চরকা-কাটা তিনি বুড়ি

চরকা-কাটা তিন বুড়ি

একটি মেয়ে ছিল, সে ছিল ভারি কুঁড়ে, কোনো কাজে তার মন ছিল না। অন্তত চরকা কাটা— তাও-ও না। তার মা অনেক চেষ্টা করেও মেয়েকে চরকায় বসাতে পারতেন না। শেষে মা একদিন এমন রেগে গেলেন যে আর থাকতে না পেরে মেয়েকে ধরে দিলেন খুব উত্তম মধ্যম। আর যায় কোথা? মেয়েও ডাক ছেড়ে কান্না শুরু করে দিলে। এমনই তার গলার জোর যে সেই সময় রানী যাচ্ছিলেন গাড়ি চেপে তাঁদের বাড়ির পাশ দিয়ে, তিনি শুনে গাড়ি থামালেন।

রানী বাড়ির মধ্যে ঢুকে গিন্নিকে জিজ্ঞেস করলেন— কী করেছে তোমার মেয়ে যে তুমি তাকে এমন করে মেরেছ? রাস্তা থেকে পর্যন্ত তার কান্নার শব্দ পাচ্ছি।

শুনে গিন্নি ভারি অপ্রস্তুত। কিন্তু রানীর কাছে মেয়ের কুঁড়েমির কথা বলতে তাঁর ভারি লজ্জা করতে লাগল। গিন্নি তাই জবাব দিলেন— দেখুন রানীমা, আমার মেয়ে এমন চরকা কাটার ভক্ত যে ওকে চরকার কাছ থেকে ওঠানোই যায় না। আমি গরিব মানুষ, চরকার জন্যে অত শন পাই কোথা থেকে বলুন তো? এই নিয়ে ঝগড়া।

রানী শুনে বললেন— ওঃ, এই কথা? চরকার শব্দের মত আর কোনো শব্দ আমি অত ভালবাসি না। দেখ, তোমাদের মেয়েটিকে আমায় দাও। ওকে আমার প্রাসাদে নিয়ে যাব— সেখানে আমার প্রচুর শন। যত খুশি সুতো কাটতে পারবে তোমার মেয়ে মনের আনন্দে।

গিন্নি শুনে খুব খুশি হলেন। রানী মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেলেন রাজপ্রাসাদে। প্রাসাদে পৌঁছে রানী মেয়েটিকে নিয়ে উঠলেন উপর তলায়। সেখানে তিনখানা ঘর মেঝে থেকে কড়িকাঠ পর্যন্ত চমৎকার শনে ঠাসা।

রানী বললেন— এই সমস্ত শন কেটে শেষ কর। সব শন যখন শেষ হয়ে যাবে তখন আমার ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব। তোমার বাপ-মায়ের অবস্থা গরিব হোক যাই হোক তাতে আমার কিছু এসে যায় না। তোমার এই চরকা কাটার অধ্যবসায়ই হবে তোমার সবচেয়ে বড় যৌতুক।

মেয়েটি কোন কথা বলতে সাহস করল না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বেচারা ভয়ে কাঁপতে লাগল। কারণ সে জানত, সে যদি ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত প্রতিদিন চরকা কাটে তাহলেও ঐ অত শন শেষ করতে তার তিনশো বছরেও কুলোবে না। রানী তাকে ছেড়ে চলে যেতেই সে কাঁদতে আরম্ভ করলে আর ঐভাবে শনের পাহাড়ের সামনে তিন দিন চুপটি করে বসে রইল, একবারও চাকা ঘুরোলো না।

তিন দিন পরে রানী এসে যখন দেখলেন মেয়েটি শন ছোঁয়ই নি, তিনি বেশ অবাক হয়ে গেলেন। মেয়েটি বললে তার বাড়ির জন্যে এত মন কেমন করছিল যে সে কাজ আরম্ভ করতে পারেনি। রানী শুনে আর কিছু বললেন না। শুধু বললেন— কাল থেকে তোমায় কাজ আরম্ভ করতেই হবে।

বেচারা এমন মুশকিলে পড়ল যে ভেবেই পেলে না কী করা যায়! ছটফট করতে করতে সে একবার জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। জানলা দিয়ে দেখতে পেল তিনটি অদ্ভুত চেহারার বুড়ি তার দিকে আসছে। একজনের একটা পা প্রকাণ্ড চওড়া পিঁড়ির মত আর একজনের নিচেকার ঠোঁটটা আধ হাত ঝুলছে আর একজনের মস্ত একখানা বুড়ো আঙুল। তারা জানলার নিচে এসে উপরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস কলে— কী হয়েছে খুকি? কাঁদছ কেন? মেয়েটি তখন তার বিপদের কথা বললে। তারা বললে— বেশ তো, আমরা তোমায় সাহায্য করব। শুধু এই শর্ত যে তোমার বিয়েতে আমাদের নেমন্তন্ন করবে। আমাদের পরিচয় দেবে তোমার মাসতুতো বোন বলে আর তোমার পাশে বসিয়ে আমাদের খাওয়াবে। যদি রাজি হও, সব শন আমরা কেটে সুতো করে দিতে পারি।

মেয়েটি বললে— নিশ্চয় রাজি। এস এখনই কাজ আরম্ভ করে দাও।

মেয়েটি বুড়ি তিনটিকে নিয়ে এল ঘরে। এনে প্রথম ঘরটাতে খানিকটা জায়গা করে দিয়ে তাদের বসিয়ে দিলে। তারা সঙ্গে সঙ্গে চরকা কাটা শুরু করে দিলে। প্রথম বুড়ি সুতো টানতে লাগল আর পা দিয়ে চরকা ঘোরাতে লাগল। দ্বিতীয় বুড়ি ঠোঁট দিয়ে সুতো ভেজাতে লাগল আর তৃতীয় বুড়ি বুড়ো আঙুল দিয়ে সুতোয় পাক দিতে থাকল। দেখতে দেখতে চমৎকার শনের সুতোয় টেকো গেল ভরে।

রানী যখন আসতেন রানীর পায়ের শব্দ পেয়ে মেয়েটি বুড়িদের লুকিয়ে ফেলত আর রানীকে টেকোর পর টেকো ভর্তি সুতো দেখাতো। রানী এত অবাক হয়ে যেতেন যে তাঁর মুখে কথাই জোগাতো না।

প্রথম ঘরের শন শেষ হয়ে যেতেই চরকা-কাটা বুড়িরা দ্বিতীয় ঘরে গিয়ে ঢুকল, তারপর তৃতীয় ঘরে। দেখতে দেখতে সমস্ত শন শেষ হয়ে গেল। তখন বুড়িরা মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। যাবার সময় বললে— মনে থাকে যেন কী অঙ্গীকার করেছ। আমাদের নেমন্তন্ন পাঠাতে ভুলো না। দেখো, তোমারই ভাল হবে।

রানী যেদিন দেখলেন শনের ঘর খালি, তিনি সেদিনই বিয়ের আয়োজন শুরু করে দিলেন। রাজপুত্র যখন দেখলেন এত চালাক আর এমন কাজের মেয়ে তাঁর বৌ হবে, তিনি বৌ-এর প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলেন।

মেয়েটি বললে— আমার তিনটি মাসতুতো দিদি আছে। তাদের কাছে আমি এত উপকার পেয়েছি যে আজকের আমার এই সুখ আর ঐশ্বর্যের দিনে তাদের আমি ভুলতে চাই না। আপনারা তাদের নেমন্তন্ন করবার অনুমতি আমায় দিন। তাদের পাশে বসিয়ে আমি খেতে চাই। রানী আর রাজপুত্র দু-জনেই খুশি হয়ে অনুমতি দিলেন।

ঠিক যখন বিয়ের ভোজ শুরু হচ্ছে সেই সময় ঝলমলে পোশাক পরে তিন বুড়ি এসে ঢুকল। কনে তাদের হাত ধরে ডেকে বললে— এস দিদিরা। কিন্তু বর তাদের চেহারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললেন— এমন বিশ্রী চেহারার দিদি তুমি কোথা থেকে পেলে?

এই বলে রাজপুত্র প্রথম বুড়ির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন— এমন খারাপ চওড়া পা তোমার কেমন করে হল দিদি?

সে বললে— পা দিয়ে চরকার চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে।

তারপর রাজপুত্র দ্বিতীয় বুড়িকে জিজ্ঞেস করলেন, তার ঠোঁট অমন ঝুলে পড়ল কী করে।

সে বললে— সুতো ভিজিয়ে ভিজিয়ে।

তারপর তিনি তৃতীয় বুড়ির কাছে গিয়ে সুধোলেন, তার বুড়ো আঙুল অমন চওড়া হল কী করে?

—সুতো পাকিয়ে পাকিয়ে।

রাজপুত্র শুনে ভয় পেয়ে বললেন— শুনছ গো রাজার বৌ? বেশি চরকা কাটলে তোমারও ঐ চেহারা হবে! আজ থেকে তোমার চরকা কাটা বন্ধ!

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন