিরও পরিবর্তন হয় না, যদিও জমিদারির পরিবর্তন হয়, মর্যাদার মানদণ্ডের পরিবর্তন হয়, এবং লাভপুর—বীরভূম তথা রাঢ়ের গ্রাম্য সমাজেও তা হয়েছে। নবাবি আমল অস্ত গিয়েছে, ব্রিটিশ বণিকরাজের আমলের অভ্যুদয় হয়েছে। কলের মালিক, কয়লাখনির মালিক, নতুন ইংরেজি বিদ্যার মালিক, এঁরা নবযুগের নতুন সামাজিক ইজ্জত, নতুন দাপটের শক্তি অর্জন করেছেন। পুরাতন মর্যাদা ও দাপটের মালিকদের সঙ্গে তাঁদের অবশ্যম্ভাবী বিরোধ বেধেছে। দাপটে আর বিরোধে গ্রাম্য সমাজ মন্থিত হয়ে কেবল বিষ উঠেছে, আর সেই বিষে জর্জরিত হয়েছে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।

সাধারণ মানুষের কথা পরে বলব। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার কথাও বলতে হবে। তার আগে গ্রাম্য সমাজের অন্য দু—একটি দিকের কথা বলব। লাভপুর গ্রামের পাশে ‘ঠাকুরপাড়া’, তারপর ‘পশ্চিমপাড়া’, ‘ব্যাপারীপাড়া’। ব্যাপারীপাড়ার পাশে গোগা, শেখপাড়া, একখানা গ্রাম ছাড়িয়ে পুরানো মহুগ্রাম বা মহাগ্রাম, কামারমাঠ, ফলগ্রাম। এগুলি সব মুসলমান প্রধান গ্রাম। ঘুরে ঘুরে কয়েকটি গ্রাম দেখলাম, মুসলমান মেয়েরাও ‘বাবা’ ‘বাছা’ বলে কথা বললেন, কোনও জড়তা নেই, দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। মুসলমান বলেও না, মেয়ে বলেও না। মিষ্টি কথাবার্তা পুরুষদেরও, উত্তর রাঢ়ের সুর ও টান কথাতে। ঠাকুরপাড়ার ঠাকুররা মুসলমান। যোগী বংশজাত বলে লোকে ‘ঠাকুর’ বলত, ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন। স্থানীয় মুসলমানদের ধর্মগুরু ছিলেন এঁরা। সম্রাট আলমগিরের তামার ছাড়পত্র এঁদের বাড়িতে ছিল। এখন বাড়ি বা বংশ কিছু নেই। মুসলমানদের বসতি অবশ্য এ অঞ্চলে যথেষ্ট আছে। হিন্দু—মুসলমানের প্রীতিবোধে কোনও কালো আঁচড় পড়েছে বলে মনে হল না। তারাশঙ্করের গৃহে প্রতিদিনই দেখলম মুষ্টিভিক্ষার্থীদের সমাগম হয় সকালে, প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ চাল আছে, তাদের মধ্যে সংখ্যায় মুসলমান মেয়ে—পুরুষেরা বেশি ছাড়া কম নয়। সকলের মধ্যে সম্পর্কের এমন একটা আন্তরিক হৃদ্যতা আছে, যা আজকের দিনে দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। মনে হয়, এখনও তাহলে এসব আছে!

আহমদপুর—কাটোয়া শাখা—রেলপথে যেমন ‘লাভপুর’ গ্রাম, তেমনি নলহাটি—আজিমগঞ্জ শাখা—রেলপথে লোহাপুর স্টেশনের পাশে ‘বারাগ্রাম’। মুসলমানদের প্রসঙ্গে উল্লেখ করছি। আঠারো মহল্লায় বিভক্ত গ্রাম। হিন্দুর সংখ্যা খুব অল্প, মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। এককালে বারাগ্রাম ছিল ব্রাহ্মণপ্রধান, এখন প্রায় ব্রাহ্মণশূন্য। প্রচুর মুসলমান পিরের সমাধি আছে এই গ্রামে। উত্তর রাঢ়ের এই অঞ্চলে গ্রাম্য সমাজের এই বৈশিষ্ট্য কৌতূহল উদ্রেক করে। পূর্ববঙ্গে ও উত্তরবঙ্গে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সংখ্যা যত বেশি, পশ্চিমবঙ্গে আদৌ তা নয়। প্রচণ্ড হিন্দুবিদ্বেষী বৌদ্ধ তন্ত্রের দুর্গস্বরূপ পূর্ববঙ্গে ও উত্তরবঙ্গে বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের, বিশেষ করে বজ্রযানীদের, তাই সহজে ইসলামধর্মে দীক্ষিত করা সম্ভব হয়েছে। উত্তর রাঢ়ের এই অঞ্চলেও দেখা যায় যে বৌদ্ধ তন্ত্রের বেশ প্রাদুর্ভাব ছিল, তাই এখানে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সংখ্যা কম নয়, সিউড়ি—রামপুরহাট অঞ্চলে যথেষ্ট বলা চলে। হিন্দু—মুসলমান সম্পর্কের মধ্যেও এ অঞ্চলে গভীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন দেখেছি। ধর্মীয় উৎসব—পার্বণের অনুষ্ঠানেও হিন্দু—মুসলমানের ভেদাভেদবোধ লক্ষ্য করিনি। নলহাটি হিন্দুদের পীঠস্থান, কিন্তু সেখানে ছোট টিলার উপরে পার্বতী (ললাটেশ্বরী—নলহাট্টেশ্বরী) মন্দিরের পাশেই দেখেছি মুসলমানদের পীরস্থান। হিন্দুর পীঠস্থান ও মুসলমানদের পিরস্থান পাশাপাশি বিরাজমান। এই রাঢ়ীয় গ্রাম্যসমাজের প্রতিচ্ছবিই লাভপুরে দেখা যায়। লাভপুরেও ফুল্লরাদেবী আছেন, খুব প্রাচীন না হলেও পীঠস্থান বলে খ্যাত। জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলেরই সমাগম হয় এখানে। ‘তারাপীঠ’ বিখ্যাত পীঠস্থান, বিশেষজ্ঞদের মতে নিঃসন্দেহে ‘তারা’ বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী। ‘তারা’ এই সমগ্র অঞ্চলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বলে মনে হয়। লাভপুরে ‘তারা মায়ের ডাঙা’ আছে এবং তারাশঙ্করের পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। ‘তারাশঙ্কর’ নামের সঙ্গে ‘তারা’র যোগ প্রত্যক্ষ। এখন আর বৌদ্ধ তন্ত্রে নয়, হিন্দু তন্ত্রের দেবী তারা, শক্তিসাধকদের আরাধ্যা।

এইবার রাঢ়ের বিশিষ্ট জনসমাজের সুবিস্তীর্ণ ভিত্তিভূমিতে পদার্পণ করা যাক। তারাশঙ্করের সাহিত্যের ভিত্তিভূমি এই রাঢ়ীয় জনসমাজ। সাহিত্যের সমালোচক আমি নই, অবিমিশ্র রসবিচারের দুরূহ কর্তব্য সমালোচকরা পালন করবেন। একজন বাঙালি পাঠক হিসেবে, বিশেষ করে রাঢ়ের বিচিত্র লোকসমাজ ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সুযোগের, আমার যা মনে হয়েছে তা—ই বলছি। পুনরাবৃত্তি করছি, তারাশঙ্করের সাহিত্যের মূলসত্তা ও আত্মার সন্ধান পাওয়া যায় রাঢ়ের লোকসমাজ ও লোকসংস্কৃতিতে। তাঁর সাহিত্যের প্রাণশক্তির প্রস্রবণ এই লোকসমাজের গিরিগহ্বর থেকে উৎক্রান্ত।

বাংলার রাঢ় অঞ্চল আদিবাসীপ্রধান। স্তরিত শিলার মতো রাঢ়ের লোকসংস্কৃতির স্তরেস্তরে আদিম কৌমসংস্কৃতির উপাদান, নানারূপে ও বিচিত্র বিন্যাসে গ্রথিত হয়ে রয়েছে। অতি প্রাচীন জনভূমি এই রূঢ় অঞ্চল। প্রাচীন জৈন—সূত্রগ্রন্থে এই ‘লাঢ়’ বা ‘রাঢ়’ দেশকে জনপথশূন্য বনভূমিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কথিত আছে, জৈন তীর্থংকর মহাবীর রাঢ়দেশে ধর্মপ্রচারোদ্দেশ্যে ভ্রমণকালে পদে পদে নাকি আদিম অসভ্য অধিবাসীদের সম্মুখীন হতেন এবং চু—চু করে তাঁর পশ্চাতে কুকুর লেলিয়ে দিত। বৌদ্ধ গ্রন্থেও এই ধরনের কাহিনি আছে। এইসব কাহিনির ইঙ্গিত স্পষ্ট। রাঢ় অঞ্চলে ছিল গভীর বিস্তীর্ণ অরণ্য আর তার মধ্যে মধ্যে ছিল আদিম জনসমাজ। যে সমাজ দীর্ঘকাল উন্নত হিন্দুসমাজ ও হিন্দু—সভ্যতার সংস্পর্কে আসেনি। এলেও খুব বেশি তার দ্বারা অভিভূত হয়নি। বীরভূমের ‘বীর’ কথা মুন্ডারি কথা, অর্থ হল ‘জঙ্গল’। প্রবল পরাক্রান্ত কোনও বীরের দেশ বলে বীরভূম নয়, জঙ্গলভূম অর্থে বীরভূম। উত্তর রাঢ়ের মল্লভূম বীরভূম ঝারিখণ্ড জঙ্গলমহল, সবই গভীর বনাকীর্ণ ছিল। আদি অসত্রাল বা নিষাদ ও দ্রাবিড় ভাষাভাষী দাসদস্যুদের বাস ছিল এই অঞ্চল থেকে সাঁওতাল পরগনা ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চল জুড়ে। উত্তরবঙ্গে যেমন কিরাত—সংস্কৃতির (ইন্দো—মোঙ্গলয়েড কালচার) সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটেছে, হিন্দু—সংস্কৃতির, পশ্চিমবঙ্গে বা রাঢ়দেশে তেমনি তার সঙ্গে মিলন—মিশ্রণ ঘটেছে নিষাদ—দাসসস্যু—সংস্কৃতির। এই সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছে রাঢ়ের উপেক্ষিত জনসমাজ—হাড়ি বাগদি বাউরি ডোম প্রভৃতি উপজাতি। এই কয়েকটি উপজাতির মোট জনসংখ্যা যা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আছে, তার প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ আছে রাঢ়ের তিনটি জেলা বর্ধমান বীরভূম বাঁকুড়ায়। বাংলা দেশে মোট প্রায় আট—নয় লক্ষ সাঁওতালের বাস, তার মধ্যে রাঢ়ের এই তিনটি জেলায় ও মেদিনীপুরে বাস করে শতকরা ৭৫ জন। বীরভূম—বাঁকুড়ার যে অঞ্চলেই যাওয়া যাক, সেখানেই দেখা যায় জনসমাজের এই বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ এদিককার যে গ্রাম্য সমাজ তার চেহারাই আলাদা। হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণের যথারীতি বাস আছে, মুসলমানরা তার পাশাপাশি আছে, আর আছে হাড়ি বাগদি বাউরি ডোম ও সাঁওতালরা। সংখ্যায় তারাই অধিকাংশ স্থানে বেশি। লাভপুর ছোট গ্রাম, তার মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। হাড়ি বাগদি কেওট ডোম বাউরিদের বাস লাভপুরে বেশি। এমনকী এ অঞ্চলে এক বাউরি রাজার গল্পও শোনা যায়। মুসলমানরা নাকি এই বাউরি রাজাকে জয় করেছিল। এরকম বাউরি—রাজা, বাগদি—রাজাদের গল্প রাঢ়ের অন্যান্য অঞ্চলেও আমি শুনেছি। এই রাজকাহিনিগুলি থেকে অন্তত এইটুকু বোঝা যায় যে রাঢ়ীয় জনসমাজের এই উপজাতিস্তরে যেসমস্ত সর্দার গোষ্ঠীপতি ও প্রধানরা ছিল, একসময় তাদের আঞ্চলিক আধিপত্য ও প্রতাপ উপরের বর্ণহিন্দু সমাজের তুলনায়, অথবা অন্যান্য সামন্তদের তুলনায় বিশেষ কম ছিল না। প্রবল দারিদ্র্যে ও নির্মম উপেক্ষায় এদের সেই লৌহ—মেরুদণ্ড পরবর্তীকালে দুমড়ে বেঁকে গিয়েছে। এই জনসমাজের উপর খুদে—মাঝারি—বৃহৎ জমিদারশ্রেণি সহজেই রাজকীয় প্রতাপ বিস্তার করতে পেরেছেন, কারণ এদের আনুগত্য ও ভক্তি ক্রীতদাসের মতো অন্ধ, ধর্মবিশ্বাস গভীর, আত্মবলিদানের সাহস অপরিসীম, কর্তব্যবোধ অটল ও নিষ্কম্প।

ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাঢ়ের এই জনসমাজের বিচিত্র ধ্যানধারণা আজও পর্যন্ত অত্যন্ত সক্রিয় ও সজীব। পাশাপাশি তান্ত্রিক বৈষ্ণবধর্মের ধারা রাঢ়ে প্রবাহিত, কিন্তু মনে হয় যেন তন্ত্রধারার প্রাখর্য বেশি। লৌকিক স্তরে ধর্মঠাকুর, চণ্ডী, মনসা এবং বিচিত্র রকমের সব লোকদেবতার অখণ্ড প্রতিপত্তি। এই প্রতিপত্তির বিস্তার বোঝা যায় যখন দেখা যায় বড়—বড় হিন্দু দেবদেবীর উৎসব—অনুষ্ঠানেও লৌকিক ধর্মের আচার—সংস্কারের নির্বিরোধ অনুপ্রবেশ ঘটেছে। নিরীহ উদাস—প্রকৃতির শিব ঠাকুর পর্যন্ত তাঁর অনুষ্ঠানে জীববলি মেনে নিয়েছেন এবং তার কোনও বাছবিচার রাখেননি। শিবপূজায় শুয়োরবলির দৃষ্টান্তও রাঢ়ে বিরল নয়। ধর্মের গাজন সমস্ত বৈচিত্র্যসহ শিবের গাজনে রূপান্তরিত হয়েছে। লাভপুরে যে ফুল্লরাদেবী আছেন তিনিও বিজয়াদশমীর ভোরে শুয়োরবলি পবিত্র অনুষ্ঠান বলে মেনে নিয়েছেন। অথচ আমরা জানি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ধর্মানুষ্ঠানে উৎসর্গের জীবেরও বর্ণভেদ আছে। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অথবা ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ধর্মঠাকুরের পূজা করেন না, শিবপূজা করেন; দেবতারও বর্ণভেদ আছে। অর্থাৎ মোষ—পাঁঠা হল জন্তুদের মধ্যে কুলীন, তাদের বলিদান উচ্চবর্ণের হিন্দুর দেবদেবীর পূজায় চলতে পারে, কিন্তু শুয়োর—মুরগি অপাঙক্তেয়, তারা উৎসর্গেরও অযোগ্য। রাঢ় অঞ্চলে শিবপূজায় অথবা ফুল্লরার মতো দেবীর পীঠস্থানে শুয়োরবলির অনুষ্ঠান লোকধর্মের জয় ঘোষণা করছে। জয় হয়, বিশেষ করে ধর্মাচারের ক্ষেত্রে, জনসমাজের জোর থাকলে। রাঢ়ে লোকধর্ম যে কতখানি শক্তিশালী, এগুলি তারই দৃষ্টান্ত। অবশ্য হিন্দুধর্মের নির্বিরোধ সমন্বয়শক্তিও এর মধ্যে পরিস্ফুট।

রাঢ়ের গ্রাম্য সমাজে বৈষ্ণব—বাউলদের আখড়া আছে অনেক, তান্ত্রিক সাধুর আশ্রমও আছে অনেক। সহজিয়া তন্ত্রসাধনার অন্যতম ক্ষেত্র বলে বৈষ্ণবীরও প্রাচুর্য আছে এবং ভৈরবীরও অভাব নেই। একতারা—খঞ্জনি বাজিয়ে পদাবলি ও বাউলগান গেয়ে বৈষ্ণব—বৈষ্ণবীরা ভিক্ষাঝুলি কাঁধে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। তান্ত্রিক সাধুরাও মধ্যে মধ্যে ‘চ্যেইৎ—চণ্ডী—কালী কপালী নরমুণ্ডমালী’ বলে ভয়াবহ হাঁক মেরে আবির্ভূত হয়। মুসলমান ফকিররাও আসে, হাতে সারেঙ্গির মতো বাদ্যযন্ত্র, বাজপাখির মতো ছেটো পাখি, কণ্ঠে দেহতত্ত্বের গান, হিন্দু দেবদেবীর গান, মা—যশোদার বেদনা—গান। এ ছাড়া রাঢ়ের গ্রাম্য সমাজে আরও যাদের দেখা যায় তাদের কাউকে বলে ‘কাকমারা’, কাউকে ‘গোরুমারা’, কাউকে ‘বাজিকর’। সাপুড়ে—বেদেরা আছে, ওঝারা আছে, ডাইনি—ডাকিনীরাও আছে। তন্ত্রমন্ত্র—তুকতাকের কলাকুশলীও আছে। আদিম কৌম—সংস্কৃতির এবং রাঢ়ীয় সমাজের ভিত্তিস্তরের লোকসংস্কৃতির বিচিত্র সব বিকৃত রূপ ও ভুক্তাবশেষ যেন গ্রাম্য সমাজের সর্বাঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে আছে কাঁকরের মতো।

রাঢ়ীয় জনসমাজের এই সমগ্র রূপের সঙ্গে পরিচয় থাকলে তারাশঙ্করের সাহিত্যসৃষ্টির স্বাতন্ত্র্য ও তার রসাস্বাদন সার্থক হয়। এককথায় বলা যায়, তারাশঙ্করের সাহিত্য বাংলার এই বৈশিষ্ট্য গ্রাম্য সমাজের শিল্পরূপায়ণ। এই গ্রাম্য সমাজে তাঁর জন্ম, এই সমাজে তিনি লালিতপালিত, এবং এই সামাজিক প্রতিবেশের সমগ্রতার মধ্যে, বিরাট বৈচিত্র্য ও সমন্বয়ের মধ্যে তাঁর মানসিকতার বিকাশ। এই রচনার সীমাবদ্ধ পরিসরের মধ্যে সম্ভব হলে দেখাতে পারত, সুদীর্ঘ শ্রেণিবদ্ধ তালিকা করে, তারাশঙ্করের সমগ্র গল্প—উপন্যাসের মধ্যে যে কয়েকশত চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন, মুখ্য ও নিতান্ত গৌণ সকল রকমের, তাদের মধ্যে বৈষ্ণব—বৈষ্ণবী—বাউলের সংখ্যা কত, তান্ত্রিক সাধুসন্ন্যাসী, ভৈরব—ভৈরবী কত, লোকাচার লোকানুষ্ঠান মেলা উৎসব—পার্বণের বিবরণ কত, হাড়ি—বাগদি—কেওট—ডোম—বাউরি—কাহার প্রভৃতি বর্ণহিন্দু—বহির্ভূত সমাজের লোক—চরিত্রের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য কত, ছোট—বড়—মাঝারি গ্রাম্য জমিদার কত এবং অন্যান্য শ্রেণির গ্রাম্য চরিত্রই বা কত। লক্ষণীয় হল, তারাশঙ্করের সাহিত্য একেবারে মধ্যবিত্ত—বিবর্জিত না হলেও, সেখানে সংখ্যালঘু শ্রেণি হল মধ্যবিত্ত। সেকালের ন্যায়রত্ন—স্মৃতিরত্ন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং একালের মধু মাস্টারের মতো অবহেলিত গ্রাম্য শিক্ষক মধ্যবিত্তের মধ্যে তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সহানুভূতির পাত্র, কিন্তু বাকি চরিত্র মধ্যবিত্তসুলভ দীনতা স্বার্থপরতা পরশ্রীকাতরতা ও হিংসাবিদ্বেষ কলঙ্কিত। মনে হয় না, তারাশঙ্করের কোনও বিশেষ আকর্ষণ ও অনুরাগ এই মধ্যবিত্তের প্রতি আছে বলে। তাঁর নাড়ির সংযোগ হল গ্রাম্য জনসমাজের ভিত্তিস্তরের সঙ্গে, এবং উপরের স্তরে জমিদারের সঙ্গে। সামাজিক মুকুরে তারাশঙ্করের সঙ্গে, এবং উপরের স্তরে জমিদারের সঙ্গে। সামাজিক মুকুরে তারাশঙ্করের সাহিত্যের এই প্রতিফলনই দেখা যায়।

সমকালীন সাহিত্যের প্রধান সাধনমার্গ হল বিকৃত কামলালসার রোমন্থন। এই বিকৃত কামলালসা বর্তমান স্বেচ্ছাচারী সমাজজীবনের সর্বস্তরে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে সত্য এবং সেটাও যে ‘সোশ্যাল রিয়ালিটি’র বা সামাজিক বাস্তবতার একটা অংশবিশেষ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সর্বপ্রকারের বাসনা ও বুভুক্ষার মধ্যে কেবল ‘কাম’ যেন অতিকায় কুৎসিত দানবের মতো সমাজজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মহাদাপটে পদক্ষেপ করছে এবং মানুষমাত্রই যেন অস্বাভাবিক যৌনতত্ত্বের যূপকাষ্ঠে উৎসর্গিত হয়েছে, এইরকম একটা ভয়াবহ লোমহর্ষক ধারণা সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য পাঠ করলে পাঠকের মনে বদ্ধমূল হয়ে ওঠে। শুধু বাস্তব বলে তা সাহিত্যের অন্যতম সাধনবস্তু, এ যুক্তিতে ভেজাল বেশি। তা ছাড়া জীবনের সমগ্র বাস্তবের একটা কথা মাত্র এই সত্য, সাহিত্যের রাজসিংহাসনে সমাসীন হবার মতো দাবি তার গ্রাহ্য হতে পারে না। সামাজিক বাস্তবতার সমগ্রতা (totality of social reality) হৃদয়ঙ্গম করা যদি খুব সহজ হত, তাহলে সমাজের অলিগলিতে মহৎ জীবনশিল্পীর আবির্ভাব হত। কিন্তু সেটি সহজ নয় বলেই তা হয় না, অতীতে হয়নি, বর্তমানেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। সদাগরি অফিসের কেরানির মতো ভিড় হয় সাহিত্যিকের, বিশেষ করে তখন, যখন সাহিত্য বাণিজ্যের পণ্য হয়ে ওঠে। বিপুলকায় স্থূল জনসমাজে (mass society) কামসাহিত্যের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা প্রচুর, তাই তার আধিপত্য ও চর্চা বেশি। তারাশঙ্করের সাহিত্য আশ্চর্যভাবে এই সমকালীন বিকারের উপসর্গ থেকে মুক্ত এবং এত দূর মুক্ত যে চিরকালীন শৃঙ্গাররসের সাধনাতেও তিনি সিদ্ধশিল্পী হতে পারেননি। সামাজিক বাস্তবতার সমগ্রতার স্বরূপ উপলব্ধি করতে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন, অখণ্ড জীবনের রসোদঘাটনে তিনি আগ্রহী, যদিও সীমানা তারও একটা আছে এবং সেটা তাঁর নিজস্ব গ্রাম্য সমাজের সীমানা।

সমাজগতির (social dynamics) ধারা সম্বন্ধেও তারাশঙ্করের যুগচৈতন্য সতত সজাগ। এই সজাগতা তাঁর আধুনিক সমাজদর্শনের পুঁথিগত বিদ্যালব্ধ নয়, জীবনের তপ্ত অভিজ্ঞতালব্ধ। যদি পুঁথিগত হত তাহলে বহু তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ ‘বিপ্লবী’ সাহিত্যকের মতো তিনি ছক—কাটা সূত্র ধরে সাহিত্য রচনা করতেন এবং সেই সাহিত্য হত বক্তৃতাপ্রধান, চরিত্রগুলি সেখানে প্রাণহীন কাঠের খুঁটির মতো নড়াচড়া করত। কিন্তু মানুষের নামে কাঠের মূর্তি তিনি তাঁর সাহিত্যে সৃষ্টি করেননি এবং যাকে ‘tendentious’ বা উদ্দেশ্যপ্রবণ সাহিত্য বলে তা—ও তিনি রচনা করেননি। জীবন্ত মানুষকে তিনি দেখেছেন, তাঁর গ্রাম্য সমাজের নানা রকমের মানুষ, এবং প্রকৃত জীবনশিল্পীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে তাদের প্রাণধর্ম, দুঃখবেদনা আনন্দ অনুভব করেছেন, সাহিত্যে রূপায়িত করেছেন। ‘রসকলি’র রাখালচূড়াবাঁধা কমলিনী বৈষ্ণবী, ‘কবি’র নিতাই বা সতীশ ডোম ও বসন ঝুমুরওয়ালি, ‘ডাকহরকরা’র দীনু ডোম, ‘ধাত্রীদেবতা—কালিন্দী—গণদেবতা—পঞ্চগ্রাম’—এর শিবনাথ, ইন্দ্ররায়, মিস্টার মুখার্জি, দ্বারিক চৌধুরী, শ্রীহরি পাল, দেবু পণ্ডিত, শিবশেখর ন্যায়রত্ন ও বিশ্বনাথ, হিন্দু—মুসলমান চাষি ও কামার—কুমোর—ছুতোর প্রভৃতি গ্রাম্য শিল্পী, ‘হাঁসুলিবাঁক’—এর বনোয়ারি করালী পরম—এরা কেউ কাঠের খুঁটি নয়, জীবন্ত মানুষ। তারাশঙ্করের সামাজিক পরিবেশে আজও এদের চলেফিরে বেড়াতে দেখা যায়।

সমাজগতিচেতনার সজাগতার জন্য তারাশঙ্কর এই গ্রাম্য সমাজের জীবনমেলার ভিতর দিয়ে সমগ্র বাস্তবকে অনেকাংশে উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং তাঁর সাহিত্যেও সেই উপলব্ধি বিনা আয়াসে শিল্পরূপে মণ্ডিত হয়ে উঠেছে। ‘রায়বাড়ি’তে বা ‘জলসাঘর’—এ, ‘ধাত্রীদেবতা’য় ও ‘কালিন্দী’তে জমিদারশ্রেণির যে চিত্র তিনি এঁকেছেন তাতে মনে হয় যেন সেকালের সামন্তযুগের অঢেল ঐশ্বর্য ও অমিত শৌর্যের প্রতি কোথায় তাঁর মনের কোণে একটা বিস্ময়াবিষ্ট মোহ আছে, যদিও মর্মে মর্মে তিনি অনুভব করেছেন যে এই মোহ মিথ্যা, এই ঐশ্বর্য ও শৌর্য নিশ্চিত বিলীয়মান, প্রশস্তবক্ষ স্বেচ্ছাচারী সামন্তের যুগ অস্তমান, সংকীর্ণচিত্ত হিসেবি যন্ত্রমালিকের যুগ উদীয়মান। বক্ষের এই প্রশস্ততার প্রতি তারাশঙ্কর তাঁর হৃদয়ের স্বাভাবিক আকর্ষণ গোপন করতে পারেননি, হোক সে প্রশস্ততা সেকালের, হোক তা মধ্যযুগীয় স্বৈরাচারীর চরিত্রসঙ্গী। তার জন্য তাঁকে সেকালপন্থী, অতীতবিলাসী, অথবা আধুনিক রাজনীতির আটপৌরে ভাষায় ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। এঙ্গেলস (Frederick Angels) একবার সাহিত্য ও সামাজিক বাস্তবতা প্রসঙ্গে (এপ্রিল ১৮৮৮) মার্গারেট হার্কনেসকে একখানি বিখ্যাত পত্রে লিখেছিলেন :

I am far from finding fault wih your not having written a purely socialist novel, a Tendenzroman, as we Germans call it, to glorify the social and political views of the author. That is not at all what I mean. The more the author’s views are concealed the better for the work of art. The realism I allude to may creep out even in spite of author’s views. Let me refer to an example.

Balzac, whom I consider a far greater master of realism than all the Zolas, past present or future, gives us…a most wonderfully realistic history of French soceity… Well, Balzac was politically a legitimist; his great work is a constant elegy on the irreparable decay of good society; his sympathies are with the class that is doomed to extinction. But for all that, his satire is never keener, his irony never more bitter, than when he sets in motion the very men and women with whom he sympathises most deeply—the nobles…That Balzac was thus compelled to go against his on class sympathies and political prejudices, that he saw the necessity of the downfall of his favourite nobles and described them as people deserving no better fate; that he saw the real men of the future…that I consider one of the greatest triumphs of realism, and one of the greatest features in old Balzac.

তারাশঙ্করের সাহিত্য সম্বন্ধে এঙ্গেলসের এই কথাগুলির প্রতিধ্বনি করা যায়। তারাশঙ্কর মনেপ্রাণে জাতীয়তাবাদী এবং জাতীয়তাবাদের গান্ধী—আদর্শে আকৈশোর প্রতিপালিত। নিজে তিনি খুব বড় জমিদার বংশের না হলেও, বেশ প্রতিপত্তিশালী জমিদার বংশের সন্তান। ‘রায়বাড়ি’র রাবণেশ্বর, ‘জলসাঘর’—এর বিশ্বম্ভর, ‘ধাত্রীদেবতা’ ও কালিন্দীর বিশ্বনাথ ও ইন্দ্র—এইসব জমিদার চরিত্রের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ও সহানুভূতি বোঝা যায়। সেকালের গ্রাম্য সমাজে অনেক সুখশান্তি ছিল, শুভবুদ্ধি ছিল, মানবিক গুণাগুণবোধ ছিল—এই অনুভূতি তাঁর সমাজচিত্রে অভিব্যক্ত। কিন্তু জীবনশিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে যখন তিনি এই চরিত্র ও সমাজকে চলমান করেছেন তাঁর সাহিত্যে, তখন তার অবশ্যম্ভাবী পতন ও ধ্বংসের বিষণ্ণমূর্তি তিনি দেখতে পেয়েছেন। নতুন সমাজ কীরকম ও নবযুগের মানুষ কারা, তারও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত তার ভিতর থেকে ফুটে উঠেছে। কলের মালিক, যন্ত্রসভ্যতার দাস যারা, এ যুগের তারাই প্রতিনিধি। একালের জীবনের ছন্দ যন্ত্রের ছন্দে ধ্বনিত। সেকালের আত্মসমাহিত গ্রাম্য সমাজ অচল, কারণ তার ভিত্তিস্তম্ভগুলি একে একে ভেঙে পড়েছে, আর সেগুলি জোড়াতালি দিয়ে দাঁড় করানো সম্ভব নয়। এমনকী সেকালের পাণ্ডিত্যগৌরবের অবশেষ ন্যায়রত্নরাও দেশত্যাগী হতে আজ বাধ্য। ‘গণদেবতা’ ও ‘পঞ্চগ্রাম’ তারই প্রতিচ্ছবি। তবু জীবনের ধর্ম ও মূলমন্ত্র এগিয়ে চলা এবং এই মূলমন্ত্রে তারাশঙ্করের বিশ্বাস হাজার হতাশার মধ্যে অবিচলিত। ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ এ যুগের জীবনের উপকথা। বানোয়ারি—করালীর দ্বন্দ্ব দুই যুগের প্রতিভূর দ্বন্দ্ব। একটি যুগ বিলীয়মান—বনোয়ারির কালরুদ্র—শাসিত—স্বজাতি—ঐতিহ্যাশ্রিত যুগ; আর—একটি যুগ উদীয়মান—করালীর আধুনিক যন্ত্রযুগ, যে যুগে মানুষের আত্মবিশ্বাস আকাশস্পর্শী হচ্ছে, স্বজাতিবোধের চেয়ে অহংবোধ হচ্ছে প্রখরতর, মানুষ হতে চাইছে বিশ্বকর্মা। অতীত—বর্তমান—ভবিষ্যতের সমস্ত ‘জোলা’র বাস্তবতা যোগ করলেও একা বালজাকের বাস্তবতাকে ছাড়াতে পারবে না। এ কথা এঙ্গেলস বলেছিলেন। তেমনি তারাশঙ্কর সম্বন্ধেও বলা যায়, মজুর—কৃষকদরদি শত সাহিত্যিকের বাস্তবতা একা তারাশঙ্করের এই বাস্তবতার সমতুল্য হবে না। হতে পারে তিনি ভাষার স্টাইলের জাদুকর নন, তাঁর চেয়ে সূক্ষ্মতর কারুশিল্পী আরও অনেকে থাকতে পারেন, আছেনও, কিন্তু তাঁর মতো এ যুগের বাংলার গ্রাম্য সমাজের একনিষ্ঠ জীবনশিল্পী সমকালে আর কেউ আছেন কি না জানি না। বালজাকের সাহিত্য থেকে, এঙ্গেলস বলেছিলেন : ‘I have learned more than from all the professional historians, economists and statisticians of the period together.’ তারাশঙ্করের সাহিত্য সম্বন্ধে বলতে পারি যে আমরা তাঁর গল্প—উপন্যাস থেকে বাংলার গ্রাম্য সমাজ (বিশেষ করে রাঢ়ের) ও লোকসংস্কৃতি সম্বন্ধে অনেক বিষয় শিখেছি ও জেনেছি, যা বহু পেশাদার ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ ও সংখ্যাতত্ত্ববিদের বিবরণ থেকে শিখতে বা জানতে পারিনি। আশা করি বাকি জীবনের সাধনায় তারাশঙ্কর বাংলার এই সমাজচিত্র ও জীবনালেখ্য আরও সমগ্র ও সমৃদ্ধ করে তুলবেন তাঁর সাহিত্যে।

১৩৭১

সকল অধ্যায়

১. বাঙালি সদাগরশ্রেণি – বিনয় ঘোষ
২. মার্কসবাদ ও মর্গানবাদ – বিনয় ঘোষ
৩. বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা – বিনয় ঘোষ
৪. গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ
৫. মধ্যবিত্তশ্রেণি ও মাধ্যমিক সংঘ – বিনয় ঘোষ
৬. শিবনাথ শাস্ত্রী – বিনয় ঘোষ
৭. সমাজপতি মহারাজা নবকৃষ্ণ – বিনয় ঘোষ
৮. ঠাকুর পরিবারের আদিপর্ব ও সেকালের সমাজ – বিনয় ঘোষ
৯. বিদ্যাসাগর-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১০. রবীন্দ্র-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১১. বিবেকানন্দ-চিন্তা – বিনয় ঘোষ
১২. জয়নারায়ণ ঘোষাল – বিনয় ঘোষ
১৩. অটোমেটিক জীবন ও সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৪. সমাজবিজ্ঞানীর এ কোন শোচনীয় পরিণতি! – বিনয় ঘোষ
১৫. মেহনত ও প্রতিভা – বিনয় ঘোষ
১৬. দীবনন্ধু মিত্র বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও বাঙালি সমাজ – বিনয় ঘোষ
১৭. বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদিপর্ব – বিনয় ঘোষ
১৮. তারাশঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ – বিনয় ঘোষ
১৯. সাহিত্যে অশ্লীলতা – বিনয় ঘোষ
২০. ‘গেট টু-গ্যাদার’ – বিনয় ঘোষ
২১. অর্থনীতির ভোজবাজি – বিনয় ঘোষ
২২. গৃহভৃত্যদের সামাজিক ভূমিকা – বিনয় ঘোষ
২৩. স্বদেশি আন্দোলন ও ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – বিনয় ঘোষ
২৪. রামমোহন রায়ের জীবনচরিত – বিনয় ঘোষ
২৫. এক পুরুষের দুস্তর ব্যবধান – বিনয় ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন