ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল

একজনের ছিল একটি গাধা। গাধাটি বহু বছর ধরে লোকটির জন্যে বস্তা বয়েছে। একদিনও সে ক্লান্তি বোধ করেনি। অবশেষে তার গায়ের জোর কমে গেল, সে আর কোন কাজেরই রইল না। কাজেই মালিক ভাবতে লাগলেন কেমন করে এর পোষার খরচ কমানো যায়। গাধা যখন সেটা টের পেল, বুঝল যে এবার তার দুঃখের দিন আসছে, সে একদিন সরে পড়ল তার মালিকের বাড়ি থেকে ব্রেমেন শহরের পথে। তার মনে হল ব্রেমেন-এ গিয়ে সে শহরের নামজাদা বাজিয়ে হতে পারবে।

কিছুদূর যাবার পর তার দেখা হল এক কুকুরের সঙ্গে। কুকুরটা রাস্তার ধারে পড়ে পড়ে হাঁপাচ্ছিল; মনে হয় অনেক দূর থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে।

গাধা জিজ্ঞেস করলে— কী ভায়া, এত হাঁপাচ্ছ কেন?

কুকুর বললে—দেখ দাদা, আমি বুড়ো হয়ে পড়েছি। প্রতিদিন আরো দুর্বল হয়ে পড়ছি। মালিকের যে কুকুরের দল আছে তাদের সঙ্গে শিকারের পিছনে আর ছুটতে পারি না। প্রভু আমাকে মেরেই ফেলতে চেয়েছিলেন। তাই পালিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন নিজের জন্যে দু-মুঠো ভাত জোটাই কী করে তা-ও তো জানি না।

গাধা বললে—বলি তবে। আমি চলেছি ব্রেমেন-এ। সেখানে গিয়ে আমি শহরের নামজাদা বাজিয়ে হব। তুমিও এসো আমার সঙ্গে। আমি বাজাবো বেহালা, তুমি পেটাবে ড্রাম।

কুকুর তাতে রাজি হল। তখন চলল তারা এগিয়ে।

কিছুদূর গিয়ে তারা দেখল, এই এত বড় মুখ করে এক বেড়াল রাস্তার ধারে বসে রয়েছে।

গাধা জিজ্ঞেস করলে—এত চটলে কেন বেড়ালমণি?

বেড়াল বললে—চটব না? বয়েস বাড়ছে, দাঁতের জোর কমে যাচ্ছে। তাই আজকাল ইঁদুর-ধরা ছেড়ে দিয়ে উনুনের ধারে বসে থাকতেই ভালবাসি বেশি। এই দোষে আমার কর্ত্রী বলেছেন আমায় ডুবিয়ে মারবেন। শুনেই আমি পালিয়েছি—এখন জানি না কোথায় যাব।

গাধা বললে—আমাদের সঙ্গে ব্রেমেনে এস। চমৎকার গলা তোমার। অনায়াসে শহরের নামজাদা গায়িকা হতে পারবে।

বেড়াল রাজি হয়ে তাদের সঙ্গে চলল।

পলাতকেরা যখন একটা উঠোনের পাশ দিয়ে যাচ্ছে তারা দেখলে দরজার উপর গোলাবাড়ির এক মোরগ বসে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে।

গাধা বললে—বাপরে, এমন চেঁচাচ্ছিস যে মনে হচ্ছে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিচ্ছিস আমাদের! ব্যাপারটা কী?

মোরগ বললে—চ্যাঁচাবো না? আবহাওয়া সম্বন্ধে আমার যে ভবিষ্যৎবাণী তা কোনদিন ভুল হয়েছে? এই তো সেদিন মেরী-মাতার দিন গেল। সেদিন গলা ছেড়ে আমি ডেকেছিলুম বলেই তো রোদ উঠল! আর রোদ না উঠলে যীশু-মাতা মেরী সেদিন শিশু-যীশুর কাপড়-চোপড় শুকোতে পারতেন? এদিকে আমার কর্ত্রীর বাড়িতে কাল রবিবার অতিথিরা আসছেন। কর্ত্রী তাঁর রাঁধুনিকে হুকুম দিয়েছেন আমাকে কেটে সূপ বানিয়ে দিতে। আজ রাতেই তো আমার শেষ। তাই যত পারি চেঁচিয়ে নিচ্ছি।

গাধা বললে—আমাদের সঙ্গে চলে আয় লাল-ঝুঁটি মোরগ, তোর অনেক ভাল হবে। আমরা চলেছি ব্রেমেন-এ। সেখানে এলে তোর কপাল খুলে যাবে। তোর গলাটা ভাল। আমাদের দলে তুই যদি যাস তো জমবে ভাল।

মোরগ রাজি হতে তারা সবাই একসঙ্গে চলল। শহর ছিল অনেক দূরে, তাই একদিনে পৌঁছনো গেল না। সন্ধের সময় তারা পৌঁছল এসে এক বনের মধ্যে। তারা ঠিক করলে সেইখানেই তারা রাতটা কাটিয়ে দেবে। গাধা আর কুকুর একটা বড় গাছের তলায় শুলো। বেড়াল আর মোরগ গিয়ে উঠল গাছের ডালে। গাছের চুড়োয় বিপদের ভয় সবচেয়ে কম বলে মোরগ গিয়ে উঠল সেখানে। ঘুমিয়ে পড়বার আগে মোরগ একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলে। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে বলে উঠল—আরে, কাছেই যে একটা বাড়ি রয়েছে! আলো দেখা যাচ্ছে।

গাধা বললে—বেশ তবে ঐ দিকেই আমরা যাই। এ জায়গাটা ভাল নয়।

কুকুর ভাবলে হয়তো একটুকরো হাড় বা মাংসও পাওয়া যেতে পারে। কাজেই তারা এগিয়ে চলল। যত এগোতে লাগল, আলো ততই উজ্জ্বল হতে থাকল বাড়িটাও হতে লাগল ততই বড়। শেষে তারা অনেক-আলো-জ্বালা এক ডাকাতের আড্ডায় এসে হাজির হল। গাধা ছিল সবচেয়ে ঢ্যাঙা—সে-ই জানলা দিয়ে উঁকি মারল।

মোরগ বললে— কী দেখলে গাধা ভাই?

গাধা বলল—কী দেখলুম? দেখলুম একটা টেবিল পাতা—তার উপর লোভনীয় সব খাদ্যবস্তু আর পানীয় বস্তু। ডাকাতরা চারিপাশে ঘিরে বসে খুব টাঁশাচ্ছে।

মোরগ বললে—ওগুলো আমাদের হলেই সবচেয়ে ভাল হত।

গাধা বললে—ঠিক বলেছিস! যদি একবার ভিতরে ঢুকতে পারতুম!

তারপর জন্তুরা বসল পরামর্শ করতে—কেমন করে ডাকাতদের তাড়ানো যায়। শেষে এক মতলব তাদের মাথায় এল।

গাধা তার সামনের দু-পা জানলার ধারে তুলে দিয়ে আধা-ওঠা ভাবে দাঁড়াবে। কুকুর লাফিয়ে উঠবে গাধার পিঠে। বেড়াল চড়বে কুকুরের উপর আর বেড়ালের মাথার উপর দাঁড়াবে মোরগ। এইভাবে তারা যখন দাঁড়ালো তখন মোরগের এক ইসারায় সবাই একসঙ্গে ডাকতে শুরু করে দিলে। গাধা হোঁকা-হোঁকা করে উঠল, কুকুর ঘেউ-ঘেউ করে আকাশ ফাটালো, বেড়াল তার সঙ্গে জুড়ল মিউ মিউ, আর মোরগ তার কোঁক্কোর কোঁ! তারপরই তারা জানলা ভেঙে খুলে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। আওয়াজ শুনেই তো ডাকাতরা টেবিল ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছিল। তারা ভাবল এ স্বয়ং শয়তান না হয়ে যায় না। ঊর্ধ্বশ্বাসে তারা ছুটে পালালো বনের মধ্যে। তখন জন্তুরা টেবিলের চারদিকে বসে যার যেমন অভিরুচি খেতে শুরু করল। এত খেল যে মনে হল যেন কত সপ্তাহ তারা খেতে পায়নি। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে তারা আলো নিভিয়ে যে যারা মতো শোবার জায়গা দেখে শুয়ে পড়ল।

গাধা শুলো একবোঝা খড়ের উপর; কুকুর শুলো দরজার পিছনে, বেড়াল শুলো উনুনের ধারে গরম ছাইয়ের উপর, আর মোরগ উড়ে গিয়ে বসল ছাদের উপরে।

মাঝরাত পেরিয়ে গেলে ডাকাতরা দূর থেকে দেখল যে আর আলো জ্বলছে না; সব চুপচাপ হয়ে গেছে। তখন ডাকাতের সর্দার বললে—ভূয়ো শব্দে অমন করে আমাদের ভয় পাওয়া উচিত হয়নি। বলে সে একজন ডাকাতকে হুকুম করল বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখে আসতে।

ডাকাতদের চর ভিতরে ঢুকে দেখল, সব নিস্তব্ধ। তখন সে রান্নাঘরে ঢুকল একটা আলো জ্বালতে। বেড়ালের চোখ দুটো অন্ধকারে জ্বলছিল। সে ভাবলে ওটা জ্বলন্ত কয়লা। এই ভেবে তার কাছে একটা দেশলাইয়ের কাঠি ধরতেই বেড়াল চটে উঠে ফ্যাঁস করে লাফিয়ে তার মুখ আঁচড়ে দিল। চর ভীষণ ভয় পেয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে গেল। সেখানে শুয়ে ছিল কুকুর। সে লাফিয়ে উঠে ঘ্যাঁক করে কামড় দিল তার পায়ে। যখন সে বাড়ির সামনে ফেলা খড়ের উপর দিয়ে লাফিয়ে যাবে, গাধা মারল তার পা দিয়ে জোর এক চাঁট। আর এই গোলমালে মোরগ জেগে উঠে ডেকে উঠল—কোঁক্কোর কোঁক্কোর কো!

ডাকাতের চর পড়ি-কি-মরি করে সর্দারের কাছে ছুটে গিয়ে বললে—একটা ভয়ানক ডাইনি ওখানে বাসা বেঁধেছে! আমার মুখের উপর নিশ্বাস ফেলে তার লম্বা লম্বা নখ দিয়ে আঁচড়ে দিল। দরজার পিছনে কে একজন দাঁড়িয়ে ছিল, সে আমায় ছোরা মেরে দিয়েছে। আর উঠোনে ছিল এক দৈত্য, সে তার গদা দিয়ে আমায় পিটিয়েছে। আর, সবচেয়ে ভয়ানক, এক বিচারক ছিল ছাদের উপরে বসে; সে চেঁচিয়ে উঠল—নিয়ে আয় বদমাসটাকে এখানে! শুনে যত জোরে পারি ছুটে আমি পালিয়ে এসেছি কর্তা!

তার পর থেকে ডাকাতরা আর সে বাড়ির দিকে মাড়ালো না। ব্রেমেন-এর চার গাইয়ে বাজিয়ের তাতে সুবিধেই হল। তারা সেখানেই থেকে গেল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন