স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল

একদিন যখন আকাশ আলো করে রোদ উঠেছে, ঈশ্বর বললেন— স্বর্গের উদ্যানে আজ আমি একটু বেড়াবো। স্বর্গে যত সন্ত আর ধর্মবীররা ছিলেন তাঁদের সকলকে নিয়ে ঠাকুর বেরোলেন; দরজায় রইলেন শুধু সন্ত পীটার। ঠাকুর বললেন— আমি যতক্ষণ না ফিরি কেউ যেন স্বর্গে না ঢোকে। পীটার তাই দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগলেন। একটু পরে কে একজন দরজায় ধাক্কা দিল।

পীটার জিজ্ঞেস করলেন— কে তুমি? কি চাও?

খুব মিষ্টি করে কে একজন বললে— আমি গরিব এক দর্জি। সৎ লোক। স্বর্গে ঢুকতে চাইছি।

পীটার বললেন— সৎই বটে! ফাঁসি কাঠের চোরের মত সৎ। কত লোকের কাপড় কেটে চুরি করেছ তার হিসেব আছে? তোমায় স্বর্গে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ঠাকুর বলে গেছেন যতক্ষণ তিনি বাইরে আছেন কাউকে যেন ঢুকতে না দিই।

দর্জি বললে— অত নির্দয় হবেন না। দর্জিদের টেবিল থেকে যে-সব কাটা কাপড়ের টুকরো মাটিতে পড়ে যায় তাদের কুড়িয়ে রাখলে কি চুরি হয়? আর ঐ সামান্য ব্যাপার নিয়ে কে-ই বা মাথা ঘামায়? দেখুন এত পথ হেঁটে এসে আমার পায়ে কি রকম ফোস্কা পড়ে গেছে। খোঁড়াচ্ছি। এখন কি আর আমি ফিরে যেতে পারি? শুধু একটু আমায় ঢুকতে দিন। যত খাটুনির কাজ আছে সব আমি করব। শিশুদের কোলে নিয়ে বেড়াবো, তাদের কাপড় কাচবো, যে-সব বেঞ্চি তারা নোংরা করবে তাদের ধুয়ে দেব, তাদের ছেঁড়া কাপড়ে তাপ্পি মেরে দেব।

শুনে সন্ত পীটারের মনে দয়া হল। তিনি দরজাটি একটু ফাঁক করতেই দর্জির রোগা দেহ তার মধ্যে দিয়ে সেঁধিয়ে গেল। পীটার বললেন— দরজার পাশে চুপটি করে বসে থাকো। যতক্ষণ না ঠাকুর ফেরেন ওখান থেকে নোড়ো না; যদি ঠাকুরের চোখে পড়ে যাও ঠাকুর তোমায় ভেতরে দেখে ভারি রাগ করবেন।

দর্জি তাই শুনে ফটকের পাশে বসে পড়ল। কিন্তু পীটার একবার যখন দরজার বাইরে বেরিয়েছেন, কৌতূহল আর দমন করতে না পেরে সে উঠে দাঁড়াল, তারপর স্বর্গের এখানে ওখানে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। এদিক ওদিক করতে করতে সে এক জায়গায় এসে দেখে সুন্দর সুন্দর অনেক চৌকি আর তার মাঝখানে সবচেয়ে উঁচু একখানি সোনার আসন— তার সর্বাঙ্গে জ্বলজ্বল করছে হীরে জহরৎ। আসনের সামনে রয়েছে একটি সোনার পাদানি। এইটি হচ্ছে স্বয়ং ঈশ্বরের বসবার আসন। সেখানে বসে তিনি পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে সমস্ত দেখতে পান।

দর্জি অনেকক্ষণ অবাক হয়ে সেইদিকে দেখলো। ভারি ভালো লাগল তার সেই স্বর্ণাসনটা। তারপর আর থাকতে না পেরে সোজা গিয়ে বসে পড়ল তাতে। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ খুলে গেল। পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে সব দেখতে পেল। সে দেখল কুরূপা এক বুড়ি নদীর ধারে কাপড় কাচতে কাচতে দুটি ছোট ছোট পোষাক চুরি করে একপাশে রেখে দিল। দেখে তার এমন রাগ হল যে সে আর সামলাতে পারল না। সোনার পাদানিটা তুলে ছুঁড়ে মারল সেই চোর কুরূপা বুড়ির দিকে। সোনার পাদানি তো গেল। তখন ভয়ে ভয়ে সে সোনার সিংহাসন থেকে নেমে ভালমানুষের মতো মুখ করে আবার দরজার পাশে গিয়ে চুপটি করে বসে পড়ল।

ঠাকুর তাঁর সন্তদের নিয়ে যখন স্বর্গের ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন দর্জি তাঁর চোখে পড়ল না। কিন্তু যখন তিনি গিয়ে নিজের আসনে বসলেন, দেখলেন সোনার পাদানিটা নেই। সন্ত পীটারকে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু পীটার কিছুই বলতে পারলেন না। তখন ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন— পীটার, তুমি কি কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিয়েছ?

পীটার বললেন— আর তো কেউ নয়, শুধু এক খোঁড়া দর্জি ঢুকতে চেয়েছিল, তাকে আমি দরজার আড়ালে বসে থাকতে বলেছি। সেইখানেই সে আছে।

তখন ঠাকুর দর্জিকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সে পাদানি নিয়ে কোথাও রেখেছে কি না!

দর্জি বললে— হ্যাঁ ঠাকুর, আমি এত রেগে গিয়েছিলুম একজন বুড়ি কাপড় চুরি করছিল দেখে যে পাদানি ছুঁড়ে তাকে মেরেছি।

ঠাকুর বললেন— তবে রে হতভাগা। তোর মতো যদি আমাকেও বিচার করতে হোতো তবে তুই নিজে কি এতদিন ধরে নিস্তার পেয়ে আসতিস? আর স্বর্গেই তাহলে কোনো চেয়ার, বেঞ্চি, তাক, এমনকি আগুন খোঁচাবার শিকও বাকি থাকত নাকি? সবই তো পাপী-তাপীদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ত। নাঃ তোমার স্বর্গে থাকা হবে না। বাইরে যাও। এখানে শাস্তি দেবার মালিক আমি— আর কেউ নয়।

পীটার তখন দর্জিকে নিয়ে স্বর্গের বাইরে দিয়ে এলেন।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন