ডাক্তার সবজান্তা

এক গ্রামে এক গরীব চাষী ছিল তার নাম ছিল কাঁকড়া। শহরের এক ডাক্তার তার কাছ থেকে এক বোঝা কাঠ কিনতে চেয়েছিলেন। চাষী তার জোড়া বলদের গাড়িতে কাঠের বোঝা চাপিয়ে শহরে নিয়ে গেল। কাঠের দাম পাবে সে দু-টাকা। চাষী গাড়ি থেকে কাঠ নামিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে টাকা চাইতে ঘরে ঢুকে দেখল ডাক্তারবাবু ডিনার খাচ্ছেন। টেবিলের উপর ভালো ভালো সব জিনিস সাজানো। দেখতে দেখতে তার মনে হতে লাগল— আঃ কী সব জিনিস! এমনটি পেলেই তবে না জীবনটা সুখের হয়। এই চাষীর জীবন—ছ্যাঃ। তার মনে হল, ডাক্তার হতে পারলে বেশ হয়।

ডাক্তারবাবু তার টাকা মিটিয়ে দেবার পরও সে খানিক দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হাতটা একবার কচলে বলল— আচ্ছা ডাক্তারবাবু, চাষী হয়ে জন্মে আমি কি ডাক্তার হতে পারি না?

—নিশ্চয় পারো। সহজেই পারো।

—কি করতে হবে?

—প্রথমে একটা বর্ণপরিচয় বই কিনতে হবে— সেই যে যার মলাটে মস্ত লাল মুরগীর ছবি আঁকা— সেই বই। তারপর তোমার বলদ আর গাড়ি বেচে সেই টাকা দিয়ে এক প্রস্থ ডাক্তাররা যেমন পোশাক পরেন সেই পোশাক কিনতে হবে। আর তারপর বেশ বড় করে একটা ইস্তাহার লিখতে হবে— আমি সবজান্তা ডাক্তার। মস্ত একটা ফলকে সেটা লিখে নিজের দরজার উপর টাঙিয়ে রাখতে হবে।

ডাক্তারবাবু যেমন যেমন বলেছিলেন সে তার সবই করল। দু-একটি রুগীও পেল— তবে খুব বেশি নয়।

সেই সময় শহরতলিতে থাকতেন এক বড় জমিদার। তাঁর বাড়িতে একটা বড় রকম চুরি হয়ে গেল। জমিদার ঘোষণা করে দিলেন, যে চোর ধরে দিতে পারবে অথবা চোরাই টাকা উদ্ধার করে দিতে পারবে তাকে বেশ ভালো পুরস্কার দেবেন।

জমিদার মশায় শুনলেন, শহরে একজন গুণী ডাক্তার আছেন তাঁর নাম ডাক্তার সবজান্তা। তাঁর কাছে গেলে তিনি খুব সম্ভবত চোর ধরে টাকা উদ্ধার করে দিতে পারবেন। শুনে জমিদার গাড়ি জুততে বললেন। তারপর গাড়ি চড়ে টগ্‌বগ্‌ করে শহরে এসে হাজির হলেন।

সবজান্তা ডাক্তার বর্ণপরিচয় বই উল্টো করে ধরে বসে আছেন, সেই সময় জমিদার ঢুকে বললেন— আপনিই কি সবজান্তা ডাক্তার?

ডাক্তার বই মুড়ে বললেন— আজ্ঞে হ্যাঁ।

—তবে একবার দয়া করে চলুন আমার বাড়ি। আমার কিছু সম্পত্তি চুরি গেছে। তা উদ্ধার করবার জন্যে আপনার সাহায্য পেলে বাধিত হব।

ডাক্তার বলল— মাননীয় জমিদার মহাশয়, আপনার সঙ্গে আমি নিশ্চয় যেতে রাজি, যদি সঙ্গে করে আমার স্ত্রী গ্রেটেলকে নিয়ে যেতে দেন।

এতে আর জমিদার মশায়ের আপত্তি করবার কি আছে? তিনি তাদের দুজনকে নিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন।

বাড়ি পৌঁছতেই খানার টেবিলে খানা সাজিয়ে দেওয়া হল। সবজান্তা ডাক্তার আর তাঁর স্ত্রী টেবিলের ধারে বসলেন, চাকরেরা খানা নিয়ে আসতে লাগল। প্রথম চাকর যখন অতি সুস্বাদু এক খাদ্যবস্তু এনে তাঁদের প্লেটে রাখল, ডাক্তার তার কনুই দিয়ে স্ত্রীকে খোঁচা দিয়ে ফিস্‌ফিস্ করে বলল— এই হল এক নম্বর!

চাষীর নিজের বাড়িতে তো চাকর নেই যে একটার পর একটা ডিশ নিয়ে আসবে। চাষানী তরিতরকারি ও মাংস মিশিয়ে একটা রান্না করে; হাঁড়িশুদ্ধ নিয়ে এসে টেবিলে বসিয়ে দেয়; তারপর দুজনে মিলে খায়। এখানকার ব্যাপারটাই আলাদা। স্ত্রীকে তাই বোঝাবার জন্যে চাষী কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বলল— এই হলো এক নম্বর। অর্থাৎ আরো আসছে।

এদিকে চাকরের কানে গেছে সে কথাটা। শুনে ভারি ভয় পেয়ে গেছে। মনে পাপ তো, সে ভাবছে ডাক্তার বলছেন—এই হচ্ছে প্রথম চোর। ঘাবড়ে গিয়ে সে খাবার ঘর থেকে বেরিয়েই তার সঙ্গীদের বললে— সর্বনাশ হয়েছে। ডাক্তার সব জেনে ফেলেছেন। আমাদেরই কীর্তি এই কথা বলছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন— এই হচ্ছে প্রথম চোর।

শুনে অন্য চাকরেরা খাবার ঘরে যেতে ভয় পেতে লাগল। কিন্তু না গেলে নয়, কাজ রয়েছে। প্রভু উপস্থিত, কাজে ফাঁকি দেওয়া যায় না।

দ্বিতীয় খাবারের প্লেট হাতে আর একজন চাকর ঘরে ঢুকল। যেই না সে প্লেটটা টেবিলে রেখেছে অমনি শুনল ডাক্তার তার স্ত্রীকে বলছে— এই হল দু নম্বর।

লোকটা বিষম ভয় পেয়ে যত তাড়াতাড়ি পারে ঘর থেকে পালালো।

তৃতীয় চাকর ঘরে ঢুকতেও ঐ একই ব্যাপার। ডাক্তার বললেন— এই হল তিন নম্বর।

তারপর চার নম্বর চাকর ঘরে ঢুকে যখন একটা ঢাকা দেওয়া ডিশ টেবিলে রাখল, জমিদার ভাবলেন ডাক্তারের বিদ্যে একটু পরীক্ষা করে দেখি। তিনি বললেন— বলুন তো ডাক্তার মশায় ঢাকার তলায় কি আছে?

ডাক্তার ঢাকার দিকে তাকিয়ে ঘামতে আরম্ভ করলো। কি করে এখন? এবার তো ধরা পড়ে যাবে। বিড় বিড় করে বললে— কাঁকড়া কাঁকড়া! এবার করবে কি তুমি?

এখন ডাক্তারের ডাকনাম যে কাঁকড়া তা তো জমিদার জানতেন না। তিনি জানেন এঁর নাম সবজান্তা। জমিদার ঢাকা তুলতে হুকুম দিলেন। ঢাকার তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল ঝোলে মশলায় মাখা লাল লাল কাঁকড়া।

জমিদার বললেন— আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার সাহেব। আপনি সবই জানেন। এবার তাহলে বলুন— কোথায় আমার টাকা। কেই-বা তা চুরি করেছে।

চাকরেরা ভীষণ ভয় পেয়ে কেবলই ডাক্তারকে ইশারা করতে লাগল তাদের ঘরে আসবার জন্যে। ডাক্তার খাওয়া শেষ করেই লুকিয়ে চাকরদের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। তারা ডাক্তারকে ঘিরে হাত জোড় করে নিজেদের দোষ স্বীকার করলে। বললে— আমরা পাঁচ জনে মিলে এই কর্ম করেছি। কিন্তু ডাক্তারবাবু যদি আমাদের ধরিয়ে না দেন তাহলে আমরা আপনাকে অনেক টাকা দেব। ডাক্তার বলল— কোথায় রত্ন লুকিয়ে রেখেছ আগে দেখাও তবে তোমাদের বাঁচাবো।

তারা তখন সেই লুকোনো জায়গায় ডাক্তারকে নিয়ে গেল। ডাক্তার দেখে শুনে এসে খাবার ঘরে পুনঃপ্রবেশ করলো। তারপর জমিদারকে বললে— এবার আমি বই দেখে মন্তর বার করব আর দেখব কোথায় গুপ্তধন লুকোনো আছে। আপনারা আমায় কিছুক্ষণের জন্যে একা ছেড়ে দিন।

ডাক্তার তার বই নিয়ে ঘরে একা রইল। এদিকে এক ব্যাটা চাকর চুপিসাড়ে এসে টেবিলের তলায় লুকিয়েছে। তারা তো আগেও চুরি করেছে, ডাক্তার সে সবও জানেন কিনা তাই জানতে এসেছে। ডাক্তার এদিকে বইয়ের এ পাতা ওল্টায় ও পাতা ওল্টায় আর ভাবে কি মন্তর আওড়াবে। নিজে তো ক-অক্ষর গোমাংস— বই থেকে কিছু হবে না, মাথা থেকেই মন্তরটা আসা দরকার। শেষে ডাক্তার চেঁচিয়ে বলে উঠল—

আছো বটে লুকিয়ে
কিন্তু আসতে হবে বেরিয়ে!

এই না শুনে প্রায় মন্তরেরই মত কাজ হল। টেবিলের তলা থেকে চাকরটা কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এসে বললে— ডাক্তারবাবু আপনি সব জানেন।

সে ভেবেছে সে যে টেবিলের তলায় লুকিয়ে আছে ডাক্তার তা জানতে পেরেছেন।

শেষে ডাক্তার সবজান্তা জমিদারকে নিয়ে গেল যেখানে চুরির ধন লুকোনো ছিল। ডাক্তার বললে— টাকা ফেরত পেয়ে খুশি থাকুন। কে চুরি করেছে তা আমি বলব না।

জমিদারের কাছ থেকে পুরস্কার নিয়ে ডাক্তার গেল চাকরদের কাছে। তারাও তাকে অনেক টাকা দিয়ে খুশি করে দিল। ডাক্তারের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন