কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি

একটি গরীব রাখাল ছেলে ছিল—তার বাবা-মা দুজনেই মারা গিয়েছিলেন। গ্রামের পাঁচ জনে পরামর্শ করতে বসলেন ছেলেটির জন্য কি করা যায়। শেষে হাকিমের পরামর্শ নিয়ে স্থির হল ছেলেটিকে এক বড়লোকের হেপাজতে রেখে দেওয়া হবে। কিন্তু এই বড়লোকটি আর তার স্ত্রী ছিলেন যেমন কৃপণ তেমনই নিষ্ঠুর। তাঁরা ছিলেন ভারি লোভী। শুধু নিজেদের ধন-সম্পদের কথাই ভাবতেন। কেউ যদি তাঁদের রুটিতে একটুকরোও ভাগ বসাতে আসতে তো তাঁদের অস্বস্তির সীমা থাকত না। রাখাল ছেলেটি যতই খাটুক না কেন, তাঁর ভাগ্যে অতি সামান্যই খাবার জুটতো—লাভের মধ্যে কিল আর চড়।

একদিন সে মনিবের একটা মুরগী আর তার বাচ্ছাগুলোকে পাহারা দিচ্ছে, মুরগীটা একটা ঝোপের নীচে দিয়ে যেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে অমনি কোথায় ছিল এক বাজ—এক ছোঁয়ে মুরগীকে নিয়ে একেবারে উধাও!

ছেলেটি চিৎকার করে উঠল—চোর! চোর! পালালো!

কিন্তু চিৎকারে কোনো ফল হল না। বাজ তার শিকার ছেড়ে দিল না। বড়লোকটি শব্দ শুনে সেখানে দৌড়ে এলেন। তারপর যখন দেখলেন যে মুরগী খোয়া গেছে তখন রাগের চোটে রাখালকে ধরে এমন পিটুনি দিলেন যে সে দুদিন নড়তেই পারল না।

মুরগী খোওয়া যেতে রাখাল বালকের ঝঞ্ঝাট বাড়ল। আগে মুরগীটাই তার বাচ্ছাদের সামলাতো, এখন রাখালকেই বাচ্ছা সামলাতে হল। বাচ্ছারা একটা এদিকে যায় আরেকটা ওদিকে যায়—এক জায়গায় রাখাই মুশকিল। সে করল কি, বাচ্ছাগুলোকে একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। ভাবলো, মস্ত একটা কাজ করেছে—এবারে আর বাজটা হঠাৎ কোনো ফালতু বাচ্ছাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যেতে পারবে না।

কিন্তু রাখালের মস্ত ভুল হয়েছিল। একে ছুটোছুটি তার উপর খিদে। রাখাল বেচারা সেদিন মুরগীর বাচ্ছা পাহারা দেবার সময় ক্লান্তিতে খিদেতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ঠিক সেইসময় বাজ এসে একটা বাচ্ছাকে মেরেছে ছোঁ। যেই ছোঁ মারা অন্য বাচ্ছাগুলো ছিল সুতোয় বাঁধা, তারাও উড়লো বাজের সঙ্গে। উঁচু এক গাছের চূড়োয় বসে বাজ একটার পর একটা মুরগীর বাচ্ছা ভোজন করলে।

সেই সময় বড়লোকটি বাড়ি ফিরছিলেন। দৃশ্য দেখে প্রথমটা তাঁর মুখ হাঁ হয়ে গেল। তারপর এমন রাগ রাগলেন যে রাখাল ছেলেটিকে ধরে তুলো ধুনে দিলেন। বহুদিন সে বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারল না।

যে দিন সে উঠল তার মনিব তাকে ডেকে বললেন—তোমার যেরকম বুদ্ধি তোমায় দিয়ে গরু ভেড়া চরানো চলবে না। তোমায় পিওনের কাজ দিচ্ছি।

হাতে এক টুকরি আঙুর আর একটা চিঠি দিয়ে বললেন—যাও এটা নিয়ে হাকিমের বাড়ি।

রাখাল খেতে প্রায় কিছুই পেত না। তার উপর অতটা পথ। পথে বেজায় খিদে আর তেষ্টা। সে দু’ থোকা আঙুর বার করে খেয়ে ফেলল। আঙুরের টুকরি হাকিমের কাছে নিয়ে যেতে হাকিম যখন চিঠি পড়লেন, দেখলেন চিঠিতে যা লেখা আছে তার চেয়ে দু’ থোকা আঙুর কম। ছেলেটি দোষ স্বীকার করল। বলল, খিদে আর তেষ্টার তাড়নায় সে দু’ থোকা আঙুরের রস খেয়েছে। হাকিম তার মনিবকে একটি চিঠি লিখলেন। লিখলেন আগে ৩ থোকা আঙুর পাঠানো হয়েছিল। আবার যেন ৩ থোকাই আঙুর পাঠানো হয়।

এর পরের বারেও সে খিদে তেষ্টায় এমন কাতর হয়ে পড়ল যে আবার দু’ থোকা আঙুর খেয়ে ফেলল। এবারে আঙুর খাবার আগে সে তার মনিবের চিঠিটা বার করে একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখে দিল। রাখাল জানতো এর আগের বারে চিঠিই সব কথা বলে দিয়েছে। তাই এবারে এই সাবধানতা। কিন্তু হাকিমের চিঠির দরকার ছিল না। তিনি আগেই জানতেন তাঁকে ক’-থোকা আঙুর পাঠানো হচ্ছে, কাজেই কম দেখে তিনি কারণ জানতে চাইলেন।

রাখাল বললে—আপনি কি করে ধরে ফেললেন যে দু-থোকা কম? চিঠি তো এবারে কোনো কথা বলে নি—আমি পাথর চাপা দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে রেখে এসেছি।

ছেলেটার সরলতায় হাকিম না হেসে থাকতে পারলেন না। তিনি তার মনিবকে একটা চিঠি লিখে জানালেন যে গরীব রাখাল ছেলেটিকে তিনি যেন আর একটু ভালো করে রাখেন। ভালো করে খেতে দেন এবং কি করা উচিত, কি উচিত নয় তা যেন শিক্ষা দেন।

বড়লোকটি চিঠি পেয়ে রাখালকে বললেন—খাবার পেতে গেলে খাটতে হবে। বেশ, কাজ দিচ্ছি, কিন্তু যদি কোনো দোষ দেখি মারের চোটে ঠাণ্ডা করে দেব।

পরদিন তিনি রাখালকে এক কঠিন কাজ দিলেন। ঘোড়ার জন্যে দু-বোঝা খড় এনে তার সামনে ফেলে দিয়ে বললেন—পাঁচ ঘন্টা পরে আমি ফিরছি। তার মধ্যে খড় কুচিয়ে ঘোড়ার জাব করে রাখতে হবে। ফিরে এসে যদি দেখি কাজ শেষ হয়নি তাহলে এমন মার দেব যে হাত পা পর্যন্ত নাড়াতে পারবে না।

বলে তিনি তাঁর স্ত্রীকে, চাকরকে আর ঝিকে নিয়ে বছরের মেলা দেখতে চলে গেলেন। রাখাল ছেলেটির জন্যে শুধু এক টুকরো পাঁউরুটি রেখে গেলেন।

ছেলেটি টুলে বসে প্রাণপণে কাজ আরম্ভ করে দিল। পরিশ্রম করায় গরম বোধ হতে লাগল। সে তখন তার ছোট্ট কোটটিকে খুলে খড়ের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। পাছে সময় মতো কাজ শেষ না হয় এই ভয়ে খাওয়া-দাওয়া ভুলে কোনোদিকে না তাকিয়ে কাজ করে চললো। আর হলো কি, খড়ের উপর কোট খুলে রেখেছিল, এ কথা ভুলে গিয়ে খড়ের সঙ্গে কোটটিকে শুদ্ধ টুকরো-টুকরো করে কেটে ফেলল। যখন ব্যাপারটা তার বোধগম্য হল তখন আর কোট উদ্ধারের উপায় নেই। রাখাল বললে—সর্বনাশ, আমার মনিব যেমন মানুষ, তিনি যদি এসে দেখেন আমি কি করেছি, তাহলে আর আমায় আস্ত রাখবেন না, মেরেই ফেলবেন। তার চেয়ে বরং আমি নিজের প্রাণ নিজেই নিই না কেন?

সে একসময় গিন্নি মা-কে বলতে শুনেছিল—আমার বিছানার নীচে এক পাত্র বিষ আছে।

আসলে সেটা বিষ নয়। পাছে কোনো লোভী খেয়ে ফেলে তাই এই সাবধানতা। তাতে ছিল মধু।

ছেলেটি বিছানার তলায় ঢুকে পাত্রটা বার করে সব শেষ করে দিল। শেষ করে দিয়ে সে বললে—লোকমুখে শুনেছি মৃত্যু বড় তিক্ত। কই তা তো মনে হচ্ছে না, বরং বেশ মিষ্টিই লাগছে।

একটা চৌকিতে সে মৃত্যুর জন্যে তৈরী হয়ে বসে রইল। কিন্তু দুর্বল হওয়ার বদলে তার মনে হল গায়ে যেন জোর পাচ্ছে।

সে মনে মনে বলল—ওটা বিষ হতেই পারে না। কিন্তু মনিব একবার বলেছিলেন যে মাছি মারবার জন্যে তিনি এক বোতল বিষ তাঁর কাপড়ের বাক্সে রেখেছেন। ওটাই নিশ্চয় আসল বিষ। ওই খেলেই মরব ঠিক।

আসলে সেটাও বিষ নয়—হাঙ্গারি দেশের মিষ্টি সরাব।

ছেলেটি বোতল বার করে সেটাও শেষ করে ফেলল। শেষ করে বলল—এ মরাটাও তো বেশ মিষ্টি লাগল!

কিন্তু খানিক পরে যখন সরাবের নেশা তার মাথায় উঠতে লাগল, মনে হতে লাগল সব কিছু ধাঁধার মত লাগছে, তখন তার মনে হল এইবার মৃত্যু নিকট।

সে বললে—মনে হচ্ছে সত্যিই মরব। যাই গির্জের কবরখানায় গিয়ে একটা গোর খুঁজি। টলতে টলতে কবরখানায় পৌঁছে দেখল সবে একটা গোর খোঁড়া হয়েছে। সেইখানেই সে শুয়ে পড়ল। সরাবের নেশায় ক্রমেই সে জ্ঞান হারাতে লাগল। কাছেই এক সরাইখানায় একটা বিয়ের উৎসব হচ্ছিল। সেখানকার গান-বাজনা তার কানে এসে ঢোকায় তার মনে হল সে যেন স্বর্গেই পৌঁছে গেছে। একটু পরেই সে সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে পড়ল। সেই যে অজ্ঞান হল, বেচারার আর জ্ঞান হল না। হাঙ্গেরিয় সরাবের গরম আর বরফশীতল রাত্রি এই দুইয়ে মিলে তার জীবন হরণ করে নিল। যে কবরের মধ্যে সে নিজেকে স্থাপিত করেছিল সেইখানেই রয়ে গেল।

বড়লোকটি যখন তার মৃত্যুর খবর পেল সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল এই ভেবে যে, হাকিম তাকেই দোষী করবেন। ভয়ের চোটে সে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তার স্ত্রী তখন উনুনে এক কড়া ঘি গরম করছিলেন। তিনি কড়া ছেড়ে স্বামীকে সাহায্য করতে দৌড়তেই কড়া উলটে ঘি পড়ে অগ্নিকাণ্ড হয়ে গেল। সারা বাড়িতেই আগুন লেগে গেল। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

বুড়ো বুড়ি বাঁচল বটে কিন্তু নিজেদের পাপের ফলে সারা জীবন দুঃখ দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাতে হল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন